লাতিন ভাষার কথা : ৯

|| লেখা, পড়া, শোনা ও বলা || যখন বলি ‘রোমক সাহিত্য’ তখন আসলে কি বোঝাই আমরা? আমরা নিশ্চয়ই তখন সেসব ছাপা বই-এর কথা বলি না দোকানে যেসব বিক্রি হয়, প্রকাশকেরা যেসব ছেপে বের করার পর বিভিন্ন স্থানে বিক্রির জন্য পাঠান, এবং লেখা-ই পেশা এমন লেখকেরা তা লেখেন। রোমে খানিকটা ভিন্ন ছিল বিষয়টা। [. . .]

Tore Janson-এর সুইডিশ ভাষায় রচিত Latin: Kulturen, historien, språket গ্রন্থের Merethe Damsgård Sørensen ও Nigel Vincet-কৃত ইংরেজি অনুবাদ A Natural History of Latin-এর বাংলা ভাষান্তর

 

লেখা, পড়া, শোনা ও বলা

যখন বলি ‘রোমক সাহিত্য’ তখন আসলে কি বোঝাই আমরা? আমরা নিশ্চয়ই তখন সেসব ছাপা বই-এর কথা বলি না দোকানে যেসব বিক্রি হয়, প্রকাশকেরা যেসব ছেপে বের করার পর বিভিন্ন স্থানে বিক্রির জন্য পাঠান, এবং লেখা-ই পেশা এমন লেখকেরা তা লেখেন। (অবশ্য এই শেষ ব্যাপারটা এখনো, এই একবিংশ শতকেও, খুব কম-ই দেখা যায় — অনুবাদক)। রোমে খানিকটা ভিন্ন ছিল বিষয়টা। রোমকরা এমন এক সমাজে বাস করত যেখানে লিখিত ভাষার ভূমিকা ছিল আমাদের জীবনে সেটার ভূমিকার চাইতে ঢের কম। শহরে থাকত যারা তাদের অনেকেই লিখতে পড়তে পারতো, কিন্তু মোটের ওপর পুরো জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই সম্ভবত ছিল নিরক্ষর। তাছাড়া, আজকের তুলনায় পড়ার জিনিসও যে ঢের কম ছিল তা বলাই বাহুল্য। এ পার্থক্যের একটা বড় কারণ নিশ্চয়ই প্রযুক্তি। রোমকদের তো আর কম্পিউটার, ছাপাখানা বা ফটোকপিয়ার ছিল না। প্রতিটি টেক্সট হাতে লিখতে হতো, আর, কোনো লেখার বেশ কিছু কপি বিলি করতে হলে মূল লেখাটা বার বার নকল করতে হতো যতক্ষণ পর্যন্ত না প্রয়োজনীয় সংখ্যক কপি পাওয়া যাচ্ছে — সেটা কবিতা থেকে পোস্টার সব কিছুর ব্যাপারেই প্রযোজ্য ছিল। একমাত্র যে ক্ষুদে টেক্সট গণহারে তৈরি করা সম্ভব ছিল তা হলো মুদ্রায় উৎকীর্ণ লিপি। প্রচুর পরিমাণে সেগুলো ছাপ মারা যেতো মুদ্রার ওপর। কাজেই ক্ষমতাসীনরা তাঁদের প্রচার-প্রপাগান্ডার কাজে মুদ্রার ওপর উৎকীর্ণলিপি (এমনকি ছবিও) ব্যাপক হারে ব্যবহার করতেন।

মুদ্রা ছাড়া টেক্সট তৈরির আর কোনো সহজ উপায় ছিল না। খানিকটা ব্যয়সাপেক্ষ একটা উপায় অবশ্য যথেষ্ট ব্যবহৃত হতো, আর সেটা ছিল পাথর বা তামার ফলকের (ট্যাবলেট) ওপর লেখা উৎকীর্ণ করা। এমন উৎকীর্ণ লিপি ছিল বেশ টেকসই, আর সেগুলো সুবিধেজনক এমন সব জায়গায় রাখা বা বসানো যেতো যাতে শহরের সব বাসিন্দা তা দেখতে পায়, বা, পড়তে পারে। এই কৌশলটা কেবল সমাধিফলক বা স্মৃতিসৌধের ক্ষেত্রেই সুবিধেজনক ছিল না, একই সঙ্গে তা আইন-কানুন, বিধি-নিষেধ, বা এরকম নানান বিষয় প্রচারের জন্যেও উপযোগী ছিল খুব। গোটা রোমক সাম্রাজ্য থেকে সংগৃহীত এ-ধরনের হাজার হাজার উৎকীর্ণ লিপি এখনো রয়েছে আমাদের কাছে।

