[১. অনুবাদক ও রচয়িতার ভূমিকা, ২. প্রাক্কথন-এর সূচনাংশ, ৩. প্রাক্কথন-এর মধ্যাংশ, ৪. প্রাক্কথন-এর শেষাংশ]
১
প্রা র ম্ভ বি স্ম য় ক র
প্রাগৈতিহাসিক এবং আদিম জনগোষ্ঠী সমূহ; প্রাচীন আমেরিকা
[সূচনাংশ]
ভাষার সূত্রপাত কীভাবে সে-সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান যতটুকু তার চেয়ে শিল্পের শুরু কীভাবে সে-বিষয়ে আমাদের জ্ঞান বেশি নয়। শিল্প বলতে আমরা যদি মন্দির এবং বাড়িঘর নির্মাণ, ছবি এবং মূর্তি তৈরি বা নকশা আঁকার মতো কর্মকাণ্ডকে বুঝি তাহলে সারা দুনিয়ায় এমন কোনো জনগোষ্ঠী পাওয়া যাবে না যাদের মাঝে শিল্পকর্ম অনুপস্থিত ছিল। আবার অন্যদিকে, শিল্প বলতে আমরা যদি এক ধরনের চমৎকার বিলাসকে বুঝিয়ে থাকি, এমন কিছু যা জাদুঘরে বা প্রদর্শনীতে গিয়ে উপভোগ করা যায়, বা বিশেষ কিছু যা সেরা কোনো বৈঠকখানায় দামী কোনো সজ্জা হিসেবে ব্যবহার করা যায়, তাহলে একথা আমাদের অবশ্যই উপলব্ধি করতে হবে যে শব্দটির এই প্রয়োগ খুবই সাম্প্র্রতিক একটি ঘটনা, এবং মহত্তম নির্মাতা, চিত্রকর বা ভাস্করদের অনেকেই কখনো স্বপ্নেও একথা ভাবেননি। স্থাপত্যকলার কথা চিন্তা করলেই পার্থক্যটি সবচেয়ে ভালো করে বুঝতে পারি আমরা। একথা আমরা সবাই জানি যে, জগতে চমৎকার সব দালান-কোঠা রয়েছে, আর সেগুলোর কিছু কিছু সত্যিকারের শিল্পকর্মই বটে। কিন্তু, বিশেষ কোনো উদ্দেশ্যে নির্মিত হয়নি এমন ভবন জগতে নেই বললেই চলে। এসব ভবন যাঁরা পুজো বা বিনোদন বা বসবাসের স্থান হিসেবে ব্যবহার করেন, তাঁরা সেগুলোকে প্রথমত উপযোগিতার মানদণ্ডেই বিচার করেন। কিন্তু সেকথা বিবেচনায় না এনেও বলা যায়, তাঁরা হয়তো ভবনটির নকশা বা কাঠামোর অনুপাতটি পছন্দ করেন বা করেন না, এবং সেটাকে কেবল ব্যবহারিকই নয় বরং ‘সঠিক’ হিসেবে তৈরি করার ক্ষেত্রে দক্ষ স্থপতিটির প্রচেষ্টার তারিফ করেন। অতীতকালে চিত্রকর্ম এবং মূর্তিকে প্রায় একই রকম দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা হতো। সেগুলোকে নিছক শিল্পকর্ম হিসেবে দেখা হতো না, বরং দেখা হতো এমন বস্তু হিসেবে যার নির্দিষ্ট কোনো কাজ রয়েছে। বাড়ি-ঘরগুলো কী উদ্দেশ্যে নির্মিত হয়েছে সেকথা কারো জানা না থাকলে তাকে সে-সবের খুব একজন ভালো বিচারক হিসেবে গণ্য করা হতো