Tore Janson-এর সুইডিশ ভাষায় রচিত Latin: Kulturen, historien, språket গ্রন্থের Merethe Damsgård Sørensen ও Nigel Vincet-কৃত ইংরেজি অনুবাদ A Natural History of Latin-এর বাংলা ভাষান্তর
গ্রন্থাবলী ও লিপিকরবৃন্দ
(শেষার্ধ)
তারপরেও, প্রায় এক সহস্রাব্দ ধরে, প্রাচীন যুগের সংস্কৃতি প্রচার করার দায়িত্ব প্রায় নিরঙ্কুশভাবে ছিল বিভিন্ন মঠগুলোর স্ক্রিপ্টোরিয়াম বা লেখার ঘরগুলোর ওপর। সেখানে যেসব পাণ্ডুলিপি তৈরি হতো সেগুলো সহজপাঠ্য ছিল না সবসময়। সমস্যাটা যে হাতের লেখারই ছিল সাধারণত তা নয়, যদিও অবশ্যই লিপিকর, কাল, এবং স্থানভেদে লিখন শৈলীর তফাত হতো প্রায়ই। হস্তরেখা পরীক্ষা করে একটি পাণ্ডুলিপি তৈরির স্থান ও কাল সম্পর্কে মূল্যবান সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেন বিশেষজ্ঞরা। এই বিদ্যাটিকে বলা হয় ‘paleography’; লাতিন টেক্সট নিয়ে যাঁরা ঐকান্তিকভাবে কাজ করেন তাঁদের প্রত্যেকের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার।
এমনকি যখন সেগুলো লিপিকরের নিজস্ব ধরন বা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত, তখনো বেশিরভাগ হস্তরেখাশৈলী যথেষ্ট পরিষ্কার ও সুসামঞ্জস্যপূর্ণ; কাজেই কেউ একবার হরফগুলোর আকৃতি-প্রকৃতি চিনে ফেলতে পারলে কোনো নির্দিষ্ট টেক্সটের অক্ষরগুলো বুঝতে পারা কঠিন কোনো বিষয় নয়। দুর্ভাগ্যক্রমে, সমস্যার এখানেই শেষ নয়। একটা বড়সড় অসুবিধার জায়গা হচ্ছে — বিশেষ করে এ-কাজে যারা নতুন তাদের জন্য — শব্দ সংক্ষেপগুলো। চর্মপট মহার্ঘ হওয়ায়, যতটুকু জায়গা পাওয়া যেতো তার সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করাটা জরুরি ছিল। তাছাড়া, লিপিকরেরা প্রয়োজনাতিরিক্ত কোনো অক্ষর লেখার ব্যাপার তেমন উৎসাহী ছিলেন না, কাজেই শব্দসংক্ষেপের বেশ কিছু উপায় ছিল তাদের। তার মধ্যে সবচাইতে প্রচলিত ছিল একটা হরফের ওপর একটা রেখা টেনে দেয়া, যে রেখাটা সেই হরফের পর একটা ‘m’ বোঝাত; কাজেই ‘uerbum’ না লিখে ‘uerbū’ লিখতেন তাঁরা। এই একটা ব্যাপার হয়ত কঠিন কিছু না। কিন্তু মুশকিল হলো দুর্ভাগ্যক্রমে রেখাটা অন্য কয়েকটা জিনিস-ও বোঝাতে পারতো, যেমন, ‘r’ রয়েছে এমন কোনো সিলেবল-এর লোপ। কাজেই ‘uerbum’ -এর স্থলে আপনি ‘ūbū’ লিখতে পারতেন, যা অনভিজ্ঞ পাঠককে একটু মুশকিলে ফেলে দেয়। আর এটা তো কেবল শুরু; এছাড়াও ছিল আর কয়েক ডযন শব্দসংক্ষেপ, এবং সেগুলো ব্যবহারের হাজারটা উপায়।
