সেই আট বছর বয়সে আবদুল্লাহ-আল-মুতির বই থেকে আকাশ নিয়ে কৌতুহলের যে অভিযাত্রা, আজও তা অব্যাহত আছে। ৪০ হাজার কিলোমিটার ব্যাসের কমলালেবুটা লক্ষকোটি জীবজড়প্রানসমেত সেকেন্ডে ২৯ কিলোমিটার গতি নিয়ে সুয্যিমামার চারপাশে যে ঘুরে মরছে তার মায়া ছাড়িয়ে মহাশুন্যে উড়াল দিতে সেকেন্ডে ১১কিমি শক্তি লাগে, কী নিদারুন ভালোবাসা বুকে তার!
বিশ্বের আর কোথাও এমন সুন্দর গ্রহ আছে কি না জানি না, কিন্তু আশেপাশের গ্রহগুলোর চেয়ে পৃথিবীর রূপ যে অনেক বেশী মোহনীয়, লোভনীয় কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু সে রূপের রহস্য কী। সে রূপের কথা কী আমরা মনে রাখি? পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য কী?
আকাশ। হ্যাঁ আকাশের চেয়ে সুন্দর, আকাশের চেয়ে বড় বন্ধু আমাদের আর কেউ নেই।
এমন সুন্দর নীল আকাশ ত্রিভুবনে কোথাও আছে কি না জানি না। তবে সৌরজগতের অন্য কোন গ্রহে যদি আমাদের জন্ম হতো, তাহলে সারাজীবন বঞ্চিত থেকে যেতাম এমন সুন্দর একটা আকাশ থেকে। চাঁদের আকাশ দেখেছেন? কী কদাকার লাগে কালো আকাশে খরখরে তপ্ত সুর্যের আলো দেখতে। আকাশে মেঘের ভেলা নেই, বাতাসে ফুলের গন্ধ নেই। কী নিদারুন বেরসিক বৈচিত্রহীন জায়গা। ভাবা যায়?
কিন্তু এই নীল আকাশটা এত মূল্যবান তা কি আমরা উপলব্ধি করি কখনো? আকাশ দেখতে পয়সা লাগেনা। রাজপুত্র থেকে ভিখিরি পর্যন্ত সবার জন্য ফ্রী। এত সহজলভ্য বলেই হয়তো আমরা ভুলে থাকি কত মূল্যবান একটা জিনিস আমাদের আছে। আমরা প্রত্যেকেই এটার মালিক। কেউ এককভাবে আকাশ দখল করে বলতে পারবে না, “যাও ভাগো আমার আকাশ থেকে, তৃতীয় বিশ্বের নাদান বালক তুমি, ভিসা দেবো না তোমাকে আমি।”
এমনকি যদি এমনও হতো যে আমাকে ঠিকেট দিয়ে আকাশে মেঘের খেলা দেখতে হবে। তাহলে আমি বোধহয় প্রতি সপ্তাহে টাকা জমাতাম আকাশ দেখার ঠিকেটের জন্য। পৃথিবী আমার প্রিয় বাসভুমি এই নীল আকাশটার জন্যই।
আমাদের এই নীল আকাশটা অনেকগুলো চাদরের সমষ্টি। একটার পর একটা বিছানো। আমাদের নিরাপত্তা বিধানের জন্য। এই চাদরগুলো না থাকলে পৃথিবীটা একদিনেই ধ্বংস হয়ে যেতে পারতো। প্রতিনিয়ত আমাদের উল্কাপাত থেকে রক্ষা করছে এই চাদর। আবার এই আকাশ আমাদের সূর্যের প্রচন্ড তাপের হাত থেকেও রক্ষা করছে, অতিবেগুনী রশ্মিকে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে ঢুকতে বাধা দিচ্ছে।
কিন্তু এই নীল চাদর বা বায়ুমন্ডলের গঠনটা আমার কাছে খুব রহস্যময়। দেখা যাক কেন।
