বহু বছর আগে বঙ্গিমচন্দ্র চট্টপাধ্যায় সেসময়কার শিক্ষিত মধ্যশ্রেণীকে সনাক্ত করেছিলেন এভাবে, “যে টেবিলে খায়, চোঙ্গা পড়ে, কমোডে হাগে কাগজে মোছে; সে-ই বাবু।” অন্যত্র বলেছিলেন, “যে পিতার কাছে হিন্দু, কেশব সেনের সামনে ব্রাহ্ম, ইয়ং বেঙ্গলের কাছে বিদ্রোহী, ভিখারির কাছে নাস্তিক, বামুনের সামনে ধর্মচারি, স্ত্রীর কাছে বীর আর সাহেবের সামনে নতজানু…সেই বাবু।” সেই বাবুরাই আজকের যুগে মধ্যবিত্ত। এখন সে সমাজে মুসলিম, রাষ্ট্রে পুঁজিবাদী, বিশ্বব্যাংকের কাছে উন্নয়নবাদী, এনজিওর কাছে সিভিল সোসাইটি, মার্কিন রাষ্ট্রদূতের কাছে ওয়ার অন টেররিজমের টেররিস্ট, বিশ্বায়নের মোহে দেশবিরোধী।
ইংরেজ আমলে যে শ্রেণীটি নিজ দেশবাসীকে বিকিয়ে দেয়ার মাধ্যমে বিত্ত অর্জন করেছিল, যারা বিদেশি শাসনের খুঁটি হয়ে কাজ করেছে, ইতিহাসের পাকেচক্রে সেই মধ্যবিত্ত সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির দোসরগিরি করে আজকের বাংলাদেশে লাটসাহেবগিরি করছে। এরা শহরগুলোকে গ্রামের বিপরীতে সাম্রাজ্যের চেকপোস্টের মতো করে বসিয়ে রেখেছে। এরা সেই করদ রাজ্যের বাধ্য জমিদার। এরাইনয়া উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বাহন এনজিওগুলো তৈরি করেছে। এদের এই জাতীয় বেঈমানের ভূমিকা সনাক্ত না করে আমাদের জাতীয় দুরবস্থার যথার্থ ডায়াগনসিস সম্ভব নয়।
এতদিন যে মধ্যবিত্তকে আমরা দেখতাম, জাতীয় রাষ্ট্রের অবসানের তালে তালে সেই আদর্শবাদী খোলসে ঢাকা জাতীয় মধ্যবিত্তের দিন শেষ। এদের তথাকথিত আলোকিত অংশ যোগ দিয়েছে নিওলিবারেল দুবৃত্তদের শিবিরে। সাম্রাজ্যবাদী আন্তর্জাতিকতা, লগ্নি পুঁজির অবাধ যাতায়াত, কর্পোরেট বিশ্বায়ন এবং গ্লোবাল মিডিয়ার কল্যাণে সে এখন আন্তর্জাতিকায়িত। এদের চালচলন ভিন্ন, এদের আচার-বিশ্বাস ভিন্ন। সাবেকি চোখে এদের প্রগতিশীল বলে ভুল হয় -এরা নারী বৈষম্যের বিরুদ্ধে, এরা প্রায় নাস্তিক, এরা অতি দেশীয়পনার গ্রাম্যতামুক্ত, এরা সমগ্র বিশ্বকেই নিজের বিহারস্থল মনে করে (পর্যটন ব্যবসা), এরা কোনো রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের প্রতি বিশ্বস্ততা দেখায় না (সিভিল সোসাইটি)| আবার এরাই নারীর পণ্যায়ন ঘটায় এবং যৌনতাকে বিক্রিযোগ্য করে হাজির করে বা তা ভোগ করে। এরা ঈশ্বরের স্থানে কর্পোরেট পুঁজিকে বসায়, এরা দেশ-রাষ্ট্রের জায়গায় সাম্রাজ্যের নাগরিক হয়| এরা খাল কেটে কুমীর আনে (এনজিও-কর্পোরেট)।এগুলো লক্ষণ, তবে গুণের দিক থেকে অনেক গুণধর এর বাইরেও আছেন দেশে ও বিদেশে। কেউ এই বিশ্বায়িত মধ্যবিত্তকে মোবাইল সিটিজেন বলেছেন। আবার অরূন্ধতি রায় ও আশীষ নন্দী এদেরকে ভোগতাড়িত ফ্যাসিস্ট মনোভাবান্নও বলতে কসুর করেননি।এটাই তার রাজনৈতিক ভূমিকা নির্ধারণ করে দেয়| এরা ঠিক সেই ভূমিকাই পালন করছে, একদা যা তারা ইংরেজ শাসনের সুবিধাভোগী হিসাবে এবং কোলাবরেটরের ভূমিকা পালন করেছিল। হালে কেবল নাম আর পদবিগুলো পাল্টেছে। সবশেষে এদের কাঁধে ভর দিয়েই সারা হয় পুঁজির সন্ত্রাস, রাষ্ট্রের ফ্যাসিবাদ আর সাম্রাজ্যিক জুলুম।
