ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চট্টগ্রাম অভিযান (১৬৮৬-৮৮)
প্রবল প্রতাপশালী আরাকানি শক্তির কাছ থেকে ১৬৬৬ সালে যখন চট্টগ্রাম শহর অধিকার করেন, তখন শায়েস্তা খান কল্পনাও করেননি, মাত্র দুই দশক পর এই শহরের প্রতি নজর পড়বে নতুন এক বিদেশী শক্তি ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির। বাংলা তখন ভারতবর্ষের সবচেয়ে সমৃদ্ধ প্রদেশ। শাহ সুজার সুবেদারিত্বের সময় এ প্রদেশের সাথে শুল্কমুক্ত বাণিজ্যের অধিকার পেয়েছিল কোম্পানি। সেই সুবিধাটি বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিল শায়েস্তা খানের আমলে। হুগলি বন্দরে সৃষ্ট একটি বিবাদের জের ধরে লন্ডনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সদর দপ্তর থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, মোগলদের কাছ থেকে একটি শহর কেড়ে নিয়ে সেখানে বানানো হবে শ্রেষ্ঠতম ইংরেজ বাণিজ্যনগরী। নগরীটির নাম চট্টগ্রাম।
একুশ শতকের এই সময়ে ২০১৯ সালে, কলকাতা ও চট্টগ্রাম শহরের মধ্যে শক্তি-সামর্থ্যে নিঃসন্দেহে কলকাতা অনেক এগিয়ে। কিন্তু ৩৩৩ বছর আগে জব চার্নকের সামনে ছিল বিপরীত চিত্র। তাই সে সময়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চট্টগ্রাম অভিযান পরিকল্পনায় তিনি সায় দিতে সাহস করেননি। তবু ১৬৮৬ ও ১৬৮৮ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি গোঁয়ার্তুমি করে চট্টগ্রামের উদ্দেশে যুদ্ধ জাহাজ পাঠিয়েছিল। যে অভিযান লজ্জাজনকভাবে ব্যর্থ হওয়ার ফলে কলকাতা নগরের জন্ম প্রক্রিয়ার সূচনা হয়েছিল। ইতিহাসের ছোট্ট কোনায় এখনো খুব তুচ্ছ আকারে Child’s War নামে সেই যুদ্ধটির উল্লেখ আছে। ভারতবর্ষে মোগলদের বিরুদ্ধে সেটা ছিল প্রথম যুদ্ধযাত্রা। সেদিন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চট্টগ্রাম আগ্রাসন যদি সফল হতো এবং ইংরেজরা যদি চট্টগ্রাম দখল করতে সক্ষম হতো, তাহলে আজ কলকাতা নামের কোনো নগরীর অস্তিত্বই থাকত না। জব চার্নক হয়তো কলকাতার বদলে চট্টগ্রামের গভর্নর হিসেবে যাত্রা করতেন।
এ যুগের কলকাতা বা চট্টগ্রামবাসী সম্ভবত ইংরেজের সেই চট্টগ্রাম অভিযানের ঘটনা জানে না। জানে না, কেননা পরবর্তীকালে ইতিহাসের ওই পর্বটিকে ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করে ফেলা হয়েছিল। ইংরেজদের অতীত কেলেঙ্কারিগুলো আমাদের সমকালীন ইতিহাসে খুব অল্পই টিকে আছে। কলকাতার ইতিহাসের সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত হলেও সেই ঘটনাটি এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার কলকাতার ইতিহাস অংশেও রাখা হয়নি। বরং সেখানে বলা হয়েছে
Charnock had previously had disputes with officials of the Mughal Empire at the river port of Hugli (Hooghly) and had been obliged to leave, after which he attempted unsuccessfully to establish himself at other places down the river.
শুনে আশ্চর্য হবেন যে ব্রিটানিকার এ তথ্যটি ভুল। শুল্ক বিবাদের ঘটনার সাথে জড়িত ব্যক্তি জব চার্নক নন, গভর্নর উইলিয়াম হেজেস। এ নিবন্ধের পরবর্তী অংশে ঘটনাটি উদ্ঘাটন করা হবে।
ইতিহাসের কিছু ভুল যেমন থেকে যায় সত্যের চেহারায়, তেমনি অনেক গুরুতর সত্য আড়ালে চাপা পড়ে যায়। ভুল-শুদ্ধ বেছে নেয়ার জন্য পাঠককে হিমশিম খেতে হয়। বাংলার ইতিহাস লেখার কাজটি বাঙালির আগে শুরু করেছিলেন ইংরেজ লেখক। সেই ইতিহাসের একদিকে আছে ইংরেজের সততা আর বীরত্বগাথা, অন্যদিকে আছে বাঙালির শঠতা ও ভীরুতার কাহিনী। গৌরবের কোনো অংশে যেমন বাঙালির অংশ নেই, তেমনি পরাজয়ের অংশে ইংরেজের উল্লেখ নেই। অথচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যখন এ দেশে বাণিজ্য করতে এসেছিল, তখন কতটা সততা আর কতখানি শঠতার আশ্রয় নিয়েছিল, তা এখন ইতিহাসের পাঠকমাত্রই জানেন। ভারতবর্ষে বাণিজ্য শুরুর প্রাথমিক পর্যায়ে ইংরেজদের সফলতার চেয়ে ব্যর্থতার গ্লানি ছিল বেশি। সে কারণে কালিমাযুক্ত অংশগুলোকে যথাসম্ভব ধুয়ে-মুছে পরিচ্ছন্ন ইতিহাস উপহার দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। বাঙালি ইতিহাস লেখকরাও তাদের অনুসরণ করেছেন। তাই আমাদের চোখ থেকে হারিয়ে গেছে ইংরেজের পুরনো কিছু কলঙ্ক।
এবার ঘটনার পেছন দিক থেকে যাত্রা করা যাক।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শুল্ক অসন্তুষ্টি ও বিবাদ ১৬৮২
ইউরোপীয় শক্তিগুলোর মধ্যে পর্তুগিজরাই প্রথম চট্টগ্রামের সাথে যুক্ত হয়েছিল গভীরভাবে। কিন্তু সেটা চট্টগ্রামের জন্য সুখকর অভিজ্ঞতা ছিল না। পর্তুগিজদের নৈরাজ্যকর চরিত্রের কারণে চট্টগ্রামে বাণিজ্যিক সুবিধা পাওয়ার বদলে দুর্নামের কালিমাই লিপ্ত হয়েছে বারবার। ষোড়শ শতাব্দীর শুরু থেকে সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত পর্তুগিজরা চট্টগ্রাম অঞ্চলে দুর্বৃত্তপনায় নিয়োজিত ছিল আরাকানি শক্তির সহায়তায়। ১৬৬৬ সালের মোগল অভিযানের পর আরাকানিদের পাশাপাশি পর্তুগিজদেরও মেরুদণ্ড ভেঙে গিয়েছিল এবং চট্টগ্রাম হয়ে উঠেছিল দক্ষিণ ফ্রন্টে মোগলদের সবচেয়ে শক্তিশালী ঘাঁটি। কিন্তু প্রাচীনকাল থেকে বন্দর হিসেবে চট্টগ্রামের যে সুখ্যাতি ছিল, তা প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল দেড় শতকের মগ-ফিরিঙ্গি দস্যিপনায়। আরব জাহাজের ওপর বারবার হামলার পর মধ্যপ্রাচ্যের সাথে বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যায় ষোড়শ শতাব্দীর শুরুতেই। প্রাচ্যের অন্যান্য বাণিজ্য জাহাজও জলদস্যুদের হামলার ভয়ে এ বন্দর ত্যাগ করেছিল। চট্টগ্রাম হয়ে পড়েছিল আন্তর্জাতিক বাণিজ্যরহিত অঞ্চল।
