ঠিক ফেব্রুয়ারিটা এলেই যেন আমাদের বাংলা ভাষা চর্চার প্রাবল্য, উৎসাহ আর অনেকটাই বুঝি দেখানোপনার রমরমা প্রচারণা, ব্যবসা ইত্যাকার নানা প্রপঞ্চ ও প্রবণতা চোখে পড়বেই কি পড়বে। অনেক পুরুষেরও মানসিক স্তনবৃন্ত টনটন করে উঠবে বাংলা ভাষা, এর বর্তমান, ভবিষ্যৎ ইত্যাদি নিয়ে আকুল হয়ে কিছু বলার ইচ্ছেয়, কিছু লেখার তাড়নায়, কিছু প্রকাশের বেদনায়। মর্দে মুমিনেরা উর্দুর জন্যে হাহাকার করেন না বোধহয়, কারণ পালের গোদাটিকে অনেকদিন ধরেই ‘ভাষাসৈনিক’ বলে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা বর্তমান। এবিষয়ে অফটপিক হলেও প্রয়াত শওকত ওসমানের একটা যুৎসই মন্তব্য স্মরণে না এনে পারি না, “বেশ্যাও একদা সতী থাকে!” মন্তব্যটি তাঁদেরই এক দ্বিনি ভাইয়ের কাছে করায় তাঁর মারমূর্তিও যথেষ্ট দর্শনীয় হয় বটে। যাক গে, দে গরুর গা ধুইয়ে।
যা বলছিলাম, মাতৃভূমির স্বাতন্ত্র্য, সম্মান আর স্বাধীনতা বজায় রাখতে যদি সংখ্যাগরিষ্ঠের কোন আপত্তি না থাকে, তবে, মাতৃভাষার শালীনতা বজায় রাখাও কি বাঞ্ছনীয় নয়? আমি উপভাষার বহুল প্রচলন নিয়ে এখন কিছু বলতে চাইছি না, বস্তুত, বাংলা চলিত রীতির বর্তমান উত্থান কিন্তু এক বা একাধিক বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত উপভাষার সম্মিলিত মিখষ্ক্রিয়া। তবে, যাঁরা অন্তত প্রমিত বাংলায় লেখেন, তাঁদের বাংলা বানানের কিছু নিয়মের কথা (যে-সংক্রান্ত ভুল প্রায়ই চোখে পড়ে এবং কিছু মানসিক কষ্টপ্রাপ্তি হয় অনুষঙ্গ) এবং কিছু ব্যাকরণমূলক নিয়মের কথা জানানো্ই আমার এই ব্রগের প্রথম প্রয়াসটির উদ্দেশ্য। আশা করি, নিয়মগুলো মানুন না মানুন, একটু চোখ বুলিয়ে জানলে ভাষার ভুল ব্যবহার সম্পর্কে অন্তত কিছুটা হলেও সচেতন হবেন।
১) বানান সংক্রান্ত দু’চার কথা
ক) যুক্তাক্ষর সংক্রান্ত :
– আধুনিক নিয়মানুসারে যুক্তবর্ণ যথাসম্ভব সরলভাবে লেখার কথা, অর্থাৎ, ‘রূ’ বা ‘শু’-এভাবে, অন্যরকমভাবে নয়। অন্য রূপের যুক্তবর্ণটি এখানে লেখা যাচ্ছে না, তাই দেখাতে পারছি না। তবে, ছোটবেলায় পড়া ‘রূপকথা’ বা ‘শুয়োর’ শব্দটি মনে করলে ভিন্নরূপটি চোখে ভাসবে। মানে, পাশের হাতলটি হবে বা মাথার প্যাচটা হবে না আর কি। এমনিভাবে, যথাসম্ভব।
– ‘হ্ন’ এবং ‘হ্ণ’ এদুটি যুক্তবর্ণ ‘হ’ বর্ণটির সাথে যথাক্রমে ‘ন’ এবং ‘ণ’-এর যুক্তরূপ। তাই, ব্যবহারটিও সেরকম হওয়া বাঞ্ছনীয়। মূলত ব্যবহারটি সংস্কৃত ব্যাকরণের ণ-ত্ব/ষ-ত্ব বিধানের সাথে সম্পৃক্ত বিধায় এবং সে-সংক্রান্ত আলোচনা অন্যত্র করার আশা রাখি বিধায় আপাতত শুধু এটুকুই জানাই-যেখানে ‘র’/’রেফ’ আছে, তার পরে এই যুক্তবর্ণটি মূলত ‘হ+ণ’ (হ্ণ) হবে। উদাহরণ : প্রাহ্ণ, পূর্বাহ্ণ, অপরাহ্ণ, কিন্তু, সায়াহ্ন, মধ্যাহ্ন ইত্যাদি।
– ‘হু’, এটির ভিন্ন রূপ লিখতেও অনেকে ভুল করেন, তবে দেখা যাচ্ছে, এখানে ভুল হবে না। বলতে চাইছিলাম মাথায় প্যাঁচ-বসানো ‘হু’-এর কথা। ভাবুন ‘বাহু’ শব্দটি। ওটি অনেকে ভুল করে ‘হ’-এর সাথে ‘ূ’-কারের জায়গায় বসান। প্রসঙ্গত, এই ব্লগের বানানরীতি অনুসারে ‘হ’-এর সাথে ‘ঊ’-কার বসালে যে-রূপটি পাওয়া যাচ্ছে, সেটি সঠিক নয় মনে হচ্ছে। মডারেটরেরা নজর দেবেন কি?