না। ঠিক একইভাবে, অতীতের শিল্প কোন উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে সৃষ্টি করা হয়েছিল সে-সম্পর্কে একেবারে অজ্ঞ থাকলে হয়তো সে-শিল্প বুঝে ওঠা আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে না। ইতিহাসের পথ ধরে আমরা যতোই পিছিয়ে যাবো, দেখব যে, শিল্পটি কোন উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে সৃষ্টি হয়েছিল তা ততোই নির্দিষ্ট কিন্তু সেই সঙ্গে ততোই অদ্ভুত। একই কথা প্রযোজ্য, যদি আমরা শহর-নগর ছেড়ে কৃষকদের সান্নিধ্যে চলে যাই, বা আরো ভালো হয় যদি আমরা আমাদের সভ্য দেশ ত্যাগ করে সেই সব মানুষজনের কাছে চলে যাই যাদের জীবনযাপনের ধরন এখনো সে-রকম যে-রকম পরিস্থিতিতে আমাদের দূরবর্তী পূর্বপুরুষরা জীবনধারণ করতেন। এই মানুষগুলোকে আমরা ‘আদিম’ বলে অভিহিত করি, তবে তা এজন্যে নয় যে তাঁরা আমাদের চেয়ে সরল ছিলেন — তাঁদের চিন্তা-ভাবনার পদ্ধতি ছিল প্রায়শই আমাদের পদ্ধতিগুলোর চেয়ে বেশি জটিল — বরং এই জন্যে যে মানবজাতি একসময় যে-অবস্থা থেকে উদ্ভূত হয়েছিল তাঁরা সেই অবস্থার অধিকতর নিকটবর্তী। উপযোগিতার বিচারে এই আদিম মানুষদের কাছে ভবন-নির্মাণ এবং প্রতিচ্ছবি-তৈরির মধ্যে কোনো ফারাক নেই। তাদের কুঁড়েঘর তাদেরকে রোদ-বৃষ্টি, বায়ু-বাত্যা, আর যেসব সত্তা সে-সব সৃষ্টি তৈরি করে তার হাত থেকে রক্ষা করে; প্রতিচ্ছবি তৈরি করা হয় যাতে করে সেগুলো তাদেরকে অন্যসব শক্তির হাত থেকে বাঁচায় যেগুলো তাদের কাছে প্রাকৃতিক শক্তির মতোই বাস্তব। অন্য কথায় বলতে গেলে, ছবি আর মূর্তি ব্যবহৃত হয়েছে জাদুক্রিয়া ঘটানোর উদ্দেশ্যে।
যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা আদিম মানবদের মনের ভেতরে প্রবেশের এবং একথা অনুধাবনের চেষ্টা না করছি যে কোন ধরনের অভিজ্ঞতা তাদেরকে দেখতে-সুন্দর-নয় কিন্তু ব্যবহারের দিক দিয়ে শক্তিশালী এমন সব ছবির কথা ভাবতে বাধ্য করেছে, ততক্ষণ পর্যন্ত শিল্পের এই বিস্ময়কর প্রারম্ভের বিষয়টি বুঝে উঠবার আশা আমরা করতে পারি না। আমি মনে করি না এই অনুভূতিটি পুনরুদ্ধার করা সত্যিই খুব দুরূহ। যা দরকার তা হলো নিজেদের প্রতি পুরোপুরি সৎ থাকার ইচ্ছা এবং এটা দেখা যে আমরা নিজেরাও যেন আমাদের মধ্যে ‘আদিমতার’ খানিকটা