Tore Janson-এর সুইডিশ ভাষায় রচিত Latin: Kulturen, historien, språket গ্রন্থের Merethe Damsgård Sørensen ও Nigel Vincet-কৃত ইংরেজি অনুবাদ A Natural History of Latin-এর বাংলা ভাষান্তর
লাতিন থেকে রোমান্স ভাষাসমূহ
৫ম শতকে রোমক সাম্রাজ্যের সমস্ত লাতিনভাষী মানুষ বড় বড় সব পরিবর্তনের মুখোমুখি হলো। সীমান্ত থেকে দলে দলে আসতে থাকল নানান জার্মানিক উপজাতি, এবং কেবল লুঠতরাজ আর ধ্বংসলীলায় সন্তুষ্ট না থেকে তারা পুরানো সাম্রাজ্যের এলাকার পর এলাকায় পাকাপাকিভাবে থেকে গেল, সেখানের ক্ষমতা দখল করে নিল। অল্প কয়েক দশকের মধ্যেই সাম্রাজ্যের কর্তৃত্ব আর তা ফলাবার উপায়গুলো উধাও হয়ে গেল। এবং ৪৭৬ খৃষ্টাব্দে সাম্রাজ্যের পশ্চিম অংশের শেষ সম্রাট রোমুলাস অগাস্তুলুস সিংহাসনচ্যুত হলেন। তাঁর কোনো উত্তরাধিকারীও ছিল না। হঠাৎ করেই দেখা গেল শাসকরা সব জার্মান, রোমক নন।
সময়টা বৈপ্লবিক-ই ছিল তাতে কোনো সন্দেহ নাই, কিন্তু ভাষার ওপর এই আগ্রাসনগুলো ঠিক ততোটা প্রবল ছিল না যতোটা মনে হওয়া স্বাভাবিক। ফ্র্যাঙ্ক, ভ্যান্ডাল, বার্গান্ডীয়, গথ, লম্বার্ড আর অন্যান্য জার্মানিক দলগুলো স্বাভাবিকভাবেই তাদের ভাষা নিয়েই এসেছিল, যেগুলো সবই ছিল জার্মানিক ভাষা পরিবারভুক্ত — তার মধ্যে আধুনিক ভাষা ইংরেজি, জার্মান, ওলন্দাজ, আর স্ক্যান্ডিনেভীয় ভাষাসমূহও ছিল। হানাদারদের একটা ভাষা, ভিসিগথিক, বাইবেলের একটা অনুবাদের কারণে — যেটাকে তথাকথিত গথিক বা রুপোলি বাইবেল বলা হয় — বেশ পরিচিত। আর সেটি এখনো সংরক্ষিত আছে। দুর্ভাগ্যক্রমে রোমক সাম্রাজ্যের অন্যান্য জার্মানিক ভাষা সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানি না আমরা, কারণ কোনো টেক্সট বা উৎকীর্ণ লিপি সংরক্ষণ করা হয়নি বা যায়নি। তবে ভিসিগথিক সহ সেগুলোর মধ্যে একটা যে সাধারণ বিষয় আমরা দেখতে পাই তা হলো সেগুলোর সব-ই অল্প কিছুদিনের মধ্যে উধাও হয়ে যায়। খুব বেশি জার্মানিকভাষী সম্ভবত ছিল-ও না, আর তারা ভূখণ্ডের ক্ষমতা ও মালিকানা দখল করলেও তাদের আশেপাশে কিন্তু লাতিনভাষী জনগণই ছিল, এবং কয়েক প্রজন্ম পরই শাসকরা সেই ভাষায় কথা বলতে লাগল যে ভাষায় তাদের প্রজারা কথা বলে।
