হেনরি এভারি এবং ইতিহাসের বৃহত্তম জাহাজ শিকার

১৬৯৫ সালের আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহ। লোহিত সাগরের এক আগ্নেয় দ্বীপে মরুভূমির গরমে/ তপ্ত লু হাওয়া বইছে। সেই দ্বীপের খাঁড়িতে ছিপ ফেলে স্থির বসে আছে অদ্ভুত এক শিকারী। লোহিত সাগরের দক্ষিণ অংশটা যেখানে আরব সাগরের সাথে মিশেছে ঠিক সেই প্রণালীতে ইয়েমেন আর জিবুতির উপকূল মুখোমুখি দাঁড়ানো। প্রণালীটির নাম বাবেল মান্দেব। ওই প্রণালীর ইয়েমেনের প্রান্ত থেকে দুই পা বাড়ালে পেরিম(Perim) নামক কাঁকড়া চেহারার খটখটে একটি আগ্নেয় দ্বীপ আছে। সেই দ্বীপের এক খাঁড়িতে ওঁত পেতে বসে থাকা শিকারীর নাম 'ফেন্সি'(Fency)।

১৬৯৫ সালের আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহ। লোহিত সাগরের এক আগ্নেয় দ্বীপে মরুভূমির গরমে/ তপ্ত লু হাওয়া বইছে। সেই দ্বীপের খাঁড়িতে ছিপ ফেলে স্থির বসে আছে অদ্ভুত এক শিকারী।

লোহিত সাগরের দক্ষিণ অংশটা যেখানে আরব সাগরের সাথে মিশেছে ঠিক সেই প্রণালীতে ইয়েমেন আর জিবুতির উপকূল মুখোমুখি দাঁড়ানো। প্রণালীটির নাম বাবেল মান্দেব। ওই প্রণালীর ইয়েমেনের প্রান্ত থেকে দুই পা বাড়ালে পেরিম(Perim) নামক কাঁকড়া চেহারার খটখটে একটি আগ্নেয় দ্বীপ আছে। সেই দ্বীপের এক খাঁড়িতে ওঁত পেতে বসে থাকা শিকারীর নাম ‘ফেন্সি'(Fancy)।

ফেন্সি, ১৫০ জলদস্যু সমৃদ্ধ ৪৬ কামানের শক্তিসম্পন্ন অতুলনীয় দ্রুতগতির একটি ইংলিশ জাহাজ। শিকারের অপেক্ষায় ফেন্সির সাথে আছে আরো পাঁচটি জলদস্যু জাহাজ- ‘অ্যামিটি’, ‘পোর্টসমাউথ এডভেঞ্চার’, ‘ডলফিন’, ‘পার্ল’ এবং ‘সুসানা’। ছয় জাহাজের মোট জলদস্যু সংখ্যা ৪৪০ জন। এই বিশাল বাহিনী যে শিকারের জন্য অপেক্ষা করছে সেটি আরো বেশী শক্তিশালী। এত শক্তিশালী শিকারকে কব্জা করার চেষ্টাকে অতি দুঃসাহসী কাজ বলা যায়। এই ভারত মহাসাগরে জাহাজ ডাকাতির ঘটনা শতবর্ষ পুরোনো। শত শত জাহাজ শিকার করেছে ভিন মহাদেশ থেকে আগত জলদস্যুরা। কিন্তু আজকের শিকারটি অতীতে ঘটে যাওয়া সকল শিকার অভিযানের চেয়ে আলাদা। এমনকি পৃথিবীতে ইতিপূর্বে যতগুলো জলদস্যুতার ঘটনা ঘটেছে তার সবগুলোর মধ্যে এই ঘটনা নজিরবিহীন। এত বড় শক্তিশালী শিকারকে ইতিপূর্বে কেউ টার্গেট করেনি। এ যেন এক গণ্ডা শেয়ালের সিংহ শিকার প্রচেষ্টা।

যাদের জন্য এমন দুঃসাহসী পরিকল্পনা করে ওঁত পেতে আছে তারাও একা নয়। ওখানে আছে ২৫ জাহাজের বিশাল এক বহর। হজ্জযাত্রী নিয়ে আরবের মক্কা নগরী থেকে রওনা দিয়েছে ভারতের উদ্দেশ্যে। লোহিত সাগর পেরিয়ে সুরাট বন্দরের দিকে যাত্রা করবে। সেই বহরের সবচেয়ে শক্তিশালী জাহাজটি ১৬০০ টন ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন ‘গঞ্জ-ই-সাওয়াই’ (Ganj-i-Sawai)। যার নিজস্ব প্রতিরক্ষার জন্য আছে ৮০টি শক্তিশালী কামান এবং ৪০০ জন বন্দুকধারী সৈন্য। বহরের মধ্যে এই জাহাজটি সবচেয়ে অভিজাত। এটি সবচেয়ে বেশী যাত্রী ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন। জাহাজে যাত্রীর সংখ্যা ৬০০ জন যার বড় একটা অংশ নারী। সেই জাহাজের প্রতিরক্ষার জন্য সাথে আছে ৬০০ টন ধারণক্ষমতাসম্পন্ন আরেকটি সশস্ত্র জাহাজ ‘ফতেহ মোহাম্মদ’। ফতেহ মোহাম্মদের সাথে লড়তে পারে তেমন জাহাজও ভারত মহাসাগরে বিরল ছিল।

এটা আরবের হজ্জ মৌসুম। এই মৌসুমে লোহিত সাগর দিয়ে প্রতি বছরই হজ্জযাত্রী নিয়ে আসা যাওয়া করে অনেক জাহাজ। অভিজ্ঞতা থেকে জলদস্যুরা জানতো জাহাজগুলো কোন সময় এই প্রণালীমুখ অতিক্রম করবে। ওই পথে চলাচলকারী হজ্জযাত্রীবাহী জাহাজগুলোরও জানা ছিল লোহিত সাগর সংলগ্ন অঞ্চলটিতে জলদস্যুতার ঘটনা ঘটে অহরহ। বিপজ্জনক এলাকা বলে জাহাজগুলো দল বেঁধে চলাচল করে। সব জাহাজে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মজুদ থাকে। ষোড়শ শতকের শুরু থেকে ভারত মহাসাগরে ইউরোপীয়ান জাহাজের আনাগোনা শুরু হবার পর থেকে নিরাপদ সমুদ্র ব্যাপারটা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। ডাকাতির আশংকা মাথায় রেখেই সমুদ্রযাত্রা করতে হতো এই অঞ্চলের জাহাজগুলো থেকে। তবে ‘গঞ্জ-ই-সাওয়াই’র মতো এতবড় শক্তিশালী জাহাজের বিরুদ্ধে লড়াই করার মতো শক্তি পৃথিবীর কোন জলদস্যু জাহাজের নেই বলে জানা আছে সবার। এমনকি ফতেহ মোহাম্মদের সাথেও লড়াই করে টিকে থাকতে পারবে তেমন জাহাজও খুব বেশী নেই। সে সময় গঞ্জ-ই-সাওয়াই জাহাজটি যে কোন দেশের সেরা যুদ্ধ জাহাজের চেয়েও শক্তিশালী ছিল।

কিন্তু শক্তিই সব কথা নয়। তারও উপর আছে কৌশল আর ধূর্ততার খেলা। সেই খেলার এক বিপজ্জনক পরিকল্পনা করে বসে আছে হেনরি এভারি নামের এক বৃটিশ জলদস্যু। সেই দস্যু এই অভিযানের সবচেয়ে দ্রুতগামী শক্তিশালী জাহাজ ‘ফেন্সি’র মালিক।

লোহিত সাগরের ভৌগলিক অবস্থা যারা জানেন তারা নিশ্চয়ই দেখেছেন লোহিত সাগর থেকে আরব সাগরে যাবার যে সরু প্রণালীটি রয়েছে তার মুখে পেরিম নামের ছোট্ট পাথুরে দ্বীপটি লোহিত সাগরের শেষ মাথায় একটা পাহারাদার হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নিশ্চিতভাবেই জলদস্যুদের অপেক্ষা করার জন্য পরম সুবিধাজনক একটি অবস্থান। অ্যামবুশ করার জন্য এর চেয়ে ভালো জায়গা এই অঞ্চলে দ্বিতীয়টি নেই। হেনরি এভারি সেই সুযোগটি নিয়ে এখানে পাহারা বসিয়েছে ‘গঞ্জ-ই-সাওয়াই’কে ধরার জন্য। গত দুই শতকে আরব বাণিজ্য জাহাজগুলোকে ভারত মহাসাগর থেকে এক প্রকার উচ্ছেদ করে দিয়েছে পর্তুগীজরা। পর্তুগীজ জাহাজের ভয়ে আরব জাহাজগুলো বাংলার সাথে বাণিজ্য করা ভুলেই গেছে, ভারতের অন্য অঞ্চলের সাথেও খুব সীমিত চলাচল। ষোড়শ শতকের শুরু থেকে পর্তুগীজ জাহাজের উৎপাত শুরু হবার পর থেকে নিয়ম চালু করা হয়েছিল ভারত মহাসাগরে যেসব জাহাজে পর্তুগীজদের ছাড়পত্র (Cartaz নামে পরিচিত ছিল সেই ছাড়পত্র) থাকবে না, সেসব জাহাজ পর্তুগীজদের হামলার শিকার হবে। সমুদ্রগামী যে কোন জাহাজকে তখন এই ছাড়পত্র নিয়ে চলতে হতো সমগ্র ভারত মহাসাগর অঞ্চলে। পর্তুগীজদের উৎপাতে আরব জাহাজগুলোর চলাচল কমে গেলেও ভারতীয় এবং পারস্যের জাহাজগুলো কার্তাজ নিয়ে চলাচল করতো বাণিজ্য এবং যাত্রী নিয়ে। তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো হজ্জযাত্রী পরিবহন। বছরে একবার ভারত থেকে একদল হজ্জযাত্রী জাহাজ বহর নিয়ে মক্কা নগরীতে হজ্জ পালন করতে যেতো। সেই জাহাজগুলোকে যেন কোন বাধা দেয়া না হয় সে জন্য কার্তাজ সিস্টেম মেনে নিয়েছিল সবাই, এমনকি মহাশক্তিধর মোগলরাও। বোঝাপড়ার ভিত্তিতে মোটামুটি নিরাপদেই হজ্জযাত্রী পারাপার করতো ভারতীয় জাহাজগুলো।

