Tore Janson-এর সুইডিশ ভাষায় রচিত Latin: Kulturen, historien, språket গ্রন্থের Merethe Damsgård Sørensen ও Nigel Vincet-কৃত ইংরেজি অনুবাদ A Natural History of Latin-এর বাংলা ভাষান্তর
এবেলার্ড ও ইলোইযা
(শেষার্ধ)
যে ঘটনাগুলোর কথা আমরা এই মাত্র বললাম সেগুলো ঘটেছিল ১১১৭ থেকে ১১১৯ খৃষ্টাব্দের মধ্যে, যখন এবেলার্ডের বয়স আটত্রিশ, ইলোইযার আঠারো কি উনিশ। এর প্রায় পনেরো বছর পর, খুব সম্ভব ১১৩৪ খৃষ্টাব্দে এবেলার্ড তাঁর ‘Historia calamitamum’ রচনা করেন, যখন তাঁর বয়স পঞ্চান্ন। এই বইতে তিনি বিগত পনেরো বছরে তাঁর জীবনের ঘটনাবলীর বিশদ বিবরণ দিয়েছেন, যা কিনা তাঁর সারা জীবনের মতোই ছিল দ্বন্দ্ব-সংঘাতে পরিপূর্ণ। সেসময় তিনি একটি মঠের মোহান্ত বা মহাধ্যক্ষ ছিলেন, আর ইলোইযা একটি কনভেন্টের মঠাধ্যক্ষা। তাঁদের জীবনের সেই সময়ের লেখা বেশ কিছু পত্র আমাদের হাতে এসে পৌঁছেছে। সেগুলোর প্রথমটি এবেলার্ডকে লেখা ইলোইযার চিঠি, আর তাতে তিনি বলছেন যে ঘটনাক্রমে তাঁর হাতে এবালার্ডের ‘Historia calamitamum’ এসে পড়ে এবং সেটা পাঠান্তে তিনি তাঁকে চিঠি না লিখে পারেননি। এরপর এবেলার্ড ইলোইযাকে চিঠিটার জবাব দেন, তারপর ইলোইযা এবেলার্ডকে, এইভাবে চলতে থাকে। পৃথিবীর সাহিত্যের ইতিহাসে এই ইলোইযা-এবেলার্ড পত্রাবলী সবচাইতে বহুল পঠিত ও আলোচিতগুলোর অন্যতম, বিশেষ করে প্রথম চিঠি দুটো শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বিস্মিত ও মুগ্ধ করে রেখেছে পাঠকদের।
এই পত্র দুটোর শুরুতে তিনি এবেলার্ডের প্রতি তাঁর প্রেমকে ব্যাখ্যা করেছেন: ‘te semper, ut ómnibus patet, immoderato amóre complexa sum’ – ‘সব সময়ই আমি তোমাকে নিঃসঙ্কোচ প্রেমের সঙ্গে আলিঙ্গন করতে চেয়েছি, যা সবাই জানে।’ বেশিরভাগ সময়েই তিনি এবেলার্ডকে ‘unice’ বা ‘ আমার একমাত্র’ বলে সম্বোধন করেছেন। এবেলার্ড যা কিছু করেন, যা কিছু ভাবেন তা অন্য সব কিছুর চাইতে ভালো; তাঁর প্রতিভা আর জ্ঞান রাজা-বাদশা বা সম্রাটদের চাইতেও ঢের বেশি; তিনি সবার চাইতে সুন্দর, অন্য যে কারো চাইতে ভালো গাইতে আর লিখতে পারেন, বিবাহিত-অবিবাহিত সব নারী তাঁকে পছন্দ করেন। ইলোইযা যা কিছু করেছেন সব এবেলার্ডের প্রতি ভালোবাসার কারণেই করেছেন, অন্য কোনো কারণে নয়। আর সেটা বিশেষ করে প্রযোজ্য কনভেন্টে তাঁর যোগ দেবার ক্ষেত্রে। ‘Tua me ad religiónis hábitum iússio, non divina traxit diléctio’ – ‘তোমার আদেশ ছিল তাই আমি কনভেন্টে যোগ দিয়েছিলাম, ঈশ্বরকে ভালোবেসে যোগ দিইনি।’ ফলে, তিনি আরো বলছেন, সত্যিকার অর্থে আমার নিজের কোনো নৈতিক মূল্য নেই। বাহ্যত আমি একটি ধর্মীয় জীবন যাপন করি, কিন্তু আসল জিনিস হচ্ছে হৃদয়ের কামনা। আর আমার হৃদয়ে তুমি ছাড়া অন্য কোনো কিছুর কোনো মূল্য নেই।
তিনি আরো বলছেন, আমি একটি পরিশুদ্ধ জীবন যাপন করি, এবং মনে করা হয় আমি সাধ্বী। কিন্তু আমার এখনো মনে পড়ে সেইসব সময়ের কথা যখন আমরা দুজন এক সঙ্গে ছিলাম রক্তে-মাংসে, মনে পড়ে দুজনে তখন কি করেছিলাম, এবং এখনো আমি বার বার তোমার কথা মনে করি সব সময়, এমনকি হোলি মাস (holy Mass)-এর সময়েও। ঈশ্বরের দৃষ্টিতে আমি মূল্যহীন; তীব্র আমার যন্ত্রণা। একমাত্র যে পারে এবং যার উচিত পত্র লিখে উৎসাহব্যঞ্জক কথা বলে আমাকে সাহায্য করা সে হলে তুমি। প্রকৃত পক্ষে এটা তোমার কর্তব্য: তুমি আমার স্বামী। চিঠি লিখো আমাকে, আমার প্রতি উদাসীন থেকো না।
