বিষণ্ণ আধারের শক্তি

...কথা ইশারা এক বিষণ্ণ শক্তি হয়ে আমাদের ইন্ধন জোগায় প্রসন্ন হতে, সামনের দিকে এগোতে। মামুন হুসাইনের এ-গ্রন্থ আমাদের তাড়িত করে অতীতকে নতুন করে দেখতে, নতুন উপনিবেশের মুখোমুখি হতে, জিজ্ঞাসু হতে। যে-মুখ আমরা লুকিয়ে রেখেছি আমাদের থেকে, সে-মুখের উদ্ভাসে যেন হঠাৎ করেই শিমুল তুলোর বাউরি ওড়ে। উড়তে উড়তে রোদ পিঠে করে, পাঁচ আঙুলে চোখ বাঁচিয়ে আরো হাঁটতে ডাক দেয় আমাদের।

স্পর্শের জালে বিভোর হয়ে মুখবই দেখতে দেখতে বই হারিয়ে যাওয়ার উল্লাস তুলতে তুলতে সবাই যখন নিজেরাই লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে অদৃশ্য গহিন এক উপনিবেশে, মামুন হুসাইন তখন নিজেকে ফিরে দেখছেন কথা ইশারায়; নিজেকে, – কিংবা অতীতজাড়িত বিপন্ন ভবিষ্যতের দিকে ইঁদুরদৌড়ে ছুটে চলা আমাদেরও। কথা ইশারা তাঁর নিজের কথায়, ‘তাদেরই টিপসই এবং জলছাপ’ ‘বিবিধ উদ্বিগ্নতা এড়ানোর জন্যে যেসব মানুষের সঙ্গে দল বেঁধে’ একদিন হেঁটেছেন তিনি। অসমাপ্ত অবয়ব নিয়ে তারা দেখা দেয় আমাদের কাছে, কিন্তু তাদের সামগ্রিকতা ধরা পড়ে আমাদের কান্নার শক্তির মুঠোতে, স্বপ্নভঙ্গের বেদনাতে, যে-পথের শেষ জানা নেই অথচ যে-পথে যেতেই হয় সে-পথের প্রতিটি পদক্ষেপে। অনেক আগে ঈশ্বরের কাছে কাঁদবার শক্তি না হারাতে প্রার্থনারত এক ঋজুমানবও ডাক দিয়েছিলেন কথা ইশারায়। ‘পুরাতন হয় নতুন পুনরায়’ – তাই আমরা আবারো কথা ইশারার হাতছানি পাই। পাই ‘নিজস্বতা’ প্রমাণ করার যে উন্মাদনা চলছে অথবা চলছে ‘নিজেকে প্রতিস্থাপন করার যে ইঁদুর-দৌড়’ তার ভয়ংকর কথাচিত্র। এর ফাঁকফোকর গলেই আবার উঁকি দেয় মামুন হুসাইনের মামুন হুসাইন হয়ে ওঠার আয়োজন, যা তাঁর অন্য কোনো গ্রন্থের পাঠ থেকে পাওয়া কখনো সম্ভব নয়।

