বেসরকারি সংস্থা সেড আয়োজিত ‘মধুপুর ও লাউয়াছড়া : বিপন্ন বন, বিপন্ন ঐতিহ্য’ শীর্ষক সপ্তাহব্যাপী গোলটেবিল বৈঠকের (২১–২৭ জুন) আগের দিন টিভিতে একটি সংবাদ শুনে বিষাদে আক্রান্ত হই। লন্ডনের একটি সংবাদ সংস্থা জানিয়েছে, এই শতকের শেষ নাগাদ বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরের লোনাজলে তলিয়ে যাবে।
বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও সমুদ্রপৃষ্ঠ উত্থানের সম্ভাব্য ফলাফল ইদানীংকার বহুল আলোচিত প্রসঙ্গ। এই শতকের শুরুর দিকে মস্কো থাকার সুবাদে সেখানকার পত্রিকায় এ ধরনের কিছু প্রবন্ধ পাঠের সুযোগ জোটে এবং জানতে পারি, পৃথিবীর আবহাওয়া মণ্ডলের উষ্ণতা বৃদ্ধির হেতু তাপবর্ধক গ্যাস (কার্বন ডাই-অক্সাইড, ক্লোরো ফোরো কার্বন ইত্যাদি) নয়, বিশেষ প্রাকৃতিক নিয়ম, যা লাখ লাখ বছরে একটি চক্রে আবর্তিত হয়। তৎকালীন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ এরই ওজর দেখিয়ে ওইসব গ্যাস-উদ্গিরণ কমাতে অস্বীকার করেন। কিন্তু বিজ্ঞানী ও পরিবেশবিদদের প্রতিবাদের তোড়ে তত্ত্বটি এক সময় আড়লে পড়ে যায় এবং দেশ দুটি শেষপর্যন্ত পৃথিবীর তাপমাত্রা সুস্থিতকরণের উদ্যোগের শরিকানায় সম্মত হয়।
তবু ভারাক্রান্ত মন নিয়েই সেড-এর গোলটেবিল বৈঠকে ঢুকি এবং অচিরেই মন খারাপ করার মতো আরও নানা উপাত্তের অস্তিত্ব টের পাই। জনৈক অধ্যাপক, যিনি ১৬ বছর লাউয়াছড়া নিয়ে গবেষণা করেছেন, জানান যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অনেক আগেই বাংলাদেশের সম্ভাব্য তেল ও গ্যাস ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করে রেখেছে এবং সেগুলোর প্রত্যক্ষ জরিপ ও খননকাজে সহায়তার জন্য বিভিন্ন দাতা সংস্থার মাধ্যমে বিজ্ঞানী ও পরিবেশবিদদের কয়েকটি পেটোয়া দল গড়ে তুলেছে। সেড-এর প্রধান ফিলিপ গাইন কয়েকটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থার নাম উল্লেখ করে বলেন যে এগুলো মার্কিন প্রভাবিত দাতা সংস্থা, বহুজাতিক কোম্পানি, এমনকি খোদ শেভরনেরও সাহায্যপুষ্ট। আমি দারুণ ধন্দে পড়ে যাই। প্রথমত, ওইসব পরিবেশবাদী সংস্থার কোনো কোনোটিতে আমারও যাতায়াত আছে, অনেককে চিনি, কেউ আমার প্রাক্তন ছাত্র, কেউ বা কনিষ্ঠ বন্ধু। তারা সজ্ঞানে দেশের স্বার্থবিরোধী কাজে লিপ্ত — এমনটি ভাবতে পারি না।
দ্বিতীয়ত, পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ অতি ক্ষুদ্র, জনসংখ্যাপীড়িত দরিদ্র একটি দেশ, যার সামান্য সম্পদের ওপরও ধনকুবের পরাশক্তির নজরদারি আছে এবং এর নিয়ন্ত্রণ কব্জায় রাখতে তারা সচেষ্ট। অর্থনীতি ও বাণিজ্যে মানবিকতার প্রসঙ্গ বস্তুত ভাবালুতারই নামান্তর। দার্শনিক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী কার্ল পপার এগুলোকে ‘অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম’ বলেছেন। প্রক্রিয়াটি প্রাকৃতিক নিয়মের মতোই অমোঘ ও নির্মম। অতঃপর আরও দুটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন — আমরা কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও উন্নত বিশ্বের সর্বগ্রাসী প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারি? আর খনিজ আহরণ ও শিল্পের প্রসার কি প্রকৃতি ধ্বংস ও আবহদূষণ এড়িয়ে সম্ভব? দুটিই বহুল আলোচিত প্রসঙ্গ এবং সমাধানের সুপারিশগুলোর অধিকাংশই ইউটোপিয়াপুষ্ট অথবা দলীয় রাজনৈতিক কর্মসূচির উপকরণ। এমন প্রস্তাব খুব অযৌক্তিক নয় যে মার্কসের বস্তুবাদী ঐতিহাসিকতার সূত্র এ ক্ষেত্রে দিকনির্দেশনায় কিছুটা সহায়তা দিতে পারে।
