দু’হাজার আট-এর ডিসেম্বর মাসটি বাঙালির জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মাস। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। নির্বাচনে জিতে কারা ক্ষমতায় যাবেন তা নিয়ে সর্বত্র জল্পনা। ইতোমধ্যে ১৭ ডিসেম্বর থেকে জরুরি অবস্থা তুলে নিচ্ছে সরকার। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট, আর বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে।
মহাজোটের অন্যতম শরিক জাতীয় পার্টি। সাবেক স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদের এই দলটি অনেক দরকষাকষি শেষে ৪৯টি আসন নিয়ে মহাজোটে থাকতে পেরেছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সাবেক স্বৈরাচারী শাসক এরশাদের জাতীয় পার্টির ঐক্য আদৌ হওয়া উচিত ছিল কি না তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন। কারণ এই এরশাদ শাহীর অবৈধ ক্ষমতায় থাকার নয় বছরে দেশে গণতন্ত্রকে হত্যার ব্যাপক তৎপরতা লক্ষণীয় ছিল। অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের জন্য আদালতে মামলা হয়েছিল এরশাদের বিরুদ্ধে। সেলিম, দেলওয়ার, ডা. মিলন, বসুনিয়া, নূর হোসেন প্রমুখ শহীদদের বুক ঝাঝরা করা হয়েছিল এই স্বৈরশাসকের মসনদ বাঁচাবার জন্যই। ব্যাপক রক্তপাতের মাধ্যমে সৃষ্ট নব্বইয়ের গণ-আন্দোলন এরশাদের পতনের সূত্রপাত করে। তিনি ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ান।
জাতির জীবন থেকে এই যে একটি দশক অবৈধভাবে ছিনিয়ে নিয়েছিলেন জেনারেল এরশাদ এর কোনো কৈফিয়ত তিনি কি রাষ্ট্রের জনগণকে দিয়েছেন? না, দেননি। বরং আজ তিনি আরেকটি প্রধান দলের ঘাড়ে সওয়ার হয়ে রাষ্ট্রের নিয়ামক হওয়ার স্বপ্নে বিভোর আছেন। এ দুর্ভাগ্যটি গোটা রাষ্ট্রের মানুষের।
অন্যদিকে বিএনপি এমন একটি দলের সঙ্গে মোর্চা করে নির্বাচন করছে, যারা মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় গোটা জাতির স্বপ্নের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল। গণহত্যা, ধর্ষণ, নারীর সম্ভ্রমহানি, লুটপাট, বুদ্ধিজীবী হত্যাসহ কোন হীন কাজটি রাজাকার আলবদররা করেনি? সেই বদর বাহিনীর প্রধান কর্ণধারদের মন্ত্রীত্ব দিয়ে বিএনপি তাদের মসনদ পাকাপোক্ত করার কাজটি সম্পন্ন করেছিল বিনাদ্বিধায়। ২০০৮-এর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সেই রাজাকার চক্রের সঙ্গেই ঐক্য করে মেনিফেস্টো দিচ্ছে বিএনপি।
বাংলাদেশের সিংহভাগ মানুষ মনে করেন আওয়ামী লীগ জাপার সঙ্গে ঐক্য না করেও নির্বাচনে ভালো ফলাফল পেতে পারতো। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনাকে সংশয়বাদী বলেই মনে হয়েছে। অনেকেই মনে করেন বর্তমান প্রেক্ষাপটে এরশাদের জাতীয় পার্টি এককভাবে নির্বাচন করে দেশে বড়জোর দশটি আসন পেতে পারে। বিষয়টি শেখ হাসিনা তার বিভিন্ন জরিপ-সমীক্ষায় জানতে-বুঝতে পেরেছেন বলেই আমি বিশ্বাস করি। তারপরও পতিত স্বৈরাচারের সঙ্গে মহাজোট করার প্রয়োজন কি জরুরি ছিল? হয়তো জাপাকে বিএনপি জোটে যাওয়া থেকে বিরত রাখতেই এমনটি করেছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু মনে রাখতে হবে, মহাজোট যদি ক্ষমতায় যায় তবে এই সুযোগে জাপা আবারো তাদের দলকে সুসংহত করার কাজটি সেরে নেবে। এবং তা করবে আওয়ামী লীগের ঘাড়ে ভর করেই। যেমনটি দুই পদে মন্ত্রিত্ব পাওয়ার পর জামায়াত করেছিল বিগত জোট সরকারের আমলে।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন এমনি এক সময়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যখন দেশে ওয়ান-ইলেভেন নামক একটি পরিবর্তনের ঝড় বয়ে গেছে বেশ জোরেশোরেই। মামলা হয়েছে বেশ কিছু প্রধান রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে। বেশ কিছু শীর্ষ রাজনীতিক প্রার্থী হওয়ার অযোগ্য ঘোষিত হয়েছেন। ঋণখেলাপি, বিলখেলাপি প্রমাণিত হলে প্রার্থী হওয়া যাবে না- তা এই প্রথমবারের মতোই দেখছে বাংলাদেশের মানুষ। যা একটি বিশেষ আশাজাগানিয়া দিক।
