Tore Janson-এর সুইডিশ ভাষায় রচিত Latin: Kulturen, historien, språket গ্রন্থের Merethe Damsgård Sørensen ও Nigel Vincet-কৃত ইংরেজি অনুবাদ A Natural History of Latin-এর বাংলা ভাষান্তর
গ্রন্থাবলী ও লিপিকরবৃন্দ
(প্রথমার্ধ)
প্রাচীনকালে লোকে প্যপিরাসের ওপর লিখত, যেটা কিনা এমন একটি উপাদান যা স্বাভাবিক পরিবেশ পরিস্থিতিতে মাত্র কয়েকশ বছর টেকে। ফলে যিশুর জন্মের কাছাকাছি সময়ের ধ্রুপদী যুগের উৎকীর্ণ লিপি ছাড়া প্রায় কিছুই টেকেনি। সেসময়ে যা কিছু লেখা হয়েছিল তার বেশিরই ভাগ হারিয়ে গেছে প্যাপিরাস নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে। তারপরেও যে প্রাচীন যুগের সাহিত্যের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ আমাদের কাছে আছে তার কারণ হলো, নষ্ট হয়ে যাওয়ার আগে সেগুলো প্রায়-ই নকল করা হতো, কাজেই সেসব আরেকটু বেশি দিনের জন্য সংরক্ষিত হয়েছিল। সৌভাগ্যক্রমে, চর্মপট বা চর্মপত্র (parchment) বলে একটা নতুন উপাদান প্রাচীন যুগের শেষের দিকে ব্যবহার হতে শুরু করে। সেটা ছিল জীব-জন্তুর চামড়া দিয়ে তৈরি, এবং এই পাত বা ফলকগুলো ছিল কঠিন, দেখতে প্রায়ই হলদেটে, খুবই শক্ত আর টেকসই। গুটিয়ে রাখা যেতো না সেগুলোকে, কাজেই তার বদলে বড় বড় পাত বা ফলকগুলোকে ভাঁজ করে সুবিধেমতো পাতার আকার দেয়া হতো, আর তারপর সেগুলোকে একসঙ্গে করে একপাশে সবগুলোকে সেলাই করে জুড়ে দেয়া হতো। সেলাই করা শিরদাঁড়া বা পুট-টি এরপর একটা শক্ত আবরণের সঙ্গে বাঁধা হতো। আর এভাবেই আবিষ্কৃত হলো বই, কার্যত যা এখনো এভাবেই তৈরি হয়।
চর্মপটের তৈরি বই চতুর্থ শতকে জনপ্রিয়তা লাভ করে। কিন্তু তারপরেও প্যাপিরাস ব্যবহৃত হতে থাকে বেশ কিছু শতক ধরে, যদিও ধীরে ধীরে তা হারিয়ে যায় পুরোপুরি। একথা সত্য যে, তুলনামূলকভাবে চর্মপট তৈরি অধিক সময়সাপেক্ষ, কিন্তু গৃহপালিত পশু সবখানেই লভ্য ছিল, ওদিকে প্যাপিরাস মিশর থেকে আমদানি করতে হতো। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে বাণিজ্য ক্রমেই কমে গিয়ে শেষ পর্যন্ত পুরোপুরি থেমে যেতে পশ্চিম ইউরোপে প্যাপিরাস আসা-ই বন্ধ হয়ে গেল। প্রযুক্তির এই পরিবর্তনটি কিন্তু পক্ষেই গেল লাতিনের। প্যাপিরাসের রোল থেকে কেউ কোনো লাতিন টেক্সট চর্মপটে নকল করলে সেই টেক্সট তখন আরো বেশ কয়েক শতাব্দী টিকে যেতো। প্রাচীন যেসব টেক্সট আমাদের কাছে এখনো আছে সেগুলো চর্মপটে নকল করা হয়েছিল। এরকম একটি নকল তৈরি করা সময় এবং অর্থের দিক দিয়ে বড়সড় একটি বিনিয়োগই ছিল বটে, কাজেই এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে অনেক টেক্সটই নকল করা হয়নি এবং সেগুলো চিরতরে হারিয়ে গেছে। যদিও, অন্তত, আমাদের কাছে সে বইগুলো আছে যেগুলো খোদ রোমকরা সেরা আর সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করত, কারণ — স্পষ্টত — সেগুলোই নকল করা হয়েছিল সবার আগে।
