লাতিন ভাষার কথা : ৫

|| প্রাচীন রোম থেকে ভেসে আসা স্বর || প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান মূলত লিখিত উৎস নির্ভর। আর একথা বলার আপেক্ষা রাখে না যে, যাঁরা সে-সময়ে জীবিত ছিলেন তাঁরা যা লিখে গেছেন সেটাই সবচাইতে নির্ভরযোগ্য ও সেরা। রোমের ক্ষেত্রে প্রাচীন কালের সে-ধরনের উপাদান খুব বেশি পাওয়া যায়নি। [. . .]

Tore Janson-এর, সুইডিশ ভাষায় রচিত Latin: Kulturen, historien, språket  গ্রন্থের Merethe Damsgård Sørensen ও Nigel Vincet-কৃত ইংরেজি অনুবাদ A Natural History of Latin-এর বাংলা অনুবাদ

 

প্রাচীন রোম থেকে ভেসে আসা স্বর

প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান মূলত লিখিত উৎস নির্ভর। আর একথা বলার আপেক্ষা রাখে না যে, যাঁরা সে-সময়ে জীবিত ছিলেন তাঁরা যা লিখে গেছেন সেটাই সবচাইতে নির্ভরযোগ্য ও সেরা। রোমের ক্ষেত্রে প্রাচীন কালের সে-ধরনের উপাদান খুব বেশি পাওয়া যায়নি। রোমকদের অবশ্যই একটি বর্ণমালা ছিল এবং সেটা তারা অন্তত ৫০০ খৃষ্টপূর্বাব্দ থেকেই খানিকটা ব্যবহার করতে শুরু করেছিল, কিন্তু ২০০ খৃষ্টপূর্বাব্দর আগের লেখা তেমন কিছু পাওয়া যায় না বললেই চলে, এবং যা পাওয়া গেছে তার মধ্যে রয়েছে মূলত সমাধি ফলকে উৎকীর্ণ লিপি ও সেরকম কিছু জিনিস। কিন্তু একেবারে প্রাচীন যুগ সম্পর্কে আমরা যা জানি তা আসলে লিখে গেছেন সেই সব লেখক যাঁরা ধরার বুকে এসেছিলেন আরো অনেক পরে, যীশু খৃষ্টের জন্মের কাছাকাছি সময়ে। তো, সেই প্রাচীনতম সময়ের এতো কম জিনিস-পত্র পাওয়ার কারণ সম্ভবত এই যে, লেখার মতো বা শুরু করার মতো সেরকম উল্লেখযোগ্য কিছু ছিল না আসলে। আর সে-সময়ে রোমকদের লেখালেখির অভ্যাসটাও গড়ে ওঠেনি তেমন একটা। যাঁদেরকে লেখক বলা যেতে পারে তাঁদের দেখা মেলেনি খৃষ্টপূর্ব ৩য় শতকের আগে। কিন্তু তাঁদের লেখার টুকরো টাকরা যা কিছু পাওয়া গেছে তা দেখে বলা যায় তাঁরা লেখক হিসেবে খুব একটা সুবিধের ছিলেন না। লাতিন রচনার কোনো লিখিত আদর্শ পাওয়া যায় না, পাঠশালাগুলোতেও ছিলো না লাতিনে লিখিত কোনো নির্দেশনা।

কাজেই, আদ্দিকালের রোমকরা কি ভাবতো, কেমন ছিল নানান বিষয় সম্পর্কে তাদের আবেগ-অনুভূতি সে সম্পর্কে আসলে আমরা তেমন কিছুই জানি না। তবে, প্রাচীন রোমকরা কেমন ছিল সে-বিষয়ে একজন বিশেষ ব্যক্তির লেখা একটি বইয়ের কথা প্রায়ই বলা হয়, আর তিনি হলেন মারকাস পরকিয়াস কাতো, বা, বড় কাতো। কার্থেজের বিরুদ্ধে যুদ্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি, এবং তিনি যেসমস্ত কারণে বিখ্যাত তার একটি হচ্ছে সিনেটে তাঁর অধিকাংশ বক্তৃতাই তিনি শেষ করতেন এই কথা দিয়ে: ‘Praetérea cénso Cartháginem esse delendam’ (তাছাড়া আমার মত হচ্ছে কার্থেজকে ধ্বংস করা উচিত। ) কাতো মারা যান ১৪৯ খৃষ্ট পূর্বাব্দে, আর যে বইটি তিনি রেখে গেছেন — ‘De Agricultura’ (কৃষিকাজ সম্পর্কে) — তা লাতিন ভাষায় লেখা অত্যন্ত প্রাচীন বইগুলোর একটি। কি করে জলপাইয়ের তেল বানাতে হবে বা মধু দিয়ে কেক তৈরি করতে হবে এই সমস্ত বিষয়ে বিস্তারিত নির্দেশনায় ভরপুর বইটি, আর সেসব নির্দেশনা কখনো কখনো বেজায় টেকনিকাল। অবশ্য কাতো নিজের সম্পর্কে কি ভাবতেন বা জীবন সম্পর্কে তাঁর কি ধারণা ছিল সে-বিষয়েও ধারণা পাওয়া যায় কিছু কিছু অংশে।