একটা বড় ব্যতিক্রম ছিল, অবশ্যই, ইংল্যান্ড আক্রমণ। এঙ্গল, স্যাকসন, আর বিশেষ করে (উত্তর ডেনমার্ক-এর অংশ বিশেষ) জাটল্যান্ড থেকে আগত জুটসহ অন্যান্য দলগুলো শুধু যে পূর্বের অধিবাসীদের জয় করেই নিল তা নয়, তাদের নিজেদের জার্মানিক ভাষাও শিগগিরই সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষায় পরিণত হলো। কথ্য ভাষা হিসেবে লাতিন টিকতে পারল না। অবশ্য রোমক যুগেও যে ক’জন এই ভাষায় কথা বলত তা ঠিকভাবে জানা যায় না, কারণ যতদূর মনে হয় বেশিরভাগ লোক তখনো আদি কেল্টিক ভাষায় কথা বলত, জার্মানিক জাহাজগুলোর আগমনের সময় যার নাম ছিল ব্রিটিশ। কিন্তু কয়েক শতাব্দী পর ব্রিটিশ ভাষার দেখা মিলত কেবল কেবল দ্বীপটির পশ্চিম ভাগে, যেখানে সেটি থিতু হয়ে গেল, এবং অবশেষে পরিণত হলো ওয়েলশ আর কর্নিশ ভাষায়। (গেলিক হিসেবে কেল্টিক ভাষা কালক্রমে স্কটল্যান্ডে ফের প্রচলিত হয় আয়ারল্যান্ড থেকে।) এদিকে এঙ্গল আর স্যাক্সনদের ভাষাই আধিপত্য বিস্তার করে দ্বীপটিতে, আর কালে কালে বাকি দুনিয়ার একটা বড় অংশে।
জার্মানিক আগ্রাসনের ফলে গোড়ার দিকে সাম্রাজ্যের বাকি অংশের ভেতর সমাজে কিন্তু খুব বেশি পরিবর্তন আসেনি। প্রায় ক্ষেত্রেই দেখা গেছে নতুন শাসকরা স্থানীয় প্রশাসনে সেরকম কোনো রদবদল করেনি, আর অনেক দিক থেকেই, শহুরে জীবন বয়ে চলেছিল আগের মতোই। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ষষ্ঠ শতকেও অনেক স্থানে রোমকদের ধরনের বিদ্যালয় ছিল, ছিল অনেক লেখক যাঁরা পুরানো নমুনা অনুযায়ী লাতিন লিখতে পারতেন। কিন্তু ক্রমেই খারাপ হতে থাকল পরিস্থিতি গোটা পশ্চিম ইউরোপ জুড়ে। লিখিত ভাষা ব্যবহার কমতে থাকল দিনের পর দিন, আর সপ্তম শতক নাগাদ ইউরোপের বৃহত্তর অংশে ভেঙে পড়ল স্কুল ব্যবস্থা। কেবল ইতালির কিছু শহরেই সম্ভব ছিল স্কুলে যাওয়া অব্যাহত রাখা। অবশ্য পঠন ও লিখন যে পুরোপুরি হাপিশ হয়ে গিয়েছিল তা নয়, আর তার কারণ হলো খৃষ্টধর্ম চালু করেছিল তার নিজস্ব শিক্ষা ব্যবস্থা।
তারপরেও, পড়া ও লেখার ক্ষমতা খুব-ই বিরল হয়ে এলো ইউরোপে, বিশেষ করে সপ্তম ও অষ্টম শতকে, যখন বহু এলাকাতেই না ছিল কোনো বিদ্যালয় ব্যবস্থা না কোনো কার্যকর লোক প্রশাসন। তাছাড়া এখানে সেখানে মানুষের যাতায়াত-ও কমে গিয়েছিল যথেষ্ট পরিমাণে; প্রায় সকলেই তাদের গোটা জীবনটাই কাটীয়ে দিত যার যার খামারে বা শহরে বা গ্রামে। এই পরিস্থিতিতে ভাষাতাত্ত্বিক পরিবর্তন কাঙ্ক্ষিত। কালক্রমে সব ভাষাই বদলে যায়, কিন্তু কত দ্রুত বা ধীর গতিতে তা বদলায় সেটা নির্ভর করে তা অনেকাংশেই নির্ভর করে যে ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে সেটি সংশ্লিষ্ট তার ওপর। কোনো কোনো পরিস্থিতি এই পরিবর্তন ত্বরান্বিত করে, অন্যগুলো করে বিলম্বিত।
