ব্লাইজ সেন্দ্রা
আমি যখন পারী-তে থাকতাম তখন একদিন বিনা নোটিশে ব্লাইজ সেন্দ্রা এসে হাজির।
“মঁসিয় সেন্দ্রা” এই বলে আমি তাঁকে অভ্যর্থনা করি।
“না” তিনি মাথা নেড়ে বলেন “আপনার কছে মঁসিয় কক্ষনো নয়, স্রেফ সেন্দ্রা!”
আমার জন্য এটা খুব সম্মানের বিষয় ছিল যখন তিনি একটা ফরাসি ম্যাগাজিনে ট্রপিক অফ ক্যান্সার বইখানার প্রথম আলোচনা লেখেন। এর শিরোনামটা আমার এখনো মনে আছে ‘আন এক্রিভাঁ নুজ এ নে’, ‘আমাদের মাঝে এক লেখকের জন্ম হয়েছে।”, যা আমাকে পৃথিবীর শিখরে তুলে দেয়।
আমরা দুজনই দুজনের সম্পর্কে কিছু না কিছু লিখেছি। ফরাসি পাঠককে তাঁর অস্তিত্ব বিষয়ে সচেতন করার জন্য আমিও অংশত দায়ী। অদ্ভুত ব্যাপার, এই অসাধারণ লেখকের দুর্দান্ত বইগুলো ব্যাপকভাবে পঠিত হয় নি। তাঁর দেশবাসী তাঁকে কঠিন মানুষ বলে গণ্য করতো। আমি তাঁকে দেখিয়েছি একজন সংস্কৃতিবান মানুষ হিসাবে যদিও তিনি সাহিত্যকে ঘৃণা করতেন। তিনি ফরাসি সাহিত্যজগতের প্রতি ন্যূনতম আত্মীয়তা অনুভব করতেন না।
তিনি ছিলেন একজন সম্পূর্ণ স্বশিক্ষিত মানুষ যিনি চোদ্দ পনেরো বছর বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন বাড়ির মূল্যবান সামগ্রীসমূহের যতটা সম্ভব চুরি করে- রূপার বাসনকোসন, গয়নাগাঁটি, যা কিছু পকেটে ভরতে পেরেছিলেন। তিনি স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বলেছিলেন যে তিনি তাঁর পারিবারিক উত্তরাধিকার ভাণ্ডার লুট করে ভেগেছিলেন।
বন্ধকির দোকানে সবকিছু বিক্রি করে তিনি যে টাকা পেয়েছিলেন তা দিয়ে ট্রান্স সাইবেরিয়ান-এর টিকিট কেটে তিনি সাইবেরিয়া থেকে বেজিং চলে গেলেন। বেজিং-এ নেমে তিনি একটা বড় হোটেলের বয়লার রুমে ফার্নেসে কয়লা ঠেলার কাজ নিলেন। অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের খাতিরে আর রোমাঞ্চের তাড়নায় তিনি নানারকম লোমহর্ষক কাজ করেছিলেন।
প্রথম মহাযুদ্ধের সময় তিনি হাতে গুলির আঘাত লেগে মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিলেন। তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে তিনি নিজেকে আরো একগাদা রোগীর সঙ্গে মেঝেতে শায়িত দেখতে পান ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে। তিনি তখন উপলব্ধি করলেন তিনি নিজেই যদি নিজেকে সাহায্য না করেন তাহলে রক্তক্ষরণেই মারা যাবেন। তিনি কোনমতে উঠে দাঁড়িয়ে কোমরবন্ধ থেকে পিস্তলখানি বার করে সোজা অপারেশন রুমে চলে যান। অপারেশনরত ডাক্তারের কপালে পিস্তল ঠেকিয়ে তিনি বলেন “ঠিক আছে, এর পরেই আমি, তা না হলে আপনি জানে বাঁচবেন না।”
তিনি জানতেন তাঁকে প্রাণে বাঁচতে হলে এরকম সাংঘাতিক কিছু একটাই করতে হবে, যদিও ততক্ষণে দেরি হয়ে গিয়েছিল কেন না তাঁর হাতটিকে কেটে বাদই দিতে হয়েছিল।
