যেসব বিবেচনাকে প্রাধান্য দিতে হবে

একটা অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের পথ সুগম হোক এটাই সাধারণ মানুষের কামনা। কিন্তু বড় দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে চার দল। বিশেষ করে বিএনপি। তাদের অনেক দাবি। ক্রমেই দাবি কমতে শুরু করেছে। নির্বাচন কমিশন তাদের কথায় ফিরে গিয়েছিল। তারা বলেছিল, ১৮ ডিসেম্বরই নির্বাচন হবে। তখন ‘আক্কেল গুড়ুম’ হলো খোন্দকার দেলোয়ারের। আবার তার কণ্ঠের সুর নরম হয়ে এলো। আবার তারা বৈঠক করলেন। কিছু দাবি কমালেন। এখন ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচন হবে। ২২ জানুয়ারি হবে উপজেলা নির্বাচন।

তারপরও দাবি তারা করেই যাচ্ছেন আরপিও ৯১(ই) ধারা বাতিল করতে হবে। জরুরি অবস্খা তুলে নেয়ার সুস্পষ্ট ঘোষণা তারা চান। এটা বিএনপির রাজনীতিকরা খুব ভাল করেই জানেন, জরুরি অবস্খা তুলে নিলেও অলিখিত জরুরি অবস্খা থেকেই যাবে। নির্বাচন উপলক্ষে বহুজাতিক বাহিনী মাঠে থাকবে সর্বোচ্চ পাওয়ার নিয়ে। কারণ দেশে অবাধ নির্বাচন করতে তারা বদ্ধপরিকর। সেটা সাধারণ মানুষও চায়।

নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই জমছে নতুন খেলা। দল বদলের পাখিরা নতুন তরণী ভাসাচ্ছে। শেখ হাসিনা অভিযোগ করেছেন, তার দলের কিছু নেতাকেও টাকার প্রলোভন দেখিয়ে দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করছে কেউ কেউ। সুযোগ সানীরা দলবদল করে। জনগণ তাদের চিনে খুব ভাল করেই। এরা জনগণের কাছে চিহ্নিত। কিন্তু যারা কখনও এলাকায় যায়নি, যারা নিজ অঞ্চলের মানুষের সুখে-দু:খে কখনই পাশে দাঁড়ায়নি­ এরা মনোনয়ন পাচ্ছে কিভাবে? বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে এর আগেও বিদেশে ‘আবাসন’ গ্রহণকারীরা এমপি হয়েছেন। বিদেশের পাসপোর্টও নাকি কারও কারও কাছে ছিল। এবারও তেমন ব্যক্তিরা নমিনেশন পাচ্ছেন। আবার তদবির করছেন। যারা বিদেশের ইমিগ্রেশনের কাছে ডান হাত তুলে শপথ করে বিদেশের বশ্যতা স্বীকার করে নাগরিকত্ব নিয়েছেন, তারা দেশে গিয়ে এমপি হওয়ার দাবি রাখেন কি? দলইবা এদের মনোনয়ন দেয় কিভাবে? মৌসুমি পাখি সেজে দরদি সাজতে চাইছে তারা।

নির্বাচন কমিশন এ বিষয়ে তথ্যানুসান করলে আরও অনেক কিছুই বেরিয়ে আসবে। জানা যাবে তাদের অতীত কর্মকাণ্ডও। ‘তারুণ্যের নেতৃত্ব’ তৈরির নামে কোন অশুভ শক্তিকে প্রমোট করার চেষ্টা করা হচ্ছে কি না তা ভেবে দেখতে হবে। এটা দেশবাসীর অজানা নয়, বড় দুটি দল থেকে যারা মনোনয়ন পাবেন তারা দুই নেত্রীর কাছ থেকে ছাড়পত্র পাওয়ার পরই ভোটে প্রার্থী হতে পারবেন। কিন্তু দুই নেত্রী কি সম্পূর্ণ পরিশুদ্ধভাবে প্রার্থী মনোনয়ন করবেন কিংবা করতে পারবেন? এমনটি আশা করা যায় না। তাই নির্বাচন কমিশনকে এ বিষয়ে সতর্ক এবং জাগ্রত থাকতে হবে। যাতে নবম জাতীয় সংসদে কোন অশুভ শক্তি এবং এর প্রেতাত্মাদের স্খান না হয়। যাতে তস্কর চক্র রাজনীতিতে এসে পরিবেশ কলুষিত না করতে পারে।

একটি বিষয় দিনে দিনে খুব স্পষ্ট হয়ে উঠছে। প্রধান দলগুলো তাদের পুরনো বলয় থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। সেই সব রাঘব বোয়ালরা যারা বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছিল তারাও মনোনয়ন প্রত্যাশা করছে। জঙ্গি সংগঠনগুলো নতুন নামে, নতুন মোর্চা তৈরি করে সামনে আসার চেষ্টা করছে। এদের অশুভ খায়েশ প্রতিহত করার দায়িত্ববোধটুকু নিয়েই নির্বাচন কমিশনকে কাজ করতে হবে। যে সব জঙ্গি ঢাকা দখলের মহড়া আজ দিচ্ছে এরাই তো দেশে একযোগে বোমা হামলা চালিয়েছিল। যাদের সুষ্ঠু বিচার আজও বাংলার মাটিতে করা সম্ভব হয়নি।

দুই.