মোটামুটিভাবে বলা যায়, ভাষাতাত্ত্বিক পরিবর্তন নির্ভর করে দুই যুযুধান এবং অসামঞ্জস্যপূর্ণ প্রবণতার মধ্যে পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্যে। একদিকে আমরা ভাষাকে ব্যবহার করতে চাই যোগাযোগের একটি কার্যকর মাধ্যম হিসেবে; অন্যদিকে, আমরা চাই আমাদের কথাবার্তা আমাদের একেবারে কাছের লোকজনের ভাষা বা কথাবার্তার মতো শোনাক, আর সেইসঙ্গে চাই চাই অন্যদের বা অপরিচিতদের চাইতে খানিকটা ভিন্নভাবে কথা বলতে। লক্ষ লক্ষ মানুষ, যারা একইভাবে কথা বলে এবং তেমন কোনো অসুবিধা ছাড়াই একে অপরের কথা বুঝতে পারে তাদের ক্ষেত্রে প্রথম প্রবণতাটি একটি বড় ভাষা তৈরি করে; অন্যদিকে দ্বিতীয় প্রবণতাটি তৈরি করতে চায় ছোট ছোট উপভাষা অঞ্চল, যেখানে প্রতিটি শহরের বাসিন্দারা তাদের উপভাষা আর পার্শ্ববর্তী শহরের উপভাষার মধ্যে তফাতটি মুহূর্তেই ধরতে পারে, এবং, যেখানে হয়ত মানুষ কয়েক কিলোমিটার দূরের মানুষের ভাষা বুঝতেই পারে না। তাই, বড়, শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো বড় বড় ভাষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। রোমক সাম্রাজ্যের কালে প্রতিটি শহরে মানুষের সঙ্গে একই ভাষায় কথা বলার বিষয়টি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, আর, পরিভ্রমণকারী অনেকেই ঠিক এই কাজটিই করত। একটি সাধারণ অর্থাৎ সবার ব্যবহৃত লিখিত ভাষা নিশ্চিতভাবেই গোটা সাম্রাজ্য জুড়ে একটি সাধারণ মানদণ্ড জোরদার করতে করেছিল। সাম্রাজ্যের পতনের পর যে নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো তাতে করে সাধারণ একটি ভাষার প্রণোদন বা প্রয়োজনীয়তা রইল না আর। ভ্রমণ করত না প্রায় কেউই, এবং বিশেষ কোনো স্থানের সঙ্গে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোর যোগাযোগ নেমে এলো সর্বনিম্ন পর্যায়ে। আর, প্রায় কেউই পড়তে বা লিখতে জানত না বলে লিখিত ভাষার প্রভাব ছিল খুবই কম।
ফলে, স্থানীয় উপভাষার বিকাশে বাদ সাধার কিছু রইল না আর। যেসব এলাকায় মানুষ লাতিনভাষী ছিল সেখানে ষষ্ঠ থেকে একাদশ শতক পর্যন্ত কথ্য ভাষা খুব দ্রুত পরিবর্তিত হয়েছে বলে মনে হয়। তাছাড়া, বিভিন্ন এলাকায় পরিবর্তনগুলো খানিকটা ভিন্ন দিকে গিয়েছিল, যাতে প্রতিটি অঞ্চলের বা কখনো কখনো এমনকি প্রতিটি শহরের নিজস্ব কথ্য ধরন তৈরি হয়ে গিয়েছিল। ধীরে ধীরে পরিবর্তনগুলো বাড়তে বাড়তে এমন এক পর্যায়ে উপনীত হলো যে বেশ খানিকটা দূরত্বে বসবাসকারী লোকজন সহজে আর একে অপরের ভাষা বুঝতে পারত না।