দুর্ভাগ্যক্রমে, প্রাচীন যুগের শেষ দিকে তৈরি করা চর্মপটের পাণ্ডুলিপির খুব বেশি আমাদের সংগ্রহে নেই। কিছু আছে পঞ্চম শতকের, যার মধ্যে দুটিতে রয়েছে ভার্জিলের মহাকাব্য “ঈনীড”, কিন্তু বেশির ভাগ-ই হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে। আমাদের কাছে যা আছে তা হল সেসব নকলের পরবর্তীকালের নকল। শার্লামেন এবং তাঁর সমসামসাময়িক কিছু মানুষের উদ্যোগের কারণে ৯ম শতকের ধ্রুপদী লেখকদের বেশ কয়েকজনের কাজ সংরক্ষণ করা গেছে। অন্যক্ষেত্রে, সবচাইতে পুরানো বিদ্যমান পাণ্ডুলিপিটি পঞ্চদশ শতকের, সেই সময়ের যখন ধ্রুপদী যুগের ব্যাপারে রেনেসাঁ যুগের উতসাহী মানুষেরা পুরানো সুসমবদ্ধভাবে পাণ্ডুলিপির সন্ধানে ব্যাপৃত হয়ে সেগুলো নকল করিয়েছিলেন।
কেউ একটা চর্মপটের পাণ্ডুলিপি তৈরি করার মানেই এই নয় যে সেটা আজীবন টিকে থাকবে। বেশি ব্যবহারে সেটা জীর্ণ হয়ে যেতে পারে, বৃষ্টি-বাদলা-বন্যা আর স্যাঁতসেতে অবস্থার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। আবার, আগুনও আমাদের বঞ্চিত করেছে অনেক পাণ্ডুলিপি থেকে। কখনো কখনো সেসবের মালিকেরা সেগুলোকে বইয়ের আবরণ বা মলাট হিসেবে বা অন্য কোনো দৈনন্দিন কাজে ব্যবহার করেছেন। কখনো কখনো আবার লোকে কোনো চাঁছনি বা সুবিধেজনক রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে কোনো পাণ্ডুলিপির পৃষ্ঠাগুলোর সব লেখা মুছে ফেলে তার ওপরে নতুন কিছু লিখেছে; এরককম পুনঃব্যবহৃত পাণ্ডুলিপিকে ইংরেজিতে বলে ‘palimpest’। এসব ক্ষেত্রে, গোড়াতে কি লেখা ছিল সেটা মাঝে মাঝে পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়, এবং এভাবেই বেশ কিছু প্রাচীন টেক্সট পুনরাবিষ্কার করা সম্ভব হয়েছে। অবশ্য, প্রাচীনতম পাণ্ডুলিপিগুলো সংরক্ষণ করা হয়নি বললেই চলে, কিন্তু তারপরেও কোনো না কোনোভাবে এখনো অনেক লাতিন পাণ্ডুলিপি রয়েছে আমাদের কাছে। আমার জানামতে কেউই সেগুলোর সংখ্যা নিরূপণ করার চেষ্টা করেননি, কিন্তু তারপরেও বলা যায় যে সংখ্যাটা বেশ কয়েক লাখ হবে। আজ সেগুলোর বেশিরভাগই রয়েছে বিভিন্ন গ্রন্থগার বা মহাফেজখানায়। ভ্যাটিকানের গ্রন্থাগারে, বা ব্রিটিশ গ্রন্থাগারে বা প্যারিসের বিবলিওথেক ন্যাশনালের মতো জায়গার বেশ কয়েক হাজারের মতো পাণ্ডুলিপির বিশাল সং গ্রহ রয়েছে।