‘সভ্যতা’ ও ‘গণতন্ত্রের’ ইন্দ্রজাল পাতা থাকে এদের চারপাশে। সেই ইন্দ্রজা এদের আর আগ্রাসী পশ্চিমা শক্তিকে একই যুক্তিবাদ একই মানবিকতা একই মূল্যবোধ আর একই উন্নয়নের তরিকায় বেঁধে রাখে। পশ্চিমা পীরের ছুঁড়ে দেয়া পাগড়ি ধরেই নাশিক্ষিত মধ্যবিত্ত এখন যা, তা হয়ে ওঠে। হয়ে উঠি পশ্চিমা অধিপতির চিরস্থায়ি বন্দোবস্তের চির মুরিদান। ব্যাপারটা কেবল বুশ-ব্লেয়ারের কারসাজি বা হান্টিংটনের উর্বর মস্তিষ্কের উস্কানি নয়। ইউরোপ যখন আলোকিত দর্শন, সাহিত্য আর মানবতাবাদের ঢেকিতে পার দিয়ে মতার/সভ্যতার কেন্দ্র হয়ে উঠছে, সেই Ôআলোকিত যুগইÕই কি এশিয়া, আফিªকা আর ল্যাটিন আমেরিকায় বর্বরতম দখল আর লুণ্ঠনের উন্মাদ কাল নয়? সভ্যতা আর বর্বরতা কি নয় একই ঔরসে জন্ম নেয়া দুই ভাই, চাঁদের এপিঠ ওপিঠ? তার নিরাকার যুক্তিবাদের তাবিজের মধ্যেই কি ফ্যাসিবাদী শ্রেষ্ঠত্বের আঁটি পুরে দেয়া ছিল না? সেকারণে, এই আধিপত্যের প্র-যুক্তি যে আধুনিক মতাদর্শে গড়া তার বিরোধিতা না করেকোনো প্রাচ্যীয় সমাজ-অর্থনীতি ও প্রকৃতি ধর্ষণের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো যায় না। দাঁড়ানো যায় না, খোদ কর্পোরেট পুঁজির জাঁতাকলে পিষ্ট হওয়া ইউরোপ আমেরিকার নীপিড়িতের সঙ্গে সহমর্মিতার পাটাতনে।
আলজিরিয় বিপ্লবী ফ্রানজ ফ্যানোর রেচেড অফ দি আর্থ বইয়ের ভূমিকা তাই সাঁত্রে স্বীকার করেন, ÔÔইউরোপীয় এলিট একটি ঔপনিবেশিক এলিট তৈরির কাজ হাতে নিয়েছিল। সম্ভাবনাময় যুবকদের তারা বেছে নিত। গনগনে লাল লোহার ছেঁকায় দাগ মেরে দেয়ার মতো পাশ্চাত্য সংস্কৃতির বুনিয়াদী নীতিমালা দিয়ে তাদের দেগে দেওয়া হতো। তাদের মুখগহ্বর ভরিয়ে দেয়া হতো গুরুগম্ভীর মহান আর ঝাঁঝালো শব্দাবলী দিয়ে। তা দাঁতে বাজতো। ঔপনিবেশিক দেশে কিছুকাল থাকার পর তাদের পাঠানো হতো নিজের দেশে। এই চলমান মিথ্যার প্রতিমূর্তিদের তরফে তখন তাদের দেশীভাইদের বলার মতো কিছুই আর থাকতো না। তারা শুধু প্রতিধ্বনি করতো। প্যারিস, লন্ডন, আমস্টারড-এ আমরা উচ্চারণ করতাম Ôপারথেনন ভ্রাতৃত্ব, আর আফ্রিকা অথবা এশিয়ার কোথাও তাদের কন্ঠ খুলে যেতো, Ô…তৃত্ত্ব তৃত্ত্ব তৃত্ত্বÕ।Ó
