Tore Janson-এর সুইডিশ ভাষায় রচিত Latin: Kulturen, historien, språket গ্রন্থের Merethe Damsgård Sørensen ও Nigel Vincet-কৃত ইংরেজি অনুবাদ A Natural History of Latin-এর বাংলা ভাষান্তর
খৃষ্টধর্ম : বিপজ্জনক সম্প্রদায় থেকে রাষ্ট্রধর্ম
ত্যাসিতাস তাঁর ‘Annals’-এ ৬৪ খৃষ্টাব্দে — সম্রাট নিরোর রাজত্বকালে — রোমে সংঘটিত হওয়া এক প্রবল অগ্নিকাণ্ডের বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন। অগ্নিকাণ্ডের পর জোরেশোরে গুজব রটল যে কাজটা বিশেষ কোনো এক অগ্নিসংযোগকারীর, এমনকি তা খোদ সম্রাটের-ও হতে পারে। এই গুজবগুলোকে ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করার জন্য নিরো এমন একটি দলের ওপর দোষ চাপালেন যারা আগে থেকেই অজনপ্রিয়, এবং যাদেরকে লোকে ‘Christiani’ বলত, কারণ, ত্যাসিতাস বলছেন :
Auctor nóminis eius Christus Tiberio imperitante per procuratórem Pontium Pilatum supplício adfectus erat
খৃষ্ট — যার কাছ থেকে ওই নামটা (অর্থাৎ, খৃষ্টান) এসেছে, তাঁকে প্রকিউরেটর পন্টিয়াস পাইলেট তাইবেরিয়াসের রাজত্বকালে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেছিলেন।
খৃষ্ট বা খৃষ্ট ধর্মাবলম্বীদের সম্পর্কে একেবারে গোড়ার দিকের কিছু উল্লেখের অন্যতম এটা। সম্ভবত যিশুখৃষ্টের মৃত্যুর তিরিশ বছর পরেও রোমে খৃষ্টানরা বাস করছিল। ত্যাসিতাসের কোনো সহানুভূতি ছিল না তাদের ধর্মের শিক্ষার ব্যাপারে, যেটাকে তিনি বলছেন ‘exitiábilis superstítio’, বা, ‘এক ক্ষতিকর কুসংস্কার’। ত্যাসিতাস আমাদের জানাচ্ছেন, খৃষ্টানদের ধরে ধরে অত্যন্ত নিষ্ঠুর সব উপায়ে মেরে ফেলা হতো : যেমন, জীবন্ত মশাল হিসেবে ব্যবহার করা হতো তাদের।
লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যেতে বাধ্য করা হলো তাদের, কিন্তু তারপরেও ঠিক যাকে বলে অদৃশ্য হয়ে গেল না তারা। এ-ঘটনার পঞ্চাশ বছরেরও কম সময় পর কনিষ্ঠ প্লিনি — আধুনিক তুরস্কের বিথিনিয়ার প্রশাসক — সম্রাট ত্রাজান-এর কাছে পত্র লিখে জানতে চাইলেন লোকে খৃষ্টান বলে অভিযুক্ত হলে তাঁর করণীয় কি? মনে হয় এ-ধরনের অনেক ঘটনা অনেকই ঘটতো, আর প্লিনির ইচ্ছেটা ছিল অনেকটা এরকম যে তাদেরকে হুট করে মেরে না ফেলে অনুতাপের সুযোগ দেয়া বরং ভালো। সম্রাট সহমত প্রকাশ করলেন, কিন্তু তাঁর কাছে মনে হলো ব্যাপারগুলোকে এতো খুঁটিয়ে দেখার কিছু নেই, বরং যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে এবং তা প্রমাণ হয়েছে তাদেরকে সাজা দিয়ে ফেললেই ল্যাঠা চুকে যায়।
