কৈশোরে মাচ্চু পিচ্চু শিহরিত করে আমাদের। এক অচেনা, দুর্ভেদ্য, গা ছমছম করা অরণ্যের গাছগাছালি, লতাপাতাকাটা আর হিংস্র কিংবা অহিংস্র ভীতিজাগানিয়া সব প্রাণীদের মধ্যে দিয়ে পায়ে চলার পথ বানাতে শেখায়। আর তারুণ্যে প্রেরণা দেয় যুদ্ধে যাওয়ার, শীতল নল মেলে ধরা শোষকশাসকের রক্তনেশা জাগা চোখের দিকে অনত চোখে তাকিয়ে থাকার। ঋজু শরীরের কবিতায় ভর করে আমাদের তন্ত্রীতে ভর করে সে। আমরা অপলক হই। আবিষ্ট হই সভ্যতার প্রাচীন ইতিহাস ও স্তব্ধতার অনন্ত গহ্বরে।
নেরুদা এই খুন হয়ে যাওয়া সভ্যতার সঙ্গে, মানুষদের সঙ্গে আর কোনওক্রমে স্মারক হয়ে টিকে থাকা শহরটির অবয়বের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিতে থাকেন :
ধাপে ধাপে উঠে যাওয়া পাথরের ঢ্যাঙা শহর,
সবশেষে, মাটি তার রাতের জামার মধ্যে লুকিয়ে রাখে নি
তার মোকাম।
অনুবাদ : সুভাষ মুখোপাধ্যায়
তারুণ্যে এইভাবে মাচ্চুপিচ্চু সঙ্গী হয় আমাদের, যেমন সঙ্গী হয়েছিল সে চে গেভারার।
জীবনের এক পর্বে থাকে রহস্যের ঘ্রাণ পাওয়ার বয়স, ভয়ের মধ্যে থেকে হৃৎস্পন্দন তুলে হাতের তালুতে রেখে চেয়ে চেয়ে দেখার বয়স। তখন প্রতিদিন যুদ্ধযাত্রা হয়, প্রতিদিন সমাজ বদলের তরঙ্গে দুলে ওঠে প্রতিটি মানুষ। সত্তরের দশকের শুরুতে ভয়াল নামে একটি সিরিজ বের হতো সেবা প্রকাশনী থেকে। ভয়াল এই রহস্য সিরিজটি লিখতেন সাগর চৌধুরী। অনেক পরে জানতে পারি, তাঁর আসল নাম নাকি শাহাদাত চৌধুরী, যিনি মুক্তিযোদ্ধা একাত্তরের, যিনি কিংবদন্তিতুল্য সম্পাদক-সাংবাদিক হয়ে ওঠেন সাপ্তাহিক বিচিত্রা সম্পাদনা করার মধ্যে দিয়ে। ভয়াল সিরিজের একেকটি বইয়ে থাকত একেকটি রহস্যাবৃত সভ্যতা ও নগরের পটভূমিতে প্রকৃতির কাছ থেকে শিক্ষা নেয়া আদিবাসী মানুষদের কাছে আধুনিক মানুষের বিস্ময়কর অসহায়তার কাহিনী। লুপ্ত সভ্যতা ও নগরের প্রকৃতিলগ্ন শক্তিমত্তাকে আধুনিক যন্ত্রলগ্ন বুদ্ধিমত্তা দিয়ে পুনরাবিষ্কার করত কাহিনীর অসহায় অভিযাত্রী।
ওই ভয়াল সিরিজে আমরা পাই পেরুর ইনকা সভ্যতাকে, যা আমাদের স্কুলের বইয়ে ছিল না, গ্রামাঞ্চলের ভাণ্ডারে ছিল না। স্কুলের বইয়ে ছিল বড় জোর মহেঞ্চোদারো, বড় জোর সিন্ধু, বড় জোর মিশরের পিরামিড-স্ফিংক্স্। কিন্তু সেইসব সভ্যতায় যত না ছিল রহস্য, তারও বেশি ছিল দম্ভ। প্রাচীনতার দম্ভ সঞ্চারিত করে আমাদের আসলে পশ্চাৎপদতার দম্ভে আটকে পড়ার মতো পাঠজ্ঞানে দণ্ডিত করতেন প্রিয় শিক্ষকগণ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা করতেন না-বুঝে, মহৎ কোনও দায়িত্ব পালন করার মোহ থেকে। বংশের আভিজাত্যে মোহাবিষ্ট ও অত্যাচারিত ছিলেন তারা, সমাজপতিদের আভিজাত্যের কাছে প্রতিনিয়ত মাথা নত করতে হতো তাদের। অতএব একটি আলাদা সামাজিক অবস্থানের দম্ভ ও আভিজাত্য তৈরি করার চেষ্টা চালাতেন তারা প্রাচীন সভ্যতা ও ইতিহাসগুলো, ইংরেজির ব্যাকরণগুলো, আওরঙ্গজেবের মতো শিক্ষকসমীহাগুলো নিজেদের করতলগত করার মধ্যে দিয়ে, প্রচার করার মধ্যে দিয়ে।
কিন্তু সেই সভ্যতার তালিকায়, প্রাচীন ইতিহাসের তালিকায় ইনকাদের নাম ছিল না, মাচ্চু পিচ্চুর নাম ছিল না। সাগর চৌধুরী আমাদের ইনকা সভ্যতা, মায়া সভ্যতা, রেড ইন্ডিয়ান, হিরাম বিংহাম এইসব শব্দের, শব্দের মতো সত্যের খুব কাছে নিয়ে গিয়ে হাতের তালুতে নিজের হৃৎপিণ্ড তুলে ধরে চোখ মেলে তাকানোর সাহস যুগিয়েছিলেন।
অনেকদিন পর এ বছর আলোচনার পাদপ্রদীপে উঠে এসেছে আবার রহস্যাবৃত নগর মাচ্চু পিচ্চু। গত নয় আগস্ট ২০০৭, বৃহষ্পতিবারে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় শেষ পর্যন্ত ঘোষণা দিয়েছে যে মাচ্চু পিচ্চু থেকে নিয়ে যাওয়া প্রত্ননিদর্শনগুলোর একটি সম্পূর্ণ তালিকা দেবে তারা পেরুর কাছে। পেরু আর যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এখন চোরাচালানবিরোধী চুক্তি হয়েছে। এর সুফল হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে প্রাক-কলম্বিয় যুগের ৩৫০টি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ফেরৎ পেয়েছে পেরু। পাচার হয়ে যাওয়া এসব প্রত্নতত্ত্ব উদ্ধার করা হয় যুক্তরাষ্ট্রের মিয়ামী থেকে। আর সেগুলো ফেরৎ দেয়ার জন্যে আগস্টে পেরুর লিমাতে গিয়েছিলেন ইউএস আন্ডার সেক্রেটারি অফ স্টেট ফর পাবলিক ডিপ্লোম্যাসি কারেন হিউজেস। তার কাছে পেরুর ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব কালচার-এর প্রধান সেসিলিয়া বাকুলা বলেন, ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় শেষ পর্যন্ত রাজি হয়েছে একটি সম্পূর্ণ তালিকা দিতে। এই তালিকা ধরে এখন পেরু ও ইয়েল নিজেদের মধ্যে কথা বলে ঠিক করবে প্রাচীন ইনকা সিটাডেল মাচ্চু পিচ্চুর চার হাজারের বেশি মৃৎশিল্পপাত্র, অলংকার আর হাড়ের মালিক কারা হবে।
এইসব প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোই দৃশ্যত ধরে রেখেছে একটি সভ্যতা ও প্রাচীন নগর বিলুপ্ত হওয়ার পরও কেবল মানুষের মুখে মুখে ভর করে টিকে থাকার দারুণ এক ইতিহাস। ধরে রেখেছে মারণাস্ত্রনির্ভর সভ্যতার মুখে অসহায় স্থানিক মানুষদের নিজেদের চারপাশে দুর্ভেদ্যতার এক আবরণ গড়ে তোলার ইতিহাস। আরও ধরে রেখেছে সবশেষে পুনরাবিষ্কারের নামে একটি সভ্যতার ও প্রাচীন নগরের বিভিন্ন নিদর্শনগুলি লুণ্ঠন করে তাকে স্রেফ পর্যটন ও প্রত্নতাত্ত্বিক দৃশ্যপটের মর্যাদায় সমাহিত করবার ইতিহাস।
