রসু খাঁ চরিত: যদি সে আমাদেরই লোক…

রসু খাঁ কাহিনীর রোমাঞ্চকর পর্ব আপাতত শেষ। এই কাহিনী-উপভোগের আনন্দ-বেদনা-ভয় আপাতত একটি খাতেই বইবে। সেটা হলো খুন ও ধর্ষণের বিবরণের বিস্তার। আসবে তার চরিত্রের কার্যকারণ-বিচার। কাহিনীর মাঝে মাঝে যাত্রার বিবেকের ভূমিকায় হাজির হবেন সাংবাদিক, পুলিশ, বুদ্ধিজীবী ও মনোবিজ্ঞানী। এই বিবেকি পাটে যে কারোরই অধিকার। কেউ তো আর প্রকাশ্যে ধর্ষণ ও খুনের সমর্থক নয়! ফলে তার চরম শাস্তি হওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তার কিছু নাই। রসু খাঁ রেহাই পাবে না। বিচার হোক, শাস্তি হোক; তার মধ্যে আমার কিছু জিজ্ঞাসা আমি বিনিময় করতে চাই, কিছু মত যাচাইও করতে চাই। আজকে তার প্রথম কিস্তি।

১. রসু খাঁ এভাবে এমনিতেই কাবু নৈতিকতার এই পুরুষালি সমাজের অনৈতিকতার বিষবটিকা হিসেবে হাজির হয়েছে। শয়তানের বিপরীতে যেমন দেবতারা পূজিত হন, রসু খাঁ-র বিপরীতের তেমনি আদর্শ হবেন তারা, যারা রসু খাঁ নন। তাকে ঘৃণা করে নীতির মেরুদণ্ডকে পোক্ত করার এই সুযোগ কে ছাড়ে? আইন তাকে শাস্তি দিয়ে মহিমান্বিত হবে। পুলিশ পাবে বাহবা, মিডিয়া পাবে জনমত গঠনের শিরোপা। তাকে শাস্তি দিয়ে আইন ‘অশুভ’কে কোরবানির মহিমা নেবে। নৈতিক পরিতৃপ্তির ঢেকুর উঠবে সমাজের চিকন ও ফোলা সব উদরে। এর মাধ্যমে সবকটি প্রতিষ্ঠান ও সমাজের প্রায় সকল অংশ রসু খাঁর বিরুদ্ধে নিজেদের মধ্যে গভীর বন্ধন অনুভব করবে এবং তার শাস্তিদান প্রক্রিয়ায় একজোট হবে। রসুহীন সমাজ হবে আগের থেকে ‘মানবিক’। এক রসু খাঁ তার ‘ভয়াবহ চরিত্র’ দিয়ে, তার বিরুদ্ধে ঘৃণার গ্রহীতা হিসেবে বাদবাকিদের শুদ্ধি ঘটাবে। কিন্তু তার পরেও পুরুষরা নিরাপদ পুরুষ হবে কি? নারীরা পাবে কি অধিকতর নিরাপত্তা? নাকি রসু খাঁ ঢাকাবাসীর ভূমিকম্পের ভয়ের মতো অচেতন ভয় হিসেবে কাজ করে যাবে?

কিন্তু আমি তাকে আলাদা ভাবতে পারছি না। একাত্তরের জেন্ডারসাইডের ভূমি কিন্তু এই বাংলাদেশী সমাজই। দিনের পর দিন এর থেকে ভয়াবহ খুন-ধর্ষণ চালানো রাজাকারেরা, দিনের পর দিন পরিকল্পিতভাবে ক্রসফায়ার করে চলা বীরেরা, টর্চার সেলে বীভৎস অত্যাচার চালনো ব্যক্তিরা, ২০০১ সালে অজস্র সংখ্যালঘু পরিবারে খুন-ধর্ষণ-পোড়ানোর নায়কেরা। পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী গ্রাম জ্বালিয়ে-কুপিয়ে গণহত্যা করা সেটলার ও সেনাবাহিনীর বীরপুঙ্গবেরা। পিলখানা হত্যাযজ্ঞের ঘাতক এবং এখন প্রায় প্রতিরাতে পিটিয়ে সেপাই মারার হোতারা, প্রতিটি বড় রাজনৈতিক দলের পোষা কিলার ও তাদের গডফাদাররা এবং মাফিয়া ব্যবসায়ীরা, কোথায় রসু খাঁ’র থেকে আলাদা? প্রেমের অভিনয় সাজিয়ে গোপনে ভিডিও করে বাজারে ছাড়ার ব্যবসা তো বিকারহীন ভাবেই চালায় অনেক পুরুষ, অপমানে কতজন নারী আত্মহত্যা করেছে তার সংখ্যা কখনো না গুণেই। এদের সিরিয়াল অপরাধের পেছনে মদদ থাকে, আইন থাকে, রাষ্ট্রীয় ছাড়পত্র থাকে, থাকে রাজনৈতিক বা আদর্শিক অজুহাত এবং কখনো কখনো মুনাফা ও সম্মানও। এসব অপরাধের নৈতিক ও আইনী চাপ শেয়ার করার জায়গা আছে বলে, এগুলো মিডিয়ায় জঘন্য-বিকৃত অপরাধ হিসেবে চিত্রিত হয় না বলেই কি এদের অপরাধ রসু খাঁ-র থেকে কম? এদের যে কারো আঘাত করবার মতা রসু খাঁর থেকে বেশি, অপরাধের রেকর্ডও অনেক গুণ বেশি। এরাও রসু খাঁর মতো চরম অপরাধ করে এসে নির্বিকারভাবে স্ত্রী-পুত্র-কন্যার প্রতি দায়িত্ব পালন করে যায়। পাথরে চুমা দিয়ে পাপ রেখে আসা, আর শয়তানের মিনারে ঢিল ছুঁড়ে পুণ্যবান হওয়ার এই অভিনয়, অপরাধীকে আমাদের বাইরের কেউ কল্পনা করে খুশি থাকার এই আত্মতৃপ্তি, রসু খাঁকে বিকারগ্রস্থ আর আমরা সবাই সুস্থ এই বিজ্ঞাপনের শান্তি আমরা নিতে পারি না। বিকার ও পাপ সব তলার নিম্নবর্গীয় বৃত্তে, যত ওপরে তত মধু আর আলো এই শ্রেণীগত বায়াস তো রসু কাহিনীর পরতে পরতে ছড়ানো।