সপ্তদশ শতাব্দীর শুরু থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পায়ে পায়ে ভারতবর্ষে বাণিজ্য সুবিধা পেতে শুরু করেছিল। শাহ সুজার সময় পর্যন্ত সেটা নিয়ে কোনো সমস্যা হয়নি। সুরাট, মাদ্রাজের পর কোম্পানির বাণিজ্যের আগ্রহ বাংলার দিকে কেন্দ্রীভূত হয়। বাংলা ছিল মোগল সাম্রাজ্যের সমৃদ্ধশালী প্রদেশ। ইউরোপীয়দের বাণিজ্য কেন্দ্রীভূত হতে থাকে হুগলি বন্দরকে ঘিরে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিও সেখানে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করেছিল। কিন্তু বাণিজ্য করতে গিয়ে শাহ সুজার আমলে প্রদত্ত কিছু শুল্ক সুবিধা নিয়ে বিতর্ক দেখা দেয় শায়েস্তা খানের শাসন আমলে। বিতর্কটি হলো শাহ সুজা বাংলার সুবেদার থাকাকালীন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে বাংলায় বিনা শুল্কে অবাধে বাণিজ্য করার অধিকার দিয়ে একটি ফরমান জারি করেছিলেন। ১৬৭২ সালে শায়েস্তা খানের প্রথম সুবেদারিত্বের সময়ও সে সুবিধা অব্যাহত ছিল। কিন্তু ১৬৭৭ সালে বাংলায় শায়েস্তা খানের সুবেদারিত্বের প্রথম মেয়াদ অবসানের পর ফেদাই খানের শাসন আমলে এ সুবিধা রহিত করা হয়। আবার পরবর্তী সুবেদার আজম শাহ শুল্কমুক্ত সুবিধা পুনর্বহাল করেন।
ইংরেজরা ভারতবর্ষে একবার কোনো সুবিধা পেলে সেটা ত্যাগ করতে চিরকালই অনিচ্ছুক ছিল। তাই এ শুল্কমুক্ত সুবিধাকে চিরস্থায়ী করার জন্য সম্রাট আওরঙ্গজেবের সাথে তদবির শুরু করে কোম্পানি। তখন সম্রাটের তরফ থেকে নতুন একটি ফরমান জারি করা হয়। যেখানে বলা হয়, ইংরেজদের সুরাট বন্দরে ২ শতাংশ শুল্কের সাথে আরো ১ দশমিক ৫ শতাংশ জিজিয়া কর যুক্ত করে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ শুল্ক দিয়ে বাণিজ্য করতে হবে। এই ফরমানে কোম্পানি খানিক অসন্তুষ্ট হলো। তবে সুরাট বাদে বাকি বন্দরগুলো আগের মতো শুল্কমুক্ত থাকায় তেমন আপত্তি করেনি। কোম্পানির আগ্রহ বাংলার দিকে। হুগলি বন্দর শুল্কমুক্ত থাকলেই হলো।
কিন্তু ১৬৮২ সালে হুগলি বন্দরের কর্তারা এ ফরমান উপেক্ষা করে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ শুল্ক দাবি করে কোম্পানির মালবাহী জাহাজ আটক করলে ঝামেলার সূত্রপাত হয়। বাংলায় তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গভর্নর ছিলেন উইলিয়াম হেজেস। সৃষ্ট জটিলতার সমাধান করতে গিয়ে তিনি নিজেও ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েন। তাঁর বজরাও আটক রাখে হুগলির মোগল বাহিনী। ফরমান আনার জন্য তিনি ঢাকায় শায়েস্তা খানের দরবারে যাওয়ার চেষ্টা করলে তাঁকে বাধা দেয়া হয়। পরে গভর্নর হেজেস কৌশলে তাদের ফাঁকি দিয়ে অন্য একটি নৌযানে পালিয়ে ঢাকার ইংরেজ কুঠিতে পৌঁছেন এবং তারপর শায়েস্তা খানের দরবারে উপস্থিত হন। হুগলি পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে নবাবের সাহায্য কামনা করলে নবাব তাঁকে একটি পরোয়ানা লিখে দিলে তিনি সন্তুষ্ট হয়ে ফিরে আসেন। কিন্তু দেখা গেল, নবাবের পরোয়ানাও উপেক্ষা করছেন স্থানীয় শুল্ক কর্তারা। মোটা অংকের ঘুষ দিয়ে পণ্য খালাস করতে হচ্ছিল। ঘুষ না দিলে পণ্য আটকে রাখা হচ্ছিল।
গভর্নর হেজেসের সাথে কাজ করত ছয় সদস্যের একটি কাউন্সিল, যার অন্যতম ছিলেন জব চার্নক। জব চার্নক ১৬৫৫ সালে ২০ পাউন্ড বেতনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে চাকরি শুরু করেছিলেন। বিয়ে করেছিলেন এক ভারতীয় হিন্দু নারীকে, যাকে তিনি সতীদাহের আগুন থেকে রক্ষা করেছিলেন। বিয়ের পর চার্নক নিজেও হিন্দু হয়ে যান বলে ইংরেজদের অভিমত। বিবাহ ও কর্মজীবনের অভিজ্ঞতা সূত্রে জব চার্নক ভারতীয়দের চরিত্র সম্পর্কে অন্যদের চেয়ে ভালো বুঝতেন। কিন্তু চার্নকের সাথে হেজেসের সম্পর্ক ভালো ছিল না। জব চার্নক খোলাখুলিভাবে তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করতেন। তাই এ শুল্ক সমস্যার সমাধানে তাঁর সাথে আলোচনা করেননি হেজেস। কাউন্সিলের বাকি সদস্যদের সাথেও হেজেসের সম্পর্ক তেমন ভালো ছিল না। ফলে এ সমস্যার সমাধানে তাদের সহায়তাও পাননি তিনি। পরিষদে তাঁর বিপক্ষ দল উল্টো তাঁর বিরুদ্ধে মোগলদের সাথে আপসকামিতার অভিযোগ আনে। শুধু তা-ই নয়, তাঁর বিরুদ্ধে লন্ডনের কোর্ট অব ডিরেক্টরসের কাছেও অভিযোগ পাঠান একাধিক পরিষদ সদস্য।
গভর্নর উইলিয়াম হেজেসের পদচ্যুতি ও অ্যাডমিরাল নিকলসনের চট্টগ্রাম অভিযান
পরিষদের সদস্যদের অভিযোগের ভিত্তিতে ১৬৮৩ সালের শেষ দিকে হেজেসকে অব্যাহতি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় কোর্ট অব ডিরেক্টরস। হেজেসকে বিদায় করলেও বিদায়কালে শুল্ক বিতর্কের সমাধানে লন্ডনে কোর্ট অব ডিরেক্টরসকে যে পরামর্শ দিয়েছিলেন, তা গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হয়। পরামর্শটি ছিল, মোগলদের কাছ থেকে বাংলার যেকোনো একটি ভূখণ্ড দখল করে নিজেদের একটি স্থায়ী বাণিজ্য কুঠি নির্মাণ করা হলে সেখানে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির স্বার্থ রক্ষা করা সহজ হবে।
অনেক বিষয়ে চার্নকসহ কোম্পানির অন্যান্য কর্মকর্তার সাথে তাঁর মতের অমিল থাকলেও বাংলায় নিজস্ব একটি বাণিজ্য কুঠি নির্মাণের ব্যাপারে কারো আপত্তি দেখা যায়নি। হেজেস তাঁর ডায়েরিতে উল্লেখ করেছিলেন যে
Experience soon showed that treaties and agreement were no avail against lawlessness of the local officials…We must protect ourselves; we must break with Indian government; we must seize some convenient post and fortify it.(3)
সেই কুঠি এমন একটি জায়গায় নির্মিত হতে হবে, যেখানে বাণিজ্য ও প্রতিরক্ষা দুটোর সুবিধাই যেন থাকে। কিন্তু স্থানটি কোথায় হবে, সেটা নিয়ে সমঝোতায় পৌঁছতে পারেনি তখনো। এ বিষয়ে আলোচনার সময় নানা প্রশ্ন তুলেছেন কোর্ট অব ডিরেক্টরসের কিছু সদস্য। এটা অনেক ব্যয়বহুল ব্যাপার, মোগলদের ক্ষেপিয়ে ব্যবসা করা যাবে না, তাদের সাথে ডাচদের ভালো সম্পর্ক, তাদের সাহায্য নিলে কোম্পানির ওপর বিপদ আসতে পারে ইত্যাদি আশঙ্কা করছিলেন একাধিক সদস্য। তবে সেই আলোচনার মাঝে কথা উঠল, যদি মোগলদের সাথে বাংলায় যুদ্ধ করতেই হয়, তাহলে চট্টগ্রাম দখল করে নিলেই তো হয়। মোগলরা আরাকানের কাছ থেকে চট্টগ্রাম দখল করেছে মাত্র কয়েক বছর আগে।
