একুশ বিজ্ঞানমনস্কতার জন্ম দিয়েছিল, অন্যভাবে বলতে গেলে পূর্ববাংলার বাঙালির বিজ্ঞানমনস্কতা থেকে একুশ অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। একুশ প্রতীক হয়ে উঠেছিল ধর্মের উর্ধ্বে ইহজাগতিক জীবনযাপনের, প্রতিভাস হয়ে উঠেছিল ধর্মীয় পরিচয়ের বাইরের অনবচ্ছিন্ন এক সামাজিকতা ও জাতিগত ঐক্যস্থাপনের । পূর্ববাংলার গ্রামগুলিকে, গ্রামের কৃষক পরিবারগুলিকে একুশ পরিণত করেছিল মধ্যবিত্ত শ্রেণি সৃষ্টির আঁতুরঘরে।
সাতচল্লিশে বাঙালির বিজ্ঞানমনস্কতা পরাজিত হয়েছিল। মধ্যযুগ থেকে অসাম্প্রদায়িকতার চেতনা বিকশিত হতে শুরু করেছিল, ঔপনিবেশিক রাজনীতি সেই বোধকে পরাজিত করেছিল। কিন্তু ভারত বিভক্তির আগেই পাকিস্তান আন্দোলনে অদৃশ্য এক ফাটল দেখা দিয়েছিল রাষ্ট্রভাষাকে নিয়ে এবং ওই ফাটলই হয়ে উঠেছিল বিজ্ঞানমনস্কতা বিকাশের নতুন আধার। একুশের মধ্যে দিয়ে বাঙালির মনোজগতে লুকিয়ে থাকা বিজ্ঞানমনস্কতার উদ্বোধন ঘটে নতুন করে এবং রাজনীতি ও বিজ্ঞানমনস্কতা পরস্পর পরস্পরের হাত ধরতে শেখে। ষাট অতিক্রান্ত একুশে এসে আমাদের চারপাশে সেই বিজ্ঞানমনস্কতা আরও বিস্তৃত হবে- এমনটিই সঙ্গত ছিল। কিন্তু বাস্তবতা হলো বিজ্ঞানমনস্কতা খুব বেশি এগুতে পারেনি বাঙালির সমাজে। আরও কঠিনভাবে বলতে গেলে, বিজ্ঞানমনস্কতার মৃতুøই ঘটেছে। তার বদলে, ইদানিং প্রায়শই মনে হয়, ধর্মান্ধতা এ দেশের নাগরিকদের একটি জেনেটিক উপাদানে পরিণত হয়েছে।
বিজ্ঞানমনস্কতা কেন এগুতে পারল না? মোটা দাগে বলতে গেলে, রাষ্ট্র বিজ্ঞানমনস্কতার প্রসঙ্গকে ধামাচাপা দিতে চাইছে বলে, বিজ্ঞানমনস্কতা প্রচলিত রাজনীতির শত্রু বলে। বাঙালির বিজ্ঞানমনস্কতার মৃতুø ঘটেছিল রাজনীতিকদের উচ্চাভিলাষ থেকে, ভারতীয় মুসলমানদের এক অবিচ্ছিন্ন সংস্ড়্গৃতির কল্পিত রূপরেখা দাঁড় করিয়ে তারা চেষ্টা করেছিলেন সেই উচ্চাভিলাষকে চিরস্থায়ী করতে। মুসলমান শাসকরা একসময় সাফল্য অর্জন করেছিলেন তাদের সামরিক বাহিনীর সংহতির প্রয়োজনে কৃত্রিম এক ভাষা উর্দুর প্রচলন ঘটাতে, পাকিস্তানের প্রভাবশালী প্রদেশ পাঞ্জাবের শিক্ষিত মুসলমানরাও নিজেদের মাতৃভাষার তোয়াক্কা না করে চর্চা করতেন উর্দু ভাষার- অভিজাত, সামন্তীয় ঘর থেকে উঠে আসা পাঞ্জাবকেন্দ্রিক নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণির স্বার্থবাহী মুসলিম রাজনীতিক ও তাদের বৃত্তাবদ্ধ অপরাপর রাজনীতিকরাও একইভাবে চেয়েছিলেন উর্দুকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে অদৃশ্য ও অনুপস্থিত এক সংস্ড়্গৃতির বৃত্তে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীকে আবদ্ধ করতে। এইভাবে রাজনীতিকরা জনগণের জন্যে এক বিভ্রম নিয়ে এসেছিলেন, জনগণকে তারা উদ্বেলিত করেছিলেন এই ধারাভাষ্যে- ধর্মশাসিত রাষ্ট্রই পারে তাদের মুক্তি দিতে, পারে তাদের সংহত রাখতে। মুক্তি না আসুক, মানুষ সংহতি চেয়েছিল এবং স্বাভাবিকও ছিল তাই- দারিদ্র নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করে, অনিশ্চয়তা তৈরি করে এবং সাধারণ মানুষ চায় নৈকট্যের মধ্যে দিয়ে সেই নিরাপত্তাহীনতা ও অনিশ্চয়তাকে দূর করতে, সংহতির মধ্যে দিয়ে সেইসবের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে। কিন্তু কেবল সাধারণ মানুষই তো না, রাজনীতিকরা যে শ্রেণিঅংশের প্রতিভূ ছিলেন, তাদের মধ্যেও ছিল নিরাপত্তাহীনতা আর অনিশ্চয়তা- ছিল অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতায় হেরে যাওয়ার আশঙ্কা। ওই আশঙ্কা থেকে তারা রণকৌশল খুঁজেছিলেন। আর ওই আশঙ্কা থেকে বেরুনোর জন্যে তাদের সবচেয়ে ভালো বিকল্প ছিল ঔপনিবেশিক শাসকদের দেখানো পথ- সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মের রাজনীতি। সাধারণ মানুষের সামনেও এই ফাঁদে পড়ার বিকল্প ছিল না, কেননা তাদের নৈকট্য ও সংহতির সব সম্ভাবনা আটকে পড়েছিল বিচ্ছিন্নতার জালে, দৈবনির্ভরতাই হয়ে উঠেছিল তাদের নৈকট্য ও সংঘবদ্ধ হওয়ার সবচেয়ে বড় অবলম্বন। এইভাবে রাজনীতিকরা দৈবনির্ভর হয়ে পড়েছিলেন, জনগণকে দৈবনির্ভর করে তুলেছিলেন। দৈবনির্ভরতার মধ্যে দিয়ে শ্রেণিআকাঙ্ক্ষা পূরণের রাজনৈতিক রণকৌশল নিয়ে এগিয়েছিলেন রাজনীতিকরা।
কিন্তু বিজ্ঞানমনস্কতা কখনও কখনও পরাজিত হয় বটে, তবু মৃত্যু তার কখনোই ঘটে না। এমনকি অদৃষ্টবাদীদেরও জন্যেও রয়েছে পরিহাসময় এই নিয়তি- তাদেরও প্রয়োজন হয় বিজ্ঞানমনস্কতাকে বাঁচিয়ে রাখার। তাদের প্রতিদিনের জীবনযাপন তাদের জন্যে বিজ্ঞানমনস্কতাকে অনিবার্য করে তোলে। তারা তাকে বৈধ করে চায় ঈশ্বরের দেয়া জীবনবিধি হিশেবে উপস্থাপন করার মধ্যে দিয়ে। মুশকিল হয় ওখানেই- কেননা বিজ্ঞানমনস্কতাকে কোনও ঘেরটোপে বাধা যায় না। নিজেকে অতিক্রম করে চলাই নিয়তি বিজ্ঞানমনস্কতার। তাই অদৃষ্টবাদীদের পক্ষে সম্ভব হয় না একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ের পর বিজ্ঞানমনস্কতা ধরে রাখা। কিন্তু বিবিধ পথে বিজ্ঞানমনস্কতার জাগতিক সুফলগুলি আদায় ও ভোগ করার চেষ্টা চালায় তারা এবং এসব প্রচেষ্টাকেই আবার বর্ণনা করে চলে নিজেদের বিজ্ঞানমনস্কতার নিদর্শন হিসেবে। বিজ্ঞান ও ধর্মে কোনও বিরোধ নেই- এরকম এক প্রকল্প ছাড়া অদৃষ্টবাদীদের পক্ষে বেঁচে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ে এবং তারা তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করে থাকে এই প্রকল্পে। এইভাবে রাষ্ট্র ও সমাজে এমনকি ব্যক্তিজীবনেও বিজ্ঞানমনস্কতার বিভ্রম দেখা দেয়। প্রযুক্তি ও কৃৎকৌশলগত সুবিধাগুলি অর্জন ও প্রয়োগ করার সাফল্য ও প্রচেষ্টাকে বিজ্ঞানমনস্কতার সঙ্গে মিলিয়ে ফেলা হয়।
