লাতিন ভাষার কথা : ২২

|| ত্যাসিতাস, সম্রাটগণ ও ব্রিটেন || সালুস্ত আর লিভি, যাঁদের নাম আগেই বলা হয়েছে, তাঁরা ছিলেন বিখ্যাত ইতিহাসবেত্তা। তবে সবচাইতে খ্যাতিমান ছিলেন সম্ভবত ত্যাসিতাস। আনুমানিক ৫৬ খৃষ্টাব্দের দিকে জন্ম তাঁর, মৃত্যু ১১৭-র পর। [. . .]

Tore Janson-এর সুইডিশ ভাষায় রচিত Latin: Kulturen, historien, språket গ্রন্থের Merethe Damsgård Sørensen ও Nigel Vincet-কৃত ইংরেজি অনুবাদ A Natural History of Latin-এর বাংলা ভাষান্তর

 

ত্যাসিতাস, সম্রাটগণ ও ব্রিটেন

সালুস্ত আর লিভি, যাঁদের নাম আগেই বলা হয়েছে, তাঁরা ছিলেন বিখ্যাত ইতিহাসবেত্তা। তবে সবচাইতে খ্যাতিমান ছিলেন সম্ভবত ত্যাসিতাস। আনুমানিক ৫৬ খৃষ্টাব্দের দিকে জন্ম তাঁর, মৃত্যু ১১৭-র পর। ১৪ খৃষ্টাব্দে সম্রাট অগাস্টাসের মৃত্যুর পর থেকে যাঁরা সম্রাট হয়েছিলেন তাঁদের জীবনী লিখেছিলেন তিনি, থেমেছেন ৯৬ খৃষ্টাব্দে দমিতিয়ানের মৃত্যু পর্যন্ত এসে। তার মানে, ত্যাসিতাস তাঁর জীবনের সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনাবলী নিয়ে কাজ করেছেন। তবে তাঁর রচনার খানিক অংশই কেবল আমাদের কাছে এসে পৌঁছেছে।

ত্যাসিতাস বলছেন ‘sine ira et studio’ বা, ‘কোনো ক্রোধ বা পক্ষপাতিত্ব ছাড়াই’ লিখেছেন তিনি। ইতিহাসবিদদের কিভাবে লেখা উচিত তা বোঝাতে গিয়ে আজও এই কথাটা উদ্ধৃত করা হয়। খোদ ত্যাসিতাসকে অবশ্য ‘studium’-এর অভিযোগে অভিযুক্ত করা যাবে না (এই প্রসঙ্গে কথাটার মানে ‘কাউকে অন্যায্য সুবিধা প্রদান করা’), কারণ কারো সম্পর্কে তিনি ভালো কিছু বলেননি বললেই চলে। বিশেষ করে, সম্রাটদের তাঁর বড়ই না-পছন্দ। ব্যক্তিগতভাবে তিনি ছিলেন সমাজের উচ্চাসনে আসীন একজন সফল মানুষ, এবং তাঁর জন্ম যে পরিবারে সেখান থেকে অনেকেই সিনেটর পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। সম্রাট দমিতিয়ানের আমলে ব্যক্তিগত দমন-পীড়নের শিকার হওয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতা হয় তাঁর, এবং প্রায়ই তাঁর মুখ থেকে মুক্তি বা স্বাধীনতার কথা শুনি আমরা, যদিও সে-স্বাধীনতা বলতে তিনি প্রধানত সম্রাটের হস্তক্ষেপ ছাড়া সিনেটের সিদ্ধান্ত নেয়ার স্বাধীনতাকেই বুঝিয়েছেন, প্রাচীনকালে যে-হস্তক্ষেপ সম্রাটগণ হরহামেশাই করতেন। বেশিরভাগ রোমক লেখকই রক্ষণশীল, তবে ত্যাসিতাসকে প্রতিক্রিয়াশীল বলাটাই সঙ্গত হবে। উত্তরকালের কাছে যে তাইবেরিয়াস, ক্লদিয়াস ও নিরো সহ কিছু সম্রাটের ছবি অত্যন্ত উজ্জ্বল হয়ে আছে ত্যাসিতাসই সেসব ছবির স্রষ্টা। অত্যন্ত চাতুর্যের সঙ্গে সেসব চিত্র এঁকেছেন তিনি, সঙ্গে ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর বর্ণনাও দিয়েছেন বটে, কিন্তু প্রধান কুশীলবদের ব্যক্তিত্ব এমনভাবে বর্ণনা করেছেন যেন তাঁরা উপন্যাসের চরিত্র।