– ‘ল্ব’-এই যুক্তব্যঞ্জনটির উচ্চারণ ‘ল্ল’ (ll)। মানে, ‘বিল্ব’ শব্দটির উচ্চারণ হবে ‘বিল্ লো’ (billo)। আর তাই, কখনোই বাল্ ব (bulb) শব্দটি লেখা যাবে না, বাল্ব। এমনকি, এই ব্লগের বানানরীতিতেও এই একই ভুল দেখতে পাচ্ছি। তাই বাধ্য হয়ে ওপরের বানানে শেষ ‘ব’-টি আলাদা রাখতে হয়েছে।
– ‘ন’ ও ‘ণ’-এর সাথে অন্য শব্দের যুক্তবর্ণেও কিছু ভুল লক্ষ্যণীয়। সেসম্পর্কে অন্যত্র আলোচনা করতে চাই। শুধু এটুকু মনে রাখুন, স্রেফ তৎসম শব্দের ক্ষেত্রেই ‘ণ’ বসবে। এবং, এক্ষেত্রে যুক্তবর্ণটি ধারণ করবে অর্ধমাত্রা, পূর্ণমাত্রা নয়।
খ) ই, উ ঘটিত জটিলতা :
– ঊনবিংশ শতাব্দীর বিখ্যাত রম্যলেখক ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় মজা করেই (বোধকরি) বলেছিলেন :
দুটো ন, আর তিনটে স-এর দরকারই বা কি?
মিছেমিছি বাজে খরচ নয় কি দুটো ই?
ভেবে দেখ লিখতে চোখে আসে কি না জল,
পাষাণী, বিষাণ, উমা, শরৎ, শাসমল?
ইত্যাদি, ইত্যাদি… মানে, ঝামেলাই ঝামেলা। তবে যেহেতু ভাষার শুদ্ধ ব্যবহারটি বাংলার সুসন্তান হিসেবে কাম্য, তাই আশা করবো একটু কষ্ট হলেও নিয়মটি একটু না হয় জানলেনই।
প্রথমটি, অতৎসম যেকোন শব্দে হ্রস্ব-ই এবং হ্রস্ব-উ এবং এদের সংক্ষিপ্ত রূপ, বা ‘কার ‘ ব্যবহার করতে হবে। এছাড়া, তৎসম শব্দের ক্ষেত্রেও যে-বানানের দুটো রূপই চলে, সেখানে শুধু হ্রস্ব রূপটিই ব্যবহার করতে হবে, যেমন : তরণি (তরণী নয়), ধমনি (ধমনী নয়) ইত্যাদি। আর অতৎসম শব্দে তো দীর্ঘস্বর ব্যবহার করাই যাবে না। যেমন : ইমান (ঈমান নয়, আশাকরি কারোর ওটি কমজোর হয়ে পড়বে না), ধুলো (ধূলো নয়, তবে ধূলি হবে, সংস্কৃতমূলক বলে), বীয়ার নয়, বিয়ার (Beer, পানীয়বিশেষ), ঠিক বানান, তির, তীর নয়, খ্রিস্টাব্দ, নয় খ্রীন্টাব্দ। তবে, বাংলা একাডেমি (বানানরীতি প্রণেতা প্রতিষ্ঠান) নিজেরাই তাঁদের নাম লেখেন ‘একাডেমী’, যদিচ কিছু পরিবর্তন এখন চোখে পড়ে। লজ্জার কথা!
একটি মাত্র শব্দ এই পরিবর্তনের হাত থেকে বোধহয় বেঁচে যাচ্ছে। শব্দটি ‘ঈদ’, যার হওয়ার কথা ছিল ‘ইদ’ (কোথাও চোখে পড়েছে কি শব্দটি, আই মিন বানানটা?)। ব্রাহ্মণেরা বোধহয় ‘গরু’ বানানটিও কাটতে পারেন না, না?
যাহোক, অনেক জ্ঞান দিয়ে ফেললাম। রাগ করবেন না আশা করি, কারণ ‘আ মরি বাংলা ভাষা’, ‘আয় মারি বাংলা ভাষা’ নয়। আশা করি, পরবর্তী কোন এক পর্ব নিয়ে আবারো দেখা হবে। ততদিন, আরো আরো লিখতে থাকুন, ঠিকভাবে। বড়দিন ও নববর্ষের অগ্রিম শুভেচ্ছা সবাইকে।
পুনশ্চ : জীবনের প্রথম ব্লগ, ভুল-টুল হলে ক্ষমা করবেন নিজগুণে।
ব্লাডি সিভিলিয়ান
নেহাৎ সাদাসিধে নাগরিক হয়ে বাঁচতে চাই। একটু অন্যরকম স্থান, কালের রূপ দেখতে চাই। পড়তে চাই, পড়ি -- এটুকুই। আর তেমন কিছু নয়।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
২১ comments
রায়হান রশিদ - ২৫ ডিসেম্বর ২০০৯ (৯:৪৮ পূর্বাহ্ণ)
অনেক ধন্যবাদ এই পোস্টটির জন্য। বানান নিয়ে সেই স্কুল জীবন থেকে শুরু করে এখনো প্রায়ই অস্বস্তিতে পড়তে হয়। আপনার পোস্ট পড়ে কিছু বিষয় জানতে পারলাম। মনে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করবো। পরের পর্বগুলো পড়ার অপেক্ষায় থাকলাম।
আবারও ধন্যবাদ।
bloodycivillian - ৬ জানুয়ারি ২০১০ (৩:১০ অপরাহ্ণ)
অসংখ্য ধন্যবাদ রায়হান আপনাকে, জীবনের প্রথম ব্লগের প্রথম মন্তব্যকারী হিসেবে। আপনার সাবলীল, সাহসী এবং তথ্যপূর্ণ লেখার আমি মুগ্ধ এক পাঠক। বিশেষত, বিডিআর বিদ্রোহের ই-মেল সংক্রান্ত গুজবের যুক্তিসঙ্গত উত্তরমালা পড়ে ও দেখে। আপনার লেখা দেখে মনে হয় আপনি বোধহয় আইনের ছাত্র। ধারণাটা কি ঠিক?
