জানালা ধরে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট্ট মেয়েটা

নীল মলাটের ছোট্ট একটা বই। ১৪৯ পাতার মধ্যেই শেষ। কিন্তু শেষ হয়ে গেলেও মুগ্ধতা শেষ হয না। তোত্তোর সঙ্গে কাটানো ১৪৯টা পাতায় ফিরে যাই বারবার। যেন আমাদের অব্যক্ত শৈশব লেখা হযে গেছে তেৎসুকো কুরোয়ানাগির কলমে। [...]

‘তোত্তো-চান’ বইয়ের প্রচ্ছদ

‘তোত্তো-চান’, তেৎসুকো কুরোয়ানাগি, ছবি : চিহিরো ইবাসাকি, অনুবাদ: মৌসুমী ভৌমিক, ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট, ইন্ডিয়া, ২০০০

. . .

জাপানের জনপ্রিয় টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব তেৎসুকো কুরোনায়াগির (জন্ম ১৯৩৩) ছোটবেলার স্মৃতিকথা ‘তোত্তো-চান’ (১৯৮১)। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার জাপানের টোকিও শহরের ঘটনা। এতে তেৎসুকোর শৈশবের সঙ্গে রয়েছে অন্যরকম একটি স্কুলের গল্প, রেলগাড়ির বাতিল কামরাগুলো ছিলো যার ক্লাসরুম। খোলামন আর স্বাধীনভাবে কিছু করার অধিকার শিক্ষার উত্তম মাধ্যম – মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক সোসাকু কোবায়াশি (মৃত্যু ১৯৬৩)। স্মৃতিচারণে উঠে এসেছে একজন আদর্শ শিক্ষাবিদের আরাধ্য শিক্ষাব্যবস্থার অনন্যসাধারণ নানা দিক । জাপানি ভাষায় প্রকাশের প্রথম বছরেই বিক্রি হয়েছিলো ৪৫ লক্ষ কপি। নানা ভাষায় অনূদিত ‘তোত্তো-চান’ সারা পৃথিবীর লক্ষ মানুষের মন জয় করেছে। মূল জাপানি ভাষা থেকে প্রথম বাংলা অনুবাদ বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত হলেও সেটা ছাপা নেই বলে জানা গেছে। অবশেষে শিল্পী গবেষক মৌসুমী ভৌমিকের অনুবাদে আমরা বাংলায় বইটি পড়বার সুযোগ পেয়েছি।

নীল মলাটের ছোট্ট একটা বই। ১৪৯ পাতার মধ্যেই শেষ। কিন্তু শেষ হয়ে গেলেও মুগ্ধতা শেষ হয না। তোত্তোর সঙ্গে কাটানো ১৪৯টা পাতায় ফিরে যাই বারবার। যেন আমাদের অব্যক্ত শৈশব লেখা হযে গেছে তেৎসুকো কুরোয়ানাগির কলমে। আজ আপনাদের তোত্তো-চানের গল্প শোনাবো। আশা করি ভালো লাগবে তোত্তো-চানের ছেলেবেলা আর হেডমাস্টারমশাই সোসাকু কোবায়াশির স্বপ্ন ‘তোমোই গাকুয়েন’কে।

 

‘তোত্তো-চান’-এর লেখিকা তেৎসুকো কুরোনায়াগি

সাত বছরের ছোট্ট তোত্তো-চানকে নিয়ে জিয়ুগায়োকা স্টেশনে নেমেছেন মা। ওকে নতুন স্কুলে ভর্তি করা নিয়ে তিনি ভীষণ চিন্তিত। কিন্তু তোত্তোর সেসব চিন্তা নেই। টিকিট চেকারের টিকিট ভর্তি বাক্স দেখেই তোত্তো ভুলে গেলো ক’দিন আগেই সে হতে চেয়েছিল গুপ্তচর। মাকে বললো, “ধরো, এমনিতে আমি টিকেট বিক্রি করি, কিন্তু আসলে আমি একজন গুপ্তচর।” আবার রাস্তার বাজনাওয়ালাদের দলেও তার থাকা চাই, পুরোনো স্কুলের জানালায় দাঁড়িয়ে রোজ যাদের কাছে বাজনা শুনবার আবদার করত। আরো কত কী যে ওর ভালো লাগতো। ওর খুব ভালো লেগেছিল স্কুলের ঢাকনাওয়ালা ডেস্ক যার ভেতরে অনায়াসে ভরে ফেলা যায় রাজ্যের সব জিনিস, আর  ডেস্কের ঢাকনা খুলে ভেতর থেকে সেসব বের করা আর ঢোকানোও ছিল ভারী আনন্দের। দিদিমণির পড়ানোর চেয়ে ওর ভালো লাগতো কার্নিশে বসে থাকা সোয়ালো পাখিদের সঙ্গে কথা বলতে। ছবি আঁকার সময়ও কল্পনার আকাশ হয়ে উঠতো সবুজ, আকাঁর খাতা ছাপিয়ে রঙ ছড়িয়ে  পড়তো চারপাশে। কিন্তু দিদিমণিদের এসব ভালো লাগেনি। রাস্তার বাজনাওয়ালাদের দল তাঁদের কান ঝালাপালা করে দিল, বারবার ডেস্ক খোলা-বাঁধার শব্দে পড়ানোর বারোটা বেজে গেল। তাড়িয়ে দিল ওরা তোত্তোকে। অগত্যা মা নতুন স্কুলের খোঁজ করলেন। এমন কোনো স্কুল যেখানে তোত্তোকে কেউ ভুল বুঝবে না, তোত্তো-ও সবার সঙ্গে মিলমিশে থাকতে শিখবে। সত্যি কি এমন কোনো স্কুল আছে?

