বাংলাদেশে এখন শীত মৌসুম চলছে। শীতের চাদরে মোড়া গ্রামবাংলা। সদ্য কেটে তোলা ফসলের ধূসর মাঠ। কিছুটা শুষ্ক আবহাওয়া আর শিমুল-বকুল ফুলে সুশোভিত ফুটপাত। পৌষ-মাঘে বাংলাদেশের যে নয়নাভিরাম দৃশ্য অবলোকন করা যায় তা সত্যি প্রকৃতির এক অপূর্ব শোভা। এ সময়ে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী বিল-ঝিলগুলোকে আরো মুখরিত করে তোলে বিদেশি অতিথিপাখিরা।
বাংলাদেশে এসব পাখির দলগুলো আসে ভারত, নেপাল, শ্রীলংকা, চীন, সাইবেরিয়া প্রভৃতি অঞ্চল থেকে। ওসব দেশে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা পড়ায় পাখিগুলো দল বেঁধে অবকাশ কাটাতে অপেক্ষাকৃত কম শীতের দেশে চলে আসে। কিন্তু বাংলাদেশে এসে এসব পাখি নিরাপদ থাকতে পারে না। শিকারিদের জাল তাদের বন্দি করে। তারপর পাখিগুলো পণ্য হয় বাজারে বাজারে। শিকারিরা ‘শিকার শিকার’ বলে চিৎকার দিতে দিতে পাখিগুলো বিক্রি করে দেশের শহরে শহরে। উচ্চবিত্ত ধনীরা চড়া দামে পাখিগুলো কিনে নিয়ে তাদের রসনার তৃপ্তি জোগান।
বাংলাদেশে অতিথি পাখি নিধন চলছে গেল প্রায় দুই যুগ থেকেই। পাকিস্তান আমলে বড় ধনীরা বন্দুকের লাইসেন্স নিতেন। তারপর তাঁরা দলবল নিয়ে বেরুতেন পাখি শিকারে। ঝাঁক ঝাঁক পাখির ওপর চলত তাদের কার্তুজ। তা ছিল এক ধরনের সামন্তবাদী মানসিকতার বিকৃত সুখ। পাখির মাংস বড় জমিদারদের ভোজনবিলাসে উপাদেয় আইটেম হতো।
মহান মুক্তিযুদ্ধের পর বন্দুকের লাইসেন্সের ওপর কিছুটা কড়াকড়ি করার পর দল বেঁধে পাখি শিকারের প্রবণতা কিছুটা কমতে থাকে। তাছাড়া দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিবেকবান মানুষের জাগ্রত বিবেকের কাছে হার মানতে থাকে সনাতনী মানসিকতা। বন্দুক বা এয়ারগান দিয়ে পাখি শিকারের প্রবণতা অনেকটা কমে আসে; কিন্তু বেড়ে যায় বাণিজ্যিকভাবে জাল ফেলে পাখি ধরার কার্যত্রক্রম। সরকার এ ব্যাপারে বিধিনিষেধ আরোপ করেও কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়নি। এ বছরের শীতের শুরুতেই পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী, উত্তরবঙ্গ, যশোর সীমান্তবর্তী এলাকা এবং সিলেটের জাফলং, তামাবিল, ভোলাগঞ্জ সীমান্ত অঞ্চলে পাখি ধরার ব্যাপক হিড়িক পড়েছে। প্রকাশিত খবর অনুযায়ী আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের নাকের ডগার ওপর দিয়েই চলছে এসব শিকার। এ সুযোগে এসব সংস্থার সদস্যরাও কামিয়ে নিচ্ছে টু-পাইস।
একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে গেল কয়েক বছর ধরে ইলিশ উৎপাদন অত্যন্ত নিম্ন পর্যায়ে রয়েছে। বাজারে গত বছর ইলিশ মাছ ছিল দুষ্প্রাপ্য। যা পাওয়া গেছে তাও বিক্রি হয়েছে অত্যন্ত চড়া মূল্যে। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশের প্রাণীবিজ্ঞানীরা গত ১০ বছর ধরেই সে আশঙ্কা প্রকাশ করে আসছিলেন। বিশেষ কাজে জাটকা মাছ ধরার প্রবণতা থেকে সে আশঙ্কা প্রকট হয়ে উঠেছিল। জাটকা নিধন বন্ধ করার জন্য সরকারি প্রচেষ্টা যথেষ্ট ছিল না। এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী জাটকা নিধন করে টাকা বানাতে ছিল তৎপর। সেই কুফল এখন দেশের জনগণ ভুগতে শুরু করেছেন।
বাংলাদেশের সুস্বাদু ইলিশ মাছের একটি ভালো বাজার ছিল বিদেশেও। ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা, মধ্যপ্রাচ্যের বাঙালি গ্রোসারিগুলোতে বাংলাদেশের ইলিশ মাছের ভালো কাটতি ছিল। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় দেখেছি, ২০০৭ সালের শেষদিকে নিউইয়র্কের বাঙালি গ্রোসারিগুলোতে বাংলাদেশের ইলিশ মোটেই পাওয়া যায়নি। সে স্থানটি এখন দখল করে নিয়েছে মিয়ানমারের তুলনামূলক কম সুস্বাদু অপুষ্ট ইলিশ। বাংলাদেশ বঞ্চিত হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা আয় থেকেও।
এটা দুর্ভাগ্যজনক যে, প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় বাংলাদেশের সরকার ও সিংহভাগ জনগণ উদাসীন ভূমিকা পালন করছে। বৃক্ষ নিধন করে ব্যক্তিস্বার্থ, দলীয় স্বার্থ হাসিল করা হচ্ছে। প্রকৃতি হত্যার অপরাধটুকু কেউ যেন অনুধাবনই করতে পারছেন না। উজাড় হয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের বনাঞ্চল। কমে যাচ্ছে ক্রমেই সবুজ আবহ।
পাখি, বাঘ, হরিণসহ প্রভৃতি প্রাণী নিধনের ব্যাপারে বন ও পশুপালন অধিদপ্তরের নিজস্ব বিধিনেষধ রয়েছে। কিন্তু খোঁজ করলে দেখা যাবে, অনেক পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, মন্ত্রী, আমলাই অতিথি পাখির প্রধান ক্রেতা। হরিণের সুস্বাদু মাংস দিয়ে ভূরিভোজন তাঁদের প্রিয় শখগুলোর অন্যতম।
বাংলাদেশে দুর্লভ জাতের গুই, গোখরা সাপ মেরে এর চামড়া বিদেশে বিক্রি করা হচ্ছে চড়া মূল্যে। তা করছে একটি সংঘবদ্ধ দল। মাছ, পাখি, সাপসহ বিভিন্ন প্রজাতির দুষ্প্রাপ্য প্রাণী ক্রমেই বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ থেকে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে, বাংলাদেশেও এখন ইলিশ মাছ আমদানি করা হচ্ছে মিয়ানমার থেকে। আমদানি হচ্ছে অন্যান্য মাছও। পশুপাখি সংরক্ষণ এবং পরিবেশ রক্ষায় বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের এগিয়ে আসা উচিত। কারণ এ সমস্যা একটি জাতীয় সমস্যা। দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ বিনষ্ট হলে তার ভুক্তভোগী হতে হবে সারাদেশের মানুষকে। বন ও পরিবেশ বিষয়ক মন্ত্রণালয় কি এ ব্যাপারে একটু দায়িত্বশীল হবে?