মুয়িন পার্ভেজ - ২৫ ডিসেম্বর ২০০৯ (১২:৩৫ অপরাহ্ণ)
ভাষা বহতা নদীর মতো, কিন্তু নিজের খেয়ালখুশির ছন্দে বোধহয় সে এগোতে পারে না সবসময়, অন্তত লেখ্যরূপের ক্ষেত্রে তাকে বহন করতে হয় নানা অনুশাসনের চিহ্ন। তিরিশের দশকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় একটি বানানবিধি বেঁধে দেয় বাংলা ভাষার জন্য; উচ্চশিক্ষিত ও প্রতিভাবান তরুণ কবিরা রবীন্দ্রবলয়ের বাইরে দাঁড়িয়েই নিজেদের পৃথক ভাষাভূমি তৈরি করতে সচেষ্ট হলেন — বাংলা কবিতার শিরায় সঞ্চারিত হল নতুন রক্তকণিকা। আমার প্রপিতামহ ছিলেন রাজশেখর বসু (১৮৮৮-১৯৬০) বা বুদ্ধদেব বসুর (১৯০৮-১৯৭৪) সমসাময়িক, কিন্তু তিনি কি জানতেন ‘কি’ ও ‘কী’-এর পার্থক্য? কলকাতাকেন্দ্রিক নব্য বানানচিন্তার সূত্রগুলো পাঠ্যপুস্তকের কল্যাণে তাঁর (আমার পিতামহেরও) হাতে এসে পৌঁছেনি সম্ভবত। বানানের সঙ্গে ভাষাতাত্ত্বিক প্রাণায়াম জড়িত, তবে ঐতিহ্যের পরশও কি থাকে না জন্মদাগের মতো, কোনো-কোনো বানানে? না হলে ‘ঈদ’ শব্দটিকে, ‘আনন্দবাজার’-এর প্রণোদনা সত্ত্বেও, ক্ষীণাঙ্গ করা যায় না কেন নির্দ্বিধায়? সম্প্রতি আবদুশ শাকুরের লেখা ‘যুবতির কাহিনি’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক সমকাল-এর সাময়িকী ‘কালের খেয়া’য় (১৮ ডিসেম্বর ২০০৯); তিনি লিখেছেন :
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীও ‘বাঙালী’-পন্থী; নতুন দিগন্ত (বর্ষ ১, সংখ্যা ২, জানুয়ারি-মার্চ ২০০২, ঢাকা) পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর ‘বাংলা বানানে অন্যায় হস্তক্ষেপ’ প্রবন্ধের সূত্র ধ’রে বানানবিষয়ক একটি বিশ্লেষণময় প্রতিপ্রবন্ধ লিখেছিলেন এহসানুল কবির (‘বাংলা বানানে অন্যায় হস্তক্ষেপ’ : একটি পাঠ’, আগুনখোলা, রুদ্র অনির্বাণ-সম্পাদিত, বর্ষ ১, সংখ্যা ১, ফেব্রুয়ারি ২০০৪, চট্টগ্রাম)। বানান যেহেতু ভাষাতাত্ত্বিক চিন্তা ও চর্চার বিষয়, তাই মনে করি, আবেগ বা বিশেষ প্রবণতা নয়, যুক্তির দরজা দিয়েই এর অন্দরমহলে ঢোকা উচিত।
বাংলা ব্লগের বহুবিধ নৈরাজ্যমুখিতার অন্যতম নিদর্শন হল আঞ্চলিকতাশ্রয়ী অশিষ্ট ভাষাপ্রয়োগের হুজোগ; ভাষা যে ভালোবাসার ধন, এ-লেখার মাধ্যমে ব্লাডি সিভিলিয়ান তা আরেকবার স্মরণ করিয়ে দিলেন। তাঁকে অনেক ধন্যবাদ। তবে লেখকের নামটি বাংলায়িত হলে ভালো লাগত।
রেজাউল করিম সুমন - ৫ জানুয়ারি ২০১০ (৯:২৩ অপরাহ্ণ)
এখানে উল্লেখ থাকা দরকার, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর প্রবন্ধের প্রতিক্রিয়া হিসেবে পাঠানো এহসানুল কবিরের “‘বাংলা বানানে অন্যায় হস্তক্ষেপ’ : একটি পাঠ” ‘নতুন দিগন্ত’ (সম্পাদক : সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী) ছাপেনি, যদিও সে-সময়ে পত্রিকাটিতে পর পর একাধিক প্রতিক্রিয়া ছাপা হয়েছিল — যেসব লেখা প্রকারান্তরে সমর্থন করেছিল অধ্যাপক চৌধুরীর বক্তব্যকেই!