অন্যদিকে, দুটি প্রধান রাজনৈতিক দল তাদের বেশ কিছু রাজনীতিককে মনোনয়ন দেয়নি। এদের বিরুদ্ধে সংস্কারপন্থী হওয়ার অভিযোগ আনলেও প্রধান শীর্ষদের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দই কাজ করেছে নেপথ্যে। যেভাবেই হোক, বেশ কিছু নতুন মুখ এসেছে প্রার্থী হয়ে উভয় বড় দলেই। এটা ওয়ান-ইলেভেনের একটি অর্জন বলা যায়। সাঁইত্রিশ বছর বয়সী বাংলাদেশে উন্নয়নের প্রধান অন্তরায় হচ্ছে রাজনীতিকদের ব্যর্থতা, লুটপাট এবং ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে জনগণের শক্তিকে বিনষ্ট করে দেয়া। যারা একাত্তরে পরাজিত হয়েছিল, সে সব রাজাকারচক্র স্বাধীন বাংলাদেশে সব সময়ে একটি নেপথ্য নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে চেয়েছে এবং তা করতে গিয়ে তারা শেষ পর্যন্ত প্রত্যক্ষ জঙ্গিবাদকে মদদ দিতেও কসুর করেনি। দেশের স্থিতিশীলতা ধ্বংস করাসহ দেশের ভাবমূর্তি এরা ক্ষুণœ করেছে। বোমা হামলা করে মানুষ হত্যা করেছে নৃশংসভাবে। সেই হায়েনাচক্র ২০০৮-এর নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে বিভিন্ন ব্যানারে। একাত্তরের পরাজিত শক্তি জামায়াত আজ দাম্ভিকতা নিয়ে বলছে, তারা ক্ষমতায় গেলে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা বাড়াবে। তারা এটাও বলে বেড়াচ্ছে চারদলীয় জোটের সময়ই মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়টির জন্ম তারাই দিয়েছিল! এর চেয়ে বেদনাদায়ক একটি জাতির জন্য আর কি হতে পারে? ঘাতকরাই আজ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা বাড়াবার অঙ্গীকার করার মতো উপহাস করছে!
আসন্ন সংসদ নির্বাচনে কাদের জেতা উচিত? কারা জিতলে জনগণ জিতবে? এই প্রশ্নটি খুবই প্রাসঙ্গিক। কারণ একটি জাতি এমন পরিকল্পিত আঁধারে নিমজ্জিত থাকতে পারে না। এর থেকে বেরিয়ে আসা উচিৎ। বেরিয়ে আসতেই হবে। এবারের নির্বাচনে স্বতন্ত্র এবং ছোট ছোট দলের বেশ কিছু যোগ্য প্রার্থী মাঠে আছেন। এদের অনেকেই সৎ এবং নিবেদিতপ্রাণ রাজনীতিক বলেও পরিচিত। যোগ্য জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের কথা যদি বলা হয়, তবে দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে, সৎ ব্যক্তিত্বদের নির্বাচিত করা উচিত।
বাংলাদেশ গেল সাঁইত্রিশ বছরে ইজমের রাজনীতি কম দেখেনি। এই ইজমের প্রতিপত্তি বিস্তারের লক্ষ্যেই দেশে বিভিন্ন ‘ভবন রাজনীতির’ তালুক সৃষ্টি করা হয়েছিল। সে সব লুটেরা তালুকদারচক্র সাময়িকভাবে এখন রাজনীতি থেকে দূরে থাকলেও তারা সময়মতো এসে রাজনীতিতে জেঁকে বসতে পারে। তাই এসব লুটেরা ফড়িয়া শ্রেণী সম্পর্কে জনগণের সব সময় সতর্ক থাকা দরকার। যে রাজনৈতিক নিষ্পেষণ চৌদ্দ কোটি মানুষের ভাগ্যকে নির্মমভাবে বিড়ম্বিত করেছে, তা থেকে মুক্তি খুঁজতে হবে মানুষকেই। এ জন্য ঐক্য এবং সাহসের কোনো বিকল্প নাই।
সাধারণ মানুষ জঙ্গিবাদমুক্ত শান্তির বাংলাদেশ চান। তারা চান ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তে ভেজা বাংলার মাটিতে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তপনার চিরঅবসান হবে। আর সে জন্যই গুণী, ত্যাগী, নিঃস্বার্থ এবং সৎ সাংসদ নির্বাচিত করতে হবে। যে কথাটি না বললেই নয়, তা হচ্ছে বাংলাদেশের মেরুদন্ডের প্রধান শক্তি, মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। তাই যুদ্ধাপরাধীমুক্ত, রাজাকার-হায়েনামুক্ত, একটি সংসদ গঠনে জনতাকে প্রত্যয়ী হতে হবে। গণতন্ত্রের যেমন বিকল্প নেই, তেমনি সুশিক্ষিত ভোটারেরও বিকল্প নেই। প্রতিবেশীকে সচেতন করে তোলা অন্য প্রতিবেশীরই নৈতিক এবং জরুরি দায়িত্ব।
নিউইয়র্ক, ১৩ ডিসেম্বর ২০০৮