শিকারের কথায় ফিরে আসা যাক। আগস্ট শেষ হয়ে সেপ্টেম্বর শুরু। একদিন ফেন্সির ডেক থেকে দূরবীন লাগিয়ে দেখা গেল কাঙ্খিত শিকার এগিয়ে আসছে লোহিত সাগরের উত্তর প্রান্ত থেকে। পেরিম দ্বীপের খাড়িতে লুকোনো শিকারী জাহাজগুলো দেখতে পেলো কাছাকাছি এসে গেছে শিকার। তবু চুপ করে বসে থাকল শিকারী জাহাজগুলো। চোখের সামনে একে একে ২৩টি জাহাজ এগিয়ে পার হয়ে গেল নির্বিঘ্নে। এরপর দেখা গেল সেই কাঙ্খিত জাহাজ ‘গঞ্জ-ই-সাওয়াই’কে। বিপুল আকার এবং অনুপম সৌন্দর্য নিয়ে গর্বিতভাবে পাল উড়িয়ে পার হয়ে যাচ্ছে প্রণালী। তার ঠিক পেছনে আছে দ্বিতীয় শক্তিশালী জাহাজ ‘ফতেহ মোহাম্মদ’। পাহারা জাহাজ হয়ে সবার পেছনে থেকে গোটা দলটাকে আগলে নিয়ে যাচ্ছে সশস্ত্র এবং সতর্ক ফতেহ মোহাম্মদ।

‘ফতেহ মোহাম্মদ’ পার হয়ে যাবার পর হেনরি বাহিনী নড়েচড়ে বসলো। আর দেরী করা যায় না। নইলে শিকার ফসকে যাবে। তখনো সুরাটের পথ অনেক বাকী, ধাওয়া করে ধরে ফেলা কোন ব্যাপার না। হেনরি এভারি সঙ্গীদের নির্দেশ দিল দ্রুত এগিয়ে যেতে। আক্রমনের প্রথম শিকার হবে ফতেহ মোহাম্মদ। এটাকে পেছন থেকে আক্রমণ করে কাবু করা যাবে। ফতেহ মোহাম্মদকে কাবু করা গেলে নিরাপদে ধাওয়া করা যাবে ‘গঞ্জ-ই-সাওয়াই’কে। কিন্তু শুরুতে ফতেহ মোহাম্মদের সাথে লড়াইয়ে পেরে উঠলো না জলদস্যু জাহাজগুলো। একের পর এক পিছিয়ে পড়তে থাকলো।

হেনরি বাহিনীর বড় একটা ক্ষতি হলো এই যুদ্ধের শুরুতে। গোলাগুলিতে এই বহরের সবচেয়ে অভিজ্ঞ জলদস্যু অ্যামিটির ক্যাপ্টেন টিউ নিহত হলো। ডলফিন জাহাজটিও পিছিয়ে পড়লো গতির কারণে। উপায়ান্তর না দেখে অ্যামিটি ও ডলফিনের দস্যুরা ফেন্সিতে উঠে গেল।

ওদিকে এই অবকাশে ফতেহ মোহাম্মদ দ্রুত অনেকদূর এগিয়ে গেছে। কিন্তু বেশীদূর এগোতে পারলো না। এবার হেনরি মরিয়া হয়ে ফেন্সিকে নিয়ে ছুটতে শুরু করলো। ফেন্সির গতি সর্বোচ্চ তখন। ছুটতে ছুটতে পাঁচ দিনের মাথায় ফতেহ মোহাম্মদকে ধরে ফেললো ফেন্সি। এটাকে কাবু করতে পারলে অর্ধেক কাজ শেষ। একের পর গোলা ছুটলো ফেন্সির কামান থেকে। আগের জাহাজগুলোর মোকাবেলা করতে সমস্যা না হলেও ফেন্সির গোলা ফতেহ মোহাম্মদকে কাহিল করে দিল। গোলার তাণ্ডবে অল্প সময়ের মধ্যেই ফতেহ মোহাম্মদ আত্মসমর্পণে বাধ্য হলো। জাহাজটি দখল করে নিল হেনরি বাহিনী। জাহাজে উঠে ইচ্ছেমতো লুটপাটে মেতে উঠলো হেনরীর বাহিনী। এই জাহাজের মালিক গাফফার নামে এক ধনী ভারতীয় মুসলমান। ফতেহ মোহাম্মদের এত সম্পদ ছিল যে সেটা দিয়ে হেনরির ফেন্সিকে পঞ্চাশবার কেনা যাবে। লুট করা সম্পদগুলো বিলি করে দেয়া হলো সব দস্যুদের মধ্যে। কিন্তু দস্যুদের সংখ্যা এত বেশী যে তাদের প্রত্যেকের ভাগে যা পড়লো তাতে কেউ তেমন সন্তুষ্ট হতে পারেনি।

বসে থাকা যাবে না। আবার ছুট দিল জলদস্যুদল। আসল কাজ তখনো বাকী। আসল টার্গেট তো এই বহরের সিংহ জাহাজ ‘গঞ্জ-ই-সাওয়াই’। ওই সিংহকে কব্জা করা এই শেয়ালের পালের পক্ষে কতটা সম্ভব কেউ জানে না। কিন্তু সেই কঠিন কাজটিতে সফল হতেই হবে। জীবনে এত বড় সুযোগ আর কখনো আসবে না। হেনরি সহ সবাই জানে ওই জাহাজটি মোগল ভারতের গর্ব। ওই জাহাজের মধ্যে অনেক মূল্যবান ধনসম্পদ থাকার কথা।

‘গঞ্জ- ই-সাওয়াই’ জাহাজের প্রধান ছিল দুর্ধর্ষ মোগল কাপ্তেন ইব্রাহীম। যার অধীনে ছিল ৮০টি কামানের গোলন্দাজ বাহিনী এবং ৪০০ বন্দুকধারী সৈন্যদল। তাকে পরাস্ত করা সহজ ব্যাপার নয়। যুদ্ধে জেতা দূরে থাক, তার মুখোমুখি হওয়াও ভয়ানক বিপজ্জনক কাজ। তবু ঝটিকা আক্রমনে পিছু ধাওয়া শুরু করলো Fancy, Pearl এবং Portsmouth Adventure.

শুধু গোলাগুলিতে পেরে ওঠা যাচ্ছে না গঞ্জ-ই-সাওয়াইর সাথে। ফেন্সির দ্বিগুণ শক্তি ওই জাহাজে। তাই ভিন্ন কৌশলে এগোলো হেনরি। গোলাগুলি করতে করতে গঞ্জ-ই-সাওয়াই জাহাজের পাশাপাশি চলে আসলো। সেই সময়ে একটা কৌশলী আক্রমন চালালো হেনরি। এবার তার কামানের লক্ষ্য হলো গঞ্জ-ই-সাওয়াই জাহাজের প্রধান মাস্তুল। একের পর এক গোলা ছুঁড়তে থাকলো মাস্তুল লক্ষ্য করে। ওই জাহাজের গতি একটা বড় শক্তি। সেই গতিকে দমাতে পারলে জাহাজটিকে পরাস্ত করা সহজ হবে। ছুটতে ছুটতে ফেন্সিকে প্রায় পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছিল জাহাজটি। কিন্তু একটি গোলা গিয়ে আঘাত করলো প্রধান মাস্তুলের মাঝামাঝিতে। সেই গোলাতেই জাহাজটির গতির দফারফা হয়ে গেল।

মাস্তুল ভেঙ্গে পড়ার পর জাহাজটির পালাবার উপায় থাকলো না। হেনরি তার জাহাজকে কাছাকাছি নিয়ে গায়ে গা লাগিয়ে দিলে জলদস্যুরা ‘গঞ্জ-ই-সাওয়াই’তে উঠতে চেষ্টা করলো। তখন তাদেরকে জাহাজের বন্দুকধারী যোদ্ধারা প্রতিরোধ করার চেষ্টা করলো। প্রাথমিকভাবে মোটামুটি ভালোই প্রতিরোধ গড়েছিল। কিন্তু হঠাৎ করে গঞ্জ-ই-সাওয়াই জাহাজের শক্তিশালী একটি কামান বিস্ফোরিত হয়ে আগুন লেগে গেল এবং তাতে বেশ কিছু হতাহত হলো। আকস্মিক ওই বিপর্যয়ে যোদ্ধারা হতভম্ব হয়ে গেল। তারপর জাহাজের আগুন নেভানোর কাজে ছুটে গেল সবাই। সেই সুযোগে হেনরি বাহিনী গঞ্জ-ই-সাওয়াই জাহাজে উঠে গেল তরতর করে। শুরু হলো হাতে হাতে যুদ্ধ। ভারতীয় যোদ্ধাদের সাথে কয়েক ঘন্টার হাতাহাতি যুদ্ধ চললো জাহাজের ডেকে। কিন্তু প্রবল হিংস্র জলদস্যুদের সাথে পেরে উঠলো না। ভারতীয়দের পরাজিত করে পুরো জাহাজই কব্জা করে নিল হেনরি বাহিনী। সুরাট বন্দরে পৌঁছার আটদিন বাকী থাকতেই ফেন্সির জলদস্যুদের হাতে চলে এল বিশ্বের সবচেয়ে বিলাসবহুল আধুনিক জাহাজটি। সেদিন ছিল ৭ সেপ্টেম্বর ১৬৯৫।