bloodycivillian - ৬ জানুয়ারি ২০১০ (৩:২৭ অপরাহ্ণ)
মুয়িন, আপনার মতো পড়াশুনো আমার নেই, তাই আপনার প্রতি আলাদা একটা শ্রদ্ধা আমার আছে। আপনার লেখা পড়ে এটুকু বুঝলাম বাংলা বানান নিয়ে মূলত লেখকদের মধ্যেই নৈরাজ্য বেশি। এব্যাপারে, ইমতিয়ার শামীমের মন্তব্যটি দেখতে পারেন, যেখানে তিনি হায়াৎ মামুদের একটি গ্রন্থ (বাঙালির বাংলা ভাষা ইদানিং) থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন। দ্বিতীয় উদ্ধৃতির শেষ কয়েকটি লাইন
চেতনায় নাড়া দেয়। তবে, আপনার মতামত আরো সুস্পষ্ট হলে আরো ভালো লাগতো।
প্রসঙ্গত, আপনার শেষ অনুচ্ছেদে ব্যবহৃত শব্দটা কি ‘হুজুগ’ হওয়া উচিত ছিলো না? আর আবদুশ শাকুরের ‘সঘন সংস্কারমোহ’ সম্পর্কেও আপনার একান্ত ভাবনা জানতে চাই। জনাব চৌধুরীর কলামটি সম্পর্কেও কিছু বলার ইচ্ছে আছে আলাদা করে। আর একটা অনুরোধ আপনার কাছে। বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা এই ব্লগে শুরু হয়, কিন্তু শেষটা আশানুরূপ নয়। আলোচকদের মধ্যে আপনিও থাকেন কখনো-সখনো। এই মুহূর্তে মনে পড়ছে ছন্দ নিয়ে জমে উঠতে-যাওয়া একটি আলোচনার অপমৃত্যুর কাহিনী। ব্যস্ততা থাকলেও একটু কিছু জানা জিনিস আমাদেরকে তো জানান।
নববর্ষের বিলম্বিত শুভেচ্ছা।
মুয়িন পার্ভেজ - ৭ জানুয়ারি ২০১০ (২:০৩ পূর্বাহ্ণ)
আপনার কথাই ঠিক। আরবি-বাহিত ‘হুজুগ’ শব্দটি ‘হুজোগ’-রূপে লেখার মানে হয় না। আরবি-মূল ও অন্যান্য বিদেশি শব্দের ক্ষেত্রে আমি আতান্তরে প’ড়ে যাই হরহামেশা, তাই ‘মুসলমান’ লিখতে গিয়ে ‘মোসলমান’ও লিখে ফেলি মূলত ‘কোরান’-এর ক্যারিশ্মায়। ফার্সি-প্রাণিত ‘মুসলমান’ আরবি ‘মুসলিম’-এর অনুবর্তী, বোঝা গেল; কিন্তু ‘কোরান’-এই বা কেন আমরা উচ্চারণপন্থী রয়ে গেলাম আজও? ‘কুরআন’ নয় কেন? তাহলে লোকোচ্চারণও শাসন করে বানানবিধি, কখনও-কখনও? ‘হিসাব’ বা ‘হিসেব’ বা ‘হিশেব’ নিয়ে তো মহামুশকিলে থাকি পদে-পদে; ‘হিসাব বহি’ ও মানুষ হিশেবে আমার অপরাধসমূহ — এই দুই ‘হিসেব’কে মেলাই কীভাবে! সংসদ্ বাঙ্গালা অভিধান (শৈলেন্দ্র বিশ্বাস-সঙ্কলিত, চতুর্থ সংস্করণ, ফেব্রুয়ারি ১৯৮৪, সাহিত্য সংসদ্, কলকাতা) থেকে অংশবিশেষ তুলে দিচ্ছি:
(পৃ. ৭২২)
তাহলে কি অর্থবৈচিত্র্যের খাতিরে বানানভেদও মেনে নিতে হবে এরকম কিছু-কিছু শব্দে? অর্থাৎ, ব্যাংকে ‘হিসাব’ খুলতে হবে, দরখাস্ত পাঠাতে হবে ‘হিসেব’ বুঝে আর শুঁড়িখানা থেকে বেরোব মাতাল ‘হিশেবে’?
এছাড়া, ‘বউ-শালি’র টানাপোড়েন তো আছেই। ঘোমটাসমেত ‘বৌ’ দেখতে চাই না এখন, কিন্তু ‘বৌদি’কে এড়ানো বেশ কঠিন! বিকল্পের কথা ব’লে আর কতদিনই বা ধ’রে রাখব ‘দাদী’কে বা ‘নানী’কে? বাংলা অভিধানের বিকল্প ভুক্তিগুলো নিয়ে আসলেই ভাবা দরকার আমাদের; মহাকালের প্রতীক্ষায় না থেকে, রেজাউল করিম সুমন-কথিত ‘বেশী’ বা ‘তৈরী’র মতো ‘তামাদি’ শব্দগুলো বানপ্রস্থে পাঠানো যায় কি না দেখা যেতে পারে। এতে আর কিছু না হোক, অন্তত বানানবৈচিত্র্যের নামে বিদঘুটে মন্বন্তরের অবসান ঘটবে। পরিভাষা নিয়েও চিন্তাবিনিময় আবশ্যক মনে করি।
২
সম্ভবত আপনি রেজাউল করিম সুমনের পোস্ট “সকলেই একটা আশ্রয়ের কথা ভাবছে” : শঙ্খ ঘোষ-এর সূত্রে এ-কথা বলেছেন। যৎসামান্য বিদ্যায় ও বিপুল কৌতূহলে ‘ছন্দের বারান্দা’য় প্রবেশ করেছিলাম; আমার মতামত স্পষ্ট করার জন্য যেটুকু বলেছি, তা যথেষ্ট মনে হওয়ায় আর কিছু বলতে যাইনি। আলোচনার চৌকাঠ ডিঙিয়ে সমগ্র ছন্দশাস্ত্র নিয়ে বসার জায়গাও নিশ্চয় ছিল না সে-আসরে। তবু আশা করেছিলাম, ছন্দ নিয়ে কথা বলতে উৎসাহী হবেন বিশেষত তরুণ কবিদের মধ্যে আরও কেউ-কেউ — তা তো আর হল না!
রেজাউল করিম সুমন - ২৫ জানুয়ারি ২০১০ (৯:৪৮ অপরাহ্ণ)
আরবি ‘হিসাব’ শব্দটির মূলানুগ উচ্চারণ hisaab. কিন্তু বাঙালির সহজাত ‘শ্’-প্রীতির কল্যাণে বাংলায় এর উচ্চারণ দাঁড়িয়েছে hishaab. এই পরিবর্তিত উচ্চারণের লেখ্যরূপই কারো কারো কলমে ‘হিশাব’। আবার ‘হিসাব’ থেকে ‘হিসেব’ থেকে ‘হিশেব’।
আবদুল মান্নান সৈয়দ অবশ্য ‘হিশেব’, ‘জিনিশ’ (< আরবি ‘জিন্স্’), ‘খশড়া’ (< আরবি ‘খসরহ্’) লিখেই ক্ষান্ত হন না, এমনকী লেখেন ‘শাল’ – শীতবস্ত্র নয়, বৎসর অর্থেই!