যাকে আমরা আকাশ কিংবা বায়ুমন্ডল বলছি তা সমুদ্রপৃষ্ট থেকে ১০০০০কিমি পর্যন্ত বিস্তৃত এবং কয়েক ভাগে বিভক্ত। সবচেয়ে উপরের অংশকে বলে Exosphere সবচেয়ে বেশী পুরু ৬৯০ থেকে ১০০০০কিমি পর্যন্ত বিস্তৃত। এখানে বস্তুর উপস্থিতি খুব নগন্য। সুর্যের আলো প্রবেশের প্রথম ধাপ। স্বভাবতই বায়ুমন্ডলের সবচেয়ে বেশী উত্তপ্ত জায়গা। মধ্যাকর্ষনের জোরাজোরি তেমন নেই। বস্তুকনারা স্বাধীন আসা যাওয়া করতে পারে।
আরেকটু নীচে নামলে পাই Thermosphere অঞ্চল। বিশাল জায়গা। ১০০কিমি থেকে ৬৯০কিমি পর্যন্ত বিস্তৃত। এই অংশে তাপমাত্রা কিছুটা কম। অবস্থাভেদে ১৫০০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড থেকে ২৫০০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড পর্যন্ত হতে পারে। এই কম(!) তাপেও লোহা গলে যাবে। এই লেভেলটা সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ন অঞ্চল আমাদের জন্য। পৃথিবীর তথ্য প্রবাহের প্রধান সড়ক এটি। সমস্ত যোগাযোগ উপগ্রহের বাসস্থান এখানে। এই লেখাটাও হয়তো ওই সড়ক ধরে আপনাদের কাছে পৌছাবে।
পরের লেভেলে নামা যাক। এটার নাম Mesosphere এটি প্রায় ৩৫ কিমি পুরু। তাপমাত্রা এখানে হঠাৎ করে মাইনাস ১০০-তে নেমে গেছে। এটা একটা আশ্চর্য ব্যাপার। মুলতঃ এই চাদরটার কারনেই আমরা বেঁচে আছি এখনও। বহিঃজগতের উল্কা-টুল্কাগুলো এই ঠান্ডা চাদরের কবলে পড়েই খাবি খেতে খেতে নিভে যায়। রাতের আকাশে তাকালে মাঝে মাঝেই এসব জ্বলতে জ্বলতে পড়া আতশবাজি চোখে পড়বে।
পরের চাদরটার নাম Stratosphere, এটা ৩০কিমি ঘনত্ব বিশিষ্ট। ২০ থেকে ৫০কিমি অঞ্চলে অবস্থিত। এখানে তাপ বাড়তে শুরু করেছে আবার। মাইনাস ৩ ডিগ্রী। এই লেভেলটার সবচেয়ে উপকারী কাজ হলো পৃথিবীকে সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মি থেকে আমাদের রক্ষা করা। হ্যাঁ, বহুল কথিত ওজোন স্তর এখানেই অবস্থিত।
সর্বনিন্ম অর্থাৎ পৃথিবীর সবচেয়ে নিকটতম চাদর হলো Trophosphere সমুদ্রপৃষ্ট থেকে ৭কিমি থেকে ২০কিমি উচ্চতার মধ্যে এর অবস্থান। আকাশের দৃশ্যমান সকল সৌন্দর্য এই অঞ্চলেই অবস্থিত। সকল কবিতা-গান-বিরহ-প্রেম, রাশি রাশি মেঘমালা, সবকিছু। এই আকাশের প্রেমেই মশগুল আমরা। সবচেয়ে বৈচিত্রময় অঞ্চল এবং বায়ুমন্ডলের তিন-চতুর্থাংশ বস্তুর অবস্থানও এখানে। Trophosphere এলাকায় মজার ব্যাপার হলো তাপমাত্রা এখানে উচ্চতার সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়। ৬-১১কিমি লেভেলে নীচ থেকে যত উপরে উঠবেন প্রতি কিলোমিটারে ৬.৫ডিগ্রী করে তাপ কমতে থাকে। আবার ১১-২০কিমি লেভেলে তাপ স্থির মাইনাস ৫৬.৫ ডিগ্রীতে।
আমার সবচেয়ে অবাক লাগে বায়ুমন্ডলের চাদরে চাদরে তাপের ওঠানামা। একদম সমুদ্রপৃষ্ট থেকে যদি ধরি, তাহলে পৃথিবীপৃষ্ঠে গড় ১৫ডিগ্রী থেকে শুরু। তারপরঃ
