লাতিন ভাষার কথা : ৮

|| বিপ্লবের কাল || শত শত বছর ধরে রোমে কার্যত একইরকম শাসন বহাল ছিল; গণপরিষদের হাতে নির্বাচিত কর্মকর্তা আর সিনেটররাই ছিলেন দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। কিন্তু ধীরে ধীরে খুবই বিশাল হয়ে পড়েছিল সাম্রাজ্যটি। [. . .]

Tore Janson-এর সুইডিশ ভাষায় রচিত Latin: Kulturen, historien, språket গ্রন্থের Merethe Damsgård Sørensen ও Nigel Vincet-কৃত ইংরেজি অনুবাদ A Natural History of Latin-এর বাংলা ভাষান্তর

 

বিপ্লবের কাল

শত শত বছর ধরে রোমে কার্যত একইরকম শাসন বহাল ছিল; গণপরিষদের হাতে নির্বাচিত কর্মকর্তা আর সিনেটররাই ছিলেন দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। কিন্তু ধীরে ধীরে খুবই বিশাল হয়ে পড়েছিল সাম্রাজ্যটি। তারপরেও গণপরিষদের সদস্য ছিলেন কেবল রোমের মুক্ত মানুষেরা, আর সত্যি বলতে সিনেটররা আসতেন রোমের খুব অল্পসংখ্যক অত্যন্ত ধনী পরিবার থেকে। কাজেই, সব ক্ষমতা আর প্রায় সমস্ত অর্থ-সম্পদই কুক্ষিগত ছিল একটি মাত্র শহরের গুটিকতেক মানুষের হাতে। রোমের দরিদ্র জনসাধারণ ও গোটা সাম্রাজ্যের সবার মাঝে ব্যাপক অসন্তোষের সৃষ্টি করে এ-বিষয়টি। এবং শেষ পর্যন্ত অকার্যকর হয়ে পড়ে ব্যবস্থাটি।

অথচ তারপরেও সেটা বদলানো সহজ ছিল না খুব একটা। এক শতকের অল্প কিছু বেশি সময় ধরে গুরুতর এক ক্ষমতার লড়াই চলে রোমে। সেটার শুরু হয় প্রস্তাবিত এক ভূমি সংস্কার নিয়ে। এই প্রস্তাব অনুযায়ী, ধনীরা আর বড় বড় জমির মালিক হতে পারবেন না এবং দাসদের দিয়ে সেগুলো চাষবাদ করাতে পারবেন না। উল্টো, অনেক জমিই তাঁদের ছেড়ে দিতে হবে, এবং সেগুলো তখন ছোট ছোট ভাগ করে গরীবদের মধ্যে, বিশেষ করে সেই সব সৈন্যর মধ্যে বিলি করে দেয়া হবে যাঁরা সেনাবাহিনীতে তাঁদের কাজের মেয়াদ শেষ করেছেন। এই ভূমি সংস্কারের প্রস্তাব যিনি করেন তাঁর নাম তাইবেরিয়াস গ্রকাস (Tiberius Gracchus)। ১৩৩ খৃষ্ট পূর্বাব্দে খুন হয়ে যান তিনি। শুধু তিনিই নন, দশ বছর পর খুন করা হয় তাঁর সহোদরকেও, যিনি ঠিক একই ধ্যান-ধারণার প্রবক্তা ছিলেন। তাঁদেরকে হত্যা করা হলেও তাঁদের চিন্তাকে কিন্তু হত্যা করা যায় নি। আর তা জন্ম দিল কিছু মানুষের ছোট একটি দলের, যদিও তাঁরা যে খুব সংগঠিত ছিলেন সেকথা বলা যাবে না। তাঁরা নিজেদেরকে বলতেন ‘populares’, আর এ-শব্দটা এসেছে ‘populus’, বা ‘জনগণ’ (people) থেকে, যার অর্থ, ‘জনগণের দল’ (the people’s party)। তাঁদের বিরোধী পক্ষে ছিলেন ধনী সব সিনেটর আর তাঁদের অনুসারীরা, আর নিজেদেরকে তাঁরা বলতেন ‘optimates’, বা, ‘সেরা’ (the best)। তো, এক অর্থে রোমে তখন দেখা দিলো একটি পরিবর্তনকামী বা, প্রগতিবাদী, বা চরমপন্থী দল, আরেকটি রক্ষণশীল দল।