লক্ষ করেছি, পশ্চিমবঙ্গীয়রা ‘মুসলমান’-এর উচ্চারণ করেন mushalmaan, ফারসি-কে বলেন faarshi. অনুমান করি, এই প্রবণতা ওই বঙ্গের মুসলমানদের তুলনায় হিন্দুদের মধ্যে হয়তো বেশি। নজরুল-তনয় সব্যসাচীর আবৃত্তিতে musalmaan–ই শুনেছি।
শঙ্খ ঘোষ একবার কথাপ্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘আমরা অনেক সময়ে ভুলে যাই যে, আরবি ফারসি শব্দেরও তৎসম-তদ্ভব আছে।’ সত্যিই তো, ‘কুর্আন’-কে আমরা বলি ‘কোরান’, ‘আল্লাহ্’-কে ‘আল্লা’, ‘নবীহ্’-কে ‘নবি’। আর ‘আস্সালামুআলাইকুম’-কে বলি ‘স্লামালাইকুম’।
গৌতম - ২৮ ডিসেম্বর ২০০৯ (১২:১৫ পূর্বাহ্ণ)
দারুণ পোস্ট। আশা করি সিরিজটি নিয়মিত লিখে যাবেন। আমি এই মুহূর্তে হায়াৎ মামুদের ‘বাংলা লেখার নিয়মকানুন’ বইটি পড়ছি। পাশাপাশি আপনার লেখাটাও উপকারে আসবে।
মুয়িন পার্ভেজ - ৫ জানুয়ারি ২০১০ (১০:২০ অপরাহ্ণ)
আমাদের দেশে যাঁরা বাংলা বানান বা ভাষা নিয়ে ভাবিত হন, হায়াৎ মামুদ তাঁদেরই একজন। এমন আরও কেউ-কেউ আছেন, যাঁদের কাছে প্রত্যাশা সবসময় বেশিই থাকে আমার; এ-কারণেই বাংলা লেখার নিয়মকানুন বইটির সমস্পর্ধী আরও বইয়ের অপেক্ষায় আছি। কবিতা-অনুবাদেও তিনি কত স্বচ্ছন্দ ও আন্তরিক, তার পরিচয় পেয়েছি বও হাওয়া দেশান্তরী বইটিতে। কিন্তু মাস কয়েক আগে তাঁর লেখা শিশুসাহিত্যবিষয়ক গ্রন্থ উৎসে ফেরার ছলচাতুরী কিনতে গিয়েও আত্মসংবরণ করলাম ‘যৎসামান্য’ কারণেই — ‘ছলচাতুরী’ বানানটি মলাটে ও ভিতরের পৃষ্ঠায় দু’রকম দেখে! এটি মুদ্রণবিভ্রাট কি না জানি না, তবে বানানও যে বইয়ের বিক্রয়ে বিরূপ প্রভাব রাখতে পারে, সেদিন বোঝা গেল।
bloodycivillian - ৬ জানুয়ারি ২০১০ (৩:৩১ অপরাহ্ণ)
গৌতম, অনেক শুভকামনা। আপনি মাঠের মানুষ কি-না জানি না, তবে শিক্ষানীতিসংক্রান্ত আপনার লেখাটি আপনার তৃণমূলঘনিষ্ঠতা স্পষ্ট করে। আমি নেহাৎই ছা-পোষা, তবে, আপনার জন্যে, আপনাদের জন্যে শুভকামনা সবসময়। আপনার বইটি বেশ ভালো, তবে, কিছু ব্যাপার নিয়ে আমার আপত্তি আছে, বারান্তরে জানাবো সেসব।
গৌতম - ৬ জানুয়ারি ২০১০ (৪:৩৯ অপরাহ্ণ)
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। হায়াৎ মামুদের বইটি পড়া মোটামুটি শেষ। পড়ে মনে হলো, বেশ কিছু জায়গায় আপত্তি করার যথাযথ কারণ রয়েছে। সেগুলো একদিন বিস্তারিত বলার আশা রাখি।
আপাতত শুধু এটুকু বলে যাই- বানানের বিষয়ে তিনি অনেককিছু জানলেও এই বই পড়ে তাঁকে আমার বানান-রক্ষণশীল মনে হয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে যুক্তির বদলে নিজের আবেগ বা ইচ্ছাকেও প্রাধান্য দিয়েছেন। তাছাড়া ভাষার বা বানানের গতি বা এর প্রবহমানতাকে বোধহয় তিনি খুব একটা আমলে নিতে চান না বলেও মনে হলো।
ইমতিয়ার - ৩১ ডিসেম্বর ২০০৯ (৮:২২ পূর্বাহ্ণ)
কিছুদিন হলো আমার হাতে এসেছে ক্ষুদ্রাকৃতির একটি বই ‘বাঙালির বাংলা ভাষা ইদানিং’। আপনার এই চমৎকার লেখাটি পড়তে পড়তে হায়াৎ মামুদের ওই বইটির কথাই প্রথম মনে এলো। বইটিতে তিনি বেশ কিছু জরুরি প্রশ্ন তুলেছেন, যে-কোনো ভাষার বানানবিধি চূড়ান্তকরণ প্রায় অসাধ্যকর্ম বলার পরও। যেমন, তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, সময়বাচক শব্দগুলি আসলে বাক্যবিন্যাসে ব্যবহার করা হবে কীভাবে? কীভাবে ব্যবহার করা হবে কিছু সংখ্যাবাচক বিশেষণ ও সংযোগসাধক বা ব্যাপ্তিবোধক শব্দগুলি? বা হাইফেনের প্রয়োগ সম্বন্ধে যুক্তিসিদ্ধ নীতিমালাই বা কেমন হবে?
