[১. অনুবাদক ও রচয়িতার ভূমিকা, ২. প্রাক্কথন-এর সূচনাংশ, ৩. প্রাক্কথন-এর মধ্যাংশ, ৪. প্রাক্কথন-এর শেষাংশ, ৫. প্রথম অধ্যায়ের সূচনাংশ, ৬. প্রথম অধ্যায়ের শেষাংশ]
২
শি ল্প শা শ্ব ত
মিশর, মেসোপোটেমিয়া, ক্রিট
[সূচনাংশ]
পৃথিবীর সবখানেই কোনো না কোনো ধরনের শিল্পের অস্তিত্ব রয়েছে, কিন্তু শিল্পের কাহিনী একটি নিরবচ্ছিন্ন প্রয়াস হিসেবে দক্ষিণ ফ্রান্সের কিছু গুহায় বা উত্তর আমেরিকার রেড ইন্ডিয়ানদের মাঝে শুরু হয়নি। এমন কোনো প্রত্যক্ষ ঐতিহ্য নেই যা এই বিস্ময়কর প্রারম্ভকে আমাদের যুগের সঙ্গে যুক্ত করেছে, তবে এমন একটি প্রত্যক্ষ ঐতিহ্য রয়েছে যা শিক্ষক থেকে শিক্ষার্থী, শিক্ষার্থী থেকে অনুরাগী বা অনুলিপিকারের কাছে উত্তরাধিকার সূত্রে চলে এসেছে, এবং যা আমাদের নিজেদের কালের শিল্পকে, যে-কোনো বাড়ি বা যে-কোনো পোস্টারকে পাঁচ হাজার বছর পূর্বের নীলনদের উপত্যকার শিল্পের সঙ্গে যুক্ত করেছে। কারণ, আমরা লক্ষ করব, মহান গ্রীক শিল্পীরা পাঠশালায় গিয়েছিলেন মিশরীয়দের সঙ্গে, এবং আমরা সবাই গ্রীকদেরই শিক্ষার্থী। কাজেই, মিশরের শিল্পকলা আমাদের কাছে অসাধারণ গুরুত্ব বহন করে।
সবাই জানে মিশর হচ্ছে পিরামিডের দেশ (চিত্র ৩১), সেই সব পাথুরে পর্বতের দেশ যেসব পর্বত ইতিহাসের সুদূর দিগন্তে ক্ষয়প্রাপ্ত দিকচিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সেগুলোকে যতোই দূরবর্তী আর রহস্যময় বলে মনে হোক না কেন, তারা তাদের নিজেদের গল্পের অনেকটাই বলে দেয় আমাদের। তারা আমাদেরকে এমন এক দেশের কথা বলে যে-দেশ এমন সর্বাত্মকভাবে সুশৃঙ্খল যে একজন মাত্র রাজার জীবদ্দশাতেই পাথরের এসব দৈত্যাকার স্তূপ দাঁড় করিয়ে ফেলা সম্ভবপর ছিল। তারা আমাদের সেই সব রাজার কথা বলে যাঁরা এতোই বিত্তশালী এবং ক্ষমতাধর ছিলেন যে হাজার হাজার শ্রমিক বা দাসকে বাধ্য করতে পারতেন বছরের পর বছর ধরে তাঁদের স্বার্থে খাটতে, পাথর খুঁড়ে তুলতে, সেগুলোকে নির্মাণস্থলে টেনে নিয়ে যেতে এবং আদিমতম যন্ত্রপাতির সাহায্যে সেগুলো স্থানান্তর করতে, যতক্ষণ পর্যন্ত না সমাধিস্থলটি পুরোপুরি প্রস্তুত হয় রাজাকে তার বক্ষে আশ্রয় দেয়ার জন্যে। কোনো নৃপতি বা জাতিই স্রেফ একটা স্মৃতিস্তম্ভ গড়ার জন্যে এতো ব্যয় বা পরিশ্রম করতো না। বস্তুত, আমরা