কালঃ ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৮, সকাল-৯/১০টা। স্থানঃ রাঙামাটির প্রবেশদ্বার-রাজারহাট ইউনিয়নের বনবিভাগের একটি বাংলো। উপস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়ের আমাদের বিষয়ের প্রাগান্তিক পর্বের শিক্ষার্থীরা এবং আমাদের একজন শিক্ষক। তিনি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের একজন শিক্ষককে। তিনি কিছু বক্তব্য রাখবেন আমাদের কাছে একুশ নিয়ে (পদাধিকারবলে, যেহেতু ঐ-বিষয়ে তিনি মনোপলিস্ট: শিক্ষক এবং বাংলার শিক্ষক হিসেবে)। একটা হোয়াইট বোর্ডে আমার এক বন্ধু লিখলো (সম্ভবত) ‘মহান একুশে ফেব্রুয়ারী, ১৯৯৮’। বললাম, ভুল লিখেছিস। ফেব্রুয়ারি বানানটা হ্রস্ব ই-কার দিয়ে হবে। সে ঠিক করলো বানানটা(খুব সহজে নয়)। অধ্যাপক মহোদয় বেরিয়ে এলেন বক্তৃতা দিতে। প্রথম কথাটাই হলো এরকম, “আমি ভেতর থেকে শুনছিলাম বানান নিয়ে তর্ক হচ্ছে। কেন এমন হবে?” মানে, চলুক আগের বানানটা। এরপর আরো বেশ কিছু, নানা কিছু। আমার মাথা লজ্জায় কাটা যাচ্ছিলো, না বানান ভুল (তাঁর ভাষায়) করার জন্যে নয়, তাঁর ভুলটা ধরিয়ে দিতে না-পারার জন্যে। বেশ আহত হয় আমার পৌরুষ সেদিন। বার্নার্ড শ-এর একটা কথা আমি মনে রাখার চেষ্টা করতাম। “যদি কিছু জানো, তাহলে তা এমন করেই জানো, যেন কেউ তা নিয়ে তোমার ভুল ধরতে না পারে” (মানে, মূল কথা এটাই)। তবে, পারি না আর কি সবসময়। যাহোক, এরপর থেকে বেশ উৎসাহ নিয়ে বানান-সংক্রান্ত লেখালেখি পড়তে নেমে পড়ি। যথারীতি জোশটা মাঝপথেই থেমে যায় বিধায় খুব বেশি কিছু সংগ্রহ করে উঠতে পারি নি। তবে, প্রচুর ছাত্র-ছাত্রীদের বাংলা পড়াতে পড়াতে বানান ভুল সম্পর্কে বেশ ভালো একটা ধারণা তৈরি হয়ে গেছে এবং কখনো কখনো ভুল বানান দেখতে দেখতে শুদ্ধ বানান নিয়ে নিজেই বিভ্রান্তিতে পড়ে যাই (শিব্রাম এমনই এক মাস্টার নিয়ে গল্প লিখেছিলেন যে ‘পৃথিবী’ শব্দের আটরকম বানান দেখে বানানটাই ভুলে গেছে)।
তবে, এটুকু বলতে পারি, যেরকম সুনীল ‘প্রথম আলো’-তে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বলেছিলেন, “ভুল বানান দেখলে রবির রীতিমত শারীরিক কষ্ট হয়”, তেমনটা না হলেও কাছাকাছি হয়। তাই, শুদ্ধ বানানের খোঁজে থাকি অহরহ। আর জ্ঞানমত ভুল বানান দেখলে শনাক্ত করার চেষ্টা করি। পাশাপাশি এ-ও চেষ্টা করি নিজে আরো জানার ও শেখার। কারণ, এখনো ভুল করি, ভুল লিখি। তাই ঠিক করার এই চলিষ্ণু প্রক্রিয়ায় অন্যদেরও একটু সতর্ক এবং ভ্রান্তিহীন হওয়ার পথে কিছুটা হলেও সহযাত্রী করার জন্যে আমার প্রথম ব্লগটি ‘বাংলা বানান ও ব্যাকরণরীতি ও অন্যান্য-১’। বেশ একটু তাড়াহুড়োয় প্রথম ব্লগ লেখার উত্তেজনায় লেখাটায় বেশ কিছু বানান ভুল তো (যেমন: ব্রগ (ব্লগ), মিখষ্ক্রিয়া (মিথস্ক্রিয়া), খ্রীন্টাব্দ (খ্রীস্টাব্দ) ইত্যাদি) ঘটেছেই, তথ্যঘাটতিও আছে বেশ। যাহোক, এবার বলবো একটু অন্য কথা।