এসবের বেশিরভাগ-ই তৈরি করেছিলেন গির্জার লিপিকরেরা, বিভিন্ন মঠে। চর্মপটে উত্তরণের ব্যাপারটা ঘটেছিল প্রায় সেই সময়ে যখন খৃষ্টধর্ম নিজের স্থান করে নিয়েছিল রোমক সাম্রাজ্যে, এবং যতদূর মনে হয়, মূলত খৃষ্টানরাই নতুন কৌশলগুলো ব্যবহার করছিল, একেবারে প্রথম থেকেই। কাজেই এটা কোনো আপতিক ঘটনা নয় যে, যেসব পাণ্ডুলিপি টিকে গেছে তার সিংহভাগই সেসব বইপত্রের নকল বা অনুলিপি যেগুলো খৃষ্ট সম্প্রদায়ের কাছে গুরুত্বপূর্ণ: ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান-প্রার্থনা বিষয়ক টেক্সট, সুসমাচার, উপাসনায় ব্যবহৃত বাইবেলের অন্তর্গত প্রার্থনা-সঙ্গীত (the psalter), স্তোত্র সংগ্রহ, ইত্যাদি। অতি অবশ্যই সেখানে সম্পূর্ণ বাইবেল ছিল, ছিল বাইবেলের নানান অধ্যায় বা পর্বের টীকা ভাষ্য, গির্জার ফাদারদের লেখা, এবং অন্যান্য খৃষ্টীয় রচনা, যেগুলোর কথা পরে আলোচনা করবো আমরা।
কিন্তু লাতিনের অন্যান্য যতো নমুনা আমরা পেয়েছি — উৎকীর্ণ লিপিগুলো ছাড়া — সেই প্রাচীনতম কাল থেকে একেবারে ছাপাখানা আবিষ্কার হওয়া পর্যন্ত, সেগুলো পেয়েছি আমরা নানান পাণ্ডুলিপি থেকেই, খৃষ্টীয় বা অখৃষ্টীয় দুই-ই; এবং কেউ হয়ত সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন করতে পারেন যে, কোনোভাবেই খৃষ্টধর্মের সঙ্গে সম্পর্কিত নয় এমন কিছুর নকল তৈরি করার কি দায় ছিল সন্ন্যাসীদের। এ প্রশ্নের জবাব হচ্ছে এই যে, প্রাচীন যুগের শেষ দিকে আশ্রমিক প্রথা শুরুর সময় থেকে সচেতনভাবেই করা হয়েছে কাজটা। আমরা আগেই দেখেছি, ক্যাসিদোরিয়াস এবং অন্যান্য যাঁরা মঠগুলো প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তাঁরা প্রাচীন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যর, বিশেষ করে লিখিত সাহিত্যের দায়িত্বভার গ্রহণ করে সেটার খানিকটা পরবর্তী কালের কাছে পৌঁছে দেয়ার কাজটিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেছিলেন। তাছাড়া, পাণ্ডুলিপির নকল তৈরি করাটা সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীদের জন্য একটা উপযুক্ত কাজ হিসেবেও বিবেচনা করা হতো। ভালো ভালো মঠে একটা ‘scriptorium’ বা লেখার ঘর থাকতই সবসময় (“The Name of the Rose” উপন্যাস ও চলচ্চিত্রের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে — অনু।), যেখানে সম্প্রদায়টির কিছু সদস্যকে সেই মঠের নিজস্ব বা অন্য কোথাও থেকে ধার করে আনা পাণ্ডুলিপি নকল করার কাজে নিরত রাখা হতো।
