হেনরি মিলারের 'ভাবনাগুচ্ছ': ১৪

মানুষের মনোজগতে এত বেশি চলক আর এত রহস্য রয়েছে যে একটিমাত্র চাবি দিয়ে তার সবকটার তালা খোলা অসম্ভব[..]

হেনরি মিলার: দানব না দেবতা?

অনেকেই আমাকে দানবের সঙ্গে তুলনা করেছেন, আবার কেউ কেউ বলেছেন দেবতা। সত্যি বলতে কি আমি কোনদিনই দেবতা হবার স্বপ্ন দেখি নি, কারণ সন্ত টমাস আকিনাস কিংবা সন্ত ফ্রান্সিসের মত ইতিহাসের বিখ্যাত দেবতাদের সঙ্গে কেউই পাল্লা দেবার ক্ষমতা রাখেন না। আমাকে আপনারা হয়ত একজন ছোটখাটো দুষ্টু সন্ত বলতে পারেন, কেননা আমার মধ্যে খানিকটা শয়তানের অস্তিত্বও রয়েছে।

সম্প্রতি আমি নিষ্কলুষতা আর কৌমার্যের মধ্যেকার পার্থক্য নিয়ে ভাবছিলাম। কৌমার্য ব্যাপারটি স্বেচ্ছা-আরোপিত, অন্যদিকে নিষ্কলুষতা এক ধরনের মানসিক অবস্থা আপনি যা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেন। আপনি চেষ্টা করে নিষ্কলুষ হতে পারেন না, হয় আপনি স্বভাবগতভাবেই নিষ্কলুষ নয় আপনি তা নন। কৌমার্য সম্ভবত সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ গুণ কেননা এর সঙ্গে সচেতন প্রয়াস, শৃঙ্খলা আর কঠিন পরিশ্রম জড়িত।

আমি জীবনভর একজন নিষ্কলুষ মানুষ। আমি আমার কোন কৃতকর্মের জন্যই অপরাধ বোধ করি না ! আমি বলছি না এটা আমার বিশেষ কোন গুণ, আমি স্রেফ জন্মগতভাবেই এমন।

সে-রকম কোন সুযোগ দেয়া হলেও আমি সন্তজাতীয় কোন মানুষ হতে চাইবো না, কেননা আমি মনে করি, যে-মানুষ ধার্মিকতা ও দেবত্ব প্রচার না করে তার ভেতরের দানবদেরও কথা বলতে দেয় সে-মানুষ অনেক বেশি জীবন্ত ও আকর্ষণীয় ।

মনোবিশ্লেষণ

আমি নিজে মনোবিশ্লেষণে বিশ্বাস করি না, কিন্তু আজকাল লোকে একে সর্বরোগহর বলে মনে করে। আমরা এখন মনোবিশ্লেষণের যুগে বাস করি, তাই জীবন আর সহজ-সাদামাটা নেই। আমরা বেশি বেশি ভাবছি আজ; বেচারা মস্তিষ্ক আমাদের আজ অতিপরিশ্রমে ক্লান্ত। আমাদের মন নামে বস্তুটি আজ যা করছে তা তার কাজ নয়, তার কাজ আমাদের তাৎক্ষণিক সমস্যাগুলোর সমাধান করা, আমাদের শরীরের সেবা করা। আজ যে আমাদের অনেকেই বিভ্রান্ত, বিপর্যস্ত এবং মানসিকভাবে অসুস্থ তার কারণ আমরা মস্তিষ্কের অপব্যবহার করছি। আমি মনে করি না কিছু বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া মনোবিশ্লেষণের আদৌ কোন দরকার আছে।

মনোবিশ্লেষকদের ব্যপারে সাধারণভাবে আমার এক ধরণের গাত্রদাহ রয়েছে। প্রথমত তারা মানুষকে ঠকায়, তাদের পকেট খালি করে এবং বিনা কারণে তাদের বছরের পর বছর চিকিৎসাধীন রাখে। মনোবিশ্লেষকদের মধ্যে আত্মহত্যা ও উন্মাদগ্রস্ততার হার অনেক বেশি; অথচ আমরা কিনা তাদের আলোকিত ঈশ্বররূপে ভজনা করি! এটা কি স্রেফ পাগলামি নয় যে, আপনি আপনার জীবন এমন একজনের হাতে সঁপে দিচ্ছেন যিনি হয়তবা আপনার চেয়েও বেশি উন্মাদ।