আছে একটা – তোমোই গাকুয়েন। এই স্কুলে ক্লাস হয় পুরোনো বাতিল ট্রেনের কামরায়। তাহলে এখানকার হেডমাস্টারমশাই তো সত্যিকার হেডমাস্টারমশাই নন; এতগুলো রেলগাড়ি যাঁর তিনি তো স্টেশনমাস্টার না হযে যান না! হেডমাস্টারমশাই অবশ্য তোত্তোর ভুল ভাঙিয়ে তাকে আশ্বস্ত করলেন। এরপর তিনি বললেন, এবার তোমার নিজের কথা বলো। তোমার যা খুশি তাই বলো! যা খুশি তাই? নিজের কথা কী বলবে তোত্তো? সে তো ভেবেছিলো তাকে অনেক সব প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে! বেশ তবে শুরু করা যাক। ব্যস্, শুরু হয়ে গেলো বকবক। একনাগাড়ে বলে যেতে লাগলো ওর ছোট্ট মনের সব কথা। তোত্তো-চান বললো, আসার পথে ট্রেনটা কত জোরে ছুটছিল, এতবার চাওয়ার পরও যে টিকিট চেকার লোকটা একটা টিকিটও দিল না, আগের স্কুলের দিদিমণি কেমন সুন্দর ছিলো, সোয়ালো পাখির বাসা, ওর কুকুর রকি কেউ বাদ পড়লো না। জানালো কীভাবে সে মুখের ভেতরে কাঁচি নিয়ে ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ করতে পারে, কাটা তাঁরের বেড়ার নীচ দিয়ে যাবার সময় তার জামা ইজের সব ছিঁড়ে যায় আর মায়ের বকুনি শোনে, বাবা কত ভালো সাঁতার কাটতে পারে, ইত্যাদি । হেডমাস্টারমশাই একটুও বিরক্ত হলেন না, প্রায় চার ঘণ্টা ধরে সমান উৎসাহ নিয়ে শুনে গেলেন তোত্তো-চানের সব কথা। তোত্তো ভেবে দেখলো এমন মানুষ সে আগে দেখেনি তো। কেউ তো কোনোদিন এমন করে ওর কথা শুনতে চায়নি। অনেকেই ওকে একটু অদ্ভুত মনে করে। একটা নিজস্ব ধরণের সরলতা ছিল ওর মধ্যে। তোত্তো-চান নিজেও বুঝতো যে তার ভালোলাগাগুলো অন্য সবার চেয়ে একটু আলাদা। তাই হেডমাস্টারমশাইয়ের কাছে গিয়ে, ওঁর মনের উত্তাপ পেয়ে ছোট্ট তোত্তোর সেদিন খুব আরাম হয়েছিল। হেডমাস্টারমশাই, সোসাকু কোবায়াশিরও ওকে ঠিক এতটাই ভালো লেগেছিল।

‘তোত্তো-চান’ বইয়ের অলংকরণ

শুরু হয়ে গেলো তোত্তো-চানের নতুন স্কুল। এই স্কুলটা সবদিক থেকেই আগের স্কুল থেকে কেমন আলাদা। মাত্র ৫০ জন ছাত্রছাত্রী। নিজেরাই নিজেদের চেয়ার-টেবিল সাজিয়ে নিচ্ছে খাবার আগে আর টিফিন বক্স খুলে বের করছে ‘সাগর থেকে পাহাড় থেকে’ আনা খাবার। সে আবার কী? তোত্তোর তর সইছিলো না। পরদিন স্কুলে পৌঁছেই সে চলে গেলো তার নতুন ক্লাসরুমে। রেলগাড়ির কামরাটা দেখেই আনন্দে বুক ধুকপুক করছিল। যদিও সে জানতো কামরাগুলো স্থির তবু তার মনে হতে লাগলো ট্রেনটা যেন চলছে (হাওয়ায় গাছের ফুল পাতা নড়তে দেখে এমন মনে হচ্ছিলো)।সবকিছু স্বপ্নের মতো, আনন্দে গান গেয়ে উঠলো তোত্তো-চান। একটু পর অন্য ছেলেমেয়েরা আসতে শুরু করলো। যার যেখানে, যার পাশে খুশি বসে পড়লো। মোট নয়জন মিলে শুরু হলো তোমোই গাকুয়েনের ক্লাস ওয়ান। আসলে রেলগাড়িতে চেপে ওরা পৃথিবী ভ্রমণে বেরিয়েছিল। শুধু রেলগাড়ির কামরায় ক্লাসরুম বা ইচ্ছেমতো বসবার ব্যবস্থা নয়, তোমোই গাকুয়েনের পাঠদান পদ্ধতিও ছিল স্বতন্ত্র। দিনের শুরুতেই দিদিমণি বা মাস্টারমশাই ছেলেমেয়েদের সেদিনকার কাজের পরিকল্পনাটা বলে দিতেন (মানে সারাদিন কী কী কাজ করা হবে, যা যা শেখা হবে তার একটা তালিকা)। তারপর যার যার পছন্দের বিষয় দিয়ে কাজের শুরু হতো।। ফলে কেউ শুরু করতো অঙ্ক দিয়ে, কেউ-বা ইতিহাস, আবার এই সক্কালবেলাতেই কারো পছন্দ বিজ্ঞান গবেষণা অথবা রচনা লেখা। সবগুলোই সমান গুরুত্বর্পূণ বিষয়, কেবল ভালোলাগাগুলো ভিন্ন ভিন্ন। পছন্দের বিষয় দিয়ে যখন দিনের শুরু হয় তখন মনটা বেশ ফুরফুরে থাকে, তাই না? তাই অপছন্দের কাজগুলিও দিনের কোনো একসময় ঠিকই করা হয়ে যেতো্ । এভাবে পড়ানোর উদ্দেশ্য ছিলো, ছেলেমেয়েরা যত উচুঁ ক্লাসে যাবে শিক্ষক-শিক্ষিকারা ততই স্পষ্টভাবে বুঝতে পারবেন ছাত্রছাত্রীদের আগ্রহ এবং কোন বিষয়ে কে বেশি ভালো করছে। প্রত্যেকের মন বুঝে ওদের বেশিষ্ট্যগুলো ধরতে চাইতেন তোমোই গাকুয়েনের শিক্ষক-শিক্ষিকারা। (এমন কোনো স্কুল কি সত্যি ছিল? আমরা কেনো খুঁজে পেলাম না এমন একটা স্কুল?)

