ওয়াল্ট হুইটম্যান
আমার বন্ধু অ্যাবে রাটনার আর আমি যখন আমাদের আমেরিকাব্যাপী এয়ারকন্ডিশন্ড নাইটমেয়ার যাত্রা শুরু করি তখন আমরা ছিলাম লং আইল্যান্ড-এ, ওয়াল্ট হুইটম্যান যে খামারে জন্মেছিলেন সেটা থেকে খুব একটা দূরে নয়। আমরা ঠিক করি যাত্রা শুরু করার আগে তাঁর জন্মস্থানের পাশ দিয়ে গিয়ে আমাদের শ্রদ্ধা জানাবো। কথামত তাঁর বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আমরা গাড়ির গতি কমিয়ে মাথার টুপি খুলে নিই, তারপর দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে, মৃদু হেসে আমাদের অভিযান শুরু করি।
আমার আমেরিকা পুনরাবিষ্কারযাত্রাটি এভাবে শুরু করাটাকেই সবচেয়ে সমীচীন বলে মনে হয়েছিল, এটা শুধু ওয়াল্ট হুইটম্যান হাড়েমজ্জায় একজন খাঁটি আমেরিকান ছিলেন বলেই নয়, গণতন্ত্রের প্রথম ও শেষ প্রতিভূ, একজন জনগণনন্দিত প্রকৃত জনগণের মানুষ, জনগণের জন্য নিবেদিতপ্রাণ মানুষ ছিলেন বলেও।
আমি হুইটম্যানকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম লেখক বলে মনে করি, এমনকি ইউরোপের যে-কোন শ্রেষ্ঠতমর চেয়েও শ্রেষ্ঠ । লীভ্স্ অভ গ্রাস একটি সত্যিকারের মাস্টারপীস, আত্মার সংগীতবিশেষ। তাঁর কবিতা সং অভ মাইসেল্ফ-এ স্বাধীনতার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল।
এই মানুষটির তাঁর নিজের ও নিজের লেখার ওপর এতটাই বিশ্বাস ও আস্থা ছিল যে তিনি গেরস্থালি সামগ্রীর ফেরিঅলার মত দরজায় দরজায় ঘুরে তাঁর কবিতা ফেরি করতেন। আমি যখন প্রথম লেখা শুরু করি তখন তাঁর সাহসই ছিল আমার আত্মপ্রকাশের প্রেরণার উৎস। তিনি তাঁর জীবনযাপনের মধ্য দিয়ে দেখিয়েছিলেন যে অনাহার ও জীবনসংগ্রামও গৌরবময় হয়ে উঠতে পারে যদি আপনি এর কাছে পরাজিত না হন।
হুইটম্যানকে প্রায়শই সমকামী বলা হয়ে থাকে কিন্তু পুরুষের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল স্রেফ ভ্রাতৃসুলভ, তা কখনোই যৌনতাময় ছিল না। যৌনতার জগৎ থেকে তা অনেক উর্ধ্বে ছিল। তাঁর ছিল এক অদ্ভূত বিকিরণী ক্ষমতা, ভালোবাসার ও দান করার ক্ষমতা ছিল তাঁর এক কথায় সীমাহীন।
তিনি ছিলেন একজন উল্লসিত মহাজাগতিক সত্তা- মানুষের কী হওয়া উচিৎ, কীভাবে চিন্তা করা ও বাঁচা উচিৎ তার সুন্দরতম দৃষ্টান্তবিশেষ।
নুট হামসুন/এজরা পাউন্ড
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালে নুট হামসুন ও এজরা পাউন্ড দুজনকেই উন্মাদাশ্রমে যেতে হয়েছিল তাঁদের কিছু মন্তব্যের কারণে। তাঁদেরকে হয়তবা জেলেই যেতে হতো, যদি না তাঁরা বৃদ্ধ এবং সম্মানিত লেখক হতেন।
নুট হামসুন সবসময় তাঁর বইয়ে নরওয়েবাসীদের নিয়ে ঠাট্টা মশকরা করতেন, ঠিক আমি যেরকম আমার বইয়ে মার্কিনিদের নিয়ে হাসি তামাশা করে থাকি। তিনি বলতেন “আমাদের লোকেরা নির্বোধ চাষা, তাদের কোন মেধা নেই এবং এর চেয়ে খারাপ তাদের কোন রসবোধও নেই।” তিনি তাঁর দেশবাসী কর্তৃক নিন্দিত হয়েছিলেন কেননা তিনি তাঁর সরকার বিষয়ে সত্যিকার অনুভূতি ব্যক্ত করেছিলেন। হিটলার যখন স্ক্যান্ডিনাভীয় দেশগুলোতে তাঁর অভিযান শুরু করেন তখন তিনি ঘোষণা করেছিলেন যে তাঁর মতে নরওয়েতে তখন যে সরকার ছিল তার তুলনায় যে কোন জিনিসই ভালো হতে বাধ্য। এই কথাই তাঁর কাল হয়। তিনি ভুল সময়ে একটা ভুল কথা বলে ফেলেছিলেন। তখন নাৎসীবিরোধী মনোভাব এমন তুঙ্গে যে তাঁর শাস্তি না হয়ে কোন উপায় ছিল না।