ইলোইযার সুতীব্র আগ্রহ-উৎসাহের তুলনায় এবেলার্ডের উত্তরগুলো কিন্তু উল্লেখযোগ্য রকমের নিস্পৃহ। নিজেকে তিনি মোটের ওপর ইলোইযার কনফেসর হিসেব দেখছেন এবং তাঁকে বলছেন যে ইলোইযার সংগ্রাম ঈশ্বরের কাছে পৌঁছবার সংগ্রাম, এবং সে জন্য তাঁকে যতো কঠিন যুদ্ধ করতে হবে ততোই সেটা মহৎ হবে। তিনি নিজে কামুকতা থেকে মুক্তি পেয়েছেন, কিন্তু তার মানে সেই সঙ্গে এটাও যে তিনি আর সেটার সঙ্গে যুদ্ধ করার কৃতিত্ব পাছেন না। কিন্তু অন্য দিকে ইলোইযা তাঁর শারীরিক কামনা বাসনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এক বিপুল বিজয় অর্জন করেছেন। কিন্তু এবেলার্ডের এই ভাবনাটি ইলোইযাকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি তেমন একটা। তৃতীয় চিঠির গোড়াতে তিনি কেবল এই মন্তব্য করছেন যে তিনি এই বিষয়ে আর লিখবেন না কারণ এবেলার্ড ঠিক তাই করতে বলছেন তাঁকে, কিন্তু নিজে তিনি তাঁর অনুভূতির ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারছেন না। ‘Nihil enim minus in nostra est potestate quam ánimus’ – ‘কারণ, হৃদয়ের চাইতে আর কোনো কিছুই আমাদের এতো কম নিয়ন্ত্রণে নেই।’ এরপর আর আবেগ-অনুভূতি নিয়ে কোনো কথাবার্তা নেই; তার বদলে কথা এগিয়েছে ইলোইযার কনভেন্টে আচরণবিধির রূপরেখা কেমন হবে তাই নিয়ে।
ইউরোপের অসাধারণ প্রণয় কাহিনীগুলোর মধ্যে এবেলার্ড ও ইলোইযারটি অন্যতম। তাঁদের পত্রাবলী অসংখ্য ভাষায় অনূদিত হয়েছে, এবং অনেক লেখকই এই কাহিনীটি নানান ভাবে বর্ণনা করেছেন। অবশ্য তাতে অবাক হওয়ার তেমন কিছুই নেই বললে চলে, কারণ এতে সুতীব্র আবেগ আর উগ্র আবেগ যথেষ্ট পরিমাণেই রয়েছে; রয়েছে বীরত্ব আর প্রতারণা, এবং সব কিছুর ওপর, সারা জীবনব্যাপী প্রেম। আর দুপক্ষই যে তাঁদের কালে খ্যাতিমান ছিলেন তাতে এই প্রেমকাহিনী আরো আকর্ষণীয় হয়েছে লোকের কাছে। বিশেষ করে আমরা দেখবো দর্শন ও ধর্মতত্ত্বের ক্ষেত্রে এবেলার্ডের পথনির্দেশনাদানকারী ভূমিকা ইউরোপীয় চিন্তার ইতিহাসে তাঁকে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অধিষ্ঠিত করেছে।
কিন্তু তারপরেও, এই গোটা কাহিনীর সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ দিক সম্ভবত এই যে, দুজনেই তাঁরা এটার কথা লিখে গিয়েছেন। সর্বোপরি, মঠাধ্যক্ষা ইলোইযা এমন নগ্নভাবে তাঁর আবেগ অনুভূতি প্রকাশ করতে পারলেন কি করে? ব্যাপারটা কি আসলেই বিশ্বাসযোগ্য? অনেকেই মনে করেন এই পত্রাবলী জাল, পরবর্তী কোনো সময়ের। কিন্তু চিঠিগুলোর লাতিন পরীক্ষা করে পণ্ডিতরা আসলেই প্রমাণ করতে পেরেছেন যে সেগুলো নিশ্চিতভাবেই এবেলার্ড ও ইলোইযার সময়ে লেখা না হয়ে যায় না, এবং খুবসম্ভব সেগুলো তাঁদের নিজেদেরই লেখা। অন্য কথায় বলতে গেলে, দ্বাদশ শতকের দুই নর-নারী আসলেই তাঁদের মনের গহীনতম অনুভূতিগুলোর কথা পরস্পরের কাছে এমন এক লাতিনে প্রকাশ করেছিলেন যার অধিকাংশ পুরোপুরিই ধ্রুপদী নিয়ম-কানুনসঙ্গত। এক হাজার বছর আগে লোকে যেভাবে কথা বলত তাঁরা ঠিক সেভাবেই লিখেছেন, এবং কাজটা তাঁরা করেছেন যথেষ্ট মনোরমভাবে। এধরনের পরিস্থিতিতে আবেগের অনিয়ন্ত্রিত প্রকাশ সম্ভব নয়, কিন্তু তাতে করে চিঠিগুলোকে শীতল বলে মনে হয় না। বরং, তারপরেও আবেগ অনুভূতিগুলো যথেষ্টই জোরালভাবে প্রকাশ পেয়েছে কারণ লেখক দুজন একটি নিয়ন্ত্রিত কিন্তু যথাযথ ভঙ্গীতে তা প্রকাশ করেছেন, ভাবালুতার কোনো লেশ ছাড়াই।
পরবর্তী অধ্যায় : ‘চিন্তকবৃন্দ’
Have your say
You must be logged in to post a comment.
১ comment
Pingback: লাতিন ভাষার কথা : ৪০ | জি এইচ হাবীব