পুরুষ ও প্রণয়
প্রণয়ের ব্যাপারে পুরুষেরা শিশুর চেয়েও অধম। বিশেষ করে মার্কিন পুরুষেরা; মহার্ঘ অহং পরিত্যাগে তাদের বড়ই মনোকষ্ট। ভালোবাসার সঙ্গে একধরনের আত্মত্যাগ ও দুর্বলতার সম্পর্ক রয়েছে; রয়েছে ক্ষমতা, আত্মতা ও অহং-বিলুপ্তির বোধ। পুরুষ জানে না নারীর মধ্যে কী রত্ন লুকানো, সে বোঝে না যে তাকে সত্যিকারভাবে ভালোবাসা ও তার কাছে আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়েই সে জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষালাভ করতে পারে।
পুরুষের কাছে প্রেমে পড়াটাই সবচেয়ে বড় বলে মনে হয়, যদিও এটা স্রেফ সূচনা মাত্র, সে-নারীর সঙ্গে তাকে সারাটা জীবন যে যাপন করতে হবে সেটাই প্রধান। একটা সম্পর্ককে কীভাবে টিকিয়ে রাখতে হয় সেটা পুরুষের চেয়ে নারী অনেক ভালো জানে। বলতে গেলে সেই-ই সম্পর্কের চাকায় তেল ঢালার কাজটা করে। সেই-ই সবকিছুকে মসৃণভাবে সচল রাখে। সে পুরুষের চেয়ে অনেক বেশি বাস্তববাদী।
আমি বলবো যে শিল্পীরাই নারী ও ভালোবাসার ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি স্পর্শকাতর। আমরা শিল্পীরা তাকে রোমান্টিকতার চোখে দেখি, তার মধ্যে দেবীত্ব আরোপ করি, আমরা তার সবকিছুর বন্দনা করি, এমনকি তার অন্ধকার দিকগুলোরও; তার খেয়ালিপনা, তার দেমাগ ও দ্বৈততা কোনকিছুই আমাদের নজর এড়ায় না। এবং সম্ভবত আমরা আমাদের এই অতিরিক্ত স্পর্শকাতরতার জন্য কষ্টও পাই অনেক বেশি। নারী আমাদের উত্তেজনা, ধ্যানজ্ঞান ও আচ্ছন্নতার একটা সার্বক্ষণিক উৎস হিসাবে বিরাজমান থাকে।
আমি সত্যি সত্যি বিশ্বাস করি যে আমরা পুরুষেরা হচ্ছি কুকুরছানার মত যে কেবল আদর পেতে, পিঠচাপড়ানি খেতে আর ভরসা পেতে ভালোবাসে। আমরা স্রেফ ক্রীতদাস, নারীরাই আমাদের প্রকৃত প্রভু, তারা আমাদের সঙ্গে যা মন চায় তাই-ই করতে পারে।
নারীর প্রশংসায়
আমি সবসময় ভেবেছি, পুরুষ নয়, নারীরাই শক্তিশালী ও উন্নততর প্রজাতি। তার ধৈর্যক্ষমতা অনেক বেশি, সে অধিকতর যন্ত্রণা, বঞ্চনা, পীড়ন ইত্যাদি সহ্য করতে পারে। তবে তার শারীরিক দমই কেবল তাকে উন্নত করে নি। তার আয়ত্তে রয়েছে প্রবল বুদ্ধিমত্তা, যাকে পুরুষের মানদণ্ডে মাপা যাবে না। এর সঙ্গে বুদ্ধিবৃত্তিক অন্বেষা কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রির কোন সম্পর্ক নেই। তার বুদ্ধিমত্তা প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ যা স্বভাবজাত ও স্বজ্ঞাসম্ভূত। প্রকৃতির প্রয়োজন ও ছন্দের সঙ্গে সে এক সুরে বাঁধা। পুরুষ যেখানে তার পরিপার্শ্বের পৃথিবীকে নিজের প্রয়োজন ও পছন্দের আদলে আকার দিতে চায়, নারী সেখানে তার প্রয়াজনের সঙ্গে সে যে পৃথিবীতে বাস করে তার প্রয়োজনকে সমন্বিত করে নেয়। জীবনের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি খৃব প্রাকৃতিক, বাস্তবসম্মত ও শান্তিপূর্ণ যেখানে পুরুষ খুব যান্ত্রিক ও যুদ্ধংদেহী।
আমি মনে করি পৃথিবীটা নারীদের দ্বারা পরিচালিত হওয়া উচিত। তাহলে সেটা হতো সেই পৃথিবী -এক পৃথিবী- যার স্বপ্ন দেখি আমি প্রায়শই। কোন নারী, পুরুষ কিংবা শিশু – ধরা যাক- কি কোন ইহুদি রাষ্ট্রনায়িকার শাসনে ক্ষুধার্ত থাকতে পারে?