তিনি উন্মাদাশ্রমে থাকাকালীন ছোট্ট ও চমৎকার একটি বই লিখেন অন ওভারগ্রোন পাথ্স্ নামে। এটি তাঁর অন্যতম সেরা বই, মজায় ঠাসা । তাঁর দেশবাসীর বিপরীতে তাঁর ছিল চমৎকার রসিকতাবোধ। আমি যত লেখকের গুণমুগ্ধ তাঁদের মধ্যে এই একজনকেই আমি অনুকরণ করতে চাইতাম।
এজরা পাউন্ড আমার কাছে সম্পূর্ণ আলাদা একটি ব্যাপার। আমি তাঁর প্রথমদিকের কবিতাগুলো পড়ে পছন্দই করেছিলাম। সেগুলো অনেক বেশি ধ্রুপদী ও রোমান্টিক ঘরানার ছিল তাঁর পরের দিকের কবিতাগুলোর চেয়ে, যেগুলোকে আমি ঘেন্না করতাম। তিনি ছিলেন একজন জাঁকজমকপূর্ণ মানুষ, যত না কবি, তার চেয়ে বেশি শিক্ষক। তিনি যখন কথা বলতেন তখন সেটা আমার কাছে তেমন আকর্ষণীয় মনে হতো না কেননা তিনি সবসময় অর্থনীতি নিয়ে পড়ে থাকতেন, আমার কাছে যা ছিল খুবই একঘেয়ে একটা বিষয়।
মুসোলিনিকে সমর্থন করার জন্য পাউন্ডকে কারাগারে যেতে হয়েছিল। তিনি অনেকদিন ইটালিতে বাস করেছিলেন এবং রাজনৈতিকভাবে পৃথিবীতে কী ঘটছিল তার সঙ্গে সংস্পর্শরহিত ছিলেন, এবং অনেকটা হামসুনের মতই নিজের মনের অনুভূতিটুকুই প্রকাশ করেছিলেন। শেষ মুহূর্তে তাঁকে উন্মাদাশ্রমে দেয়া হয়েছিল, যেনবা সেটা কিছু কম শাস্তি ছিল!
সাত বছর আটক থাকার পর তিনি যখন মুক্তি পান তখন তিনি একজন সম্পূর্ণ পরিবর্তিত মানুষ। তিনি তখন একেবারে ভেঙে-পড়া, বিধ্বস্ত, পরাজিত একজন মানুষ। যখন কেউ তাঁর সঙ্গে কথা বলতে চাইতো বা তাঁকে কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতো তখন তিনি বলতেন “আমি কিছু জানি না। আমি কিছু বুঝি না।” তিনি কিছু এড়িয়ে যেতে চাইছিলেন না, তাঁর তখন সেই মনটাই আর অবশিষ্ট ছিল না যার সাহায্যে তিনি কোন বুদ্ধিজীবী কিংবা শিল্পী হিসাবে বাঁচতে পারতেন, তিনি ছিলেন শূন্য, শুষ্ক একজন মানুষ যিনি কোন কাজ করতে পারতেন না আর।
আমি প্রায়ই ভাবি আমার ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটতে পারতো, সরকার আমাকেও জেলে ভরে দিতে পারতো আমি আমেরিকার বিরুদ্ধে যত কথা বলেছি তার জন্য। সেটা কী ভয়ঙ্করই না হতে পারতো, ঠাণ্ডা একটি বদ্ধ প্রকোষ্ঠে শুয়ে শুয়ে মৃত্যুর প্রতীক্ষা করা! তবে সেটাকে যখন আমি একটা সত্যিকারের সম্ভাবনা হিসাবে বিচার করি তখন আমার মনে হয় যে আমাকে তারা ধরতে আসার আগেই সম্ভবত আমি মৃত্যুকে আলিঙ্গন করবো।
নরমান মেইলার
নরমান মেইলার একজন নেশা-ধরানো, মজার মানুষ। ইস্পাতের ফাঁদের মত মন তাঁর। আপনি তাঁকে কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলে তিনি খুব জটিল একটা উত্তর দেবেন, তাঁকে বোঝা খুব কঠিন। নরমান কোনকিছুকেই সহজ করতে পারেন না, বিশেষ করে শব্দের বেলায়।
