আমার চাচা অধ্যাপক আলী আনোয়ার

নিজের আত্মীয়, বিশেষ করে পিতৃ বা মাতৃতুল্য মানুষদের নিয়ে লেখা খুব কঠিন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একই পরিবেশে বেড়ে উঠেছি আমরা, আমি আর কুসুম, অধ্যাপক আলী আনোয়ারের ছোট মেয়ে, আমার আশৈশব, আকৈশোর, আযৌবন, আজীবন বন্ধু। তাই আলী আনোয়ার চাচাকে, এবং লাবণ্য চাচীকে আমরা মাথার ওপর বটগাছের মত ছায়াময়, শান্তিময় আশ্রয় ও প্রশ্রয়ের জায়গা হিসেবে পেয়েছি, কখনো মনে হয়নি, এমন তো নাও হতে পারত! […]

নিজের আত্মীয়, বিশেষ করে পিতৃ বা মাতৃতুল্য মানুষদের নিয়ে লেখা খুব কঠিন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একই পরিবেশে বেড়ে উঠেছি আমরা, আমি আর কুসুম, অধ্যাপক আলী আনোয়ারের ছোট মেয়ে, আমার আশৈশব, আকৈশোর, আযৌবন, আজীবন বন্ধু। তাই আলী আনোয়ার চাচাকে, এবং লাবণ্য চাচীকে আমরা মাথার ওপর বটগাছের মত ছায়াময়, শান্তিময় আশ্রয় ও প্রশ্রয়ের জায়গা হিসেবে পেয়েছি, কখনো মনে হয়নি, এমন তো নাও হতে পারত! আমাদের সারা জীবনের সুখ-দুঃখ আনন্দ-বেদনা শোক-মৃত্যুর টানাপোড়েনের মধ্যে ওঁদের পেয়েছি, আত্মীয়র মতন। এই তো। এত সহজ পাওয়াগুলি কি আর বিশ্লেষণ করা যায়, নাকি মানুষগুলোকে দূর থেকে নিরীক্ষণ করা যায়।

অন্য অনেকের মত চাচার দৈহিক জীবনাবসান এখনো আমি গ্রহণ করতে পারছি না, কিছুতেই তো মেনে নিতে পারছি না আমার একজন বাবা চলে গেলেন। বাংলাদেশের সবচেয়ে অসাম্প্রদায়িক, বিদগ্ধ, সংবেদনশীল একজন মানুষ আর নেই। যদিও জানি, শেষ পর্যন্ত রোগ-ভোগে অনেক কষ্ট পেয়ে অনেক দিন যুদ্ধ করে যেতে হলো তাঁকে। অনেক ভালবাসা নিয়ে গেলেন তিনি — এই কথা বলছিলেন তাঁর পাশে দিনরাত সেবা-রত, আমৃত্যু-সঙ্গী, আমাদের লাবণ্য চাচী।

লাবণী চাচী ও আলী আনোয়ার চাচা, ২০০৭

লাবণী চাচী ও আলী আনোয়ার চাচা, ২০০৭

কুসুম আর আমি একই ক্লাসে পড়তাম। অবিচ্ছেদ্য বন্ধু টুম্পা-কুসুম, এই দুই বন্ধুর সঙ্গে ক্লাস সেভেন-এর পর আনন্দ নামটাও সব সময়ের জন্য সঙ্গে জুড়ে গিয়েছিল, আমার কপাল-গুণে, আমি তখন সদ্য ইউগান্ডায় ৪ বছর কাটিয়ে দেশে ফিরেছি বাবা-মার সঙ্গে। সৌম্যদর্শন, আপাত-গম্ভীর চাচা, দেখা হলেই একটা হালকা হাসির রেখা দেখা দিত সেই মুখে, কী যে অসাধারণ! বিশাল লাইব্রেরি ছিল ওঁদের — চাচাকে দেখতাম একটা খাটে বসে পড়ছেন, ওখানেই খাবার পাঠিয়ে দিতেন কখনো কখনো, লাবণ্য চাচী। চাচার পড়াশুনো বোধহয় প্রায় সারাদিনই চলত। যুক্তরাষ্ট্র, ঢাকা অথবা কলকাতায় গেলে ফিরে আসতেন বিশাল বই-এর স্তূপ নিয়ে।