রসু খাঁ-র লাভ এন্ড হেট-এর সমীকরণ আমাদের মধ্যে, বাকিসব পুরুষের মধ্যেও কি ক্রিয়াশীল নয়? নারীকে ডাকিনী ও দেবীর মধ্যে ভাগ করে ঘৃণা ও ভালবাসার ব্যায়াম আমাদের মনও করে না কি? রসু খাঁর বেলায় এই ভারসাম্য ভেঙ্গে গেছে এবং পুরুষের যে মূর্তি বেরিয়ে গেছে, তা কি তার মধ্যেই সুপ্ত কিন্তু সম্ভাবনাময় প্রবণতা নয়, যাকে আমরা যুদ্ধ-দাঙ্গা ইত্যাদির মধ্যে পূর্ণ রূপে আর আপাত শান্তিকালীন সামাজিক লেনাদেনার মধ্যে কম-বেশি ঘটতে দেখি না? রসু খাঁ যা করেছে যা আর কেউ কদাচ করেনি_ কম বা বেশি মাত্রায়?

না, আমি তার অপরাধের ভয়াবহতাকে খাটো করে দেখছি না। বরং ভয়াবহতাটা যে আরো ছড়ানো ভাবেই বিদ্যমান_ নারীর বিরুদ্ধে বলি, যাবতীয় অধস্তনতার বিরুদ্ধে বলি, এবং তার বিশেষ বিশেষ ছবি-ই কেবল আমাদের মিডিয়া-মারফত-জানাবুঝা অভিজ্ঞতায় ধরা পড়ে, বাকিটা আমরা ভুলে থাকি। তাই আরামে থাকি। কিন্তু কোনো প্রায় অসম্ভব, অদ্ভুত ও অসহ্য পরিস্থিতিতে তা বেরিয়ে আসে।

চার্লি চ্যাপলিনের সিটি লাইটস ছবিতে একটা অসাধারণ পরিস্থিতি আছে। এক সিরিয়াস ভদ্রলোক মশাই ভুল করে একটা ছোটো হুইসল বাঁশি গিলে ফেলেন এবং একের পর এক হিক্কার শিকার হন। বাঁশিটি তার পেটের ভেতর কোথাও আটকে থাকা অবস্থায় তার হিক্কার দমক শুরু হয়। আর বাঁশির দরজায় বাতাস লাগে। এরকম হাস্যকর অবস্থায় বেচারা যতবার হিক্কা দেয় ততবার তার পেটের ভেতর থেকে অদ্ভুত এক হুইসল বেজে উঠতে থাকে। বিব্রত বেচারা মরিয়া হয়ে শব্দটি লুকাতে যায়, কিন্তু খুঁজে পায় না কী করবে। সে বোঝাতে যায় যে যেটা বাজছে সেটা তার শরীরের অংশ নয়। ওটা বহিরাগত জিনিস, কিন্তু তা তার নিয়ন্ত্রণে নাই। ওটা আমার শরীরের ভেতর বসেই আমার সর্বনাশ ঘটাচ্ছে।

যতই ভাবি না কেন, রসু খাঁ আমাদের সমাজের বাইরের এক বিকারগ্রস্থ পাষণ্ড। সে আমাদের ভেতর বসেই বাঁশি বাজিয়ে দিয়েছে, যাতে আমরা নিজেরাই_ পুরুষপ্রধান মানুষেরা সবাই ধরা পড়ে গেছি।

আগামি কিস্তি: রসু খাঁ ফেনোমেনা বনাম আইন ও নৈতিকতার থইকাঠি।

সাবস্ক্রাইব করুন
অবগত করুন
guest

10 মন্তব্যসমূহ
সবচেয়ে পুরোনো
সাম্প্রতিকতম সর্বাধিক ভোটপ্রাপ্ত
Inline Feedbacks
View all comments
10
0
আপনার ভাবনাগুলোও শেয়ার করুনx
  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.