কিন্তু ‘সাগর থেকে পাহাড় থেকে’-র ব্যাপারটা? তোত্তোকে যে জানতেই হবে এসবের মানে। আসলে এটা দিয়ে সোসাকু কোবায়াশি বোঝাতে চেয়েছেন পুষ্টিকর খাবারের গুরুত্ব। পাহাড় থেকে আসবে শাক-সবজি, ফল-জল, মুর্গি আর সমুদ্র থেকে পাবো আয়োডিন-সমৃদ্ধ রূপচাঁদা মাছ, চিংড়ি । ‘শিশুদের সবকিছু খেতে শেখান’ –  এসব গৎবাঁধা বুলির বদলে, শিশুদের সহজে পুষ্টিকর খাবারের গুরুত্ব বুঝতে শেখানোর জন্য তিনি ‘সাগর থেকে পাহাড় থেকে’ এই সুন্দর কথাটা ব্যবহার করলেন। যাই হোক, পুরোটা জানবার পর তোত্তোর খুব ভালো লেগেছিল। কে কী আনলো সেটা কোনো ব্যাপার নয় টিফিন বক্সে সাগর-পাহাড়ের খাবার থাকাটাই আসল। কারো বক্সে যদি সাগর বা পাহাড়ের যে-কোনো একটি উপাদান বাদ পড়ে তার বন্দোবস্ত করে রেখেছেন হেডমাস্টারমশাইয়ের স্ত্রী। তখন কে আর বলবে অমুকের টিফিন পচা – আমারটা ভালো, বা আমি মাছ খাই না? সবাই যে সাগর আর পাহাড়ের গল্পে মশগুল। খেতে খেতে হেডমাস্টারমশাই সবাইকে নানারকম প্রশ্ন করতেন, কোন খাবারটা সাগরের বা কোনটা পাহাড়ের। কেউ কোনো অচেনা বা সুস্বাদু খাবার আনলে সবাই মিলে চেখে দেখাও চাই। এভাবে ওদের কাছে খাওয়াটাও হয়ে উঠেছিল আনন্দময় একটা ক্লাস।

 

টিফিন বক্স শিশুদের জীবনে খুব গুরুত্বর্পুণ। কারণ টিফিনের রকমফের শিশুদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে। ওইটুকু বয়সেও টিফিন বক্স, বক্সের ভেতরে থাকা খাবার নিয়ে ছেলেমেয়েদের কত রেষারেষি, বড়-ছোট ভেদাভেদ। মনে পড়ে আমার রুটি-আলুভাজা/ডিমসেদ্ধ টিফিন ছিলো ‘গরিবের নাস্তা’। ক্লাসে ‘গরিবের নাস্তা’ রা দলে ভারী হলেও মুখ কালো করে বক্স খুলতো, লুকিয়ে লুকিয়ে খেতো। কেউ আবার আমার মতো মন খারাপ করে টিফিন আনাই বন্ধ করে দিতো। তোত্তো-চানের নতুন স্কুলের এসব ছিল একদম আলাদা, নতুন নিয়মের। খাবার আগে ওরা অদ্ভুত কিন্তু মজার একটা গান গাইতো। ‘ভালো করে চিবোও তুমি/ চিবিয়ে চিবিয়ে খাও, ভাত, মাছ, মাংস, ডিম/ সবটা চিবিয়ে নাও।’ হেডমাস্টারমশাই সবসময় ওদের বলতেন ধীরে সুস্থে গল্প করতে করতে, ভালোবেসে খাবারটা খেতে। তাই হয়তো এমন একটা গান বেঁধেছিলেন। ওরাও গলা ফাটিয়ে গান গেয়ে সাগর থেকে, পাহাড় তেকে আনা খাবার খেতে শুরু করতো।

সেদিন ওরা দিদিমণির দেয়া কাজগুলো ঠিকঠাকমতো শেষ করেছিলো। তাই স্কুলের নিয়ম মতো খাবার পরে তোত্তো-চানরা হাঁটতে গেলো। নদীর ধার ঘেঁষে হেঁটে যাচ্ছিল ওরা নয় জন, সঙ্গে দিদিমণি। ফুলে ফুলে ঢাকা মস্ত চেরি গাছ, দিগন্তবিস্তৃত হলুদ সর্ষে ক্ষেত পেরিয়ে ওরা যাচ্ছিল কুহুনবুৎসু নামের প্রাচীন এক মন্দিরের দিকে। সহপাঠী সাক্কো-চান জানালো মন্দিরের পাশের কুয়োটায় একবার আকাশ থেকে একটা উল্কা খসে পড়েছিলো। সর্ষে ক্ষেতের পাশ দিয়ে যাবার সময় দিদিমণি শোনালেন সর্ষে ফুল ফোটার গল্প, রেণুর কথা, তার নলের মত কেশরের কথা, প্রজাপতি কেমন করে ফুল ফুটতে সাহায্য করে ইত্যাদি। ইয়াসুকি-চান, সাক্কো-চানের সঙ্গে মিলে তোত্তো-চানও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করতে লাগলো ফুলগুলো। দেখে শুনে সবাই সবার মতামত জানাচ্ছিল। খোলা আকাশের নীচে ছোট্ট ছেলেমেয়ের দল বুঝে না-বুঝেই প্রকৃতির পাঠ গ্রহণ শুরু করলো। মিনিট দশেক হাঁটার পর পৌঁছালো কুহুনবুৎসু মন্দিরে। ভেতরে ধ্যানস্থ বুদ্ধদেব। বাইরে পাহারারত ভুঁড়িওয়ালা দেবতাদের দেখে তোত্তোর হাসি পেয়ে গেলো। উল্কা দেখলো, তেঙ্গু নামে একটা লম্বা নাকওয়ালা জিনের ইয়া বড়ো পায়ের ছাপে সবাই পা রাখলো, এক্কাদোক্কা খেললো। শিশুদল বুঝতেও পারেনি কখন ক্লাসের পড়া থেকে ছুটির ফাঁকে খেলাচ্ছলে বিজ্ঞান আর ইতিহাসের শিক্ষা নিয়ে ফেললো। বাঁধভাঙা আনন্দ নিয়ে সন্ধ্যায় তোত্তো বাড়ি ফিরে এলো। এরপর যেদিন স্কুলে নতুন রেলগাড়ির কামরা এলো সেদিন তোত্তোর কী উত্তেজনা! হেডমাস্টারমশাইয়ের অনুমতি নিয়ে সেদিন রাতে ওরা রাতের পোশাক আর কম্বল নিয়ে স্কুলে থাকতে এলো। সেই রাতে ওরা শিখেছিলো কীভাবে ট্রাক্টর নামের একটা গাড়ি ট্রেলার নামের মস্ত গাড়িটাকে টেনে আনে। হেডমাস্টারমশাই দেখিয়েছিলেন কোনটাকে বলে রোলার, বুঝিয়ে দিয়েছিলেন কীভাবে একটা বিশেষ শক্তি কোনো জিনিসকে গড়িয়ে নামতে সাহায্য করে। স্কুলে ক্যাম্পিংয়ের দিনটাও ছিল অসাধারণ। হেডমাস্টারমশায়ের নির্দেশ অনুযায়ী সবাই পাজামা কম্বল নিয়ে স্কুলে হাজির হলো। বাচ্চাদের বাবা-মায়েরা ভেবেছিলো বাইরে খোলা আকাশের নীচে কোথাও ক্যাম্পিং হবে। কিন্তু বাচ্চারা যেন বৃষ্টি বা শীতে কষ্ট না পায় সে ব্যাপারে সচেতন ছিলেন হেডমাস্টারমশাই। তাই স্কুলের হলঘরেই ক্যাম্পিংয়ের ব্যবস্থা করা হলো। তোত্তোরা প্রথমেই শিখে নিলো তাঁবু খাটানোর কৌশল। তারপর ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে শিক্ষকদের সহযোগিতায় নিজেদের তাঁবু খাটিয়ে নিলো। এরপর হেডমাস্টারমশাই ওদের মধ্যে বসে বলতে শুরু করলেন ওঁর দেশ-বিদেশে ভ্রমণের গল্প। ছেলেমেয়েরা এতটাই মুগ্ধ হয়ে গল্প শুনছিলো যে সাগর পারের অদেখা সেইসব জায়গা তাদের খুব কাছের মনে হতে লাগলো। গল্প শেষ হলে ওরা অন্ধকারে আরো কিছুক্ষণ হুটোপুটি, হা হা-হি হি করে ঘুমিয়ে পড়লো। খুব সাধারণ একটা ঘটনা – স্কুলের হলঘরে তাঁবু টাঙিয়ে রাত কাটানো। কিন্তু এই সাধারণ ব্যাপারটাই অসাধারণ হয়ে উঠেছিলো শিশুদের কাছে। বাড়ির বাইরে একটা রাত শুধু হৈচৈ করে, গল্প শুনে কাটানোর এত সুন্দর অভিজ্ঞতা আগে তো কখনো হয়নি। হেডমাস্টারমশাই শিশুদের মন বুঝতেন, জানতেন ওদের আনন্দেই হলঘরটা হয়ে উঠেবে একটা খোলা মাঠ। খুশিতে ঝকমক-করা কচি মুখগুলোর কাছে সেদিন হার মেনেছিলো চাঁদ-তারা ভরা আকাশ। বিভিন্ন বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে তোত্তা-চানদের দল একটু একটু করে নিচ্ছিলো জীবনের পাঠ ।