লেখালেখির উপকরণ হাতে একটি যুগল : পুরুষটির হাতে প্যাপিরাস, আর মেয়েটির এক হাতে লেখনী, অন্য হাতে মোমের ফলক। পম্পেই নগরে প্রাপ্ত প্রাচীন রোমক ভিত্তিচিত্র, আনু. ৭৫ খৃষ্টাব্দে অঙ্কিত।

লেখালেখির উপকরণ হাতে একটি যুগল : পুরুষটির হাতে প্যাপিরাস, আর মেয়েটির এক হাতে লেখনী, অন্য হাতে মোমের ফলক। পম্পেই নগরে প্রাপ্ত প্রাচীন রোমক ভিত্তিচিত্র, আনু. ৭৫ খৃষ্টাব্দে অঙ্কিত।

তুলনামূলকভাবে ক্ষণস্থায়ী কোনো বার্তা হলে লোকে অবশ্য কোনো দেয়ালের ওপর সেটা রঙ দিয়ে এঁকে বা লিখে দিতো প্রায়-ই। তবে সেগুলোর বেশিরভাগই হারিয়ে গেছে। কিন্তু এ-ধরনের লেখা কেমন ছিল সে-সম্পর্কে আমরা খানিকটা ধারণা পাই ৭৯ খৃষ্টাব্দে ভিসুভিয়াসের অগ্ন্যুৎপাতের ফলে নিঃসৃত লাভা আর ছাইয়ের নিচে চাপা-পড়া পম্পেই নগরটির কাছ থেকে। নগরটির বেশিরভাগ দেয়ালের সারা গা জুড়েই লেখা বা আঁকা ছিল নানান রকমের বার্তা বা সংবাদ : ফলের দোকানের বিজ্ঞাপন, বিশেষ কোনো প্রার্থীকে ভোট দেবার আহ্বান, প্রণয়ের ঘোষণা, এবং অগুনতি খারাপ খারাপ বা অপমানজনক কথাবার্তা। মাঝে মাঝে এখানে সেখানে দেখা যেত কিছু কবিতা, সেগুলোর অনেকগুলোই সুপরিচিত কোনো কবির লেখা।

অবশ্য উৎকীর্ণলিপি আর দেয়াল ঠিক হিসাবরক্ষণ বা ব্যক্তিগত চিঠি-পত্রের জন্য উপযোগী ছিল না, বোঝা-ই যায়। সে- ধরনের লেখার জন্য ছিল দুটো প্রধান উপায়। একটা হচ্ছে মোমের ফলক — ঠিক করে বললে, মোমের প্রলেপ দেয়া কাঠের টুকরো। সেই মোমের ওপর চোখা একটা ছোট লাঠি দিয়ে সহজেই লেখা যেতো, আর সেই লাঠিটিকে বলা হতো ‘stilus’ (এখান থেকেই এসেছে ইংরেজি ‘style’ শব্দটা, যার আক্ষরিক মানে ‘লেখার একটি উপায়, বা ধরন’)। তো, বার্তাটির প্রয়োজন ফুরালে, মোমটাকে সমান করে দিয়ে আবার নতুন কিছু লেখা যেতো। নোট-পত্তর, ছোট চিঠি, বা এ-ধরনের নানানা কিছু, যা সংরক্ষণ করার খুব একটা দরকার নেই, সেসব লেখার জন্য বেশ উপযোগী ছিল এই পদ্ধতিটি। লোকে আসলেই এরকম অনেক ফলক একসঙ্গে বেঁধে এক রকমের নোটবইয়ের মতো বানাতো।

আরো বড় যেসব লেখা লোকে সংরক্ষণ করতে চাইতো সেগুলোর জন্য উপাদান হিসেবে ছিল প্যাপিরাস। জিনিসটা দেখতে, ধরতে মোটামুটি কাগজের মতোই, কিন্তু বেশ মোটা আর শক্ত। তৈরি হয় প্যাপিরাস গাছ থেকে, নলখাগড়ার মতো যা জন্মায় নদীর তীরে তীরে আর জলাভূমিতে, প্রধানত নীল নদের বদ্বীপে। মিশরীয়রা প্যাপিরাসে লেখার কৌশল আবিষ্কার করে এবং ২০০০ খৃষ্ট পূর্বাব্দের মধ্যে তা গোটা ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে।