পুনরাবিষ্কারের নামে ইতিহাস লুণ্ঠনের এই নেতা হিরাম বিংহাম, যিনি ছিলেন ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসঅনুরাগী এক শিক্ষক। মাত্র ১৮ মাস গবেষণার কাজে ব্যবহারের নামে তিনি ইয়েলে নিয়ে যান পেরুর মাচ্চু পিচ্চুর চার হাজারের বেশি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। এতদিনে, প্রায় এক শতাব্দী বছরের মুখে এসে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় বলছে, পেরুকে তারা নিদর্শনগুলির একটি পরিপূর্ণ তালিকা দেবে, যাতে উভয় পক্ষ মিলে আলোচনা করা যায়।
তামাশা, ফাজলামি, বাদরামি নয়,- এ হলো নির্জলা শয়তানি।
ঘটনার শুরু মধ্যযুগে।
প্রাক-কলম্বিয় যুগে পেরুর উরুবাম্বা উপত্যকার রিজ পাহাড়ের ওপর গড়ে ওঠে এক সমৃদ্ধ ইনকা সিটাডেল মাচ্চু পিচ্চু। কুয়েচুয়া ভাষায় মাচ্চু পিচ্চুর অর্থ হলো প্রাচীন শিখর বা বুড়ো চূড়া। ইনকাদের রাজধানী ছিল কিউসকোতে। পেরুর দক্ষিণপূর্ব কিউসকো শহরটির অবস্থানও ছিল উরুবাম্বার পাদদেশে, মাচ্চু পিচ্চুর শিখর থেকে মাত্র ৭০ মাইল দূরে। সমৃদ্ধ বসতি, ইনকার সিটাডেলের অবস্থান ছিল কিউসকো থেকে আরও কাছে, ৫০ মাইল দূরে। সিটাডেল মাচ্চু পিচ্চু গড়ে ওঠে ১৪৫০ সালের দিকে। কিন্তু মাত্র একশ বছরের মাথায় স্পেনিয় দখলদাররা সেখানে হামলা চালায়। স্পেনিয় দখলদাররা কিউসকো দখল করে নেয়, কেবল কিউসকো নয়, ইনকাদের সব শহরই তারা ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে। কিন্তু অলৌকিকভাবে সিটাডেল-এর অস্তিত্ব গোপন রয়ে যায়, এটি অক্ষত রয়ে যায় এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এর চারপাশে কেবলই অরণ্য বাড়তে থাকে। অরণ্যের পর অরণ্য এক সময় মাচ্চু পিচ্চুকে ঢেকে ফেলে, মাচ্চু পিচ্চুর চারপাশে অরণ্যের প্রাচীর তৈরি হয়, নিরাপদ এক অরণ্যবেষ্টনি গড়ে ওঠে সিটাডেলকে ঘিরে।
ইনকা সভ্যতা গড়ে উঠেছিল এবং বিস্তৃত হয়েছিল সমৃদ্ধ এক যোগাযোগ ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে। প্রাক-কলম্বিয় যুগে দক্ষিণ আমেরিকার ইনকার এই সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থাকে বলা হয় এল কমিনো ইনকা। মাচ্চু পিচ্চু ইনকাদের রাজধানী কিউসকোর সঙ্গে সংযুক্ত হয় এ যোগাযোগ ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে। দখলদাররা হামলা চালালে ইনকারা প্রতিরোধ গড়ে তোলে, কিন্তু বার বার স্পেনিয়দের আগ্রাসনের মুখে পরাজিত হতে থাকে। এ রকম পরিস্থিতিতে বিদ্রোহী ইনকা দ্বিতীয় মানকো কেপেক পালিয়ে যান গভীর জঙ্গলের ভেতর। সেখানে তিনি গড়ে তোলেন ভিকলাবাম্বা নামের গুপ্ত বসতি। ১৫৭২ সালে ইনকাদের সর্বশেষ বিদ্রোহী নেতা টুপাক টামারু স্পেনিয়দের হাতে ধরা পড়ে এবং ইতিহাসের আড়ালে ঢাকা পড়ে যায় ইনকা সভ্যতার সর্বশেষ দ্রষ্টব্য, ঢাকা পড়ে যায় মাচ্চু পিচ্চুকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা সভ্যতানগর।
কিন্তু মানুষের মুখে মুখে কিংবদন্তির মতো বেঁচেছিল মাচ্চু পিচ্চু। আর এই কিংবদন্তি হাতছানি দিয়ে ডাকত সবাইকে মাচ্চু পিচ্চুর দিকে। যেমন সোনার জন্যে মানুষ হন্যে হয়ে পাড়ি দেয় মরুভূমির পর মরুভূমি, প্রান্তরের পর প্রান্তর, তেমনি এই কিংবদন্তির ওপর ভর করে পেরুতে আসেন ইয়েলো বিশ্ববিদ্যালয়ের হিরাম বিংহাম। তারপর বিখ্যাত হন দ্য লস্ট সিটি অব ইনকা নামের বইটি লিখে।
বিখ্যাত, মেধাবী কিন্তু অকৃতজ্ঞ একজন ব্যক্তি অধ্যাপক হিরাম বিংহাম। বিখ্যাত, কেননা সভ্যতার ইতিহাসের যে কোনও ছাত্র চেনে তাকে। মেধাবী, কেননা ইয়েল ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতার সময়ে তিনি মাচ্চু পিচ্চুর ইতিহাসকে এক যথোপযুক্ত গবেষণা পদ্ধতির মাধ্যমে পৃথিবীর আলোর মুখ দেখান। কিন্তু অকৃতজ্ঞ, কেননা এই পুনরাবিষ্কারের কৃতিত্ব তো বটেই, পুনরাবিষ্কৃত নিদর্শনগুলিও তিনি মোটামুটি লোপাট করার প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। তাতে তাৎক্ষণিকভাবে সফলও হয়েছিলেন এবং প্রত্নতাত্বিক নিদর্শনগুলো মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। হিরাম বিংহাম-এর লেখা থেকে মনে হয় কেবল গুজব আর গুঞ্জনের ওপর নির্ভর করে তিনি ক্রমাগত এগিয়ে গেছেন এবং শেষ পর্যন্ত মাচ্চু পিচ্চু খুঁজে পেয়েছেন। স্থানীয় অধিবাসী, যারা মাচ্চু পিচ্চুর অস্তিত্ব খুব ভালোভাবেই জানত শ শ বছর ধরে এবং এক পর্যায়ে তাঁকে বিশ্বাস করে, বিশ্বস্ত মনে করে মাচ্চু পিচ্চুতে নিয়ে গিয়েছিল, তাঁদের তিনি সতর্কতার সঙ্গে আড়ালেই রেখে দিয়েছেন। মাচ্চু পিচ্চুর আবিষ্কার তাই কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের মতোই।
মজার ব্যাপার, হিরাম বিংহাম মাচ্চু পিচ্চুর অনুসন্ধানে যান নি। তিনি আসলে খোঁজ করছিলেন প্রাচীন ভিকটোস সিটির ভৌগলিক অস্তিত্ব। যেমন ক্রিস্টোফার কলম্বাস আমেরিকার খোঁজে নয়, বেরিয়েছিলেন ইন্ডিয়ার খোঁজে। এই ভিকটোস সিটি ছিল স্পেনিয় দখলদারদের আক্রমণের মুখে ছত্রভঙ্গ উদ্বাস্তুদের শেষ আশ্রয়স্থল, শেষ প্রতিরোধস্থল। ইনকা সাম্রাজ্যের মূল ভাষা ছিল কুয়েচুয়া। দক্ষিণ এশিয়ার নেটিভ আমেরিকান এই ভাষায় মোটামুটিভাবে আমেরিকার সব আদিবাসীই কথা বলে। এখনও এ ভাষায় কথা বলে আন্দেজ অঞ্চলের তথা পেরু, দক্ষিণ-পশ্চিম বলিভিয়া, দক্ষিণ কলম্বিয়া এবং ইকুয়েডর, উত্তর-পশ্চিম আর্জেন্টিনা ও উত্তর চিলির ১০ মিলিয়ন (এক কোটি) মানুষ। কুয়েচুয়া ভাষাভাষী এই মানুষদের বলা হয় কুয়েচুয়ানস। প্রাচীন ভিকটোস সিটির সন্ধানে বিভিন্ন এলাকায় ঘুরতে ঘুরতে, বিভিন্ন সূত্র যুক্ত করতে করতে ১৯১১ সালের দিকে একসময় হিরাম বিংহাম যাত্রা করেন এই কুয়েচুয়ানসদের সিটাডেলের দিকে। সিটাডেলে গিয়ে তিনি দেখেন কুয়েচুয়াসরা বসবাস করে ইনকাদের আদি অবকাঠামো মাচ্চু পিচ্চুতে। ১৯১১ সালের ১২ জুলাই হিরাম বিংহাম মাচ্চু পিচ্চুতে গিয়ে পৌঁছান।
