বারাক ওবামা কি বিশ্বের নতুন প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন? প্রশ্নটা করছে মার্কিনি মিডিয়া। বারাক যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্রেট প্রার্থী হিসেবে লড়ছেন। এটা সবাই জানেন। তাহলে ‘বিশ্বের প্রেসিডেন্ট’ পদবিটি যুক্ত হচ্ছে কেন? তবে কি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টই বিশ্বের প্রেসিডেন্ট? প্রশ্নটির বিভিন্ন উত্তর আছে। তবে সে উত্তরে যাওয়ার আগে মহামহীম এডওয়ার্ড সাঈদকে স্মরণ করি। তিনি জাতিসংঘের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে এক সেমিনারে বলেছিলেন, এই সংঘটি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের লীলাক্ষেত্র। সবকিছু নিয়ন্ত্রিত হয় যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছে-অনিচ্ছার ওপর।
হয়তো ভুল বলেননি এডওয়ার্ড সাঈদ। আমরা সে নজির দেখছি প্রতিদিনই। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াল স্ট্রিটে ধস নামার সঙ্গে সঙ্গেই বিশ্বের অর্থনীতির বাজারে ধস। যুক্তরাষ্ট্র ইরাক ইস্যুতে যুদ্ধ বাধানোর সঙ্গে সঙ্গে সৈন্য পাঠাল ইউরোপীয় মিত্ররা। ব্রিটিশরা শাসন করেছিল বিশ্বকে। স্বয়ং তদারকি করে। যুক্তরাষ্ট্র এখন সে শাসন চালাচ্ছে। তবে তা কটনৈতিকভাবে। তাদের প্রয়োজনে সামরিক জান্তাও যে জায়েজ হয়ে যায়, তা তো আমরা পাকিস্তানের পারভেজ মোশাররফের বেলায়ই দেখলাম। এভাবে দেখে যেতেই হচ্ছে। দেখতে হচ্ছে, আসছে ৪ নভেম্বর ২০০৮-এর নির্বাচনে বারাক ওবামা জিতে আসতে পারবেন কি না? নাকি তাকেও আল গোরের ভাগ্য বরণ করতে হবে?
এটা বেশির ভাগ মার্কিনিই মনে করেন, দু’হাজার সালের নির্বাচনে আল গোর জিতেছিলেন। হ্যাঁ! তিনি পপুলার ভোটের সিংহভাগ পেয়েছিলেনও। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ‘ফ্লোরিডা কন্সপিরেসি’র মাধ্যমে আইনি প্রক্রিয়ায় জয়ী হন জর্জ বুশ। একই অবস্খা হয় ২০০৪-এর নির্বাচনেও। ওহাইও অঙ্গরাজ্যে নানা অনিয়মের সূত্র ধরে হেরে যান জন কেরি। আবারও বুশ উল্লাসের হাসি হাসেন। ‘গভর্নমেন্ট অফ দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল’ এই যদি গণতন্ত্রের সংজ্ঞা হয়, তবে পপুলার ভোটই নির্বাচনের মূল নিয়ামক হবে না কেন? তা আমার কাছে বোধগম্য কখনই নয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করে ‘ইলেক্টরাল কলেজ’। অর্থাৎ প্রতিটি অঙ্গরাজ্যের একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক ‘ডেলিগেট পাওয়ারই সমষ্টিগতভাবে নির্ধারণ করে প্রেসিডেন্টর প্রার্থী ভাগ্য। ২০০৮-এর নির্বাচনেও এই ইলেক্টরাল কলেজ প্রধান ফ্যাক্টর বলে মনে করছে মার্কিনি মিডিয়াগুলো। এখানে একটি প্রথা আছে প্রধান মিডিয়াগুলো সরাসরি তাদের পছন্দের প্রার্থীকে সমর্থন দিয়ে থাকে। এবারও দুই প্রধান প্রার্থীর পক্ষে লড়ছে মার্কিনি মিডিয়াগুলো।