নারীরা পুরুষের সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক। সে তাকে একেবারে দোলনা থেকেই জীবনের ও ভালোবাসার সবচেয়ে বড় শিক্ষা দিয়ে থাকে। সে সমগ্র মানবজাতির অস্তিত্ব, ভবিষ্যৎ এবং আলোকায়নের জন্য সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। আমি আমার টুপি খুলে নিই এবং তার সামনে নতজানু হই।
নোবেল পুরস্কার
কোন রাখডাক না করেই বলতে পারি, যে কোন জীবিত লেখকের চেয়ে আমি নিজেকে নোবেল পুরস্কারের জন্য বেশি যোগ্য বলে মনে করি। কেন? কারণ আমি অনেক প্রথা ভেঙেছি, আমি নির্ভীক, আমার লেখাও সাহসী, তা বহু পাঠককে গভীরভাবে স্পর্শ করেছে, উপরন্তু, আমি এইসব গ্রন্থ রচনা করতে গিয়ে বিশাল ঝুঁকি নিয়েছি।
এই পুরস্কারে ভূষিত হতে না পেরে আমি একরকম বেদনা অনুভব করি। বিশেষ করে যখন যারা এই পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে তাদের কথা ভাবি। কয়েকজন নোবেলবিজয়ীর কথা জানি যারা কবুল করেছেন যে আমি তাদের চেয়ে যোগ্যতর।
এটা আমার দুর্ভাগ্য যে এই পুরস্কারের সিদ্ধান্ত নেয় যে পরিষদ তার সদস্যরা সব নবতিপর, প্রথাগত এবং চরম রক্ষণশীল। আমার লেখা নিশ্চয়ই তাদের প্রবলভাবে আহত করে। আমি প্রগতিশীল, বিদ্রোহী এবং অননুমেয়; যখন এরকম হওয়াটা ঠিক কেতাদুরস্ত ছিল না। আমি সত্য বলতে কখনো পিছপা হই না, তার জন্য যে দামই দিতে হোক না কেন। এ যুগের লেখকদের এই গুণগুলোর জন্যই এখন বাহবা দেয়া হয়, যখন ঠিক একই কারণে আমাকে করা হত গালমন্দ।
আমার ধারণা আমাকে হয়ত মরার আগে কিংবা মরমর অবস্থায় এই পুরস্কার দেয়া হবে। আমি তা নিয়ে কিছুই করব না, কোন হৈ চৈ না, কোন বাগাড়ম্বর না। আমি টনি কিংবা আর কাউকে পুরস্কার গ্রহণ করতে পাঠিয়ে প্রসন্নচিত্তে পটল তুলবো!
Have your say
You must be logged in to post a comment.
৩ comments
kamruzzaman Jahangir - ২৪ আগস্ট ২০১০ (১১:৫৯ অপরাহ্ণ)
আহা, নারী বিষয়ে কী যে অমৃতবাণী শুনলাম। ভালোবাসার স্রোতে মন-প্রাণ, এমনকি শরীর ভিজে গেল! এটি ভালোবাসার সিলেবাসে শীর্ষে থাকার যোগ্যতা রাখে। পুরুষ-প্রণয় আর নোবেল প্রাপ্তির সাতকাহনও ভালো লাগল।
আহারে মজা, মজারে মজা, মজা যে কতদিকে থাকে।
সালাউদ্দীন খালেদ - ২৮ আগস্ট ২০১০ (৬:২৪ অপরাহ্ণ)
আমি সত্যি সত্যি বিশ্বাস করি যে আমরা পুরুষেরা হচ্ছি কুকুরছানার মত যে কেবল আদর পেতে, পিঠচাপড়ানি খেতে আর ভরসা পেতে ভালোবাসে। আমরা স্রেফ ক্রীতদাস, নারীরাই আমাদের প্রকৃত প্রভু, তারা আমাদের সঙ্গে যা মন চায় তাই-ই করতে পারে।
ভাল লাগল
আজম - ৩১ জানুয়ারি ২০১২ (৩:০৩ পূর্বাহ্ণ)
বেগম রোকেয়ার সুলতানার স্বপ্নের মতই মনে হয় লেখক ভাবতেন। আসলেই তাই। বিশ্ব সুষম কঠামোতে কখনোই ছিল না, এর জন্য পুরুষের বিবর্তনের ধারায় পাওয়া অপ্রয়োজনীয় জেনেটিক্যাল বৈশিষ্ট্য গুলোই দায়ী, যে বৈশিষ্ট্য গুলোর প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গিয়েছিল সভ্যতার উম্মেষ ঘটার সাথে সাথেই। অনেক ভালো লাগল লেখাটি।