ধরে না রাখি। ‘বরফ যুগ’-এর বদলে আমাদের নিজেদের দিয়েই শুরু করা যাক। ধরা যাক, আজকের খবরের কাগজ থেকে আমাদের প্রিয় ক্রিকেট খেলোয়াড় বা চিত্রতারকার একটি ছবি নেয়া হলো — তো এখন, আমরা কি একটা সুচ নিয়ে সেটার চোখ খুঁচিয়ে তুলে আনন্দ পাবো? সেটা নিয়ে কি আমরা সেরকম নির্লিপ্ত থাকতে পারবো যেন আমরা কাগজের অন্য যে-কোনো স্থানে একটা ফুটো করেছি? আমি তা মনে করি না। আমার জাগ্রত বিচারবুদ্ধি আমাকে যতোই বলুক না কেন যে এই ছবি নিয়ে আমি যা-ই করি না কেন তাতে আমার বন্ধু বা নায়কের কিছুই আসবে যাবে না, তারপরেও ছবিটির ক্ষতি করার ব্যাপারে একটি অস্পষ্ট অনিচ্ছা আমার মধ্যে কাজ করে। কোথাও একটা এই উদ্ভট বোধটি কাজ করে যে, ছবিটির সঙ্গে যে-আচরণ করা হবে ছবিটি যার প্রতিনিধিত্ব করছে তার প্রতিও ঠিক সেটাই করা হবে। তো, আমার এ-কথাটি যদি সত্য হয়, এই বিচিত্র এবং অযৌক্তিক ধারণাটি যদি সত্যিই এখনো টিকে থাকে, এমনকী আমাদের মধ্যে, এই পারমাণবিক শক্তির যুগেও, তাহলে তথাকথিত আদিম জাতিগুলোর মধ্যে প্রায় সবখানেই যে এরকম ধারণা প্রচলিত ছিল তাতে সম্ভবত অতো অবাক হওয়ার কিছু নেই। পৃথিবীর সব জায়গাতেই ওঝা-বৈদ্য বা ডাইনীরা কোনো না কোনোভাবে জাদুটোনা করতে চেয়েছে — কোনো শত্রুর ছোট ছোট প্রতিমূর্তি তৈরি করে তারা বেচারী পুতুলটার হৃৎপিণ্ড ফুটো করে দিয়েছে বা সেটাকে পুড়িয়ে ভস্ম করে ফেলেছে, তারপর আশা করেছে তাদের শত্রুও একইভাবে যন্ত্রণাভোগ করবে। এমনকী, ব্রিটেনে গাই ফক্স ডে-তে ((ইংল্যান্ডের রোমান ক্যাথলিকদের ওপর অত্যাচারের প্রতিশোধ নেবার জন্যে রাজা প্রথম জেমসকে হত্যা এবং সংসদ ভবন উড়িয়ে দেবার ব্যর্থ ষড়যন্ত্রের অপরাধে ইংরেজ গাই ফক্স-এর প্রাণদণ্ড কার্যকর করা হয় ১৬০৫ খ্রিস্টাব্দের ৫ই নভেম্বর। প্রতিবছর গ্রেট ব্রিটেনে দিবসটিকে মহা ধুমধামের সঙ্গে উদযাপন করা হয় — অনুবাদক)) আমরা যে লোকটাকে পুড়িয়ে মারি সেটাও এরকমই একটি কুসংস্কারের অবশিষ্টাংশ। কোনটি বাস্তব আর কোনটি ছবি সে-ব্যাপারে আদিম মানুষেরা মাঝে মাঝে আরো বেশি অনিশ্চিত। একবার, আফ্রিকার একটি গাঁয়ে এক ইউরোপীয় চিত্রকর গরুর পালের ছবি আঁকাতে সে-গাঁয়ের অধিবাসীরা বড়োই মুষড়ে পড়ল : ‘তুমি গরুগুলো সঙ্গে করে নিয়ে গেলে আমরা বাঁচব কী করে?’