এরপর গঞ্জ-ই-সাওয়াই জাহাজের আরোহীদের জন্য অপেক্ষা করছিল সবচেয়ে মর্মান্তিক পর্বটি। জাহাজে উঠে জলদস্যুদল নিষ্ঠুরতম লুটতরাজ ও রাহাজানির নজির সৃষ্টি করলো। দস্যুদের হাতে সম্ভ্রম হারালো অনেক নারী, সম্ভ্রম বাঁচাতে আত্মহত্যা করলো অনেকে, যারা বেঁচে ছিল তাদের উপর দিনের পর দিন নারকীয় তাণ্ডব চালানো হলো। দশদিন ব্যাপী সেই লুটের উৎসবে ধর্ষিত হলো জাহাজের প্রায় সব বয়সের নারীগণ যার মধ্যে মোগল বাদশার পরিবারের কেউ কেউ ছিল বলে জানা যায়। সর্বস্ব হারিয়েও বাঁচতে পারেনি অনেক নারী পুরুষ। অনেক নারীকে ধরে নিয়ে যাওয়া হলো ফেন্সি জাহাজে। তাদের কথা পরবর্তীতে আর কেউ জানতে পারেনি।

সমগ্র জাহাজে লুটতরাজ চালিয়ে যে পরিমাণ ধন সম্পদ রত্নরাজি হরণ করা হয়েছিল তা সেই যুগের হিসেবে প্রায় ৬০০,০০০ পাউণ্ডের সমতূল্য। জলদস্যুতার ইতিহাসে এত বড় ঘটনার নজির আর একটিও নেই। ইতিহাসের সবচেয়ে বড় জলদস্যুতার ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হলো সারা দুনিয়ায়।

মোগলদের জন্য ঘটনাটি রীতিমত সাম্রাজ্যের উপর আঘাতের শামিল। কারণ ‘গঞ্জ-ই-সাওয়াই’ নামের ওই জাহাজটির মালিক ছিলেন স্বয়ং দোর্দণ্ড প্রতাপশালী মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেব।

কে এই হেনরি এভারি?

এই ভয়ানক দুঃসাহসী ঘটনার নায়ক হেনরি এভারি কে? এই ঘটনার আগে তাকে ভারত মহাসাগর এলাকায় কেউ চিনতো না। জলদস্যুতার ইতিহাসে তার চেয়ে বড় ত্রাস সৃষ্টিকারী জলদস্যুও আছে। কিন্তু হেনরির মতো এত ভয়ানক দুঃসাহসী জাহাজ ডাকাতি আর কেউ করতে পারেনি। মাত্র দুবছর সক্রিয় থেকে ১১টি জাহাজ ডাকাতির ঘটনা ঘটিয়েছিল হেনরি। যার মধ্যে ‘গঞ্জ-ই-সাওয়াই’ সবচেয়ে সেরা। এত বিপুল সম্পদ সমৃদ্ধ জাহাজ আর কেউ ছিনতাই করেনি। হেনরির ওই রেকর্ড কেউ ভাঙ্গতে পারেনি। হেনরির নাম পরিচয় ইত্যাদি স্থান-কাল-পাত্র ভেদে পাল্টে যেতো। কখনো Captain Bridgeman, কখনো Henry Every, কখনো বা Long Ben নামে নিজেকে পরিচয় দিত।

সপ্তদশ শতকের অন্যতম দুঃসাহসী জলদস্যু এই হেনরি এভারি জন্মেছিল ১৬৫৩ সালে ইংল্যাণ্ডের প্লাইমাউথে। কেউ বলেন জন্মের সময় তার পারিবারিক নাম ছিল বেঞ্জামিন ব্রিজম্যান। হেনরি এভারি তার নিজের নেয়া ছদ্মনাম যা নৌবাহিনীতে যোগ দেবার সময় থেকে ব্যবহার করতে শুরু করেছিল। এই নামেই তার পরিচিতি বেশি। তবে জলদস্যুতার ঘটনা ঘটাবার সময় সে নিজেকে ক্যাপ্টেন ব্রিজম্যান হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করতো। হেনরির এভারির পেশাদারী জীবনের হাতেখড়ি হয়েছিল বৃটিশ রাজকীয় নৌবাহিনীতে। নাবিক হিসেবে রয়েল নেভিতে কাজ শুরু করার পর নানান অভিযানের সাথে যুক্ত হয় হেনরি। একসময়কার রয়েল নেভির ক্যাপ্টেন হেনরি ১৬৭১ সালে আলজিয়ার্সের যুদ্ধে গোলাবর্ষণের কাজে যেমন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে, তেমনি আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের দুঃসাহসী অভিযান পরিচালনায়ও ছিল তার সক্রিয় অংশগ্রহন। দিনে দিনে নানান অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হতে থাকে হেনরি।

১৬৮৯ সালে ইংল্যাণ্ডের নেতৃত্বে ডাচ, ব্যাভারিয়া, স্পেন ইত্যাদি রাষ্ট্রকে নিয়ে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে একটি বৃহৎ জোট গড়ে উঠেছিল। জোটভুক্ত দেশগুলো ফ্রান্সের চতুর্দশ লুইয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল তার আঞ্চলিক সম্প্রসারণবাদকে রুখে দেবার জন্য। সেই যুদ্ধে হেনরি রুপার্ট(HMS Rupert) নামের এক যুদ্ধ জাহাজে মিডশিপম্যান হিসেবে কাজ করেছিল। যার ক্যাপ্টেন ছিল ফ্রান্সিস হুইলার। ওই যুদ্ধে হেনরির জাহাজ সাফল্যের সাথে একটি ফরাসী নৌবহরকে কব্জা করেছিল। ফলে হেনরির দ্রুত পদোন্নতি ঘটেছিল এবং ফ্রান্সিস হুইলার তাকে নতুন এবং অধিকতর শক্তিশালী ৯০ কামানের জাহাজ আলবেমার্লে (HMS Albemarle) যোগ দেবার আমন্ত্রণ জানায়। কিন্তু সেই জাহাজ দুই সপ্তাহ পরে ফ্রান্সের সাথে লড়তে গিয়ে শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করে। সেই পরাজয়ে কপাল ভাঙে হেনরির। তাকে রয়েল নেভি থেকে চাকুরিচ্যুত করা হয়। পরাজয়ের পেছনে হেনরির কোন গুরুতর ভূমিকা ছিল কিনা তা জানা যায় না।

রয়েল নেভি থেকে চাকুরিচ্যুত হবার পর হেনরি আটলান্টিক মহাসাগরে দাস ব্যবসার সাথে জড়িত হয়। ১৬৯০ থেকে ১৬৯২ সময়কালে হেনরি ক্যারিবিয়ান সাগর অঞ্চলে অবৈধ দাস ব্যবসা করতো বাহামার গভর্ণর ক্যাডওয়ালাডার জোন্সের (Cadwallader Jones) আনুকূল্যে। ওই সময়কালে, অর্থাৎ ১৬৬০ থেকে ১৬৯৮ সালের মধ্যে আটলান্টিকের দুই প্রান্তে সকল দাস ব্যবসার একচ্ছত্র অধিপতি ছিল রয়েল আফ্রিকান কোম্পানীর (RAC)। তাদের লাইসেন্স বা অনুমতি ছাড়া কারো পক্ষে ওই অঞ্চলে ব্যবসা বাণিজ্য করা নিষিদ্ধ ছিল। পশ্চিম আফ্রিকা উপকূলে RAC-র বাণিজ্য স্বার্থ রক্ষার জন্য সক্রিয় ছিল বৃটিশ রয়েল নেভি। যে কোন অবৈধ বাণিজ্যে লাভের পরিমাণ থাকে বেশী, দাস ব্যবসাও তার ব্যতিক্রম নয়। হেনরি তা ভালো করে জানতো। এও জানতো এমন অবৈধ কর্মে সে একা নয়। আরো অনেকেই জড়িত। তবে তার জন্য সবচেয়ে সুবিধাজনক ছিল বাহামার গভর্ণরের আনুকূল্য। সেই সুযোগে কয়েক বছর ধুমিয়ে অবৈধ দাস ব্যবসায় করে বিস্তর পয়সাকড়ি কামিয়ে নিয়েছিল। কিছুদিন পরে ওই পেশা ছেড়ে নতুন পেশায় যোগ দিল হেনরি।

Charles-II থেকে Fancy : হেনরির জলদস্যু জীবনের সূচনা

১৬৯৩ সালে লণ্ডনের কয়েকজন ধর্নাঢ্য ব্যবসায়ী Sir James Houblon এর নেতৃত্বে ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে ইংরেজদের বাণিজ্য শক্তি বৃদ্ধি করার জন্য চারটি শক্তিশালী জাহাজ নামানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সেই ইংলিশ জাহাজগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিল স্পেনিশ সরকার। ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে স্পেন ও ফ্রান্সের মধ্যে তিক্ত প্রতিযোগিতা ছিল। সেই প্রতিযোগিতায় যখন ইংরেজরা স্পেনের পক্ষে যোগ দিলো, তখন প্রতিপক্ষকে ঠেকানোর কাজটা আরো সহজ হয়ে গেল। ওই জাহাজগুলোর অন্যতম কাজ হবে ফরাসী জাহাজগুলোকে তাড়া করে ফরাসী বাণিজ্যকে ওই অঞ্চলে অসম্ভব করে তোলা। এই পরিকল্পনার সাথে স্পেনিশ বণিকদের সরাসরি যোগসাজস ছিল। সেই চারটি জাহাজ বা ফ্রিগেট- Seventh Son, Dove, James এবং Charles-II নামে পরিচিত। এদের মধ্যে Charles-II জাহাজটিকে বিশেষভাবে তৈরী করা হয়েছিল ফরাসী জাহাজ শিকার করার কাজে।