এতো কিছু কিভাবে ঘটল তা খুব বিস্তারিতভাবে বলা সম্ভব না, কারণ রোমক সাম্রাজ্যের পতনের অব্যবহিত পরের যে সব সোর্স আমাদের হাতের কাছে রয়েছে তা খুবই সামান্য। যারা আদৌ লিখতেন, তাঁরা লিখতেন লাতিনে, আর গুটিকতক যেসব ইশকুল চালু ছিল সেখানে লোকজন যীশুর জন্মের আগের শতাব্দীতে — পাঁচশ বছরেরও বেশি আগে — সিসেরো আর ভার্জিলের লিখিত ভাষাই শিখত যতদূর সম্ভব। কেউই তাদের কথ্য ভাষা লিখে রাখেনি, কাজেই সেটা শুনতে কেমন ছিল সেকথা খুব একটা জানা নেই আমাদের কারো। তা সত্ত্বেও, ততোটা সুশিক্ষিত নন এমন লেখকরা যখন ধ্রুপদী লাতিনে নিজেদের কথা বলতে গিয়ে নানান ভুলভাল করেছেন, সেসব থেকে আমরা কিছু সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি। প্রাচীনকালেই এধরনের ভুল কিছু হয়েছে, এবং তা ভাষাটির বিকাশের একটি খসড়া ছবি তৈরি করতে আমাদের সাহায্য করে।
প্রাচীনকালেই কথ্য লাতিন ভাষার পরিবর্তন হচ্ছিল, আর বিদ্যালয়গুলোতে যে লিখিত লাতিন শেখানো হতো তা রয়ে যাচ্ছিল আগের মতোই, ফলে পঞ্চম শতকের মধ্যে কথ্য আর লিখিত (লাতিন) ভাষার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ফারাক ঘটে যায়। এই পরিস্থিতিকে ইংরেজি ভাষার অবস্থার সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায় এ ভাষার শব্দগুলোর বানান মূলত ঠিক তেমন-ই আছে যেমনটি সেসব ১৭শ শতকে উচ্চারিত হতো। একইভাবে, প্রাচীন কালের শেষ অংশে যারা বাস করত তাদের কাছে সে সময়ের লিখিত লাতিনকে তাদের নিজেদের উচ্চারণের কাছে রীতিমত সেকেলে বা প্রাচীন বলে মনে হতো।
উদাহরণ হিসেবে একথা বলা যায় যে, শব্দের শেষের [m] ধ্বনিটি বেশ আগে থেকেই অনুচ্চারিত থাকত। যেহেতু বহু লাতিন শব্দই ‘-m’ দিয়ে শেষ হয়, কাজেই এই ছোট পরিবর্তনের একটি বড় প্রভাব পড়েছিল। আরেকটি পরিবর্তন হলো স্বরবর্ণের উচ্চারণ লক্ষণীয়ভাবে বদলে গিয়েছিল। যেমন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ‘u’ উচ্চারিত হতো ‘o’ হিসেবে এবং ‘i’ [e] হিসেবে। এসব পরিবর্তনের সম্মিলিত প্রভাবের অর্থ হলো এরকম: যেমন ধরুন, লোকে লিখত ‘imperium romanum’, কিন্তু তারা পড়ত [imperio romano]। এবং এই উচ্চারণটি হুবহু মিলে যায় আধুনিক ইতালীয় আর হিস্পানী ভাষায় এই কথাটি যেভাবে উচ্চারিত হয় তার সঙ্গে: ‘imperio romano’। আসলে প্রাচীন যুগের শেষের দিকেই লাতিন ভাষা সেদিকে ঝুঁকে পড়েছিল যা পরে আধুনিক রোমান্স ভাষাগুলোর দিকে অগ্রসর হবে।