আরেকটা সমস্যা যতি বা বিরামচিহ্ন। অনেক পাণ্ডুলিপিতেই বিরামচিহ্নের কোনো বালাই নেই বললেই চলে, বা যখন তাদের দেখা মেলে তখন সেগুলো আমরা আজ যেসব ব্যবহার করি তার মতো নয়, এবং ওসব ব্যবহারের রীতিনীতিগুলো আমাদেরগুলোর চাইতে একেবারেই ভিন্ন রকম। পাঠককে নিজে নিজেই বুঝে নিতে হবে টেক্সট-এ কোথায় কমা বা ফুলস্টপ বসবে। বড় হাতের অক্ষরগুলো এক্ষেত্রে কাজে আসে না, কারণ বড় হাতের অক্ষর দিয়ে নতুন বাক্য শুরু করার আমাদের আধুনিক প্রথা এসেছে আরো অনেক পরে। বেশিরভাগ পাণ্ডুলিপিতেই টেক্সট শুরু হয়েছে বড় হাতের অক্ষর দিয়ে, আর তারপর হয়ত স্রেফ আরেকটা এসেছে নতুন কোনো পর্বের শুরুতে। অবশ্যই, পাণ্ডুলিপিভেদে নানান ভিন্নতা রয়েছে। পড়া সবচেয়ে সহজ de luxe সংস্করণগুলো, যেগুলো হয়তো কোনো আর্চবিশপের ফরমায়েশে নির্মিত হয়েছিল, বা কোনো রাজা বা অন্য কোনো ক্ষমতাধর ব্যক্তির কাছে উপস্থাপনের কথা ছিল। বড় বড় অক্ষরে, সুচারু হাতে শব্দ ও লাইনের মাঝে বেশ ফাঁকা রেখে প্রায় কোনোই শব্দসংক্ষেপ ব্যবহার না করে লেখা হয়েছে সেগুলো; সঙ্গে রয়েছে সুসজ্জিত আদ্যক্ষর, আর কখনো কখনো অলংকরণ। বিভিন্ন চিত্রে বা জাদুঘরের প্রদর্শন বাক্সে এই ধরনের পাণ্ডুলিপি-ই দেখানো হয়। কিন্তু বেশিরভাগ পাণ্ডুলিপিই ছোট ছোট অক্ষরে অসংখ্য শব্দসংক্ষেপসহ এবং বিনা সাজসজ্জাতেই লেখা।
পাণ্ডুলিপি নিয়ে সবচাইতে বড় সমস্যায় পড়তে হয় হাতের লেখা, বিরামচিহ্ন, আর শব্দসংক্ষেপের মতো বাহ্যিক জিনিসগুলো অতিক্রম করার পর। কেবল তখন-ই আপনি আবিষ্কার করেন যে হয়ত কিছু জায়গায় আপনি বুঝছেন না যে কি বলা হচ্ছে; দেখেন যে, লাতিনটা স্রেফ অবোধ্য। এখানে এসে আপনি সন্দেহ করতে শুরু করেন যে কোথাও কোনো একটা গলদ ঘটেছে, এবং পাণ্ডুলিপিতে যা লেখা আছে রচয়িতা তা বলেননি। কিন্তু কিই-বা করার আছে আপনার? অন্য পাণ্ডুলিপিতে যদি একই টেক্সট থাকে এবং আপনার হাতে ইউরোপময় ঢুঁড়ে বেড়াবার মতো সময় থাকে, বা যদি মাইক্রোফিল্ম কপি জোগাড় করতে পারেন তাহলে আপনি আপনার সংস্করণটির সঙ্গে সেগুলো মিলিয়ে নিয়ে দেখতে পারবেন কোনটা অর্থবহ। ধরে নেয়া গেল আরেকটা পাণ্ডুলিপিতে আরো বোধগম্য কিছু পেলেন আপনি, কিন্তু তখনো কি নিশ্চিত হতে পারবেন যে এটাই রচয়িতা লিখেছিলেন? দুটো পাণ্ডুলিপি যদি একটা বিশেষ প্রসঙ্গে এসে আলাদা হয়ে যায়, সেক্ষেত্রে একটিতে নিশ্চয়ই ভুল রয়েছে, কিন্তু আমরা কিভাবে জানবো কোনটাতে রয়েছে সঠিক টেক্সট, বা দুটোতেই ভুল রয়েছে কিনা।