এসব অদ্ভুত চিন্তাধারা কিন্তু হেলাফেলার নয়, কারণ প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম বেয়ে আমাদের হাতে আসা প্রাচীনতম চিত্রগুলোকে বুঝতে এরা হয়তো সাহায্য করতে পারে আমাদের। এই চিত্রগুলো যে-কোনো মানব দক্ষতার সমান বয়েসী। কিন্তু তারপরেও, ঊনবিংশ শতাব্দীতে স্পেন (চিত্র ১৯) এবং ফ্রান্সের (চিত্র ২০) গুহায় ও দেয়ালে যখন সেগুলো আবিষ্কৃত হলো তখন জীবজন্তুর এসব সুস্পষ্ট আর জীবন্ত চিত্র যে বরফ যুগের লোকজন আঁকতে পারে সেকথা পুরাতত্ত্ববিদরা প্রথমে মানতে চাইলেন না। তবে ধীরে ধীরে, এসব অঞ্চলে আবিষ্কৃত পাথর আর হাড়ের তৈরি আদিম কিছু হাতিয়ার দেখে ক্রমেই আরো নিশ্চিতভাবে বোঝা গেল যে বাইসন, ম্যামথ বা বল্গা হরিণের এসব ছবি সত্যি সত্যিই সেই সব মানুষের আঁকা বা আঁচড়ে ফুটিয়ে তোলা যারা এসব প্রাণী শিকার করত এবং কাজেই সেগুলোকে খুব ভালো করে চিনত। এসব গুহার ভেতর, মাঝে মাঝে নিচু সরু অলিন্দ ধরে, পাহাড়ের অন্ধকারের গহিন অভ্যন্তর পর্যন্ত নেমে যাওয়া এবং হঠাৎ করে পথপ্রদর্শকের বৈদ্যুতিক মশালের আলোয় একটি বৃষের ছবি উদ্ভাসিত হতে দেখা এক বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা। একটা বিষয় খুব স্পষ্ট, ধূলি ধরার এই ভূতুড়ে অভ্যন্তরের এতো গহিনের এমন একটি অগম্য স্থানকে শুধুমাত্র অলংকৃত করার উদ্দেশ্যে কেউই সেখানে হামাগুড়ি দিয়ে ঢোকেনি। তাছাড়া, এসব ছবির খুব কমই গুহার ছাদে বা দেয়ালে সুস্পষ্টভাবে বিন্যস্ত রয়েছে, কেবল লাস্কো (Lascaux) গুহার কিছু ছবি ছাড়া (চিত্র ২১)। বরং, আপাত কোনো শৃঙ্খলা ছাড়াই সেগুলোর একটির ওপর অন্যটি আঁকা হয়েছে বা খোদিত হয়েছে। এসব আবিষ্কার সম্পর্কে সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যা এখন অব্দি এই যে, এগুলো হচ্ছে চিত্রকর্ম সৃষ্টির সেই সর্বজনীন বিশ্বাসের প্রাচীনতম স্মারক; অন্য কথায় বলতে গেলে এসব আদিম শিকারী ভাবত তারা যদি তাদের শিকারের স্রেফ একটি ছবি আঁকতে পারে এবং তাদের বল্লম বা কুড়াল দিয়ে সর্বশক্তিতে সেগুলোর গায়ে আঘাত হানতে পারে তাহলে সত্যিকারের জন্তুগুলোও তাদের শক্তির কাছে পরাভব মানবে।