তাইবেরিয়াসের রাজত্বকালের বর্ণনার শুরুতে তিনি বলছেন কিভাবে আগ্রিপিনা — যিনি ত্যাসিতাসের এক ভ্রাতুষ্পুত্রকে বিয়ে করেছিলেন — রাইন-এ এক সামরিক সংকটকালে অসীম সাহসিকতার সঙ্গে পরিস্থিতি সামলেছিলেন। তারপর তিনি বলছেন, ‘Id Tiberii animum altius penetravit’, অর্থাৎ, ‘আর সেটা গভীরভাবে দাগ কেটেছিল তাইবেরিয়াসের মনে’ (আক্ষরিক অর্থে, ‘আর সেটা গভীরভাবে ঢুকে গিয়েছিল তাইবেরিয়াসের মনে’)। কারণ — ত্যাসিতাস ব্যাখ্যা করে বলছেন — তাইবেরিয়াস এটা সহ্য করতে পারেন নি যে এক নারী এতোটা উদ্যোগী হবেন, এতোটা প্রভাব বিস্তার করবেন। সেই ঘটনায় তাইবেরিয়াস নিজে কোনো পদক্ষেপ নেননি, কিন্তু পাঠক ক্রমেই একটা আভাস পেতে থাকেন কি করে সম্রাট পরে আগ্রিপিনাকে পর্যুদস্ত করবেন। এ-ধরনের মন্তব্য আর ইঙ্গিতের মাধ্যমে ত্যাসিতাস এক ধূর্ত, কোনো কিছুই বিস্মৃত না-হওয়া, প্রতিহিংসাপরায়ণ ব্যক্তি হিসেবে তাইবেরিয়াসকে চিত্রিত করেন। গোড়ার দিকের রোমক সম্রাটদের কোনোভাবেই সদগুণের আধার বলা যায় না, তবে একথা বলা যায় যে, ত্যাসিতাসকে যাঁরা তাঁদের ইতিহাসবিদ হিসেবে পেয়েছেন তাঁদের কপাল নেহাতই মন্দ। তিনি জানতেন কি করে তাঁদেরকে বদমায়েসের মতো করে আঁকতে হয়; আর সেটা একটা কারণ যে তাঁর লেখা শেষ না করে ওঠা খুব মুশকিল, তবে সেই যুগটাকে তাঁর চোখ দিয়েই একটু বেশি করে দেখার একটা প্রবণতা রয়েছে সম্ভবত উত্তরকালের। সাধারণ, দুর্বল, মোটামুটিভাবে যোগ্য ব্যক্তিবিশেষের চাইতে আসল তস্করেরা অনেক বেশি আকর্ষণীয়।

কিন্তু ত্যাসিতাস কেবল নানান সম্রাট আর তাঁদের ব্যক্তিত্ব নিয়েই চিন্তিত ছিলেন না। বৃহত্তর সাম্রাজ্যে, এমনকি প্রতিবেশী দেশগুলোতে কি ঘটছিল সে-বিষয়েও এন্তার কথা বলে আমাদেরকে তাঁর ইতিহাস। বিশেষ করে তাঁর আগ্রহ ছিল সাম্রাজ্যের পুব সীমান্ত নির্দেশকারী রাইন নদী তীরবর্তী অঞ্চলের ঘটনাবলী আর সীমান্তের অপর পাড়ের মানুষদের ব্যাপারে। আলাদা একটা ছোট্ট বই-ও লিখেছিলেন তিনি ‘Germania’ নামে। সেখানে তিনি এখন যে-দেশ জার্মানী নামে পরিচিত সেখানকার এবং তা ছাড়িয়েও আরো দূর অঞ্চলে বসবাসরত মানুষের কথা বলেছেন।