একদিকে এই দুই দলের দ্বন্দ্ব নানান ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে এগোতে থাকল আর অন্যদিকে রোমকরা অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধের মাধ্যমে ক্রমেই বাড়িয়ে যেতে থাকল তাদের সাম্রাজ্যের পরিধি। সামরিক বাহিনী ছিল এই ক্ষমতার খেলায় এক গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়, আর ক্ষমতার ভারসাম্যের অতি তাতপর্যবাহী বিষয়টি দিন দিন আরো বেশি করে চলে যাচ্ছিল সফল সেনাপতিদের হাতে, যাঁরা কখনো এক দলের পক্ষে থাকতেন তো কখনো অন্য দলে। তাঁদের কারো কারো নাম খুবই পরিচিতি লাভ করেছিল, যেমন, ‘populares’ দলের প্রতি সহানুভূতিপূর্ণ মারিয়াস, আর ‘optimates’ শিবিরের সুলা। রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব তীব্র আকার ধারণ করেছিল, এবং বেশ কয়েকবারই তা সত্যিকারের গৃহযুদ্ধে রূপ নিয়েছিল। আর তাতে করে এটা মনে করা অমূলক নয় যে গোটা সাম্রাজ্যই ভেঙে পড়বার উপক্রম হয়েছিল। এই পর্বের শেষ দিকে এক রোমক ঐতিহাসিক রোম সম্পর্কে এই মন্তব্য করেছিলেন যে, ‘magnitúdine sua labórat’, ‘এটি তার নিজের বিরাটত্বের নিচে নিজেই চাপা পড়ছে।’

বিপ্লবের কালে এই সেনাপতিদের মধ্যে সবচাইতে বিখ্যাত ছিলেন গেইয়াস জুলিয়াস সিযার (Gaius Julius Caesar)। প্রাচীন এক সিনেট পরিবার থেকে এসেছিলেন তিনি, এবং রাজনীতিক ও যোদ্ধা দুই দিক থেকেই ছিলেন অসাধারণ। অমিত প্রাণশক্তির অধিকারী ছিলেন সিযার। খৃষ্ট পূর্বাব্দ ৫৮ সালে গালিয়া সিসালপিনা (Gallia Cisalpina) প্রদেশের গভর্নর নিযুক্ত হন তিনি; জায়গাটার নামের আক্ষরিক মানে ‘আল্পসের এই দিকের গঅল’, অন্য কথায়, উত্তর ইতালি। সেখান থেকে, মোটের ওপর তাঁর নিজেরই প্রচেষ্টায়, পশ্চিম ও উত্তরের অধিবাসী গলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন তিনি। (এই প্রসঙ্গে অনেকেরই হয়ত মনে পড়ে যাবে ভুবনবিখ্যাত কমিক সিরিয Asterix-এর কথা — অনুবাদক)। তো, আমরা আজ যে ভূখণ্ডকে ফ্রান্স বলে জানি তার পুরোটাই আট বছরের মধ্যে সিযারের করায়াত্তে চলে আসে, এবং খৃষ্ট পূর্বাব্দ ৫৫–৫৪-তে তিনি ব্রিটেন আক্রমণ করেন। এছাড়া, এক বিশাল সেনাবাহিনী তৈরি করেন তিনি যার সদস্যরা রোমের চাইতে ব্যক্তিগতভাবে তাঁর নিজের প্রতিই বিশ্বস্ত ছিল। সিযার যে কত চতুর ছিলেন সেকথা প্রায়ই শুনতে পাই আমরা। তবে, তিনি চরম নিষ্ঠুর-ও ছিলেন বৈকি। তাঁর নিজের হিসাবমতেই দশ লাখ কুড়ি হাজার গলবাসীকে হত্যা করেছিল তাঁর বাহিনী, দশ লক্ষকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল বন্দি হিসেবে, যাদেরকে দাস হিসেবে বিক্রি করে তিনি নিজে আর তাঁর সেনাবাহিনী প্রচুর অর্থের মালিক হয়েছিলেন। আজকের দিনে এমন ভয়ানক কাণ্ড ঘটালে তাঁকে নিশ্চিতভাবে গণহত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত হতে হতো।