কথাটা অবশ্যই অনুমান নির্ভর। তবে আমাদের সময়কার আদিম জনগোষ্ঠী যারা এখনো তাদের প্রথাগুলো বাঁচিয়ে রেখেছে তাদের মাঝে শিল্পকলার ব্যবহার এই অনুমানকে যথেষ্ট সমর্থন জোগায়। একথা সত্যি যে, আমি যতটুকু জানি, ঠিক এই ধরনের জাদু ব্যবহার করে এমন কাউকে আমরা দেখতে পাই না। কিন্তু তাদের কাছে বেশিরভাগ শিল্পই প্রতিচ্ছবির ক্ষমতা সম্পর্কে একই রকম ধারণার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। এখনো এমন সব আদিম জনগোষ্ঠী রয়েছে যারা পাথরের হাতিয়ার ছাড়া অন্য কোনো হাতিয়ার ব্যবহার করে না, এবং তারা জাদুকরী উদ্দেশ্যেই পাথরের গায়ে আঁচড় কেটে জীবজন্তুর ছবি আঁকে। এছাড়াও, কিছু উপজাতি রয়েছে যারা নিয়মিতই কিছু উৎসবের আয়োজন করে, আর এসব উৎসব চলাকালীন তারা জীবজন্তু সেজে এবং গুরুগম্ভীর নৃত্যের মাধ্যমে সে-সব জন্তু-জানোয়ারের অঙ্গ-ভঙ্গির অনুকরণ করে। তারা এও বিশ্বাস করে যে এতে করে তারা তাদের শিকারের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারবে। কখনো-সখনো তারা এমনকী একথাও বিশ্বাস করে যে, বিশেষ কিছু জন্তু রূপকথায় যেমন থাকে তেমনভাবে তাদের সঙ্গে সম্পর্কিত, এবং পুরো উপজাতিটি একটি নেকড়ে উপজাতি, দাঁড়কাক উপজাতি বা ব্যাঙ উপজাতি। কথাটা বেশ আশ্চর্যজনক বলে মনে হতে পারে, কিন্তু আমাদের ভুললে চলবে না যে এমনকী এই ধারণাগুলোও আমাদের নিজেদের সময় থেকে ততটা দূরবর্তী নয় যতটা দূরে বলে আমরা মনে করে থাকি। রোমানরা বিশ্বাস করত রোমুলাস ও রিমাসকে একটি স্ত্রী-নেকড়ে স্তন্যদান করেছিল এবং রোমের পবিত্র ক্যাপিটল-এ সেই স্ত্রী নেকড়ের একটি ব্রঞ্জের মূর্তিও ছিল তাদের। এমনকী আজো, ক্যাপিটলের সিঁড়ির ধারে ইটের খাঁচার মধ্যে একটি জলজ্যান্ত স্ত্রী নেকড়ে রেখে দিয়েছে তারা। ট্র্যাফালগার স্কোয়্যারে যদিও জলজ্যান্ত কোনো সিংহ নেই, কিন্তু রাজনৈতিক ব্যঙ্গচিত্রে ব্রিটিশ সিংহ এখনো প্রবলভাবে বেঁচে রয়েছে। অবশ্য, এ-ধরনের কুলচিহ্ন সম্বন্ধীয় বা ব্যাঙ্গাত্মক প্রতীকময়তা আর আদিবাসী লোকজন টোটেমের — অর্থাৎ তাদের ভাষায়, তাদের প্রাণিকুলীয় স্বজনদের — সঙ্গে নিজেদের সম্পর্ককে যে গভীর ঐকান্তিকতার সঙ্গে দেখে তার মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে। কারণ, মনে হয়, তারা যেন এক ধরনের স্বপ্নরাজ্যের মধ্যে বাস করে যেখানে তারা একই সঙ্গে মানুষ আর জন্তু দুই-ই হতে পারে। অনেক উপজাতিরই বিশেষ কিছু উৎসব আছে যখন তারা এসব জীবজন্তুর বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত মুখোশ পরে, এবং যখন তারা সেসব পরে তখন তাদের মনে হয় তাদের রূপান্তর ঘটেছে, তারা দাঁড়কাক বা ভালুক হয়ে গেছে। শিশুরা যেমন জলদস্যু বা গোয়েন্দা গোয়েন্দা খেলতে খেলতে বুঝতে পারে না কোথায় এই অভিনয়ের শেষ আর বাস্তবতার শুরু, এই ব্যাপারটিও অনেকটা সে-রকম। কিন্তু শিশুদের বেলাতে তাদের চারপাশে