অভিবাদন বাংলাদেশ!

অভিবাদন বাংলাদেশ! স্যালুট বাঙালি জাতি। আবার তারা দেখিয়ে দিয়েছে, এই জাতির স্বপ্ন ফুরিয়ে যায়নি। আবার তারা প্রদর্শন করেছে সেই মনন, যা একাত্তরে মুষ্টিবদ্ধ হয়েছিল একটি পতাকার স্বপক্ষে। ২৯ ডিসেম্বর ২০০৮ বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় দিন। বিজয়ের মাসে, আরেকটি মহাবিজয় ছিনিয়ে নিয়েছে এই প্রজন্ম। তারা রায় দিয়েছে দিন বদলের পক্ষে। এদেশের নারীসমাজ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছেন, এই দেশ সর্বশ্রেণীর ধর্মপ্রাণ মানুষের। এই দেশ মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িকদের নয়। এদেশের মেহনতি জনতা জানিয়ে দিয়েছে, জঙ্গিবাদ এবং তার গডফাদার-গডমাদারদের স্খান নেই ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তেভেজা বাংলার মাটিতে।

নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এই মহাজোটের বিশাল বিজয় প্রত্যাশিত ছিল যদিও, তবুও চমকে গেছে বিশ্ববাসী। কারণ সত্তরের নির্বাচনের পর এই প্রথমবারের মতো সুদৃঢ় প্রজ্ঞা দেখিয়েছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলার মানুষকে সঙ্গে নিয়ে, অনেকটা একাত্তরের মতোই। দেখেছি, ‘নৌকা’ প্রতীক নিয়ে  অনেক স্বল্প পরিচিত নতুন প্রার্থী জিতে এসেছেন বিপুল ভোটে ধরাশায়ী করেছেন প্রবীণ কোন রাজনীতিককে। এর কারণ কি? কারণটি হচ্ছে বাংলাদেশের মানুষ একটি ব্যাপক পরিবর্তন দেখতে চেয়েছে। তারা চেয়েছে অপেক্ষাকৃত তরুণ নেতৃত্ব দেশ পরিচালনার ভার তুলে নিক। নতুন মেধাবীরা এগিয়ে আসুক। হয়েছেও তাই। ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস, তৌহিদ জং মুরাদ, এডভোকেট শামসুল আলম টুকুর মতো তেজী তরুণরা পাস করেছেন এই তরুণ ভোটারদের ভোটেই। প্রবীণরা পাশে থেকে জুগিয়েছেন প্রেরণা। প্রমাণিত হয়েছে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশের তরুণরা রাষ্ট্র পরিচালনার সঠিক গাইডেন্সই পাচ্ছে এবং পাবে।

এবারের নির্বাচনে বিশাল জয় হয়েছে বাংলাদেশে অসম্প্রাদিয়ক চেতনার। আমরা দেখেছি ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই’­ এই দাবি নিয়ে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রজন্ম রাজপথে দাঁড়িয়েছে ব্যানার হাতে। তারা রুখে দিয়েছে কুখ্যাত আল বদর রাজাকারদের। জঙ্গিবাদী পাষণ্ডরা পরাজিত হয়েছে শোচনীয়ভাবে। চারদলীয় জোটের সাবেক মন্ত্রীদের প্রায় সবাই পরাজিত হয়েছেন। তারা তাদের ক্ষমতাসীন সময়ে কি করেছিলেন সে হিসাবটি মিলিয়ে দেখলে তারা নিজেদের পরাজয়ের অনেক উপাত্ত পাবেন। এদের অনেকের নির্বাচনে প্রার্থী হওয়াই উচিত ছিল না। তারপর লজ্জার মাথা খেয়ে তারা প্রার্থী হয়েছিলেন। বিশেষ করে বলা যেতে পারে সাইফুর রহমান, মওদুদ আহমদ,  খোন্দকার দেলোয়ার প্রমুখের কথা।

ব্যক্তিগত জীবনে আমি সিলেট সদরের বাসিন্দা আর মৌলভীবাজারের জামাই। তাই সাইফুর রহমানের দু’টি আসনের প্রতিই আমার চোখ ছিল জাগ্রত। অত্যন্ত আনন্দ ও সাহসের সঙ্গে দু’টি আসনেই সাধারণ মানুষ সাইফুর রহমানকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। হযরত শাহজালাল (র.) আর তার অন্যতম সঙ্গী হযরত শাহ মোস্তফার (র.) মাটি সিলেট ও মৌলভীবাজার জানিয়ে দিয়েছে সেখানে কোন জালেম নেতার ঠাঁই নেই। গণমানুষের এই শাণিত বিজয় আমাকে আশান্বিত করেছে ব্যাপকভাবে। গৌরবান্বিত হয়েছি এই অঞ্চলের মানুষের ঐক্যবদ্ধতায়, সব দানবীয়তার বিরুদ্ধে।