আমার এখনও মনে হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের বর্ণবৈষম্য বিষয়টি সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি। বরং সময়ে তা মাথাচাড়া দিয়েই উঠে। বারাক ওবামার পিতা একজন আফিন্সকান কৃষäাঙ্গ। তার মা একজন শ্বেতাঙ্গ আমেরিকান। এখানে তার পিতৃপরিচয়টি প্রাধান্য পাচ্ছে ভিন্নভাবে। শ্বেতাঙ্গ মায়ের কথাটি বেমালুম চেপে যাচ্ছেন অনেকেই। কেন যাচ্ছেন? এর প্রকৃত উদ্দেশ্য কী অর্থ বহন করে? না, বিশ্ব এখন আদিমতাকে লালন করে না। সেটা কি আমরা শুধু মুখেই বলি? হয়তো বলি। হয়তো বলি না। অথবা এসব বিষয় নিয়ে বেশি কিছু বলতে চাই না। কিন্তু না বলাটা তো কোন সমস্যার সমাধান নয়। বরং বলার সাহস নিয়ে এগিয়ে আসাটাই হচ্ছে মঙ্গলজনক। মাটির জন্য মানুষের জন্য।
বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট হলেই যে যুক্তরাষ্ট্র কিংবা গোটা বিশ্বের চেহারা রাতারাতি পাল্টে দিতে পারবেন, সে বিশ্বাস আমি করি না। তবে মেধা ও মনন নিয়ে খুব দ্রুত উঠে আসা যে তরুণ মাত্র চার বছর যুক্তরাষ্ট্র সিনেটের সদস্য থেকেই আলোচিত হতে পেরেছেন, তার কাছে প্রত্যাশা করা যেতেই পারে। তার রয়েছে প্রজ্ঞাশীল ভাবনার প্রচেষ্টা, যা একটি জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সর্বোতভাবে সহায়ক।
দুই.
দিন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই যুক্তরাষ্ট্রে বাড়ছে রাজনৈতিক উত্তাপ। সারাহ পোলিনকে ভাইস প্রেসিডেন্ট মনোনীত করে সিনেটর জন ম্যাককেইন একটা চমক লাগাতে চেয়েছিলেন। সিনেটর হিলারি ক্লিনটন ডেমোক্রেট পার্টির মনোনয়ন বঞ্ছিত হওয়ার পর, ম্যাককেইন এই সহজ পথটি খুঁজছিলেন। আর তা ছিল একজন মহিলাকে তার রানিংমেট করার। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে? সে ব্যক্তি একজন নবিস গভর্নর সারাহ পোলিন হবেন কেন? যুক্তরাষ্ট্রে কি তার চেয়ে অভিজ্ঞ আর কোন মহিলা রিপাবলিকান ছিলেন না? অবশ্যই ছিলেন। তারপরও সারাহ পোলিন কেন মনোনীত হলেন সে কথা এখনও রহস্যাবৃত। না, ঝানু রিপাবলিকানরাও কেন এই রানিংমেট নির্বাচনে বাধা দিলেন না। কেন দিলেন না?
সারাহ পোলিনকে নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই গসিপ রিপোর্ট বেরুচ্ছে মার্কিন মিডিয়ায়। সে তুলনায় বারাক ওবামার রানিংমেট জো. বাইডেন থেকে গেছেন জনপ্রিয়তার শীর্ষে।
মার্কিন নির্বাচনী প্রচারণায় মিডিয়াই সর্বেসর্বা তা কারও অজানা নয়। মিডিয়া জরিপে দুই প্রধান প্রার্থীর জনপ্রিয়তা উঠছে-নামছে। কিন্তু এবারের নির্বাচনকে সামনে রেখে এক ধরনের প্রতিমিডিয়ার ছড়াছড়ি আমাকে বেশ ভাবিয়েছে। প্রতিমিডিয়ার কথা এলেই আমার মনে পড়ে বাংলাদেশের দেয়াল লিখনের কথা। আমরা মাঝে মাঝে দেখতাম কালো-লাল-নীল হরফে বড় বড় দাবি, îোগাননির্ভর দেয়াল লিখনে ভরে গেছে শহর-নগর-বন্দরের বড় বড় দেয়াল। রাজনীতিকরা বলতেন ‘দেয়ালের ভাষা পড়ূন।’ বিরোধী দলগুলো সরকারকে সতর্ক করতো অনেকটা দেয়াল লিখনের মাধ্যমেই। প্রতিমিডিয়ার কথা যখন আসে তখন লিফলেট, ব্যানার, ফেস্টুন এসব চিত্রও ভেসে ওঠে আমাদের চোখের সামনে।
