দুর্নীতি দমনে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে

বিগত চারদলীয় জোট সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিরা বিভিন্ন দুর্নীতির মাধ্যমে বিদেশে যে কোটি কোটি টাকা পাচার করেছেন এর চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পুত্র আরাফাত রহমান কোকো ছিলেন সব টেন্ডারবাজির নেপথ্য কারিগর। এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন প্রায় একডজন মন্ত্রী এসব কথা জানা যাচ্ছে­ বিদেশের বিভিন্ন সূত্র থেকে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের দু’শীর্ষ কর্মকর্তা এ বিষয়ে ঢাকা সফরে গেলে দেশজুড়ে হৈ চৈ পড়ে। খবর আসতে থাকে মিডিয়ায়ও।
বিএনপি-জামায়াত সরকার দেশে যে একটি চরম ত্রাসের রাজস্ব কায়েম করেছিল তা কারও অজানা নয়। শীর্ষ নেতারাই শুধু নয়, বিভিন্ন অঞ্চলে দলীয় নেতা-কর্মীরাও তৈরি করেছিল নিজস্ব মগের মুল্লুক। রিকশাওয়ালা, ঠেলাওলায়া থেকে বারকি শ্রমিক কারও কাছ থেকে চাঁদা নিতে তারা বাকি রাখেনি। তাদের লক্ষ্য ছিল এভাবে স্খায়ী লুটপাটের রাজস্ব কায়েম করা এবং ক্ষমতার স্খায়ী ইজারা নেয়া। হাওয়া ভবনে মস্তান পোষা হচ্ছিল সেসব কারণেই।
বলতে হবে বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য ভাল বলেই ওয়ান-ইলেভেনের মাধ্যমে এই সিন্ডিকেটের কোমর ভেঙে দেয়া সম্ভব হয়েছে। উঠতি চাঁদাবাজরা মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য হয়েছে। বিএনপি জামায়াত জানতো সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তারা ভরাডুবির মুখে পড়বে। তাই তারা নির্বাচন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সব ধাপ সম্পন্ন করে রেখেছিল আগে-ভাগেই।
২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে একটি গণনির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই সরকার ক্ষমতা গ্রহণের মাত্র কয়েকদিন পরই যুক্তরাষ্ট্রে মামলা হয়েছে মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে কোকো গংয়ের বিরুদ্ধে। বর্তমান আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেছেন, রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সব সহযোগিতা দেয়া হবে। অন্যদিকে বিএনপি বলা শুরু করেছে জিয়া পরিবারের ইমেজ ক্ষুণí করার জন্য এমন মামলা করা হয়েছে।
দেখতে হবে মামলাটি কে করেছে? মামলাটি করেছে বিদেশী সংস্খা। তারপরও বিএনপি নানা ছল-ছুঁতোয় সরকারকে গালমন্দ শুরু করে দিয়েছে। যা অনেকটাই শাক দিয়ে মাছ ঢাকার শামিল। কারণ তারা জানে, তারা দুর্নীতি করেছে এবং তাদের হাতগুলো কলুষিত। বিদেশে অর্থপাচারে জড়িত সাবেক মন্ত্রীদের নাম দেশবাসী এখনও জানে না। আইনমন্ত্রী বলেছেন, শিগগিরই নামগুলো জানতে পারবে দেশবাসী। প্রথমে বলা হয়েছিল ২০০ মিলিয়ন ডলার। এখন জানা গেছে হাজার হাজার মিলিয়ন ডলার।
এটর্নি জেনারেল সালাহউদ্দিন আহমদ তার পদত্যাগপত্র সরকারের কাছে জমা দিয়েছেন। নতুন সরকার এলে এসব গুরুত্বপূর্ণ পদে পরিবর্তন আসে সেটাই নিয়ম। পদত্যাগী এটর্নি জেনারেলও বলেছেন, সাবেক জোট সরকারের দুর্নীতির নেটওয়ার্ক ব্যাপকভাবে বিস্তৃত ছিল।
দুই.
আইনমন্ত্রীর একটি সাক্ষাৎকার দেখলাম চ্যানেল আইতে। এই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, আমি টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী। তাই রাষ্ট্রের জনগণের প্রতি আমার দায় বেশি। তার এই কথাগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তিনি জনগণের স্বার্থ রক্ষার জন্য আইনি দিকগুলো দেখার জন্যই মনোনীত হয়েছেন।