এগুলি সত্যিই জরুরি প্রশ্ন এবং ভাষা-ব্যাকরণ নিয়ে যারা কাজ করছেন, তাদের এ ব্যাপারে অবশ্যই পথ দেখাতে হবে, না হলে আমাদের ভাষা ও বানানের নৈরাজ্য আরও বাড়বে। প্রসঙ্গত এই বইয়ের কিছু খানিকটা দীর্ঘ হলেও প্রাসঙ্গিক বক্তব্য ভাগাভাগি করতে চাই আপনার সঙ্গে :
‘বাংলা ভাষা ও লিপি এবং ভাষা বিষয়ে দু-একটি প্রাথমিক সত্য’ :
বাংলা ভাষা-বানানের বিশৃঙ্খলতা সম্পর্কে আরও একটি মন্তব্য তিনি করেছেন, যা অন-লাইনের লেখকদেরও গুরুত্ব নিয়ে বিবেচনা করা উচিত বলে আমি মনে করি :
আমার মনে হয়, আমরা যদি এখনই মনযোগী না হই তা হলে এই নাবালকত্ব ও অসম্পূর্ণতা আরও বাড়বে, যেমন বাড়বে শৈলীমাহাত্ম্যের নামে ব্যাকরণ অবমাননা।
আপনাকে বিশেষভাবে অনুরোধ করব, বাংলা বানান ও ব্যাকরণনীতি নিয়ে এখানে নিয়মিত লিখতে, যাতে আমরা সচেতন হতে পারি এবং প্রয়োজনে তর্কে-বিতর্কে জড়িয়ে হলেও ঋদ্ধ হতে পারি।
bloodycivillian - ৬ জানুয়ারি ২০১০ (৩:৫৭ অপরাহ্ণ)
শুভদিন ইমতিয়ার। আপনার লেখা ছাপার অক্ষরে পড়ছি আগে থেকেই। তবে, ‘কঠিন’ ও ‘জটিল’ রকমের মুগ্ধ হয়েছি আপনার ডারউইন-সংক্রান্ত লেখাটি পড়ে। জেনেছি অনেককিছু, ভাবিয়েছে অবশ্যই, আর সম্মোহিত হয়েছি আপনার ভাষার তৈলচিত্রে। অতীব স্বাদু এবং সুরম্য ভাষা। তাই, আমার লেখায় মন্তব্য করায় যারপারনাই সম্মানিত বোধ করছি। তবে, প্রশ্ন। যে-বইটির কথা বললেন, সেটির শিরোনামে কি সত্যিই ‘ইদানিং’ শব্দটি আছে? কারণ, বানানটি ভুল। এবং, হায়াৎ মামুদের ‘বাংলা ভাষার নিয়মকানুন’ বইতে ভুল শব্দের তালিকায় শব্দটি আছে। আর ‘মনোযোগ’ শব্দটি আপনার লেখায় ‘মনযোগ’। এটি কি ভ্রান্তিবশত নাকি এভাবেই লিখতে আগ্রহী আপনি?
আশা করি, কিছু মনে করবেন না। বানান ভুল দেখলে চোখে লাগে তাই বলা। তবে, আপনার উক্ত বানানের একজন বিখ্যাত সমর্থক পাবেন।
ধন্যবাদ।
ইমতিয়ার - ৮ জানুয়ারি ২০১০ (৭:৩৮ অপরাহ্ণ)
আমারই ভুল ভাই। আর এর একটিকে একজন বিখ্যাত সাহিত্যিক সঠিক মনে করলেই কি তা শুদ্ধ হয়ে যায়? সাহিত্যিক ও সংবাদপত্রগুলির (এর সঙ্গে বর্তমানে অনলাইনের সাইটগুলিকেও যুক্ত করা যায়) ব্যাকরণ ও বানানরীতির বিষয়ে পাঠককে তাৎক্ষণিকভাবে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রয়েছে। সেকারণেই তাদের এ ব্যাপারে অনেক বেশি দায়িত্ববান হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। জনপ্রিয় সাহিত্যিকদের দায় তো আরও বেশি, যৌক্তিক ও খুবই শৈল্পিক কোনও কারণ ছাড়া তাদের উচিত নয় অনিয়মকে টেনে আনা।
আপনার প্রতি অনুরোধ রইল, বিভিন্ন বাংলা সাইটগুলি থেকে গৃহীত উদাহরণসাপেক্ষে অন্তত ১৫ দিন অন্তর বাংলা ব্যাকরণ ও বানানরীতি নিয়ে লিখবার। আমরা যে উপকৃত হব, তা লেখাই বাহুল্য।
আমার লেখাটি পড়ার জন্যে ধন্যবাদ, ভালো লেগেছে জেনে আমারও আনন্দ হচ্ছে। শুভেচ্ছা আপনাকে।
রেজাউল করিম সুমন - ৫ জানুয়ারি ২০১০ (৯:০১ অপরাহ্ণ)
১
ভাই সিভিলিয়ান, উপভোগ করলাম এই লেখার সরস বাগ্ভঙ্গি – (পুরুষের ‘মানসিক স্তনবৃন্ত’র ব্যাপারটা যদিও ঠিক স্পষ্ট হলো না আমার কাছে); উপকৃত হলাম প্রয়োজনীয় এই আলোচনা পড়ে।