হেজেস ডায়েরিতে লিখেছেন
in spite of all objections, the idea gradually took hold of the English mind at home as in Bengal; and year after year the court recurred to the scheme of getting possession of Chittagong(2)
অতঃপর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলায় একটি ব্রিটিশ উপনিবেশ গড়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে তাদের কাছে সম্পূর্ণ অচেনা একটি নগর চট্টগ্রামকে ঘিরে।
প্রাথমিক পরিকল্পনা ছিল এ রকম:
An ultimatum was to be sent to the nabob at Dacca, and if, as was probable, no satisfactory answer was received, the bulk of the force was to proceed to Chittagong. Here, “after summons, if the Fort, Town, and Territory thereunto belonging be not forthwith delivered to our Lieutenant-Colonel Job Charnock, we would have our forces land, seize and take the said Town, Fort, and Territory by force of arms.” The place, when captured, is to be made “as the art and invention of man can extend to,” and Job Charnock was to be Governor of our Fort, Town, and Territory of Chyttegam. [p90, Early Annals-1]
বিষয়টি নিয়ে কোম্পানির দুই রকমের চিন্তা কাজ করছিল। যদি শুধু শিল্প বাণিজ্য নিয়ে থাকলে চলে, তাহলে হুগলিতে স্থির থাকলেই হয়। কিন্তু যদি সামরিক শক্তি প্রয়োগের কথা ভাবা হয়, তাহলে অবশ্যই চট্টগ্রাম দখল করা উচিত।
চট্টগ্রামকে কত অনায়াসে দখল করে নেয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছিল, সে প্রসঙ্গে পরবর্তী সময়ে আরেকজন ইংরেজ ঐতিহাসিক ক্যাপ্টেন আর্থার ব্রুম লিখেছিলেন—
Chittagong was fixed upon as the place of debarkation, with orders take possession of and defends it in the strongest possibe manner, for which purpose 200 pieces of cannon were sent out to be mounted on the works. As soon as Chittagong should be captured and put in a state of proper defence, the troops and the smaller vessels were so proceed against Dacca, which it was contemplated would offer but little resistance; and when masters of his capital, terms were to be offered to the Nawaub on the following conditions:
‘That he should cede the city and territory of Chittagong to the company and pay the debts due by him; that he should alllow rupees coined at Chittagong to pass current in the Province, and restore all privileges according to the ancient Phirmaunds; each party to bear their respective losses and expenses in the war; on these condition alone the company would agree to resettle the factories in Bengal’ (5)
সেই সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে লন্ডনের কোর্ট অব ডিরেক্টরস চট্টগ্রাম অভিযানের ব্যাপারে রাজা দ্বিতীয় জেমসের অনুমতি সংগ্রহ করে। তারপর ১৬৮৬ সালে অ্যাডমিরাল নিকলসনের নেতৃত্বে ১২টি সশস্ত্র জাহাজের বড় একটি বহর রওনা হলো চট্টগ্রামের উদ্দেশে। সরাসরি ইউরোপ থেকে এর আগে আর কোনো দেশ মোগলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেনি।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হুগলি হত্যাকাণ্ড
লন্ডনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সদর দপ্তর যখন চট্টগ্রাম পরিকল্পনাকে বাস্তবায়ন করার জন্য যুদ্ধ জাহাজ পাঠিয়ে দিয়েছিল, তখন বাংলায় অন্য এক নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছিল। কাশিমবাজার কুঠিতে জব চার্নক স্থানীয় ব্যবসায়ীদের করা এক মামলায় ৪৩ হাজার রুপির ঘুষের মামলায় দোষী সব্যস্ত হয়েছিলেন। বিচারকের রায়ের প্রতি সমর্থন জানিয়ে শায়েস্তা খান তাঁকে ঢাকায় তলব করার পর তিনি হাজির হতে অস্বীকার করলে তাঁর তত্কালীন অবস্থান কাশিমবাজার কুঠি অবরোধ করা হয়। একদিন সেই অবরোধের ফাঁক গলে চার্নক হুগলি পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। জব চার্নক একসময় হুগলি ফ্যাক্টরির প্রধান ছিলেন। হুগলিতেই ইংরেজ জাহাজের আনাগোনা সর্বাধিক। তাই তিনি নিজেকে হুগলিতে নিরাপদ মনে করেছিলেন।
এসব ঘটনা চলাকালীন অবস্থায়ই ইংল্যান্ড থেকে কোম্পানির পাঠানো জাহাজগুলো বঙ্গোপসাগরে এসে পৌঁছে যায়। তারপর ঝড়ের মুখে পড়ে পথ হারিয়ে হুগলি নদীতে ঢুকে পড়ে। এরই মধ্যে বহরের অর্ধেক জাহাজ নিখোঁজ হয়েছে। বাকি ছয়টি জাহাজ প্রতিকূল বাতাসের টানে এবং কিছুটা পথ ভুল করে হুগলি নদীতে ঢুকে পড়ে। বহরের বড় যুদ্ধ জাহাজগুলো হলো ৭০ কামান সজ্জিত Beaufort, ৫০ কামান সজ্জিত Nathaniel, ৬৫ কামান সজ্জিত Rochester, তাছাড়া এদের সাথে ১২ কামান সজ্জিত তিনটি ফ্রিগেট যুক্ত ছিল। এছাড়া মাদ্রাজের ফোর্ট জর্জ থেকে আরো জাহাজ ও সৈন্যদের চট্টগ্রাম অভিযানে যুক্ত হওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছে কোর্ট অব ডিরেক্টরস।
কোম্পানির নির্দেশে অ্যাডমিরাল নিকলসনের চট্টগ্রাম অভিযানের পরিকল্পনাটা চার্নকের পছন্দ হয়নি। কিন্তু হুগলিতে সেই মুহূর্তে ইংরেজ যুদ্ধ জাহাজের উপস্থিতি নিঃসন্দেহে তাঁকে স্বস্তি দিয়েছিল মোগলদের কাছ থেকে আত্মরক্ষার স্বার্থে।