মাচ্চু পিচ্চু প্রচণ্ড আলোড়ন তোলে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটি তাদের ১৯১৩ সালের এপ্রিল সংখ্যা প্রকাশনার পুরোটিই প্রকাশ করে মাচ্চু পিচ্চুকেন্দ্রিক তথ্য, লেখা ও ছবি দিয়ে। ১৯১১ সালের পর একবার নন, হিরাম বিংহাম বার বার যান মাচ্চু পিচ্চুতে, সর্বশেষ যান ১৯১৫তে। পেরুর সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন তিনি। তাই পেরুর যে কোনও স্থানে চলে যেতে বা তথ্যানুসন্ধানে কোনও অসুবিধা হয় নি তাঁর। শুধু তাই নয়, নির্বিঘ্নে খননকাজ পরিচালনা করেন তিনি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে। তারপর নির্বিঘ্নে অসংখ্য, চার হাজার থেকে প্রায় পাঁচ হাজারের মতো প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন নিয়ে আসেন। সেগুলো দিয়ে গড়ে তোলেন ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতাত্ত্বিক ভাণ্ডার।
হিরাম বিংহাম মাচ্চু পিচ্চুকে তথা ইনকা সভ্যতাকে পশ্চিমা জগতের চোখের সামনে দ্রষ্টব্য করে তোলেন। পশ্চিমা জগত আনন্দিত হয়, প্রাচীন সভ্যতার অন্তত একটি নির্দশন তাঁদের ভৌগলিক পরিসরে আছে দেখে। কিন্তু মাচ্চু পিচ্চুর ইতিহাস ক্রমউদ্ঘাটনের মধ্যে দিয়ে দেখা যাচ্ছে হিরাম বিংহাম মাচ্চু পিচ্চুতে পৌঁছানোর খুবই ছোট একটি পদক্ষেপমাত্র। মাচ্চু পিচ্চুর শরীর থেকে এখনও দূর হয় নি রহস্যের আলোকআভা। যে রহস্যময় শক্তি দিয়ে সে পঞ্চদশ শতকের শেষভাগ থেকে উনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভ পর্যন্ত নিশ্চুপ হয়েছিল, সেই নিশ্চুপতা কাটিয়ে তার জেগে ওঠা যেন নেহাৎই হিরাম বিংহামকে অনুকম্পা দেখানোর জন্যে। আসলে মাচ্চু পিচ্চু বহাল তবিয়তেই ছিল, লুকিয়ে নয়, প্রকাশ্যেই ছিল, সবার চোখের সামনেই ছিল। কিন্তু আদিবাসীরা আগ্রহী ছিল না কাউকে সেখানে নিয়ে যেতে।
সিমন ওয়েস্টবার্ড নামের এক ফরাসি গবেষক নারী অনেকদিন কাটিয়েছেন দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকায়। প্রাচীন সভ্যতা নিয়ে কাজ করেছেন তিনি, আদিবাসীদের সঙ্গে কাটিয়েছেন বছরের বছর। দুটি বইও আছে তাঁর। তথ্যানুসন্ধান করে দেখেছেন তিনি, ১৯০১ সালের ১৪ জুলাই এইখানে এনরিখ পালমা, গাবিনো শ্যাচেজ, অগাস্টিন লিজারাজা নামের আরও তিনজন মাচ্চু পিচ্চুকে খুঁজে পেয়েছিলেন। নিজেদের নাম ও তারিখ তাঁরা খোদাই করে রেখে গেছেন সেখানে এক রকের গায়ে। ফ্রাংকলিন নামের একজন ইঞ্জিনিয়ারও একটি দূরবর্তী পাহাড় থেকে ১৯০৪ সালে মাচ্চু পিচ্চুর অস্তিত্ব খুঁজে পান। সে কথা জানান ওই এলাকার একজন খ্রিস্টান মিশনার থমাস পেইনকে। ১৯০৬ সালে থমাস পেইন আরও একজন স্বধর্মী মিশনারি স্টুয়ার্ড ই ম্যাকনেয়ার্নকে (১৮৬৭-১৯৫৬) সঙ্গী করে মাচ্চু পিচ্চুর শিখরে ওঠেন। পুরানো ধ্বংসাবশেষ দেখেন তারা। পাঁচ বছর পর এই থমাসই হিরাম বিংহামকে সন্ধান দেন মাচ্চু পিচ্চুর। সেখানে যাওয়ার সমস্ত পথ বাতলে দেন। সঙ্গী জুটিয়ে দেন।
অতএব, সম্ভবত হিরাম বিহামের কৃতিত্ব এ টুকুই,- মাচ্চু পিচ্চুকে তিনি সফলভাবে তাঁর গবেষণার কাজে লাগিয়েছিলেন।
এরপর মাচ্চু পিচ্চুকে নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছে। সাম্রাজ্যবাদের তাগিদে নৃতত্ত্ব, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ইতিহাস গবেষণায় নানাভাবে ব্যবহৃত হয়ে মাচ্চু পিচ্চু। তবে শেষ পর্যন্ত মাচ্চু পিচ্চুকে সাম্রাজ্যবাদ পারে নি তার উপাঙ্গে পরিণত করতে, বরং মাচ্চু পিচ্চু জুগিয়েছে সমাজ বিপ্লবের রাজনীতিতে অনুপ্রেরণা। পেরুর জনগণের জাতীয় ঐক্যের একটি অন্যতম সূত্র হয়ে উঠেছে মাচ্চু পিচ্চু।
১৯৮১ সালে পেরু সরকার মাচ্চু পিচ্চু ও তার আশেপাশের ৩২৫.৯২ বর্গকিলোমিটার এলাকা ঐতিহাসিক স্থান হিসাবে ঘোষণা করে। কেবল ধ্বংসাবশেষ নয়, এর উদ্ভিদকূল ও প্রাণীজগত, অর্কিড ইত্যাদি পরিবেশগত নমুনাও সংরক্ষণের প্রচেষ্টা চলে। নিত্য নতুন ধারণা উঠে আসছে এখন মাচ্চু পিচ্চু স্থানটি নিয়ে, গবেষণার মধ্যে দিয়ে উদ্ঘাটিত হচ্ছে এর নতুন নতুন দিক। মোটামুটি তিন এলাকায় ভাগ করা হয়েছে মাচ্চু পিচ্চুকে, যে বিভক্তি পাল্টে যেতে পারে যে কোনও মুহূর্তে নতুন কোনও তথ্য পাওয়ায়। এখন দক্ষিণে বিস্তৃত পবিত্র এলাকা, তারপর জনবহুল এলাকা এবং এর বাইরে রাজকীয় এলাকা বা পুরোহিত ও অভিজাতদের এলাকা। পবিত্র এলাকায় আছে ইনতিহুয়াতানা বা ইনকাদের জ্যোতিষঘড়ি বা অ্যাস্ট্রোনমিক ওয়াচ, টেম্পল অব দি সান বা সূর্যমন্দির, রুম অব দি থ্রি উইনডোস বা তিন জানালার ঘর। এগুলো আর নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় নি হিরাম বিংহাম ও তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গোদের পক্ষে। বিস্ময়কর এ সব নিদর্শন দেখার আকাঙ্ক্ষায় প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ মাচ্চু পিচ্চু ভ্রমণ করে।
জাতিসংঘ ১৯৮৩ সালে মাচ্চু পিচ্চুকে বিশ্বঐতিহ্য এলাকা ঘোষণা করে। কেননা গবেষক, বিশেষজ্ঞ ও বৈজ্ঞানিকরা সিদ্ধান্তে পৌঁছান স্থাপত্যগত বিবেচনায় এটি অনবদ্য এবং ইনকা সভ্যতার অদ্বিতীয় নিদর্শন। তারপর ৭ জুলাই, ২০০৭-এ পৃথিবীর নতুন সপ্তমাশ্চার্যের তালিকায় উঠে মাচ্চু পিচ্চু আবারও হৈচৈ ফেলে দেয়।