তারপরেও, সে-সময়ে স্পষ্টতই ভাষা ছিল মাত্র একটি-ই। ইউরোপের বিভিন্ন অংশ থেকে ৫ম ও ৬ষ্ঠ শতকে রচিত বিভিন্ন লাতিন টেক্সট আমাদের হাতে এসে পৌঁছেছে, কিন্তু উপভাষাগত কোনো পরিবর্তন সেখানে আবিষ্কার করা একেবারেই সম্ভব নয়, যদিও অনেকেই সে-চেষ্টা করেছেন। (যে-সমস্ত ভুল বানানের কারণে আসল উচ্চারণ প্রকাশ হয়ে পড়ে সেগুলো সব এক-ই, তা সে-টেক্সট যে জায়গার-ই হোক না কেন।) ৭ম ও ৮ম শতকের অল্প যে-ক’টি লাতিন টেক্সট আমাদের কাছে এসে পৌঁছেছে সেগুলো এই ইঙ্গিত-ই দেয় যে সেসবের লেখকেরা কোনোমতে দু’চার অক্ষর লিখতে পারতেন। টেক্সটগুলোর কিছু কিছু এমন সমস্ত অদ্ভুত বৈশিষ্ট্যপূর্ণ যে আমরা সেসবের কেবল আদ্ধেকটা বুঝতে পারি। নবম শতকে শার্লামেন (Charlemagne) শিক্ষাক্ষেত্রে একটা বড়-সড় সংস্কার সাধন করেন। এরপর থেকে, একসময় যা রোমক সাম্রাজ্য ছিল সেই ভূখণ্ডে লাতিন লেখার ব্যাপারে একটা উল্লেখযোগ্য জোয়ার আসে, এবং কেবল তখন থেকেই আর লিখিত ভাষা দেখে দৈনন্দিন উচ্চারণ বোঝার উপায় রইল না, কারণ আবারও লেখকেরা বিদ্যালয়ে শেখা তাদের প্রাচীন রীতি-নীতি বিশ্বস্তভাবে অনুসরণ করতে শুরু করেন।
তাহলে ৯ম আর ১০ম শতকে লোকে আসলে কোন্ ভাষায় কথা বলত? লাতিনে, নাকি নতুন ভাষা ফরাসী, হিস্পানী, ইতালীয় ইত্যাদিতে? প্রশ্নটির উত্তর খুব সহজ নয়। কথ্য ভাষাটি শুনতে কেমন ছিল সে-বিষয়ে সাক্ষ্য-প্রমাণ খুব বেশি নেই আমাদের কাছে, তবে সেটাই যে সবচাইতে বড় সমস্যা তা নয়। বড় প্রশ্ন হলো লোকে কোন্ ভাষায় কথা বলছে তা ঠিক করা। নীতিগতভাবে দুটো উপায় আছে। হয় আপনি লোকে কিভাবে কথা বলে সে বিষয়ে কিছু তথ্য বের করবেন, এবং সেগুলোর সঙ্গে অন্য পরিচিত বা জানা ভাষাগুলোর তুলনা করবেন, অথবা আপনি লোকজনকে সরাসরি জিগ্যেস করবেন তাদের ভাষা কি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উত্তরটা দুক্ষেত্রে এক-ই হবে।
নবম শতকে ফ্রান্সে যেসব লোক বাস করত তাদের প্রসঙ্গে এলে ব্যাপারটা অনেক বেশি জটিল হয়ে পড়ে। তাদের ভাষা কেমন শোনাত সে বিষয়ে আমরা অনেক কিছু জানি বললে যা বোঝায় তা হলো সেটা ঠিক লাতিনের মতো শোনাত না। সত্যি কথা বলতে কি, দুই-এক শতাব্দী পর লোকজন যে ভাষাটিকে ‘français’ বলতে শুরু করে তা থেকে খুব বেশি আলাদা শোনাতো না সেটা। সেই দৃষ্টিভঙ্গী থেকে একথা বলাই যুক্তি সঙ্গত যে তারা ফরাসী ভাষায় কথা বলত। অন্যদিকে, ফ্রান্সে তখন যেসব মানুষ বাস করত তারা যে তাদের ভাষাটির ক্ষেত্রে ওই নামটিই ব্যবহার করত এমন কোনো প্রমাণ নেই। উল্টো বরং, নবম শতকের কিছু লাতিন পাণ্ডুলিপিতে এরকম কথা আছে: ‘rustica romana lingua’, ‘the rustic Roman language’ বা স্রেফ ‘lingua romana’, ‘the Roman language’, যা কথ্য ভাষাটিকে নির্দেশ করছে। স্বাভাবিক লাতিন প্রয়োগবিধি অনুযায়ী ‘lingua romana’ আর ‘lingua latina’ ঠিক একই জিনিস বোঝায়: লাতিন ভাষা। সেক্ষেত্রে, এই প্রমাণের ভিত্তিতে এটা মনে হয় যেন সে সময়ের ফরাসিরা ভাবত তারা লাতিন বলছে, যদিও সেটা ছিল ভাষাটির একটা গ্রাম্য রূপ।