বানান ভুল বাংলা ভাষার একটা ঐতিহাসিক অনুষঙ্গ।
মহাগ্রন্থ ‘ODBL’-এ ড. সুনীতিকুমার, “Scribes were careless and they were careless even with regard to the Sanskrit words. There was no uniformity, the same word being written differently in the same page and even in the same line.” (vol. I, p. 226)
বঙ্গীয় শব্দকোষ অভিধানের সংকলক হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৮৬৭-১৯৫৯) আক্ষেপ: “বাঙলায় শব্দের বানান এক বিষম সমস্যা; এখনও ইহার সমাধান হয় নাই, হইবে কিনা জানি না।” ((হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বঙ্গীয় শব্দকোষ, দ্বিতীয় সংস্করণ, নিউদিল্লি, ১৯৬৬, প্রথম খণ্ড, পৃ. ৩৫))
চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা, রোধ করার কেউ নেই। পেশ করা হলো বানান-বৈচিত্র্যের (নাকি বলবো বানান-ব্যভিচারিতার)কিছু উদাহরণ, যা অনেক আদিকাল থেকেই এই অঞ্চলে প্রচলিত: “সংস্কৃতে একটা শব্দের বানান পেয়েছি আটরকম-ভ্রুকুটি ভ্রুকুটী ভ্রূকুটি ভ্রূকুটী ভৃকুটি ভৃকুটী ভ্রকুটি ভ্রকুটী”। আবার, বাংলাও কম কিসে, তাই ‘করছি’ ক্রিয়াপদটির ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, “শব্দটির বানান ছিল ডজন-তিনেক। ক, ক’, কো; র, র্, রেফ, সম্পূর্ণ র বা রেফবিহীন; চি, চ্চি, ছি, চ্ছি-এই বর্ণগুলির প্রায় সবরকমের সম্ভাব্য বিন্যাস দেখা যেত।” ((মণীন্দ্রকুমার ঘোষ, বাংলা বানান, তৃতীয় সংস্করণ, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, ১৯৭৯, পৃ. ৩০)) হায়, রবীন্দ্রনাথ! অগত্যা, তোমারেই স্মরি!
“দেশ অরাজক?
অরাজক কে বলিবে মহারাজ, সহস্ররাজক।”
১৯৩৫-৩৬-এ প্রথম বাংলা বানান সংস্কার। কর্তৃপক্ষ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। কারণ: রবীন্দ্রনাথের অনুরোধ। এছাড়া, ১৯৩৫ সালের নবেম্বরে এই বিশ্ববিদ্যালয় মাধ্যমিক শিক্ষার বাহন হিসেবে বাংলার নাম ঘোষণা করে। রাজশেখর বসুকে সভাপতি এবং চারুচন্দ্র ভট্টাচার্যকে সম্পাদক করে বাংলা বানানের নীতিমালা প্রণয়নের জন্যে একটি সমিতি গঠন করা হয়। সমিতির সদস্যেরা: প্রমথনাথ চৌধুরী (প্রমথ চৌধুরী), বিধুশেখর ভট্টাচার্য, বিজয়চন্দ্র মজুমদার, সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার, দ্বারকানাথ মুখোপাধ্যায়, খগেন্দ্রনাথ মিত্র, দুর্গামোহন ভট্টাচার্য, চিন্তাহরণ চক্রবর্তী, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, বিজনবিহারী ভট্টাচার্য ও অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ। সমিতিতে প্রমথনাথ বিশী-রও ভূমিকা ছিলো। এছাড়া, দেবপ্রসাদ ঘোষ, ড. মু. শহীদুল্লাহ প্রমুখ বিশেষজ্ঞ এবং বিশ্ববিদ্যালয় ছাপাখানার কর্মী অজরকুমার সরকার প্রমুখের পরামর্শও সমিতি কর্তৃক গৃহীত হয়।
তবে, শেষরক্ষা হয় নি।