লন্ডনের সভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল যে জব চার্নককে কর্নেল পদে উন্নীত করে তাঁকে সেই অভিযানের স্থলবাহিনীর নেতৃত্ব অর্পণ করা হবে। কিন্তু পরিকল্পনাটি যারা প্রণয়ন করেছিলেন, ইংল্যান্ডের সেই কর্তাদের আদৌ জানা ছিল না অভিযানটি কোন পথে অগ্রসর হবে। জব চার্নকের সাথেও এ ব্যাপারে আলোচনা করেনি কেউ। পরিকল্পনাটি ছিল অসম্পূর্ণ ও আনাড়ি। এ অঞ্চলের ভূগোল সম্পর্কে অজ্ঞতাও একটা কারণ।
দিল্লির সম্রাট আওরঙ্গজেব কিংবা বাংলার সুবেদার শায়েস্তা খান ইংরেজদের এসব যুদ্ধ পরিকল্পনার কিছুই জানতেন না। তবে হুগলিতে ইংরেজদের একটা সশস্ত্র নৌবহরের আগমনের খবর তাঁর কানে পৌঁছেছিল। সে কারণে শায়েস্তা খান হুগলি বন্দর প্রতিরক্ষার উদ্দেশে তিন হাজার পদাতিক ও ৩০০ ঘোড়সওয়ার বাহিনী নিয়ে একটি অভিযান পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন। সম্ভবত চার্নক পালিয়ে হুগলি চলে গেছেন, এ খবরও নবাবের কানে গিয়েছিল ততদিনে।
ওই বাহিনী আসার আগে হুগলির মোগল গভর্নর ইংলিশ জাহাজকে আক্রমণের উদ্দেশে বন্দরে ১১টি কামান স্থাপন করেন এবং ইংরেজদের সাথে সব লেনদেন কাজকর্ম বন্ধ করে দেন। তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য, ঘর-বাড়ি থেকে সব স্থানীয় কর্মচারীকে সরিয়ে দেন। এমনকি ব্যবসায়ীদের নির্দেশ দেয়া হয় ইংরেজদের সাথে কোনো পণ্য কেনাবেচা না করার জন্য।
এর মধ্যে একদিন একটা অনাহূত ঘটনা দ্রুত অবনতি ঘটাল পরিস্থিতির। ২৮ অক্টোবর ১৬৮৬ সকালে তিনজন ইংরেজ সৈন্য বাজারে যাওয়ার পথে তাদের বেধড়ক মারধর করে মোগল সৈন্যরা এবং আটকে রাখে কেল্লায়। এদের উদ্ধার করার জন্য ক্যাপ্টেন লেসলির নেতৃত্বে একটি দল এগিয়ে গেলে তাদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে সাতজনকে হত্যা করা হয়।
ঘটনাটি ইংরেজ শিবিরে চরম উত্তেজনার জন্ম দেয়। উপস্থিত ইংরেজ সৈন্যরা মোগলদের সাথে পেরে উঠছিল না বলে চন্দননগর থেকে বাড়তি সৈন্য আসার জন্য খবর দেয়া হয়।
চন্দননগর থেকে সাহায্যকারী বাহিনী আসার পর মোগলদের ওপর ভয়াবহ আক্রমণ চালানো হয়। এ আক্রমণে স্বয়ং হুগলির মোগল গভর্নর আবদুল গনির বাসভবন পর্যন্ত আক্রান্ত হয়। গভর্নর নৌপথে পালাতে সক্ষম হলেও হুগলিজুড়ে তাণ্ডব চালিয়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে ইংরেজ বাহিনী। ৬০ জনের মতো নিহত হয় মোগল পক্ষে, অগণিত মানুষ আহত হয়, পাঁচ শতাধিক ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে ছারখার করে দেয়া হয় হুগলি নগরীকে। এ পরিস্থিতিতে হুগলির মোগল গভর্নর ডাচদের মধ্যস্থতায় আপসের প্রস্তাব দিলে দুই পক্ষের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়। ইংরেজরা চুক্তির শর্তানুযায়ী তাদের খাবারদাবার, চাকরবাকর ও শ্রমিক জোগান দেয়ার দাবি জানায়। নবাবের নির্দেশে দেশীয় শ্রমিকরা ইংরেজদের সাথে কাজ করতে অস্বীকার করেছিলেন। ইংরেজরা আরো জানায়, তারা যেন তাদের ফ্যাক্টরিতে উৎপাদিত শোরা (Saltpetre) রফতানি অব্যাহত রাখতে পারে। ভারতে তখন ইংরেজদের প্রধান রফতানি পণ্য শোরা। শোরা বিস্ফোরক তৈরির প্রধান উপকরণ।
এভাবে আরো প্রায় দুই মাস হুগলিতে অবস্থান করে ইংরেজরা জাহাজ মেরামত, শোরা গুদামজাত ও প্যাকেটজাত ইত্যাদি কাজ করে। ২০ ডিসেম্বর শান্তিপূর্ণভাবে হুগলি ছেড়ে যায় ইংরেজ বাহিনী।
জব চার্নকের সুতানটি প্রস্তাব
হুগলি ছেড়ে যাওয়ার পথে চার্নক ভাবতে থাকেন, এখন কোন পথে অগ্রসর হওয়া উচিত? কোম্পানির সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য বালাশোর গিয়ে যুদ্ধ প্রস্তুতি নেবেন চট্টগ্রাম দখলের জন্য? নাকি হিজিলি গিয়ে মোগলবিরোধী শাসকের আমন্ত্রণ গ্রহণ করে প্রস্তুতি নেবেন পরবর্তী আক্রমণের?
জব চার্নক এর কোনোটাই করলেন না।
তিনি আপাত উদ্দেশ্যহীনভাবে তাঁর বাহিনী নিয়ে হুগলি নদীতে কিছু দূর গিয়ে সুতানটি নামক একটা জায়গায় যাত্রাবিরতি করলেন। জায়গাটি নিরিবিলি। এখানে কিছুদিন অবস্থান করা যায়। অল্প সময়ের মধ্যে সুতানটি জায়গাটি তাঁর মনে কেড়ে নিল। দেখে-শুনে মনে মনে ভাবলেন, বাংলায় ইংরেজদের বাণিজ্য কুঠি নির্মাণের জন্য এর চেয়ে উপযুক্ত স্থান আর হয় না। প্রতিরক্ষা ও বাণিজ্য দুটোর জন্যই জায়গাটি উপযুক্ত। কুঠি নির্মাণের যোগ্য বাকি তিনটি জায়গার সাথে তুলনা করে এটাকেই উত্তম বলে ভাবলেন। হুগলি, হিজিলি, বালাশোর—এ তিনটি স্থানের চেয়ে এই বিরানভূমি যোগ্যতর। কেননা স্থানটি মোগলদের চোখে গুরুত্বপূর্ণ কোনো স্থান নয়। সুতরাং এখানে কুঠি তৈরি করলে তাদের আপত্তি থাকার কথা না। সিদ্ধান্তটি একান্তই তাঁর নিজস্ব, বাস্তবায়নের ক্ষমতাপ্রাপ্ত ছিলেন না বলে চিন্তাটা মনের ভেতরেই থেকে গেল তখনকার মতো।
চার্নকের সুতানটি অবস্থানের খবর পেয়ে ঢাকার ইংরেজ এজেন্ট ওয়াটস শায়েস্তা খানের এক প্রতিনিধি বারামালের সাথে এসে পৌঁছেন। বারামাল ইংরেজদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন বলে তাঁর মাধ্যমে চার্নক সুতানটিতে কুঠি নির্মাণের অনুমতি চেয়ে ইংরেজদের ১২ দফা দাবি পেশ করলেন ১১ জানুয়ারি ১৬৮৭ সালে। এর জবাবে বারামালের মাধ্যমে জানানো হলো, দাবিগুলো দিল্লির অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে।
কিন্তু তিন সপ্তাহ পর দেখা গেল, কুঠি নির্মাণের অনুমতি তো এলই না, তার বদলে নতুন এক হুমকি এসে হাজির। ইংরেজদের কুঠি নির্মাণের এ দাবিকে ধৃষ্টতা হিসেবে ধরে নিয়ে নবাব তাঁর বাহিনীকে আদেশ করেছেন, বেয়াদব ইংরেজদের যেন এ অঞ্চল থেকে সমূলে উচ্ছেদ করা হয়।
এটা শুনে আবারো ক্ষেপে গেল ইংরেজ বাহিনী। যুদ্ধের দামামা বেজে উঠল। ৯ ফেব্রুয়ারি প্রথম আক্রমণে নবাবের লবণ গুদাম ধ্বংস করে দেয়া হলো। লবণ খুব মূল্যবান পণ্য ছিল সে সময়। মোগলদের কয়েকটি থানাও আক্রমণ করে দখল করা হলো। অ্যাডমিরাল নিকলসনকে পাঠানো হলো হুগলির দক্ষিণে হিজিলি দখল করতে। মাত্র কয়েক মাস আগে করা চুক্তির শান্তি ভেস্তে গেল এখানেই।