একসময় উপনিবেশিক শক্তি প্রত্যক্ষভাবে তার থাবা বিস্তৃত করেছিল সারা বিশ্বে। তখন কোনও মতামতের তোয়াক্কা না করে তারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে লুণ্ঠন করেছে ঐতিহ্যময় বিভিন্ন নিদর্শন। সুপরিকল্পিতভাবে এ রকম কথাও ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে, এইসব নিদর্শন সংরক্ষণের মতো ও এগুলো নিয়ে গবেষণা করার কোনও যোগ্যতাই নেই ওইসব রাষ্ট্রের। তারা চেয়েছে উপনিবেশিক ও তৃতীয় রাষ্ট্রগুলিকে ঐতিহ্যহীন, ইতিহাসহীন করে ফেলতে। পৃথিবীর অধিকাংশ রাষ্ট্র সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলোর এই প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন লুন্ঠনের প্রতিবাদে তেমন সোচ্চার না হলেও বিশেষ করে পেরু, গ্রিস ও মিশর খুবই উচ্চকিত তাদের প্রত্নতাত্বিক নিদর্শনগুলি ফিরে পাওয়ার দাবিতে। সেখানকার প্রত্নতাত্ত্বিক ও নৃতাত্ত্বিকদের এই দাবি এখন হয়ে উঠেছে গণদাবি। রাজনৈতিক ইতিহাস সচেতনতার ধারাবাহিকতাতে পেরুর সরকারও এখন তৎপর তাদের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো ফিরিয়ে আনতে।
২০০১ সালে পেরুতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন আলেজান্দ্রো টোলেডো। আগেকার সরকারগুলোর অনেক রাষ্ট্রবিরোধী সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করে তাঁর সরকার। এবং পেরু এ সময় উচ্চকিত হয় ইয়েল থেকে তাদের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ফিরিয়ে নিতে। ইয়েলের সঙ্গে তাদের মতদ্বৈধতা এতই তীব্র হয়ে ওঠে যে পেরু ২০০৫ সালে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করার পরিকল্পনা ঘোষণা করে। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় থমকে দাঁড়ায় পেরুর এ ঘোষণায়। এর মধ্যে পেরুর রাষ্ট্রক্ষমতায় আবার পরিবর্তন ঘটে। নতুন রাষ্ট্রপতি হন অ্যালান গার্সিয়া। তার কাছে চিঠি লেখেন ইয়েল প্রেসিডেন্ট রিচার্ড লেভিন। পেরুর জনগণের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এবং মাচ্চু পিচ্চু পৃথিবীর নতুন সপ্তমাশ্চার্য হয়ে ওঠাতে তিনি বাধ্য হন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলি নিয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা করতে, পূর্ণাঙ্গ একটি তালিকা পেরুর হাতে তুলে দিয়ে নিদর্শনগুলির ভবিষ্যত নির্ধারণ করার জন্যে পেরুকে আলোচনার প্রস্তাব দিতে।
চল্লিশের দশক থেকে বিগত আশির দশক অবধিও এই মাচ্চু পিচ্চু ছিল তারুণ্যের সঙ্গী, চে গেভারার পূর্বসূরি কিংবা উত্তরসূরিদের সঙ্গী। সভ্যতা খুঁড়ে খুঁড়ে মাচ্চু পিচ্চু ও ইনকা সভ্যতা উঠে আসে সমাজ বদলের জন্যে আন্দোলনকারীদের মধ্যে। মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা বা লাতিন আমেরিকার এই প্রাচীন নগর তুলে ধরে মানুষের নিরবধি সংগ্রামযাত্রা। হিরাম বিংহাম ইনকা সভ্যতাকে প্রতিস্থাপন করেছিলেন সাম্রাজ্যবাদীদের চোখের নিচে, দুয়ারবন্ধ গবেষকদের মস্তিষ্কের মধ্যে; কিন্তু কবি পাবলো নেরুদা মাচ্চু পিচ্চুকে নিয়ে আসেন তার যথাযথ স্থানে, পৃথিবীর মানুষের মধ্যে। দু শব্দের এই নামটি মুহূর্তে অসামান্য হয়ে ওঠে এবং দশকের পর দশক তারুণ্য অপলক হয়ে তাকিয়ে থাকে মাচ্চু পিচ্চুর দিকে। ইনকা সভ্যতার প্রাচীন মানুষটিকে নতুন করে উঠে আসার জন্যে আহ্বান জানান পাবলো নেরুদা :
আমার সঙ্গে, উঠে এসো ভাই আমার
তোমাকে যে জন্ম নিতে হবে
তোমার পরিব্যপ্ত অন্তর্জ্বালার
গভীর রাজ্য থেকে তোমার হাত বাড়িয়ে দাও।
পাতালপুরীর গহন থেকে তাকাও আমার দিকে
চাষী, তাঁতি, নির্বাক রাখাল;
লামা উটের সহিস
পাঁচিলের গায়ে ভারায় আরোহী রাজমিস্তিরি,
আন্দিস পাহাড়ের চোখের জলের ভিস্তি,
খোদাই করা অঙ্গুরী মালার জহুরি;
বীজের মধ্যে স্পন্দমান বাগানী
কুম্ভকার-
অনুবাদ : রণেশ দাশগুপ্ত
কী আবেগ জন্ম দিয়েছিল মাচ্চু পিচ্চু আমাদের মধ্যে? পাবলো নেরুদার মধ্যে? ইনকা সিটাডেল মাচ্চু পিচ্চুর কথা মনে করে পাবলো নেরুদা লিখেছিলেন এটি এমন কিছু,- ‘যেখানে মহত্তর প্রেম/ চাঁদের দীর্ঘ বিলম্বিত উদয়ের মতো কিছু আমাদের দেয়।’
মাচ্চু পিচ্চুর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে পাবলো নেরুদার জীবনের আবেগঘন রাজনৈতিক ও শৈল্পিক জীবনের এক পর্ব। স্পেনের গৃহযুদ্ধের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে পাবলো নেরুদা চিন্তাচেতনায় কমিউনিস্ট হয়ে ওঠেন এবং তা চূড়ান্ত পরিণতি পায় মেহিকোতে থাকার সময়। ১৯৪০ সাল থেকে ১৯৪৩ অবধি মেহিকোতে চিলের দূতাবাসে কনস্যুল জেনারেল হিসেবে কর্মরত ছিলেন তিনি। ১৯৪০ সালে সেখানে লিও ট্রটস্কিকে গুপ্তহত্যার চেষ্টা চলে। মেহিকোর পেইন্টার ডেভিড আলফারো সিকোয়ারোস এই ব্যর্থ গুপ্তহত্যার অপচেষ্টার সঙ্গে জড়িত আছেন বলে প্রচার চলে। পাবলো নেরুদা তাকে চিলের ভিসা দেন, ফলে তিনি জেল থেকে মুক্ত হয়ে নিরাপদে সরাসরি চিলে চলে যান। নেরুদা পরে জানান, মেহিকোর রাষ্ট্রপতি ম্যানুয়েল আভিলা কামাচো-র অনুরোধে তিনি সিকোয়ারোসকে চিলের ভিসা দেন। সিকোয়ারোস মেহিকো থেকে চিলে গিয়ে নেরুদার নিজের বাড়িতে ওঠেন এবং একটি স্কুলে ম্যুরাল তৈরির কাজে সম্পৃক্ত হন। এইসব ঘটনাক্রমের মধ্যে দিয়ে নেরুদাও আলোচিত হয়ে ওঠেন। ১৯৪৩ সালে মেহিকো থেকে ফেরার পথে তিনি পেরু পরিভ্রমণ করেন। তখন মাচ্চু পিচ্চু দেখেন তিনি। ইনকা আদিবাসী সভ্যতার এই ধ্বংসাবশেষ তাঁর মধ্যে যুগপৎ পরস্পরবিরোধী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। একদিকে তিনি মুগ্ধ হন এই বিশাল সৃজন ও নির্মাণে। অন্যদিকে যে নির্মম দাসত্ব ও নির্যাতন এই সৃজনশীলতার জন্যে প্রয়োগ করা হয়েছিল তা তার মধ্যে সৃষ্টি করে প্রচণ্ড ক্রোধ, অবসাদ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সর্বহারা শ্রমজীবী বিভিন্ন বর্ণপেশার নামহীন যেসব মানুষ এই সভ্যতা রচনা করেছিলেন তাদের পক্ষেই দাঁড়ান তিনি এবং কলম ধরেন এই মহান শৈল্পিক নগরীর হারিয়ে যাওয়া সৃজনশীল মানুষগুলোর প্রতি নৈবেদ্য প্রকাশের লক্ষ্যে।