ন্যুয়র্কে আমি একবার মনোবিশ্লেষক সেজেছিলাম। পারী থেকে আমি ও আনেই কয়েকমাসের জন্য সে-বার ন্যুয়র্ক এসেছিলাম। আমার সঙ্গে তখন এক ইহুদি ডাক্তারের পরিচয় হয় যিনি আমাকে খুব পছন্দ করে ফেলেন। তিনি আমাকে বলেন যে আমার মনোবিশ্লেষক হিসাবে কাজ করা উচিৎ এবং তাহলে তিনি আমার কাছে রোগী পাঠাবেন। তাঁর একদল বিত্তবান রোগী ছিল। আমি ভাবলাম, কেন নয়? আমি সেইদিন থেকে ডাঃ মিলার নামে দু’মাসের জন্য মনোবিশ্লেষক-জীবন শুরু করি। বিশেষ কোন পদ্ধতি অবলম্বন করি নি আমি, লোকেরা যখন হালকা হবার জন্য আমার সামনে নিজেদের মেলে ধরত আমি তখন তাদের কথা মন দিয়ে শুনতাম। মূল ব্যাপারটা হলো আপনার দুটো সুস্থ ও সক্রিয় কান রয়েছে কি না, এর চেয়ে বেশি কিছুর দরকার পড়ে না একজন সফল মনোবিশ্লেষক হবার জন্য।

অধিকাংশ সময়ই আমি ক্লান্ত হতাম। আমি ঘুমে ঢলে পড়তাম প্রায়শই, তাই রোগীদের বলতাম “ঠিক আছে আপনি এখন একটু জিরিয়ে নিন। ছোট্ট একটা ঘুম দিয়ে উঠুন।” এই বলে আমরা দুজনেই ঘুমিয়ে পড়তাম। ঘুমটা আসলে ছিল আমার নিজের জন্য, কিন্তু রোগীরাও দেখতাম সেটা খুব ভালোবাসতো।

মজার ব্যাপার, মনস্তত্ত্ব বিষয়ে আমার কোন শিক্ষা কিংবা অভিজ্ঞতা না থাকলেও আমি এইসব রোগীর কাছে ডাক্তার হিসাবে খুবই সফল বলে প্রতীয়মান হয়েছিলাম। যদিও এটা বিশাল কোন ব্যাপার ছিল না। আপনাকে এর জন্য শুধু খোলা মনের অধিকারী আর চটজলদি ভালোমন্দ রায় দিয়ে ফেলার প্রবণতা থেকে মুক্ত থাকতে হবে। আমি কাউকে কোন উপদেশ বিতরণ করি নি, আমি তাদের সামনে হাজির ছিলাম স্রেফ একজন গ্রহীতা হিসাবে।

একদিন আমার এক রোগী, যার ছিল ভয়ঙ্কর তোতলামির ব্যারাম, দুটো শতী-ডলারের নোট-হাতে আমার দরজায় আবির্ভূত হন। আমার হাতে নোটদুটি গুঁজে দিয়ে তিনি বলেন “এই নিন, আপনার জন্য।” আমি বললাম “কিন্তু কীসের জন্য?” “কারণ আপনি আমার অসুখ সারিয়ে দিয়েছেন। আমি আর তোতলাই না।” এই বলে তিনি প্রস্থান করেন। এটা সত্যি তাঁর তোতলামি কেটে গিয়েছিল, কিন্তু আমি কোনদিনই বুঝে উঠতে পারি নি ঠিক কীভাবে সেটা ভালো হয়েছিল।

লোকে যখন মনোবিশ্লেষণ বিষয়ে আমার অনুভূতি জানতে চায় তখন আমাকে বলতেই হয় যে আমি এতে বিশ্বাস করি না। তবে আপনি যদি আমার পরামর্শ চান তাহলে বলি, শান্ত হোন। দুশ্চিন্তা করবেন না বেশি, সমস্যা নিয়ে খুব বেশি ভাববেন না। তরুণদের সমস্যা তৈরি করার একটা বিশেষ প্রতিভা রয়েছে, যখন কার্যত কোন সমস্যার অস্তিত্বই নেই। ঘটনা যেভাবে ঘটছে ঘটুক, স্থির থাকুন, মনকে বিচলিত হতে দেবেন না। দেখবেন খুব দ্রুত সব সমস্যা ও দুর্ভাবনাকে আপনার কাছে গুরুত্বহীন মনে হবে। নিজের মন ও হৃদয়ের ব্যাপারে আপনিই আপনার সবচেয়ে বড় ডাক্তার। কিন্তু এটা যদি হয় ভাঙা হাড়ের ব্যাপার, তবে সেটা আরেক গল্প।

অটো র‌্যাঙ্ক, সিগমুন্ড ফ্রয়েড, কার্ল গুস্তাভ ইয়ুং

ড. অটো র‌্যাঙ্ক-এর সঙ্গে আমার পরিচয় হয় আনেই নিনের মাধ্যমে যখন সে তাঁর সঙ্গে কাজ করছিল ন্যুয়র্কে। আনেই-এর ওপর তাঁর গভীর প্রভাব পড়েছিল, তাই সে আমাদের সাক্ষাতের ব্যাপারে খুব উৎসাহী ছিল, যাতে আমার ওপরেও তাঁর একইরকম প্রভাব পড়ে।