 

তোত্তোর জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছিলো স্কুলের চমৎকার সব নিয়মকানুন। পুরানো স্কুলে যা যা করতে পারেনি সেগুলো এখানে কোনো শাস্তি, বকুনির ভয় ছাড়াই মনের আনন্দে করা যেতো। তোত্তো-চানের খুব প্রিয় একটা খেলা ছিলো ওদের বাড়ির কাটাতাঁরের বেড়ার নীচে গর্ত খুঁড়ে তারপর হামাগুড়ি দিয়ে ওপারে কোনো খোলা জমিতে চলে যাওয়া। প্রায় কাঁটাতাঁর লেগে জামাকাপড় যেতো ছিঁড়ে, ধুলো-কাদা তো আছেই। এখন উপায়, মাকে কী বলবে? ব্যস্, ছেড়াঁ জামা নিয়ে তৎক্ষণাৎ একটা গল্প বানিয়ে ফেললো। কিন্তু ওর ইজেরটাও যে প্রতিদিন ছিঁড়ে কুটিকুটি। খেলতে গিয়ে জামা নষ্ট হওয়া, কাদা লেগে যাওয়া বাচ্চাদের জীবনে নিত্যদিনের ঘটনা। ধোপদুরস্ত ইউনিফর্ম পড়ে শিশুরা অস্বস্তিতে ভোগে, ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকে – এই বুঝি দাগ লেগে গেল (বাসায় ফিরে আর রক্ষা নেই)।সোসাকু কোবায়াশি মনে করতেন এতে শিশুর স্বাভাবিক কাজের যে ছন্দ সেটা ব্যাহত হয়। তাঁর কথামতো অভিভাবকরা সবাই বাচ্চাদের সবচেয়ে খারাপ পোশাক পরিয়ে স্কুলে পাঠাতেন। এতে করে ওরা মনের আনন্দে জল-কাদা ঘেঁটে খেলতেও পারতো আবার বাড়ি ফিরে বকুনির ভয়ও থাকতো না। আর আদুল গায়ে সাঁতার কাটার দিনগুলি কোনাদিন ভুলতে পারবে না তোত্তো-চান। নৌকার মতো একটা সুইমিং পুল ছিল স্কুলে। গরমের দিনে মাঝেমাঝে তাতে জল ভরে সাঁতার কাটতো ছেলেমেয়েরা। হেডমাস্টারমশাই চাইতেন শিশুরা সব জামাকাপড় খুলে স্নান করুক। শরীরের পার্থক্য নিয়ে বেশি কৌতূহল থাকার চেয়ে শরীরকে স্বাভাবিক ভাবে দেখতে শিখুক। তোত্তোর বন্ধু ইয়াসুকি-চান, পোলিওতে যার হাত পা বেঁকে গিয়েছিল, তাকাহাশির মতো ছোটোখাটো যারা, অথবা অন্য যে-কোনো ধরণের প্রতিবন্ধিকতা আছে এমন শিশুরা যেন কখনোই তাদের শরীর নিয়ে লজ্জাবোধ না করে, দুর্বল মনে না করে নিজেদের। কী চমৎকার ভেবেছিলেন  হেডমাস্টারমশাই, সোসাকু কোবায়াশি।