হেনরি এভারি যোগ দিল চার্লস-টু জাহাজে। এই জাহাজ বহরের ঘোষিত বেতনভাতা ইত্যাদি ভালোই ছিল। অভিযান শুরুর আগেই সবাইকে কিছু অগ্রিম টাকাকড়ি দেয়া হয়েছে। স্পেনিশদের পক্ষ থেকে এই জাহাজ বহরকে বিশেষভাবে মদদ দেয়া হয়েছে। এদের উপর বাড়তি যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল তা হলো ক্যারিবিয়ান সাগর অঞ্চলে ফরাসী অধিকৃত জায়গাগুলোতে লুটপাট চালানো এবং সেই লুটের সম্পদ হরণ করে আনা। হেনরি তার পূর্বাভিজ্ঞার কারণে একটু উচু পদে স্থান পেল। জাহাজে তার জায়গা হলো ফার্স্টমেট হিসেবে। ওই চারটি জাহাজের প্রধান কাপ্তেন হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হলো অ্যাডমিরাল ওবির্নে (Admiral Sir Don Arturo O’Byrne) নামের এক আইরিশকে। তৎকালীন পরিস্থিতির ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত ছিল। কেননা ইগোসমৃদ্ধ কোন ইংরেজ সন্তান আইরিশ নাগরিকের অধীনে কাজ করাটা অসম্ভব বিবেচিত হতো সেই কালে। তবে ওই অভিযানের পুরোটাই একটু অদ্ভুতই ছিল। অনেকটা স্পেনিশদের ভাড়াটে গুণ্ডা হিসেবে ইংরেজ সন্তানেরা এই অভিযানে যুক্ত হয়েছে। সেটাও কম অপমানের বিষয় ছিল না। তবু বড় অংকের লাভের আশায় এসব মানসম্মানের বিষয়কে বিসর্জন দেয়া যায়।

আগস্টের শুরুতে টেমস নদী থেকে যাত্রা শুরু করে স্পেনের করুনা (Coruna) বন্দরে পৌঁছানোর পর ঘটনার হাওয়া একটি ভিন্নদিকে বইতে শুরু করে। কথা ছিল করুনা বন্দরে পৌঁছানোর পর মাদ্রিদ থেকে যাত্রা শুরুর অনুমতিপত্র ইত্যাদি আসবে। ওই কাগজ ছাড়া যাত্রা করা যাবে না। স্পেনিশদের বৈধ অনুমতি ছাড়া তাদের উপনিবেশে মাতব্বরী করতে যাওয়া অসম্ভব। তাই যাত্রা শুরু করতে না পেরে মাসের পর মাস ধরে চারটি জাহাজই করুনা বন্দরে বসে থাকলো। বসে থাকতে থাকতে শেকড় গজানোর উপক্রম হলো তাদের। তাও হতো, যদি মাসে মাসে বেতনগুলো পাওয়া যেতো। করুনা বন্দরে বসে থাকার সময়টাকে এক পয়সা বেতনও দেয়া হয়নি তাদের। নাবিকদের পরিবারে উপোষ দেবার অবস্থা হয়েছে। বেতন ভাতা না পেয়ে নাবিকরা সব বিদ্রোহী হয়ে উঠলো। অধৈর্য নাবিকরা বারবার জাহাজ কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ আবেদন নিবেদন করেও কোন ফল পাচ্ছিল না।

কয়েক মাস পর অবশেষে যাত্রার অনুমতি মিললো। ১ মে ১৬৯৪ সালে জাহাজগুলো যাত্রা করার সিদ্ধান্ত নিল অ্যাডমিরাল ওবির্নের নেতৃত্বে। কিন্তু তখন জাহাজের নাবিকরা তাদের দাবী পুরণের জন্য বেঁকে বসলো। বকেয়া বেতন পরিশোধ করা ছাড়া তারা কেউ যাত্রা করবে না। পরিস্থিতির বিরূপ অবস্থা দেখে ওবির্নে তখন লণ্ডনে লিখলেন টাকা পাঠাবার জন্য।

ইতিমধ্যে হেনরি একটা মতলব এঁটে ফেলেছে। সে তার জাহাজের নাবিকদের নিয়ে বিদ্রোহ করার সিদ্ধান্ত নিল। নিজের জাহাজ বাদে অন্য জাহাজের নাবিকদেরও গোপনে খবর দেয়া হলো। চার জাহাজের নাবিকদের জানালো তারা যদি নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে চায় তাহলে সবাই যেন চার্লস টুতে সময়মতো হাজির হয়। তখনো লণ্ডন থেকে কোন জবাব আসেনি।

সেদিন ছিল ৭ মে ১৬৯৪। সময় রাত নটা। জাহাজ বহরের প্রধান এডমিরাল ওবির্নে সেরাতে জাহাজে ছিলেন না- তিনি বন্দরে নেমে ঘুমোতে গিয়েছিলেন। ওটা ছিল আরো সুবর্ণ সুযোগ। চার্লস টু জাহাজের ক্যাপ্টেন গিবসন জাহাজে ছিলেন তবে তিনি নিজ কক্ষে শুয়ে পড়েছিলেন। বিদ্রোহী নাবিকরা সব জড়ো হয়ে গেছে হেনরির জাহাজ চার্লস টুতে।

চার্লস-টু এর পাশের জাহাজ জেমসের ক্যাপ্টেন হামফ্রে কিছু একটা সন্দেহ করলেন পরিস্থিতি দেখে।

তিনি তাঁর জাহাজ থেকে হেনরিকে ডেকে বললেন, “তুমি কী জানো আমার জাহাজ থেকে লোকজন কোথায় চলে গেছে?”

হেনরি দেঁতো হেসে জবাব দিল, “আমি ঠিক জানি সবাই কোথায় গেছে। চাইলে আপনিও আমাদের সাথে যোগ দিতে পারেন।”

ক্যাপ্টেন হামফ্রে বুঝলেন ঘটনা কোনদিকে মোড় নিতে যাচ্ছে। তিনি দ্রুত ভেতরে গিয়ে তার জাহাজ থেকে কামান দেগে বন্দরের নৈশ প্রহরীদের উদ্দেশ্যে সতর্কবার্তা পাঠালেন।

গোলার শব্দ শুনে হেনরি বুঝলো আর দেরী করা যাবে না। বন্দর ছাড়ার আগে তাদের আটকে ফেললে পরিকল্পনা ভণ্ডুল হয়ে যাবে। সে দ্রুত তার জাহাজটি চালু করে যে যেই অবস্থায় আছে সেই অবস্থাতে বন্দর ছেড়ে খোলা সাগরে বেরিয়ে পড়লো।

নিরাপদ দূরত্বে যাবার পর সবাইকে ডেকে বললো, এখানে তার মিশনে যদি কেউ থাকতে না চায়, তাহলে তারা নৌকা নিয়ে তীরে চলে যেতে পারে। পাশে নৌকা তৈরী আছে।
তার কাণ্ড এবং ঘোষণা দেখে হতভম্ব হয়ে পড়লো ঘুম থেকে সদ্য জাগা ক্যাপ্টেন গিবসন। হেনরি তার কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বললো, ভাগ্য পরিবর্তন করতে চাইলে তিনিও হেনরির দলে যোগ দিতে পারেন। তবে জাহাজে তাকে হেনরির অধীনস্থ হয়ে থাকতে হবে।

হেনরির অপমানজনক প্রস্তাবে ক্যাপ্টেনের রাজী হবার কোন কারণ নেই। তিনি বন্দরে ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন। ক্যাপ্টেন গিবসন এবং অন্য কয়েকজন নাবিককে নৌকায় তুলে দেয়া হলো তীরে ফিরে যাবার জন্য।

জাহাজে বাকী যারা ছিল তারা সবাই একাত্ম হয়ে হেনরীর নেতৃত্ব মেনে নিল। তারপর হেনরি জাহাজটিকে আফ্রিকার দক্ষিণ উপকূলের দিকে চালিয়ে দিল। উত্তমাশা অন্তরীপ পেরিয়ে তাদের গন্তব্য ভারত মহাসাগর। যেখানে তার অনুপ্রেরণা হয়ে আছে থমাস টিউ নামের এক জলদস্যু যে আগের বছর লোহিত সাগরে সাফল্যের সাথে জলদস্যুতা করে সারা দুনিয়ায় নাম কামিয়েছে। হেনরি তাকেই অনুসরণ করার সিদ্ধান্ত নিল। তবে রওনা দেবার আগে জাহাজের নাম বদলে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়া হলো।

চার্লস টু নামটি বদলে দিয়ে নতুন নাম রাখা হলো ‘ফেন্সি’ (Fancy)। যাত্রার শুরুতে প্রথম ডাকাতির বউনি করলো কেপ অব ভার্দে দ্বীপপুঞ্জের কাছে। বারবাডোজ থেকে পন্যবাহী তিনটি ইংলিশ জাহাজ লুট করা হলো। মাইও নামক দ্বীপের কাছে ওই ডাকাতির ঘটনা ঘটাবার পর মালামালের বন্দোবস্ত করার পর নতুন বুদ্ধি খেললো তার মাথায়। লুন্ঠিত জাহাজের নয়জন নাবিককে হেনরি প্রস্তাব দিল নিজেদের দলে যুক্ত হবার জন্য। লাভের অংক বুঝে নাবিকরা প্রস্তাবে রাজী হয়ে গেল। আরেকটু দক্ষিণে গিনি উপকূলে গিয়ে আরেকটি জাহাজকে কব্জা করে তাদের সম্পদও লুটপাট করে। এরপর বেনিনের কাছাকাছি গিয়ে একটু যাত্রাবিরতি করলো।