আমাদের সাহিত্য,বুদ্ধিবৃত্তি, রাজনীতি ও উন্নয়ন সেই ÔতারাÕর জবানীতে বর্ণিত হয়। কারণ আমাদের কথা আমরা বলতে শিখিনি। এখন আর সভ্য হওয়ার জন্য ইওরোপে যেতে হয় না, ইউরোপ চলে আসে ঘরের কাছে। দোকান খোলে বাহারি সব উন্নয়ন, প্রগতি আর আধুনিকতার। এ পণ্যের প্রচারকদের আমরা নাম দিয়েছি জাতীয় বুদ্ধিজীবী। অথচ কী পরিহাস! কোটি কোটি ÔআঁধারবাসীÕ’পশ্চাদপদ’ জনগণের কাছে এদের কোনো প্রাসঙ্গিকতাই নাই। এ বুদ্ধিজীবীদের তারা পুঁছেও দেখে না। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস যেমন বলেছিলেন, ‘এসব (গরিব) মানুষ প্রতিদিন যে পানি খায় তা দিয়ে ঐসব আলোকিত মানুষরা ছুঁচতেও রাজি হবেন না।’ তাহলেও আমাদের সাংস্কৃতিক মেরাজ বন্ধ হয় না, পশ্চিমা আরশের সংবাদের তৃষ্ণাও মেটে না আমাদের। আমাদের বাসনা চায় ইওরোপের লাওহে মাহফুজে রক্ষিত সভ্যতার আত্ম-উপভোগের শাঁস চেখে দেখার অভিযান চালাতে। এই-ই তাদের সেক্যুলার ধর্ম এবং এইই জনগণের বিপক্ষে দাঁড়াবার দার্শনিক বর্ম। তাই আমাদের মতো উপনিবেশিত দেশের সামাজিক পাঁকে আটকে থেকে কল্পনার সুষমায় পাক খেতে থাকা প্রতিটি ÔআলোকিতÕ ও ‘শিক্ষিত’ নাগরিকদের কি নিজেকে প্রশ্ন করা উচিত নয়, যে সুরভিত মোমের পাখনায় আমাদের সাংস্কৃতিক উড়াল, তা কি জাতীয় অবস্থা তথা জনগণের অকহতব্য দুর্দশা থেকে দূরে সরবারই ছল? ছল, কেননা পাখনাটা মোমের আর সংগ্রামের সূর্যের তাপে তা গলে যেতে বাধ্য। ইকারুসের মতোই।
ঔপনিবেশিক শিক্ষায় শিক্ষিতদের প্রতিবাদস্পৃহাকে আধুনিকতার আংটায় লটকে থাকে শূণ্যে। জনগণের ফরিয়াদকে যদি আমরা ধর্মের জিম্মায় রেখেই খুশি থাকি, তবে জনগণ ÔমৌলবাদেরÕ দলে গেলে আমাদের আপত্তি থাকবে কেন? জনগণের দায়িত্ব কী চেতনায় আর কী আমলে আমরা নিচ্ছি? (এর বিপরীতে আরেক জিঘাংসার রস চোঁয়াতে দেখি আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে। আরবের প্রতিরোধ দেখিয়ে বঙ্গীয় প্রাতিষ্ঠানিক ইসলাম,তথা শরিয়াবাদীদের উত্থানকে মজলুমের উত্থান বলে চালাবার চেষ্টাও দেখি। বুঝি যে, একাত্তরে প্রত্যাঘাতের জমিন তৈরি চলছে)। যে সংস্কৃতির জমিনে তাদের আগডুম বাগডুম সেই জমিনে অনেককাল তাই কিছুই ফলে না। তারা জনগণকে ভয় পায়। এই ভয় থেকে জন্ম নেয় তাদের প্রতি অবজ্ঞা ও ঘৃণা। প্রভুকেও তারা ভয় করে, কিনতু তা রূপান্তরিত হয় ভক্তিমিশ্রিত আনুগত্যে। সেকারণে একই অঙ্গে মানবতাবাদী ছটফটানি এবং সাম্রাজ্যবাদের উন্নয়ন ও আধুনিকতার জোয়ার বইয়ে দেবার উদ্দীপনার কাতরতা দেখি। আমাদের অবস্থা হয় না ঘরকা না ঘাটকা। আমাদের আত্মচৈতন্য অপরের ছাঁচে ঢালাই হবার কারণে তা এক নৈতিক সঙ্কটেরও কারণ হয়। আমাদের চৈতন্য আর সমাজ জীবনের মধ্যে এমন এক কাঁটাতারের বেড়া, যার আগম-নিগমে রক্তাক্ত হবার সম্ভাবনা। এ অবস্থা লজ্জাকর। মার্কস বলেছেন, লজ্জাও এক বিপ্লবী ব্যাপার। কারণ, সেখানে নিজেকে পাল্টাবার চেতনাগত তাগিদের বীজ থাকে।