কলম দিয়ে কালির সাহায্যে লিখতে হয় প্যাপিরাসে, কাজেই লেখাটা স্থায়ীই হয় বটে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে, খোদ উপাদানটি-ই, অর্থাৎ প্যাপিরাসই খুব বেশি টেকসই নয়। কয়েক শ বছর যেতে না যেতেই স্বাভাবিক আবহাওয়াতেই নষ্ট হয়ে যায়, আর তার অর্থ, সেই প্রাচীন কালে রচিত আদি লেখা-পত্তর আমাদের হাতে তেমন নেই। যা আছে তার বেশিরভাগ সেসবের নকল, এবং সেগুলো কি করে টিকে গেল বা আমাদের হাতে এলো সে-নিয়ে পরে আলাপ করবো আমরা।

সে যাই হোক, বিশেষ ব্যবস্থায় প্যাপিরাস দীর্ঘদিনের জন্য সংরক্ষণ করা যায়, বিশেষ করে যদি কোনোভাবে একেবারে শুকনো জায়গায় রাখা যায় বা থাকে সেটা। প্রাচীনকালের যেসব প্যাপিরাস টিকে গেছে সেসব সাধারণত মরুভূমিতে আর ‘ডেড সি’ এলাকার কিছু গুহায় পাওয়া গেছে। লেখাগুলো মূলত গ্রীক, হিব্রু, আর আরামাইক, তবে কিছু কিছু লাতিনও আছে বৈকি।

Psalms_Scroll

‘ডেড সি স্ক্রল’

চিঠি আর সেরকম জিনিসপত্রের জন্য প্যাপিরাস খোলা পৃষ্ঠা হিসেবে ব্যবহার করা যেত। আট ইঞ্চি থেকে এক ফুট চওড়া আর দশ গজ পর্যন্ত লম্বা প্যাপিরাসের ফালির ওপর লেখা হতো দীর্ঘ লেখাগুলো, আর সেই ফালিগুলোর দু’প্রান্ত থাকত কাঠের লাঠির সঙ্গে বাঁধা। ফালিটি সাধারণত একটি প্রান্তের চারধারে গুটিয়ে রাখা হতো, পড়ার সময় খুলে নিলেই চলতো। টেক্সট লেখা থাকত রোলটির ওপর আড়াআড়িভাবে, এক কাঠি থেকে অন্য কাঠিটি পর্যন্ত। রোলটির এক পিঠেই লেখা হতো যা লেখার, এবং সেটায় সব মিলিয়ে যে-জায়গা থাকত তা আধুনিক কালের একটি সাধারণ বইয়ের তিরিশ বা পঞ্চাশ পৃষ্ঠার মতন হবে। এ-ধরনের রোলকে রোমকরা বলত ‘liber’, যা অনুবাদ করলে দাঁড়ায় ‘বই’। আজ আমরা যেসব বই ব্যবহার করি সেসবের তুলনায় অবশ্য এসব বই ব্যবহার করা কষ্টসাধ্য ছিল বেশ, আর তাছাড়া সেগুলো আকারে ছোট-ও ছিল অনেক। একটি ‘liber’ বা বইয়ে সাধারণত কিছু কবিতা বা একটি নাটক লেখার মতো জায়গা থাকত, কিন্তু কেউ তার চাইতে বড় কিছু লিখতে চাইলে তাকে রচনাটিকে ছোট ছোট খণ্ডে ভাগ করে নিতে হতো, যার একেকটি হয়তো এক এক রোল-এ এঁটে যেতো। প্রাচীন রচনাগুলো এ কারণেই অধ্যায়ে নয়, ‘book’-এ বিভক্ত, যার প্রতিটি মোটামুটি প্রায় কুড়ি থেকে চল্লিশ পৃষ্ঠা দীর্ঘ হতো।