খৃষ্টধর্মের প্রসার অব্যাহত রইল, এবং রাষ্ট্রের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা বহাল থাকলেও তা যে খুব নিয়মিতভাবে ঘটত তা নয়, আর এর অল্প কিছুদিন আগে থেকে খৃষ্টানরা লাতিন লিখতে শুরু করেছিল। ধর্মটির উদ্ভব হয়েছিল সাম্রাজ্যের পুব অঞ্চলে, যেখানে গ্রিক ছিল দাপ্তরিক ভাষা। নিউ টেস্টামেন্টের লেখকরাও গ্রিক ভাষাতেই লিখেছিলেন, এবং সেই ভাষাই পুবে চার্চ-এর ভাষা হিসেবে গৃহীত হয়। প্রথম গুরুত্বপূর্ণ খৃষ্টান লেখক হলেন তেরতুলিয়ান (Tertullian)। দ্বিতীয় শতকের শেষ দিকে বেশ কিছু গ্রন্থ রচনা করেছিলেন তিনি। সেগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে খৃষ্টধর্মাবলম্বীদের সমর্থনে রচিত ‘Apologéticum’, যে-শাসকরা মাথার ওপর বসে তাদের বিচার করছে সরাসরি তাদের উদ্দেশ করে লেখা। তাঁর অন্যান্য গ্রন্থের অনেকগুলোই ‘নিষ্কৃতি’ (absolution), ‘ট্রিনিটি’ (Trinity), ইত্যাদির মতো ধর্মতাত্ত্বিক কিছু চাতুরীপূর্ণ বিষয় নিয়ে লেখা। লেখাগুলোর সবচাইতে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো এই যে, তেরতুলিয়ানের সঙ্গে যাঁরা সহমত নন তাঁদের প্রতি তাঁর বিদ্বেষপূর্ণ ও অনমনীয় মনোভাব। যুগ যুগ ধরে যে ধর্মতাত্ত্বিক তর্ক-বিতর্ক চলে আসছে, দুর্ভাগ্যক্রমে তার (বিদ্বেষপূর্ণ) সুরটা বেঁধে দিয়েছিল তেরতুলিয়ানের এই রচনা।
তৃতীয় শতকেও খৃষ্টধর্ম ছিল রোমক সাম্রাজ্যে বিকাশমান অন্যান্য অনেক ধরনের ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মধ্যে স্রেফ একটি মাত্র। এই সময়ের খৃষ্টীয় লেখা-পত্তর খুব কমই পাওয়া যায়। সে যা-ই হোক, সম্রাট কন্সটান্টাইন — যিনি চতুর্থ শতকের গোড়ার দিকে রাজত্ব করেছিলেন — তিনি খৃষ্টানদের সঙ্গে সহনশীল আচরণ করলেন, এবং মৃত্যুর অল্প কিছুদিন আগে নিজেই খৃষ্টধর্ম গ্রহণ করলেন। তাঁর পরবর্তী সম্রাটেরা, কিছু ব্যতিক্রম বাদে, খৃষ্টানই ছিলেন, এবং শতাব্দীর শেষ নাগাদ খৃষ্টধর্ম রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করল।
চতুর্থ ও পঞ্চম শতকের দিকে লাতিন ভাষার বেশিরভাগ লেখকই — বা বলা যায় — বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ লেখকই ছিলেন খৃষ্টান। সবচাইতে প্রতিভাবান লোকজন আর যাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন বাতাস কোনদিকে বইছে, এই দুই দলকেই আকৃষ্ট করেছিল নতুন ধর্মটি। সেই সঙ্গে বেশ কিছু ফাঁকা জায়গাও ছিল পূরণ করার। রোমক সাম্রাজ্যের পশ্চিম অংশে নব্য খৃষ্টানদের অনেকেই গ্রিক তেমন একটা পড়তে পারতেন না, কাজেই লাতিন ভাষায় একটা খৃষ্টীয় সাহিত্য তৈরি করা জরুরি হয়ে