প্রসঙ্গত একাধিকবার ‘এই ব্লগের বানানরীতি’র কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আমার জানামতে এখানে সুনির্দিষ্ট কোনো বানানরীতি অনুসৃত হয় না।
এই ব্লগের লেখকদের মধ্যে অনেকেই এখনো ‘বেশী’/‘বেশি’ কিংবা ‘তৈরী’/’তৈরি’-র মধ্যে পুরোনো বানানেরই (‘বেশী’ ও ‘তৈরী’) পক্ষপাতী, যদিও ‘বেশী’ ও ‘তৈরী’ বানান অনেক কাল আগেই তামাদি হয়ে গেছে। ‘তরণী’-র বদলে ‘তরণি’ কিংবা ‘ধমনী’-র বদলে ‘ধমনি’ লিখতে ক’জন সম্মত হবেন, বলা মুশকিল। লক্ষণীয়, অভিধানে ‘তরণী’ বা ‘ধমনী’ কিন্তু বর্জিত হয়নি, বিকল্প বানান হিসেবে ঠাঁই পেয়েছে। ‘কাহিনি’ শব্দটি এসেছে হিন্দি ‘কহানী’ থেকে; ফলে এ শব্দের ‘ন’-এর সঙ্গে নির্দ্বিধায় ই-কার ব্যবহার করা যেতে পারে, কিন্তু এখনো সবাই তা করেন না। আবার ‘ইদানীং’ শব্দটিতে ই-কার ব্যবহারের কোনো সুযোগ নেই, কোনোকালেই ছিল না, তবু আমরা অনেকে লিখি – ‘ইদানিং’। শর/বাণ-এর প্রতিশব্দ ‘তির’ ফারসি থেকে এসেছে, কাজেই ই-কার ব্যবহারে কোনো বাধা থাকার কথা নয়; তবুও সব জেনেশুনেও এখনো আমরা অনেকেই লিখি ‘তীর’। আসলে, প্রধান বাধাটা হলো অভ্যাস।
প্রমিত বানানরীতির অনুসরণে ‘ঈমান’-এর বদলে যদি ‘ইমান’ লিখতে পারি, ‘ঈদ’-এর বদলে ‘ইদ’ লিখতে পারি না কেন? অভ্যাসে আটকায়, কেননা পুরোনো বানানকে জন্মদাগের মতোই অনপনেয় বলে ধরে নিই আমরা। বাংলাদেশে এখনো ‘ঈদ’-ই লেখা হয়, পশ্চিমবঙ্গে কিন্তু ‘ইদ’-ও লেখা হচ্ছে – এবং তা কেবল ‘আনন্দবাজার’-এর প্রণোদনায় নয়। উদাহরণ? আমার হাতের কাছেই আছে কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘আরম্ভ’ পত্রিকার ‘ইদ ১৪১২’ সংখ্যা। ‘মুসলমান বাঙালির লোকাচার’ বইয়ের কয়েকটি ভুক্তি : ‘ইদ’, ‘ইদ-উল-ফিত্র’, ‘ইদ-উল-আজহা’। পত্রিকাটির সম্পাদক : বাহারউদ্দিন, বইটির লেখক : একরাম আলি। প্রথমজন তো বটেই, সম্ভবত দ্বিতীয়জনও পেশাগত জীবনে ‘আজকাল’ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি-র ‘আকাদেমি বিদ্যার্থী বাংলা অভিধান’-এ প্রথমে ‘ইদ’ এবং পরে বিকল্প বানান হিসেবে ‘ঈদ’ দেওয়া হয়েছে। বলাই বাহুল্য, আধুনিক অভিধানের ভুক্তির বিকল্প বানান(গুলো) রাতারাতি বাদ দিতে না পারলেও ক্রমশ-বর্জনীয় – অবশ্য যদি আমরা গোড়াতেই বানানের প্রমিতকরণের বিরোধী না হয়ে থাকি। বানান সংস্কারের প্রস্তাবগুলো আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়েই কার্যকর করা সম্ভব, জবরদস্তির মাধ্যমে নয়। আবার ‘ধমক’ দিয়ে প্রমিতকরণের সমন্বিত প্রয়াসকে রুখে দেওয়াও যায় না, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী হয়তো সে-কথা জানেন না!
২
তেমনি ‘ন্ব’-এর উচ্চারণও ‘ন্ন’ (nn)। যেমন, ‘সমন্বয়’। সম্প্রতি ওরহান পামুকের একটা বইয়ের বঙ্গানুবাদের প্রচ্ছদে দেখলাম লেখা আছে – ‘ইস্তান্বুল’। Istanbul-এর nb–কে ‘ন্ব’ দিয়ে লিপ্যন্তর করা যায় কি? আমরা অবশ্য ছোটবেলায় ওই শহরের নাম জানতাম ‘ইস্তাম্বুল’। সেটা নিশ্চয়ই বিকল্প বানান/উচ্চারণ?