লাতিন সম্পর্কে যতদূর বলা যায়, লোকজন কোন্ ভাষায় কথা বলছে সে বিষয়ে তারা কি ভাবত সেটা খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। যে ব্যাপারটি বেশ পরিষ্কার তা হলো যারা লিখত তারা লিখত লাতিন ভাষাতেই। যেসব দেশে লোকে লাতিনে কথা বলত তার সবগুলোতেই অবস্থাটি সেরকমই ছিল, যতদিন পর্যন্ত না নতুন লিখিত ভাষা তৈরি হলো। এই ব্যাপারটি প্রথম ঘটে উত্তর ফ্রান্সে, যেখানে এগারো শতকের বেশ কিছু সংখ্যক লেখক এমন এক ভাষায় লেখা শুরু করেন যে-ভাষার ভিত্তি ছিল সে সময়ের কথ্য লাতিন। এই ভাষাটি লাতিন থেকে একেবারেই আলাদা ছিল, এবং অনেক পরিবর্তনের পর তা আধুনিক লিখিত ফরাসী ভাষায় রূপ নেয়। ইতালী আর স্পেনেও একই ঘটনা ঘটেছিল, যদিও আরো গোটা দুই শতাব্দী পরে, ত্রয়োদশ শতকে। ধীরে ধীরে, গোটা রোমান্স অঞ্চলই তাদের লিখিত ভাষা অর্জন করে।
এই নতুন ভাষাগুলোর সঙ্গে অবশ্যই লাতিনের একটি প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছিল। আর সেগুলো তৈরি হওয়ার আগ পর্যন্ত সবকিছু লাতিনেই লেখা হতো, কাজেই সেগুলো লাতিনের কাজ হাতে তুলে নিল। তবে তা ঘটল খুবই ধীরেসুস্থে। গোড়ার দিকে কল্পনাশ্রয়ী সাহিত্য রচয়িতারাই কেবল নতুন ভাষাগুলোতে লিখতেন। ধীরে ধীরে জনসাধারণ ব্যক্তিগত চিঠিপত্র এবং নানান রসিদ ও ঋণস্বীকার-পত্রে সেগুলো ব্যবহার করতে শুরু করল। তবে কোর্ট-কাছারি আর সরকারী দপ্তরগুলো আরো শত শত বছর ধরে লাতিনকেই আঁকড়ে ধরে থাকল। কিন্তু তার চাইতেও রক্ষণশীল ছিল খৃষ্টজগৎ, লাতিনকে যা কিনা অন্য যে কোনো প্রতিষ্ঠানের চাইতে বেশি দিন ধরে তার প্রধান ভাষা হিসেবে বহাল রেখেছিল। উচ্চশিক্ষা আর সব ধরনের বিজ্ঞানের জগতেও দীর্ঘদিন ব্যবহৃত হয়েছে লাতিন।
সার কথা, লিখিত রোমান্স ভাষাসমূহ আর লাতিন খুবই দীর্ঘ সময় ধরে পাশাপাশি ব্যবহৃত হয়েছে, এগারো শতক থেকে বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত। আর, সাবেক রোমক সাম্রাজ্যে নতুন ধরনের লেখা পুরানো ধরনের লেখাকে উৎখাত করেছে তা প্রায় হাজার বছর হলো।
(পরবর্তী অধ্যায় : ‘ধর্ম্প্রচারকবৃন্দ, লাতিন, এবং বিদেশী ভাষাসমূহ’)
Have your say
You must be logged in to post a comment.
২ comments
Pingback: লাতিন ভাষার কথা : ২৪ | জি এইচ হাবীব
Pingback: লাতিন ভাষার কথা : ২৫ » বাংলাদেশী শীর্ষ কমিউনিটি নিউজ পোর্টাল