কথা ইশারা

কথা ইশারা

নিজের কথাই লিখেছেন বটে মামুন, খুঁজেছেন তাঁর বিবিধ পদচিহ্ন; নিজের নিরীহ সাদামাটা জন্মবৃত্তান্তের খানিকটা ডিমেন্টিক হতে থাকা মায়ের দাদির কাছে শুনতে শুনতে তিনি মুখোমুখি হয়েছেন পাখিহীনতার কষ্টে আচ্ছন্ন শিশুপুত্রের। তবু ব্যক্তিগত গদ্য হয়েও তা ব্যক্তিগত নয়। শেষ পর্যন্ত কথা ইশারা সমকালের যৌথ কোরাস, উত্তর-অন্বেষা। যে-শনাক্তকরণ চিহ্ন তিনি তুলে ধরেন, শুরুর যে-পাঁচালি বয়ন করেন, কিংবা সমসময়ের মানুষের সঙ্গে চলতে চলতে নিরুপায় বাজার-সদাইয়ে শামিল হন, সেসবের সবকিছুতেই ঘটতে থাকে সামাজিক সংখ্যালঘুত্বের ব্যক্তিক উদ্ভাস। একটু একটু করে সময়কে চিনতে থাকি আমরা, চিনতে থাকি মামুনকেও, যিনি শেষ পর্যন্ত ভাবতে শুরু করেন, ‘এখন মনে হয়, লেখায় আধুনিকতার চেয়ে ট্র্যাডিশন আবিষ্কার করাই বড় সমস্যা!’ মামুনের লিখনশৈলীর আধুনিকতায় যাঁরা পথ হারিয়ে ফেলেন, গোলকধাঁধায় ঘুরপাক খেতে থাকেন, সংগুপ্ত ঈর্ষাও বয়ে বেড়ান, তাঁরা এবার নতুন করে ভাবতে পারেন, ট্র্যাডিশনের অন্বেষণ কত গভীর হলে আধুনিকতারও বাক বদলায়। দুর্বলচিত্তের মানুষ হিসেবে নিজেকে গ্রন্থিত করতে থাকলেও একটি প্রস্ত্ততিপর্বের আখ্যানও পেতে থাকি আমরা। সেই প্রস্ত্ততিপর্বে থাকে আলাদা হওয়ার নয়, বরং মেলানোর প্রস্ত্ততি, ‘সহস্র বন্ধন মাঝে মুক্তির স্বাদ’ নেওয়ার প্রস্ত্ততি। খাতায় তিনি লিখে রাখেন মনীষীবন্ধুদের সব সেরা বাক্য, উলটেপালটে দেখেন, মনে করেন, হয়তো ভুল হয়ে যায় আবার কোনো কোনো কথা বোধের এত গভীর তলদেশে পৌঁছে যে নিজেরই কথা হয়ে যায়। ‘নিজস্বতা’র আত্মম্ভরিতা হারাতে থাকেন তিনি, বোধকরি সেজন্যেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে তাঁর নিজস্বতা। লিখেছেন তিনি, ‘প্রাচীন গ্রিসের মনীষীরা পারতেন – অর‌্যাটরি, জিমন্যাস্টিকস, অ্যাস্ট্রোলজি, দর্শন, সাহিত্য, সংগীত, যুদ্ধবিদ্যা – সবকিছু মিলিয়ে ওঁরা ভাবতেন এগোনোর কথা। আমরা পারি না। সুপার স্পেশালিটির যুগে আমরা সবাই কুঠুরিবদ্ধ এক একজন অর্ধমানুষ। আমি নিজে যেভাবে বুঝেছি, তাতে মনে হয় এখনো দার্শনিক, ফিজিসিস্ট, মিউজিশিয়ান, পেইন্টার, বায়োলজিক্যাল সায়েন্টিস্ট, এগ্রোনমিস্ট, শুধুমাত্র তাঁর জগৎকে নিয়েই চমৎকার এক সৃজনশীল জীবনযাপন করতে পারেন। কিন্তু লিটারেচারের মানুষ কেবল গদ্য-পদ্যের দীঘল সব অ্যান্থোলজি উল্টে চলেছেন, তা মানতে মন সায় দেয় না। ফলে আমার আর ‘লিটারেচার’ করা হয় না। নানান করণ-কৌশলে আমার যৎসামান্য বাক্য রচনাকে ভুল বিবেচনা করে সতীর্থরা বয়কট করেন। লিটারেচারের বড় বিষয় যেহেতু মানুষ এবং এই মানুষ এত বিচিত্র পেশা, এত অদ্ভুত আচরণ আর ঘাত-প্রতিঘাত নিয়ে বেড়ে ওঠে যে, এর সামান্যতম স্বাদ নিতেই প্রস্ত্ততি হয়ে যায় অনন্তকালের। ফলে মনের অজান্তে টপকে-টপকে ভাবনার নানান গলিঘোঁজের সংবাদ খানিকটা আক্রান্ত করেই বসে। যেজন্য বুদ্ধির ধার অনেকখানি বেড়েছে, এরকম একটি ভান করা আচরণ থেকে আর রেহাই হয় না। বন্ধুরা এই বদলে যাওয়া চোখ-মুখকে কাকের ময়ূরপুচ্ছ জ্ঞান করলে আমার এবার সংকোচ বাড়ে।’ (পৃ ৩৫-৩৬) আমরা দেখি, একটি মেটাফোরের মধ্যে জন্ম নিচ্ছে অসংখ্য মেটাফোর, সমান্তরালে এগিয়ে চলছে সেসব, আবার লুপ্ত হচেছ মেটাফোরেরই ঘরজমিনে। জীবনকে চিনতে তিনি এগোচ্ছেন গ্রন্থের দিকে, গ্রন্থকে সঙ্গে এগিয়ে চলেছেন জীবন নামক গ্রন্থের কাছে, আবার হারমান হেসের মাঝির কাছে কনভিন্সড হয়ে হেঁটে চলেছেন নদীর দিকে। কিন্তু নদীর ওপারে মিছমিথুইর গাঁয়ের ‘গল্প’কে খুঁজে পাওয়া যায় না, শ্মশানের চরে পুলিশের প্রহরায় গুপ্ত-লাশ পুড়তে থাকে, আগুনের ছাই এসে ঢেকে দেয় মুখ, বুকপকেট এমনকি বইয়ের শেলফ। বাঁচার রকমফের দেখতে থাকেন তিনি, দেখেন গ্রন্থকীট না হয়েও অচিন মানুষেরা আনন্দবেদনায় আচ্ছন্ন হচ্ছে, দ্রোহে-বিদ্রোহে, হাসিকান্নায়, মায়ামমতায় জীবনকে জাপটে ধরে পত্তন ঘটাচ্ছে বাঁচার, আনন্দের ও স্বস্তির উপনিবেশের। গদ্য-পদ্য লেখে না তারা, আপাত দলছুট তারা, কিন্তু সৃজনশীলতার মহাযজ্ঞের অংশীদার তারা সবাই, যূথবদ্ধ হয়ে তারা লিখে চলেছে মহাকালের মহামায়াময় জীবনগাথা। উপসংহারে পৌঁছান তিনি, ‘…লেখকের খাতা থেকে এবেলা নাম খারিজ হয়ে গেলে আমার আর বেদনা হয় না। এখন তাই চিরকালের বকলম পাঠকের খাতায়, দর্শকের খাতায় একটি টিপসই অাঁকার প্রস্ত্ততি সারছি। আর ভাবছি, আমাদের কী এক ঘোরের কাল ছিল, যখন বন্ধুদের ভালোবাসায় আমরা মাইলের পর মাইল পথ হেঁটে গেছি।’ (পৃ ৩৭)