তোমোই-এর বার্ষিক স্পোটর্সের বেশিরভাগ খেলা ছিল হেডমাস্টারমশায়ের উদ্ভাবন। অন্যরকম মজার সব  খেলার প্রচলন করেছিলেন তিনি। তাকাহাশি বলে ছেলেটি, যার শরীর কোনোদিন বাড়বে না, পা দুটো ধনুকের মত বাঁকা সে-ই সব খেলায় জিততে লাগলো। সোজা দৌড়াতে না পারলেও জটিল-বুদ্ধির খেলাগুলোতে সে সবাইকে হারিয়ে দিলো। আসলে হেডমাস্টারমশাই সবাইকে সমান সুযোগ দিতে চেয়েছিলেন। তাকাহাশি, ইয়াসুকি-চানের মতো শিশুরা যেন সব প্রতিবন্ধকতা দূর করে জীবনযুদ্ধে জয়ী হবার আত্মবিশ্বাস অর্জন করে। তাই অমন মজার সব খেলার উদ্ভাবন করেছিলেন। পুরস্কার নিয়েও অভিনব ছিলো তাঁর চিন্তা। প্রথম পুরস্কার  ছিলো একটা মস্ত মুলো, দ্বিতীয় জন পেল দুটো বার্ডক-এর শেকড় এবং তৃতীয়জন এক আঁটি পালংশাক। এদিকে শাক-সবজি পুরস্কার পেয়ে তো সবার মন খারাপ। মোটা একটা ছেলে বাঁধাকপি পেয়ে বুঝে উঠতে পারছিলো না ওটা নিয়ে কী করবে। সবার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে হেডমাস্টারমশাই বললেন, ‘মাকে গিয়ে এগুলো দিয়ে বোলো আজ রাতের জন্য কিছু একটা রান্না করতে। এই সবজিগুলো তো তোমরা নিজেরা নিজেদের পরিশ্রম দিয়ে উর্পাজন করেছো, তোমাদের বাড়ির সবার জন্য তোমরা কিছু একটা রোজগার করে নিয়ে যাচ্ছো আজ। এটা ভাবতে তোমার ভালো লাগছে না? এগুলো খেতে খুব ভালো লাগবে, দেখো!’ সত্যি, ‘প্রথম রোজগার’ দারুণ তো ব্যাপারটা! তোত্তো ঠিক করলো মাকে আজ রাতে মশলাদার বার্ডক রাঁধতে বলবে। অন্যরাও ভাবতে লাগলো কার বাড়িতে আজ রাতে কী কী রান্না হতে পারে আর ভাবনাগুলো হেডমাস্টারমশাইকে বুঝিয়ে বলতে লাগলো। ছেলেমেয়েদের তাদের শ্রমের মূল্য বোঝাতে পেরে সোসাকু কোবায়াশির মুখটা একটা সুন্দর হাসিতে আলোকিত হয়ে উঠলো।

অদ্ভুত সব কাণ্ডকারখানা ছিল তোত্তো-চানের। একদিন ওর পয়সার থলেটা সেফটি ট্যাংকে পড়ে গেলো। একটা বিশাল কাঠের হাতা দিয়ে অনেক ঘাঁটাঘাঁটি করেও খুঁজে পেলো না সেটা। এদিকে চারদিকে ময়লা, দুর্গন্ধে ভরে গেছে। সব বড়োরাই ওর পাগলামো দেখলে আঁতকে উঠতেন, চ্যাচাঁমেচি করতেন। কিন্তু হেডমাস্টারমশাই একটুও বকলেন না। খুব স্বাভাবিক ভাবে এসে বললেন, ‘তোমার খোঁজা হয়ে গেলে এ সব যা বের করেছো, ভেতরে ঢুকিয়ে দেবে তো, তাই না?’ তোত্তোর খুব পরিশ্রম হেয়েছিল পুরো কাজটা শেষ করতে। কিন্তু হেডমাস্টারমশাইকে সেদিন আরো আপন মনে হয়েছিলো। হয়তো এজন্যই তোত্তো-চান আর কোনদিন অমন পচা কাজ করেনি। কিন্তু ওর দুষ্টুমি থেমে রইলো না। প্রায়ই সে যেখানে সেখানে লাফিয়ে পড়ে নানা কাণ্ড বাধায়। একবার বালির পাহাড় ভেবে লাফ দিতেই দেখে সেটা সিমেন্ট-বালি মেশানো প্লাস্টার। সারা গায়ে প্লাস্টার মেখে তোত্তো হয়ে গেল একটুকরো দেয়াল। আর একবার এভাবে ঝাঁপ দিয়ে পড়লো সেফটি ট্যাংকের ভেতরে, বুঝুন! তার আগে রকির সঙ্গে নেকড়ে নেকড়ে খেলতে গিয়ে কান কেটে রক্তারক্তি। ব্যথায় চীৎকার করে কাঁদার বদলে উল্টো বারবার বলে চলেছে, ‘রকিকে বোকো না, রকিকে বোকো না।’ দুষ্টুমি করতে গিয়ে এমনই সব ভয়ংকর ব্যাপার ঘটিয়ে বসতো ও। কিন্তু বাবা-মায়ের ভালোবাসা, তোমোই গাকুয়েনের শিক্ষা ব্যাবস্থা ও সোসোকু কোবায়াশির প্রভাব তোত্তোকে শুধরে নিতে শেখাচ্ছিল ।

 

