Tore Janson-এর সুইডিশ ভাষায় রচিত Latin: Kulturen, historien, språket গ্রন্থের Merethe Damsgård Sørensen ও Nigel Vincet-কৃত ইংরেজি অনুবাদ A Natural History of Latin-এর বাংলা ভাষান্তর
রেনেসাঁ
প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে ইউরোপের ইতিহাসকে সাধারণত তিনটে কালপর্বের পরম্পরা হিসেবে দেখা হয়: প্রাচীন যুগ, মধ্যযুগ, আর আধুনিক যুগ। রেনেসাঁ নামে অভিহিত একটি বিষয় দিয়ে আধুনিক যুগের সূচনা হয়। একথার সুস্পষ্ট মর্মার্থ হচ্ছে প্রাচীন যুগ ছিল উন্নত সভ্যতার একটি সময়, যেখানে মধ্যযুগ ছিল পতনের বা অবক্ষয়ের একটি কাল যার পরিসমাপ্তি ঘটে শেষ অব্দি রেনেসাঁ অর্থাৎ ধ্রুপদী সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের পুনর্জন্মের মাধ্যমে। এতে অবাক হবার কিছু নেই যে এই ধারণাটি আবিষ্কার এবং সেটার প্রসার ঘটিয়েছিলেন রেনেসাঁ আন্দোলনের পুরোধা প্রতিনিধিবৃন্দ, যাঁরা ছিলেন চতুর্দশ, পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতকের ইতালীয় লেখক শিল্পী এবং অন্যান্য বুদ্ধিজীবী। অবশ্যই, এই কালপর্বে ইতালির সংস্কৃতির পরিমণ্ডলে যে অসাধারণ সব সাফল্য অর্জিত হয়েছিল তাতে কোনো সন্দেহ নাই: সাহিত্যাঙ্গনে পেত্রার্ক ও বোক্কাচিও, এবং চিত্রকলার ক্ষেত্রে লিওনার্দো দা ভিঞ্চি ও রাফায়েলের নাম উল্লেখ-ই বোধ হয় যথেষ্ট হবে। এই মানুষগুলো ধ্রুপদী প্রাচীনযুগ সম্পর্কে তাঁদের উল্লেখযোগ্য প্রবল আগ্রহের কারণেই এতো বিখ্যাত বা অসাধারণ বা মহৎ হয়ে উঠেছিলেন কিনা সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। এবং সে-প্রশ্নটা আমরা এখানে অনায়াসে একপাশে সরিয়ে রাখতে পারি।
এ-সময়ে লাতিন কতটা ব্যবহৃত হয়েছিল সে-প্রসঙ্গে এ-কথা বলতে হয় যে রেনেসাঁ এক্ষেত্রে কোনো বাঁক ফেরানো মুহূর্তের সৃষ্টি করেনি। আমরা দেখেছি, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ত্রয়োদশ শতক থেকে একেবারে বিংশ শতক পর্যন্ত সংঘটিত এই পরিবর্তনগুলো ছিল ধীর, দীর্ঘ মেয়াদী এবং লাতিনের জন্য ক্ষতিকারক। যদিও রেনেসাঁর সঙ্গে সঙ্গে যা এলো তা হচ্ছে শুদ্ধতার প্রতি একটি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি। প্রাচীন যুগের পর কেটে যাওয়া বহু শতাব্দীতে লাতিন শব্দ ভাণ্ডার যথেষ্টই সম্প্রসারিত হয়েছিল, এবং গড়ে উঠেছিল ভাষা ব্যবহারের নতুন স্বভাব ও শৈলী। রেনেসাঁ সময়ের অগ্রগণ্য অসংখ্য ব্যক্তিত্বই বিদ্বান মানবতাবাদী ছিলেন; ধ্রুপদী প্রাচীন যুগের সাহিত্যিক টেক্সটগুলো যে সেসবের বিষয়বস্তু ও অনুকরণযোগ্য ভাষা এই দুইয়ের কারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সে-বিষয়ে নিঃসন্দেহ ছিলেন তাঁরা। কাজেই অ-ধ্রুপদী শব্দাবলী এবং অভিব্যক্তি অপসারণ করার জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন তাঁরা; মোটের ওপর চেষ্টা করেছিলেন তাঁদের সময়ের লিখিত এবং বাচিক বা কথ্য লাতিনের মানোন্নয়ন করবার।