মুয়িন পার্ভেজ - ৭ জানুয়ারি ২০১০ (২:১৫ পূর্বাহ্ণ)
আমিও ‘ইদ’ লেখার পক্ষপাতী। অন্তত আমাদের দেশের পত্রিকাগুলো যদি ‘ইদ সংখ্যা’ বের করে দেখাত, পাঠকদের টনক নড়ত ব’লে মনে হয়। এখনও পত্রিকার মাধ্যমেই অধিকাংশ মানুষ বাংলা রচনাদি পাঠ ক’রে থাকেন, হয়তো এভাবে আধুনিক বানানেও অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন ক্রমশ। মন্তব্যের ঘরে ‘‘আনন্দবাজার’-এর প্রণোদনা” কথাটি উল্লেখ করেছি একটি পাঠস্মৃতি থেকে — অনেকদিন আগে আনন্দ পাবলিশিং প্রা. লি. থেকে প্রকাশিত নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী-সম্পাদিত বাংলা কী লিখবেন কেন লিখবেন বইটি পড়েছিলাম; ‘ঈদ’ শব্দটিকে ‘ইদ’রূপে লেখার জন্য যৌক্তিক পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল এ-বইয়ে। কলকাতার বইপত্রে ঠিক কবে থেকে ‘ইদ’ মুদ্রিত হয়ে আসছে, তা জানার কৌতূহল বেড়ে গেল এখন।
bloodycivillian - ৭ জানুয়ারি ২০১০ (২:০১ অপরাহ্ণ)
আরেকটা শব্দও বোধহয়, তবে পরিমাণ অনেক কম। শব্দটা ‘নবী’ বা ‘নবীজী/জি’। মূলত, ধর্মসংক্রান্ত শব্দে সম্ভবত একরকম ট্যাবু কাজ করে। মনস্তাত্ত্বিকদের গবেষণার বিষয় হতে পারে ব্যাপারটা।
আর, নিজের ওপর জাগা হীনম্মন্যতাবোধ থেকেই আমার ছদ্মনামটি নেয়া। অনেকটা দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের “লাথি তো মেরেছো পিঠে, এবার মারো পুরোভাগে, দেখি সেটা কেমন লাগে” প্রকৃতির আর কি।
রেজাউল করিম সুমন - ২৫ জানুয়ারি ২০১০ (৯:৫৩ অপরাহ্ণ)
অভিধান বলছে, ‘নবী’ শব্দটা এসেছে আরবি ‘নবীহ্’ থেকে। আকাদেমি বিদ্যার্থী বাংলা অভিধান ‘নবি’ বানানের পক্ষপাতী। (আমরা অবশ্য ‘বিশ্বনবী’, ‘নুরুন নবী’ ইত্যাদি – অর্থাৎ দীর্ঘ-ঈ-কার লিখি এখনো।)
‘জি’ হিন্দি শব্দ। ‘নেতাজি’, ‘গান্ধিজি’, ‘বাবাজি’ দেখতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি আমরাও।
bloodycivillian - ৭ জানুয়ারি ২০১০ (১:৫১ অপরাহ্ণ)
শুভদিন, সুমনদা। উত্তর দিতে দেরি হয়, কারণ, কার্যালয়ে থাকি বা বাইরে, নিজস্ব আন্তর্জাল-সংযোগ না থাকায় বেশিক্ষণ থাকা সম্ভব হয় না।
লজ্জায় ফেললেন, ‘মানসিক স্তনবৃন্ত’ নিয়ে। মানে, সন্তানবতী মায়েরা স্তন্য পান করাতে না পারলে তাঁদের উক্ত উপাঙ্গটি যেভাবে বেদনার্ত হয়ে ওঠে তার সাথে ব্যঙ্গাত্মক এ্যানালজি টানার ব্যাপার আর কি….
অদ্ভুত ব্যাপার। লেখার সময় যেরকমটা লিখছি, পোস্ট করার পর আবার যুক্তব্যঞ্জনের ভিন্ন রূপ। তাই লিখেছিলাম ‘এই ব্লগের বানানরীতি’। আসলে, ব্যাপারটা সম্ভবত ইউনিকোড-ঘটিত।
এছাড়াও বানান না-জানার পরও অশিক্ষিত-আস্ফালন, মানসিক প্রবণতা, উচ্চারণবিভ্রাট বানানে ঢোকানো, সাহিত্যিক শ্লাঘায় নৈরাজ্য তৈরি, ইত্যাদিও।
এপর্যন্ত ধমক, যুক্তি, ব্যাকরণবিধান-অনেক দেয়া হয়েছে, কিন্তু অলক্ষ্যে বয়ে চলেছে পরিবর্তনের ধারা। রুধিবে কে?
ব-ফলা বা য-ফলাযুক্ত শব্দ পদমধ্যে বা পদান্তে থাকলে সংযুক্ত ব্যঞ্জনটি দ্বিত্ব উচ্চারিত হবে, যেমন: বিশ্ব (Bissho), অন্বয় (Onnoi), সত্য (Shotto) ইত্যাদি। কাজেই, ইস্তানবুল। প্রসঙ্গত, ইস্তাম্বুল জানতাম ঠিক। ভুলটা সম্প্রতি ধরা পড়লো। এখানে আরো তথ্য পাবেন নগরীটি সম্পর্কে।
প্রতিবর্ণীকরণ বা লিপ্যন্তরকরণ (Transliteration) বাংলার পুরনো সমস্যা। এনিয়ে একটি পোস্ট লেখার ইচ্ছে আছে, কখনো।
আপনার ভ্রাতৃভাবের জন্যে ‘ভাই সিভিলিয়ান’ এবং সামগ্রিক মন্তব্যের জন্যে ধন্যবাদ। সত্যিই সাহস পাই।
রেজাউল করিম সুমন - ২৫ জানুয়ারি ২০১০ (৯:৪৪ অপরাহ্ণ)
১
অনেক ধন্যবাদ। অনেক তথ্যই পাওয়া গেল ওই লিংক থেকে। Names of Istanbul নামেও একটি তথ্যসমৃদ্ধ ভুক্তির সন্ধান মিলল। জানা গেল:
‘স্তাম্বুল’ সম্পর্কে আরো লেখা হয়েছে :
‘স্তাম্বুল’ থেকেই নিশ্চয়ই ‘ইস্তাম্বুল’। বাংলায় প্রচলিত ‘ইস্তাম্বুল’কে তাহলে আর ভুল বলা যায় না। তবে এখন অবশ্য ‘ইস্তান্বুল’-ই লেখা উচিত। এরই মধ্যে হঠাৎ চোখে পড়ল, কল্যাণী দত্ত লিখেছেন (‘প্রসঙ্গ গর্দভ’, দেশ ৫৩ বর্ষ ৩ সংখ্যা, ২৩ নভেম্বর ১৯৮৫) :
(উপরের বাক্য দুটি অবশ্য রুশ কথাসাহিত্যিক কন্স্তান্তিন পাউস্তোভ্স্কির লেখা থেকে নেওয়া, লেখিকাই আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন।)
২
খুবই ভালো হয়।
আককাস - ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১১ (২:০৬ পূর্বাহ্ণ)
বাংলা একাডেমির ব্যবহারিক বাংলা অভিধানে ইদ বানানটি বিকল্প হিসেবে পাওয়া যায়। আর গরু আরেকটি বানান গোরু (রবীন্দ্রনাথেও তাই আছে)।