বড়দের একটা জগৎ সবসময়ই থাকে, থাকে সেই সব লোকজন যারা তাদেরকে বলে ‘এতো হল্লা কোরো না’, বা ‘এবার শোয়ার সময় হলো’। কিন্তু আদিম মানবদের ক্ষেত্রে তাদের এই বিভ্রান্তি নষ্ট করে দেবার মতো অন্য কোনো জগৎ থাকে না, কারণ সেই উপজাতির সকল সদস্যই ভান করার তাদের সেই দুর্দান্ত খেলাধুলোসহ সেইসব পরবের নাচ আর আচার অনুষ্ঠানে অংশ নেয়; সেগুলোর গুরুত্ব সম্পর্কে তারা আগেই ওয়াকিবহাল হয়েছে তাদের পূর্বসূরীদের কাছ থেকে এবং এর ভেতর তারা এতোটাই মগ্ন হয়ে রয়েছে যে তার বাইরে পা দেয়া এবং নিজেদের আচার-ব্যবহার সমালোচকের চোখে দেখার সম্ভাবনা তাদের নেই বললেই চলে। ‘আদিম মানুষেরা’ তাদের বিশ্বাসগুলোকে যেমন স্বতঃসিদ্ধ বলে ধরে নেয়, আমরাও আমাদের বিশ্বাসগুলোর বেলাতে তাই করি এবং সাধারণত তা এতোটাই যে আমরা এমনকী সেগুলোর ব্যাপারে সচেতনও থাকি না, যতক্ষণ পর্যন্ত না এমন কিছু মানুষের সঙ্গে আমাদের সাক্ষাৎ ঘটে যারা সে-সবের ব্যাপারে প্রশ্ন তুলে বসে।
মনে হতে পারে, শিল্পের সঙ্গে এসবের সম্পর্ক সামান্যই, কিন্তু আসলে এ-ধরনের অবস্থা নানান উপায়ে শিল্পকে প্রভাবিত করে। অনেক শিল্পীর কাজ তৈরিই হয়েছে এসব অদ্ভুত প্রথাতে একটা ভূমিকা রাখার উদ্দেশ্য নিয়ে, এবং সেক্ষেত্রে এটা দেখার কোনো বিষয়ই নয় যে ভাস্কর্যটি বা চিত্রকর্মটি আমাদের মাপকাঠিতে সুন্দর হলো কিনা, বরং সেটা ‘কাজ করে’ কিনা, অর্থাৎ সেটার জন্যে নির্ধারিত জাদু সেটা দেখাতে পারে কিনা সেটাই বিবেচ্য। তাছাড়া, শিল্পীরা তাঁদের নিজেদের উপজাতির জন্যে শিল্প সৃষ্টি করেন, যে-উপজাতির সদস্যরা ঠিকই জানে প্রতিটি ফর্ম বা প্রতিটি রঙ ঠিক কী গুরুত্ব বহন করে। কেউই আশা করে না যে এসব তাঁরা বদলে দেবেন, বরং এটাই আশা করা হয় যে তাঁরা কেবল তাদের সমস্ত দক্ষতা এবং জ্ঞান তাদের কার্যসিদ্ধিতে ব্যবহার করবেন।
এবারেও, একই ধরনের ব্যাপার খুঁজে পেতে খুব বেশি দূরে যেতে হবে না আমাদের। জাতীয় পতাকার ক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয়টি এটা নয় যে সেটাকে সুন্দরভাবে রঙ করা এমন একটি কাপড়ের টুকরো হতে হবে যেটাকে যে-কোনো নির্মাতাই তার খেয়ালখুশিমতো বদলে নিতে পারে; একটি বিয়ের আংটির ক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয়টি এটা নয় যে সেটাকে এমন একটি অলংকার হতে হবে যেটাকে আমাদের ইচ্ছেমতো পরা বা বদলানো যাবে। কিন্তু তারপরেও, আমাদের জীবনের নির্দিষ্ট আচার-আচরণ ও রীতি-নীতির ভেতরেও রুচি ও দক্ষতা সংক্রান্ত পছন্দ ও সুযোগের অবকাশ রয়েছে। একটা ক্রিসমাস ট্রি-র কথাই ভাবা যাক। সেটার প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো প্রথানির্দিষ্ট হয়েই আছে। সত্যি বলতে কী, প্রতিটি পরিবারেই সেটার নিজস্ব কিছু ঐতিহ্য এবং নিজস্ব কিছু পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপার রয়েছে যেগুলো ছাড়া গাছটাকে ঠিক মানানসই হয়েছে বলে পরিবারের সদস্যদের মনে হয় না। কিন্তু তারপরেও, গাছটি সাজাবার সেই মাহেন্দ্রক্ষণটি যখন এসে পড়ে তখন অনেক কিছুর ব্যাপারেই অনেক কিছু করা বা সিদ্ধান্ত নেবার বিষয় এসে পড়ে। এই ডালটাতে কি একটা মোমবাতি বসবে? চুড়োয় যথেষ্ট টিনসেল রয়েছে তো? এই তারকাটা কি খুব ভারি বলে মনে হচ্ছে না, বা এই দিকটা কি বেশি তারকা ভারাক্রান্ত হয়ে গেল না? বাইরের কোনো লোকের কাছে পুরো ব্যাপারটাই খানিকটা অদ্ভুত বলে বোধ হবে। তিনি হয়তো ভাবতে পারেন, টিনসেল ছাড়াই তো গাছটাকে বেশি ভাল লাগে। কিন্তু আমাদের কাছে, যারা এসবের গুরুত্ব জানি, তাদের কাছে আমাদের নিজস্ব ধ্যান-ধারণা, চিন্তা ভাবনার সাহায্যে গাছটাকে সাজানোটা একটা মহা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে ওঠে।
আদিম যুগের শিল্প ঠিক এ-ধরনেরই পূর্ব-নির্ধারিত রীতি অনুযায়ী কাজ করে, কিন্তু তারপরেও শিল্পীকে তার নৈপুণ্য প্রদর্শনের যথেষ্ট ফুরসত দেয়। কিছু কিছু আদিবাসী কারিগরের কলাকৌশলগত নৈপুণ্য সত্যিই বিস্ময়কর। আদিম শিল্পকলা সম্পর্কে আলোচনার সময় একথা ভোলা আমাদের কখনোই উচিত হবে না যে আদিম কথাটি দিয়ে একথাটি বোঝায় না যে শিল্পীদের তাঁদের কারুশিল্প সম্পর্কে শুধুমাত্র প্রাথমিক বা আদিম কিছু ধারণা ছিল। বরং তার উল্টো। স্বদেশী অনেক উপজাতিই খোদাই কাজে, ঝুড়ি তৈরিতে, চামড়া প্রক্রিয়াজাত করায় কিংবা এমনকী ধাতুর কাজে আশ্চর্যরকমের দক্ষতা অর্জন করেছে। আমরা যখন উপলব্ধি করি কতো মামুলি যন্ত্রপাতির সাহায্যে এসব কাজ করা হয়েছে তখন শতাব্দী পরম্পরা ধরে চর্চার ফলে আদিম শিল্পীরা যে ধৈর্য এবং নিশ্চিত কর্মদক্ষতা অর্জন করেছে তা দেখে অবাক মানা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, নিউজিল্যান্ডের মাওরিরা কাঠ খোদাই-এ (চিত্র ২২) রীতিমত বিস্ময় সৃষ্টিকারী ক্ষমতা অর্জন করেছে। অবশ্য, কোনো জিনিস তৈরি করা কঠিন হলেই যে সেটা একটি শিল্পকর্ম বলে বিবেচিত হবে এমন কোনো কথা নেই। তাই যদি হতো তাহলে কাচের বোতলে যারা সমুদ্রগামী জাহাজের মডেল তৈরি করে তাদেরকেই মানা হতো মহত্তম শিল্পী বলে। কিন্তু স্বদেশী দক্ষতার এই