আগে উপনিবেশিক শাসকশ্রেণীর আধিপত্য বজায় থাকতো বলপ্রয়োগের ক্ষমতায়, যাকে বলা হতো ডমিন্যান্স। শাসিতদের মধ্যে শাসকশ্রেণীর মতাদর্শ প্রোথিত করার সুযোগ তার ছিল না। বেশিরভাগ মানুষ শাসিত হলেও সাংস্কৃতিকভাবে শাসনব্যবস্থা থেকে দূরত্ব রাখতো এবং তাকে ‘অপর’ বলে ভাবতো। কিন্তু শিক্ষা-মিডিয়ার ওয়াজমাহফিল-এনজিওর প্রচারণা এবং সর্বোপরি কালচার ইন্ডাস্ট্রির পণ্যবাহিত আদর্শিক বটিকা সেবনে (ফেয়ার এন্ড লাভলি থেকে শুরু করে মোবাইলের স্বাধীনতা আর ক্ষুদ্রঋণে মুক্তির যুক্তি) তার মধ্যে মতাদর্শিক আধিপত্য বিস্তার করা সম্ভব হয়েছে। ইতিহাসে এই প্রথম আমাদের মতো উপনিবেশিক দেশে ডমিন্যান্স সাংস্কৃতিকভাবে নিজেকে গ্রহণীয় করার মতো ব্রেনওয়াশ করতে সক্ষম হয়েছে। ডমিন্যান্স এখন হেজমিনি দিয়ে কাজ সারছে।
ট্রানজিশনের সময় শ্রেণীর গাঠনিক সীমানা আর সাংস্কৃতিক সীমানা যে আবছা হয়ে যায় এবং তা যে ওভারল্যাপ করে তা খেয়াল করা জরুরি। এটা উপনিবেশিক দেশে আরো বেশি করে সত্য। রাষ্ট্র ও অর্থনীতি যখন উপনিবেশিক গড়নে চলে, তখন তার ভেতরকার সকল সম্পর্কই আসলে উপেনেবিশিক হায়ারার্কির সম্পর্ক। জাতির সঙ্গে শ্রেণীর বিচ্ছিন্নতা এবং শ্রেণীর সঙ্গে গোষ্ঠীর দূরত্বের সম্পর্ক মোটা দাগে সমান নাগরিকদের মধ্যে সম্পর্ক না, বরং আধিপত্য বনাম বশ্যতার সম্পর্ক। মধ্যবিত্ত এই সম্পর্কের পূজারি ও পুনরুতপাদক। কিন্তু একটি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে আত্মসক্ষম দেশের মধ্যবিত্তবে এরকম পরজীবীতা করতে হয় না, ইউরোপে তেমন দৃষ্ঠান্ত রয়েছে, রুশ বা চিন বিপ্লবেও তা দেখা গেছে। খেয়াল করলে দেখা যাবে, উপনিবেশিক দেশে এরকমটা ঘটেনি এবং এরকম কোথাও বিপ্লবও আসেনি মধ্যবিত্তের প্রতিবিপ্লবী চরিত্রের কারণে। আমরা বোধহয় সেই দলে পড়ি। ফলে আমাদের শ্রেণীবিশ্লেষণ আসলে আত্মবিশ্লেষণ। এবং তার মাধ্যমে যদি আমরা আমাদের চেতনার উপনিবেশায়ন ঘটাতে না পারি, তাহলে জাতীয় মুক্তির লড়াইয়ে আমাদের দেখা যাবে গণশত্রুদের কাতারে।
এই মুক্ত হবার প্রক্রিয়াকে আমি বলতে চাই ডিকলোনাইজেশন। ফ্রাঞ্জ ফ্যানো এটা বলেছিলেন, মার্কস যাকে ডিক্লাসমেন্ট বলেছেন, আমাদের এখানে তা ডিকলোনাইজেশনের ধাপে আছে। আমি মনে করি, মাওলানা ভাসানী, সুলতান, আহমদ ছফা, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, আরজ আলী মাতুব্বর এরকম ডিকলোনাইজড হওয়ার সংগ্রাম চালিয়েছিলেন যার যার ক্ষেত্রে। আর লালনের তা করার প্রয়োজন ছিল না, কারণ রবীন্দ্রনাথের মতো তাঁকে কালোনাইজেশনের খপ্পরে পড়তে হয়নি। কলোনির ঘাঁটি তখনো নদীয়ায় হানা দেয়নি, কৃষক সংস্কৃতিকে তখনও তা পরাভূত করেনি। লালন সেই কৃষক সমাজের শেষ দার্শনিক বিপ্লবী। তার সমস্যা অন্য, তিনি আধুনিক বস্তবিশ্ব এবং তার রাজনীতিকে চৈতন্যের সংকট দিয়ে বুঝেছিলেন, অর্থনীতি-রাজনীতি দিয়ে বোঝেননি। কিন্তু যতটা বুঝেছেন ,তাও আমাদের পথ দেখায়।