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই ‘বিশ্বজনীন সঙ্গীত’ (কান্তো হেনেরাল্) নামের একটি বড় উপন্যাস লেখার ইচ্ছে নেরুদার মাথার মধ্যে খেলা করতে থাকে। ১৯৪৬ সালে তিনি এই ‘কান্তো হেনেরাল্’ লিখতে শুরু করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এ উপন্যাস আর শেষ হয় নি। তবে কবিতায় লেখা এ অসম্পূর্ণ উপন্যাসটির খানিকটাই পরবর্তী সময়ে আমাদের কাছে আসে ‘মাচ্চু পিচ্চু পর্বতের শিখরে’ নামে। বাংলায় অনেক পরে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় এটি অনুবাদ করেন, মাচ্চু পিচ্চুকে তিনি লেখেন মাকু পিচ্চু। নেরুদাবিষয়ক একটি সংকলনের সম্পাদক, প্রাবন্ধিক হায়াৎ মামুদ এ ভুল সংশোধনের ব্যাপারে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করার আগেই তাঁর মৃত্যু ঘটে। মৃত সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের প্রতি সম্মান প্রকাশের উদ্দেশ্যে হায়াৎ মামুদ সুভাষ ব্যবহৃত বানানেই কবিতাটি সংকলনভুক্ত করেন। উদ্ধৃতি হিসেবে ব্যবহারের জন্যে রণেশ দাশগুপ্তও ‘মাচ্চু পিচ্চু’র কোনও কোনও অংশ অনুবাদ করেছেন খুব সাবলীললতায়।
মহাকাব্যিক ‘কান্তো হেনেরাল্’-এ নেরুদার প্রাণাবেগের সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে মানুষের আবহমান সৃজনশীলতার প্রতি অপরিসীম আস্থা। অসমাপ্ত ‘কান্তো হেনেরাল্’-এ তিনি ঘুরেফিরে দেখেন ‘মাটির নিচে চাপা পড়া’ আদি ও অকৃত্রিম আমেরিকাকে, কথা বলেন তিনি তাদের আত্মার সঙ্গে। পর্বতের পাদদেশে শুয়ে শুয়ে তিনি অনুভব করেন পরিশ্রান্ত, ক্লান্ত ও কর্মমুখর মানুষদের প্রবল অস্তিত্ব, বোবা নিঃশ্বাস। তিনি দেখেন ‘পাথরভাঙা জোয়ান, উপবাসী জোয়ান, খালি পা জোয়ানের’ দেহাবশেষ। অরব অন্ধকারে ডুবে যাওয়া তাদের অস্তিত্ব স্পর্শ করার চেষ্টা করেন তিনি, হৃদয়ের সমস্ত আকুতি দিয়ে আহ্বান জানান তাদের ফিরিয়ে আনতে এবং তারপর গভীর হতাশ্বাসে ডুবে যান না-পাওয়ার গ্লানিতে:
মাটির গলায় পা দিয়ে বার ক’রে আনো দুর্ভাগাদের
কষ্টার্জিত রুটি, আমাকে দেখাও
ভূমিদাসের পরনের কাপড় আর তার জানলা।
বেঁচে থাকতে সে কেমন ক’রে ঘুমোত আমাকে বলো?
ওঠো, আমার সঙ্গে ভূমিষ্ঠ হও, ভাই।
তোমার দূরবিক্ষিপ্ত দুঃখের গভীর অব্জল থেকে
আমাকে তোমার হাত দাও!
শিলাপুঞ্জের নিচে থেকে তুমি আর ফিরে আসবে না।
মৃদ্গত সময় থেকে তুমি আর ফিরবে না।
অনুবাদ : সুভাষ মুখোপাধ্যায়
১৯৩৫ থেকে ১৯৪৫ সাল অবধি পাবলো নেরুদার কাব্যে যে সুস্পষ্ট প্রত্যক্ষ ভাষণের রীতি ছিল, যে রীতির ছায়াচ্ছন্নতা তাঁর ‘পৃথিবীর আবাসভূমি’-র ভেতর, তা পুরোপুরি পাল্টে গেছে কান্তো হেনেরাল্-এর মাচ্চু পিচ্চুসংক্রান্ত ১২টি অধ্যায়ে। অস্পষ্ট সান্ধ্য ভাষণের পদ্ধতিতে তিনি উচ্চারণ করেছেন এ কবিতার প্রতিটি বাক্য, যেন লোরকা নেই বলেই তাঁর মধ্যে উঠে আসছে স্বগত একক গভীর কন্ঠস্বর। তাঁর এই সান্ধ্য পদ্ধতি বেছে নেয়ার আরেকটি কারণ হতে পারে, যেমনটি রণেশ দাশগুপ্ত বলেছেন, সম্ভবত রহস্যময় এই সভ্যতার নির্মাতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ট আলাপের ইচ্ছা। রণেশ দাশগুপ্ত আরও বলেছেন, এ কবিতা লিখতে গিয়ে নেরুদা সাহায্য নিয়েছেন অতিরিক্ত আসক্তি-ভাষী অবচেতনার সাহায্য। এরকম করেছেন তিনি কবিতার বোধবিষয়ক আধুনিক ও প্রাচীন উভয় কার্যক্রমেরই প্রতীতি থেকে। তাঁর সমগ্র কাব্যের পারম্পর্যের চেতনা মূর্ত হয়ে উঠেছে এ কবিতার মধ্যে দিয়ে, যেখানে তিনি সমন্বিত করেছেন জীবনের প্রত্যক্ষণ আর অনুভবের পরোক্ষতাকে।
‘কান্তো হেনেরাল্’-এর মধ্যে দিয়ে ‘প্রাচীন আমলে প্রত্যাবর্তন নয়, নতুন পৃথিবীতে অভ্যুত্থান’ ঘটানোর জন্যে তিনি আহ্বান রাখেন লাতিন আমেরিকার আদিবাসীদের পাশাপাশি বিশ্বের মূকহীন শোষিত সৃজনশীল মানুষদের সবার প্রতি। কারো কারো মতে, ১৯৪৫ সালের মধ্যেই তিনি আসলে মাচ্চু পিচ্চু বিষয়ক ১২টি পর্ব লেখা শেষ করেছিলেন। ১৯৪৫ সালের চার মার্চ অ্যানতোফাগাসতা ও টারাপাকা প্রদেশ দুটির জন্যে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে সিনেটর নির্বাচিত হন এবং এর চার মাস পর আনুষ্ঠানিকভাবে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। সঙ্গতকারণেই সময় কমে আসে তাঁর এবং রাজনৈতিক কাজে তিনি এতই ব্যস্ত হয়ে পড়েন যে ব্যর্থ হন লেখাটি শেষ করতে। বিশেষ করে ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টি সমর্থিত রেডিক্যাল পার্টির রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী গ্যাব্রিয়েল গনজালেস ভিলেদার প্রচার ব্যবস্থাপক নিয়োজিত হওয়ার পর তিনি কবিতার জগত থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। ১৯৪৭ সালে কমিউনিস্ট পার্টি আনুষ্ঠানিকভাবে সিদ্ধান্ত নেয় যে আগামী এক বছর নেরুদাকে পার্টির কর্মকাণ্ডে যুক্ত করা হবে না, যাতে তিনি নির্মুক্ত হয়ে লিখতে পারেন। কিন্তু রাজনৈতিক আবহই নেরুদাকে ঠেলে দেয় ভিন্ন এক আবর্তের মধ্যে। কেননা রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর গ্যাব্রিয়েল গনজালেস ভিলেদা তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান পরিবর্তন করেন। কমিউনিস্ট পার্টির ওপর নেমে আসে প্রবল নির্যাতন। ১৯৪৭ সালে লোটায় খনিশ্রমিকদের সফল ধর্মঘটের সময় ধর্মঘটী শ্রমিক ও কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যদের নির্বিচারে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হয় দ্বীপের সামরিক কারাগারগুলোতে এবং পিসাগুয়ার কুখ্যাত কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে। এই অবস্থায় নেরুদা নিজে থেকেই মুখ খোলেন এবং ৬ জানুয়ারি ১৯৪৮ সালে চিলের সংসদে একটি বক্তৃতা দেন, যা ইতিহাসে ‘আই অ্যাকিউজ্ড্ (আমি অভিযুক্ত করছি) নামে অমরতা পেয়েছে। খুব কম সময়েই বিশ্বব্যাপী তোলপাড় তোলা এ বক্তৃতা দেয়ার পর নেরুদা বাধ্য হন স্ত্রীকে নিয়ে বাড়ি থেকে পালাতে, অন্যদিকে গনজালেস সরকার তাকে ধরার জন্যে মরিয়া হয়ে ওঠে। টানা তেরো মাস নেরুদা পালিয়ে থাকেন। পুরো সময়টাই তিনি লুকিয়ে ছিলেন চিলের বিভিন্ন শ্রমিকের ঘরে, যাঁরা ছিল তাঁর কবিতার প্রতি ও সেইসূত্রে তাঁর প্রতি প্রচণ্ড অনুরক্ত, যাঁরা প্রস্তুত ছিলেন জীবন দিয়ে হলেও নেরুদাকে বাঁচাতে। এ সময় তাঁর সিনেটর পদ বাতিল করা হয়। তারপর সেপ্টেম্বর, ১৯৪৮ সালে সেখানকার কমিউনিস্ট পার্টিও বাতিল করা হয়।