অধ্যাপনার ফাঁকে ওঁদের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক বাড়িতে বিদগ্ধ ও আড্ডাবাজ বন্ধুদের সঙ্গে তুমুল আলোচনাও দেখতাম, কত মানুষকে যে দেখেছি সেই আড্ডায়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা তো আছেনই, আরো আছেন ঢাকা থেকে, দেশের প্রত্যন্ত সীমানা থেকে, কলকাতা থেকে, বিভিন্ন মানুষ, বেশির ভাগই তাঁরা অধ্যাপনা করেন, মুক্ত-চিন্তা করেন, বই লেখেন, পত্রিকা বের করেন, সংগীতের চর্চা করেন, সঙ্গীত সাধনা করেন। এই আড্ডা চলত নানাবিধ বিষয় নিয়ে, কখনো সাহিত্য, সঙ্গীত, কখনো সমসাময়িক পরিস্থিতি, দেশ, শিক্ষা, অর্থনীতি, রাজনীতি — এত গভীর পাণ্ডিত্য আর খোলামেলা আলোচনা আমি খুবই কম দেখেছি, তার সঙ্গে এমন বন্ধু-বাৎসল্য।

লাবণ্য চাচী নিজে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক, সমাজকর্মী, তিনি ঘরে ও বাইরে দুইদিকে সমান কর্মঠ — আড্ডাগুলি চলছে, কারণ আড্ডার ইন্ধন তিনি যোগাচ্ছেন, অনবরত চা জলখাবার দিয়ে। বলতে কি, আমরা অনেকেই ওঁর হাতের রান্নাগুলি খাবো এই আশা নিয়েও যেতাম। চা-এর সঙ্গে টা হয়ে গেলে পরে প্রায়ই চাচী জানাতেন তিনি দুপুরের রান্নার ব্যবস্থা করছেন; থেকে যেতে। তখনি হয়ত বাজার করতে পাঠিয়েছেন। এই ভাবে আত্মীয় অনাত্মীয় হাজার অতিথির দৈনন্দিন সমাগম, খাওয়া-দাওয়া, চাচীর এই অন্নপূর্ণার মত সকলকে খাওয়ানো, চলতেই থাকত। কখনো একতিল বিরক্তি অথবা ক্লান্তি দেখিনি। এখনো খুব ভালবাসেন খাওয়াতে। আর সকলেই আমরা ভালবাসতাম, এখনো বাসি, তাঁর অসাধারণ হাতের রান্না।

সুস্মি আপা, শমী ভাই, অবিন, কুসুম, চাচী ও চাচার চার সন্তান, ওরা সকলেই বিদগ্ধ পাঠক — সেই শিশু কাল থেকে । এমন কোনো নিয়ম ছিল না, যে এটা পড়া যাবেনা, বা ওটা যাবে। অবারিত, অফুরন্ত বই — আর সেই বইয়ের স্তূপ এমনভাবে বেড়ে চলেছে, যে কিছু দিন পর বইয়ের শেলফে আর সেগুলির সংকুলান হচ্ছে না, বিছানায় জড়ো হচ্ছে। সকলেই খুব ছোট থেকে মানিক, বিভূতি, বনফুল, তারাশংকর, রবীন্দ্রনাথের পাশাপাশি পড়ছে বিদেশী সাহিত্য, বিশেষ করে রুশ সাহিত্য, সত্যেন সেন, সতীনাথ ভাদুড়ী। আমি তখন সদ্য বিদেশ-ফেরত, তাই বাংলা সাহিত্যের এই ভান্ডারের রত্নগুলি চিনিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে আমার বাবা মা, আর কুসুম-টুম্পা আমার ভরসা। টুম্পাদের বাড়িতেও অনুরূপ সাহিত্যের চর্চা। দুই বন্ধুর সাহচর্যে এসে গানবাজনা আর বইয়ের ভালবাসা আরো উস্কে গেল। এই কথাগুলি এই জন্য বলছি, যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্কালীন একটা ছবি তুলে ধরতে চাই অক্ষম হাতে, যেখানে রাজশাহীর এই অধ্যাপকরা, এবং অবশ্যই তাঁদের সহধর্মিণীরা, ঘরে ও বাইরে তাঁদের আলোচনা সভা, গানের আড্ডা, সাহিত্যের আড্ডা, অসাম্প্রদায়িক রাজেনৈতিক সচেতনতার চর্চা, এগুলির মাধ্যমে আমাদের ছোটদের জন্যও একটি সংবেদনশীল, সচেতন, সাহসী বাতাবরণ তৈরী করে দিয়েছিলেন । অকিঞ্চিৎকর যতই শোনাক, আমার জন্য তা বিশাল পাওয়া। আমরা ছোট থাকতেই দেশপ্রেমে, সেবামূলক কাজে উদ্বুদ্ধ হতে পারি। আমি নয়, আমরা — এইভাবে prioritize করতে শিখি। আর এই সব কিছুর প্রাণকেন্দ্রে আলী আনোয়ার চাচা আর লাবণ্য চাচীর অবিসংবাদিত ভূমিকা।