আমি তাঁকে পড়ার চেষ্টা করেছি, কিন্তু তাঁর বই আমি নামিয়ে রাখতে বাধ্য হয়েছি। তিনি কী বলতে চান তার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারি নি আমি। জিনিয়াস অ্যান্ড লাস্ট বইয়ের যে ভূমিকা লিখেছেন তিনি সেটি আমার কাছে দুর্বোধ্য ঠেকেছে।
আপনারা জানেন ফরাসি পেত্ শব্দের অর্থ বাতকর্ম, আর পেতেরাদ হচ্ছে বাতকর্মের লহরী। নরমানের লেখা হচ্ছে সেই বাতকর্মের লহরীর মত। তিনি দারুণ এক মনের অধিকারী, কিন্তু তিনি সবকিছুকেই ফেনিয়ে তোলেন। তাঁর রয়েছে, যাকে বলা যায়, শব্দ-দাস্তের রোগ, তিনি তাঁর শব্দদের সামলাতে পারেন না, তিনি তাদের প্রেমে এতটাই মশগুল যে সেগুলো ব্যবহারের সামান্যতম সুযোগও তিনি হাতছাড়া করতে চান না।
আমাদের দুজনের মধ্যে অনেক মিল রয়েছে। প্রথমত আমাদের দুজনেরই দারুণ দেমাগ। পৃথিবী যে আমাদের দুজনকে কেন্দ্র করে ঘোরে সেকথা জানেন না বুঝি আপনারা? আমরা দুজনেই ভাঁড়, আমাদের মধ্যে অনেকটুকু জুড়েই এক অভিনেতার বাস, আমরা লোকদের সহজেই ভোলাতে পারি। যদিও আমরা খুবই অশ্লীল কথা বলি, অশ্লীল কাজ করি, তবু আমাদের মধ্যে এমন এক সারল্য আছে যা মানুষকে আকৃষ্ট করে দেখামাত্রই।
নরমান এক ধরনের দুষ্টু-দানব বিশেষ যে কারণে সে অদ্ভুত সব কাজ করেও পার পেয়ে যেতে পারে, যেমন ধরুন, ন্যুয়র্ক শহরের মেয়র পদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা। সে এমনকি একবার টেলিভিশনে গোর ভাইদালকে মুষ্টিযুদ্ধেও আহ্বান করেছিল। ভাইদাল এসবের অনেক উর্ধ্বে ছিলেন, তাই এতটা নীচে নামতে রাজি হওয়ার কথা নয় তাঁর। এই জাতীয় কাণ্ডকারখানাই এক ধরনের উন্মাদের খ্যাতি এনে দিয়েছিল তাঁকে।
তাঁর যে জিনিসটা আমাকে পীড়িত করে সেটা হচ্ছে যে তিনি একমাত্র যৌনতা ছাড়া আর কোন বিষয়েই আমাকে লেখক হিসাবে স্বীকৃতি দিতে চান না। কলোসাস অভ মারুসির মত বইকেও তিনি ধর্তব্যের মধ্যে নেন না। অধিকাংশ মানুষ, খোদ আমি-সহ, মনে করে এটা আমার সেরা লেখা, কিন্তু নরমান সেটা পছন্দ করেন না কেননা তাঁর মতে এটা যথেষ্ট উত্তেজক নয়। আমি মনে করি এই অভিমত তাঁর সংকীর্ণতার পরিচায়ক।
অনেকেই আমাকে চিঠি লিখে জিজ্ঞাসা করেছে জিনিয়াস অ্যান্ড লাস্ট সম্পর্কে আমার অভিমত কী, লেখকের উদ্দেশ্য সম্পর্কে তারা মনে হয় আমার মতই বিভ্রান্ত। হেনরি, আপনি বইটা পড়ে কী বুঝেছেন? তারা প্রশ্ন করে। তাদের এই প্রশ্নে আমার মাথায় নরক ভেঙে পড়ে। আমিও জানি না তিনি কী বলতে চেয়েছেন। মাঝেমাঝে আমার সন্দেহ হয় তিনি নিজেও তা জানেন কিনা। এটা হয় আমার বোধবুদ্ধির অনেক ওপরের বিষয়, নয় স্রেফ ফালতু কোন লেখা।
মানুষ নরমানকে আমি পছন্দ করি, কিন্তু লেখক নরমানকে পড়ার পরামর্শ দেবো না আমি কাউকে।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
১ comment
kamruzzaman Jahangir - ১৪ জুলাই ২০১০ (৮:০২ পূর্বাহ্ণ)
মজা পেয়ে, মজা করে, দারুণ আনন্দের ভিতর দিয়ে পাঠ করা গেল। অনুবাদও হয়েছে খুবই চমৎকার, যেন পুনঃসৃজনের স্বাদ পাওয়া গেল। এটি গ্রন্থ হিসাবে দেখার ব্যাকুলতা তৈরি হচ্ছে।