সাতচল্লিশের বিজ্ঞানমনস্কতার পরাজয় ঘটেছিল, অনিবার্যকারণেই তার মৃত্যু ঘটেনি। আটচল্লিশ থেকেই সে ফের মাথা তুলতে শুরু করেছিল আর বায়ান্নর একুশেতে তার পুনপ্রকাশ ঘটেছিল পুরো পূর্ববাংলাতে। বাঙালি বুঝেছিল, সংহতি প্রতিষ্ঠার কৃত্রিম এক পন্থায় বরং তাদের পিছিয়ে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে। তাদের আরও বড় ধরণের অনৈক্যের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। এই উত্থানপর্বে বাঙালি মুসলমানের মধ্যে অপেক্ষাকৃত অগ্রসর রাজনীতিকরা মননে বিজ্ঞানমনস্ক না হলেও বাধ্য হয়েছিলেন বিজ্ঞানমনস্কতাকে আঁকড়ে ধরতে- কেননা অবিভক্ত ভারতে শ্রেণিগত যে অনিশ্চয়তা তাদের পশ্চাৎপদ সাম্প্রদায়িক রাজনীতির দিকে ঠেলে দিয়েছিল, নতুন পাকিস্তানে সেই রাজনীতির অবিচ্ছিন্ন কাঠামোয় তাদের অবস্থান যে প্রান্তিক, তা তারা উপলব্ধি করতে শুরু করেছিলেন। এই শ্রেণিস্বার্থ তাদের উদ্বুদ্ধ করেছিল একুশের স্রোতলগ্ন হতে, বিজ্ঞানমনস্কতার উদ্বোধনে একত্র হতে। একুশের মধ্যে দিয়ে রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে কেবল সদ্য বিকাশমান শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণিটিই নয়, উঠে এসেছিল পূর্ববাংলার কৃষক সমাজ। এই কৃষক সমাজই হয়ে উঠেছিল মধ্যবিত্তকেন্দ্রিক নতুন রাজনৈতিক শক্তির নতুন আতুরঘর।
এমনকি স্বাধীন বাংলাদেশে, বুর্জোয়া দল হওয়া সত্ত্বেও, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে যে রাজনৈতিক দূরত্ব রয়েছে, তার উৎসও একদিক দিয়ে দেখতে গেলে ভাষা আন্দোলনকালীন ওই রাজনৈতিক মেরুকরণ। রাজনীতির প্রতিষ্ঠিত ধারাটির নেতৃত্ব দিচ্ছিল অভিজাত সামন্ততান্তিক বিভিন্ন পরিবার থেকে অংশগ্রহণকারী রাজনীতিকরা, মুসলিম লীগের রাজনৈতিক স্রোতধারা ছিল তাদের নিয়ন্তণে। কিন্তু একুশকে যারা সৃষ্টি করলেন, একুশের মধ্যে দিয়ে যে নেতৃত্ব গড়ে উঠল, যে রাজনৈতিক সংগঠকরা বিকশিত হতে শুরু করলেন তারা মূলত কৃষক পরিবারের সন্তান- তাদের মধ্যেও সামন্তবাদী চিন্তাচেতনা ছিল বটে, সামন্তীয় সংস্কৃতি তাদেরও আচ্ছন্ন করে রেখেছিল বটে, কিন্তু তারা সামন্ততন্ত্রের নিয়ন্তক ছিলেন না, তাদের জীবনযাপন সামন্তের ছিল না। বাঙালি মধ্যবিত্ত