এখানে জাহাজটিকে খাদ্য ও পানীয়ে পরিপূর্ণ করা হলো। সেই সাথে জাহাজের কিছু মেরামতির কাজও সেরে নিল হেনরি। জাহাজটির অপ্রয়োজনীয় কিছু অংশ কেটেছেটে দ্রুত গতিতে চলার উপযোগী করা হলো। জলদস্যুদের আসল অস্ত্র হলো গতি। দ্রুতগতিতে এগিয়ে আক্রমন করে দ্রুত সটকে পড়াই মহাসমুদ্রে ডাকাতির নিয়ম।

উত্তমাশা অন্তরীপ পেরিয়ে মাদাগাস্কারের কাছাকাছি পৌঁছে গেল হেনরির জাহাজ। সেখানে দেখা পাওয়া গেল একটি ফরাসী জলদস্যু জাহাজ। ইংরেজের জাতশত্রু ফরাসীরা। তাই জলদস্যু হলেও তাদের নিস্তার নেই। হেনরি বাহিনী সেই জলদস্যু জাহাজের উপরও হামলা চালালো। ঝটিকা হামলায় জাহাজ লুটপাট করে প্রমাণ করলো তারাই এখানে সেরা। তবে জাত শত্রু হবার পরও বহুজাতিক বাহিনী গড়ার বাসনায় ফরাসী জাহাজের ৪০ জনকে প্রস্তাব দেয়া হলো তার বাহিনীতে যোগ দেবার জন্য। প্রাণে বাঁচতে পেরে ফরাসী নাবিকেরা এত খুশী ছিল যে তারা সানন্দে যোগ দিলো হেনরির বাহিনীতে। সব মিলিয়ে হেনরি এখন ১৫০ জলদস্যুর নেতা।

ইংলিশ জাহাজের জন্য বিশেষ ছাড়

১৬৯৫ সালের শুরুতে হেনরি তার জাহাজ নিয়ে কমোরোজ দ্বীপপুঞ্জের জোহানায় পৌঁছালো। এখানে আসার পর সম্ভবতঃ ভারত মহাসাগরে জলদস্যুবৃত্তি শুরু করা উপলক্ষে হেনরি নজিরবিহীন একটি সিদ্ধান্ত নিল। এই অঞ্চলে বিচরণরত সব ইংলিশ জাহাজের জন্য বিশেষ ছাড় দেয়ার জন্য মনস্থ করলো হেনরি। জোহানা দ্বীপে অবস্থানকালে পৃথিবীর সব ইংরেজ জাহাজের উদ্দেশ্যে একটা খোলা চিঠি লিখলো যার ভাষা ছিল এরকম-

To all English Commanders lett this Satisfye that I
was Riding here att this Instant in ye Ship fancy man of
Warr formerly the Charles of ye Spanish Expedition
who departed from Croniae [Corunna] ye 7th of May. 94:
Being and am now in A Ship of 46 guns 150 Men & bound
to Seek our fortunes I have Never as Yett Wronged any
English or Dutch nor never Intend while I am Commander.
Wherefore as I Commonly Speake wth all Ships I Desire
who ever Comes to ye perusal of this to take this Signall
that if you or aney whome you may informe are desirous
to know wt wee are att a Distance then make your Antient
[i.e., ensign, flag] Vp in a Ball or Bundle and hoyst him att
ye Mizon Peek ye Mizon Being furled I shall answere wth
ye same & Never Molest you: for my Men are hungry Stout
and Resolute: & should they Exceed my Desire I cannott
help my selfe.

as Yett
An Englishman’s friend,

At Johanna [Anjouan] February 28th, 1694/5
Henry Every

Here is 160 od french Armed men now att Mohilla
who waits for Opportunity of getting aney ship, take Care of your Selves.

হেনরির ইংরেজি ভাষাজ্ঞানে আস্থা না রেখেও বোঝা যায় এই পত্রের মূল বক্তব্য হলো হেনরির বাহিনী স্বজাতি ইংরেজ জাহাজের উপর হামলা করবে না। যদি ইংরেজ জাহাজ তাদের জাতীয় পরিচয় দিতে সক্ষম হয় তাহলে তাদের জাহাজ লুট করা হবে না। সুতরাং সবাই যেন নিজ নিজ পরিচয়পত্র বহন করে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেয়। এ ছাড়া বাকী যে কোন দেশের জাহাজ হেনরির শিকার বলে পরিগণিত হবে। মনে হতে পারে হেনরি প্রবল দেশপ্রেম তাড়নায় সিদ্ধান্তটি নিয়েছিল। আসল কথা হলো ভারত মহাসাগরে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর বড় বড় জাহাজগুলো হেনরীর জন্য একটু হুমকি স্বরূপ ছিল। সেই জাহাজ কব্জা করা সহজ কাজ ছিল না। হয়তো সে কারণেই এই ঘোষণা বা ইনডেমনিটির মহানুভবতার ভড়ং।

হেনরির এই ঘোষণায় ইংরেজদের কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল জানা যায়নি। কিন্তু ভারত মহাসাগরে আসার পর দুটি ডেনিশ বাণিজ্য জাহাজ কব্জা ও লুট করার মাধ্যমে জলদস্যু হিসেবে সুনাম অর্জন করার চেষ্টা করে হেনরি। এর কিছুদিন পরেই হেনরি জীবনের সবচেয়ে বড় শিকারের আয়োজন করে। গঞ্জ-ই-সাওয়াই শিকারের মহাপরিকল্পনাটির সফল বাস্তবায়ন করে সারা দুনিয়াকে তাক লাগিয়ে দেয়।

আওরঙ্গজেবের তোপের মুখে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্য

মোগল জাহাজের উপর এমন হামলা এই প্রথম নয়। প্রায় আশি বছর আগে সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলেও একটি বড় রকমের হামলা হয়েছিল হজ্জযাত্রীবাহী জাহাজের উপর। সেই হামলার জন্য দায়ী ছিল পর্তুগীজ জলদস্যুরা। তখনো ইংরেজরা ভারতের মাটিতে বাণিজ্যের অধিকার পায়নি। বাণিজ্যের অনুমতি বিষয়ে দিল্লীর সম্রাট জাহাঙ্গীরের সাথে দেন দরবার চলছিল ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর। সুরাট বন্দরে ইংরেজদের সাথে পর্তুগীজদের যুদ্ধও হয়েছিল বাণিজ্যের অধিকার নিয়ে। পর্তুগীজরা তখন ভারত মহাসাগরে বেয়াড়া শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। সমুদ্র বিদ্যায় পারদর্শী হয়ে এতই শক্তিশালী হয়ে ওঠে যে তখন ভারত মহাসাগরে যে কোন জাহাজকে পর্তুগীজদের দেয়া ছাড়পত্র (Cartaz) নিয়ে চলাচল করতে হতো। তেমন একটা সময়ে পর্তুগীজরা টার্গেট করে রাহিমি(Rahimi) নামে পরিচিত ভারতের গর্ব হিসেবে ১৭০০ টনের বিলাসবহুল জাহাজটিকে। ১৬১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মক্কা থেকে ৭০০ হজ্জযাত্রী নিয়ে ফেরার পথে লোহিত সাগরেই হামলার সম্মুখীন হয় জাহাজটি। ৩ লাখ পাউণ্ডের মালামাল এবং যাত্রীসহ জাহাজটিকে ছিনতাই করে গোয়া বন্দরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কার্তাজ বা ছাড়পত্র থাকা সত্ত্বেও ওই হামলাটি ছিল মোগল রাজশক্তির বিরুদ্ধে একটি প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা। কেননা মোগলরা তখন ভারতে ইংরেজদের বাণিজ্য করার অনুমতি দেবার প্রক্রিয়া শুরু করেছিল যা ছিল পর্তুগীজদের জন্য চরম অনাকাঙ্খিত ব্যাপার। জলদস্যুরা ছিনতাই কর্ম করলেও তার অনুমোদন ছিল গোয়ার পর্তুগীজ গভর্ণরের। সেই জাহাজটির মালিকানা ছিল স্বয়ং সম্রাট জাহাঙ্গীরের মা, রানীমাতা নামে সুপরিচিত মরিউম-উজ- জামানীর (Maryam Uz Zamani)। তিনি ছিলেন সম্রাট আকবরের অন্যতম প্রভাবশালী স্ত্রী।

‘গঞ্জ-ই-সাওয়াই’ জাহাজে হেনরির আক্রমণের ঘটনার পর ভারতবাসী এবং মোগলদের নিশ্চিতভাবে ‘রাহিমি’ ছিনতাইয়ের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল।

‘গঞ্জ-ই-সাওয়াই’ হামলার ঘটনার পর সবার আগে তোপের মুখে পড়লো ভারতে ইংরেজ প্রতিষ্ঠানগুলো। প্রাথমিক প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থায় আওরঙ্গজেব চারটি ইংরেজ কারখানা বন্ধ করে দিয়ে তাদের কর্মীদের আটক করে। ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর বাণিজ্য ভয়ানক বিপদের মুখে পড়ে যায় সমগ্র ভারত জুড়ে। বোম্বের ইংরেজ গভর্ণর জন গায়ের(John Gayer) তড়িঘড়ি করে লণ্ডনে ট্রেড বোর্ডের কাছে পত্র লিখে জানালেন-

It is certain the Pyrates, which these People affirm were all English, did do very barbarously by the People of the Ganj-i-sawai and Abdul Gofor’s Ship, to make them confess where their Money was, and there happened to be a great Umbraws Wife (as Wee hear) related to the King, returning from her Pilgrimage to Mecha, in her old age. She they abused very much, and forced severall other Women, which Caused one person of Quality, his Wife and Nurse, to kill themselves to prevent the Husbands seing them (and their being) ravished.