সেটা যে একেবারে নতুন ব্যাপার ছিল তা কিন্তু নয়; আমরা দেখেছি কি করে নবম শতকের গোড়ার দিকে এলকুইনের মতো মানুষ শার্লামেনের দরবারে যথেষ্ট সচেতনভাবেই প্রাচীন আদর্শের কাছে ফিরে গিয়েছিলেন, এবং দ্বাদশ শতকেও সমঅভিমুখী একটি প্রবণতা দেখা দিয়েছিল। সেই কারণে আধুনিক ইতিহাসবিদেরা ‘ক্যারোলিঞ্জীয় রেনেসাঁ’ ও দ্বাদশ ‘শতকীয় রেনেসাঁ’ নামে দুটো শব্দবন্ধ তৈরি করেছিলেন।
কিন্তু প্রকৃত রেনেসাঁর সময় এই প্রবণতাটি আরো জোরালো হয়, এবং সেটি প্রোথিত ছিল অংশত ভিন্ন এক মতাদর্শে। আগের আন্দোলনগুলো ছিল মূলত লাতিন সম্পর্কে আরো ভালো জ্ঞান এবং সাধারণভাবে শিক্ষা ও বিদ্যাচর্চায় উচ্চতর মান অর্জন করা। রেনেসাঁর সময় প্রধান চিন্তকদের লক্ষ্য ছিল উন্নততর লক্ষ্যে পৌঁছানো; যেমন তাঁরা চেয়েছিলেন পুরুষেরা (এবং কিছুটা কম করে হলেও নারীরা) তাঁদের পূর্ণ সম্ভাবনার বিষয়টি উপলব্ধি করুক; চেয়েছিলেন প্রাচীন যুগের উজ্জ্বলতার পর ‘medias aetas’ বা মধ্যযুগে কুসংস্কার ও অজ্ঞতার যে-পাহাড় গড়ে উঠেছিল তা থেকে তাদের মুক্ত করতে। আর এই লক্ষ্য সাধনের একটি উপায় ছিল লাতিন ভাষা ব্যবহারে সংস্কারসাধন। কিন্তু ঠিক এই অতি উচ্চাকাঙ্ক্ষার কারণেই ফলাফলটি আশানুরূপ হয়নি।
রেনেসাঁর প্রভাবে (প্রথমে ইতালিতে এবং পরে ইউরোপের প্রায় অধিকাংশ স্থানে) লিখিত লাতিনের মান যে যথেষ্ট উন্নতি লাভ করেছিল তাতে কোনো সন্দেহ নাই। Coluccio Salutati-র মতো অসাধারণ মানবতাবাদীরা প্রাচীন কালের নানান গুরুত্বপূর্ণ পাণ্ডুলিপি, যেমন সিসেরোর পত্রাবলী, আবিষ্কার করেন। নানান ধ্রুপদী টেক্সটের ভাষা ও শৈলী নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে গবেষণা ক’রে তাঁরা তাঁদের সমসাময়িকদের জন্য ম্যানুয়াল প্রস্তুত করেন যাতে করে তাঁরা খাঁটি সিসেরীয় লাতিন লিখতে পারে। এগুলোর মধ্যে সব চাইতে বিখ্যাত ছিল লরেঞ্জো ভায়া-র (Lorenzo Valla) ‘Elegantiae Linguae Latinae’। ধ্রুপদী টেক্সট কি করে সম্পাদনা করতে হয় তা ভায়া এবং তাঁর সমসাময়িকদের কাছ থেকে শিখেছিলেন গেরহার্ড গেরহার্ডস নামের এক গুরুত্বপূর্ণ ইউরোপীয় ধ্রুপদীতত্ত্ববিদ যিনি কিনা তাঁর লাতিন ছদ্মনাম ‘দেসিদেরিয়াস’ এবং সবচাইতে বেশি ক’রে তাঁর গ্রীক নাম ‘রটারডামের ইরাযমাস’ নামে পরিচিত ছিলেন। তাঁর রচনার পরিমাণ বিস্ময়কর: নিজের মৌলিক কাজ ছাড়াও – যেগুলো অবশ্য সব লাতিনে রচিত – তিনি তেরেন্স, লিভি, প্লিনি, এবং সেনেকাসহ তাঁর গ্রন্থাবলীতে উল্লেখিত অসংখ্য লেখকের নানান রচনার বিভিন্ন সংস্করণ তৈরির কাজ তত্ত্বাবধান করেন। এছাড়াও তিনি জেরোমে, অগাস্তিন এবং এম্ব্রোসসহ অনেক খৃষ্টীয় ফাদারের রচনার নানান সংস্করণ প্রস্তুত করেছিলেন। সম্ভবত তাঁর সবচাইতে বিখ্যাত মৌলিক রচনা হলো ‘Moriae Encomium’ বা, ‘In Praise of Folly’ (১৫১১)। এছাড়াও তিনি ‘Adagia’ বা ‘প্রবাদসমূহ’ নামে লাতিন ও গ্রীক প্রবাদের একটি সংকলন প্রকাশ করেন, আর এসব প্রবাদের কিছু কিছু – যেমন, ‘mortuum flagellas’ ‘মৃত (ঘোড়াকে) পেটানো’, ‘inter caecos regnat strabus’ অর্থাৎ ‘অন্ধের দেশে এক চোখবিশিষ্ট লোক-ই রাজা’ (আক্ষরিক অর্থে, অন্ধদের মাঝে এক চোখ বিশিষ্ট লোক-ই রাজত্ব করে) – এখনো আমরা ব্যবহার করি।