প্রমাণটি যেন আমাদেরকে প্রচলিত এই বিশ্বাসের বিষয়েও সতর্ক করে দেয় যে তাদের কাজগুলো অদ্ভুত কারণ তারা এর চেয়ে ভালো কিছু করতে পারে না। তাদের চারুকুশলতার মান যে আমাদের থেকে আলাদা তা কিন্তু নয়, বরং তাদের ধ্যান-ধারণা আমাদেরগুলোর চেয়ে আলাদা। কারণ শিল্পের পুরো গল্পটি কলাকৌশলগত দক্ষতার ক্রমন্নোতির কোনো গল্প নয়, বরং তা ক্রমপরিবর্তমান ধ্যান-ধারণা এবং প্রয়োজনের একটি গল্প। ক্রমেই আরো বেশি করে প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে যে বিশেষ কিছু পরিস্থিতিতে উপজাতীয় শিল্পী এমন শিল্পকর্ম সৃষ্টিতে সক্ষম যা প্রকৃতির প্রতিরূপ সৃষ্টিতে পশ্চিমা যে কোনো বড় শিল্পীর সবচেয়ে নিপুণ কাজের সমকক্ষ। কয়েক দশক আগে নাইজেরিয়াতে ব্রঞ্জ-এর তৈরি এমন কিছু মাথা পাওয়া গেছে যেগুলো নিগ্রোদের প্রতিরূপের এ-পর্যন্ত পাওয়া সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য নিদর্শন (চিত্র ২৩)। দেখে মনে হয় সেগুলো বহু শতাব্দী পুরনো, এবং এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি যে স্বদেশী শিল্পীরা বাইরের কারো কাছ থেকে তাঁদের দক্ষতা অর্জন করেছিলেন।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
৪ comments
Pingback: মুক্তাঙ্গন | ই. এইচ. গম্ব্রিখ্-এর শিল্পকথা : ৬ | জি এইচ হাবীব
Pingback: মুক্তাঙ্গন | ই. এইচ. গম্ব্রিখ্-এর শিল্পকথা : ৭ | জি এইচ হাবীব
ইমতিয়ার - ১২ মার্চ ২০১১ (৫:১৯ অপরাহ্ণ)
শিল্পের শুরু নিয়ে আমাদের জ্ঞান কি কেবল ভাষার সূত্রপাতের তুলনাতেই অপ্রতুল? পৃথিবীর সৃষ্টি সম্পর্কে আমরা যতটুকু চিন্তা করেছি, হরফের উদ্ভব সম্পর্কে আমাদের ধারণা যতটুকু এগিয়েছে, শিল্পের উৎস নিয়ে আমরা সেসবের তুলনায়ও কিছুই এগুইনি। সব মিলিয়ে আদিম শিল্প নিয়ে আমরা যা চিন্তা করি, তাতেও দেখা যায় তাদের শিল্পসত্বাকে খাটো করে দেখার প্রবণতা। আধুনিক বিশ্বে আমাদের জীবনযাপন থেকে শিল্প এত বেশি করে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে যে আদিম অনেক শিল্পকেই আমরা আর শিল্পের দৃষ্টিতে দেখতে রাজি হই না। কেননা আমরা সরলভাবে ধরে নেই যে, এগুলি তাদের জীবনযাপনের অঙ্গ ছিল, ভয়তাড়ানিয়া অথবা শিকার-আকাঙ্ক্ষার মন্ত্র ছিল; কিন্তু যে-অনুভূতি তাদের এমন আধুনিক রেখার জনক করে তুলেছে সেই অনুভূতি আসলে আমরা কখনোই অনুভব করতে পারব না।
আবদেল মাননান - ১২ মার্চ ২০১১ (৮:৪৮ অপরাহ্ণ)
খুব ভালো লাগলো। এখনো কেউ কেউ না মরে আবারও ঈশ্বরের হাসি হাসে…
হাহ হাহ হা…