হিজিলি দখল করার পর সেখানে ইংরেজদের অস্থায়ী ঘাঁটি করা হলো। সব ইংরেজ বাহিনী সেখানে একত্র হলো। মোগলদের যেকোনো আক্রমণ ঠেকাতে জল ও স্থলপথে প্রস্তুত থাকল বাহিনী। হিজিলির শাসক কিছুটা মোগলবিরোধী ছিল বলেই হয়তো ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় কিংবা ভয়ে ইংরেজদের সাহায্য করতে লাগল। হিজিলির পর দখল করা হলো বালাশোর। আবারো তছনছ করা হলো হুগলি। চারদিকে ইংরেজ বাহিনীর জয়জয়কার। এই আপাত বিজয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন চার্নক। মার্চ-এপ্রিল দুই মাস ধরে হিজিলিতে ঘাঁটি করে বসে থাকল চার্নক বাহিনী।
কিন্তু তখনো তারা টের পায়নি মোগল বাহিনীর আসল শক্তি।
২৮ মে ১৬৮৭ বিপুল শক্তি নিয়ে মোগল বাহিনী এসে হাজির হলো হিজিলির কাছে। এবার মোগলদের প্রচণ্ড আক্রমণে ইংরেজ বাহিনীর ত্রাহি ত্রাহি দশা। চতুর্মুখী আক্রমণ থেকে পালিয়ে বাঁচারও কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছিল না ইংরেজ বাহিনী। ওদিকে অ্যাডমিরাল নিকলসনের জাহাজ ফুটো হয়ে গেছে বলে মালপত্র ছুড়ে ফেলে দিচ্ছে সাগরে। চার্নক নিজের প্রাণ বাঁচাতে হিমশিম খাচ্ছিল। পরাজয় একদম নিশ্চিত, এমনকি মৃত্যুও।
সেই চরম দুঃসময়ে একটা আশার আলো দেখা গেল, যখন ক্যাপ্টেন ড্যানহেমের নেতৃত্বে একটা ইংরেজ যুদ্ধ জাহাজ হুগলির মোহনার কাছে পৌঁছল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গোলন্দাজ বাহিনীর খুব সুনাম ছিল সে সময়। ড্যানহেমের গোলন্দাজ বাহিনীর ঝটিকা আক্রমণে মোগলদের এমন ক্ষয়ক্ষতি হলো যে এবার মোগল বাহিনীই বাধ্য হলো যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব পাঠাতে।
জব চার্নক যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হলে ১০ জুন আবারো সন্ধিচুক্তি হয় দুই পক্ষের মধ্যে। সেই সন্ধি মুহূর্তের সুযোগ নিয়ে নাছোড়বান্দা জব চার্নক তাঁর সুতানটিতে কুঠি গড়ার প্রস্তাবটি আবারো নবাবের কাছে পাঠালেন। শায়েস্তা খানের কাছে পাঠানো প্রস্তাব অনুমোদনের অপেক্ষায় থাকা জব চার্নক তখনকার মতো উলুবাড়িয়ার দিকে পাল তোলেন।
এসব যুদ্ধবিবাদের গণ্ডগোলে অ্যাডমিরাল নিকলসনের চট্টগ্রাম অভিযান সেখানেই বাতিল হয়ে পড়ে।
উইলিয়াম হিথের অসংলগ্ন চট্টগ্রাম অভিযান ১৬৮৮
জব চার্নক যখন হুগলি নদীর তীরে সুতানটিতে বাণিজ্য বসতির আশার পাল তুলে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন, লন্ডনের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হেডকোয়ার্টারে চলছিল তাঁর তীব্র সমালোচনা। মোগলদের সাথে এই শান্তি চুক্তি, কুঠি নির্মাণের অনুমতি প্রার্থনা ইত্যাদি নমনীয় কর্মকাণ্ডকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কোর্ট অব ডিরেক্টরস ঠিক মেনে নিতে পারছিল না। এই আপসকামী মনোভাবকে ইংরেজের দুর্বলতার প্রকাশ বলে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন কোম্পানির কর্তারা। অ্যাডমিরাল নিকলসনের চট্টগ্রাম অভিযান ভেস্তে গেল চার্নকের সুতানটি পছন্দের কারণে। অথচ বাংলায় তখনো দুর্গ তৈরির একটা ইটও বসাতে পারলেন না চার্নক।
সুতরাং গভর্নর জোশিয়া চাইল্ড নতুন করে আরেকটি অভিযানের পরিকল্পনা করলেন। এবার চার্নককে ডিঙিয়ে সর্বময় ক্ষমতা দিয়ে নির্বাচিত করলেন ক্যাপ্টেন উইলিয়াম হিথকে। কোম্পানির নিজস্ব সিদ্ধান্তে ১১টি জাহাজের আরেকটি বহর চট্টগ্রাম অভিযানে যাবে এমন এক ব্যক্তির নেতৃত্বে, যার কোনো ধারনাই নেই, মানচিত্রের ঠিক কোথায় চট্টগ্রামের ভৌগোলিক অবস্থান।
মাথা গরম, আত্মঅহংকারী, অস্থির প্রকৃতির মানুষ হিসেবে পরিচিত এই ক্যাপ্টেন হিথ। চট্টগ্রাম থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে বসে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কোর্ট অব ডিরেক্টরস স্থির সিদ্ধান্তে এল, যেকোনো মূল্যে চট্টগ্রাম দখল করতে হবে এবং ক্যাপ্টেন হিথ হলেন তার উপযুক্ত নেতা।
কোম্পানির এ অভিযানের সংবাদ পেয়ে চার্নক খুশি হলেন না। তিনি খুব ভালো করে জানেন চট্টগ্রামের অবস্থা। সে কারণেই একমত নন এই পন্থার সাথে। ইংরেজদের পক্ষে চট্টগ্রাম দখল করা অসম্ভব। যদি কোনোমতে দখল করা সম্ভবও হয়, তবু তাকে ধরে রাখা কোম্পানির পক্ষে কষ্টসাধ্য। চট্টগ্রামে মোগল অবস্থান অনেক বেশি শক্তিশালী। আরাকানিদের কাছ থেকে চট্টগ্রাম অধিকার করার জন্য মোগলরা অনেক বেশি কাঠখড় পুড়িয়েছে। তার কাছে ঘেঁষাও নিরাপদ না এখন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এখন দরকার এমন জায়গা, যেখান থেকে বাণিজ্য করা সহজ, কিন্তু দখলে রাখা নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে হবে না। পশ্চিমবঙ্গের দিকে হুগলি, হিজিলি, উলুবাড়িয়া—এ তিনটি স্থানের অভিজ্ঞতা সুখকর নয় বলে সুতানটির মতো বিরানভূমিকে পছন্দ হয়েছে চার্নকের। এটা অখ্যাত একটা গ্রাম, দখলে রাখা নিয়ে মোগলদের কোনো আগ্রহ নেই বলে মনে হয়। সুতানটি অঞ্চলে হুগলি নদীতে জাহাজ নোঙর করার সুবিধা আছে। সুবিধা আছে প্রতিরক্ষার। শত্রুর মোকাবেলায় নিজেদের জাহাজ দিয়ে কুঠির নিরাপত্তা বিধান করা যাবে। তাই দ্বিতীয়বার সুতানটি এসে মোগলদের নানাবিধ বাধার মুখেও বছরখানেক গেড়ে বসে থাকলেন এবং ছোটখাটো স্থাপনা নির্মাণের চেষ্টা করলেন স্থানীয় মোগল শাসকের সাথে আপস করে। জব চার্নক তখনো আশাবাদী, নবাবের অনুমতি মিলবেই।
উইলিয়াম হিথের প্রথম পাগলামি
জব চার্নক যখন সুতানটিতে থিতু হওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন, ক্যাপ্টেন হিথ তখন ইংল্যান্ড থেকে ছুটে আসছিলেন যেকোনো মূল্যে নিজের মিশনটাকে সফল করার জন্য।
২০ সেপ্টেম্বর ১৬৮৮ কলকাতা পৌঁছেই হিথ যুদ্ধ পরিষদের সভা ডাকলেন এবং কোর্ট অব ডিরেক্টরসের নির্দেশনা জানালেন সবাইকে। এটা নিয়ে তুমুল বিতর্ক হলো এবং যুদ্ধ পরিষদের সদস্যরা যেসব মতামত দিয়েছেন, তার সবই হিথের অভিযানের বিপক্ষে। তবু ক্যাপ্টেন হিথ সবার মতামতকে পাশ কাটিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন, চট্টগ্রামে অভিযান চালানো ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই তাঁর কাছে।