১১-২০কিমি = – ৫৬.৫ ডিগ্রী
২০-৫০কিমি = -৩ ডিগ্রী
৫০-৮৫কিমি = -১০০ডিগ্রী
৮৫-৬৪০কিমি = +১৫০০ ডিগ্রী
বিস্ময়ের ব্যাপার না? সুর্যের আলো ছাড়া পৃথিবীর সবকিছু অচল। আবার সেই সুর্যের তাপে যেন আমরা ঝলসে না যাই সেজন্য কী চমৎকার ব্যবস্থাপনায় ঠান্ডা গরমের চাদর দিয়ে সহনশীল তাপমাত্রা সৃষ্টি করা হয়েছে পৃথিবীতে। এখানেই নীড় সন্ধান করি তাই চিরকাল। ফিরে ফিরে আসতে চাই এই নীলাকাশ শোভিত পৃথিবীতে। আকাশের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
১০ comments
ইমতিয়ার - ২১ অক্টোবর ২০০৮ (১২:০০ অপরাহ্ণ)
আকাশের এই বর্ণনা স্কুলজীবনে মাস্টারমশাইদের গলায় অবশ্য তত ভালো লাগেনি। তবে নীড়সন্ধানীর এ লেখাটা এখন ভালো লাগছে। ধন্যবাদ।
নীড় সন্ধানী - ২২ অক্টোবর ২০০৮ (৮:২৩ পূর্বাহ্ণ)
লিখেছিলাম নিজের জন্য। শেয়ার করেছি আর কারো ভালো লাগার সাথে মিলে কিনা দেখতে। আপনার ভালে লেগেছে, আমি সার্থক।
সৈকত আচার্য - ২১ অক্টোবর ২০০৮ (১১:১১ অপরাহ্ণ)
নীড় সন্ধানী এবার পৃথিবী ছেড়ে একেবারে মহাশূন্যে। থাকুন না কিছুদিন ওখানে। কিছুদিন না হয় মহাকাশ বার্তা শুনি আপনার কাছে। ইচ্ছে হয়, কিছুদিন বেরিয়ে আসি, এই রূপসী পৃথিবী ছাড়িয়ে শূন্যে, মেঘের অনেক উর্দ্ধে, নক্ষত্র খচিত আলো আঁধারী ছায়াপথে চির রহস্যময় অনন্ত মহাশূন্যে।
নীড় সন্ধানী - ২২ অক্টোবর ২০০৮ (৮:২৯ পূর্বাহ্ণ)
মাঘ নিশীথের রাতঘুমে মহাশূন্যের দুর গ্যালাক্সী তে হারিয়ে যাই মাঝে মাঝে। আপনার নিমন্ত্রন রইল। নিঃসন্দেহে ভালো লাগবে।
সৈকত আচার্য - ২৫ অক্টোবর ২০০৮ (১২:০৬ অপরাহ্ণ)
আপনার নিমন্ত্রণ কবুল করলাম। বাহনটা কি পাঠিয়ে দেবেন প্লিজ!
রায়হান রশিদ - ২৫ অক্টোবর ২০০৮ (১:০২ অপরাহ্ণ)
আমিও, আমিও . . .
নীড় সন্ধানী - ২৬ অক্টোবর ২০০৮ (২:৩৬ পূর্বাহ্ণ)
বাহন নিশ্চয়ই আসবে। সৈকত ও রায়হান নামে দুটো টিকিটের বুকিং দিয়ে রাখছি। এক্সিট ভিসা পেলেই চলে আসবেন।
সৈকত আচার্য - ২৬ অক্টোবর ২০০৮ (৩:১৬ পূর্বাহ্ণ)
যাকগে বাহন তাহলে পাওয়া গেল! আর একটা চিন্তা হচ্ছিল আসলে। ওখানে যাওয়ার জন্য তো বিশেষ মহাকাশ স্যুট পরতে হয়। তবে নীড় সন্ধানীকে আর বিরক্ত করতে চাই না। কাল নিজেই চলে যাব বঙ্গবাজারে, দেখি ঐ রকম কাছাকাছি কোন কিছু পাওয়া যায় নাকি!
mahtab - ২৪ অক্টোবর ২০০৮ (৯:১৮ অপরাহ্ণ)
আপনার লেখাটা আমাকে মহাকাশের প্রতি নতুন করে ভাবাল
sadakalo - ২ জুন ২০০৯ (১২:৪৫ অপরাহ্ণ)
আমার জন্য একটা সিট হবে কি? আমার শূন্যতার সাথে মহাশূন্যের তফাত দেখতে চাই।