শোনা গিয়েছিল ওই জাহাজে স্বয়ং সম্রাটের পরিবারের সদস্য, আত্মীয়া, কন্যা বা নাতনীও ছিল। যেটা মোগলদের জন্য বিরাট একটা অপমানের ব্যাপার ছিল। যদিও ঘটনাটির সাথে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী জড়িত না, তবু ইংরেজ সন্তান জড়িত বলে দায় দায়িত্ব তাদের ঘাড়ে চলে আসে। ওই জাহাজ থেকে লুন্ঠিত সম্পদের পরিমাণ দুই থেকে ছয় লাখ পাউণ্ড হতে পারে বলে অনুমান করা হয়। এ ছাড়া নগদেও ছিল পাঁচ লক্ষ স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রা। এই যুগের হিসেবে ওই সম্পদের মূল্য অনেকগুণ বেশী তা বলাই বাহুল্য।

দুনিয়ার প্রথম আন্তর্জাতিক মানব হুলিয়া

মোগল সম্রাটের তোপের মুখে পড়ে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী বিপদগ্রস্থতার বিষয়ে লণ্ডনের রাজপ্রাসাদেও চরম উদ্বিগ্নতা বিরাজ করছিল। হেনরি এমন ভয়ানক কর্ম করেছে যার ফলে গোটা ভারতবর্ষে বৃটিশদের বাণিজ্য এবং অস্তিত্ব দুটোই বিপর্যয়ের মুখে পড়তে যাচ্ছে। ভারতে তখন ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী একটু লাভের মুখ দেখতে শুরু করেছিল। মাত্র কয়েক বছর আগে মোগলদের সাথে যুদ্ধ-আপোষ করে ভারতের সবচেয়ে লোভনীয় জায়গা বাংলায় বাণিজ্যের অধিকার আদায় করেছে অনেক কষ্টে। জব চার্নক সুতানটিতে বাণিজ্য করার অনুমতিপত্র পেয়েছে মাত্র কয়েক বছর আগে। এখনো সেই বাণিজ্য পোক্ত হতে শুরু করেনি। সেই অর্জন এই দস্যুতার ঘটনায় হুমকির মুখে পড়ে গেল। মোগল সম্রাটের ক্রোধ থেকে রক্ষা পেতে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী জাহাজটির সমস্ত ক্ষতিপূরণ দিতে সম্মত হয়েছে। খোদ ইংলিশ পার্লামেন্ট এই দস্যুদলকে মানবজাতির শত্রু হিসেবে ঘোষণা করেছে। বৃটিশ সরকার হেনরিকে ধরিয়ে দেবার জন্য বিশ্বব্যাপী হুলিয়া জারি করেছে।

হেনরীর মাথার দাম ধার্য করা হয়েছে ৫০০ পাউণ্ড। যা পরবর্তীতে দ্বিগুণ করা হয়েছিল। ইতিহাসে সেই ছিল প্রথম বিশ্বব্যাপী মানব হুলিয়া। সেই হুলিয়ায় আরো বলা হলো সঙ্গীদের কেউ যদি তাকে ধরিয়ে দেয় তাহলে তাদেরকে সাধারণ ক্ষমা ও পুরস্কার দেয়া হবে। তার সঙ্গীর সংখ্যা ছিল শতাধিক। তাদের কেউ না কেউ জানে হেনরি কোথায় লুকিয়ে আছে। এত বিপুল পরিমাণ সম্পদ নিয়ে একটা মানুষ গায়েব হয়ে যেতে পারে না। তাকে সেই সম্পদগুলো, লুণ্ঠিত সোনাদানা রত্নরাজিসমূহ কোথাও না কোথাও বিক্রি করতে হবে। সম্ভাব্য রত্নবিক্রির জায়গাগুলোতে খোঁজ লাগালো ইংরেজ শক্তি। ইউরোপের প্রতিটি বন্দরে নজরদারি শুরু হলো। ভারত মহাসাগরের সবগুলো বন্দরে খোঁজ করলো ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির জাহাজ।

কিন্তু কেউ তার নাগাল পায়নি। সে মোগল সম্রাট, ইংরেজ সরকার কিংবা ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর ধরা ছোঁয়ার বাইরে কোথাও চলে গেছে।

হেনরি কোথায়?

জাহাজ লুট শেষে হেনরির জাহাজ দক্ষিণ দিকে পাল তোলে এবং মাদাগাস্কারের কাছে বর্তমান রিইউনিয়ন দ্বীপে নোঙর ফেলে ভাগ সম্পদের বাটোয়ারা করার জন্য। জানা যায়, প্রত্যেক দস্যু জনপ্রতি ১০০০ পাউণ্ড (এ যুগের হিসেবে প্রায় এক লাখ পাউণ্ড) করে পায় যা তারা সারা জীবনেও আয় করতে পারতো না। এ ছাড়াও সব জলদস্যুর ভাগে পড়েছিল মূল্যবান রত্নপাথর। ভাগ বাটোয়ারা শেষে এবার নিরাপদ জায়গা খুঁজে পালানোর ব্যবস্থা করতে হবে। এই মহাডাকাতি যে বিশ্বব্যাপী আলোড়ন তুলবে তা সবাই জানে। সুতরাং এমন কোথাও হারিয়ে যেতে হবে যেখানে তাদের কোন নিশানা থাকবে না। ফরাসী জাহাজ থেকে যেসব নাবিক যোগ দিয়েছিল তারা ওই রিউইনিয়ন দ্বীপেই থেকে যাওয়া শ্রেয় মনে করলো। বাকীরা হেনরির সাথে থাকাই মনস্থ করলো।

ধূর্ত হেনরি জানে কোন এলাকা তার জন্য নিরাপদ। সে ফরাসী নাবিকদের রেখে বাহামা দ্বীপপুঞ্জের নাসাউর দিকে জাহাজের পাল তুললো। ভারত মহাসাগর থেকে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে নাসাউ যাত্রা করার পথটা দুনিয়ার প্রায় অর্ধেক, কিন্তু না গিয়ে উপায় নাই। মোগল সম্রাটকে ক্ষেপিয়ে ভারত মহাসাগর তাদের জন্য মোটেও নিরাপদ নয় আর।

সেই সময় ক্যারিবিয়ান অঞ্চল ছিল জলদস্যুদের নিরাপদ আখড়া। ক্যারিবিয়ান দ্বীপগুলোর অনেক গভর্ণর প্রখ্যাত জলদস্যুদের সাথে বখরা ভাগাভাগি করে নিজেদের আখের সঞ্চয় করতো। ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে হেনরির আনাগোনা ছিল রয়েল নেভিতে কাজ করার সময়ই। ওই এলাকার ভূগোল এবং শাসকদের চরিত্র/চাহিদা সম্পর্কে তার ভালোমতন জানা শোনা ছিল। আটলান্টিক পাড়ি দেবার আগে হেনরি আফ্রিকার উপকূল থেকে বেশকিছু দাস সংগ্রহ করে। তারপর আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে ক্যারিবিয়ান এলাকায় চলে গেল।

সবার আগে সেন্ট থমাস নামের একটা ক্যারিবিয়ান দ্বীপে নোঙর ফেলে কিছু লুটের মাল বিক্রি করলো। হাতে নগদ টাকাকড়ি আমদানীর দরকার আছে। তারপর সেখান থেকে গেল বাহামার ইল্যুথেরা নামক এক নির্জন দ্বীপে। সেখান থেকে হেনরি চারজনকে একটা নৌকায় করে পাঠালো বাহামায়। বাহামার গভর্ণর ছিলেন স্যার নিকোলাস ট্রট। নতুন এই গভর্ণর সম্পর্কে তার ধারণা ছিল না। হেনরি গভর্ণরের কাছে একটা চিঠি পাঠিয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইল কিংবা বুঝতে চাইল অবস্থান কী। চিঠিতে যা বললো তার সারমর্ম হলো, হেনরির দল আফ্রিকার উপকুল থেকে কিছু দাস নিয়ে এসেছে বিক্রি করতে। তার জাহাজ ফেন্সিতে ১১৩ জন নাবিক আছে এবং জাহাজটি ৪৬ কামানের শক্তি সম্পন্ন। তারা এই দ্বীপে নামার জন্য গভর্ণরের অনুমতি চায়। যদি তিনি এই দ্বীপে থাকার অনুমতি দেন তাহলে বিনিময়ে ওই জাহাজটি তাঁর সেবায় নিয়োজিত রাখবে। গভর্ণর যদি তাদের অবৈধ দাস ব্যবসার কথা গোপন রাখতে পারেন তাহলে জাহাজের নাবিকরা তাঁকে ৮৬০ পাউণ্ড উপহার দেবে এবং জাহাজের ক্যাপ্টেন হেনরি ব্রিজম্যান চিরকৃতজ্ঞ থাকবে।