এসব প্রশ্নের জবাব ছোট না, আবার সরলও না, এবং তা আমাদেরকে আরেক ধরনের বিদ্যাবত্তার দিকে নিয়ে যায় যার নাম হলো ‘পাঠভিত্তিক (textual) সমালোচনা’। একজন লাতিন বিশারদের দৈনন্দিন জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এটি। পাণ্ডুলিপিগুলো সাধারণত প্রমাদ-আকীর্ণ হয়ে থাকে, বিশেষ করে যদি তাতে পুরানো টেক্সট থাকে, কারণ সেগুলো অসংখ্যবার নকল করা হয়েছে আর প্রতিবার নকল করার সময়ই অবশ্যম্ভাবীভাবে কোনো না কোনো ভুল হয়, তা লিপিকর যতো সাবধানীই হোন না কেন (আমার কথা বিশ্বাস না হলে নিজে হাতে লিখে কয়েকশ পৃষ্ঠা নকল করুন, তারপর প্রতিটি শব্দ ধরে ধরে মিলিয়ে দেখুন কি লিখেছেন!) এছাড়াও, একটি নকলের ভুলগুলো আরেক নকলে গিয়ে আরো জটিল হয়ে পড়ে যখন স্পষ্টতই যা ভুল তা শুধরাতে গিয়ে লিপিকর মূল টেক্সটে কি ছিল তা অনুমান করতে গিয়ে ভুল করে বসে।
এ-ব্যাপারটার গতি করতে গেলে একটি টেক্সটের বিদ্যমান সমস্ত পাণ্ডুলিপি সংস্করণ ভালো করে দেখতে হবে আপনাকে, সেগুলোর মাঝে সম্পর্কটা বাজিয়ে দেখে তা নির্ণয় করতে হবে, এটা ঠিক করার জন্য যে এসবের মধ্যে কোনটি সবচাইতে নির্ভরযোগ্য। তারপর টেক্সটটির সেই হতবুদ্ধিকর প্যাসেজগুলোর সব কটি পড়তে হবে ভালো করে এবং সিদ্ধান্ত নিতে হবে কোন নকলটি কখন অনুসরণ করবেন। যদি সেগুলোর সব কটিতেই এমন কিছু থাকে যা কঠিন বা দুর্বোধ্য এবং ব্যাখ্যাতীত, তখন হয়ত মূল পাণ্ডুলিপিতে আদতে কি ছিল সে সম্পর্কে আপনাকে একটা বিচক্ষণ অনুমানের দিকে যেতে হবে। এই ক্লান্তিকর ও দীর্ঘ প্রক্রিয়াটির বর্ণনা শুনেই হয়তো অনেকে হাই তুলছেন এরিমধ্যে। কিন্তু কেউ কেউ আবার হয়ত মুগ্ধ হবেন ঠিক এই সমস্যাগুলোর কারণেই, যা কেবল যথেষ্ট ধৈর্য আর জ্ঞানগম্যিই দাবি করে না, সেই সঙ্গে বিশেষ ধরনের চতুরতাও দাবি করে, খানিকটা, খুবই জটিল ক্রসোয়ার্ড পাযল বা শব্দজটের মতো। প্রকৃত ভালো পাঠভিত্তিক সমালোচক বিরল প্রজাতির পাখি; বা, লাতিনে যাকে বলে ‘rare ave’, এবং এসব কাজের জন্য কি কি প্রয়োজন পড়ে সে বিষয়ে ধারণা রাখা অল্প যে ক’জন মানুষের মধ্যে তাঁদের নাম কিংবদন্তীর মতো।