এও জানতাম, এঁরা ঘরে এত আনন্দ সৃজন করলেও, কেউই আইভরি টাওয়ারে আটকে নেই — দেশের, দশের কোনো বিপদে, এঁরাই প্রথমে প্রতিবাদে সোচ্চার হন, শিক্ষক হিসেবে প্রথমেই ছাত্রদের পাশে গিয়ে দাঁড়ান। অন্যায়, সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ দেখলে এঁরা প্রতিরোধ করেন। আজ তাই হয়ত এইটা আমাদের আশ্চর্য করে না, যে আলী আনোয়ার চাচা মৃত্যুর পর শহীদ বুদ্ধিজীবীদের গণকবরে অন্তিম শয্যা চেয়েছিলেন।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো এক আশ্চর্য কারণে প্রগতিশীল অসম্প্রদায়িক গ্রুপটি লাল নীল গোলাপি হিসেবে আখ্যা না পেয়ে আখ্যা পেয়েছিল রবীন্দ্র গ্রুপ হিসেবে। এর সঙ্গে মিলে যায় এঁদের রবীন্দ্র-চর্চা, রবীন্দ্রসংগীত সাধনার বিষয়টি । সুব্রত মজুমদার, আমার বাবার হাত দিয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্র-গান ও নৃত্য-নাট্যের অনুষ্ঠানের প্রথম পত্তন, সেই ষাটের দশক থেকেই, আর তারপর, রবীন্দ্র-গান, রবীন্দ্র-নাটক, রবীন্দ্র-আদর্শ, ও রবীন্দ্র-চেতনা এই সব রক্তের মত মিশে যায় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের দেহে। আমরা যখন বেশ একটু বড়, ইস্কুল কলেজে পড়ি, তখন কুসুমদের বাড়ি, টুম্পাদের বাড়ি, আমাদের বাড়ি, মফিজুদ্দিন আহমেদ চাচা বা নাজিম মাহমুদ চাচা — এরকম কয়জনের বাড়িতে গানের রিহার্সাল চলছে। অনেকটাই রবীন্দ্রনাথের গান, অথবা গণসংগীত। রবীন্দ্রসংগীতের চর্চা প্রায় আলো-বাতাসের মত সহজ ও প্রাত্যহিক, সকাল-সন্ধে একসঙ্গে হলেই গানের দলের হারমোনিয়াম তবলা নিয়ে বসে যাওয়া, লোডশেডিং হলে বসে গান গাওয়া, ১লা ফাল্গুনে, ১লা বৈশাখে তানপুরা আর গানের দল নিয়ে বাবার সঙ্গে আমাদের বেরিয়ে পড়া, এসব কিছুর ইন্ধন ও আশ্রয়ের একটা জায়গা ছিল আলী আনোয়ার চাচার বাড়ি। আর সেখানে বছরে মাঝে মধ্যেই আসতেন গানের বাউল, ওয়াহিদুল হক কাকু। কুসুমদের বাড়িতে সেই সব গানের আসর প্রায় সারা দিন চলত, দিনে ৩/৪ টে গান শেখা তো হতই। সে সব দুর্লভ, আনন্দময় পরিবেশ — এর জন্য অনেক ত্যাগ ও যত্ন, অনেক আন্তরিকতা ও দৃঢ় আদর্শের প্রয়োজন হয়, তখন কি বুঝেছি সেসব?

চাচার বই-এর সঙ্গে আমার পরিচয় অনেক পরে। তাঁর ইবসেনের ওপর বইটি পড়ে আমি কী আপ্লুত হয়েছি বলার নয়। সেরকমই আপ্লুত হয়েছি তাঁর পাবলো নেরুদার ওপর বইটি পড়ে। এমন সুন্দর বাংলা কয়জন লিখতে পারে? ভাষাটাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসলে, তবেই হয়ত যায়! চাচার নেরুদার কবিতার অনুবাদ আমাকে এখনো অনুপ্রেরণা দেয়, ওটাই আমার কাছে বাংলা অনুবাদের সর্বোচ্চ, সোনার পরাকাষ্ঠা । ভালবাসাটুকুই আমি হয়ত বুঝতে পারি পাঠক হিসেবে, বৈদগ্ধ্য নিয়ে আলোচনা করার সুযোগ্য মানুষ নিশ্চয়ই আছেন অনেকে। গতকালই মুজতবা হাকিম প্লেটো, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবারের আরেক বড় ভাই চাচার সম্পর্কে এক আশ্চর্য লেখায় বলছিলেন:

জাতীয়তাবাদী-সাম্যবাদী এমন সব মতাদর্শে বা এরও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র খোপে ঢেলে ছোটখাটো মানুষের বেলায় কিছু বলা হয়তো অবিচার হয় না। কিন্তু আলী আনোয়ারদের বেলায় তা সংকট তৈরি করে। লালঝাণ্ডার আওয়াজে বধির হবার দশার সময় তারা বিদ্যাসাগর নিয়ে ভাবতে বসেন। সব কিছু ধ্বসে পড়ার কালে বিজ্ঞানীদের নামহীন ‘কেউ নন’ হয়ে ওঠা দেখতে পান। কথা বলবার সময় বাক্যগুলোয় ইংরেজি শব্দ ঠাসা থাকলেও লেখনিতে তার আভাসটি নেই। যখন তিনি বলেন ভাষাটা নির্মাণ করে নিতে হয়। আমরা বুঝে ফেলি তার সতর্কবাণী। তার চেতনায় বহুস্তরী শিলাখণ্ডের অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়। এত গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেন যে তার দৃষ্টি ধারণ না করেও তাকে অগ্রাহ্য করা যায় না।

এই বহুস্তরী অস্তিত্ব, গভীর বিশ্লেষণ, আমরা তাঁর সঙ্গে যে কোনো বিষয়ে আলাপ করলেই আঁচ করতে পারতাম — হোক তা ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ, নিছক আড্ডা, একটি চলচ্চিত্র অথবা কোনো বই নিয়ে কথোপকথনে । তিনি দেখতেন তাঁর অতিরিক্ত তৃতীয় নয়ন দিয়ে। বৈদগ্ধ্য অনেকের থাকে, কিন্তু চাচার ক্ষেত্রে বোধহয় বৈদগ্ধ্য তাঁর অস্তিত্বের মাটির নীচে মূল গাছটিকে প্রাণশক্তিতে এমন উপচে তুলেছিল, যে চিন্তার, আবেগের, প্রকাশের, প্রত্যেকটি শাখাকে তা জীবন্ত, লৌকিক করে। আমরা তার ফল আস্বাদন করেছি প্রাণ ভ’রে — বুঝি, না বুঝি । সেই জন্য আশ্চর্য হইনা, যখন শুনি তাঁর থিয়েটার-জীবনের কথা প্লেটো ভাই-এর বয়ানে,

ওঁরা তখন নাটক করতেন। তারা গড়ে তোলেন ‘থিয়েটার ওয়ার্কশপ।’ দেশে থিয়েটার আন্দোলনের যাত্রা শুরু ওখানেই। নটে গাছ মুড়োনোর মতো তারপর মূলটা ঢাকা কেন্দ্রিকই। ওখানে শিক্ষকরাই শুধু অভিনয় করতেন না। তাদের অনেকের স্ত্রী, এমন কি কারো কারো কন্যাও মঞ্চে উঠতেন। সেখানে নিয়মিত কর্মশালা হতো। জীবনভর শুনেছি ‘আলী আনোয়ারের মতো নাটক বোঝে এমন কেউ বাংলাদেশে নেই।’ তবে ঢাকা থেকে অতিথিরা আসতেন। নটে গাছের মতো রাজধানীর আলোক ছটায় আবৃত হতেই হবে সব? কে জানে। হয় তো তা-ও নয়। জমিনটা শক্তপোক্ত করতে অভিনয়ের অন্য শূন্যতা ভরাটে অথবা আন্দোলনে মেলবন্ধন রচনায় তারা মিলিত হতেন। গোলাম মোস্তফা, রামেন্দু মজুমদার, ফেরদৌসী মজুমদার যেতেন মনে পড়ে। আলী আনোয়ার অভিনয়ে অপটু এ কথা শুনিনি কখনো। অন্য অনেকের অভিনয়ের প্রসংশায় বেলা পড়ে গেলে সবাই ব্যস্ত হয়ে ওঠে। তাই তাঁর পরিচালনায় দক্ষতার গল্পই ভাসতে থাকে। উনি চরিত্রগুলো বিশ্লেষণ করেন আর হাসান আজিজুল হক নড়েচড়ে তা দেখিয়ে দেন। এজন্য বন্ধুমহলে হাসান চাচার নাম জুটেছিল- মোশন মাস্টার। তাঁর গল্পের মতোই তার অভিনয়ও খুব তীব্র ছিল।