কলোনাইজেশন যদি মানি, তাহলে এ থেকে মুক্ত হতে ডিকলোনাইজেশনও মানতে হয়। এই ডিকলোনাইজেশনকে এভাবে বলা যায়, যে শিক্ষা-সংস্কৃতি-মূল্যবোধ ও অর্থনৈতিক জীবনে আমাদের স্ক্রুর মতো পেঁচিয়ে ঢোকানো হয়েছে সিস্টেমের তক্তায়, তাকে আবার উল্টা পেঁচে খুলে এনে অন্য জায়াগায় প্রোথিত করা। সেটা দেশের ইতিহাস–ভাষা-সংষ্কৃতি ও অর্থনীতি এবং জনস্বার্থের পাটাতনে দাঁড়ানো বৈশ্বিকতা। আমরা যতটা বৈশ্বিক হতে চাই ততটাই দেশের হৃদয়ে প্রবেশ করতে যে চাই না, একে পরজীবীতা ছাড়া আর কি বলা যায়? আমরা মধ্যবিত্তরা আধুনিকতার নামে, বিপ্লবের নামে, প্রগতির নামে আর এখন উন্নয়নের নামে যতবারই জনগণকে মুক্ত করার নামে যতবারই ডাক দিয়েছি, ততবারই ভুলে গেছি আমাদের নিজেদেরই মুক্ত করা হয়েছে কিনা চৈতন্যের মধ্যে, স্বার্থবোধের মধ্যে। মার্কস বলেছিলেন, যে মুক্তি অপরকে মুক্তি দেবে, সে নিজেই মুক্ত কিনা তা আগে দেখা দরকার। আমরা যদি জনগণকে মুক্ত করতে চাই-ই (যদিওকেউ কাউকে মুক্ত করে না, মুক্তির সহযাত্রী হয় মাত্র) তাহলে তার আগে আমাদেরকেই চেতনার দাসত্ব আর গণবিরোধী প্রবণতা থেকে মুক্ত হতে হবে। সেই কাজে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি ও স্বার্থের ভিতে নতুনভাবে আÍগঠন করতে হবে। কিন্তু একদল লোক ইদানিং দেখা যায়, যারা জনগণের সংস্কৃতির মধ্যে ধর্মের উচ্চবর্গিয় রূপ ছাড়া অন্য কিছু দেখতে পান না। যেন ধর্ম ছাড়া জনগণের সংষ্কৃতিতে আর কিছু নাই। ঠিক যেভাবে প্রাচ্যবাদীরা কুসংস্কার ছাড়া ন্যাটিভ সংস্কৃতিতে আর কিছু দেখতে পায় না। সেই সাংষ্কৃতিক রাজনীতির ভিতের ওপরই নতুন জমানার বিপ্লবী রাজনীতি দাঁড়াতে পারে। ফকির লালন সাঁই তাই আমাদের জানান, শব্দের ঘরে নৈঃশব্দ করে, সদাই তারা আছে জুইড়ে দিয়ে জীবের নজরে ঘোর টাটি, ও মিছে ঘোর টাটি পরের হাতে কলকাঠি।
আপন ঘরে পরের সংসার,
আমি দেখলাম না রে তার বাড়িঘর।
আমি বেহুশ মুটে, তার মোট বাহি,
ও তার মোট বাহি
পরের হাতে কলকাঠি।।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
১ comment
মাইনুল বাকী - ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (১:৫০ অপরাহ্ণ)
`শব্দের ঘরে নৈঃশব্দ করে, সদাই তারা আছে জুইড়ে দিয়ে জীবের নজরে ঘোর টাটি, ও মিছে ঘোর টাটি পরের হাতে কলকাঠি’ এই লাইন কয়টি কিভাবে আসবে জানাবেন।