আমি ধরাধামের যাবতীয় বিষয় নিয়ে তাঁর সঙ্গে প্রায় ঘন্টাখানেক কথা বলি। আমার কথা শেষ হলে তিনি আমাকে বলেন “হেনরি, আপনার কোন মনোঃসমীক্ষণ এর দরকার নেই, আপনি সবদিক থেকেই পরিপূর্ণভাবে সুস্থ রয়েছেন। তবে আমি মাঝেমাঝে আপনার দেখা পেতে চাই কেননা আমি আপনার সঙ্গে কথা কলতে চাই। আমার কেউ নেই যে আমার কথাগুলো শুনবে। আমার কোন বন্ধু নেই।”

তিনি একজন আকর্ষণীয় মানুষ ছিলেন, গভীর ধী-শক্তির অধিকারী, কিন্তু ভয়ঙ্কর রকম নিঃসঙ্গ। তাঁর ছিল অবিশ্বাস্য প্রাণশক্তি। তিনি তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয় নিয়ে অনর্গল কথা বলে যেতে পারতেন, খুব সাধারণ কাজের মধ্যেও খুঁজে পেতেন গভীরতম অর্থ। আপনি যদি একটি ফুলদানির পাশে একখানা লবনদানি রাখেন তাহলে তিনি সেটাকে এমনভাবে ব্যাখ্যা করবেন যেন তা ইতিহাসের গতিপথ পাল্টে দেবে। তিনি ছিলেন একজন দুর্দান্ত ভাবুক, কিন্তু সবকিছুর পরেও আমি বলি এতে কী লাভ? এইভাবে মনকে ব্যবহার করে কী উদ্দেশ্য হাসিল হবে?

আমার বয়স তখন আঠারো হবে যখন আমি প্রথমবারের মত সিগমুন্ড ফ্রয়েড-এর নাম শুনি! ন্যুয়র্কের থিওসফিকাল সোসাইটিতে এক ব্যক্তি তাঁর সম্পর্কে বক্তৃতা দেন যেটা ছিল আমার কাছে ছায়াপথ আবিষ্কারের মত। তাঁর লেখা আমার মধ্যে তেমন আবেদন তৈরি করে নি, কেন না সেটা ছিল খুবই বিদ্যায়তনিক, তবে আমি অনেক বন্ধুর সঙ্গে তাঁর বিষয়ে আলোচনা করেছি। আমরা সবাই তাঁর বই স্বপ্নের ব্যাখ্যা দ্বারা গভীরভাবে আলোড়িত হয়েছি। পরে অবদমিত যৌনতা বিষয়ে তাঁর তত্ত্বসমূহ আমাদের কাছে কৌতুকের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়, যদিও শুরুতে তাঁর চিন্তাগুলো ছিল বিপ্লবাত্মক, প্রায় মহাপ্লাবনিক।

কার্ল গুস্তাভ ইয়ুং ছিলেন এদের মধ্যে সবচাইতে জবরদস্ত মনোঃসমীক্ষক। তিনি স্রেফ একজন মনোচিকিৎসক ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন কবি, রাহসিক, দ্রষ্টা। তিনিই ছিলেন এঁদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অধ্যাত্মবোধসম্পন্ন এবং এই বিষয়ে সবচেয়ে ভালো লেখক। তাঁর লেখাগুলো তাত্ত্বিক নয় বরং অনেক বেশি অনুপ্রেরণাদায়ী।

তাঁর পাশে ফ্রয়েড ছিলেন একজন শ্লথপদ যুক্তিবিচারী, যিনি বহুমতের বিরোধী একজন কট্টরপন্থী ভাবুক। এমন একজন মানুষ যাঁর কথাই হচ্ছে আইন। অন্যলোকের চিন্তা ও তত্ত্বের কাছে নিজেকে সমর্পণ করাটা তাঁর কাছে খুব কঠিন ছিল, যেখানে ইয়ুং সারাজীবন ধরে মানুষের মনোজগৎ বিষয়ে তাঁর তত্ত্ব ও ভাবনাসমূহকে প্রসারিত করে গেছেন।

মানুষের মনোজগতে এত বেশি চলক আর এত রহস্য রয়েছে যে একটিমাত্র চাবি দিয়ে তার সবকটার তালা খোলা অসম্ভব। সৃষ্টির আদি থেকেই মানবমনের রহস্য নিয়ে জগতের শ্রেষ্ঠ ভাবুকেরা চিন্তিত হয়েছেন এবং পৃথিবীর শেষ দিন পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকবে। এমন অযুত সম্ভাবনাবিশিষ্ট একটি বিষয়ে কোন বিশেষজ্ঞ থাকতে পারে না, থাকতে পারে কেবল পথিকৃৎ।

আলম খোরশেদ

লেখক, অনুবাদক, সংস্কৃতিকর্মী

১ comment

  1. kamruzzaman Jahangir - ৮ সেপ্টেম্বর ২০১০ (৫:৫৮ অপরাহ্ণ)

    র‌্যাঙ্ক আর ইয়ং এর ব্যাপারে মন্তব্যসমূহ অধিক ভালো লাগল।

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.