কিন্তু কথা হচ্ছে আইনমন্ত্রী দেশে কতটুকু স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করতে পারবেন? অতীতের অভিজ্ঞতা খণ্ডন করে তিনি কি হতে পারবেন দেশের মানুষের ন্যায়বিচার পাওয়ার মন্ত্রী প্রতিভ? এ প্রশ্নটি থেকেই যাচ্ছে।
বলতে দ্বিধা নেই, ব্রুট মেজরিটি পাওয়া আওয়ামী লীগের সামনে সময়টি মোটেই কুসুমাস্তীর্ণ নয়। জাতি তাদের বেশকিছু গুরুদায়িত্ব দিয়েই সংসদে পাঠিয়েছে। এর মধ্যে ঘাতক-যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, বঙ্গবু হত্যা মামলার রায় কার্যকর, কঠোর হস্তে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমন, দুর্নীতি প্রতিরোধ, কর্মসংস্খান তৈরি, ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের প্রত্যয় অন্যতম।
কিন্তু কথা, এর প্রতিটি কাজেই বাধা হয়ে দাঁড়াবে একটি মহল। এরা কোন মতেই চাইবে না আওয়ামী লীগ দেশের ম্যানিফেস্টো বাস্তবায়ন করার মতো কর্মকাণ্ড এগিয়ে নিয়ে যাক। দুর্নীতিতে কোকোর সম্পৃক্ত থাকার ইস্যুকে কেন্দ্র করে বিএনপি প্রথম থেকেই নেতিবাচক মনোভাব দেখিয়ে দেশে আন্দোলন-হরতাল শুরু করে দিতে পারে। তাদের শীর্ষ মন্ত্রীদের সম্পৃক্ত থাকার তালিকা প্রকাশ পাওয়ার পরপরই তারা বিভিন্নভাবে মারিয়া হয়ে উঠতে পারে। ভুলে গেলে চলবে না দেশে জঙ্গিবাদী চক্রের মদদদাতা কিন্তু এই ডানপন্থি চক্রটিই। যারা ‘বাংলাদেশী’ জাতীয়তাবাদের দোহাই দিয়ে এতদিন থেকেই গণমানুষের ‘আইওয়াশ’ করে আসছে। প্রয়োজনে এরা দেশে এই  জঙ্গিবাদী চক্রকে আরও সক্রিয় করে তুলতে পারে সে ভাবনাও উড়িয়ে দেয়ার নয়।
আমরা প্রত্যক্ষ করছি দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইতোমধ্যেই নানা রকম সংঘর্ষ হয়েছে। এটা শুভ লক্ষণ বলা যায় না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন এটাকে ছাত্রদল কিংবা বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল বলে ইতোমধ্যেই সমালোচিত হয়েছেন।
গোলযোগ, ত্রাস যেই করুক না কেন তাকে শক্ত হাতে দমন করতে হবে সর্বশক্তি দিয়ে। কারও দলীয় কোন্দল বললেই দায়িত্ব শেষ হওয়ার নয়। কোন সরকার ক্ষমতায় এলে ‘সরকারি পার্টি’ হয়ে যাওয়ার ধান্দা নতুন নয়। এসব মধ্যস্বত্বভোগীদের ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে।
সংসদ কার্যকর করার ব্যাপারে বিএনপি সহযোগিতা দেবে এটা বললেও কার্যত তারা কি করবে তা দেখার বিষয়। কারণ তাদের রাঘববোয়ালরা দুর্নীতিবাজ প্রমাণিত হওয়ার আশঙ্কাটি দেশে-বিদেশে প্রকটভাবে প্রমাণিত হলেই তারা গোলযোগের দিকে এগুতে পারে। তারা ইতোমধ্যেই ২৫ জানুয়ারিকে ‘বাকশাল প্রতিষ্ঠা দিবস’ আখ্যাতি করে প্রথম দিন সংসদে যোগ না দেয়ার পাঁয়তারা করছে। যা তাদের হীনমন্যতারই বহি:প্রকাশ।
নতুন এটর্নি জেনারেল এডভোকেট মাহবুবে আলম দায়িত্ব নিয়েছেন। রাষ্ট্রের আইনি স্বার্থরক্ষায় তার এই যাত্রা শুরু হচ্ছে বেশ কঠিন সময়ে। মনে রাখতে হবে দুর্নীতি দমনের প্রথম ধাপটি হচ্ছে সরকারি দলের স্বেচ্ছাচারিতা রোধ করা। প্রধানমন্ত্রীকে এই বিষয়টি দেখতে হবে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভেতরের একটি অপশক্তি সব সময়ই তৎপর থাকে। যে শক্তিটি জন্মদিয়েছিল একজন মীরজাফর খন্দকার মোশতাক। এর যে পুনরাবৃত্তি ঘটবে না তা কেউ বলতে পারবে না। তাই চলার পথটিকে খুব মন্থন ভাবার সুযোগ নেই। দুর্নীতি, লুটপাট দমনে জনগণ সবসময়ই সোচ্চার। তারা সরকারকে অতীতে সাহায্য করেছে, ভবিষ্যতেও করবে। আমি বিনীত অনুরোধ করব মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেন দু:খিনী বাংলা মায়ের মুখ-স্মৃতিটি ভুলে না যান কখনোই।
নিউইয়র্ক, ১৪ জানুয়ারি ২০০৯

ফকির ইলিয়াস

একটা সূর্য চাই, একটা চন্দ্র চাই / নদীর নীরব নগরে পসরা সাজাই ।।

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.