পড়েছিল। তবে অবশ্যই সবচাইতে লাযীম হয়ে পড়েছিল বাইবেলকে পাঠযোগ্য করা। ওল্ড এবং নিউ টেস্টামেন্ট-এর খানিকটা অংশ আগেই অনুবাদ করা হয়েছিল লাতিনে, কিন্তু সে অনুবাদের মানের তারতম্য ছিল বিস্তর। পঞ্চম শতকের গোড়ার দিকের আগ পর্যন্ত বাইবেলের পূর্ণাঙ্গ এবং বিশ্বস্ত অনুবাদের দেখা মেলেনি। আর সেই বিশাল কাজটি সম্ভব হলো জেরোমের মতো একজন বিদ্বান ও কঠোর পরিশ্রমী মানুষের সুবাদে। ‘ওল্ড টেস্টামেন্ট’-এর একেবারে নতুন একটি অনুবাদ করলেন তিনি হিব্রু থেকে, এবং গ্রিক ভাষায় ‘নিউ টেস্টামেন্ট’-এর যে অনুবাদ ছিল সেটা ঘষে-মেজে ঠিক করলেন। নিজেকে গর্বের সঙ্গে তাই ‘homo trilínguis’ বা ‘ত্রিকোণাকার মানুষ’ আখ্যা দেয়াটা ঠিক-ই ছিল তাঁর।
মজার বিষয় হচ্ছে, পাঠকদের নিয়ে জেরোমের কিন্তু ঠিক একই সমস্যা হয়েছিল যা বাইবেলের পরবর্তী অনুবাদকদেরও হয়েছিল তাঁদের পাঠকদের বেলায়। এই কারণে পাঠকেরা অভিযোগ করেছিল যে, গির্জায় তারা যা শুনে অভ্যস্ত জেরোমে তাঁর অনুবাদে সেসব বদলে দিয়েছিলেন, আর এটা সবচাইতে পষ্ট ‘Book of Psalms’-এ, যেটা কিনা হিব্রু থেকে গ্রীক হয়ে লাতিন ভাষায় খুব-ই বাজে একটি অনুবাদে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। গির্জায় উপাসনার সময় স্তোত্রগুলো প্রায়ই আবৃত্তি করা হতো, আর, জেরোমের নতুন ধ্যান-ধারণার প্রতি বিরুদ্ধতা এতোই জোরালো ছিল যে পুরানো অনুবাদটিও ব্যবহার করার অনুমতি দেয়া হয়েছিল। যাই হোক, জেরোমের অনুবাদটি শেষ অব্দি মেনে নিল সবাই, এবং পরে সেটি পরিচিত হলো ‘Versio vulgáta’ বা আক্ষরিক অর্থে, ‘সাধারণ সংস্করণ’ নামে। তবে ইংরেজিতে সেটাকে সাধারণত ‘the Vulgate’-ই বলা হয়। সেই প্রাচীন কাল থেকে এই বাইবেলটিই ব্যবহৃত হয়ে আসছে রোমক ক্যাথলিক গির্জায়। এমনকি আজ-ও যেখানে উপাসনার ভাষা হিসেবে লাতিন ব্যবহৃত হয় সেখানে এই বাইবেলটিই পাঠ করা হয়।
অবশ্য খৃষ্টানদের যে কেবল বাইবেলের টেক্সটই প্রয়োজন ছিল তা নয়। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের অন্যান্য অংশের জন্যেও দরকার ছিল নানা স্তোত্র আর টেক্সট। সেই তখন যা লেখা হয়েছিল তার অনেকটাই সংখ্যা বা পরিমাণে প্রায় একই অবস্থায় সংরক্ষিত আছে এতো শতাব্দী ধরে। নিচে সেরা স্তোত্রগুলোর একটির সূচনাংশ দেয়া হলো :
Te deum laudámus
te dóminum confitémur,
te aetérnum patrem omnis terra venerátur.
‘বুক অভ কমন প্রেয়ার’-এ এটি অনূদিত হয়েছে এইভাবে :
We praise thee, O God:
We acknowledge thee to be the Lord.
All the earth doth worship thee: the Father everlasting.
