প্রথম লেখার কাজ
পেটের ভাত যোগানো আর কোনমতে বেঁচে থাকার লড়াইই আমাকে তৈরি করেছে। আমি অবশ্য এই লড়াইয়ে নিজেকে কাবু হতে, ধ্বংস হয়ে যেতে দিই নি।
হায় যীশু! ক’খানা ফালতু ডলার জোগাড় করার জন্য আমাকে আর জুনকে কী দুঃস্বপ্নের ভেতর দিয়েই না যেতে হয়েছিল! আমরা আমার কিছু কবিতা ছাপিয়েছিলাম, আর জুন সেগুলো বার, কাফে ইত্যাদিতে গিয়ে বিক্রি করার চেষ্টা করতো, আমি তখন বাইরে অপেক্ষা করতাম। আমরা জানতাম আমি পাশে না থাকলেই বরং জুন বেশি টাকা যোগাড় করতে পারবে। কখনো কখনো সে কয়েক ঘন্টার মধ্যেও বারের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসতে পারতো না। সে হয়তো কোন ব্যাটাছেলের সঙ্গে বসে কথা বলতো আর সেই ছেলে তাকে পানীয় কিনে দিত এবং স্রেফ তার কথা শোনার জন্যই তাকে টাকা দিত। সে কখনো কখনো হয়ত মাত্র পঞ্চাশ পয়সা নিয়ে বেরিয়ে আসতো, কালেভদ্রে হয়তোবা পঞ্চাশ ডলার নিয়ে, আর আমি দরজার পাশে গুটিশুটি মেরে দাঁড়িয়ে থেকে হাতে কবিতার বান্ডিল নিয়ে ঠাণ্ডায় জমে যেতাম।
আমরা এমনকি একবার রেস্তোঁরায় রেস্তোঁরায় ঘুরে চমৎকার মোড়কে প্যাঁচানো চকলেট, ক্যান্ডি বিক্রি করার উদ্যোগও নিয়েছিলাম। আবারও জুনই যেত সেইসব জায়গায়, তার আগ্রহ ছিল, আমার ছিল না। লোকেরা হাসাহাসি করে আমাকে বার করে দিতো, আমি সেটা সহ্য করতে পারতাম না। জুন খুব সুন্দরী ছিল। আমি কখনো লেখার কাজ চাইতে গেলে জুনকে সঙ্গে নিয়ে যেতাম। আমি একা গেলে যতটা সহানুভূতি ও আনুকূল্য পেতাম তার সঙ্গে গেলে সচরাচর এর চেয়ে বেশিই পেতাম।
আমরা একদিন লিবার্টি ম্যাগাজিন-এর প্রধানের সঙ্গে দেখা করি। আমি তাঁর কাছে সহকারি সম্পাদক পদের জন্য চাকরি প্রার্থনা করি। তিনি জুন ও আমার দিকে ভালো করে চেয়ে দেখে আমাকে বলেন, “শব্দ নিয়ে একটি রচনা লিখে নিয়ে আসো!” আমাকে ভালো চাকরি দিতে পারেন এমন একজনের কাছে নিজেকে প্রমাণ করার সুযোগ পেয়ে আমি লাফিয়ে উঠি, তাছাড়া বিষয়টাও ছিল অনেক ব্যাপক, আমি এ-নিয়ে অনেক কিছুই লিখতে পারতাম।
গবেষণা করার জন্য আমি ফাঙ্ক অ্যান্ড ওয়াগনাল-এর অভিধানের দপ্তরে যাই। ফ্রাঙ্ক ভিজটেলী ছিলেন এর সম্পাদক, তিনি এমন একজন মানুষ যাঁকে কোনদিনই ভুলবো না আমি। তিনি গোটা অভিধানটিই তিনবার কি চারবার পড়েছেন! আমাদের মধ্যে খুবই উজ্জীবক একটি আলোচনা হয়। আমাদের সাক্ষাৎকারের পর, কয়েকদিনের মধ্যেই, আমার বাবা ফ্রাঙ্ক ভিজটেলীর কাছ থেকে একটা চিঠি পান ডাকে। তিনি লেখেন, “মিস্টার মিলার, আমার মতে আপনার ছেলে একটি জিনিয়াস!” আমার বাবা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না যে তিনি আমার সম্পর্কেই এ-কথা বলেছেন।