বইটির ভূমিকায় তিনি বলছেন, কৃষিকাজ হলো পেশা মহত্তম, এবং প্রাচীন রোমকরা কাউকে সর্বোচ্চ প্রশংসা করতে চাইলে তাকে ‘Bonam agrícolam bonúmque colonum’ বা ‘একজন উত্তম কৃষক ও উত্তম গৃহস্থ’ বলে অভিহিত করতো (কোনো শব্দের শেষে ‘-que’ যোগ করা আর সেটার আগে ‘এবং’ বা ‘ও’ ব্যবহার করা একই কথা)। কিন্তু কাতো যখন নিজের খামারের বর্ণনা দিতে শুরু করেন তখন দেখা যায় যে বীজ বপন, হাল চাষ, এমনকি এসব কাজের তদারকি পর্যন্ত করার লোক অন্য যে-ই হোক তিনি নন। তিনি এমন এক খামারের বর্ণনা দেন যার তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব একজন ওভাসীয়ারের ওপর ন্যস্ত, এবং বেশ কিছু দাস তার অধীনে কাজ করে। একজন রোমকের — ‘ভাল কৃষকের’ — কাজ হচ্ছে মাঝে মধ্যে হাজিরা দেয়া, নানান কাজের হুকুম দেয়া, ওভারসীয়ারকে তলব করে তার কাজ কর্মের হিসাব নেয়া, এবং সবশেষে লাভটা পকেটস্থ করা। এই শেষ কাজটি বড়ই জরুরী কাতো-র জন্য। তিনি নীচ, যদিও হাড়কেপ্পন তাঁকে বলা যাবে না, এবং কৃষিকাজ তাঁর কাছে অর্থোপার্জনের একটি উপায় মাত্র।যাঁরা কাজ করেন, অর্থাত কিনা দাসেরা, তাঁরা স্রেফ উৎপাদন প্রক্রিয়ার স্রেফ একটি অংশ মাত্র। তাঁরা খাবার-দাবার আর পোশাক-পরিচ্ছেদ পান যাতে তাঁরা কাজ করতে পারেন। আর তা যদি তাঁরা না করতে পারেন তাহলে তাঁরা প্রয়োজনের তুলনায় উদবৃত্ত্ব। এক পর্যায়ে তিনি বিক্রয়যোগ্য জিনিসের একটি তালিকা প্রণয়ন করেন : plostrum vetus, ferramenta vétera, servum senum, servum morbosum, et si quid áliud supérsit … একটা পুরানো ওয়াগন, পুরানো নানা হাতিয়ার ও যন্ত্রপাতি, এক বৃদ্ধ দাস, এক জন রুগ্‌ণ দাস, এবং কাজে লাগছে না এমন যে-কোনো কিছু।

কাজেই, ভালো করে খেয়াল করলে আমরা দেখতে পাই যে একজন সত কৃষক সম্পর্কে তাঁর সমস্ত কথাবার্তা মিথ্যে, ভিত্তিহীন। কাতো ছিলেন কৃষিকাজে অর্থলগ্নীকারী একজন ধনী মানুষ, এবং তাঁর কাছে তাঁর কর্মীদের ভালোমন্দের কোনো গুরুত্ব ছিল না। প্রাচীন কালের রোমকরা সবাই কাতোর মতো ছিলেন এমন কথা বলা সঙ্গত হবে না; বাকিদের সম্পর্কে আমরা খুব কম-ই জানি। আবার একথাও সত্য যে কাতো এমন এক সময় জীবন যাপন করে গেছেন যখন নতুন পরিবর্তিত পরিস্থিতির কাছে পুরানো আদর্শগুলো খুব একটা গুরুত্ব পাচ্ছিল না। তবে একথা আমাদের বলতেই হবে যে কাতোর বই পড়ে ক্ষমতাশালী রোমকদের যে ছবি আমরা দেখতে পাই তা মোটেও আকর্ষণীয় কিছু নয়।

যাই হোক, রোমের সংস্কৃতি, সৌভাগ্যক্রমে, কেবল-ই ন্যায়পরায়ণ কিন্তু কঠোর কুলপতিদের নিয়ে গঠিত নয়। ততদিনে সময় হয়ে এসেছিল এক নতুন দিগন্তের দ্বার উন্মোচনের।

(ক্রমশ)

জি এইচ হাবীব

জন্ম ১০ই মার্চ ১৯৬৭। পেশা: শিক্ষকতা।

১ comment

  1. Pingback: লাতিন ভাষার কথা : ৪ | জি এইচ হাবীব

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.