স্কুলেও তোত্তো-চান ওর দুষ্টুমির জন্য বিখ্যাত ছিলো। এমনিতে ও অনেক দিক থেকেই একটা ভালো মেয়ে ছিলো।  সবার সঙ্গেই মিশতো, সুন্দর ব্যবহার করতো। অন্য স্কুলের কেউ তোমোই নিয়ে বাজে কথা বললেই সে ঝগড়া করতো, মারপিট বাঁধিয়ে মার খেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরতো। সবাই বুঝতো যে ওর মনের ভেতরটা ভালোয় ভরা। তারপরও নিজের নানারকম অদ্ভুত কৌতূহল মেটাতে গিয়ে প্রায় নানারকম গণ্ডগোল বাঁধিয়ে বসতো আর কেটে ছরে একসা হতো। কিন্তু হেডমাস্টারমশাই কোনোদিন তোত্তো-চানের মা-বাবাকে ডেকে পাঠাননি, নালিশ করেননি। আসলে তোমোইতে ওসব ছিলোই না। হেডমাস্টারমশাই তোত্তোর সঙ্গে দেখা হলেই বলতেন, ‘তুমি কিন্তু সত্যি খুব ভালো মেয়ে।’ শুনে শুনে তোত্তোরও মনে হতো সত্যি সে একটা ভালো মেয়ে। কোনো-না-কোনোভাবে হেডমাস্টারমশাইয়ের এই কথাটা তোত্তোকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিলো। অনেক পরে বড়ো হয়ে তেৎসুকো অনুভব করেছিলেন সেটা। একইভাবে সোসোকু কোবায়াশি স্কুলের সব শিশুরই কথা শুনতেন যেভাবে প্রথমদিন চার ঘণ্টা ধরে তোত্তো-চানের কথা শুনেছিলেন। সবাইকেই সমানভাবে সহযোগিতা করতেন, উৎসাহ দিতেন। তাকাহাশির মতো শারীরিক প্রতিবন্ধী ছেলেটি যখন সবার আড়ালে গিয়ে লুকানোর চেষ্টা করতো, তখনই তিনি ওকে সামনের সারিতে এনে দাঁড় করিয়ে দিতেন। বলতেন, ‘দেখো, তুমি পারবেই পারবে।’ আজ যে তাকাহাশি সব প্রতিকূলতা দূরে ঠেলে একজন সফল মানুষ, সুন্দর জীবনযাপন করছে তার পেছনে ওর পরিবারের পাশাপাশি সোসোকু কোবায়াশির অবদানও কম নয়। ‘তুমি পারবেই পারবে’ বা ‘তুমি কিন্তু সত্যি খুব ভালো মেয়ে।’ – এ কথাগুলো বলে বলে ছেলেমেয়েদের আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তুলতেন হেডমাস্টারমশাই। তোমোইতে ভর্তি না হলে তোত্তো-চানকে হয়ত একটা স্কুল তাড়ানো ‘খারাপ’ মেয়ে হয়েই থাকতে হতো। আমরা অনেকেই ছোটবেলায় এসব ‘ভালো/মন্দ’ ভাগাভাগির শিকার হয়েছি, তাই না? একটু অন্যরকম ভাবতে গেলেই অল্প বয়সে আমরা পরিবার, সমাজের কাছে ‘উদ্ধত’, ‘বেয়াদব’ আখ্যা পেয়েছি। কখনো কখনো আমাদের বাবা-মায়েরা তোত্তোর বাবা-মায়ের মতো বুঝদার হলেও কুচুটে আত্মীয় স্বজন আর প্রতিবেশীরা তো ছিলোই। ভালোবেসে বোঝানোর চেয়ে শিশু কিশোরদের খুঁচিয়ে উত্যক্ত করেই তৃপ্ত হতেন তারা। অবোধ শিশুদের মধ্যে অন্যায় প্রতিযোগিতা, দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করার ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে আমাদের চারপাশে। তাই টিফিন বক্স, জুতো-স্কুল ব্যাগ নিয়ে, গাড়ি-বাড়ি নিয়ে, জাত-ধর্ম্ নিয়ে শিশুরা না জেনে বুঝেই ঝগড়া করছে, ‘ভালো/মন্দের’ পার্থক্য করছে। ২০ বছর আগে প্রাথমিক বিদ্যালয় ছেড়েছি। শিশুকাল পার করে এসেছি বহুদিন হলো, তবু শিশুমনের কষ্টগুলো এখনো কাঁটার মত বিঁধে আছে বুকের ভেতরে।

 

‘তোত্তো-চান’ পড়তে পড়তে আমরা ছোট্ট তোত্তোকে ভালোবাসার সঙ্গে সঙ্গে সোসাকু কোবায়াশিকেও ভালোবেসে ফেলি। তিনিই তো তোত্তো-চানদের জন্য অমন অনন্য স্মৃতিময় শৈশব নিয়ে এসেছিলেন। ১৮৯৩ সালের ১৪  জুন টোকিওতে এক সাধারণ কৃষক পরিবারে জন্ম সোসাকু কোবায়াশির। প্রাথমিক শিক্ষা শেষে একটি স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি সঙ্গীত শিক্ষা নিতে শুরু করেন ও পরবর্তীকালে টোকিও বিশ্ববিদ্যালযের চারুকলা এবং সঙ্গীত বিভাগে যোগ দেন।

জাপানের বিখ্যাত শিক্ষাবিদ হারুজি নাকামুরা সোসাকু কোবায়াশিকে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছিলেন। নাকামুরা বিশ্বাস করতেন, মানুষের জীবনে প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্বই সেবচেয়ে বেশি। নাকামুরা ক্লাসে অল্পসংখ্যক ছাত্র, পড়াশোনার ক্ষেত্রে শিশুদের অবাধ স্বাধীনতা দেয়ার পক্ষপাতী ছিলেন। পরে সোসাকু কোবায়াশি তোমোই গঠনের সময় এই শিক্ষাপদ্ধতির অনেক দিক অনুসরণ করেছিলেন। ১৯২২ থেকে দু-বছর সোসাকু কোবায়াশি প্যারিসে এমিল জাক্স-ডালক্রোসের স্কুলে ইউরিমিদিক্স নিয়ে পড়াশোনা করেন। ১৯৩৭ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘জাপান ইউরিমিদিক্স অ্যাসোসিয়েশন’। তোমোই গাকুয়েনে ভিন্ন ধারার পড়াশুনার সঙ্গে সঙ্গে সঙ্গীত শিক্ষার উপর জোর দেওয়া হত। কারণ সঙ্গীতপ্রিয় হেডমাস্টারমশাই মনে করতেন, সঙ্গীত পড়াশোনারই একটি অঙ্গ। কেমন করে সঙ্গীতের মাধ্যমে শিশুদের সুক্ষ অনুভূতিগুলো জাগিয়ে তোলা যায়, শুধু কান নয় মন দিয়েও যেন শিশুরা সঙ্গীতকে গ্রহণ করতে পারে সেসব নিয়ে ডালক্রোসের ভাবনা তাঁকে নাড়া দিয়েছিলো। ইউরিমিদিক্সের লক্ষ্য ছিলো শরীর আর মনের ভেতরের তাল ও ছন্দের বোধ জাগিয়ে তোলার মাধ্যমে একটা সুরের ঐকতান সৃষ্টি করা। এই ঐকতান শিশুমনের কল্পনাশক্তি আর সৃজনশীলতার জন্ম দেয়। হেডমাস্টারমশাই বিশ্বাস করতেন,  ‘শিশুদের শরীর আর মনের ঐকতান, একই ছন্দে তালে শরীর মনকে গড়ে তোলা’-র ফলে শিশুরা বেড়ে উঠবে খুব সহজ স্বাভাবিকভাবে। তোমোই-এর সবকিছুতেই ছিলো তাঁর এই আদর্শের প্রতিফলন। ‘এই যে চোখ থাকা কিন্তু কোনো সৌন্দর্য্ দেখতে না পাওয়া, কান থাকা কিন্তু সুর শুনতে না পাওয়া, বুদ্ধি থাকা অথচ বোধ না থাকা, মন থাকা কিন্তু তাতে সুখ দুঃখের স্পর্শ্ না লাগা, মনের মধ্যে আগুন জ্বলে না ওঠা’ – এসবকে ভয় পেতেন শিক্ষাবিদ সোসাকু কোবায়াশি।