কালক্রমে অর্থনৈতিকভাবে বুর্জোয়া হয়েছে, কিন্তু অভিজাত সামন্ততন্ত প্রথানুগতভাবে যে বুর্জোয়া তৈরি করেছে, অন্যদিকে একুশের মধ্যে দিয়ে বিকশিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি যে বুর্জোয়া তৈরি করেছে, প্রাত্যহিক অর্থনৈতিক সংগ্রামের ধরণ, জীবনযাপন ও সংস্কৃতি তাদের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলকে পৃথক করে তুলেছে। এই বৈভিন্নতার অনুশীলন বিভিন্নভাবে হয়েছে, বিভিন্নভাবে তা শক্তি সঞ্চয় করেছে এবং রাজনৈতিক প্রবহমানতা বজায় রেখেছে। কালক্রমে কি আওয়ামী লীগ কি বিএনপি উভয়েই বুর্জোয়া রাজনীতির প্রতিনিধিত্বকারী হয়ে উঠেছে বটে, কিন্তু এই পার্থক্য ও দূরত্ব আর ঘোচেনি। তাই ‘বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থেও দু’ দল এক হতে পারছে না’ বলে এ দেশের সিভিল বা সুশীল সমাজ যত আর্তনাদই করুক না কেন, রাজনৈতিক ওই দূরত্ব কখনোই দূর হবার নয়। অন্যদিকে, এ ধরণের দূরত্ব ও পার্থক্যগুলি চিহ্নিত করে ও কাজে লাগিয়ে এগিয়ে যাবার জন্যে লেনিন তার রাজনৈতিক সাহিত্যে বার বার পরামর্শ দিলেও বাংলাদেশের বামপন্থী তাত্ত্বিকরা তাদের সর্বপ্রতিভা নিয়োগ করেছেন এ দুটি দলের অভিন্নতাগুলি প্রমাণের কাজে, নাম ছাড়া এ দুটি দলের মধ্যে-যে কোনও তফাৎ নেই তা প্রমাণের কাজে। বাস্তবতা হলো, এ দেশে মেহনতি মানুষের মুক্তির অভিন্ন শ্রেণিস্বার্থের কথা বললেও বামপন্থীরা বেশিক্ষণ যেমন এক মঞ্চে থাকতে পারেন না, অভিন্ন কিছু শ্রেণিস্বার্থ থাকলেও ঠিক তেমনি আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পক্ষে এমনকি গুরুত্বপূর্ণ কোনও কোনও রাষ্ট্র্রীয় নীতিতে এক হওয়া সম্ভব নয়।
ইউরোপের মতো ভারতীয় মুসলিম রাজনীতিকদের সামনে পুঁজির অবাধ প্রতিযোগিতার স্বপ্ন ছিল না, বরং ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত না হওয়ার কারণে ঔপনিবেশিক শাসনকাঠামোর সর্বক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ার ভূত তাকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। সে তাই তার প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রকে চেয়েছে সীমিত করতে, সীমিত রাখতে। অনিবার্য কারণেই তাকে যেতে হয়েছে ধর্মজাত রাজনীতির কাছে, ধর্মজাত রাজনীতি এরকম রাজনীতিকদের জন্যে নিরাপত্তার বলয় তৈরি করেছে। রাজনীতিকরাই তাই সাধারণ জনগণকে উৎসাহিত করেছেন, সেই রাজনৈতিক বাতাবরণ সৃষ্টি করেছেন, যাতে উপমহাদেশের মুসলমানরা ভাবতে বাধ্য হন শ্রেণিগত কারণে নয়, বরং ধর্মের কারণেই তারা বঞ্চিত হচ্ছেন, অশিক্ষিত থাকছেন, দরিদ্র