অনুমান করি, বিস্মিত হওয়ার, সংশয়ী হওয়ার এবং উত্তর খুঁজে ফেরার বেলায় চিরতরুণ মামুন। মৃত্যুচিন্তা, একাকিত্ব, সৌন্দর্যবোধ কিংবা চোখের জল অনন্ত বিস্ময়সমেত বারবার সংশয়ী করে তাঁকে। ইলিয়াসকে নিয়ে কয়েকটি লেখা এবং বক্তব্য আছে তাঁর বইয়ে। কিংবা ধরা যাক, কায়েস আহমেদের কথা – তাঁর মৃত্যুশিল্পের অনুসন্ধানও করেছেন তিনি একাধিকবার। বাবার মৃত্যু তো আছেই – আরো মৃত্যু স্পর্শ করেছে তাঁকে, স্পর্শ করেছে পুকুরের পানিতে পড়ে মরে যাওয়া প্রথম কন্যার কথা ভেবে চোখ মুছে বিদ্যাসাগরের ‘প্রভাবতী-সম্ভাষণ’ নিয়ে কথা বলা বিদগ্ধ মানুষের মৃত্যু, এ-দেশে থাকতে পারবেন কি না তা নিয়ে শঙ্কিত হয়ে ওঠা অপার নিঃসঙ্গতার সঙ্গী এক বেহালাবাদকের মৃত্যু। সব মৃত্যুরই আছে নিজস্ব এক স্বর। কিন্তু বাবার মৃত্যু নিয়ে ইলিয়াসের অনুভূতি – যে-অনুভূতি হয়তো সার্ত্র ছাড়া আর সকলের জন্যেই আদিখ্যেতা – তাঁ তাকে বিশেষভাবে একাত্ম করেছে ইলিয়াসের সঙ্গে। ইলিয়াসের ক্ষেত্রে দেখেছেন, তিনি হয়তো বা বিপন্ন বিস্ময়ের সঙ্গেই, মরবিডিটির গোপন প্রলোভন যে মানুষটি এড়াতে পারেননি, সেই মানুষটিরই লেখা, উচ্চারণ, রাজনৈতিক ভাষ্য, বিবৃতি, আলোচনা সব মিলিয়ে কালপ্রবাহে যে-ভাবমূর্তি তৈরি করছে তার সঙ্গে ‘তিন দশক আগে দেয়া তাঁর তথ্য স্বগত মৃত্যুর মতো কেবল স্ববিরোধিতাই তৈরি করে। মামুন দেখেছেন, ইলিয়াস অবশেষে চেষ্টা করেছেন এই স্বগত মৃত্যুকে এড়িয়ে যাওয়ার, তাই সামনে নিয়ে এসেছেন তাঁর কালের সমস্ত জরুরি প্রশ্নকে। মানুষ এবং সমস্ত কালের মানুষই হয়ে উঠেছে ইলিয়াসের একমাত্র মনোযোগের বিষয়। আবার কায়েস আহমেদের স্বেচ্ছামৃত্যুর সুবাদে ভেবেছেন তিনি, হয়তো এই মৃত্যুর সুবাদেই তারা একদিন পৌঁছবেন সুমহান এক আনন্দ-বেদনার জগতে, ভাববেন একদিন, ‘স্বেচ্ছামৃত্যু কোনো পাপ নয়, ক্ষয় নয়, এই মৃত্যু মহাভারতের ভীস্মের মতোই শোভন ও সুন্দর।’ (পৃ ১৭৩) সৌন্দর্যের তত্ত্বতালাশ করতে করতে মামুন দেখা পান ইউল ডুরান্টের এবং মানুষকেই তিনি সবচেয়ে সৌন্দর্যময় বিবেচনা করেছিলেন জেনে সামান্য ভরসা খুঁজে পান নিজের বিদ্যাবুদ্ধির ওপরে; আবিষ্কার করেন আশ্চর্য-সুন্দর এক বেহালাবাদক মানুষকে, তিনি তার স্টেডিভেরিয়াস-বেহালা বাজানো হাতটি রাখেন চুপচুপ ফরমালিনে মায়ের কর্কট আক্রান্ত বুক আবদ্ধ করে রাখা মামুনের মাথার ওপর, চোখে জল জমে তার, অনুভব করেন, ‘…এই শহরের তাবৎ বুদ্ধিবাদী-সংগীততৃষ্ণার্তদের কাছে অ্যাপিল করার পরেও একটি রেকর্ড করা যায় না রঘুকাকার।’ (পৃ ১৯) তবু তিনি সৌন্দর্যবিষয়ক অসামান্য সব পাঠ দিয়ে যান, ‘কাকা, সুন্দর কিছু দেখলেই আমার চোখ ভিজে যায়।’ ‘সৌন্দর্য কি তবে কান্নার দ্যোতক?’ – ভাবতে শেখেন মামুন। বেহালাবাদক তাঁর কাছে নিয়ে আসেন সংবাদপত্র থেকে কেটে পকেটে রাখা বুকে-পিঠে স্লোগান লেখা নূর হোসেনের ছবি, ঘুম আসছে না তার, কান্না – কেবলই কান্না ছুঁয়ে যাচ্ছে তাকে, বলছেন তিনি, ‘মৃত্যুর কী অপূর্ব সৌন্দর্য দেখুন কাকা…।’ (পৃ ৮০) সৌন্দর্যের তত্ত্বতালাশ করতে করতে মধ্যবিত্তের চিত্তের কাছে পৌঁছে গেছেন মামুন, আতমপীড়নের স্বর চারপাশে : ‘লোকটি যেদিন শ্মশানে পুড়ে ছাই হলেন, সেদিন কীসব প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, নদীর স্রোত দেখতে দেখতে তার সবটুকু মনে নেই। যথারীতি শ্মশানের ছাই মেখে, ছাই মুছে আবার ঘরে ফিরে আসি। সিরামিক্স বিভাগের এক বন্ধু দুটি ছাপচিত্র দান করেছে, ঘরে টাঙিয়ে দিই। স্ত্রী হাউস-প্লান্ট করছে। আর্ট কালচারের অধ্যাপকদের মতো অনেক বই জোগাড় হয়েছে সৌন্দর্য বিষয়ে। গান হয়েছে। ফাঁকে ফাঁকে যামিনী, বার্গম্যান, তারকোভস্কি, ঋত্বিক…। জামাকাপড়ে আর্বান ডিজাইন হাউসের ফোক-মোটিভ, কোলাপুরি, কোকাকোলা, ভায়াগ্রা, শপিংমল, বার্গার, ম্যাগডোনাল্ড ইত্যাদি নিয়ে আমি যখন ঝকঝকে জীবনের স্বপ্ন গড়ছি, তখন আমাদের হাউজিং এস্টেটে রাতে একদল স্মার্ট হুলিগান এলো বেড়াতে। সারারাত হল্লা শুনলাম। আমাকে ডাকল। আমি যাইনি। ফোন করল কেউ সাহায্য চেয়ে, আমি যাইনি। ফোন করল কেউ সাহায্য চেয়ে, আমি ফোন রিসিভ করলাম না, পুলিশ স্টেশনে জানাতে বলল। রাজি হইনি। পাহারাদার রক্তাক্ত হয়ে পড়ে থাকল। আমি অ্যাম্বুলেন্স ডাকি না। নয়েজ টর্চার এড়াতে ঘরে তীব্র সরোদ চড়াই। হাউজিং এস্টেটের অন্যসব অধ্যাপক, শিল্পী, চিকিৎসক, দার্শনিকের ঘর থেকে ভেসে আসা মধ্যরাতের বিবিধ মেধাবী সংগীত একসময় হুলিগানদের স্বর এবং উচ্চারণ নিঃশেষ করে দেয়। আমাদের সৌন্দর্য-পুস্তক, আমাদের রবীন্দ্রনাথ, তারাশঙ্কর, জীবনানন্দ, বিভূতি, কাফকা, ক্যামু, মার্কসসহ আমাদের তাবৎ সারিবদ্ধ ডিসিপ্লিনড গ্রন্থগুলি জানালা দিয়ে দরজা ভাঙার শব্দ শুনতে শুনতে, চোখ মুদে গ্যাং রেপের দৃশ্য ভুলবার জন্য মেডিটেশন করে। পাশের অ্যাপার্টমেন্টের অবিবাহিত সোশ্যাল সাইনটিস্ট দাঁত চেপে গালি দেয়… ডিমিনিউশন অফ রেসপনসিবিলিটি! কথাটি আমি ইচ্ছে করে ভুলে যাই। যে জন্য সকল মূর্খতা নিয়ে সৌন্দর্যদায়ক এক রকিং চেয়ারে, ফিনেগান ওয়েক্স বুঝবার জন্য পুরো জীবন আমি হত্যা করি। এই আত্মাহুতির খবর ছড়িয়ে গেলে আমার খ্যাতি হয় খানিকটা। এবার বসন্তে একটি ফুল ফোটে আমার কবরে। দ্বিজেন শর্মার মতো কেউ খুঁজে পেতে আবিষ্কার করেন ফুলটির নাম নার্সিসাস। কবরজুড়ে ফুলেরা এখন খেলা করে আর সৌন্দর্য ছড়ায়।’ (পৃ ৮১)