তাঁর ছিল চমৎকার রসিকতাবোধ। তিনি একদিন আমাকে ও আমার এক বন্ধুকে এক হাত দিয়ে কীভাবে শরীরের যেকোন জায়গা চুলকাতে পারেন সেটা দেখিয়ে মজা দিয়েছিলেন। তিনি সত্যি মজার একটা বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের রূপ দিয়েছিলেন একে। তিনি যেভাবে এঁকেবেঁকে দুমড়েমুচড়ে গিয়ে একহাত দিয়ে এখানে ওখানে চুলকাচ্ছিলেন তা দেখতে খুবই বিনোদনপূর্ণ হয়েছিল। আমরা হাসতে হাসতে এক পর্যায়ে প্রায় কেঁদেই ফেলি।
শেষবার যখন আমি তাঁকে দেখি সেটি ছিল খুব দুঃখের বিষয়। যাকে বলা যেতে পারে ট্রাজিক। আমাকে দৌড়ে পালিয়ে আসতে হয়েছিল এবং তারপর আমি আর কোনদিন তাঁর কাছে ফিরে যাই নি। জানি এটা আমার ঘোরতর অন্যায় তবু আমি তাঁর এভাবে কষ্ট পাওয়ার দৃশ্য সহ্য করতে পারছিলাম না। তিনি ক্যান্সারে মারা যাচ্ছিলেন, আর ব্যথা সহ্য করতে না পেরে তিনি বসে বসে কাঁদছিলেন। তিনি ব্যথানাশক কোন অষুধ নিতেন না। তিনি বলতেন: আমি দেখতে চাই মৃত্যু ব্যাপারটি কীরকম। গভীর গর্ব নিয়ে তিনি আমাকে জানান যে আন্দ্রে মালরো তাঁকে প্রি দ্য পারী পুরস্কার দিয়ে তাঁর মহানুভবতার নিদর্শন রেখেছেন। গোটা ব্যাপারটাই খুব করুণ কেননা তাঁরা জানতেন তিনি মৃত্যুশয্যায় শায়িত। প্রি দ্য পারী পুরস্কারটি এম্নিতেও তেমন আহামরি কিছু ছিল না। আমার ধারনা এটি তাঁরা মুদির দোকানি, ব্যবসায়ী এমনকি মাংস কাটার কসাইদেরও দিয়ে থাকেন।
আমি নিজেকে ধরে রাখতে পারছিলাম না। আমাকে পালিয়ে আসতে হয়েছিল তাই। একজন মহাপ্রাণ মানুষকে এই অবস্থায় পর্যবসিত হতে দেখাটা খুবই বেদনার। তাঁর কাছে ফিরে যাবার সাহস আমার আর কোনদিনই হয় নি। কিছুদিন পরেই তাঁর মৃত্যু হয়।
হান্স রিশেল
রিশেল নামে এক লোক ছিল, একজন শিল্পী, এক দানবীয় চরিত্র, দারুণ। দারুণ যখন সে স্বাভাবিক থাকতো আর ভয়ংকর যখন মদ খেয়ে থাকতো। তার তখন খিঁচুনি হত, হাতের সামনে যা পেত তা-ই ভাংচুর করতো। সে ছিল সোচ্চার স্বভাবের এবং তাকে নিয়ন্ত্রণ করা ছিল খুবই কঠিন, যদিও আমি অন্যদের চেয়ে ভালো বশ মানাতে পারতাম তাকে। তার সেইসব ঘোরের মুহূর্তে তাকে থামিয়ে দেওয়ার চাইতে আমি তাকে আরো উস্কে দিতাম সবকিছু ভেঙে ফেলার জন্য এবং আরো জোরে চীৎকার করার জন্য। তার তৃষ্ণা মিটে যাওয়ার পর সে কান্নায় ভেঙে পড়তো এবং তখনই তার পাগলামির সমাপ্তি হতো। তবে মাঝেমাঝে আমি এমন বিরক্ত হতাম যে তাকে গলা ধাক্কা দিয়ে সিঁড়িতে বের করে দিতাম। আমি ব্যালকনিতে গিয়ে দেখতাম সে ব্যথা পেয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে, আমাকে দেখে সে নাকে আঙুল দিত আর আমিও তাইই করতাম। সে সারা পাড়া ঘুরে ঘুরে আমাকে জার্মানে গালি দিত আর আমি তাকে গালি দিতাম ইংরেজি আর ফরাসি ভাষায়। পরদিন সে ফুলের তোড়া কি কোন শান্তিসূচক উপহার নিয়ে হাজির হত।