একটা কথা আমার কাছে, আমাদের কাছে দরকারী : বাংলাদেশে ধর্ম-নিরপেক্ষতা নিয়ে যতটুকু কাজ হয়েছে, শিক্ষা-ক্ষেত্রে, ঘরে, বাইরে, তা হয়েছে চাচার মতন মানুষের জন্য। হাতে-কলমে এমন একজন অসম্প্রদায়িক মানুষ শুধু বই পড়ে তৈরী হয় না। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের, পৃথিবীর স্বপ্ন যাঁদের কাঁদায়, তাঁরা একজন অভিভাবককে খুঁজে পাবেন অধ্যাপক আলী আনোয়ারের ভেতর। ‘ধর্ম-নিরপেক্ষতা’ নিয়ে ১৯৭৩ সালে চাচার সম্পাদিত বই থেকে পাওয়া:

ধর্মনিরপেক্ষতার প্রসঙ্গে তাই শেষ পর্যন্ত ব্যক্তির মুক্তি রাষ্ট্রীয় নিরপেক্ষতার মতোই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ব্যক্তিকেই এই বোঝা বইতে হবে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দায়িত্বের বোঝার মতো এটাও তার নতুন অর্জিত দায়। গণতন্ত্র আর ধর্মনিরপেক্ষতা যেন এপিঠ-ওপিঠ। একটি ছাড়া অন্যটি সফল হয় না। ততকাল আমরা অন্য পক্ষের ভুল-ভ্রান্তিকে যেন ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখতে চেষ্টা করি, অন্যের দৃষ্টির আচ্ছন্নতাকে যেন সহ্য করতে শিখি। কথাটা ভলটেয়ারের। আমরা প্রতিপক্ষের প্রতি সহজেই কঠোর হতে পারি; কিন্তু নিজেদের প্রতি অন্ধভাবে উদার ও আত্মসন্তুষ্ট। আমরা যেন অন্যের প্রতি উদার হতে পারি এবং নিজেদের প্রতি কঠোর। আত্মপরিচয় বা আত্মচেতনা যেন আত্মতুষ্টির নামান্তর না হয়। আত্মসমালোচনায় যেন শুদ্ধ হতে পারি। অন্যকে সাম্প্রদায়িক গাল দিয়ে যেন নিজের সাম্প্রদায়িকতা না ঢাকি। এটা কঠিন, সামাজিক আদর্শ হিসেবে। কিন্তু আদর্শকে যেন ছোট না করি। আমরা সমাজকে বদলাতে চাই, সমাজ আজ যেখানে আছে, সেখানেই ফেলে রাখতে চাই না। ভীরুতা দিয়ে পরিবর্তন সাধন করা যায় না। ধর্মনিরপেক্ষতার জন্যও সাহসের প্রয়োজন।

(ধর্মনিরপেক্ষতার ভবিষ্যৎ, আলী আনোয়ার, ধর্মনিরপেক্ষতা, ১১৪-১৫, ঢাকা: বাংলা একাডেমি, ১৯৭৩)।

শেষ কথা, চাচা আর চাচী কে কখনো আলাদা করে ভাবিনি। চাচী কখনো তাঁকে ছেড়ে কোথাও যাননি, আগলে রেখেছেন আমৃত্যু। এমন ভালবাসা শুধু বইতে পড়েছি, আর কদাচিৎ দেখেছি — পরস্পরের জন্য আজীবন এই পাশে থাকা, এই সহানুভূতি, এই উষ্ণতা, আশা-জাগানিয়া স্নিগ্ধ বাণী, এমন শান্ত, সমাহিত, স্নিগ্ধ বিদায় জানানো, এমন দৃঢ় অবিচল সেবা আর শুশ্রুষা।

কত স্বপ্ন, কত প্রাণশক্তি, কত অলিখিত বই, কত কথা, কত গল্প, কত আড্ডা, কত বন্ধুতা, কত উষ্ণতা — কিছুই বাড়িয়ে বলা নয়, কমিয়ে বলা শুধু, আর কি ফিরে পাব সেই মানুষ, যিনি সারা জীবন শুধু ভালবাসা ফেরী করেন, জ্ঞান ফেরী করেন। মানবিক, সাহসী, সচেতন বলে বলে কি শেষ করতে পারব — তিনি কী ছিলেন আমাদের কাছে, কী আছেন?

সাবস্ক্রাইব করুন
অবগত করুন
guest

10 মন্তব্যসমূহ
সবচেয়ে পুরোনো
সাম্প্রতিকতম সর্বাধিক ভোটপ্রাপ্ত
Inline Feedbacks
View all comments
10
0
আপনার ভাবনাগুলোও শেয়ার করুনx
  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.