সুন্দর কিছু দেখলেই কান্নাকাতর রঘুদাই কি মামুনকে তাড়িত করেছে ‘আর চোখে জল’ খুঁজতে? কত বিবিধ প্রকরণ ক্রন্দনের, আমাদের তা জানা ছিল না। আশ্চর্যভূমির এলিস নিজের কান্না পার হচ্ছিল সাঁতার দিয়ে – মনে করিয়ে দেন তিনি। আর তাঁর দুর্বলচিত্ত আনমনা হয়ে পড়ে নিমাই হালদারের কথা ভেবে। অনুভব করেন, কান্না তাঁকে হয়তো প্রথম ছুঁয়েছিল বাবার কবরস্থানে। উঁচু করে শিশু মামুনকে ধরা হয়েছিল বাবার মুখ দেখানোর জন্যে। তিনি কেবল আন্দাজ করতে পারেন সামান্য ভেজা তুলো জায়গা করে নিয়েছে বাবার নাসারন্ধ্রে। এইভাবে বহুদিন কান্না তাঁর করতলগত হয়, মায়ের অনুপস্থিতি দেখলে কাঁদেন তিনি, কাঁদেন ড্রয়িং টিচারের মুখে অবজ্ঞার হাসি দেখে, বন্ধুকে সজাগ করতে গিয়ে শিক্ষকের তীব্র আঘাতে কান্না ভুলে যান তিনি, কান্না ভুলে যান তার ‘তরুণতম বন্ধু রতন শিক্ষকমন্ডলীর সামনে পুণ্যলোভী ছাত্র সংগঠনের জিহাদি তরবারিতে চূর্ণ হয়ে গেলে’, পেজমার্কার বসিয়ে তিনি মনীষীবন্ধুদের ক্রন্দনচিন্তাকে দ্রষ্টব্য করে রাখেন, সম্পর্ক খোঁজেন কান্নার সঙ্গে মানুষের পরিত্রাণ পর্বের কিংবা আত্মপরিশুদ্ধির। বইয়ের মৃত্যু-আশঙ্কায় চাপা উল্লাস কিংবা গোপনক্রন্দন ছড়িয়ে পড়ার এই যুগে কান্না ভুলে অকস্মাৎ মামুন ধাবিত হন নিঃসঙ্গ গ্রন্থের দিকে, স্বার্থপরের মতো আরো অন্তত পঞ্চাশ বছর বইয়ের আয়ুষ্কাল প্রার্থনা করতে থাকেন। আত্মপ্রসাদ অনুভব করেন ভার্জিনিয়া উলফকে এই কথা লিখতে দেখে : ‘সবাইকে শেষ বিচারের কালে যখন পুরস্কৃত করা হচ্ছে, তখন ঈশ্বর পড়ুয়াদের দিকে তাকিয়ে বললেন, দেখো পিতর, এদের আর আমার কী পুরস্কার বরাদ্দ করব, আমাদের পুরস্কার দেবার কিছু নেই। এরা তো আসলে পড়তেই সবচেয়ে বেশি পছন্দ করত…।’ (পৃ ১০৭)