গঅল-এর সঙ্গে যুদ্ধের পর সিনেটের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন সিযার। নিজের প্রদেশের বাইরে সেনাবিহিনীর নেতৃত্ব দেয়া অবৈধ ছিল তাঁর জন্য। তারপরেও নিজ সেনাবাহিনী নিয়ে দক্ষিণ দিকে রওনা দেন তিনি, এবং যখন সিসালপিনা গঅল আর ইতালির মধ্যে সীমান্ত হিসেবে বয়ে যাওয়া রুবিকন নদীর কাছে এসে পৌঁছান তখন জীবনের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হয় তাঁকে। আর এই সময়ই সেই বিখ্যাত উক্তিটি করেন তিনি। “The die is cast.” (দান চালা হয়ে গেছে; ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেছে)। আমাদের কাছে যে সূত্র আছে, সেই মতে তিনি আসলে যা বলেছিলেন তা হলো ‘iacta álea est!’ শব্দের ক্রমটি খেয়াল করবার মতো এখানে। ‘Alea’ মানে ‘die’, বা, আধুনিক ইংরেজিতে যাকে ‘dice’ বলে — পাশা খেলার ছক্কা। আর যদি লাতিন শব্দক্রম ইংরেজিতে প্রয়োগ করি তাহলে তা হবে ‘Cast die is!’, যেটা নিঃসন্দেহে বেশ অদ্ভুত শোনায়। অবশ্য লাতিনেও যে এটা সবচেয়ে স্বাভাবিক শব্দক্রম তা নয়, কিন্তু ইংরেজির চাইতে ঢের কম অস্বাভাবিক।

তো, এই কাজটির মাধ্যমে সিযার একটি বড়সড় গৃহযুদ্ধের সূত্রপাত করলেন, এবং শেষ অব্দি তাতে জিতেও গেলেন। আর তার ফলে, ‘dictator’ উপাধি নিয়ে কয়েক বছরের জন্য কার্যত একমাত্র ও স্বৈরাচারী শাসক বনে যান তিনি রোমের। অল্প কিছুদিনের মধ্যে বেশ কিছু সংস্কার ও পরিবর্তন আনেন তিনি, যার মধ্যে অনেকগুলোই আইন বা বিধি পুস্তকের স্থায়ী অংশ হয়ে যায়। কিন্তু অনেকেই তাঁর স্বৈরাচারী ভূমিকার প্রচণ্ড বিরোধী ছিলেন, এবং ৪৪ খৃষ্ট পূর্বাব্দের ১৫ই মার্চ হত্যা করা হয় তাঁকে; তাঁরই বন্ধু ব্রুটাসের নেতৃত্বে সিনেটের বেশ কয়েকজন ষড়যড়যন্ত্রকারী মিলে তাঁকে ছুরিকাঘাতে খুন করেন। বলা হয়ে থাকে মৃত্যুর সময় তিনি আরেকটি কথা উচ্চারণ করেন, এবং এ-কথাটিও ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছে : ‘Et tu, Brute’ (ব্রুটাস তুমিও!)। এই মন্তব্যটিও বিভিন্ন কারণে বিশ্লেষণের দাবি রাখে। ‘Et’ শব্দটি — যার সঙ্গে আগেই পরিচয় ঘটেছে আমাদের — সাধারণত ‘এবং’ / ‘ও’ (and) অর্থে ব্যবহৃত হয়; কিন্তু সেটি ‘-ও’ (too) বা ‘এমনকি’ (even) অর্থেও প্রয়োগ হতে পারে। আর, ‘Brute’ তো বোঝাই যাচ্ছে, যার উদ্দেশে কথাটা বলা হয়েছে তার নাম, নমিনেটিভ কেইস (nominative case) বা কর্তৃকারকে যার রূপ ‘Brutus’। ‘-e’ যুক্ত রূপটির (Brute) নাম ‘vocative’ বা সম্বোধনসূচক কারক; বোঝা-ই যাচ্ছে, যখন কারো উদ্দেশে কথা বলা হয়, বা কারো নাম ডাকা হয় তখন এই রূপটি ব্যবহৃত হয়। লিখিত টেক্সট-এ খুব বেশি ভোকেটিভ বা সম্বোধনসূচক কারক নজরে পড়ে না আমাদের, কিন্তু রোমকরা নিশ্চয়ই তাদের দৈনন্দিন জীবনে তা আকছার-ই ব্যবহার করত যখন কাউকে সম্বোধন করত তারা বা ডাকত তাদের সন্তানদের।