রাষ্ট্রক্ষমতা পারিবারিককরণের প্রক্রিয়ায় মনোনয়ন বঞ্চিত শীর্ষ নেতাদের ছেলে-মেয়ে-স্ত্রীদের মনোনয়ন দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। এই প্রক্রিয়ায় বড় দলগুলো আগেও করেছে, এখনও করছে। একটি কথা মনে রাখা দরকার। বাংলাদেশ কারও পৈতৃক সম্পত্তি নয়। যে আবদুল জলিল চারদলীয় জোটের আমলে জ্যোতিষির মতো পতনের বিভিন্ন ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, তিনিই লিখিতভাবে বলেছিলেন আর রাজনীতি করবেন না। রাজনীতির মাঠ সবাইকে ছাড়তেই হয়। এটা কারও স্খায়ী সম্পতি নয়। অথচ আবদুল জলিল এখন আবার রাজনীতিতে সক্রিয় হতে চাইছেন। যে সাইফুর রহমান বলছিলেন, আর রাজনীতি করবেন না। ভাল করে দাঁড়াতে পারেন না তিনি কারও সাহায্য ছাড়া, সেই তিনিই এখন জনগণের ইচ্ছায় প্রার্থী হওয়ার খায়েশ প্রকাশ করেছেন। এরই নাম রাজনীতি! বাংলাদেশে রাজনীতির মাঠ কেউ ছাড়তেই চায় না। দুর্নীতিবাজদের পোষ্যদের মনোনয়ন দেয়া আর দুর্নীতিবাজ-গডফাদারকে স্বয়ং মনোনয়ন দেয়া তো সমান কথাই হলো। বড় দলগুলো এভাবে জনগণের মুখের সামনে মুলো ঝুলিয়ে দিয়ে সেই পুরনো স্ট্রাটেজি বজায় রাখতে চাইছে। তারা প্রকারন্তরে দুর্নীতিবাজদেরই বাঁচাতে চাইছে।

বাংলাদেশে আরেকটি প্রথা চালু আছে, একই পরিবারের সদস্যরা বিভিন্ন দল করেন। তা তারা গণতান্ত্রিকভাবে করতেই পারেন। কিন্তু দেখা যায় দরকার মতো এরা বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাবলম্বী হলেও নিজ সহোদর/সহোদরাদের ব্যাপক সাহায্য করেন রাজনৈতিক মুনাফা পাইয়ে দেয়ার লক্ষ্যে। তাহলে তো বোঝা যায়, এরা বিভিন্ন উৎস থেকে ফায়দা লাভের আশায়ই বিভিন্ন দল করেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে এসব স্বার্থপর পরিবারতন্ত্রের বিরুদ্ধেও জনগণকে সজাগ থাকতে হবে। এসব বিবেচনাকে প্রাধান্য দিতে হবে।

মনোনয়ন দাখিল, বাছাই এবং চূড়ান্ত হওয়ার পর বোঝা যাবে কারা কোন দলের প্রার্থী হলেন। কতটা আসন কোন জোটের, কোন দলের মধ্যে বন্টন হলো। তবে আমার মতে, রাষ্ট্রের জনগণের একটা প্রধান ভূমিকা এসব বিষয়ে থাকা উচিত। আর তা হচ্ছে কোন চাপিয়ে দেয়া প্রার্থীকে গ্রহণ না করা। দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে, জঙ্গি-মৌলবাদী-পরাজিত রাজাকারদের বিরুদ্ধে নিজ নিজ এলাকায় প্রতিরোধ গড়ে তোলা। ব্যাপক জনমত সৃষ্টি করা।

যে সুশীল সমাজ এতদিন সৎ এবং যোগ্য প্রার্থী নির্বাচনের বিভিন্ন বুলি আওড়িয়েছেন তাদেরও আমি সক্রিয় হতে বিনীত অনুরোধ করি। শেখ হাসিনা কিংবা খালেদা জিয়া সনদ দিলেই এদেশে কেউ সৎ হবে না। হতে পারবে না। শেষ হাসিনার দেয়া মনোনয়নে আওয়ামী লীগের তিনশত প্রার্থীর মধ্যে বেশ কিছু ‘সুবিধাবাদী’ আমরা ইতোমধ্যেই দেখতে পাচ্ছি। একই প্রথা অনুসরণ করবেন বেগম জিয়াও­ এতে কোন সন্দেহ নেই। তাই নিজ নিজ এলাকায় মানুষের প্রত্যয়কে সঙ্গে নিয়ে সুশীল সমাজকে দাঁড়াবার এটাই উপযুক্ত সময়।

বাংলাদেশের মানুষের এখন প্রধান শত্রু দুটি। একটি পরিবারতন্ত্র আর অন্যটি রাজাকার মদদপুষ্ট জঙ্গিতন্ত্র।

জঙ্গিরা সহিংস দখল চাইছে। আর পরিবারতন্ত্রের বলয় তৈরি করে পিতার পর পুত্র-কন্যাকে নেতৃত্ব এনে দখল দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। এই দুই রাহুর কবল থেকেই মানুষকে মুক্ত হয়ে বেরিয়ে আসার কথা ভাবতে হবে। ওয়ান-ইলেভেন একটি দানবশক্তির পাঁজরে আঘাত করে তা সাময়িকভাবে থামিয়েছে। কিন্তু এর শিকড় উৎপাটন করতে হবে গণমানুষকেই। আর সেজন্য বিবেক সজাগ রেখে নেতৃত্ব নির্বাচনের কোন বিকল্প নেই।

নিউইয়র্ক, ২৫ নভেম্বর ২০০৮

ফকির ইলিয়াস

একটা সূর্য চাই, একটা চন্দ্র চাই / নদীর নীরব নগরে পসরা সাজাই ।।

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.