কিন্তু কোম্পানির অবস্থান হিথের চেয়ে একটু ভিন্ন। যেহেতু এটা একটা দূরবর্তী নির্দেশের মিশন, সেখানে কিছুটা নমনীয়তার অবকাশ ছিল। কোর্ট অব ডিরেক্টরস চার্নকের ওপর পুরোপুরি বিশ্বাস হারায়নি। তাই হিথকে পাঠানো পরের চিঠিতে বলে রেখেছিল, ‘চার্নক যদি এরই মধ্যে শান্তিপূর্ণভাবে কুঠি গড়ার একটি স্থানকে নির্ধারিত করে থাকে, তাহলে তোমাকে সেটার ভিত্তি নির্মাণের দিকেই মনোযোগী হতে হবে এবং পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত চট্টগ্রাম অভিযান মুলতবি রাখতে হবে।’
তিন সপ্তাহ পরের একটা চিঠিতে কোর্ট সুতানটি প্রস্তাবের পক্ষে আরেকটু পরিষ্কার অবস্থান ঘোষণা করে, ‘আগেকার সব মোগল সম্রাটের আমলে বাংলায় আমাদের অবস্থান যে শান্তিপূর্ণ ছিল, তাতে সন্দেহ নেই, অতএব চার্নক যদি কাশিমবাজার ও মালদার কুঠি পুনরুদ্ধার করে ব্যবসা চালু করতে পারে, সেটাই কোম্পানির জন্য মঙ্গলজনক। তবে যেহেতু তিনি প্রতিরক্ষামূলক বাণিজ্য কুঠির জন্য সুতানটিকে পছন্দ করেছেন, আমাদের বিশ্বাস যথাসম্ভব ব্যয়সংকোচন করে ওখানেও কুঠি গড়া যেতে পারে।’
এটা ঠিক যে চার্নকের গড়া সুতানটির অস্থায়ী স্থাপনাটি মোটেও সুরক্ষিত নয়, প্রতিরক্ষার জন্য একটা ইটের দেয়ালও নেই। তবু এটার সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো দক্ষিণ ও পূর্ব দিকে কোম্পানির জাহাজ ইচ্ছামতো আসা-যাওয়া করতে পারবে এবং কুঠির নিরাপত্তায় নিয়োজিত থাকতে পারবে। নৌশক্তি যাদের প্রধান ভিত্তি, তাদের জন্য এমন নদীতীরের স্থাপনা সুবিধাজনক। এ সুবিধা ক্যাপ্টেন হিথ দেখতে ব্যর্থ হয়েছিলেন কিংবা দেখতে চাননি আত্মগরিমার কারণে।
তাই কোর্ট অব ডিরেক্টরসের এমন নমনীয় অবস্থান দেখেও তিনি পরিষদকে সাফ জানিয়ে দেন যে বাংলায় কোম্পানির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার একমাত্র কর্তৃত্ব তাঁর। তিনি মোগলদের সাথে আপস করার কোনো যুক্তিই খুঁজে পান না। তিনি পরিষদকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত সময় বেঁধে দিলেন মোগলদের ব্যাপারে তাদের যা করার কিংবা যা কিছু খোঁজখবর নেয়ার। এর মধ্যে তিনি তাঁর জাহাজগুলো মেরামত, রক্ষণাবেক্ষণ ইত্যাদি কাজ সেরে অভিযানের জন্য প্রস্তুত করে নেবেন, তারপর চট্টগ্রাম দখল করার জন্য রওনা হবেন।
উইলিয়াম হিথের দ্বিতীয় পাগলামি
কিন্তু তিন সপ্তাহ না যেতেই তিনি শুনতে পেলেন, ঢাকায় নতুন নবাব বাহাদুর খান আরাকানের উদ্দেশে একটা অভিযান চালাতে যাচ্ছেন চট্টগ্রাম থেকে। এটা শোনার পর নতুন এক ফন্দি খেলে গেল তাঁর মাথায়। তিনি নবাবকে দ্রুত একটি পত্র পাঠিয়ে জানালেন, আরাকানি অভিযানে ইংরেজরা নবাবকে সাহায্য করতে প্রস্তুত। যদি নবাব ইংরেজদের আগের সব সুযোগ-সুবিধা বহাল করেন। তবে সেই মর্মে তাঁর নিজের স্বাক্ষরিত একটি আদেশ জারি করতে হবে, যেন ইংরেজরা একটি সুরক্ষিত কুঠি তৈরি করতে পারে, যা কোম্পানির কর্মচারীদের নবাবের পেটি অফিসারদের অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা করে। যদি নবাব সেটা করতে ব্যর্থ হন, তাহলে আমরা সব ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে এ দেশ ত্যাগ করে চলে যাব। এমন অনিরাপদ অবস্থায় এখানে ব্যবসা করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।
এ ধরনের ঔদ্ধত্যপূর্ণ শর্তযুক্ত সাহায্যের প্রস্তাবকে নবাব বাহাদুর খান নিশ্চিতভাবেই বন্ধুসুলভ না ভেবে হুমকি হিসেবেই নিতেন। কিন্তু ভাগ্যক্রমে ঢাকায় তখন যে দুজন প্রভাবশালী ইংরেজ কর্মকর্তা ছিলেন, তাঁরা বার্তাটি নবাবের কাছে পাঠানোর আগে খানিক বদলে দিয়ে নমনীয় সুরে আরেকটি লিখে পাঠান। নবাব সেই চিঠিকে দ্রুততার সাথে বিবেচনা করেন এবং সম্মতি দিয়ে মালিক বরকরদার নামে একজনকে হুগলিতে পাঠানোর হুকুম দিলেন।
কিন্তু ক্যাপ্টেন হিথের মাথায় তার আদি চিন্তাই ঘুরপাক খাচ্ছিল। তিনি মালিক বরকরদারের মতো একজনের জন্য অপেক্ষা করতে রাজি না, যে কিনা ইংরেজের পুরনো দুশমন, চার্নকের সুতানটি প্রস্তাবের সমর্থক। যদিও হিথের বেঁধে দেয়া সময় তখনো উত্তীর্ণ হয়নি, তবু তিনি ৮ নভেম্বরই কোম্পানির সব কর্মচারীকে হুকুম দিলেন যার যার মালপত্র নিয়ে জাহাজে উঠে পড়তে এবং নতুন জায়গা খোঁজার জন্য বেরিয়ে পড়তে।
মালিক বরকরদার হুগলি উপস্থিত হয়ে এ কাণ্ড দেখে বিস্মিত হয়ে গেলেন। তিনি অনেক চেষ্টা করেও ইংরেজদের ফেরাতে পারলেন না। অনেকটা গোসা করেই যেন হুগলি ছেড়ে চলে গেল ইংরেজ বাহিনী।
উইলিয়াম হিথের তৃতীয় পাগলামি
ক্যাপ্টেন হিথকে ১৬ নভেম্বর বালাশোরের রাস্তায় দেখা গেল চার্নকের সাথে। হুগলি ছেড়ে তাঁরা তখন বালাশোর এসে পৌঁছেছিলেন। বালাশোরে ইউরোপ থেকে আসা যুদ্ধ জাহাজ ‘ডিফেন্স’ ও ‘প্রিন্সেস অব ডেনমার্ক’ নামে দুটো জাহাজের সাথে আরো ১৩-১৪টি ছোট জাহাজ ছিল। বালাশোরের মোগল গভর্নর ইংরেজদের ব্যাপারে আগে থেকেই সতর্ক ছিলেন বলে তাঁর বাহিনী নিয়ে নদীর তীরে মজবুত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন এবং নিজেই সেখানে তাঁবু গেড়ে বাস করতেন। তিনি প্রতিদিন ইংরেজদের ব্যাপারে ঢাকার সিদ্ধান্তের অপেক্ষা করতেন। ঢাকার সিদ্ধান্ত আসার আগ পর্যন্ত নিজ থেকে তিনি ইংরেজদের ওপর এমন এক ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলেন, যেন তারা বালাশোরে কোনো রকমের লেনদেন বা কেনাকাটা কিছুই করতে না পারে।
এক্ষনে ক্যাপ্টেন হিথ অনুভব করতে শুরু করলেন, ব্যাপারটা জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্থানীয় বাজারের সরবরাহ ছাড়া এত বিপুল লোকের খাবারদাবার জোগানো সহজ কাজ নয়। তিনি গভর্নরের কাছে বারবার লোক পাঠিয়ে খবর নিচ্ছেন, তাদের ব্যাপারে ঢাকার কোনো বার্তা আছে কিনা। কোনো সংবাদ না পেয়ে তিনি গভর্নরকে সতর্ক করে দিলেন, এটার জন্য যদি শান্তিভঙ্গ হয়, তাহলে গভর্নরই দায়ী থাকবেন। ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত কোনো সংবাদ না আসায় তিনি একটি সৈন্য দলকে নিঃশব্দে তীরে নামিয়ে আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হতে বললেন।
পরদিন সকাল ৮টার দিকে চার্নক ও সঙ্গীরা তাদের জাহাজে বসে শুনতে পেলেন, ইংরেজের বন্দুকের গুলির জবাবে মোগলরা কামানের গোলা ছুড়ছে। ঘণ্টা তিনেক পর কামানগুলো চুপ হয়ে যাওয়ার পর তীরে আগুনের শিখা ও ধোঁয়া দেখা গেল। মোগল বাহিনীর সাথে ইংরেজদের ছোটখাটো লড়াই বেধে গেছে। ইংরেজ বাহিনী কিছু ঝোপঝাড়ের আড়ালে তীরে নেমে পড়েছিল। ঝটিকা আক্রমণ করে মোগল বাহিনীকে পরাজিত করে ব্রিটিশ সৈন্যরা রাজকীয় পতাকা উত্তোলন করে ফেলেছে বালির চড়ায়। ইংরেজ বাহিনী আনন্দে মাতোয়ারা।
কিন্তু শিগগিরই সেই আনন্দে গরম পানি ঢেলে দিল মোগল বাহিনী। পরদিন মোগল বাহিনী এমন কঠিন ও নির্বিচার আক্রমণ চালাল যে ইংরেজ বাহিনীর তখন কচুকাটা হওয়ার দশা। ক্যাপ্টেন হিথ এবার পালিয়ে জাহাজে এসে উঠলেন এবং আপসের পথ খুঁজতে লাগলেন।
ভাগ্য ভালো ছিল তার। সেই সময়েই ঢাকা থেকে ইংরেজ দূতের পত্র এসে পৌঁছল সুসংবাদ নিয়ে। নবাব বাহাদুর খান জানিয়েছেন, জব চার্নক যদি তাঁকে অক্টোবরের প্রস্তাবটা আবারো পাঠান, তাহলে তিনি তা বিবেচনা করতে রাজি আছেন।
এ সংবাদে ‘ডিফেন্স’ জাহাজের কেবিনে দ্রুত সভা ডাকলেন ক্যাপ্টেন হিথ। ঢাকা থেকে পাঠানো চিঠি নিয়ে আলোচনা করা হলো। পরিস্থিতি এখন তাঁর প্রতিকূলে। মোগলদের সাথে আপস করা ছাড়া বাঁচা যাবে না। সুতরাং চার্নককে বলা হলো নবাবের কাছে প্রস্তাবটা আবারো লিখে পাঠাতে।
চার্নককে প্রস্তাবটা পাঠাতে বললেও হিথের মনে ছিল অন্য উদ্দেশ্য। তিনি চট্টগ্রাম দখলের পুরনো মতলবকে বাস্তবায়ন করার সিদ্ধান্ত নিয়ে দুটি জাহাজকে আগেই আরাকানের উদ্দেশে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। এরপর ২৩ ডিসেম্বরে অন্য দুই জাহাজ নিয়ে নিজেই বালাশোর থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা হলেন।
পণ্ড হলো চট্টগ্রাম অভিযান
১৮ জানুয়ারি ক্যাপ্টেন হিথের জাহাজ চট্টগ্রাম পৌঁছে কর্ণফুলী নদীর মোহনার কাছে অবস্থান নিল। এরপর জাহাজ থেকে ছোট্ট একটা দলকে শান্তিসূচক পতাকা দিয়ে নৌকায় করে শহরের দিকে পাঠাল। চট্টগ্রাম শহরের অবস্থান মোহনা থেকে বেশ কয়েক মাইল ভেতরে। যে দলটি শান্তির পতাকা নিয়ে শহরের দিকে গেল, তাদের প্রকাশ্য দায়িত্ব হলো স্থানীয় মোগল গভর্নরকে জানানো যে ইংরেজরা নবাবের সাথে করা চুক্তি অনুসারে আরাকান অভিযানে সাহায্য করতে এসেছে। তবে তাদের আসল উদ্দেশ্য হলো শহরের অবস্থা জেনে এখানকার মোগলদের শক্তি সম্পর্কে ধারণা নেয়া। চট্টগ্রাম দখল করতে কতটা শক্তি দরকার, সেটা পরিষ্কার না জেনে আক্রমণ করাটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।
তখন চট্টগ্রামের গভর্নর ছিলেন নবাব বাহাদুর খানের পুত্র মোজাফফর খান, যার অধীনে সবসময় যুদ্ধ সাজে তৈরি থাকে ১০ হাজার মোগল সৈন্য। আগেই বলা হয়েছে, চট্টগ্রামে মোগলদের এ যুদ্ধ প্রস্তুতি থাকত আরাকানি আক্রমণের আশঙ্কায়ই।
ইংরেজ গুপ্তচরেরা মোগলদের এই সার্বক্ষণিক যুদ্ধ প্রস্তুতির খবর নিয়ে জাহাজে ফিরে আসার পর ক্যাপ্টেন হিথের যুদ্ধ বাসনা দপ করে নিভে গেল। ২১ জানুয়ারি জাহাজে আবারো বৈঠক ডাকা হলো যুদ্ধ পরিষদের। শহর আক্রমণ করার ব্যাপারে তাদের মতামত জানতে চাইলেন তিনি। পরিষদ সাফ জানিয়ে দিল যে এখন চট্টগ্রাম আক্রমণ করা আত্মহত্যার শামিল। তার চেয়ে নবাবকে দেয়া প্রস্তাব অনুমোদনের অপেক্ষায় থাকাই নিরাপদ। যেহেতু প্রস্তাব চলে গেছে, এখন কেবল তার জবাবের অপেক্ষা।
অপেক্ষা ব্যাপারটাই হিথের চরম অপছন্দের। হিথ তীব্র প্রতিক্রিয়ার সুরে বললেন, অসহ্য!! এর সবকিছুই অসহ্য। আমরা দুই পক্ষই খামাকা মিথ্যের খেলা খেলছি, এর কোনো মানে নেই। আমি কখনো নবাবকে আরাকান অভিযানে সাহায্য করতে চাইনি। আবার নবাবের জবাবের অপেক্ষায় থাকাও আমার পছন্দ নয়। একটা কিছু করা দরকার আমাদের!
কিন্তু উপায় নেই। পরিস্থিতি প্রতিকূলে বলে সম্মত হলেন অপেক্ষা করতে। এই সম্মতি ছিল সাময়িক। কারণ জানুয়ারি শেষ হওয়ার আগেই আবার মতি ঘুরে গেল তার। এবার জাহাজের পাল তুলে আরাকানের দিকে রওনা হওয়ার নির্দেশ দিলেন অস্থির এই ক্যাপ্টেন। ক্ষণে ক্ষণে মত বদলানো লোকটার এবারের পরিকল্পনা হলো আরাকানের রাজাকে রাজি করিয়ে চট্টগ্রাম আক্রমণ ও দখল।
কিন্তু আরাকানি রাজা ক্যাপ্টেন হিথের এ পাগলামিকে প্রশ্রয় দেয়া দূরে থাকুক, তাঁর সাথে দেখাও করলেন না। তাঁর পাঠানো উপহারকে এমন শীতলতার সাথে গ্রহণ করলেন যে এটা প্রায় অপমানের শামিল। এতে ক্যাপ্টেন হিথ ভীষণ মনঃক্ষুণ্ন হলেন। আরাকানরাজের কাছ থেকে এ ধাক্কাটা আশা করেননি তিনি। বাধ্য হয়ে যুদ্ধ বাসনা ত্যাগ করে ফিরতি পথ ধরলেন।
ক্যাপ্টেন হিথের নিজের ভাষায়, ‘যখন আমরা ওই বেকুবদের (আরাকানিদের) বোঝাতে ব্যর্থ হলাম যে তাদের ওপর কী ভয়ংকর বিপদ আসন্ন, তখন আমরা আমাদের জাহাজে পানিটানি ভর্তি করে নিয়ে আমাদের স্কার্ভি আক্রান্ত লোকদের চাঙ্গা করার চেষ্টা করলাম, জাহাজে অনেকে স্কার্ভিতে আক্রান্ত হয়েছিল। তারপর ১৭ ফেব্রুয়ারি মাদ্রাজের উদ্দেশে রওনা হলাম। প্রত্যেক জাহাজকে নির্দেশ দেয়া হলো যত দ্রুত সম্ভব পৌঁছে যেতে, আর সময় নষ্ট করা যাবে না এদিকে। দুর্ভাগ্যক্রমে সেই সমুদ্রে কোনো মুর (আরব) জাহাজের সাথে দেখা হলে আমাদের বিপদ হতে পারত।’
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দ্বিতীয় চট্টগ্রাম অভিযানও এভাবেই ব্যর্থ হয়ে যায়। ছয় মাস ধরে একের পর এক বন্দর থেকে বন্দরে ঘুরে ক্যাপ্টেন হিথের এ পাগলামির ফলে ভারতবর্ষে গোটা ইংরেজ বাণিজ্য বিপদের মুখে পড়তে যাচ্ছিল।