এই টেক্সট-এ এমন কিছু শব্দ আছে লাতিন ভাষায় যেগুলো হরহামেশাই দেখা যায়। কিন্তু খৃষ্টীয় টেক্সট-এ এসে সেগুলো নতুন অর্থ ধারণ করেছে। লাতিন ‘dóminus’-মানে ‘master’ বা, ‘Lord’ (প্রভু)। সাধারণত কোনো দাসমালিক অর্থে ব্যবহৃত হয় এটা। কিন্তু খৃষ্টীয় প্রসঙ্গ প্রতিবেশে তা সবসময়ই বড় হাতের ‘এল’ সহ লর্ড (Lord) বোঝায়। আবার, ‘confitéri’ শব্দটার মানে ‘স্বীকার করা’ (ইংরেজিতে confess), এবং মূলত সেটা আদালতে ব্যবহৃত শব্দ। কিন্তু খৃষ্টধর্মাবলম্বীদের মাঝে শব্দটা ‘কোনো ধর্মে কারো বিশ্বাসের কথা স্বীকার করা’-র অর্থ লাভ করেছে। আর সেটার সঙ্গে সম্পর্কিত বিশেষ্য ‘conféssio’, বা, ‘স্বীকারোক্তি’ (confession)-র মানে দাঁড়িয়েছে ‘কারো বিশ্বাস সম্পর্কে স্বীকারোক্তি’। খৃষ্টধর্মীয় শব্দভাণ্ডার লাতিনের কাছ থেকে ইংরেজি ভাষা ধার করেছে হাজার বছরের মতো আগে। কাজেই ইংরেজভাষীদের কাছে সেসবের মানে একেবারেই স্বাভাবিক, এমনকি খুবই স্পষ্ট বলে ঠেকে, কিন্তু প্রাচীনকালের শেষভাগের রোমকদের কাছে ব্যাপারটা নিশ্চয়ই ভিন্ন ছিল একেবারে। খৃষ্টধর্মের একেবারে মূল ধারণাগুলো সংক্রান্ত কোনো শব্দ ছিল না লাতিন ভাষায়, কাজেই, পুরানো শব্দকে নতুন মানে দিয়ে — যেমনটা আমরা উপরের উদাহরণে এইমাত্র দেখলাম — অথবা, গ্রীক থেকে শব্দ স্রেফ ধার করে সেগুলো তৈরি করতে হয়েছিল।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পরিবর্তনগুলো ছিল একেবারে মৌলিক। রোমক জীবনযাত্রায় লোক-বক্তৃতার কিরকম গুরত্বপূর্ণ অবস্থান ছিল সেকথা আমরা আগেই আলাপ করেছি, এবং ‘বক্তৃতা দেয়া’-র (to make a speech) স্বাভাবিক ক্রিয়াপদ ছিল ‘oráre’। খোদ ‘বক্তৃতা’-র লাতিন হল ‘orátio’। কিন্তু খৃষ্টীয় লাতিনে ক্রিয়াপদ ‘orare’ মানে হচ্ছে (ঈশ্বরের কাছে) ‘প্রার্থনা করা’ (to pray to God), আর ‘oratio’ মানে প্রার্থনা (prayer)। আরেকটি বেশ প্রচলিত লাতিন শব্দ হচ্ছে ‘gratia’, যার মানে, ‘thanks’ বা, ‘favour’ (আনুকূল্য)। ওদিকে খৃষ্টীয় লাতিনে কথাটার রয়েছে সুনির্দিষ্ট ধর্মতাত্ত্বিক মানে: ‘grace’ (অনুগ্রহ, শুভেচ্ছা), যা সবচাইতে বেশি নজরে পড়ে ‘Dei gratia’ শব্দবন্ধটিতে, যার মানে, ‘ঈশ্বরের অনুগ্রহ’ (the grace of God)।
গ্রীক থেকে ধার করা এন্তার শব্দের মধ্যে আমরা ‘baptizare’ (to baptize), আর ‘ecclésia’ (church)-এর কথা উল্লেখ করতে পারি। এক অর্থে, এই শব্দগুলো ছিল অপেক্ষাকৃতভাবে কম গোলমেলে, কারণ কেবলই খৃষ্টীয় অর্থ ছিল এদের। তাছাড়া, সেগুলোর বানান আর উচ্চারণই বলে দিত যে শব্দগুলো বিদেশী। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ‘baptizare’ শব্দে ‘z’ হরফটি আছে, যা কিনা স্বদেশী লাতিন শব্দে থাকে না, আর, সেটা এমন এক গ্রীক ধ্বনির প্রতিনিধিত্ব করে যেটা লাতিনে সাধারণত [ts] উচ্চারিত হয়।