অতীতে প্রত্যাবর্তন নয়, আপাতনির্লিপ্ত এক ঘোরে কালের উজ্জ্বলতা আর নিষ্প্রভতায় পরিভ্রমণ করতে করতে মামুন আমাদের যেন দেখান বর্তমানের এই উপনিবেশ, যা নিদারুণ নিরুপায়তার। আমাদের সাহস নেই সেই ঔপনিবেশিক জাল ছিন্ন করার – আরো সত্যি করে বলতে গেলে, আমরা মনেই করি না আবদ্ধ হয়ে আছি নতুন এক উপনিবেশে। সেই উপনিবেশ কেমন, তার কিঞ্চিৎ অভিজ্ঞতা তিনি নিজেও পান পেশাগত জীবন থেকে, পাদ্রীশিবপুরে কিংবা পাবনায় গিয়ে। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, ধর্মের বৈকল্য আর নগরের বিকৃত পরিবর্ধন খুবলে খাচ্ছে মানুষকে, মানুষের মননকে, জীবনযাপনকে। সরকারি চাকরির সুবাদে তিনি যখন পাদ্রীশিবপুরে গিয়ে পৌঁছেন, রিটা গোমেজ জানতে চান তার কাছ থেকে, আদৌ থাকতে চান, নাকি শিগগিরই পালিয়ে যাবেন তিনি। মামুন ছিলেন, তা এক ব্যতিক্রমই বটে। ধর্মপ্রাণরা রুষ্ট হয়েছে, ‘মুসলিম ক্যান খ্রিষ্টানবাড়ির রান্না খাবে?’ রোষ এড়াতে রান্নার জন্যে খুঁজে বের করেছেন বিধবা নূরজাহানকে। উপসাগরীয় যুদ্ধ শুরু হয়েছে, ধর্মপ্রাণরা ঝাঁপিয়ে পড়েছে খ্রিষ্টানদের ওপর ‘বুশের অনুগামী’ বলে। নিরীহ স্বরে মামুন বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, খ্রিষ্ট পরিবারের সন্তান তারিক আজিজ, লড়ছেন বুশের বিরুদ্ধে। স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচন হচ্ছে, বিশপ তার সদস্য হিসেবে মনোনীত করেছেন আগন্তুক চিকিৎসককে, নির্বাচনের রাজনীতি শুরু হয়ে গেছে তা নিয়ে। বহিরাগত ছাপ এঁটে যাচ্ছে গায়ের ওপর, মামুন নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন সেখান থেকে। দূর্বাঘাসের মতো একপ্রস্থ দাড়ি এবং মাথায় তেলে ডোবানো টুপি পরে কেউ এসে স্ত্রীর শারীরিক দুর্বলতার জন্যে স্যালাইন চাইছে, সরকারি স্যালাইন কেবল ডায়রিয়া-কলেরা মোকাবিলার জন্যে, তাই না দেওয়াতে বাতাসে সংবাদ ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ‘খ্রিষ্টভক্তদের প্রতি মনোযোগ বেশি’ এই চিকিৎসকের। কী মনোবৈকল্য আমরা ছড়িয়ে রেখেছি আমাদেরই আবাসে, মামুন তা প্রতিদিন উপলব্ধি করেছেন পাদ্রীশিবপুরের জীবনযাপনের মধ্যে দিয়ে। রিটা গোমেজের নিরীহ জিজ্ঞাসা এমন এক জিজ্ঞাসা উত্তর দিয়েও যার নিষ্পত্তি করা যায় না। কিংবা যে-জিজ্ঞাসা জেগে ওঠে উত্তর জানা আছে বলেই। মামুনকে সে-জিজ্ঞাসার নিষ্পত্তি করতে হয়েছে প্রতিদিন থাকার মধ্যে দিয়ে। কিন্তু অর্জনও তো আছে, আছে প্রাপ্তি। কীর্তনখোলা পেরিয়ে শ্রীমন্তের পাড়ে পৌঁছলে বহুকাল পরে মনে পড়ে ‘সিদ্ধার্থে’র কথা, হেমন্তের অবিস্মরণীয় সব গান আর নদীর ওপর সিনেমাটোগ্রাফি চোখে জল এনে দেয়। যেন কমলকুমার প্রত্যাবর্তন করেন, ‘অতি গভীর মনের কথা কহিতে, চোখ নিজেই অক্ষরে পরিণত হয়।’ অস্তিত্বের সংকট দেখছেন খ্রিষ্টান মেয়ের চোখে, নামাজ পড়বে না ‘মিশা’য় আসবে বুঝতে পারছে না সে। নিজেকে পাপী ভাবছে সে। সকালে ঘুম ভাঙতেই কানে ভেসে আসছে, সমস্বর সংগীত, ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে…।’ সারা শরীরে-মগজে তার শিহরণ ছড়িয়ে পড়ে, ঘরে জানালা নেই, দক্ষিণের দরজা খুলে দেখেন ‘কপিক্ষেতের ঘাস-মাটিতে শত-শত মানুষ সাধু যোসেফের মঠের সামনে ধ্যানমগ্ন। দীর্ঘ ক্যাসাক, ক্রুশ গলায় ফাদার সার্মন দিচ্ছেন,… রবীন্দ্রনাথ, বোধ করি এমনটিই চাইতেন।’ সারা পল্লিতে নবান্নের আয়োজন। কোথাও প্রাচীন ঘণ্টার শব্দ। হঠাৎ করেই খুঁজে পেয়েছেন বাঙালি মুসলিম পরিবারের ঐতিহাসিক ফাঁক, ‘সকল সম্প্রদায়ে সংগীত যখন ধর্মচর্চার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী জড়িয়ে গেছে, তখন এখানে তা এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে সযত্নে।’ এ-ও ভেবেছেন, ‘সমগ্র ভারতীয় মার্গ-সংগীতে মুসলিমদের প্রবল দাপট সত্ত্বেও তা বাঙালি মুসলমান সমাজে বড় কোনো প্রভাব তখনই ফেলতে পারেনি।’ (পৃ ১২২) প্রশ্ন জেগেছে, ‘সংখ্যালঘু হিন্দু এবং বৌদ্ধও বটে, কিন্তু সমাজের তথাকথিত মাথাভারী লোকসকল, যেমন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক-চিকিৎসক-বুদ্ধিজীবী তথা প্রতিনিধিত্বশীল মানুষ এই দুটি সম্প্রদায় থেকে যে হারে বিদ্যমান, সেই তুলনায় শতবর্ষের ধর্মপল্লি ইউরোপীয় সাহেবদের সাহচর্য পাওয়া সত্ত্বেও এখনো শূন্যের কোঠায় কেন…।’ (পৃ ১২৪) ‘ফাদার সিয়ের্গি’কে নিয়ে ফাদারের সঙ্গে কোনোদিন কথা বলা হয়নি, এই অতৃপ্তি জমছে। আবার হেমায়েতপুর এসে ইনসেনিটি নিয়ে নিৎসের অনুভূতি লিখে রেখেছেন যে-পৃষ্ঠাটিতে, তার শেষে মোটা নিবের কলমে লিখে রাখছেন আত্মহননকারী ঠিকানাহীন সিজোফ্রেনিক ব্যক্তির পুরো নাম ও মৃত্যু তারিখ। কেউ আর আসেনি তার খোঁজখবর নিতে, অবস্থার উন্নতি ঘটার পরে সমাজকল্যাণের কর্মচারীরা যাকে ঠিকানা ধরে পৌঁছাতে গিয়ে জানতে পারে, ঠিকানাই বানোয়াট। বেদনাতপ্ত অভিজ্ঞতা, কিন্তু তাকে খুঁজতে প্রাণিত করছেন সেইন-ইনসেইনের বিভেদ।