থাকছেন। ইংরেজরা তাদের ঔপনিবেশিক শাসনের প্রয়োজনে অনেক আগে থেকেই হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে বিভেদ তৈরি করে রেখেছিল- রাজনীতিকরা সেই বিরোধকেই দিনের পর দিন, বছরের পর বছর ধরে সযত্নে লালন করেছেন, বাড়তে দিয়েছেন এবং সাধারণ মানুষকে এই ধারণায় উদ্বুদ্ধ করেছেন করেছেন যে একমাত্র ধর্মশাসিত রাষ্ট্রই পারে তাদের মুক্তি দিতে, সংহতি দিতে। এমনকি এসবেরও অনেক আগে, ১৮৫৭ সালে যে মহাবিদ্রোহ সংগঠিত হয়েছিল, তাতেও আসলে কাজে লাগানো হয়েছিল সাধারণ জনগণের অবচেতন সাম্প্রদায়িকতাকে। গরু আর শুয়োরের চর্বি দিয়ে বন্দুকের টোটা তৈরি করা হয়েছে- সিপাহীদের বিদ্রোহী করে তোলা হয়েছিল এরকম প্রচারণার মধ্যে দিয়ে।
একুশ বাঙালিকে মুক্ত করেছিল এরকম সব পশ্চাৎপদ ধারণা থেকে, বিজ্ঞানমনস্কতার বিকাশ ঘটিয়েছিল বাঙালির মধ্যে, বাঙালি তার ভাষা-সংস্কৃতি-ইতিহাসের আলোয় জেগে উঠেছিল এবং অপরাপর পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীগুলিকেও আলোড়িত করেছিল। স্বৈরাচার থেকে মুক্তির এবং গণতন্ত প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা জন্ম নিয়েছিল এ অঞ্চলের মানুষের মনে। অনিবার্য হয়ে উঠেছিল স্বাধীন বাংলাদেশ। শুধু বাংলাদেশ নয়, আরও অনেক রাষ্ট্রের উদাহরণ টেনেও দেখানো সম্ভব, ধর্মীয় সংহতির বোধ নয়, বরং অন্যান্য সব সংহতির বোধ থেকেই সেসব রাষ্ট্র পাচ্ছে জীবনশক্তি। অথচ সংহতির সেইসব বোধ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল এ অঞ্চলের মানুষদের। এমনকি যে-পাকিস্তান ধর্মীয় সংহতির দোহাই দিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করেছিল, সে-পাকিস্তানকেও এখন পর্যন্ত এক করে রেখেছে মূলত রাষ্ট্রের শক্তি, রাষ্ট্রের অতি-রাষ্ট্র হয়ে ওঠার শক্তি। অন্যদিকে, একুশের বিজ্ঞানমনস্কতার পথ ধরে ১৯৭১ বাংলাদেশের ধর্মজ শক্তিকে পরাজিত করেছে। এই পরাজয় রাষ্ট্রের শক্তি সম্পর্কে এখানকার মৌলবাদীদের সচেতন করে তুলেছে। মৌলবাদীরাও চাইছে যে কোনও উপায়ে হয় রাষ্ট্রশক্তির দখল নিতে না হয় রাষ্ট্রশক্তির কাছাকাছি থাকতে। অন্যদিকে, পাকিস্তান রাষ্ট্রের কাঠামোর মধ্যে অবাঙালি মুসলমানের সঙ্গে অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতায় যে বাঙালি মুসলমান বাধ্য হয়েছিলেন একুশের বিজ্ঞানমনস্কতার ছায়ায় দাঁড়াতে, সে এখন আবার অনুকুল আবহাওয়ায় সরে দাঁড়াচ্ছে বিজ্ঞানমনস্কতার ছায়া থেকে। এখন তার সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী, সবচেয়ে বড় শত্রু বিজ্ঞানমনস্কতা। সে এখন হয়তো বিপরীত ধারার