এ রকম রাজনৈতিক ডামাডোলে পাবলো নেরুদার ‘কান্তো হেনেরাল্’ আর শেষ হয় নি। কিন্তু এটি যে নেরুদার প্রধান একটি গুরুত্বপূর্ণ লেখা তা খণ্ডিত আকারে প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই টের পাওয়া যায়। কবিতাটি জনপ্রিয় হয় কেবল বিপ্লবী ও সাধারণ মানুষের কাছে নয়, এমনকি শিল্পবোদ্ধাদের কাছেও। মার্টিন এসপাদা, ইউনিভার্সিটি অব ম্যাসাচুসেটস-এর ক্রিয়েটিভ রাইটিং-এর অধ্যাপক ও কবি এই কবিতাকে প্রশংসা করে লেখেন যে, ‘এর চেয়ে মহৎ আর কোন রাজনৈতিক কবিতা এখনো লেখা হয় নি।’
সত্যি হলো, মাচ্চু পিচ্চুকে নিয়ে সংগ্রাম এখনও শেষ হয় নি। আদিবাসী ইনকাদের ওপর যে নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছিল, একের পর এক তাদের জীবন, শহর ও সভ্যতা ধ্বংস করা হচ্ছিল তার দায় এখনও কেউ নেয় নি। পেরুতে প্রত্নতাত্ত্বিক নির্দশনগুলো ফিরে এলে একটি ইতিহাসগত উপযোগিতা তৈরি হবে সত্যি, কিন্তু সেই ইতিহাসের কাঠগড়ায় যে-সব হত্যাকারীদের দাঁড় করাতে হবে, তাদের নাম কি পেরুর সরকার বলতে রাজি হবেন? কী বাস্তবের মাচ্চু পিচ্চু, কী আলোকচিত্রের মাচ্চুপিচ্চু,- যে দিকেই তাকানো হোক না কেন, অনিবার্যভাবেই তাই আমাদের মনে হয় কথা বলছেন পাবলো নেরুদা, আর তাঁর সঙ্গে গলা মেলাচ্ছে চে গেভারা; তাঁরা কিংবা আমরা বলছি :
আমি এসেছি তোমাদের মৃত মুখের ভেতর দিয়ে কথা বলতে…
তোমাদের রাখা ছুরিগুলোতে ধার দাও,
আমার বুকে, আমার হাতে স্থাপন করো,
যেন হলুদ আলোর অনেক ছটার একটি নদী,
যেন মাটি চাপা পড়া বহু বাঘের একটি নদী
আর আমাকে কেঁদে ভাসাতে দাও, ঘন্টার পর ঘন্টা, দিনের পর দিন,
বছরের পর বছর,
অন্ধ যুগের পর যুগ, শতাব্দীর পর শতাব্দী।
দাও আমাকে নৈঃশব্দ্য, জল, আশা।
দাও আমাকে সংগ্রাম, লৌহ, আগ্নেয়গিরি।
দেহগুলো, আমাকে আঁকড়ে থাকো, চুম্বকের মতো।
আশ্রয় নাও আমার ধমনীতে আর আমার মুখগহ্বরে।
কথা বলো আমার শব্দাবলি আর আমার রক্তের ভেতর দিয়ে।।
অনুবাদ : সুভাষ মুখোপাধ্যায়
রহস্যময়তায় ভরা মন্দ্রিত উচ্চারণে এভাবেই নির্বাক মাচ্চু পিচ্চু আমাদের হৃদয়ের কথাগুলো তুলে আনে, তুলে আনবে রক্তপাতের মধ্যে দিয়ে; আমাদের প্রতিস্থাপিত করে, প্রতিস্থাপিত করবে মাটি চাপা পড়া বহু বাঘের একটি নদীতে।
নিশ্চয়ই একদিন মাচ্চু পিচ্চু তার সত্যিকারের ইতিহাস ফিরে পাবে।
(শেষ। কোনও কোনও ব্যক্তি ও স্থানের নামের উচ্চারণ আমার অজ্ঞতাবশত সঠিকভাবে লেখা যায়নি, এ জন্যে ক্ষমাপ্রার্থী )।
ছবি সৌজন্য: সুসান টোমায়ো (২০০১)। এখানে।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
২৬ comments
রায়হান রশিদ - ১২ সেপ্টেম্বর ২০০৮ (১:৪৯ অপরাহ্ণ)
মাচ্চু পিচ্চু, পেরু, নেরুদা, চে গ্যেভারা, বিংহ্যাম, মার্কিন আধিপত্যবাদ সব এক সূত্রে গেঁথে নেয়া এই লেখাটির জন্য লেখককে ধন্যবাদ।
১৯৫২ এর বসন্তে ভগ্নদশা এক মটরসাইকেল নিয়ে লাতিন আমেরিকাকে জানার উচ্চাভিলাষ নিয়ে আর্জেন্টিনা থেকে যাত্রা শুরু করে দুই তরুন। তাদের একজন আর্নেস্তো (চে) গ্যেভারা, অন্যজন তার প্রিয় বন্ধু আলবার্তো গ্রানাদো। গন্তব্য পেরু, গন্তব্য আন্দেজ গর্ভের মাচ্চু পিচ্চু। তাদের সেই ভ্রমণকাহিনী নিয়েই “দি মটরসাইকেল ডায়েরীজ”।
যাত্রাপথে প্রচন্ড ঠান্ডা এক রাত কাটায় দু’বন্ধু পেরুর দিক থেকে কাজের সন্ধানে আসা গৃহহীন এক দম্পতির সান্নিধ্যে। আগুনের পাশে বসে থাকা তরুণ আর্নেস্তোর জবানীতে: “it was one of the coldest nights of my life, but also one which made me feel closer to this strange, for me anyway, human race.”
এ কাহিনী একদিক থেকে যেমন মাচ্চু পিচ্চুর, তেমনি তা পথ চলতে চলতে তরুন আর্নেস্তোর মননে চেতনায় ‘চে’ হয়ে ওঠার কাহিনীও; নানা কিসিমের মানুষের চোখ দিয়ে লাতিন আমেরিকাকে নতুনভাবে দেখার কাহিনী। লাতিন আমেরিকার দেশে দেশে মানুষের সর্বহারা হয়ে ওঠার কাহিনী, অনড় অবিচল মাচ্চু পিচ্চু যার স্তরে স্তরে জড়িয়ে আছে।
রেজাউল করিম সুমন - ১২ সেপ্টেম্বর ২০০৮ (৭:৩৬ অপরাহ্ণ)
চে-র ওই শীতার্ত রাত্রিযাপনের কথা মনে আছে। দ্য মোটরসাইকেল ডায়েরিজ ছবির ওই অংশে পৌঁছে নেরুদার দীর্ঘ কবিতাটার কথা বারেবারেই মনে পড়ছিল। আমরা অনেকেই নেরুদার কবিতার মাধ্যমেই মাচ্চু পিচ্চুর সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম।
মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ও কবিতাটি অনুবাদ করেছিলেন। মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়ও করেছিলেন কি? তবে এর ইংরেজি একটি অনুবাদ — অনুবাদকের নাম মনে রাখিনি! — এখনো কানে বাজে। না, আবৃত্তি শুনিনি। একা একা অস্ফুটে পড়তে গিয়েই দৃশ্য-ধ্বনিময় এক জগতের অস্তিত্ব টের পাচ্ছিলাম নিজের চারপাশ ঘিরে! ওই আশ্চর্য অভিভব কখনোই ভোলার নয়।
ইমতিয়ার শামীম - ১২ সেপ্টেম্বর ২০০৮ (৮:৫৭ অপরাহ্ণ)
সিনেমাটা আমিও দেখেছি। অবিশ্বাস্য সুন্দর দৃশ্য ওটা!