সময়টা এমনিতে ভালো যাচ্ছিল না গভর্নর ট্রটের। তিনি বেশ কিছুদিন যাবত বৃটিশ রয়েল নেভির কোন সাহায্য পাচ্ছিলেন না। ইউরোপে তখন ইংল্যাণ্ডের নেতৃত্বে গঠিত বৃহৎ জোটের সাথে ফ্রান্সের ‘নয় বর্ষ যুদ্ধে’র অষ্টম বছর চলছিল। ফ্রান্সের সাথে সেই যুদ্ধটা বিশ্বব্যাপী ছিল। বাহামা ইংরেজের দখলে থাকলেও ফ্রান্সের সৈন্যরা বাহামার নিকটবর্তী একটা দ্বীপ এক্সুমা দখল করেছে কিছুদিন আগে। যে কোন সময় তারা বাহামার রাজধানীতেও এসে হামলে পড়তে পারে। এই দ্বীপে এমনিতে জনসংখ্যা খুব কম। পুরুষ জনসংখ্যা ষাট সত্তর জনের বেশী হবে না। তাদের অর্ধেক পালা করে পাহারা দেয় দ্বীপটাকে। বাইরের কোন আক্রমণ ঠেকাবার শক্তি বাস্তবে তাদের নেই। হেনরির দলবল যদি এই দ্বীপে আশ্রয় নেয় তাহলে দ্বীপের পুরুষের সংখ্যা তিনগুণ হয়ে যাবে। আর হেনরির জাহাজের কামানকে যদি প্রতিরক্ষার কাজে লাগানো যায় তাহলে ফরাসী আক্রমণ থেকেও নিরাপদে থাকা যাবে। এ ছাড়া হেনরি দাস ব্যবসা গোপন রাখার বিনিময়ে যে টাকা দেবে বলেছে তা গভর্নরের বার্ষিক বেতনের তিনগুণ প্রায়। গভর্ণর তখন বার্ষিক ৩০০ পাউণ্ড বেতন পেতেন।

সব মিলিয়ে হেনরির প্রস্তাবকে গভর্ণরের জন্য সোনায় সোহাগা বলা চলে। রাজী না হয়ে কোন উপায়ও নেই। রাজী না হলে হেনরি চাইলে জোরপূর্বক এই দ্বীপ তার দখলে নিতে পারে, যা তার পক্ষে কঠিন কোন কাজ নয়। সুতরাং সবদিক বিবেচনা করে হেনরির প্রস্তাবকে স্বাগত জানাবার সিদ্ধান্ত নিলেন গভর্ণর ট্রট। তিনি পরদিনই কাউন্সিলের সভা ডেকে হেনরির প্রস্তাবটা জানালেন, কেবল ঘুষের প্রস্তাব অংশটা গোপন রাখলেন। কাউন্সিল প্রথমে আইনগতভাবে অবৈধ কাজটির অনুমোদন দেয়া ঠিক হবে কিনা তা নিয়ে আপত্তি করলো। কিন্তু দ্বীপের নিরাপত্তা একটা বড় ইস্যু বলে রাজী হয়ে গেল।

অনুমতির কথা গভর্নর চিঠি দিয়ে জানালেন হেনরিকে। তারপর একদিন হেনরির সাথে ব্যক্তিগত ভাবে গোপন সাক্ষাত করলেন। সেই সাক্ষাতে হেনরি গভর্ণরকে বাড়তি উপঢৌকন হিসেবে ৫০ টন আইভরি, ১০০ ব্যারেল গান পাউডার, কয়েক বাক্স অস্ত্র এবং গোলাবারুদ ইত্যাদি হস্তান্তর করলো। এত বিপুল পরিমাণ উপঢৌকন পেয়ে গভর্ণর ট্রট প্রায় হেনরির বন্ধু হয়ে গেলেন এবং পুরো ব্যাপারটিকে চেপে রাখতে রাজী হলেন।

কিছুদিন পর ইংল্যাণ্ড থেকে হেনরির খোঁজে দুনিয়া জুড়ে ছড়ানো হুলিয়ার খবর এসে পৌঁছালো নাসাউতেও। হুলিয়া দেখে গভর্ণরের বুঝতে বাকী রইল না ক্যাপ্টেন ব্রিজম্যানই হেনরি এভারি। বুঝলেও গভর্ণর হুলিয়াকে পরোয়া করলেন না। তিনি নেমকহারাম নন। যার কাছ থেকে এত বিপুল উপহার বুঝে পেয়েছেন, গুনে গুনে এতগুলো কাঁচা মুদ্রা নিয়েছেন তার গন্ধ এখনো মুছে যায়নি। হেনরিকে ধরিয়ে দেবার কোন ইচ্ছে তার নেই। তবে জানতেন একদিন এই দ্বীপেও হেনরির খোঁজে আসতে পারে সরকারী বাহিনী। সরকারের কাছ থেকে সরাসরি কোন খোঁজ আসার আগেই তিনি নিজ দায়িত্বে হেনরির জাহাজ থেকে সব মালামাল সরিয়ে জাহাজটিকে নিশ্চিহ্ন করে দেবার সিদ্ধান্ত নিলেন। লোকবল দিয়ে একটা পাথুরে দ্বীপের সাথে ধাক্কা লাগিয়ে ধ্বংস করে দিলেন জাহাজটিকে। গভীর সমুদ্রে হারিয়ে গেল জাহাজটির সকল অংশ।

এর কিছুদিন পর সত্যি সত্যি সরকারী নির্দেশ এসে পৌছালো গভর্ণরের কাছে। ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী ও ইংরেজ সরকার হেনরিকে গরু খোঁজা করছে। গভর্ণর সেটাকেও এড়াতে চাইলেন প্রথমে। জানালেন সেরকম কোন দুষ্ট লোকের খোঁজ তাদের কাছে নেই। এই দ্বীপের কোন বাসিন্দা সেরকম কোন জাহাজ কখনো দেখেনি। এখানে যে দলটা আশ্রয় নিয়েছে তারা কেবল দাস ব্যবসাতেই নিয়োজিত। অন্য কোন মতলবে তাদের দেখা যায়নি।

কিন্তু বেশীদিন লুকোনো গেল না। সরকারের কাছে কোন একটা সংবাদ গিয়েছিল হয়তো। গভর্ণরের উপর চাপ আসলো বৃটিশ সরকারের কাছ থেকে। সরকারী বাহিনী নাসাউতে আসছে জলদস্যুদের ধরার জন্য। সুতরাং গভর্ণরের উচিত সরকারী বাহিনীকে সাহায্য করে যে কোন উপায়ে হেনরিকে ধরিয়ে দেয়া। যদি তা করতে না পারে তাহলে ধরে নেয়া হবে তার সাথে জলদস্যুদের যোগসাজস আছে।

এবার একটু টনক নড়লো গভর্ণরের। ব্যাপারটা গোলমেলে হয়ে যাচ্ছে দেখে গভর্ণর রাজী হলেন জলদস্যুদের খোঁজ দিতে। রাজী হলেও তিনি ভালো করেই জানেন হেনরি ধরা পড়লে যেসব কথা দুনিয়ার কাছে ফাঁস হয়ে পড়বে তার ফলাফল মোটেও সুখকর হবে না। হেনরির কাছ থেকে পাওয়া ভাগ বাটোয়ারার অংশ ফাঁস হয়ে গেলে তাকেও ফাঁসিতে ঝুলতে হতে পারে। অতএব ভেবেচিন্তে গভর্ণর চতুর একটা সিদ্ধান্ত নিলেন। হেনরিকে আগাম জানিয়ে দিলেন তাঁকে ধরতে আসছে বৃটিশ সৈন্যবাহিনী। সুতরাং সরকারী বাহিনী আসার আগেই সে যেন দ্রুত দ্বীপ ছেড়ে পালিয়ে যায়।

হেনরিও বুঝলো পালানো ছাড়া উপায় নেই। দ্বিরুক্তি না করে অল্প কিছু সঙ্গীকে নিয়ে সে উধাও হয়ে গেল অজানার দিকে। কোথাও কোন সুত্র না রেখে হেনরি উধাও হয়ে যাবার পর গভর্ণরের বুকে পানি আসলো। বাকী সঙ্গীরা কেউ জানে না গভর্ণরের সাথে হেনরির গোপন লেনদেন, তারা ধরা পড়লেও সমস্যা নেই। হেনরি পালিয়ে যাবার পর সরকারী বাহিনী এসে হাজির হলে তাদের সাথে গভর্ণরও জোর কদমে তল্লাশী চালালো হেনরিকে ধরার জন্য। হেনরিকে ধরার কোন পথ নেই। কেবল দ্বীপে রয়ে যাওয়া হেনরির কয়েকজন দলছুট সঙ্গী ধরা পড়লো।

জলদস্যুতার বিচার

১৬৯৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে ইংল্যাণ্ডের সাসেক্স শহরের মেয়রের কাছে একটা সংবাদ আসে। শহরের জন ডান নামের এক ব্যক্তির জামার পকেটে ১০৪৫ পাউণ্ডের স্বর্ণমুদ্রার সন্ধান পাওয়া গেছে। সন্ধানটি এনেছে যে মেয়েটি সে জন ডানের বাড়িতে কাজ করে। কাজ করার সময় কাপড়চোপড় গোছাতে গিয়ে তার ওই স্বর্ণমুদ্রা আবিষ্কার। কিছু একটা সন্দেহ হওয়াতে মেয়েটা শহরের মেয়রের কাছে সংবাদটি পৌঁছে দিয়েছিল পুরস্কারের লোভে। সংবাদটি যে সঠিক ছিল তা বোঝা গেল ৩০শে জুলাই জন ডানকে গ্রেফতার করার পর।

জন ডান ছিল হেনরি এভারির অন্যতম সহযোগী। জলদস্যুতার অভিযোগে বিচার শুরু হবার পর ফাঁসির দড়ি এড়াতে জন ডান অন্যন্যদের বিষয়ে তথ্য সরবরাহে রাজী হয়। এর আগে ফিলিপস মিডলটন নামের হেনরির আরেক সহযোগী আত্মসমর্পণ করেছিল। দুজনের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে আরো ২৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়। তারপর বেরিয়ে আসতে থাকে একের পর চাঞ্চল্যকর তথ্য। বিচারের চুড়ান্ত পর্যায়ে সবাইকে আত্মপক্ষ সমর্থন করার সুযোগ দেয়া হলে অধিকাংশই ভুল স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা করে।