সিযারের মৃত্যুর পর ফের গৃহযুদ্ধ বেধে যায়, পনেরোটা বছর লেগে যায় দীর্ঘ ও বিশৃঙ্খলাপূর্ণ বিপ্লবের যুগটির অবসান ঘটতে। শেষ পর্যন্ত রোমে ফিরে আসে কার্যকর দীর্ঘমেয়াদী নেতৃত্ব। এই দীর্ঘ সময়ের রাজনীতি ও যুদ্ধ-বিগ্রহের বিবরণ পড়ে মনে হতে পারে রোমের আকাশে অন্তহীন, নিদারুণ দুর্ভাগ্য আর দুর্যোগ নেমে এসেছিল; কিন্তু আসলে তা নয়। সমস্যার একটা কারণ ছিল এই যে এই পুরো সময়টা জুড়ে অর্থনীতি ছিল খুবই ভাল অবস্থায় আর অনেকেই সেই সমৃদ্ধির ভাগীদার হতে চাইছিল। বাণিজ্য-ও চলছিল রমরমিয়ে, তার ফলে অনেকেই টাকার কুমীর বনে গিয়েছিল। শিক্ষার হার বেড়ে গিয়েছিল, রোমক সমাজ গ্রীক সংস্কৃতির নানান দিক নিজেদের মধ্যে গ্রহণ করা ছাড়াও নিজেদের মতো করে সেটার বিকাশ ঘটাচ্ছিল।

আর, বিশেষ যে একটি দিকে উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটেছিল তা হলো লিখিত ভাষা। এমনকি তখন পর্যন্ত লাতিন ভাষায় লেখা বই-পত্র ছিল নেহাতই হাতে গোনা। কাতো আর প্লতাস, যাঁদের কথা আমরা উল্লেখ করেছি তাঁরা ছাড়া আরো অল্প কিছু লেখক ছিলেন, বিশেষ করে, তেরেন্স (Terence) নামের আরেক কমেডি লেখকের বেশ কিছু রচনার খোঁজ জানা আছে আমাদের। কিন্তু, যেসব লেখা হারিয়ে গেছে তার সংখ্যা যে খুব বেশি তা কিন্তু নয়, আর যতদূর জানা গেছে, সেগুলো এমন আহামরি গোছের কোনো রচনাও নয়। কিন্তু অন্যদিকে খৃষ্টপূর্ব প্রথম শতকে অসাধারণ উঁচু মানের বেশ কিছু লেখক ছিলেন, এবং তাঁদের অনেক লেখাই সংরক্ষিত আছে আমাদের কাছে। এটাই হছে রোমক সাহিত্যের সোনালী যুগ, যার ব্যাপ্তি ছিল প্রথম খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত। ১০০ খৃষ্টপূর্ব থেকে ১০০ খৃষ্টাব্দ, এই দুই শতাব্দীকে সাধারণত রোমের ধ্রুপদী বা ক্লাসিকাল যুগ বলে মনে করা হয়।

(ক্রমশ)

জি এইচ হাবীব

জন্ম ১০ই মার্চ ১৯৬৭। পেশা: শিক্ষকতা।

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.