এই তত্ত্বানুসারে উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ একটি বিশেষ স্তরে পৌঁছালে বিদ্যমান সমাজকাঠামোর সঙ্গে তা সংঘাতে লিপ্ত হয় এবং পুরোনোর উৎখাতের মাধ্যমে নতুন সমাজের জন্ম লাভ ঘটায়। এভাবেই আদিম সাম্যবাদী সমাজ থেকে সামন্ততন্ত্র এবং সামন্ততন্ত্র থেকে ধনতন্ত্রের উদ্ভব ঘটেছে; এবং ধনতন্ত্র থেকে সমাজতন্ত্রের উদ্ভব ঘটবে এবং মানবসভ্যতা একদিন কমিউনিজমে পৌঁছাবে। সমাজবিবর্তনের এই ধারায় কোনো সমাজ-সংস্থাকেই এড়িয়ে যাওয়া যাবে না, ধনতন্ত্রকে পাশ কাটিয়ে সমাজতন্ত্রে উত্তরণ সম্ভব হবে না। বলা যেতে পারে, আজকের বিশ্বপুঁজিবাদের যে সংকট, তা উৎপাদিকা শক্তির ব্যাপক বৃদ্ধির ফল এবং তা ঘটেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার অভূতপূর্ব উন্নতির দৌলতে।
বিশ্বের পরাশক্তি এই সংকট উত্তরণে অপারগ, তারা বৈপ্লবিক পরিবর্তনের বদলে পুরোনো পদ্ধতিতে সমাধান খুঁজছে, বিশ্বায়নের স্বপ্ন দেখছে। উন্নয়নশীল বিশ্বের ওপর আগ্রাসন বাড়ছে; এ থেকে বাংলাদেশও রেহাই পাচ্ছে না। এই পরিস্থিতির রাজনৈতিক চেহারা ভয়াবহ। তারা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে আন্তঃসংঘর্ষে জড়ানোর উস্কানি বাড়াচ্ছে, কোথাও কোথাও নিজেও জড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু শেষপর্যন্ত নিজেদের টিকিয়ে রাখতে পারবে কি?
খনিজ আহরণ ও প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস হলো বৃহৎ একটি সমস্যার খণ্ডাংশ মাত্র। ধরা যাক, লাউয়াছড়ায় প্রচুর গ্যাস পাওয়া গেল এবং খনিটি বনের মধ্যে রাখাও জরুরি বিবেচিত হলো। তখন কী হবে? উল্লুক ও কিছু দুষ্প্রাপ্য গাছপালা রক্ষার জন্য গ্যাস বর্জনের পক্ষে কি কোনো জনসমর্থন মিলবে? মিলবে না। মানুষ ভোগী জীব, আশু লাভেই অধিকতর আকৃষ্ট। ‘ডিপ ইকোলজি’ মানুষ ও প্রকৃতির মিথোজীবিতামূলক যে সভ্যতার স্বপ্ন দেখে তা এখনও ইউটোপিয়া-সম। তবু এটা দুর্লক্ষ্য নয় যে পুঁজিবাদ-উত্তর সম্ভাব্য সমাজকাঠামো ও ইকোলজি-ভাবনা কোথায় যেন মিশে আছে, যেখানে অর্থনীতি ও ইকোলজির সুষম সংশ্লেষ ঘটবে; মানুষ যুগ-যুগান্ত ধরে যে ন্যায় ও সমতাভিত্তিক সমাজের স্বপ্ন দেখেছে, তা সত্য হয়ে উঠবে।
[প্রথম প্রকাশ : প্রথম আলো, ২০ জুলাই ২০০৮, ৫ শ্রাবণ ১৪১৫]
দ্বিজেন শর্মা
জন্ম ১৯২৯, সিলেট। উদ্ভিদবিদ্যার শিক্ষক (ব্রজমোহন কলেজ, বরিশাল ও নটর ডেম কলেজ, ঢাকা); অনুবাদক, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো; শিক্ষা, বিজ্ঞান, প্রকৃতি ও পরিবেশ বিষয়ক লেখক। বসবাস ঢাকায়। শখ : উদ্যান পরিকল্পনা।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
৬ comments
আলমগীর কবীর - ৩০ জুলাই ২০০৮ (৩:৪৬ অপরাহ্ণ)
স্মরণাতীত কাল থেকে যাঁরা ক্ষমতায় যান, তাঁরা কেন মানুষের ভালো নিয়ে ভাবেন না! আর যাঁরা ভাবেন, তাঁরা কেন ক্ষমতায় যান না!