জানি যে রাজা-রাজড়া এবং তাঁদের প্রজাদের চোখে এসব পিরামিডের একটি ব্যবহারিক গুরুত্ব ছিল। রাজকে বিবেচনা করা হতো এক ঐশ্বরিক সত্তা হিসেবে, যে-সত্তা তাদের ওপর প্রভুত্ব করে; এবং এই পৃথিবী থেকে তাঁর বিদায়ের কালে তিনি উঠে যাবেন সুরলোকে, যেখান থেকে তিনি এসেছিলেন। আকাশের দিকে উঠে যাওয়া পিরামিডগুলো সম্ভবত তাঁর এই ঊর্ধ্বগমনে সাহায্য করবে। অন্তত তাঁর পবিত্র দেহকে রক্ষা করবে ক্ষয় থেকে। কারণ মিশরীয়রা বিশ্বাস করত মৃত্যুর পরেও যদি কারো আত্মাকে জীবিত রাখতে হয় তাহলে দেহটিকে সংরক্ষণ করতে হবে। এ-কারণেই মৃতদেহকে ক্ষয় থেকে রক্ষা করত তারা সেটার গায়ে সুগন্ধি ওষুধ লেপন এবং সেটাকে কাপড় দিয়ে আবৃত করার বিশদ একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। রাজার মমির জন্যেই নির্মিত হতো পিরামিড, এবং বিশাল সেই পর্বতের মধ্যেখানে পাথরের একটি শবাধারের মধ্যে রাখা হতো দেহটি। পরলোকের উদ্দেশে তাঁর যাত্রা সুগম করার জন্যে সমাধিগৃহটির চারপাশে সর্বত্র লিখে রাখা হতো নানান জাদুমন্ত্র।
শিল্পের কাহিনীতে প্রাচীন বিশ্বাসগুলো কী ভূমিকা পালন করেছে সেকথা যে শুধু মানব স্থাপত্যের এই প্রাচীন স্মারকগুলোই বলে দেয় তা কিন্তু নয়। মিশরীয়রা বিশ্বাস করত, কেবল দেহের সংরক্ষণই যথেষ্ট নয়। রাজার চেহারাটিও যদি অক্ষুণ্ণ রাখা যায় তাহলে এ-ব্যাপারে দ্বিগুণ নিশ্চিত হওয়া যাবে যে তাঁর অস্তিত্ব চিরকাল বজায় থাকবে। কাজেই ভাস্করদের আদেশ দেয়া হল যেন তাঁরা কঠিন, অবিনশ্বর গ্র্যানিট পাথরের গা ছেনি-বাটালি দিয়ে কুঁদে রাজার মাথাটি খোদাই করে সমাধিস্থলে লোকচক্ষুর অন্তরালে রেখে দেয়, যাতে করে সেটা তার জাদু বিস্তার করতে পারে, এবং এসব প্রতিমূর্তির মধ্যে এবং মাধ্যমে আত্মাকে বাঁচিয়ে রাখতে সাহায্য করে। ভাস্কর কথাটা বোঝাতে মিশরীয় ভাষায় একটি শব্দ রয়েছে যার অর্থ আসলে ‘যিনি-বাঁচিয়ে-রাখেন’।
গোড়ার দিকে এসব আচার-ব্যবস্থা রাজাদের জন্যেই নির্ধারিত ছিল, কিন্তু শিগগিরই রাজমহলের অভিজাত সম্প্রদায়ভুক্ত লোকজন রাজার ঢিবিকে ঘিরে ছোট ছোট কবর চমৎকার করে সার বেঁধে বসাবার ব্যবস্থা করল, এবং ধীরে ধীরে আত্মমর্যাদাসম্পন্ন প্রত্যেক মানুষকেই তার পরকালের প্রস্তুতির ব্যবস্থা করে রাখতে হলো মহার্ঘ একটি সমাধির ফরমাশ দিয়ে, যেখানে তার মমি, তার চেহারা-খোদাই-করা মূর্তি থাকবে, যেখানে তার আত্মা বাস করতে পারবে, সেই সঙ্গে পারবে মৃতকে দেয়া খাবার-দাবার আর নৈবেদ্য গ্রহণ করতে। পিরামিড যুগের, ‘প্রাচীন রাজ্য’-র চতুর্থ রাজবংশের এসব আদি প্রতিকৃতি মিশরীয় শিল্পের সবচেয়ে সুন্দর কাজগুলোর অন্তর্ভুক্ত (চিত্র ৩২)। এগুলোর মধ্যে এমন একটি গাম্ভীর্য আর সারল্য রয়েছে যা সহজে ভোলা যায় না। আমরা লক্ষ করি যে, ভাস্কর তার সমুখে উপবিষ্ট মানুষটির ত্রুটি-বিচ্যুতি উপেক্ষা করতে বা তার জীবনের কোনো ক্ষণস্থায়ী মুহূর্ত ধরে রাখতে চাইছেন না। প্রতিটি ছোটখাট খুঁটিনাটি তিনি এড়িয়ে গেছেন। মানুষের মাথার এসব মৌলিক আকৃতি-প্রকৃতির প্রতি এই কঠোর মনোযোগের কারণেই সম্ভবত এসব প্রতিকৃতি এতো আকর্ষণীয় হয়েছে। কারণ, সেগুলোর প্রায় জ্যামিতিক কঠোরতা সত্ত্বেও প্রথম অধ্যায়ে (চিত্র ২৫, ২৮) উল্লিখিত মুখোশগুলোর মতো আদিম নয় এগুলো। অবশ্য একথাও ঠিক যে, এগুলো নাইজেরিয়ার শিল্পীদের প্রকৃতিবাদী প্রতিকৃতির মতো বাস্তবসদৃশ-ও নয় (চিত্র ২৩)। প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ এবং পুরো বিষয়টির সুষমতার (regularity) মধ্যে এমন যথাযথভাবে ভারসাম্যবিধান করা হয়েছে যে বাস্তবসদৃশ হয়েও বহুপ্রাচীন ও দীর্ঘস্থায়ী হিসেবে তা আমাদের অভিভূত করে।
জ্যামিতিক সুষমতা এং তীক্ষ্ণ প্রকৃতি-পর্যবেক্ষণের এই সংযোগ সমগ্র মিশরীয় শিল্পেরই বৈশিষ্ট্য। সেটা আমরা সবচেয়ে ভালোভাবে লক্ষ করি সমাধিগুলোর দেয়াল যেসব রীলিফ আর চিত্র দিয়ে সজ্জিত করা হয়েছে সেগুলোতে। একথা সত্যি যে, যে-শিল্প সৃষ্টি হয়েছিল আর কারো নয় বরং মৃত মানুষের আত্মার অবলোকনের উদ্দেশ্যে সে-শিল্পের প্রসঙ্গে ‘সজ্জিত’ শব্দটির ব্যবহার হয়ত যথোপযুক্ত নয়। আসলে, কেউ উপভোগ করবে এমন উদ্দেশ্য নিয়ে এসব কাজের সৃষ্টি হয়নি। এগুলোর লক্ষ্য ছিল ‘বাঁচিয়ে রাখা’। করাল, দূরবর্তী অতীতে এরকম একটি প্রথা ছিল যে, কোনো ক্ষমতাধর মানুষ মৃত্যুবরণ করলে তাঁর ভৃত্য এবং দাসদেরকেও কবরে তাঁর সঙ্গী হতে হতো যাতে করে পরলোকে হাজির হতে পারেন তিনি উপযুক্ত একদল অনুচর নিয়ে। তাদেরকে বলি দেয়া হতো; পরবর্তী সময়ে এই ভয়ংকর প্রথাকে হয় খুবই নিষ্ঠুর নয়ত খুবই ব্যয়বহুল বলে গণ্য করা হল, এবং এ-সমস্যার