অনেকেই লাতিন ভাষায় এমন দক্ষতা অর্জন করেছিলেন যে তাঁরা ভাষাটির ধ্রুপদী মান ও শৈলীগত অভিব্যক্তির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ কবিতা ও বক্তৃতা রচনা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আমরা ইতিমধ্যে রেনেসাঁর একেবারে গোড়ার দিককার কবি পেত্রার্ক ও রেনেসাঁ আন্দোলনের অব্যবহিত পরবর্তীকালের জন মিল্টনের কথা বলেছি। এই দুই কবির জীবতকালের মাঝখানের সময়টায় শত শত কবি-সাহিত্যিক-লেখক নিখুঁত লাতিনে শিল্পসম্মত অগুনতি লেখা লিখেছেন। দুর্ভাগ্যক্রমে রেনেসাঁ আমলের লাতিনে রচিত সাহিত্যে একটি দুর্বলতা সব রচনার মধ্যেই পরিলক্ষিত হয়, আর তা হলো বিষয়বস্তু খুব কম ক্ষেত্রেই আঙ্গিকের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। এসবের মধ্যে বহু কাজই মৌলিক নয়, বিদ্যালয়ের নীরস অনুশীলনী। বেশির ভাগই পঠিত হয়েছে একেবারে কম, এখন কেবল বিশেষজ্ঞরাই সেসবের পাতা ওল্টান। তবে এর ব্যতিক্রমও যে নেই তা নয়। উল্লেখিত রচনাগুলো ছাড়াও ভুললে চলবে না টমাস মোরের ‘ইউটোপিয়া’-র (১৫১৬) কথাও, যা কিনা সত্যিকার অর্থেই অত্যন্ত মৌলিক একজন চিন্তকের খুবই প্রভাবসঞ্চারী রচনা। তা সত্ত্বেও, রেনেসাঁ পর্বের সত্যিকার উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্মগুলো ইউরোপের নতুন ভাষাগুলোতেই রচিত, প্রথমে ইতালীয়, এবং পরে ফরাসি, ইংরেজি ও অন্যান্য ভাষায়। নিখুঁত ধ্রুপদী লাতিন শেখার প্রবল সম্মিলিত প্রচেষ্টা বহুলাংশেই বিফল হয়েছে – সেই ভাষায় মৌলিক সাহিত্যিক রচনা সৃষ্টি করা যায়নি।
গির্জা, প্রশাসন, এবং আরো বহু পরিসরে লাতিনের দৈনন্দিন ব্যবহারের কথা বলতে গেলে বলতে হয়, সেটা রেনেসাঁর আদর্শের দ্বারা দুইভাবে প্রভাবিত হয়েছিল। একদিকে, লিখিত লাতিনের আনুষ্ঠানিক মান প্রায় সব ক্ষেত্রেই বেড়ে গিয়েছিল, নিশ্চিতভাবেই যাকে একটি অগ্রগতি বলে গণ্য করা যায়। অন্যদিকে, শৈলীগত চারুতার উন্নততর চাহিদার কারণে লেখকদের ওপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করেছিল। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, একটি দাপ্তরিক চিঠি বা ইচ্ছাপত্র তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় মান অর্জন আগের চাইতে অনেক কঠিন হয়ে পড়েছিল। এই সমস্যার ফলে কালক্রমে এসব চিঠিপত্র জাতীয় ভাষাতে লেখার প্রবণতা বেড়ে যায়। লাতিন লেখা ক্রমেই আরো জটিল হয়ে পড়াতে ভাষাটি ব্যবহারিক উদ্দ্যেশ্যগুলোর জন্য কার্যকারিতা হারাতে থাকে।
মোটের ওপর, তাহলে, নেতৃস্থানীয় কুশীলবদের লাতিন প্রীতি এবং ভাষাটির প্রসারে তাঁদের যথেষ্ট প্রয়াস সত্ত্বেও রেনেসাঁ ইউরোপে লাতিনের বিস্তৃততর ব্যবহারে প্রত্যাবর্তনের কাল ছিল না মোটেই। আন্দোলনটির প্রভাব সম্পর্কে কেবল এটুকুই বলা যায় যে সেটা হয়ত লাতিন ছেড়ে জাতীয় ভাষার দিকে ঝোঁকার প্রবণতাটিই ত্বরান্বিত করেছে।
পরবর্তী অধ্যায় : ‘চিকিৎসকবৃন্দ ও তাঁদের ভাষা’
Have your say
You must be logged in to post a comment.
১ comment
Pingback: লাতিন ভাষার কথা : ৪২ | জি এইচ হাবীব