ইমতিয়ার শামীম - ১২ সেপ্টেম্বর ২০০৮ (৮:৫৫ অপরাহ্ণ)
ধন্যবাদ রায়হান রশিদ।
তবে মাচ্চু পিচ্চু নিয়ে ভালভাবে জানেন এমন কারও বাংলা লেখা পেলে আমাদের সাহিত্যের ঘাটতিটা ভালভাবে মেটে।
রেজাউল করিম সুমন - ১২ সেপ্টেম্বর ২০০৮ (৭:৩৪ অপরাহ্ণ)
ইমতিয়ার ভাই,
“ভয়াল” সিরিজের বই আমাদের প্রজন্ম বোধহয় পাইনি!
মাচ্চু পিচ্চুকে নিয়ে এই তথ্যসমৃদ্ধ লেখাটির জন্য আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ আছি।
একটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। আলেক্সান্দর রাস্কিন-এর “বাবা যখন ছোট” কি আপনার বা আপনার বোনের সংগ্রহে এখনো আছে? আমার বইটা এক বন্ধু হারিয়ে ফেলেছে!
ইমতিয়ার শামীম - ১২ সেপ্টেম্বর ২০০৮ (৮:৫৯ অপরাহ্ণ)
ভয়াল সিরিজ ঠিক আমাদের প্রজন্মের জন্যেও ছিল না। তবে এই বইটার দু’চারটে কপি শিল্পী ধ্রুব এষের কাছে থাকতে পারে।
আর হ্যাঁ, বাবা যখন ছোট বইটিও আছে। তবে খুঁজতে হবে হয়তো।
রেজাউল করিম সুমন - ১২ সেপ্টেম্বর ২০০৮ (১০:৪৪ অপরাহ্ণ)
ভয়াল সিরিজের বইয়ের খোঁজ পাওয়ায় খুব ভালো হলো।
বাবা যখন ছোট দিব্যপ্রকাশ নতুন করে ছেপেছে। দেখেছেন আপনি? অন্যকে কিনে দিয়েছি, কিন্তু নিজের সংগ্রহে রাখার ইচ্ছে হয়নি। আসল বইয়ের মুদ্রণসৌকর্য কিছুই অক্ষুণ্ণ নেই।
ননী ভৌমিকের অনুবাদটা কিনেছিলাম মাত্র ৬ টাকা দিয়ে, চট্টগ্রামের এক পুরোনো বইয়ের দোকান থেকে। বন্ধুদের পড়ে শোনানোর জন্য প্রতিদিন সঙ্গে নিয়ে বেরোতাম। একজনকে ধার দেয়াতেই সর্বনাশটা হলো। কী যে মন খারাপ হয়েছিল তখন! পরে ইংরেজি অনুবাদ কিনি — নতুন, ১০০ টাকা দিয়ে। কিন্তু শোকটা প্রশমিত হয়নি। আপনার কপিটা দেখতে চাওয়ার বিশেষ কারণ এই যে, দুই প্রজন্মের পাঠকের ভালোলাগার চিহ্ন জড়িয়ে আছে ওই বইয়ের পাতায়।
কোনো বাঙালি কি মাচ্চু পিচ্চু দেখতে গিয়েছেন? সেরকম কারো খোঁজ পেলে ভালো হতো। আপনার কি ইচ্ছে আছে পেরুতে যাবার?
ইমতিয়ার - ১৫ সেপ্টেম্বর ২০০৮ (৭:৪০ অপরাহ্ণ)
দিব্যপ্রকাশের বাবা যখন ছোট এখনও দেখিনি, তবে অনেক আগে দৈনিক বাংলাবাজারের ছোটদের পাতায় দেখেছিলাম কবি নির্মলেন্দু গুণ বইটির বঙ্গীয়করণ করে ধারাবাহিকভাবে ছাপছেন। খুবই কষ্ট পেয়েছিলাম কয়েকটি পর্ব পড়ে। ননী ভৌমিকের অনুবাদটি যারা পড়েছেন, তাদের জন্যে বিষয়টি সত্যিই যন্ত্রণাকর। তবে আমরা তো আবার লেখকের স্বাধীনতার কথা বিশ্বাস করি, তাই অনেক কিছু সহ্য করতে হয়!
আশা রাখি, কোনও না কোনও সময় বইটি আপনাকে আবার দেখাতে পারব।
নিশ্চয়ই আমাদের কেউ মাচ্চু পিচ্চু দেখেছে। আমিও দেখার আশা রাখি। একটা কবিতা আছে না, দূরাশা আমার সীমাহীন বটে…
রেজাউল করিম সুমন - ১৫ সেপ্টেম্বর ২০০৮ (৯:০৩ অপরাহ্ণ)
কবির গুণপনার কথা শুনে সত্যিই বিস্মিত।
কোনো একদিন আপনার সঙ্গে দেখা হবে নিশ্চয়ই, আর হয়তো ছোট বাবার সঙ্গেও! ভাবতে ভালো লাগছে।
অদিতি কবির - ১০ মার্চ ২০১২ (১:১১ পূর্বাহ্ণ)
অণু তারেক দেখেছে।
Farhida - ১৩ সেপ্টেম্বর ২০০৮ (৮:১১ পূর্বাহ্ণ)
শামীম ভাই! আমি কিন্তু এই সুন্দর লেখাটা পড়ে গেছি!! এই বিষয়ে পরে আবার জানাব 🙂
ইমতিয়ার - ১৫ সেপ্টেম্বর ২০০৮ (৭:৪৮ অপরাহ্ণ)
ধন্যবাদ ফারহিদা, তুমিও কিন্তু লিখতে পার। দেখছো তো, অর্ধেক জনসংখ্যাহীন এই প্রান্তর… (বুদ্ধদেব বসু এইরকম কিছু লিখেছিলেন, আড্ডায় নারী অপরিহার্য, তাতে আড্ডাবাজদের রসনা সংযত হয় আর রসবোধের প্রকাশ সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষতর হতে থাকে। এখন যদিও সময় পাল্টে গেছে, কোথাও কোথাও তা স্থূল থেকে স্থূলতর হতে থাকে, তারপরও উটপাখি হয়ে থাকলে তো চলে না)।
Farhida - ২০ সেপ্টেম্বর ২০০৮ (৩:৩১ পূর্বাহ্ণ)
নারী নাই নাকি এখানে? :-/
🙂 বুদ্ধদেব বসুর কথাটা কিন্তু দারুণ, শামীম ভাই!
সত্যি একদিন এখানে চলে এসে উৎপাত করবো, দেখবেন… 😉
আপনার নতুন লেখাটা পড়তে আসছিলাম। ভাগ্যিস, ফেসবুক-এ লিঙ্ক দেন আপনি, নাহলে তো খোঁজ-ই পেতাম না নতুন লেখা দের! 🙂 (নতুন লেখা নিয়ে কমেন্ট ওটায় করাই ভালো)
যাই আজ, আর দেখি, উটপাখি-র বদলে “ময়ূরপাখি” হয়ে এই ব্লগ গুলাতেও হানা দিয়ে ফেলবো কোনো এক সময়! :-))…
muntasir - ১৫ সেপ্টেম্বর ২০০৮ (৮:৪৯ অপরাহ্ণ)
দারুন লাগল। আামি বর্তমানে সে পথে আছি। দেখি যেতে পারি কিনা। এরা এখন সহজে ভিসা দেয়না।
ধন্যবাদ।
মুনতাসির
রায়হান রশিদ - ১৫ সেপ্টেম্বর ২০০৮ (৯:১৩ অপরাহ্ণ)
আমরা সবাই মন থেকে কামনা করি আপনি যেন ভিসা পান, কোন ধরণের সমস্যা ছাড়াই। আর বেশী বেশী করে ছবি তুলবেন, প্লীজ, আমরা যারা যাইনি সেখানে তাদের কথা ভেবে অন্তত। আর ফিরে এসে যদি আপনার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে এখানে লেখেন, তাহলে আপনার চোখ দিয়ে আমাদেরও মাচ্চু পিচ্চু দেখে আসা হবে।
রেজাউল করিম সুমন - ১৫ সেপ্টেম্বর ২০০৮ (১১:০৬ অপরাহ্ণ)
মুনতাসির,
আপনার মতো একজন ভ্রামণিকের অপেক্ষায় ছিলাম আমরা।
যাত্রা শুভ হোক!