বেশ কিছু পাঠভিত্তিক সমালোচক গত পাঁচশ বছর প্রাচীন লেখকদের নিয়ে কাজ করছেন, কাজেই হোরেস আর সিসেরোর যেসব টেক্সট আজ ছাপা হচ্ছে সেগুলো এসব সুস্পষ্ট লিপিকারক ত্রুটি বিবর্জিত। তারপরেও অনিশ্চয়তা থেকে যায়, এবং বিশেষজ্ঞদের জন্য যেসব সংস্করণ বের হয় সেগুলোর পৃষ্ঠার নিচের দিকে প্রচুর ক্ষুদে টীকা থাকে। এ থেকেই তৈরি হয় যাকে বলে ক্রিটিকাল এপারেটাস বা সমালোচনামূলক উপকরণ, যেখানে থাকে পাণ্ডুলিপিগুলোতে টেক্সট এর নানান প্রকারান্তর বা বিকল্প, এবং পাণ্ডুলিপিতে যা আদৌ নেই কিন্তু সম্পাদক বা অন্য কেউ যা আছে বলে অনুমান করেছেন সে সম্পর্কে নানান তথ্য। এসব তথ্য সংক্ষিপ্ত আর দুর্জ্ঞেয়ভাবে খুবই ছোট অক্ষরে লেখা টীকাতে সন্নিবেশিত হয়, যা দেখে পাঠকের মন আরো দমে যায়। বিশেষজ্ঞ না হলে ওসব পড়ার দরকার নেই আপনার, কিন্তু কোনো প্রাচীন লেখক একটি বিশেষ অনুচ্ছেদে কি লিখেছিলেন সেটা যে পাঠক জানতে চান তার জন্য সেসব অমূল্য হতে পারে।
প্রত্নহস্তরেখাবিদ এবং পাঠভিত্তিক সমালোচকদের কয়েক প্রজন্মের কারণে আমাদের কাছে সব প্রাচীন টেক্সট-এর মুদ্রিত সংস্করণ রয়েছে, যা পড়তে সহজ এবং টিকে যাওয়া পাণ্ডুলিপিগুলোর চাইতে বেশি সঠিক। অবশ্য মধ্যযুগের টেক্সটের ক্ষেত্রে এমনটি হয় না। কারণ সেসময়ের পাণ্ডুলিপি আরো অনেক বেশি এবং সেগুলো লাতিন বিশারদদের খুব বেশি মন যোগ আকর্ষণ করতে পারেনি। সেসবের অনেক গুলোই, এমনকি যেগুলো যথেষ্ট পাঠযোগ্য, সেগুলো হাতের কাছে পাওয়া পাণ্ডুলিপি ব্যবহার করে ছাপানো হয়েছে, যদিও হয়তো সেসবের চাইতে ভালো পাণ্ডুলিপি হয়তো রয়েছে। আরো অনেক টেক্সট আদৌ ছাপাই হয়নি, কারণ কবে কোন পাঠক তা পড়বে আর কোনো সংস্করণ তৈরি করবে সে-অপেক্ষায় পড়ে আছে গ্রন্থাগারে। লাতিন এবং মধ্য যুগের প্রতি মনোনিবেশে আগ্রহী মানুষজন কবে সেগুলো নিয়ে কাজ করবেন তার অপেক্ষায় অসীম সংখ্যক মূল্যবান রচনা পড়ে আছে।
এই বেলা আমরা লাতিন ভাষাটির সম্পর্কে সব প্রশ্নে ইস্তফা দেবো, এবং কিভাবে সেটি লেখা বা বলা হয়েছে সে প্রশ্ন মুলতবি রেখে প্রাচীন কালের পর লোকে লাতিন ভাষায় কি লিখেছে যার অনেকটাই পাঠযোগ্য বা সে সম্পর্কে কিছু জানার যোগ্য, সেদিকে মন দেবো।
পরবর্তী অধ্যায় : ‘সন্তবৃন্দ ও ধর্মদ্রোহীগণ’
Have your say
You must be logged in to post a comment.
১ comment
Pingback: লাতিন ভাষার কথা : ৩২ | জি এইচ হাবীব