আমরা দেখেছি খৃষ্টানরা নিজেদের জন্য একটা বিরাট শব্দভাণ্ডার তৈরি করেছিল। গোড়ার দিকে সম্ভবত শব্দগুলো অদ্ভুত শোনাত, বা, অনেকের কাছে এমনকি হয়তো মজার বলেও মনে হতো, কিন্তু খৃষ্টধর্ম ধীরে ধীরে গোটা সাম্রাজ্য জুড়ে বিস্তার লাভ করতে এসব খৃষ্টীয় শব্দ এবং সেসবের মানে লাতিন ভাষায় ঢুকে পড়ে। কোনো সমাজে নতুন কিছু প্রবেশ করার এটাই স্বাভাবিক নিয়ম: নিজের সঙ্গে সেটা তার শব্দভাণ্ডারও নিয়ে আসে। জনসাধারণের দৈনন্দিন জীবনে, তাদের চিন্তাধারায় বিপুল পরিবর্তন এনেছিল খৃষ্টধর্ম, কাজেই প্রচুর নতুন শব্দ, নতুন অভিব্যক্তির প্রয়োজন পড়েছিল। যেসব মানুষ সেসব প্রবর্তন করেছিলেন তাঁরা স্রেফ অনুবাদক আর স্তোত্র-রচয়িতা ছিলেন না, ছিলেন গোটা একদল মিশনারী, ধর্ম প্রচারক, যাজক, আর বিশপ। তাঁদের অনেকেই আবার ছিলেন লেখক। তাঁরা হিতোপদেশ (sermon) লিখেছেন, স্তোত্র লিখেছেন, লিখেছেন বাইবেলের উপর হ্রস্ব-দীর্ঘ নানান ভাষ্য, সেই সিঙ্গে লিখেছেন পেগানদের বিরুদ্ধে বিতর্কিত পুস্তিকা, আর অতি অবশ্যই ধর্মতাত্ত্বিক গবেষণামূলক প্রবন্ধ, প্রায় ক্ষেত্রেই যার উদ্দেশ্য থাকত ধর্মদ্রোহীদের (heretics) প্রতি আক্রমণ শানানো।
ঠিক কে ধর্মদ্রোহী (heretic, haeréticus) আর কে নয় তা জানা খুব সহজ ছিল না তখন। সেটা নির্ভর করত শেষ অব্দি কারা আদিপাপ ও ট্রিনিটি সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গী খৃষ্টধর্মের সত্যিকার শিক্ষা হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করাতে পারল তার ওপর। বিজেতার পুরস্কার হিসেবে জুটত — যা মোটেই নগণ্য নয় — একেবারে আধুনিক কাল পর্যন্ত বিরোধীপক্ষের ওপর আক্রমণ চালানোর সংরক্ষিত অধিকার; আর অন্যদিকে, বিজিতদের বইপত্র সাধারণত যেতো নিরুদ্দেশ হয়ে। তো, একজন ছিলেন যিনি সব সময়ই জিততেন। তার নাম ছিল অগাস্তিন। ক্যাথলিক চার্চ ফাদারদের মধ্যে সেরা বলে মানা হয় তাঁকে। অলংকারশাস্ত্রের একজন শিক্ষক হিসেবে পেশাগত জীবন শুরু করেন তিনি, আর তারপর তিরিশ বছর বয়েসে ধর্মান্তরিত হয়ে খৃষ্টান হন। আজকের তিউনিসিয়ার কার্থেজের কাছে হিপ্পো নামের এক ছোট্ট শহরে প্রথমে একজন যাজক, পরে বিশপ হয়েছিলেন তিনি, আর ৪৩০ খৃষ্টাব্দে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সেই শহরেই কাটিয়ে দিয়েছিলেন জীবনের পুরো চল্লিশ বছর। উল্লেখ্য, ঠিক সেই সময়ই ভ্যান্ডালরা হামলা চালিয়ে সেই প্রদেশটি জয় ও দখল করে নেয়।