“মিলার” সে বলতো, “কাল রাতে কী হয়েছিল? আমার কিছুই মনে নেই।” ব্যাপারটা সত্যি করুণ, কিন্তু রিশেল আমার পারী-বাসের সময়কার এক বন্ধু আমি যাকে কোনদিন ভুলবো না।
আমি কোন এক ক্রিসমাস দিনের কথা মনে করতে পারি যখন আমাদের কারোরই কোন খাবার, কিংবা টাকা কিংবা মদ ছিল না। একটা বোতলে হয়তবা ষোলভাগের একভাগ মদ তলানিতে পড়ে ছিল। আমি, রিশেল আর আল্ফ ছোট ছোট গ্লাস বার করি। আমরা সেই সামান্য মদটুকুই তিনজনে মিলে ভাগ করে খাই. আমরা সেটা দীর্ঘ সময় ধরে পান করি, কোনরকমে গিলে না ফেলে। আমরা আমাদের ক্ষুধার্ত সময়গুলোর গল্প করি এমনকি ক্ষুধার উদ্দেশে স্বাস্থ্য পান করি। আমরা সেইসব দিনগুলোতে প্রত্যেক বিষয় থেকে সর্বোচ্চ মূল্য আদায় করে নিতে পারতাম, এমনকি শূন্যাবস্থাতেও চলতে পারতাম। আমরা একসঙ্গে থাকতে পেরেই সুখী ছিলাম, তা সেটা আমরা ক্ষুধার্তই থাকি, কি কপর্দকশূন্য এবং ভবিষ্যৎ বিষয়ে আশাভরসাহীনই থাকি না কেন।
আমরা বসে বসে স্রেফ গল্প করে আর আমাদের যা কিছু অভিজ্ঞতা সেগুলো ভাগ করে নিতে পেরেই তৃপ্ত ছিলাম।
পিকাসো
সুখ্যাতির শীর্ষে ওঠার আগে পারী শহরে ফরাসি কবি মাক্স জ্যাকবের সঙ্গে ছোট্ট একটা ঘরে থাকতেন পিকাসো। তাঁরা এত গরিব ছিলেন যে বাইরে গিয়ে কফি খাওয়ার পয়সা পর্যন্ত তাঁদের ছিল না। তাই তাঁরা দুজন দুজনকে বিনোদিত করতেন, ঘরের ভেতরের একটা পাটাতনে উঠে পালা করে তাঁরা এ কাজ করতেন। তাঁরা গান করতেন, নাচতেন এবং গভীর রাত অব্দি হাস্যকৌতুকে মাতিয়ে রাখতেন পরস্পরকে।
তাঁরা এতটাই গরিব ছিলেন যে তাঁদের একটা মাত্র ছোট খাট ছিল যাতে পালা করে ঘুমাতেন। প্রথমে মাক্স জ্যাকব এবং পরে পিকাসো ঘুমাতেন। ভাবতেই অবাক লাগে যখন আমরা জানি পিকাসো পরে কী ধনীই না হয়েছিলেন।
আমি দুঃখিত যে আমাকে বলতে হচ্ছে মানুষ হিসাবে পিকাসোর প্রতি আমার কোন শ্রদ্ধা নেই। তিনি বিশেষ করে তাঁর সন্তানদের সঙ্গে জঘন্য ব্যবহার করেছেন। অনেকদিন আগে তাঁর দুই সন্তানের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। তাদেরকে দেখে মনে হয়েছিল তারা বুঝি অন্য গ্রহ থেকে আগত। খুবই সুন্দর, সূক্ষ্ম এবং স্পর্শকাতর মানুষ। তারা আমাকে বলেছে যে তাদের বাবা বাগানবাড়ির দরজা থেকে তাদের ফিরিয়ে দিয়েছিল। ‘ভাগো তোমরা, আমি কাজ করছি’ ইন্টারকম মারফত এই কথা বলে তিনি দরজা খুলতে অস্বীকার করেছিলেন।
আমাদের সময়ের অধিকাংশ প্রতিভাবানই ছিলেন ঘৃণ্য চামারের মত। আমার মনে হয় আমাকেও বোধহয় সহজেই এই দলে ফেলা যায়।
পিকাসোরা, সন্দেহ নেই, দুনিয়াতে একবারই আসেন। আমার মনে হয় না তাঁর মত আর একজনকে আমরা দেখতে পাবো। সেরকম সৃজনশীল শক্তি, সেরকম তুমুল প্রতিভা দ্বিতীয়টি হয় না।