নিজস্ব বা তৈরি করা পাণ্ডুলিপির সংখ্যা অবশ্যই মঠভেদে ভিন্ন হতো, কিন্তু মোটের ওপর একটা বড়সড় শিল্প ছিল সেটা, কারণ মঠ ছিল শত শত। টেক্সট বাছাইয়ের কাজটা সম্ভবত আপতিকই ছিল প্রায় সব সময়, অন্তত কিছুটা হলেও, কারণ যা হাতের কাছে পাওয়া গিয়েছিল বা জোগাড় করা গিয়েছিল সেগুলোরই নকল করিয়ে রেখেছিল মঠগুলো। সে যা-ই হোক, মোদ্দা কথা হলো প্রাক-খৃষ্টীয় যুগের একটা যথেষ্ট ভালো বারোয়ারি সংগ্রহ সংরক্ষিত রয়েছে আজ আমাদের জন্য। এই বইয়ের প্রথম ভাগে সেসবের অনেকগুলোর কথা আলোচনা করেছি আমরা। কিন্তু তারপরেও অনেক ফাঁকা জায়গা রয়ে গেছে। তার একটা হচ্ছে লিভির রোমের ইতিহাস, যার মূল ১৪২টি বইয়ের মধ্যে মাত্র ৩৫টি পাওয়া গেছে। অন্যদিকে, খৃষ্টান লেখকদের লেখা বরং ব্যাপকভাবে নকল করা হয়েছে। যেমন, চার্চ ফাদার অগাস্তিন এবং জেরোমে ছিলেন অবিশ্বাস্য রকমের বহুপ্রজ, এবং তাঁদের রচনার প্রায় প্রতিটি লাইনই টিকে গেছে।
গোটা মধ্যযুগ জুড়েই খৃষ্টীয় অখৃষ্টীয় দুই বিষয়েই লোকে লিখে গেছে লাতিন ভাষায়। কাজেই, নকলযোগ্য বই শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বেড়েই চলেছে অবিরত। স্পষ্টতই, এর মধ্যে একটা বড় অংশ বেমালুম উধাও হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু অনেকগুলোই তা হয়নি, এবং আজ আমাদের হাতে যেসব লাতিন টেক্সট আছে তার একটা অনেক বড় অংশ লেখা হয়েছে প্রাচীন যুগের পর। সেই সময় থেকে মুদ্রণের যুগ শুরু হওয়ার আগের প্রায় সব কিছু আমাদের কাছে পৌঁছে দেবার ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা ছিল সন্ন্যাসী আর সন্ন্যাসিনীদের যাঁরা পাণ্ডুলিপিগুলো নকল করার কাজটি করেছেন। দীর্ঘ দিন তাঁরা চর্মপটে লিখেছেন, কিন্তু চতুর্থ শতক থেকে কাগজের ব্যবহার প্রচলিত হলো। এটা বেশ পুরানো একটি কৌশল, যা যিশু খৃষ্টের জন্মের কিছুদিনের মধ্যেই আবিষ্কৃত হয়েছিল চীনে। মুসলিম জগতে কাগজের ব্যবহার চলে আসছে সেই অষ্টম শতক থেকে, কিন্তু ইউরোপে, আরো সঠিকভাবে বললে স্পেনে সেটা তৈরি হতে শুরু করে কেবলই ত্রয়োদশ শতকে। প্রায় সেই সময়েই চার্চ তার নিয়ন্ত্রণ হারাতে থাকে শিক্ষা আর লেখালেখি সংক্রান্ত সব বিষয়ের ওপর থেকে। কাগজ যেহেতু চর্মপটের চাইতে সস্তা তাই লোকজনের পক্ষে আর্থিকভাবে সাশ্রয়ী উপায়ে টেক্সটগুলোর নিজের নকল নিজেই করা বা নিজে নিজেই টেক্সট লেখা সম্ভব হলো। চতুর্দশ ও পঞ্চদশ এমনকি আরো পরের-ও এমন বহু টেক্সট রয়েছে। গ্রন্থনির্মাণের প্রধান ভূমিকা থেকে গির্জাকে প্রতিস্থাপিত করার জন্য কেবল মুদ্রণ শিল্পই দায়ী ছিল না নয়। পঞ্চদশ শতকের শেষ দিকে ছাপাখানা যখন নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে গেছে, মঠগুলো ততোদিনে এই বাজারে তার অগ্রগণ্য অবস্থান হারিয়ে ফেলেছে।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
১ comment
Pingback: লাতিন ভাষার কথা : ৩১ | জি এইচ হাবীব