বিশ্বসাহিত্যে সবচাইতে বহুপ্রজ লেখকদের মধ্যে অগাস্তিন অন্যতম। যারা কোনো না কোনো সময়ে তাঁর সঙ্গে, এবং পরে সমগ্র খৃষ্টধর্মের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছিল সেই ডোনাটিস্ট, পেলাজীয়, প্রিসিলীয় এবং অন্যান্যদের বিরুদ্ধে এক অনিঃশেষ যুদ্ধের অংশ হিসেবে ধারাবাহিক কিছু দীর্ঘ গবেষণামূলক প্রবন্ধে নানান ধর্মতাত্ত্বিক প্রশ্নের বিশ্লেষণ করার কাজে তিনি তাঁর শক্তি ও ক্ষমতার অনেকাংশ ব্যয় করেছিলেন। এছাড়াও তিনি বিপুল সংখ্যক হিতোপদেশ, স্তোত্র (hymn), এবং নানান উপলক্ষভিত্তিক রচনার স্রষ্টা। কিন্তু এসব ছাপিয়ে তিনি বিখ্যাত হয়ে আছেন দুটো বইয়ের জন্য। প্রথমটিকে — যেটার নাম হচ্ছে ‘Confessiones’ (Confessions) — বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসের জরিপে সব সময় দেখা যায়, কারণ এটাই প্রথম আত্মজীবনী যেখানে যা ঘটেছে তার বর্ণনাই কেবল দেয়া হয়নি, সেই সঙ্গে সেখানে চেষ্টা করা হয়েছে লেখকের ব্যক্তিগত বিকাশের বিবরণ দেবার, তাঁর জন্ম থেকে ধর্মান্তরিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত। অন্য বইটির নাম ‘De civitate Dei’ (The City of God)। বইটা লেখার তাৎক্ষণিক কারণ ছিল ৪১০ খৃষ্টাব্দে ভিসিগথদের রোম নগর আক্রমণ ও লুণ্ঠন। এটি এই কারণে এক অভূতপূর্ব ঘটনা ছিল যে তা দেখিয়ে দিল এরকম একটি বিশাল সাম্রাজ্যের রাজধানী অন্য যে-কোনো শহরের মতোই দখল করে নেয়া যায়। রোমকরা পুরানো দেবতাদের ছেড়ে খৃষ্টধর্ম গ্রহণ করেছে বলে তাদের ওপর নেমে আসা গজব বা শাস্তি হিসেবেও দেখল কেউ কেউ ঘটনাটিকে। এ-ধারণাটি খণ্ডাবার জন্যই এই বই লিখতে কলম ধরেছিলেন অগাস্তিন, কিন্তু ধীরে ধীরে সেটি “পার্থিব শহর” আর “ঈশ্বরের রাজ্য”-র মধ্যেকার সম্পর্কভিত্তিক এক উচ্চাকাঙ্ক্ষী দার্শনিক গবেষণায় রূপ নেয়।
অ-খৃষ্টীয় দর্শন থেকে পাওয়া অতি-বিচিত্র সব ধারণার সঙ্গে সমগ্র খৃষ্টীয় শিক্ষা যুক্ত করে সেটির একটি সারসংক্ষেপ রচনা করেছেন অগাস্তিন। এভাবে তিনি আর তাঁর পূর্বসূরীরা গোটা একটি চিন্তা-পদ্ধতি, একটি খৃষ্টীয় দর্শন তৈরি করলেন। খৃষ্টধর্মাবলম্বী নন এমন কারো কাছে তাঁর ধারণাগুলোকে অদ্ভুত, এমনকি আপত্তিকর বলে মনে হবে। কথাটা বিশেষ করে আদিপাপের ধারণার বেলায় সত্য, যে-ধারণা অনুযায়ী মানুষ জন্মসূত্রেই মন্দ, এবং ‘ত্রাণকর্তা’ উদ্ধার না করলে তার আর মুক্তি নেই। কিন্তু প্রায় দেড় হাজার বছর ধরে মানুষের যাবতীয় দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা সংক্রান্ত আলোচনায় তাঁর চিন্তা-চেতনাই অন্যতম ভিত্তি হিসেবে গৃহীত হয়ে এসেছে। তিনি ছিলেন প্রাচীন দার্শনিকদের শেষদের মধ্যে অন্যতম, কিন্তু সেই সঙ্গে ভাবীকালের অগ্রগণ্য বুদ্ধিজীবীদের-ও একজন।
. . .
প্রথম পর্ব “লাতিন ও রোমকগণ” সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব : “লাতিন ও ইউরোপ”।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
১ comment
Pingback: লাতিন ভাষার কথা : ২২ | জি এইচ হাবীব