কথা ইশারা এক বিষণ্ণ শক্তি হয়ে আমাদের ইন্ধন জোগায় প্রসন্ন হতে, সামনের দিকে এগোতে। মামুন হুসাইনের এ-গ্রন্থ আমাদের তাড়িত করে অতীতকে নতুন করে দেখতে, নতুন উপনিবেশের মুখোমুখি হতে, জিজ্ঞাসু হতে। যে-মুখ আমরা লুকিয়ে রেখেছি আমাদের থেকে, সে-মুখের উদ্ভাসে যেন হঠাৎ করেই শিমুল তুলোর বাউরি ওড়ে। উড়তে উড়তে রোদ পিঠে করে, পাঁচ আঙুলে চোখ বাঁচিয়ে আরো হাঁটতে ডাক দেয় আমাদের।

ইমতিয়ার শামীম

আপনারে এই জানা আমার ফুরাবে না...

১ comment

  1. রায়হান রশিদ - ১৯ জুলাই ২০১৫ (৬:০১ পূর্বাহ্ণ)

    “স্পর্শের জালে বিভোর হয়ে মুখবই দেখতে দেখতে বই হারিয়ে যাওয়ার উল্লাস তুলতে তুলতে সবাই যখন নিজেরাই লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে অদৃশ্য গহিন এক উপনিবেশে . . .”

    – কি অমোঘ সত্যকথন ইমতিয়ার ভাই!

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.