প্রাচীন এসব বইয়ের রোলগুলো আধুনিক বইয়ের তুলনায় ব্যবহারিক দিক থেকে যথেষ্ট পিছিয়ে ছিল : ইচ্ছে করলেই চটজলদি যে-কোনো পৃষ্ঠায় চলে যাওয়া যেতো না, আর বার বার খুলতে ও গুটিয়ে রাখতে হতো বলে তাড়াতাড়ি জীর্ণ হয়ে পড়তো সেগুলো। তাছাড়া বই তৈরিতে খরচ-ও হতো খুব; কাজেই সম্ভবত গুটিকতেক লোকেরই কেবল বই-পত্তর নাড়াচাড়া করবার সুযোগ ঘটত। তারপরেও একথা বলা চলে যে, আর্থিক দিক থেকে সম্পন্ন এবং মানসিক দিক থেকে বিদ্যানুরাগী লোকের পক্ষে বড়সড় একটি সংগ্রহ গড়ে তোলা অসম্ভব ছিল না। এবং রোমে ধীরে ধীরে গণগ্রন্থাগারও স্থাপিত হয়েছিল। তারপরেও একথা বলতেই হবে যে গ্রন্থপাঠ আজকের দুনিয়ায় আমাদের জীবনে যে-ভূমিকা পালন করে রোমকদের জীবনে তা মোটেই সেরকম কোনো ভূমিকা পালন করতো না। একেবারে বাস্তবসম্মত কারণেই, এমনকি পড়তে জানার পরেও, খুবই কম পড়া হতো তাদের। কিন্তু একথা সত্য যে নিজেদের ভাষা আর সেটা ভালো করে ব্যবহারের কৌশলের ব্যাপারে প্রবল উৎসাহ ছিল রোমকদের। তবে মূল ব্যাপারটি ছিল স্রেফ এই যে নিজেদের ভাষার সঙ্গে তাদের যোগাযোগ বা সম্পৃক্ততা ঘটত একেবারে সনাতনী কায়দায়, কানের মাধ্যমে। চোখ দিয়ে কারো বক্তব্য গ্রহণ করা নিশ্চিতভাবেই অনেক বেশি ঘোরালো বা জটিল পদ্ধতি বলে মনে হতো তাদের কাছে আমাদের কাছে তা যেমন বোধ হয় তার চাইতে।

লিখিত টেক্সট বা পাঠ-কে সবসময়ই  উচ্চারিত কথা ধরে রাখার একটা উপায় বা পদ্ধতি বলে দেখা হতো; কাজেই কেউ যখন কিছু পড়ত তখন তা জোরে জোরেই পড়ত। লোকে নীরবে বা মনে মনেও পড়ত বৈ কি। কিন্তু ধনী মানুষদের শিক্ষিত দাস ছিল, যারা তাদের প্রভু বা প্রভুর পরিবারের সদস্য এবং বন্ধু-বান্ধবদের জোরে জোরে পড়ে শোনাত। আরও কি, লেখকেরাও প্রায়ই তাঁদের রচনা থেকে জোরে জোরে পড়ে শোনাতেন। মানুষের কাছে একটি নতুন রচনা, বিশেষ করে কবিতাকে নিয়ে যাওয়ার বা পরিচিত করাবার খুবই সাধারণ একটি পদ্ধতি ছিল এটি, আর এ-ধরনের ঘটনা ধীরে ধীরে বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে রোমে।

ভাল কবিতা লেখা আর তা আবৃত্তি করা ছিল আসলে রোমে সাফল্য অর্জন করা ও বিখ্যাত হওয়ার একটি উপায়। তবে সেই সঙ্গে ছিল আরেক ধরনের মৌখিক বা বাচনিক শিল্প যা আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে রোমক সমাজে, এবং সেটি হচ্ছে বাগ্মিতা। মজা করার জন্য বা লোক দেখানোর জন্য কিন্তু কাজটি করত না লোকে; বরং লোকসমাজে গৌরব ও যশপ্রার্থীদের জন্য এটি ছিল অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি দক্ষতা, আর বিষয়টি যে তাই ছিল সেটিই তাদের সমাজ আর আমাদের সমাজের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ফারাকের দিক তুলে ধরে।

(ক্রমশ)

জি এইচ হাবীব

জন্ম ১০ই মার্চ ১৯৬৭। পেশা: শিক্ষকতা।

১ comment

  1. Pingback: লাতিন ভাষার কথা : ৮ | জি এইচ হাবীব

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.