কোনও রাজনৈতিক দলে অবস্থান করছে বটে, কিন্তু তার সমস্ত কার্যক্রমই পক্ষে দাঁড়াচ্ছে মৌলবাদের। বিজ্ঞানমনস্কতার এই পরিণতি মৌলবাদকে টিকিয়ে রাখছে, নতুন নতুন সামাজিক পরিসর তৈরির সুযোগ করে দিচ্ছে। জামায়াতে ইসলামীর নেতা মওদুদী ভারতবিভক্তির আগে একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন হিন্দুস্তানের, পাকিস্তান আন্দোলনের তিনি বিরোধিতা করেছিলেন। জামায়াতে ইসলামীর আরেক নেতা গোলাম আযম পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার করার জন্যে বিলেতে হিযরত করেছিলেন। কিন্তু এখন জামায়াতে ইসলামীর নেতা থেকে শুরু করে সাধারণ কোনও কর্মীও আর এক হিন্দুস্তানের কথা দূরে থাক, এক পাকিস্তানের কথাও চিন্তা করেন না। তারা চায় ছোট ছোট পাকিস্তান গড়তে- তারা চায় বাংলাদেশকে পাকিস্তান আদলের এক রাষ্ট্রে পরিণত করতে।
তাদের ওই আকাঙ্ক্ষার পথের সবচেয়ে বড় বাধা বিজ্ঞানমনস্কতা। কিন্তু বিজ্ঞানমনস্কতার পথের বাধা কেবল মৌলবাদই নয়, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে বুর্জোয়া সংস্কৃতিও। পুঁজিতন্তও শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয় দারিদ্র থেকে বেরিয়ে আসতে, ব্যর্থ হয় মানুষের গণতন্তমনস্কতা মেনে নিতে এবং স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে, একটি নির্দিষ্ট বৃত্তেই বার বার ঘোরাফেরা করতে থাকে সে- এরকম অবস্থায় দারিদ্রপীড়িত মানুষকে পোষ মানানোর জন্যে পারলৌকিকতার সংস্কৃতিই সবচেয়ে বড় অবলম্বন এখনকার বুর্জোয়াদের। তাই পুঁজিতান্তিক শাসকরাও এখন বাঁচিয়ে রাখতে চায় পারলৌকিকতাকে, তারাই নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে বিজ্ঞানমনস্কতা সৃষ্টির পথে- পুঁজিতন্তের মোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্কুলেও তাই ডারউইনের বিবর্তনবাদ পড়াতে গিয়ে হয়রানির শিকার হতে হয় জীববিজ্ঞানের শিক্ষকদের। বাংলাদেশের অবস্থা যে আরও খারাপ তা লেখাই বাহুল্য। একুশ বিজ্ঞানমনস্কতার উদ্বোধন ঘটিয়েছিল, কিন্তু এখনও তার প্রতিপদে নানা বাধা। আমাদের রাষ্ট্রপক্ষ বিজ্ঞানমনস্কতার অনুকুলে নয়, রাজনীতিকরা বুঝেসুঝে চলেন, এর বাইরে বিজ্ঞানমনস্ক যারা আছেন, তাদের তা হলে ছায়া দেবে কে? তাই খুবই স্বাভাবিক যে প্রতি বছর অসংখ্য বই বের হবে একুশের গ্রন্থমেলা থেকে, কিন্তু তার মধ্যে এমন বই থাকবে না, যেটি বিজ্ঞানমনস্ক দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম দেবে। প্রতি বছর বিজ্ঞান নিয়ে অসংখ্য বই বের হয় বটে, শিশুকিশোরদের অনুশীলনউপযোগী বিজ্ঞান বই বের হয় বটে, কিন্তু বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ সৃষ্টির বই চোখে পড়ে না। বিজ্ঞানমনস্কতার অভাব আমাদের মধ্যে এত বেশি যে, আমাদের কাছে সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তি বলে হয় একজন জাকির নায়েককে! রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘যুক্তি পেয়েছি বলে বিশ্বাস করি, সেটা অল্পক্ষেত্রেই, বিশ্বাস করি বলেই যুক্তি আনি, সেইটেই অনেক ক্ষেত্রে। একমাত্র বৈজ্ঞানিক মতই খাঁটি প্রমাণের পথ দিয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছয়; অন্য জাতের মতগুলো বারো আনাই রাগ-বিরাগের আকর্ষণে ব্যক্তিগত ইচ্ছার কেন্দ্রকে প্রদক্ষিণ করতে থাকে।’’ জাকির নায়েক এখন হয়ে উঠেছে বিশ্বের ধর্মান্ধ মুসলমানদের সেই নায়ক, যিনি অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সঙ্গে তাদের বিশ্বাসের অনুকুলে যুক্তির যোগান দিতে পারেন, যুক্তির ফাঁকিগুলি লুকিয়ে রেখে কথার তোড়ে বিজ্ঞানমনস্কতার বিভ্রম তৈরি করতে পারেন এবং শ্রোতার ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষা ও বিশ্বাসের রসদ যোগাতে পারেন।
অন্ধবিশ্বাসের এই প্রবণতা আমাদের কোনওভাবেই মুক্ত করতে পারে না- বড় জোর পারে ইহজাগতিক সমস্যাগুলি থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখার আত্মপ্রসাদ দিতে। কিন্তু সেই আত্মপ্রসাদও প্রকৃতপক্ষে আমাদের গোপনে গোপনে ক্ষতবিক্ষত ও রক্তাক্ত করে, আমাদের সমাজবিমুখ করে, আমাদের অবদমন করতে শেখায় এবং আমরা প্রকৃতপক্ষে বেঁচে থাকি অবদমনের বিকৃতি নিয়ে। বাংলাদেশে এখন চলছে সেই অবদমনের বিকৃতিকাল- আমরা সরে এসেছি, সরে চলে যাচ্ছি একুশের বিজ্ঞানমনস্কতা থেকে।
একুশ ও আমাদের বিজ্ঞানমনস্কতা
...এমনকি স্বাধীন বাংলাদেশে, বুর্জোয়া দল হওয়া সত্ত্বেও, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে যে রাজনৈতিক দূরত্ব রয়েছে, তার উৎসও একদিক দিয়ে দেখতে গেলে ভাষা আন্দোলনকালীন ওই রাজনৈতিক মেরুকরণ। রাজনীতির প্রতিষ্ঠিত ধারাটির নেতৃত্ব দিচ্ছিল অভিজাত সামন্ততান্তিক বিভিন্ন পরিবার থেকে অংশগ্রহণকারী রাজনীতিকরা, মুসলিম লীগের রাজনৈতিক স্রোতধারা ছিল তাদের নিয়ন্তণে। কিন্তু একুশকে যারা সৃষ্টি করলেন, একুশের মধ্যে দিয়ে যে নেতৃত্ব গড়ে উঠল, যে রাজনৈতিক সংগঠকরা বিকশিত হতে শুরু করলেন তারা মূলত কৃষক পরিবারের সন্তান- তাদের মধ্যেও সামন্তবাদী চিন্তাচেতনা ছিল বটে, সামন্তীয় সংস্কৃতি তাদেরও আচ্ছন্ন করে রেখেছিল বটে, কিন্তু তারা সামন্ততন্ত্রের নিয়ন্তক ছিলেন না, তাদের জীবনযাপন সামন্তের ছিল না।...