অবশ্য লিবার্টি আমাকে টাকা দিতে অনেক দেরি করে। তারা বুঝতে পারছিল না আমার লেখাটি ব্যবহার করবে কি না, কেননা তাদের মতে এটা ছিল ‘বেশি ভালো, অত্যধিক উচ্চনাসা’ একটি লেখা। তাদের এই মন্তব্য আমাকে চাঙ্গা করে তোলে। স্বীকৃতি ও উৎসাহ আমার জন্য খুবই দরকারি ছিল। তারা অবশ্য শেষ পর্যন্ত আমাকে টাকা দিয়েছিল, যদিও লেখাটি তারা কখনো প্রকাশ করে নি কোথাও। সেই দিনগুলোতে তিনশত ডলার ছিল রীতিমত অলৌকিক আশীর্বাদের মত।
চেকটা নিতে যাবার সময় জুন আমার সঙ্গে ছিল। এলিভেটরে ফেরার পথে সম্পাদক আমার সঙ্গে করমর্দন করেন, আমাদের শুভকামনা জানান এবং আমার হাতে আরো কুড়িটি ডলার গুঁজে দেন। তাঁর মত মানুষেরাই আমার সকল প্রয়াসকে শক্তি যোগান, সামনে এগিয়ে যেতে উৎসাহ দেন। তাঁদের ছাড়া আজ আমি যেখানে এসেছি সেখানে আসতে পারতাম না কিছুতেই।
নারীবাদীরা
নারীবাদীদের একটা ব্যাপার আমার কাছে খুবই হাস্যকর বলে মনে হয়, সেটি হচ্ছে পুরুষদের যে অভ্যাসগুলোর বিরুদ্ধে তারা এমন সরব ও সোচ্চার তাদের অনেকে আবার সেগুলোই রপ্ত করার জন্য উদগ্রীব। আমরা সবাই জানি যে পুরুষরাই এই পৃথিবীর বারোটা বাজিয়েছে। তাহলে নারীরা কেন তাদেরকেই অনুকরণ করতে চাইবে? আমি এই নারীদের কাউকে কাউকে টেলিভিশনে দেখেছি, তাদেরকে ঠিক পুরুষদের মতই শক্তপোক্ত আর ধুরন্ধর বলে মনে হয়েছে। আমার মতে তারা এর মাধ্যমে নারী-অধিকার আদায়ের সংগ্রামের ভালো করার চাইতে ক্ষতি করে বেশি।
আমি দুজন নারীবাদীর খুবই গুণগ্রাহী; জারমেইন গ্রীয়ার আর গ্লোরিয়া স্টাইনেম। এই দুজনের কারো সাথেই আমার ব্যক্তিগত পরিচয় নেই তবে এদের দুজনই আমাকে বেশ অবাক করেন। দুজনেই সুন্দরী, নারীসুলভ এবং খুবই বুদ্ধিমতী। জারমেইন গ্রীয়ার যখন কোন পুরুষের সঙ্গে বিতর্কে রত হন তখন সেই পুরুষটিকে স্রেফ রদ্দিমাল বলে মনে হয়। যাকে বলে বোকার হদ্দ! আমি একবার প্লেবয় পত্রিকায় তাঁর একটা সাক্ষাৎকার পড়ি- ওহ্ সেকি জিনিষ! তাঁর কথাবার্তা, যুক্তিতর্ক এমন জোরালো এবং শাণিত ছিল যে লোকেরা এম্নিতেই সোজা হয়ে বসে তাঁকে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করে, এর জন্য তাঁকে পুরুষের মত কাপড় পরে তাদের মত আচরণ করতে হয় নি। তাঁর কথায় সাড়া দেওয়াটা সহজ ছিল কেননা তিনি আক্রমণ, অপমান কিংবা ঠাট্টা মশকরা করছিলেন না। সেগুলো আসলে পুরুষদের কূটকৌশল। তাঁর বক্তব্য এমন সপ্রতিভ, অনুপ্রেরণাদায়ী ও সুগঠিত ছিল যে আপনি আলোড়িত না হয়ে থাকতে পারবেন না।