তৎকালের ইংল্যাণ্ডের বিচার ব্যবস্থায় দোষীর নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার যথেষ্ট সুযোগ ছিল এবং জুরিদের সহানুভুতি পাওয়ারও অবকাশ ছিল। বিচারক যদিও চেয়েছিলেন সবার জন্য কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে, কিন্তু জুরিগণ তাতে একমত ছিল না। বিচারক Sir Dr Thomas Newton বলেছিলেন এই দস্যুপনার জন্য কঠিনতম শাস্তি হওয়া উচিত। কেননা এই ঘটনার প্রতিক্রিয়া খুব ভয়ংকর হতে পারে। ভারতবর্ষে আমাদের সকল কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ঘটনার সম্ভাব্য পরিণতি সম্পর্কে বিচারক বলেছিলেন- “the total loss of the Indian trade, and thereby the impoverishment of this kingdom”

তবু জুরিরা আসামীদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল কোন কারণে। সেই সুযোগে মাত্র ৫ জন জলদস্যু বাদে বাকী সবাই ফাঁসির দড়ি এড়াতে পেরেছিল। এমনকি জন ডানও বেঁচে গিয়েছিল রাজসাক্ষী হবার সুবাদে।

ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর ক্ষতিপূরণ

ওদিকে ‘গঞ্জ-ই-সাওয়াই’ এর ক্ষতিপূরণের অংক নিয়ে মোগল কর্তৃপক্ষের সাথে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর বিতর্ক চলছিল। জাহাজটিতে কী পরিমাণ সম্পদ ছিল তা কেউ নিশ্চিত নয়। সবটাই অনুমানের ভিত্তিতে বলা। ক্ষতিপূরণের অংকটা ওঠানামা করছিল ৩ লাখ পাউণ্ড থেকে ৬ লাখ পাউণ্ডের মধ্যে। মোগলরা চাইছিল সর্বোচ্চ অংক আদায় করতে, কোম্পানী চাইছিল কম দিয়ে পার পেতে। মোগলদের দাবী ছিল ৬ লাখ পাউণ্ড, বৃটিশরা দিতে চাইছিল ৩ লাখ পাউণ্ড। তবে শেষমেষ মোগল সম্রাটের দাবীই বোধহয় মেনে নিতে হয়েছিল ইংরেজদের। কেননা আর্থিক ক্ষতির চেয়ে মানবিক ক্ষতির পরিমাণটা আরো বেশী ক্ষতের সৃষ্টি করেছিল মোগল দরবারে। সেই ক্ষতি আর্থিক মূল্যে পরিশোধ করা সম্ভব ছিল না।

সময়টা এমনিতে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর জন্য খুব বিপর্যয়কর ছিল। মাত্র কয়েক বছর আগে শুল্ক বিবাদ ও বাংলায় কুঠি স্থাপন নিয়ে কোম্পানির সাথে বাংলার সুবেদারের একরকমের যুদ্ধ বিগ্রহ লেগে গিয়েছিল। Child War নামে চট্টগ্রাম দখল করার সেই বেকুবি অভিযানটি ব্যর্থ হয়ে ইংরেজদেরকে ব্যাপক ক্ষতির মাশুল গুণতে হয়েছিল। অনেক কষ্টে সুতানটিতে কুঠি গড়ার অনুমতি লাভ করলেও সেই যুদ্ধের ক্ষতিটা কাটিয়ে উঠতে পারেনি কোম্পানী। সেই যুদ্ধের আগে ১৬৮৪ সালে কোম্পানীর বার্ষিক আমদানীর পরিমাণ ছিল ৮ লাখ পাউণ্ড, এখন সেটা নেমে এসেছে ৩০ হাজার পাউণ্ডে। সেই যুদ্ধের ফলাফলটা প্রতিকূলে গিয়ে নিজেদের অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়েছিল। সেইবারও কোনমতে হাতে পায়ে ধরে সম্রাট আওরঙ্গজেবের অনুকম্পায় রক্ষা পেয়েছিল ইংরেজ বাণিজ্য। এখন এই হেনরির চরম অপকর্মটি পুরোনো ঝালকে উস্কে দেয়াতে দিল্লীর সাথে কোনরকম দেন দরবার করাই অসম্ভব হয়ে পড়েছে। ক্ষতিপূরণের অংক হিসেবে আওরঙ্গজেব যা চাইবেন তাই দিতে বাধ্য হবে কোম্পানী।

হেনরি এভারির শেষ পরিণতি

এই ব্যাপারটি শেষমেষ অমীমাংসিত থেকে গিয়েছিল। হেনরি এভারির জীবনের শেষভাগ কোথায় কেটেছে, পরিচয় লুকিয়ে আর কোথায় বাস করেছে সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোন তথ্য মেলেনি কোথাও। যেসব তথ্য পাওয়া গেছে তার মধ্যে গুজব ও কল্পকাহিনীর সংখ্যাই বেশী। একটা সুত্রে জানা গিয়েছিল হেনরি আবার ইংল্যাণ্ডে ফিরে এসেছিল। বাহামা কিংবা জ্যামাইকার গভর্ণরের কাছে আশ্রয় না পেয়ে হেনরির দল বিভক্ত হয়ে আমেরিকা সহ নানান স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। হেনরি কিছু সাঙ্গপাঙ্গ সহকারে সি ফ্লাওয়ার নামে একটা জাহাজে করে আয়ারল্যাণ্ডে ফিরে গিয়েছিল। কিন্তু তারা লুটের মালামালগুলো বন্দরে নামাতে গেলে সন্দেহের মুখে পড়ে, দুজন লোক ধরা পড়ে। কিন্তু এভারি ধরা পড়ার আগেই চম্পট দেয়।

ব্রিটিশ লেখক ও জলদস্যু জীবনীকার চার্লস জনসন মনে করেন এভারি তার লুন্ঠিত হীরকগুলো বিক্রি করতে গিয়ে ব্রিস্টলের ব্যবসায়ীর কাছে প্রতারিত হয় এবং শেষ জীবন দারিদ্র মাথায় নিয়ে মৃত্যুবরণ করে।

হেনরির শেষ পরিণতি সম্পর্কে সঠিক কোন তথ্য না মিললেও তাকে নিয়ে লেখা কল্পকাহিনী খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছিল অষ্টাদশ শতকের শুরুতে। তার একটি ছিল হলো হেনরি জাহাজ লুট করে পালাবার সময় মোগল রাজপরিবারের এক কন্যাকে নিয়ে যায় সাথে। তাকে বিয়ে করে মাদাগাস্কারের কাছে সেন্ট মেরিস নামের ছোট্ট একটা দ্বীপে রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করে এবং সেখানে পুত্র কন্যা সহকারে জীবন কাটাতে থাকে।

গল্প উপন্যাসে হেনরি অনেকদিন বেঁচে থাকলেও বাস্তবে তার শেষ পরিণতির কোন খবর কিংবা সমাধির খোঁজ কেউ দিতে পারেনি।

সমাপ্তি নোট

সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো কুখ্যাতি ও জনপ্রিয়তার সহাবস্থানের এক অদ্ভুত নিদর্শন হেনরি এভারি। দুনিয়া জুড়ে হেনরির কুখ্যাতির এত বদনাম সত্ত্বেও সে কিভাবে যেন জনপ্রিয়তাও অর্জন করেছিল রবিনহুডের মতো। তাকে নিয়ে লেখা গল্প উপন্যাস নাটকগুলোই এর প্রমাণ। প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক ড্যানিয়েল ডিফোর একাধিক ফিকশনের নায়ক সে। এমনকি তার জলদস্যু জীবনের সময়সাময়িককালে তার অভিযান নিয়ে ব্যালাড প্রকাশ পেয়েছিল ১৬৯৪ সালে। সেই ব্যালাডের একাংশ দিয়ে হেনরি কাহিনীর ইতি টানছি-

COPY of VERSES,
COMPOSED BY
Captain Henry Every,
LATELY
Gone to SEA to seek his FORTUNE
To the Tune of, The two English Travellers.
COme all you brave Boys, whose Courage is bold,
Will you venture with me, I’ll glut you with Gold?
Make haste unto Corona, a Ship you will find,
That’s called the Fancy, will pleasure your mind.
Captain Every is in her, and calls her his own;
He will box her about, Boys, before he has done:
French, Spaniard and Portuguese, the Heathen likewise,
He has made a War with them until that he dies.
Her Model’s like Wax, and she sails like the Wind,
She is rigged and fitted and curiously trimm’d,
And all things convenient has for his design;
God bless his poor Fancy, she’s bound for the Mine.
Farewel, fair Plimouth, and Cat-down be damn’d,
I once was Part-owner of most of that Land;
But as I am disown’d, so I’ll abdicate
My Person from England to attend on my Fate.

 

তথ্যসুত্র :

1. King of the Pirates: The Swashbuckling Life of Henry Every – Fox, E. T. (2008)
2. Indian Pirates: From the Earliest Times to the Present Day- Saletore, Rajaram Narayan (1978)
3. The History of India, as Told by Its Own Historians: The Muhammadan Period- Elliot, Henry Miers (1877)
4. Captain John Avery’ and the Anatomy of a Mutiny”. Eighteenth-Century Life – Baer, Joel H. (1994)
5. British Piracy in the Golden Age: History and Interpretation 1660–1730- Baer, Joel H. (2007)
6. Pirates of the Eastern Seas (1618–1723): A Lurid Page of History – Grey, Charles (1933)
7. Encyclopedia Brittanica : John Avery
8. Wikipedia : Henry Every
9. “Case of Henry Every”. Privateering and Piracy in the Colonial Period: Illustrative Documents – Jameson, John Franklin (1923)
10. Bold Captain Avery in the Privy Council: Early Variants of a Broadside Ballad from the Pepys Collection- Baer, Joel H. (1995)

নীড় সন্ধানী

অদেখা স্বপ্নের ব্যাপ্তিটা প্রতিদিন বিস্তৃত হতে থাকে.........

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.