চট্টগ্রাম দখল হলো না, হলো কলকতা নগরীর বীজ বপন
ক্যাপ্টেন হিথের এসব কাণ্ডকীর্তির খবর সম্রাট আওরঙ্গজেবের কানে পৌঁছার পর তিনি তো রেগেমেগে হুকুমই দিয়েছিলেন সব ইংরেজকে ভারতের মাটি থেকে উচ্ছেদ করে তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত বা ধ্বংস করার জন্য। পরে আবার রাগ দমন করেন, কেননা তিনি বাস্তববাদীও বটে। প্রথমত, ইংরেজ বাণিজ্যের রাজস্ব তাঁর কোষাগারে জমা হচ্ছিল। দ্বিতীয়ত, তিনি হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন, এক পাগলের জন্য সব ইংরেজকে দায়ী করা সমুচিত নয়। তৃতীয়ত, ইংরেজের স্থলশক্তি কম হলেও নৌশক্তি অনেক। সম্পর্ক তিক্ত হয়ে পড়লে ইংরেজ জাহাজগুলো আরবদের সাথে মোগল বাণিজ্যে বিঘ্ন ঘটাতে পারে পর্তুগিজদের মতো।
এসব কারণে তিনি পরে বাংলার নবাবকে লিখলেন, ‘যদিও ইংরেজরা তাদের অতীত কার্যক্রমে দুর্বিনীত আচরণের স্বাক্ষর রেখেছে, তবুও আমি মানবিক দিক বিবেচনা করে এবারের মতো তাদের ক্ষমা করে দিলাম এবং তাদের বাণিজ্য করার অনুমতি দিলাম। তবে তোমাকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে, তারা যেন আর কোনো ঝামেলা না করে। তুমি তাদের আগের নিয়মে বাণিজ্য করার সুযোগ দিতে পারো। আমি আশা করব, তুমি এ আদেশ কঠোরভাবে মেনে চলবে।’
ইংরেজরা মনে করে, যদি শায়েস্তা খানের আমলে এমন আদেশ জারি হতো, তাহলে সেই আদেশ যথাযথ পালন করা হবে কিনা সে ব্যাপারে সন্দেহ থেকে যেত। কিন্তু বর্তমানে নতুন নবাবের প্রতি ইংরেজদের বিশ্বাস আছে, তাই সম্রাটের এবারের আদেশ পালিত হবে বলে আশা করা যায়। ইব্রাহীম খানের প্রতি ইংরেজদের এমন বিশ্বাসের কারণ তিনি নবাবিত্ব গ্রহণের পর পর ঢাকায় আটক সব ইংরেজ এজেন্টকে মুক্তি দিয়েছিলেন। মাদ্রাজে চার্নকের কাছে পত্র পাঠিয়ে তাঁকে বাংলায় আসার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। চার্নক প্রথমে দ্বিধান্বিত ছিলেন। তিনি যদিও নবাবের আন্তরিকতাকে বিশ্বাস করেন, তবুও নবাবের অধস্তনদের বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তাই নবাবের কাছে কুঠির অনুমতির সাথে একটি স্পষ্ট নির্দেশনা চাইলেন, কোম্পানি ঠিক কীভাবে কোন শর্তে বাংলায় ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারবে। নবাব নিজে তার উত্তর না দিয়ে এ ব্যাপারে আওরঙ্গজেবের দরবারে লিখলেন। এর উত্তর আসতে কয়েক মাস লেগে যেতে পারে বলে তিনি চার্নককে অবিলম্বে বাংলায় এসে কাজকর্ম শুরু করার অনুরোধ করলেন।
এবার সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করলেন না চার্নক। ২৪ আগস্ট ১৬৯০ দুপুরবেলা তিনি সুতানটি এসে পৌঁছলেন। সুতানটিতে তিনি আগেও এসেছিলেন। তবে তাঁর এবারের আগমনটি ঐতিহাসিক। কেননা এখন থেকেই সুতানটিতে শুরু হবে ইংরেজদের স্থায়ী বাণিজ্য। এখানেই তৈরি হবে ভবিষ্যতের কলকাতা নগরী।
অবশেষে কয়েক মাস পরই সম্রাটের লিখিত পরোয়ানা চলে এল। ১০ ফেব্রুয়ারি ১৬৯১ জারিকৃত ফরমানে ইংরেজদের বার্ষিক মাত্র ৩ হাজার রুপির বিনিময়ে বিনা শুল্কে বাণিজ্য করার অনুমতি দেয়া হয়।
প্রকৃতপক্ষে এই দিন থেকেই কলকাতা নগরীর জন্ম প্রক্রিয়া শুরু হবে এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গভর্নর স্যার জোশিয়া চাইল্ডের পরিকল্পনায় একটু ছেদ ঘটিয়ে চট্টগ্রামের বদলে কলকাতার গভর্নর হবেন জব চার্নক।
তথ্যসূত্র:
1. Portuguese in Bengal – J A Campos
2. Early Anals of English in Bengal-I,II-C.R.Wilson
3. The Diary of William Hedges (1681-1687) –
4. The Diaries of Streynsham Master (1675-1680)
5. History of the Rise and Progress of the Bengal Army – Campain Arthur Broome
6. The Embassy of Sir Thomas Roe to India Vol-1, 1615-1619
7. Voyage to East Indies 1685 – Admiral Hamilton
Have your say
You must be logged in to post a comment.
৫ comments
রায়হান রশিদ - ২৩ মার্চ ২০১৯ (৫:৩৮ অপরাহ্ণ)
অনেক ধন্যবাদ, নীড় সন্ধানী, অত্যন্ত পরিশ্রমসাধ্য এই লেখাটির জন্য। কাকতালীয়ভাবে এখনই পড়ছি শশী থরুর এর Inglorious Empire এবং সেখানে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কান্ডকারখানার খতিয়ান। এই বইটি পাঠ্য হওয়া উচিত ছিল ইংল্যান্ডের সব স্কুলে। নিদেনপক্ষে অভিবাসী বাঙালী (কিংবা ভারতীয় উপমহাদেশের) সব ছেলেমেয়েদের তো এই বই পড়া অবশ্যপাঠ্য। শশী থারুর এর লেখায় বাঙলার কথা আছে, কিন্তু চট্টগ্রামকে ঘিরে ইংরেজ বানিজ্য চৌকির রাজনীতি নিয়ে আরেকটু জানা গেল এই লেখাটি পড়ে। কৃতজ্ঞতা সে জন্য।
বিনয় ধর - ২৪ মার্চ ২০১৯ (১:৩৫ অপরাহ্ণ)
শশী থারুর’র লেখা বইটি অনুবাদ করে এখানে সিরিজ আকারে কি দেয়া যায় রায়হান!!!
রায়হান রশিদ - ২৪ মার্চ ২০১৯ (৩:০৪ অপরাহ্ণ)
এই বইটা অনুবাদ হওয়া দরকার। এক দুই চাপ্টার হলে হয়, কিন্তু পুরো বই অনুবাদ করতে গেলে (এবং তা বিনামূল্যে ব্লগে বিতরণ করতে হলে) প্রকাশকের অনুমতির দরকার পড়বে মনে হয়। প্রকাশনার এ বিষয়গুলো নিয়ে আরও ভাল যারা জানেন তারা পরামর্শ দিতে পারবেন আশা করি।
বিনয় ধর - ২৪ মার্চ ২০১৯ (৪:৩০ অপরাহ্ণ)
তাহলে আমি অনুবাদক জি এইচ হাবিব ভাইয়ের সাথে এব্যাপারে এক্টু কথা বলে দেখি। আর আমার মনে হয় এক্টা দুইটা চ্যাপ্টার বাংলায় অনুবাদ হলে লেখক বা প্রকাশকের দিক থেকে তেমন কোন বাধা আস্বে।
নীড় সন্ধানী - ৩১ মার্চ ২০১৯ (১০:৪৯ পূর্বাহ্ণ)
এই সুবিশাল পোস্টটি পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ রায়হান। ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর আদিযুগের অনেক কাহিনীই ইতিহাসের আড়ালে চলে গেছে। এখনকার প্রজন্মের জানার স্বার্থে মাঝে মাঝে এমন কিছু খুঁজে বের করতে ইচ্ছে করে। কিন্তু এসব বিষয় আজকাল খুব বেশী মানুষ পড়ে বলে মনে হয় না। শশী থরুর বইটার কথা জানা ছিল না। সুযোগ পেলে পড়ার আগ্রহ রইল।