আমি খুব সম্প্রতি কেইট মিলেট আমাকে নিয়ে যে নিবন্ধটি লিখেছিলেন এবং আমার সম্মান রক্ষার্থে নরমান মেইলার যার উত্তর দিয়েছিলেন, সেটি পড়ি। মজার ব্যাপার হলো তাঁর লেখাটি পড়তে পড়তে আমি নিজেও বিশ্বাস করতে শুরু করি পুরুষতান্ত্রিক শূকরের প্রকৃষ্ট উদাহরণ হিসাবে তিনি যে আমার নামটি উল্লেখ করেছেন তাতে সম্ভবত সত্যের কিছু উপকরণ রয়েছে।
সম্প্রতি আমি যখন আমার আলোচিত বইগুলোর কিছু কিছু অংশ আবার পড়ি তখন আমার ভাষাব্যবহারে আমি নিজেই বেশ আহত বোধ করছিলাম। বিশেষ করে নারী ও যৌনতা বিষয়ে আমার কথাবার্তায়। তাঁদের সম্পর্কে এমন রুক্ষ উচ্চারণে তাঁরা কেমন ক্রুদ্ধ বোধ করেছিলেন সেটা আমি বুঝতে পারছিলাম। কেউ ভাবতে পারেন আমি বুঝি নারীদের ঘৃণা করি, তবে তা থেকে সত্যের চেয়ে দূরবর্তী আর কিছু হতে পারে না।
আপনারা দেখেছেন আমি আমার বইয়ে কীরকম একটা দৈত্যসুলভ চরিত্র তৈরি করেছি, যার নাম দিয়েছি আমি হেনরি মিলার। সে একটি দানব, ঠক আর দুশ্চরিত্র বিশেষ। সে নিজেকে প্লেবয় অফ দি ওয়েস্টার্ন ওয়ার্ল্ড ভাবতে পছন্দ করে, সে ভাবে সে একজন দুর্দান্ত প্রেমিক, যেখানে কার্যত সে একটি বিরক্তিকর প্রেমিক মাত্র। সে সবসময় নিজের প্রয়োজন আর আকাঙ্ক্ষায় এতটা মত্ত যে নারীদের চাওয়াপাওয়ার কাছে কিছুতেই আর নিজেকে মেলে ধরতে পারে না। এর অধিকাংশটাই অতিরঞ্জন এবং দেখানোপনা, নয় কি? সেই চরিত্রটিই আমি, আবার আমি নইও। মনে হয় বুঝি দুটো হেনরি মিলার রয়েছে। একটি, যাকে আমি সৃষ্টি করেছি, আরেকটি যে তার সৃষ্টির সবচেয়ে ভালো এবং সবচেয়ে খারাপ দিকগুলোকে অতিক্রম করে বেঁচে রয়েছে।
আমার প্রথম বইগুলো লেখার সময় আমি এখনকার চেয়ে আরো অনেক বেশি রাগী মানুষ ছিলাম। আমার এমনটি মনে হয়, যদি কেইট মিলেট আজ আমার সঙ্গে বসে কথা বলতেন তাহলে তিনি আবিষ্কার করতেন যে তিনি তাঁর বইয়ে যে হেনরি মিলারের এমন নিন্দা করেছিলেন, আমি তার চেয়ে অনেকটাই আলাদা। তিনি সেই লেখাটি লেখার পর অনেক পানি গড়িয়ে গেছে পুলের তলা দিয়ে। সময় আমাকে পাল্টে দিয়েছে, আমাকে আরো কোমল করেছে। সময় সম্ভবত তাঁর বেলাতেও একই কাজ করেছে। আমি সম্প্রতি শুনেছি যে তিনি নোবেল কমিটিকে চিঠি লিখেছেন আমাকে পুরষ্কার দেওয়ার জন্য অনুরোধ করে, সেটি রীতিমত বিস্ময়কর, বিশেষত আমাকে এতটা হেনস্থা করার পর। আমাদের যদি সামনাসামনি সাক্ষাৎ হয় কখনো তাহলে সম্ভবত আমরা অনেক বিষয়েই একমত হবো। আমরা হয়ত এমনটাও আবিষ্কার করবো যে আমরা বন্ধু পর্যন্ত হতে পারি।