শিশুদের হাঁটাচলা, কথা বলা, নিঃশ্বাস নেয়া সব খেয়াল করতেন হেডমাস্টারমশাই। তিনি মনে করতেন প্রত্যেক শিশুরই এটা সুন্দর মন আছে। বড়দের নজরদারি আর প্রতিকূল পরিবেশের প্রভাবে সেই মন হারিয়ে যায়।  সোসাকু কোবায়াশি মানুষের সহজাত গুণের কদর করতেন, চাইতেন শিশুরা যেন আপন সৌন্দর্য বিকশিত করে একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ হয়ে উঠতে পারে। সেজন্যই ১৯৩৭ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন তোমোই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের সেই কঠিন দিনগুলোতে যখন নির্বিচারে লক্ষ লক্ষ মানুষ অন্যায় যুদ্ধে মারা যাচ্ছে, তখন প্রচারবিমুখ সোসাকু কোবায়াশি তোমোই-এর মতো অন্যধারার একটি স্কুল দিয়ে বেঁচে থাকাকে মহিমান্বিত করবার যজ্ঞ শুরু করেছিলেন। কিন্তু পৃথিবী ব্যাপী ছড়িয়ে থাকা যুদ্ধের আগুন আর বীভৎসতা থেকে বেশিদিন মুক্ত থাকতে পারেনি তোমোই গাকুয়েন। ১৯৪৫ সালে টোকিওতে মিত্রবাহিনীর গোলা বর্ষণের একরাতে ধ্বংস হয়ে গেলো তোত্তো-চানদের স্কুল। তিল তিল করে গড়ে তোলা তাঁর স্বপ্নের তোমোই, শিশুদের হাসি-আনন্দ আর গানের ভুবন গ্রাস করে নিল আগুনের লেলিহান শিখা। কিন্তু স্কুলের প্রতি আর স্কুলের শিশুদের প্রতি ভালোবাসা তো আগুনে পুড়ে যাবার নয়। যুদ্ধের পর সোসাকু কোবায়াশি তোমোই-এর ধ্বংসস্তূপের উপরই গড়ে তুলেন একটা কিন্ডারগার্ডেন। কুনিতাচি সঙ্গীত বিদ্যালয়ের শিশু শিক্ষা বিভাগ প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি সেখানে প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ নেন। ইউরিমিদিক্স অ্যাসোসিয়েশন এবং কুনিতাচি সঙ্গীত বিদ্যালয়ে তাঁর অবদানের জন্য মানুষ আজো তাঁকে মনে রেখেছে। ১৯৬৩ সালে ৬৯ বছর বয়সে মৃত্যবরণ করেন মহান শিক্ষাবিদ সোসাকু কোবায়াশি। তোমোই-এর মত আদর্শ্ স্কুল আর গড়ে ওঠেনি ।

 

এই ছিলো মোটামুটিভাবে তোত্তো-চানের গল্প। তোমোই গাকুয়েনের ব্যাতিক্রমী শিক্ষাব্যবস্থা কেবল তেৎসুকো, তাকাহাশিদের নয় তাই-চানের মতো খ্যাতিমান বিজ্ঞানীকেও অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিলো। আবার কুনিও ওয়ি মাধ্যমিক স্কুলে না গিয়েও হয়ে গেলো জাপানের অন্যতম অর্কিড বিশেষজ্ঞ। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনার চেযে অর্কিডের সুরভিত সৌন্দর্য্ ওকে বেশি আকর্ষণ করতো। ভালো লাগার টানে সারা জীবন কাটিয়ে দেয়া  – মনে করিয়ে দেয় সোসাকু কোবায়াশির আদর্শ ‘খোলা মন আর স্বাধীনভাবে কিছু করার অধিকার শিক্ষার উত্তম মাধ্যম।’ জাপানে তোত্তো-চান পাঠ্যপুস্তকের অর্ন্তভুক্ত। সাত বছরের শিশুরাও অভিধানের সাহায্যে ‘তোত্তো-চান’ পড়ার চেষ্টা করে। অথচ একযুগ আগে প্রকাশিত বাংলা অনুবাদটি বাংলাদেশের বেশিরভাগ বাবা মা, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের চোখ এড়িয়ে গেছে। ইটকাঠের জঙ্গলে বেড়ে ওঠা টিভি আর ‘ডোরেমন’ (কার্টুন ছবি) আক্রান্ত এই সময়ের শিশুদের জন্য একটা তোমোই গাকুয়েনের-এর অভাব বোধ করি।

ঈশিতা দস্তিদার

জন্ম চট্টগ্রামে। নৃবিজ্ঞানী।

৯ comments

  1. অদিতি কবির - ৩০ আগস্ট ২০১২ (২:৪৮ পূর্বাহ্ণ)

    সুন্দর মনের সংস্পর্শে এলে নিজের মন সুন্দর হয়। আমরা ভুলেই গেছি প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব- শুধু অক্ষরজ্ঞান নয়, শিশুর প্রথম পৃথিবীই প্রাথমিক স্কুল। সেই পৃথিবী যদি কর্কশ আর অসুন্দর হয়, তাহলে কেমন হয়? খুব সুন্দর পোস্ট।

  2. সুকান্ত - ৩০ আগস্ট ২০১২ (৫:১৩ পূর্বাহ্ণ)

    চমৎকার। খুবই ভাল লাগলো। দেখতে হবে আন্দ্রুশার জন্য পাওয়া যায় কিনা।

    • রেজাউল করিম সুমন - ১ সেপ্টেম্বর ২০১২ (৭:২০ অপরাহ্ণ)

      @ সুকান্ত রক্ষিত

      রুশ ভাষায় তোত্তো-চান (Тотто-тян, маленькая девочка у окна) অনুবাদ করেছেন ল. লেভিন। বইটির অলংকরণও রুশ শিল্পীর। প্রকাশ করেছে Детская литература. আশা করি মস্কোয় পাওয়া যাবে। (কয়েক বছর আগে এই একই প্রকাশালয় থেকে ছাপা এক্সুপেরির ছোট্ট রাজকুমার-এর রুশ অনুবাদ কিনেছিলাম চট্টগ্রামের ফুটপাত থেকে!)