রোমকদের কাছে যথেষ্ট গুরুত্ব ছিল জার্মানদের, কারণ কিছুদিন পরপরই সামরিক হুমকি হয়ে দাঁড়াত তারা। আর পঞ্চম শতকে কিন্তু সত্যি সত্যিই নানান জার্মানিক উপজাতি আক্রমণ চালায় সাম্রাজ্যের ওপর, এবং শেষ পর্যন্ত পতন ঘটায় সেটার। তবে, সাম্রাজ্যের বিপদের কারণ ছিল বলেই যে ত্যাসিতাস তাদের সম্পর্কে লিখতে উদ্যোগী হয়েছিলেন তা সম্ভবত নয়। জার্মানদের যে বিশেষ ধরনের সামাজিক বিন্যাস, তাদের স্বভাব-চরিত্র, আচার-ব্যবহার, সেসবের ব্যাপারেও আগ্রহ ছিল তাঁর। তাঁর চোখে জার্মানরা ছিল আদিম মানুষ, সভ্য রোমকদের চাইতে স্বাধীন বা মুক্ত, আর সৎ, কিন্তু সেই সঙ্গে আরো বেশি সহজ-সরল ও আবেগপ্রবণ। তিনি যেভাবে তাদের বর্ণনা দিয়েছেন তা এক শতাব্দী বা তার কিছু আগে দূরবর্তী বিভিন্ন অঞ্চলে নানান জাতির দেখা পেয়ে ইউরোপীয় অভিযাত্রীরা যেভাবে তাদের কথা লিখতেন খানিকটা সেরকম। তবে ত্যাসিতাস নিজে জার্মানিয়া সফর করেননি; যেসব রোমক ব্যবসায়ী সেখানে গিয়েছিলেন কোনো না কোনো সময়ে সম্ভবত তাদের কাছ থেকে নানান তথ্য পেয়েছিলেন তিনি। জার্মানিক নানান দলের কথা জানতেন তিনি, আর সেসব দলের-ই একটি হলো Angli, যারা সেসময় জার্মানির একেবারে উত্তরে অনেকটা লোকচক্ষুর আড়ালে বাস করত। ব্রিটেনের ব্যাপারেও একটা বিশেষ আগ্রহ ছিল ত্যাসিতাসের, এবং এই দ্বীপাঞ্চলের ইতিহাসে তার একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান-ও আছে। নিজের শ্বশুর মহাশয় — Gnaeus Iulius Agricola-র একটি জীবনী লিখেছিলেন তিনি, নাম, স্রেফ ‘Agricola’। ইনি ছিলেন একজন বিখ্যাত সামরিক অধিনায়ক এবং রাজনীতিবিদ, আর, ৭৮ থেকে ৮৪ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত যে-সাত বছর তিনি ব্রিটানিয়া প্রদেশের প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন সেটাই ছিল তাঁর জীবনের সবচাইতে উল্লেখযোগ্য কীর্তি। তারও মোটামুটি পঁয়ত্রিশ বছর আগে দ্বীপটির দক্ষিণ ও পুব অঞ্চল রোমক শাসনের অধীনে আসে, যদিও তখনও, অর্থাৎ এগ্রিকোলার শাসনামলেও, দখলদারদের বিরুদ্ধে যথেষ্ট প্রতিরোধ চলছিল। এগ্রিকোলা কিছু সফল সামরিক অভিযান চালিয়েছিলেন ওয়েলস আর উত্তরে এবং সেখানে তিনি ফার্থ অভ ফর্থ (the Firth of Forth) আর ক্লাইড (the Clyde) পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিলেন।