সমাধানকল্পে এগিয়ে এল শিল্প। রক্তমাংসের চাকর-বাকরের বদলে পৃথিবীর মহৎ ব্যক্তিবর্গকে বিকল্প হিসেবে দেয়া হল প্রতিমূর্তি। মিশরীয় সমাধিগুলোতে পাওয়া ছবি এবং মডেলগুলো পরলোকে আত্মাকে সাহায্যসঙ্গী সরবরাহ করার ধারণার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, আর এমন ধারণা অসংখ্য আদিম সংস্কৃতিতেই পাওয়া গেছে।
এসব রীলিফ এবং দেয়ালচিত্র মিশরে হাজার হাজার বছর আগে যাপিত জীবনের অসাধারণ প্রাঞ্জল ছবি তুলে ধরে আমাদের সামনে। কিন্তু তারপরেও, প্রথমবারের মতো সেগুলোর দিকে তাকিয়ে কেউ হয়ত হতবাক বনে যেতে পারেন। তার কারণ, বাস্তবকে ফুটিয়ে তোলার আমাদের পদ্ধতি থেকে মিশরীয় চিত্রকরদের পদ্ধতি একেবারেই অন্যরকম। সম্ভবত, তাঁদের ছবিগুলোকে যেসব বিভিন্ন উদ্দেশ্য পূরণের কাজে লাগানো হতো তার সঙ্গে বিষয়টি জড়িত। সৌন্দর্য নয়, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল সম্পূর্ণতা। শিল্পীর কাজ ছিল সবকিছুকে যদ্দূর সম্ভব পরিষ্কার আর চিরন্তনভাবে সংরক্ষণ করা। কাজেই, প্রকৃতিকে কোনো সুবিধেজনক দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁদের কাছে যেরকম দেখাচ্ছে সেভাবেই সেটাকে আঁকতে বসে যেতেন না তাঁরা। আঁকতেন তাঁরা স্মৃতি থেকে, কঠিন কিছু নিয়ম মেনে, যেসব নিয়ম এই বিষয়টি নিশ্চিত করত যে ছবিতে যা কিছু থাকবে তার সব কিছুকেই ফুটিয়ে তুলতে হবে নিখুঁত স্পষ্টতার সঙ্গে। সত্যি বলতে কী, তাঁদের পদ্ধতি মানচিত্র-আঁকিয়েদের পদ্ধতির অনুরূপ, চিত্রকরদের পদ্ধতির নয়। আর সেটাই দেখা যাচ্ছে চিত্র ৩৩-এ, পুকুরসহ একটি বাগানের মামুলি একটা উদাহরণের মাধ্যমে। এরকম একটি মোটিফ যদি আমাদের আঁকতে হতো তাহলে আমরা চিন্তা করতাম কোন দৃষ্টিকোণ থেকে সেটাকে ধরা যায়। গাছগুলোর আকার-আকৃতি ও বৈশিষ্ট্য কেবল পাশ থেকেই পরিষ্কার করে দেখা যেতে পারে, আর পুকুরটির আকার-প্রকার দেখা সম্ভব শুধু ওপর থেকে দেখলে। এই সমস্যার ব্যাপারে কোনো বিবেক-যন্ত্রণা ছিল না মিশরীয়দের। পুকুরটাকে আঁকবে তাঁরা এমনভাবে যেন ওপর থেকে দেখা হয়েছে সেটা, আর গাছগুলোকে পাশ থেকে। অন্যদিকে, ওপর থেকে দেখলে পুকুরের মাছ আর পাখিগুলোকে প্রায় চেনাই যাবেই না, কাজেই সেগুলোকে আঁকা হয়েছে পাশ থেকে।
জন্ম ১০ই মার্চ ১৯৬৭। পেশা: শিক্ষকতা।