      বিস্তারিত তথ্য এখানে

      • সুকান্ত - ২ সেপ্টেম্বর ২০১২ (১২:০২ পূর্বাহ্ণ)

        @ রেজাউল করিম সুমন

        অসংখ্য ধন্যবাদ।

  3. সানাউল্লাহ - ৩০ আগস্ট ২০১২ (৮:৩১ অপরাহ্ণ)

    একেবারে রূপকথার মতো শৈশব! চমৎকার! অভিভূত হলাম। ধন্যবাদ লেখককে “তোত্তো-চান”-এর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য।

  4. পারু রহমান - ৩০ আগস্ট ২০১২ (১১:১৯ অপরাহ্ণ)

    সত্যিই যদি এমন একটা স্কুল করা যেত বাচ্চাদের জন্যে ! ভীষণ ভাল লাগল তোত্তোর শৈশব-এর কথা পড়তে !

  5. ঈশিতা দস্তিদার - ২ সেপ্টেম্বর ২০১২ (১০:১০ পূর্বাহ্ণ)

    যাঁরা পড়েছেন এবং মন্তব্য করেছেন সবাইকে ধন্যবাদ। লেখার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিলো ‘তোত্তো-চান’-এর পরিচিতি বাড়ানো। তার সঙ্গে জড়িয়ে গেছে লেখকের ব্যক্তিগত আবেগ, ভালোলাগা। কিন্তু পরিকল্পনা অনুযায়ী এগোয়নি আলোচনা। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের হালচাল নিয়ে ভাবনাগুলো লেখা হলো না। আগ্রহী পাঠক যাঁরা ইতিমধ্যেই ‘তোত্তো-চান’ পড়েছেন তাঁদের প্রতি অনুরোধ রইলো এই বিষয়ে তাঁদের চিন্তা শেয়ার করবার।

    রুশ অনুবাদ খুঁজে পাওয়ায় ভালো লাগছে। রেজাউল করিম সুমনকে ধন্যবাদ।

  6. রফিকুল আনোয়ার রাসেল - ২ সেপ্টেম্বর ২০১২ (১২:৩৫ অপরাহ্ণ)

    সত্যি দারুণ একটি লেখা। আমি ইতিমধ্যে বাসায় সরবরাহ করে ভাইবোনদের মধ্যে যারা বাবা-মা, তাদের বাধ্যতামূলক পড়ার জন্য বলেছি। কিন্তু তাদের মধ্যে একজন শুধু আমায় জানাল, সময়ের কথা। প্রতিদিন যে গতিতে পৃথিবী এগুচ্ছে এবং তার গতিমাত্রা বাড়াচ্ছে, তাদের ছেলেমেয়েদের অনেক সময়ের সুযোগ দেয়া কি সম্ভব? তারা আমাকে বললেন, ৫০-এর আগের পৃথিবী আর এখনকার পৃথিবী — মাঝে অনেক পার্থক্য। এমনকি আমরাও একদিন মাঠে চড়তে ফিরতে গিয়ে বালি আর গাছের পাতার সাথে পরিছিত হয়েছি। বিছুটি পাতা বলে একটা ভয়াবহ জিনিশ ছিল। মনে আছে, শীতকালে গ্রামের বাড়িতে খরের গাদায় সারা বিকেল দাপাদাপি, আর সন্ধে হলে হাত-পা ভেজালে শুরু হত জ্বলন, চুলকানি। এ সবই খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। একটু ভাবলে দেখা যাবে, পিতামাতার শৈশবের সাথে আমাদের শৈশবের অনেক পার্থক্য আছে, আবার মিলও আছে। আবার আমাদের পিতামাতার সাথে তাদের পিতামাতার শৈশবের পার্থক্য খুব বেশি নয়। কিন্তু আজকের পৃথিবীতে, আমাদের সন্তানদের সাথে আমাদের শৈশবের আকাশ-পাতাল পার্থক্য। ফলে, তারা যে সময়ের মানুষ, তাদের সেই সময়ের বিবেচনা আর মানসিকতায় বড় হতে দেয়া উচিত। তারা যাতে আমাদের কোন শৌখিন বিবেচনায় সমসাময়িককালে একজন ‘মিসফিট’ এ পরিনত না হয়। আমার অনুরোধ, এই লেখা শুধু আমাদের যেন নস্টালজিক না করে‘তোত্তো-চান’ পাঠকে অনুধাবিত করে, আমাদের সন্তানদের জন্য সময় উপযোগী একটি নতুন ভাবনা নির্মাণে সহায়তা করে। লেখককে ধন্যবাদ ।

  7. অদিতি কবির - ১ অক্টোবর ২০১২ (৬:৫৫ পূর্বাহ্ণ)

    দেরী করে হলেও তোত্তো-চান পড়লাম। কেমন লাগল সেটা তো বুঝতেই পারছেন। আমার সবচাইতে দাগ কেটেছে ‘পাহাড় থেকে, সাগর থেকে’ টিফিন আনার ব্যপারটি। আমার এক সহপাঠিনী একটি তথাকথিত কিন্ডারগার্টেন স্কুলে পড়িয়েছিল কিছুদিন, সে একটা ঘটনা বলেছিল। সেটা এমন- একটা বাচ্চা খুব কাঁদছিল কারণ তার বন্ধুরা নাকি খেলছে না তার সাথে। ব্যপার তদন্ত করতে গিয়ে সহপাঠিনী তো অবাক! ঐ বাচ্চাটা রোজ টিফিনে আলুভাজি আর রুটি নিয়ে আসে, অতএব ওরা গরীব। তাই ওর সাথে মেশা যাবে না! সেজন্যই কেউ ওর সাথে খেলবে না। ওকে বইটা পড়েই ফোন করেছিলাম। আমরা দু’জনেই একটা তোমোই স্কুলের অভাব বোধ করছিলাম এই দেশে।

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.