সুনীতিকুমারের পিতৃদেব (হরিদাস চট্টোপাধ্যায়) স্বয়ং পুত্রবিরোধিতায় অবতীর্ণ হন। তীব্র বিরোধীদের মধ্যে আরো ছিলেন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় (‘প্রবাসী’ সম্পাদক), দেবপ্রসাদ ঘোষ প্রমুখ। “অসংখ্য লেখক, প্রায় সমস্ত ইংরেজী বাংলা দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক পত্রের সম্পাদক, এমনকি রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের মতো ধীরবুদ্ধি রবীন্দ্রানুরাগী মনীষীও এই নিয়মের উপর এমন বিরূপ হলেন যে তৎকালীন বাংলা সরকার এবং খোদ কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ও বলতে বাধ্য হলেন যে এই বানান-বিধি অবশ্য-পালনীয় নয়।” ((মণীন্দ্রকুমার ঘোষ, বাংলা বানান, তৃতীয় সংস্করণ, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, ১৯৭৯, পৃ. ২৫)) কেউ কেউ কিছুটা ভিন্নমত তুলে ধরেন।
গ্রহণ করেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। সংস্কার সমিতির প্রথম পুস্তিকা প্রকাশিত হয় ৮ মে, ১৯৩৬ সালে। পুস্তিকার প্রথমেই রবীন্দ্রনাথের হস্তাক্ষরে ছাপা কয়েকটি লাইন-“বাংলা বানান সম্বন্ধে যে নিয়ম বিশ্ববিদ্যালয় নির্দিষ্ট করিয়া দিলেন আমি তাহা পালন করিতে সম্মত আছি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১১ই সেপ্টেম্বর, ১৯৩৬।” আরও একটি স্বাক্ষর ছাপা দেখা গেলো: “শ্রীশরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।” ভূমিকায় উপাচার্য শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় জানালেন: “কিছুকাল পূর্বে রবীন্দ্রনাথ চলিত বাংলা ভাষার বানানের রীতি নির্দিষ্ট করিয়া দিবার জন্য কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে অনুরোধ করেন। গত নভেম্বর মাসে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বানানের নিয়ম-সংকলনের জন্য একটি সমিতি গঠন করেন। সমিতিকে ভার দেওয়া হয়-যেসকল বানানের মধ্যে ঐক্য নাই সেসকল যথাসম্ভব নির্দিষ্ট করা এবং যদি বাধা না থাকে তবে কোন কোন স্থলে প্রচলিত বানান সংস্কার করা। প্রায় দুইশত বিশিষ্ট লেখক ও অধ্যাপকের অভিমত আলোচনা করিয়া সমিতি বানানের নিয়ম সংকলন করিয়াছেন।…আবশ্যক হইলে ইহা সংশোধিত ও পরিবর্তিত হইতে পারিবে।” তৃতীয় সংস্করণটি আসে জুন, ১৯৩৭-এ। কিছুটা সংস্কার করা হয়েছিল এটাতে শ্যামাপ্রসাদের কথা অনুযায়ী। কিন্তু, কট্টর সংস্কৃতপ্রেমী পণ্ডিতদের পক্ষে নয় কোনটিই।
উদাহরণ: প্রথম সংস্করণে ছিল, “সংস্কৃত শব্দে যদি ব্যুৎপত্তির জন্য আবশ্যক হয় তবেই রেফের পর দ্বিত্ব হইবে; যথা-কার্ত্তিক, বার্ত্তা, বার্ত্তিক ইত্যাদি। অন্যত্র দ্বিত্ব হইবে না।” কিন্তু, তৃতীয় সংস্করণে “কোন ক্ষেত্রেই রেফের পর দ্বিত্ব আর ফিরে এল না।” ((মণীন্দ্রকুমার ঘোষ, বাংলা বানান, তৃতীয় সংস্করণ, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, ১৯৭৯, পৃ. ১৮)) আজকাল এটাতো রীতিমত প্রতিষ্ঠিত বানানরীতি। কিন্তু, একটা সময় বাংলা বানান নিয়মে বাঁধতে কী পরিমাণ যে বিরোধিতা সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলো, তার ইতিহাসগত বিবরণ রীতিমত কৌতূহলোদ্দীপক। দুঃখ এটাই যে আজও বানানের নিয়মে চূড়ান্ত শৃঙ্খলা নেই। এবং, যথার্থই বলেছেন হায়াৎ মামুদ তাঁর ‘বাঙালির বাংলা ভাষা ইদানিং’ (ইমতিয়ার শামীম যেদিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন আমার পূর্বতন ব্লগে এবং ধন্যবাদার্হ হন) গ্রন্থে যে, মূলত লেখকেরাই এই বানানবিভ্রান্তির জন্যে বহুলপরিমাণে দায়ি (শব্দটা ‘দায়ী’ হবে না ‘দায়ি’, এনিয়েও একটি মজার আলোচনা করা যেতে পারতো একটি ঐতিহাসিক ঘটনার উল্লেখ করে, যা সময়াভাবে স্থগিত রইলো)। অন্তত দুটি শব্দের গণবানানভুলের জন্যে, আমি মনে করি, এই বঙ্গের দুজন লেখক সহোদর বা সহোদর লেখক অপরাধী। একটি (তাঁদের বানানে) ‘শূণ্য’, অপরটি ‘এক্ষুণী’। ভুল দেখলে ভুলের প্রবণতা তো বাড়বেই। পবিত্র সরকারের ‘বাংলা বানান সংস্কার: সমস্যা ও সম্ভাবনা’ বইয়ে এরকম একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। একটি চলচ্চিত্রের পোস্টারে ‘ব্রজবুলী’ এই ভুল বানানটি লেখা থাকায় পরীক্ষায় বানানটি আশঙ্কাজনক হারে চোখে পড়তো। বহুজনপ্রিয় (আমিও ভক্ত তাঁদের) সেবা প্রকাশনীই বা কম কিসে? তাদের নানান বইয়ে নানান বানান। বিদেশি শব্দ কোথাও ‘য’, (যেমন: আলেকযান্ডার, ইমবোযউই), কোথাও ‘জ’; ‘ঙ’ বা ‘ং’-এর ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট নিয়ম না থাকা (যেমন: “ভাঙল না আঙটা। রিঙটা উঠল”); ঈ-কারের ব্যবহারের প্রাদুর্ভাব (সী. চীফ, জংলী, নাড়ী) ইত্যাদি পাঠকদের ঠিক বানানের দিকে টানবে কি? এমনকি, প্রগতি প্রকাশনের বইয়ের ক্ষেত্রেও নির্দিষ্ট বানানরীতি ছিলো বলে মনে হয় নি। (এ-বিষয়ে রেজাউল করিম সুমন বোধহয় অথরিটি) এই মুহূর্তে মনে পড়ছে ননী ভৌমিকের অনুবাদে ম্যাক্সিম গোর্কির ‘ইতালির রূপকথা’ বইয়ে চোখে-পড়া ‘কাণা’ বানানটি। আর শিরোনামে ‘ইতালি’ থাকলেও ভেতরে পাতায় পাতায় ‘ইতালী’। এমনকি, একই গল্পের দুই পাতায় দেশটির দুরকম নাম। মুদ্রণপ্রমাদও ঘটে। তবে, ছাপাখানার ভূতের কাণ্ড আর না-জেনে ভুল লেখা দুটোর অপরাধ সমান না হলেও ফলাফলের দিকে খুব একটা হেরফের হয় না।
কাজেই, চাই বিশুদ্ধ বানানের নিয়ম, প্রথমত। আর দ্বিতীয়ত, চর্চা। প্রথম বাক্যটিও বিতর্কিত, কারণ বানান বিশুদ্ধ কি না সে-দায়িত্ব নির্ধারণ করছে কে বা কারা এবং সে-অনুশাসন সবাই মানছেন কি না। “…একটি সর্বজনমান্য আকাদেমি গোছের কিছু থাকলে তার কাছে ফতোয়া চাওয়া যেত। আকাদেমিই বলে দিত, আজ থেকে এই শব্দগুলি ভাষা থেকে বাতিল হল, তার বদলে নুতন বানানে শব্দগুলির অন্য চেহারা হল; এখন থেকে সবাই নতুন বানানে শব্দগুলি লিখবেন। নরওয়েতে যেমন হয়।” ((পবিত্র সরকার, বাংলা বানান সংস্কার: সমস্যা ও সম্ভাবনা, তৃতীয় সংস্করণ, কলকাতা, ১৯৮৭, পৃ. ১০৭)) প্রস্তাবক পবিত্র সরকার নিজেই অবশ্য জানেন তা হওয়ার নয়। তাই একই পৃষ্ঠায় বলছেন, “সুতরাং