সিলেট বিভাগের ১৯টি আসনের মধ্যে সব ক’টিই ছিনিয়ে নিয়েছে মহাজোট। ১৭টিতে আওয়ামী লীগ এবং দু’টিতে জিতেছে জাতীয় পার্টি। বাংলাদেশের মানুষের এই মহাবিজয়ের দিনে আজ কিছু শোকস্মৃতি স্মরণ করে মনটাকে লাঘব করতে চাই। এই সিলেটের মুজাররদে ইয়ামেনি হযরত শাহজালাল (র,)-এর মাজারের পুকুরে বিষ প্রয়োগ করা হয়েছিল। এই পবিত্র মাজার-মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করতে গিয়ে বোমা হামলার শিকার হন, সিলেট বিভাগেরই কৃতী সন্তান তৎকালীন ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী। এই সিলেট বিভাগের হবিগঞ্জে নিজ এলাকায় রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে শাহাদাতবরণ করেন দেশের কৃতী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া। আর তা সবই ঘটে খালেদা-নিজামীর চারদলীয় জোটের দু:শাসনের কালে। জঙ্গিতন্ত্রের একটি খোয়াড়ে পরিণত করা হয়েছিল দেশটিকে। কোন হীন কাজটি করেনি তারা? তারপরও তারা পবিত্র সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছে, দেশে কোন জঙ্গি নেই। এমন মিথ্যার বেসাতির মধ্য দিয়েই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া একে একে উসকে দিয়েছিলেন তার পালিত মন্ত্রীদের। শেখ হাসিনার জনসভায় বোমা হামলার সঙ্গে সাবেক মন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর সম্পৃক্ত থাকার ঘটনা প্রমাণ করে কত জঘন্য হীনম্মন্য হয়ে উঠেছিল চারদলীয় জোট সরকার। কতটা উগ্র ছিল তারা।

দেশের মানুষ ভোট বিপ্লবের মাধ্যমে সেসব দুর্বৃত্তপনার সমুচিত জবাব দিয়েছেন। শেষ মুহর্তে এসে পল্টনের জনসভায় নির্বাচনী কৌশলে ‘ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টি’ কামনা করেছিলেন খালেদা জিয়া। মনে করেছিলেন, এতে বোধহয় শেষ রক্ষা হতে পারে! না­তাও হয়নি, দেশের মানুষ বুঝে নিয়েছে জঙ্গিতন্ত্রের চালাকি। আর তাই শক্ত হাতে দমন করতে উদ্যত হয়েছে সব অশুভ শক্তিকে।

এবারের নির্বাচনে বেশ কিছু বামপন্থি প্রজ্ঞাবান নেতাও জিতেছেন। জাসদের হাসানুল হক ইনু, মঈনুদ্দিন খান বাদল, ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন, এলডিপির কর্নেল (অব.) অলি আহমেদ জিতেছেন। একটি আলোকিত বাংলাদেশ গঠনে এসব নেতা তাদের ধ্যানী মনন কাজে লাগাবেন বলে আমার বিশ্বাস।
মনে রাখতে হবে বিজয় অর্জনের চেয়ে তা ধরে রাখা এবং ওয়াদাপরণ করা কঠিন কাজ। দু:খের  সঙ্গেই বলতে হচ্ছে, চিহ্নিত আলবদর নেতারা এবার গণভোটে হেরে গেলেও, চট্টগ্রামে রাজাকার মুওদুদীপন্থি জামায়াতের দু’জন এমপি পাস করেছে। পাস করেছে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী সা. কা. চৌধুরীও। এসব দুষ্টচক্র সম্পর্কে জাতিকে সজাগ থাকতে হবে। লক্ষ্য রাখতে হবে তাদের গতিবিধি।

বিজয়ের পর সিলেট-১ আসনের বিজয়ী প্রার্থী আবুল মাল আবদুল মুহিত চ্যানেল আইকে একটি তাৎক্ষণিক সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, জাতির দেয়া আমানত রক্ষার্থে ব্যাপক কর্মযজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়াই হবে মহাজোটের কাজ। আমি আবেগাপ্লুত হয়েছি, যখন দেখেছি সিলেট-২ আসনের বিজয়ী আওয়ামী লীগ নেতা শফিকুর রহমান চৌধুরী মুহিতকে জড়িয়ে ধরে অশ্রুসিক্ত হয়েছেন। অগ্রজপ্রতিম শফিকুর রহমান চৌধুরী দীর্ঘদিন ব্রিটেন প্রবাসী ছিলেন। তিনি বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে হবেন লাখ লাখ প্রবাসী বাঙালির প্রতিনিধি। ব্রিটেনে এই শফিকুর রহমান চৌধুরীর অনেক ত্যাগ ও আদর্শগত সংগ্রামের প্রত্যক্ষ সাক্ষী আমি।  তিনি তার সেই শাণিত চেতনা নিয়েই গণমানুষের পক্ষে সংসদে দাঁড়াবেন সে প্রত্যাশা করছি। মহাজোটের বিজয়ী সব সাংসদকে
আমার প্রাণঢালা অভিনন্দন। জয় বাংলা ।
নিউইয়র্ক / ৩১ ডিসেম্বর ২০০৮

সাবস্ক্রাইব করুন
অবগত করুন
guest

2 মন্তব্যসমূহ
সবচেয়ে পুরোনো
সাম্প্রতিকতম সর্বাধিক ভোটপ্রাপ্ত
Inline Feedbacks
View all comments
2
0
আপনার ভাবনাগুলোও শেয়ার করুনx
  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.