না, যুক্তরাষ্ট্রে অন্তত দেয়াল লিখন নেই। তবে ২০০৮-এর ৪ নভেম্বরের নির্বাচনকে সামনে রেখে নানা ধরনের লিফলেট প্ল্যাকার্ড, ব্যানার নজরে পড়ছে। সেদিন সেন্ট্রাল পার্কে তেমনই একটি র্যালি চোখে পড়ল। খোলা আকাশের নিচে উদোম গায়ে শুয়ে আছে বেশ কিছু নারী-পুরুষ। তারা বলছে, আমরা সৈনিকদের মৃতদেহ। জজ বুশ মিথ্যা যুদ্ধের অজুহাতে ইরাক-আফগানিস্তানে আমাদের যে ভাইবোনকে হত্যা করাচ্ছে, আমরা তাদের ছায়াদেহ। তারা রাস্তায় দাঁড়িয়ে বিতরণ করছে লিফলেট। এতে লেখা আছে জর্জ বুশের গত ৮ বছরের নানা ফিরিস্তি। তারা বলছে, ‘মি ম্যাকেইন আপনার নেতা জর্জ বুশ বলেছিলেন ওসামা বিন লাদেনকে জীবিত ধরে আনবেন। আমরা দেখতে চাই সেই লাদেন এখন যুক্তরাষ্ট্রের কোন বালাখানায় আয়েশে আছেন।’
গণতন্ত্রে মত প্রকাশের এমন স্বাধীনতা থাকতেই হয়। না থাকলে তো গণতন্ত্রের চর্চা পরিশুদ্ধ থাকে না। কিন্তু আমি ভাবি ভিন্ন ভাবনা। যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের এই যে চাওয়া এর সঙ্গে ইলেক্টরাল কলেজের সঙ্গতি আছে কি? মার্কিন সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বলেন, এই কলেজ প্রথা বহাল না থাকলে ছোট ছোট অঙ্গরাজ্যগুলোর ক্ষুদ্র জনসংখ্যা সুবিধা বঞ্ছিত হবে। কিন্তু যেহেতু বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের (যাকে আমরা প্রদেশ ও বলতে পারি) বিভিন্ন আইন বলবৎ আছে কিংবা থাকতে পারে তাহলে তারা ফেডারেল সুবিধাও তো সমানুপাতিক হারে পেতে পারে। এতে ইলেক্টরাল কলেজের নামে মূলত মানুষের সংখ্যাগরিষ্ঠদের অধিকারই তো ক্ষুন্ন করা হচ্ছে। তাদের ভোটের সরাসরি অধিকার কার্যত প্রতিফলিত হচ্ছে কি?
জর্জ বুশ প্রথমবার জিতলেন। এরপর ঘটে গেল অনেক ঘটনা। টুইন টাওয়ার ধ্বংস হয়ে গেল। পেন্টাগনে হামলা হলো। এর পরের ইতিহাস সবার জানা। আফগানিস্তানে যুদ্ধ বাঁধালো বুশ প্রশাসন। এরপর ইরাকেও। ২০০4 সালে বুশ জিতলেন দ্বিতীয়বারের মতো। বললেন, অসমাপ্ত কাজ শেষ করতে চাই।
কতটুকু শেষ করেছেন, তা দেখেছে যুক্তরাষ্ট্রবাসী। দেখেছে বিশ্বের মানুষ। এখন রিপাবলিকানদের ভাষ্য হচ্ছে ইরান বিশাল হুমকি। জন ম্যাককেইন জিতলে ইরানে আক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা নিশ্চিত হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র কিংবা বিশ্ব কী আরেকটা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত?
পাদটীকা
এই লেখা যেদিন ছাপা হবে, এর মাত্র ৪ দিন পরই বিশ্ব জেনে যাবে যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্টের নাম। আমি ব্যক্তিগতভাবে একজন রেজিস্টার্ড ডেমোক্রেট। বারাক ওবামা আমার মননের মনোনীত প্রার্থী। তাই তার প্রতি আমার সর্বাত্মক পক্ষপাত থাকাটা খুবই স্বাভাবিক। আমি তার পক্ষ নিচ্ছি এজন্য, কারণ জর্জ বুশের শাসনকালের শেষ বছরটিতে আমি ‘ভাতপ্রিয় বাঙালি’ মানুষটির চালের দাম তিনগুণ হয়েছে। আমি বারাককে ভোট দেব এজন্য। কারণ অর্থনৈতিক মন্দা বাড়িয়ে দিয়েছে আমার জীবনের শঙ্কা। আমি মধ্যবিত্ত আমেরিকানের একটি প্রতিচিত্র মাত্র। আমি প্রতীক্ষা করছি নতুন বিশ্বনেতার, নতুন বিশ্বনেতৃত্বের।
নিউইয়র্ক ২৮, অক্টোবর ২০০৮