হাসান মাহমুদ - ৭ আগস্ট ২০০৮ (৩:২১ অপরাহ্ণ)
“লন্ডনের একটি সংবাদ সংস্থা জানিয়েছে, এই শতকের শেষ নাগাদ বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরের লোনাজলে তলিয়ে যাবে”।
It is not a new proposition. This is one of the few geological certainties scientists have been warning the world for decades. Another one is destruction of New York city by a huge cyclone – but they couldn’t predict the timeline.
Roughly, water level of world’s all oceans are rising about 7 millimetres a year due to huge ice melting of the arctic. On the other hand the POLIMATI brought by the Padma / Jamuna has been reduced so much so that Bengal’s land is raising 5 millimetres a year. Plus, rivers are taking some MATI to Bay of Bengal .
Overall we are in a loss of about 2 millimetres a year, every year.
It is a dangerous phenomenon for a plain land like ours.
As far as I know geo-scientists are still struggling to develop its antidote.
In 30 – 50 years we might see the largest mass-migration in human history when about 1/3 of Bangladesh will be under water.
One of my musical pieces was on this issue and presented 10 years ago in Toronto. With songs and recitals in JARI-SARI tune the geological data were presented about how many million cusecs of water and how many million tons of POLIMATI were normally brought to Bengal per year by our rivers 100 years ago, and how much it is reduced by now. The reduction is alarming. Also, the bed of the Padma raised 18 feet on average, seriously reducing its water-contain ability that results in flood almost every year. I took these data from the PhD thesis of Khalequzzaman (Abdul Khaleq?), a Bangladeshi PhD geology-student then in Philadelphia USA.
Hasan Mahmud
(Sorry I can’t use the Bangla font yet. It is up to Moderator if postings can be made in English until I learn).
Pingback: ‘লাউয়াছড়ার শেকড়’ - দ্বিজেন শর্মা’র পোস্ট নিয়ে কিছু ভাবনা | মুক্তাঙ্গন : নির্মাণ ব্লগ
মাসুদ করিম - ২৭ ডিসেম্বর ২০১২ (১২:৪৪ পূর্বাহ্ণ)
মাসুদ করিম - ৩০ ডিসেম্বর ২০১২ (১১:০৯ পূর্বাহ্ণ)
হ্যাঁ, আমাদের সুপারিশকৃত লিন্কে ফেব্রুয়ারি ২০১২তেই খবরটা ছিল। ‘গত বছরের ফেব্রুয়ারি’ নয় এটা হবে ‘গত ফেব্রুয়ারি’। সবচেয়ে কৌতুহল উদ্দীপক হচ্ছে ভারতেও এই প্রজাতিটি উত্তরপূর্ব ভারতের পাহাড়ি অঞ্চলেই পাওয়া গেছে। এতে মনে হচ্ছে আমাদের দেশের লাউয়াছড়ার প্রাণীটিও সেই একই প্রজাতির হওয়ার সম্ভাবনা খুবই বেশি।
দেখা যাক, লাউয়াছড়ায় পাওয়া প্রাণীটির ডিএনএ টেস্ট কী বলে?
মাঈনউদ্দিন মইনুল - ৩ মে ২০১৩ (১০:৩১ অপরাহ্ণ)
লেখাটি অন্য কোনখানে একবার পড়েছি, তারপরও আবার পড়লাম। ভোগবাদিতার কারণেই তো পরিবেশ বিপর্যয়। অথচ দেখুন, ভোগ করলো এক পক্ষ আর দুর্ভোগের শিকার হচ্ছি আমরা।