ইমতিয়ার শামীম - ১৬ সেপ্টেম্বর ২০০৮ (১:২৪ অপরাহ্ণ)
আপনাকে অবশ্যই যেতে হবে সেখানে, বুঝতে পারছেন তো, না হলে আমরা শান্তি পাব না…
মুজিব মেহদী - ১৬ সেপ্টেম্বর ২০০৮ (৩:১৬ অপরাহ্ণ)
লেখাটা দীর্ঘ বলে পুরোপুরি পড়তে দেরি হলো, এজন্য দুঃখিত। আপনি অসাধারণ এক প্রেম সহযোগে লিখেছেন এই লেখা। রহস্যময় ও গম্ভীর মাচ্চু-পিচ্চুর গাম্ভীর্য আরো যেন বেড়েছে আপনার বর্ণনায়। লেখাটির জন্য অনেক ধন্যবাদ রইল। মাচ্চু-পিচ্চু বিষয়ক আমার অজ্ঞতার অনেকটাই ঘুচাতে পারল এ লেখা।
ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের জোচ্চুরির ঘটনাটা আমার একেবারেই জানা ছিল না। সভ্যতার নামে অসভ্যতার কারবারি আমেরিকানদের নামে আরো কিছু ঘৃণা বরাদ্দ হলো।
নওরীন তামান্না - ২১ অক্টোবর ২০০৮ (১২:৪৪ অপরাহ্ণ)
হুম। লক্ষণটির সাথে আমরা নারীরা সকলেই সম্ভবত কমবেশী পরিচিত। কারণটি কি বলে মনে হয়? খানিকটা সূত্র বোধ হয় পাওয়া যাবে ভার্জিনিয়া উলফ্ এর লেখায়। এ বিষয়ে (“নারীর আয়নায় পুরুষের বিবর্ধিত প্রতিবিম্ব” প্রসঙ্গে) উলফ্ এর কয়েকটি লাইন উদ্ধৃত করার প্রলোভন সামলাতে পারলামনা।
ইমতিয়ার শামীম - ২৪ অক্টোবর ২০০৮ (১২:৫৯ অপরাহ্ণ)
লক্ষণ বিলক্ষণ মিলছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই… আর কে না জানে, ডাক্তার যত বড়, লক্ষণও মিলবে তত বিলক্ষণ। তবে বুদ্ধদেব যদি জানতেন, আমাদের উচ্চ মাধ্যমিকের পাঠ্যবাংলার সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত তার আড্ডা রচনার মধ্যে থেকে এমন সব লক্ষণ খুঁজে পাওয়া সম্ভব এবং এতসব কিছু তাতে বিম্বিত হওয়া সম্ভব, তা হলে বোধ করি তিনি শোকে নির্বাক হয়ে যেতেন।
sumonrahman - ২৬ অক্টোবর ২০০৮ (৮:০৫ পূর্বাহ্ণ)
আনন্দ পেলাম ইমতিয়ার ভাই।
সুমন রহমান
ইমতিয়ার শামীম - ২৮ অক্টোবর ২০০৮ (১১:১৭ পূর্বাহ্ণ)
আমিও আনন্দিত,- গর্বিতও,- আপনি আনন্দ পেয়েছেন জেনে। তবে আনন্দের কারণটি কি? লেখা? না বিভিন্ন মন্তব্য?
যেটাই হোক,- ‘শান্তিরস্তু, শান্তি হোক’। না কি বলেন?
সাগুফতা শারমীন তানিয়া - ২৮ মার্চ ২০১০ (২:১৭ পূর্বাহ্ণ)
লেখাটা পড়ে খুব ভাল লাগলো। আর একটা কথা মনে পড়লো, লর্ড এলগিন পার্থেননের অপূর্ব মার্বল জাহাজে করে বৃটেনে নিয়ে এসেছিলেন, রীতিমত মাটিতে ফেলে টুকরো করে, তা বৃটিশরা যদ্দুর জানি এখনো গ্রীকদের ফিরিয়ে দেয়নি, হাজার অনুরোধ সত্তেও।
জানিনা, মাচ্চুপিচ্চুর সম্পদ ফিরিয়ে দেবার আমেরিকান দৃষ্টান্তে তারা আদৌ অনুপ্রাণিত হবে কিনা।
মোহাম্মদ মুনিম - ২৯ মার্চ ২০১০ (১১:৩৬ অপরাহ্ণ)
২০০১ কি ২০০২ সালে আমেরিকান সোসাইটি অব সিভিল ইঞ্জিনিয়ার্স (ASCE) মাচ্চুপিচ্চুর সেচব্যবস্থার উপরে তাদের মাসিক সাময়িকীতে একটা রিপোর্ট করেছিল। মাচ্চুপিচ্চুতে শুধু সেচই নয়, শহরে নিত্য প্রয়োজনীয় কাজে ব্যবহারের জন্য public water system ছিল। অত উঁচুতে শহর নির্মাণের সম্ভবত কোন ধর্মীয় কারণ ছিল, সেই শহরকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য তো সারা বছর নিয়মিত খাদ্য এবং পানি সরবরাহের প্রয়োজন। তারা পাশ্ববর্তী নদী থেকে খাল কেটে কেটে শহরে নিয়মিত পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করেছিল। শুধু তাই নয়, শুকনো মৌসুমে নদীর পানি কমে গেলে লোকে যেন পানির অভাবে কষ্ট না পায়, সে জন্য reservoir এ পানি জমিয়ে রাখার ব্যবস্থাও ছিল। অতোটা মন দিয়ে পড়িনি বলে কোন pumping এর ব্যবস্থা ছাড়াই নীচের নদী থেকে পানি অতো উপরে নিয়ে যাবার ব্যাপারটা মনে নেই (তবে কি বৃষ্টির পানি জমিয়ে রাখা হতো?)। এছাড়া পাহাড় ধসে পড়ার হাত থেকে রক্ষার জন্য তারা সিঁড়ির (terrace) মত পাহাড় কেটে সেখানে কৃষিকাজ করতো। এই করে তারা শহরটাকে প্রায় পাঁচশত বছর বঁচিয়ে রেখেছিল। আমার একজন শিক্ষক (ডঃ চার্লস অবিনী) পিরামিডের কথা উঠলেই বলতেন ‘just a pile of rocks’, রাজাগজার কবর বানানোর জন্য দাস খাটিয়ে বানিয়েছে, এতে আর বাহাদুরির কি আছে। মাচ্চুপিচ্চুর খাল বানানোটাই আসল বাহাদুরি।
ASCE মাচ্চুপিচ্চুর উপর একটি বই প্রকাশ করেছে। বইটার লিঙ্ক এখানে।
মোহাম্মদ মুনিম - ২ এপ্রিল ২০১০ (১:৩৯ পূর্বাহ্ণ)
মাচ্চু পিচ্চুকে কেন্দ্র করে গড়ে ঊঠা পর্যটনশিল্প থেকে বছরে এক বিলিয়ন ডলারেরও বেশী আয় করে পেরু, এই নিয়ে বিবিসির রিপোর্ট
বিনয়ভূষণ ধর - ৩ এপ্রিল ২০১০ (২:৩১ অপরাহ্ণ)
ল্যাটিন আমেরিকার দেশ পেরু’র সবচেয়ে বিখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকা ‘মাচ্চু পিচ্চু’ দর্শনার্থীদের প্রবেশের জন্যে দু’মাস বন্ধ থাকার পর আবার খুলে দেয়া হয়েছে। পেরু’র ‘মাচ্চু পিচ্চু’ এলাকাতে গত জানুয়ারী মাসের শেষের দিকে প্রচণ্ড বৃষ্টিপাত ও ভূমিধ্বসের কারণে রেলওয়ে ব্যবস্হা ভেঙ্গে পড়ে। যার কারণে ‘মাচ্চু পিচ্চু’ এলাকাটি দর্শনার্থীদের প্রবেশের জন্যে বন্ধ করে দেয়া হয় তখন। পড়ুন এখানে...