এক্ষেত্রে আকাদেমি বিশেষ কার্যকর হবে না। আর-একটা কারণ-বাংলাদেশ নামে পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্রে যে বিপুল সংখ্যক মানুষ বাংলা ভাষা লেখেন, তাঁরা সবাই কি মেনে নেবেন এসব প্রস্তাব?” ((পবিত্র সরকার, বাংলা বানান সংস্কার: সমস্যা ও সম্ভাবনা, তৃতীয় সংস্করণ, কলকাতা, ১৯৮৭, পৃ. ১০৭-৮)) প্রশ্নটা আমাদেরও। যাহোক, আপাতত আমাদের কথাই চিন্তা করি। নিজেরাই বানান-বিশেষজ্ঞ, এই ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে এবং আলোচনার মাধ্যমে বিবুধসমাজ একটি প্রামাণ্যরীতি অনুসরণ না করলে এই বানান ভুলের এবং স্বেচ্ছাচারী বানানের (এর পরিমাণ এখন অনেকটাই কম, কিন্তু অনুপস্থিত নয়) মাত্রা হ্রাস পাবে বলে মনে হয় না। মাইকেল লিখতেন ‘কর্ত্তুম, কর্ত্তে, কচ্যি’; গিরিশচন্দ্রে ‘র্ব্ব’ চোখে পড়ে (কর্ব্বেন, মার্ব্বো); দ্বিজেন্দ্রলাল রায় আরও চমৎকার, তিনি ‘কর্চ্ছি, পার্চ্ছি’-তেও চলে গেছেন; বিদ্যানিধি যোগেশচন্দ্র রায় ‘কল্য, চাউল, দাইল’ বোঝাতে লিখতেন ‘কৗল, চৗল, দৗল’; ‘প্রবাসী’-তে সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় কিছুকাল লিখে গেছেন, ‘খাওা, যাওা’ ইত্যাদি। শব্দগুলো কি বলুনতো? ‘খাওয়া, যাওয়া’! অবশ্য, সবই প্রমিতকরণের আগের বানান। বুদ্ধদেব বসু তো রীতিমত বিদ্রোহই ঘোষণা করে বসেছিলেন অনেক বানানের বিপক্ষে। লিখেছেন ‘স্ টেশন, স্ টিমার, ওঅর্ডস্বর্থ’ প্রথম দুটির ভঙ্গি নিয়ে নাকি কেউ কেউ ব্যঙ্গ করে বলতেন, “মরি মরি কী সটাইল রে বাবা”!
এবার আমাদের মাটিতে। রুদ্রের লেখায় ছিলো প্রচুর নিজস্ব বানান। তিনি বেশ কিছু বানান (সব নয়) উচ্চারণানুগভাবে লিখবেন ‘নরোম, কেমোন, মাংশ’; বাদ দেবেন পদমধ্যে বিসর্গ বা যুক্তবর্ণ হলে পদান্তে য-ফলা (দুখ, সন্ধা) এবং এই মুহূর্তে মনে না-পড়া আরো কিছু। হুমায়ুন আজাদও লিখছেন, ‘েঅৗড (ode)’ এবং গোটা জীবন ধরে লিখে গেছেন ‘বাঙলা, বাঙলাদেশ’। বাংলা ‘একাডেমী’-র (এটা ভুল বানান, এটা ভুল বানান, এটা ভুল বানান) ১৯৯১-এর প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম-এ বলছেন (অনু: ২.১০), “বাংলা এবং বাংলাদেশ শব্দ দু’টি ং দিয়ে লিখতে হবে; বাংলাদেশের সংবিধানে তাই করা হয়েছে।” ((বাংলা একাডেমী, প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম, দ্বিতীয় সংস্করণ, ঢাকা, ১৯৯৪, পৃ. ১২)) বেশ কথা, কিন্তু, সংবিধানে কোন বিধানে বানানটি লেখা হলো? বানানের সংবিধানটা কোথায়? তবে, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ‘বাঙ্গালী’ বহুদিন আগেই ঠাঁই নিয়েছে ইতিহাসের কোলে। অবশ্য, ‘ওঅর্ডস্বর্থ’ এবং ‘েঅৗড’ বানানগুলো প্রতিবর্ণীকরণ সংক্রান্ত। এ-নিয়েও একটি ছোটখাটো ব্লগ লেখার ইচ্ছে আছে।
[আগামী সংখ্যায় সমাপ্য]
নেহাৎ সাদাসিধে নাগরিক হয়ে বাঁচতে চাই। একটু অন্যরকম স্থান, কালের রূপ দেখতে চাই। পড়তে চাই, পড়ি — এটুকুই। আর তেমন কিছু নয়।