এসব সামরিক অভিযানের খুঁটিনাটি নানান জিনিস ধরে রেখেছে ‘Agricola’; সেই সঙ্গে তাতে আছে ব্রিটনদের সম্পর্কে অনেক তথ্য। তারা ছিল কেল্ট; ভাষা ও সংস্কৃতির দিক থেকে গঅলের অধিবাসীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। ট্যাসিটাসের চোখে তারা ছিল অসম্ভব স্বাধীনতাপ্রেমী, কিন্তু শেষ অব্দি রোমকদের প্রতিহত করতে অক্ষম, কারণ তারা সম্মিলিতভাবে কোনো কাজ করতে পারত না। তিনি বলছেন… ‘Nec aliud … pro nobis utilius quam quod in commune non consultant’ — ‘তারা যে একত্রে বসে আলাপ-আলোচনা করতে পারে না তার চাইতে বড় সুবিধের ব্যাপার আমাদের জন্য আর হতে পারে না।’ তারপরেও, নিজেদের স্বাধীনতা ফিরে পাওয়ার জন্য অত্যন্ত সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছিল তারা। তাদের বীরাঙ্গনাদের অন্যতম ছিলেন রানী বুদিকা (Boudicca; কখনো কখনো নামটা ইংরেজিতে ‘Boadicea’-ও লেখা হয়); অন্যান্য নেতারা তাঁকেই তাঁদের বিদ্রোহের নেত্রী হিসেবে নির্বাচিত করেছিল : ‘Neque enim sexum in imperiis discernunt.’ ‘কারণ কর্তৃত্বের প্রশ্নে তারা নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য করত না।’ সে যা-ই হোক, রানী বুদিকার বাহিনী খুব শিগগিরই পরাস্ত হলো, এবং তাঁকে আত্মহত্যা করতে হলো। পরে, ব্রিটনেরা উত্তরাঞ্চলে এগ্রিকোলা ও তাঁর বাহিনীর বিরুদ্ধে একটি প্রবল সুপরিকল্পিত যুদ্ধে অংশ নেয় ও তাতে পরাজয় বরণ করে। সেনাবাহিনীর উদ্দেশে দেয়া এক ব্রিটিশ সেনা অধিনায়কের একটি কাল্পনিক বক্তৃতাও রচনা করে ফেলেন ট্যাসিটাস। এবং তাঁকে দিয়ে রোমকদের হেনস্তার এক জীবন্ত বর্ণনা দেয়ান এবং তাদের ক্রিয়াকলাপের একটা সার-সংক্ষেপ দেন এই বিখ্যাত শব্দবন্ধে :

Ubi solitúdinem fáciunt, pacem appellant.

যখন তারা মরুভূমি রচনা করে সেটাকে তখন তারা বলে শান্তি।

সেই অর্থে, রোমক বিজয় নিয়ে লেখকের দৃষ্টিভঙ্গিটা বেশ দ্ব্যর্থবোধক। একদিকে তিনি তাঁর শ্বশুরের কৃতিত্ব বেশ পছন্দ করছেন, কেবল যখন তিনি যুদ্ধে জেতেন তখন-ই না, সেই সঙ্গে যখন তিনি ব্রিটনদের বৈরি মনোভাব বদলাবার জন্য কঠোর পরিশ্রম করেন তাদেরকে রোমক স্নানাগার ব্যবহারে প্রলুব্ধ ক’রে আর তাদের সন্তানদের জন্য রোমক শিক্ষার ব্যবস্থা ক’রে, তখনও। অন্যদিকে তিনি মনে করেন এটা তাদেরকে তাদের আগের স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করার খুব কার্যকর উপায়।

Apud imperítos humanitas vocabatur, cum pars servitutis esset.

অজ্ঞরা একে বলে সভ্যতা, আসলে কিন্তু তা দাসত্বের অংশ।

স্পষ্টতই, ব্রিটেনকে রোমকায়িত করার বিষয়টি ছিল কিছু কিছু দিক থেকে আফ্রিকার অনেক দেশকে পশ্চিমীকরণের মতোই। তবে ত্যাসিতাস বিজিতদের চাইতে বিজেতাদের নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন অনেক বেশি। তাঁর নিজের জাতির লোকেরা তাদের স্বাধীনতা হারিয়েছিল, এবং এখন তারা তাদের নৈতিক অবক্ষয় অন্যদের কাছে চালান করছে, এরকম-ই ছিল তাঁর মনোভাব।

(ক্রমশ)

জি এইচ হাবীব

জন্ম ১০ই মার্চ ১৯৬৭। পেশা: শিক্ষকতা।

৩ comments

  1. Pingback: লাতিন ভাষার কথা : ২১ | জি এইচ হাবীব

  2. borna - ৩ মার্চ ২০১৫ (৯:১৬ অপরাহ্ণ)

    অজ্ঞরা একে বলে সভ্যতা, আসলে কিন্তু তা দাসত্বের অংশ….. :)‌‌ ক্রমশের অপেক্ষায়

  3. Pingback: লাতিন ভাষার কথা : ২২ » বাংলাদেশী শীর্ষ কমিউনিটি নিউজ পোর্টাল

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.