বেলজিয়াম-এর অন্ধ পাখিরা
আমি ঠিক মনে করতে পারি না আমরা যে পাখির বাজারটাতে গিয়েছিলাম সেটা কোন্ শহরে ছিল: ব্রাসেলস্, ঘেন্ট নাকি ব্রুজেস-এ। আমার আবছা মনে আছে এটা একটা গীর্জাঘেরা বড় চত্বরের মধ্যে ছিল এবং আমরা যখন সেখানে গিয়ে পৌঁছি ঠিক তখনই সেখানকার রাস্তা দিয়ে কোন এক ধর্মীয় নিদর্শনের শোভাযাত্রা হচ্ছিল। অন্তত এটুকু মনে আছে যে আমরা যখন সেগুলো দেখছিলাম আর প্রশংসা করছিলাম তখন কে একজন যেন আমাদের এই তথ্যটি দিয়েছিল যে অন্ধ পাখিরা ভালো গান করে। লোকটি আরো বলে যে সাধারণ রীতি হচ্ছে এদের চোখের তারায় একটা সুঁই ফুটিয়ে দেওয়া।
ভালো গান গায় বলতে সেই ব্যক্তি বোঝাতে চেয়েছিলেন অধিকতর করুণ রসের সঙ্গে গাওয়া। এই মন্তব্য শুনে আমার ও আমার স্ত্রী ইভ এর শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত নেমে গেল। বেলজিয়াম ভ্রমণের সময় আমরা যত আশ্চর্যজনক দৃশ্য দেখেছি তার সবই মুছে গেল এইসব অন্ধ পাখিদের স্মৃতিতে যারা তখন দেবদূতের মত গান গাইতে পারতো।
অনেক রাতে ব্রাসেলস্ এ ফেরার পথে আমাদের গৃহকর্তা, যিনি লিমুজিন চালানোর দায়িত্বে ছিলেন, হঠাৎ করে ইভ-এর দিকে তাকিয়ে বললেন যে তিনি তাঁর গুনগুন করা শুনছিলেন এবং তাঁর কন্ঠের যাদুতে মুগ্ধ।
তিনি আরো বলেন “আপনি কি আমাদের একটা গান শোনাবেন না?”
এটা শুনে ইভ আর কথা না বাড়িয়ে তার গলা খোলে এবং আমাদের খুব প্রিয় একটা গান ‘অলওয়েজ’ গাইতে শুরু করে। কিন্তু এবার আমার মনে হলো তার কন্ঠে একটা নতুন সুর লতিয়ে উঠছে। এটা সেই অন্ধ পাখিদের বিধুরতা। গাড়িতে আমরা মোট ছয়জন ছিলাম কিন্তু আমাদের কেউই তার সঙ্গে গলা মেলায় না। এক ধরনের চাপা নীরবতা বিরাজ করছিল গাড়িতে যেন বা জীবনে প্রথমবারের মত কোন অস্বাভাবিক কিছু একটা শুনছিলো সবাই।
গান শেষ করার পর আমাদের গৃহকর্তা তাকে বলে সে এটা আরেকবার গাইবে কি না, ইভ তা আরেকবার গেয়ে শোনায়। আরো একবার সে স্রেফ তার গলা খুলে গানটাকে গড়িয়ে বেরিয়ে যেতে দেয়। সেটাও আমাদের আরেক প্রিয় গান “রোজেস অফ পিকার্ডি”। আবার সেই একই ঐন্দ্রজালিক প্রতিক্রিয়া হয়। সকলেই গভীরভাবে আলোড়িত বোধ করে।
বর্হিপৃথিবী
আমি বিশ্বাস করি অন্যান্য গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব রয়েছে। মহাবিশ্ব তার প্রতিটি অংশেই খুব জীবন্ত। শুধুমাত্র আমরা এখনো অপর পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগের যন্ত্রপাতিগুলো বানিয়ে উঠতে পারি নি। না, মহাবিশ্ব কেবল আমাদের জন্যই তৈরি করা হয় নি।
বিশ্বাসীরা ভেবেছিল পৃথিবী নামক গ্রহটি একটি মহাজাগতিক ভুল। আমিও সেরকমই বোধ করি- আমি এই পৃথিবী থেকে বিদায় নেবার আগেই এর ওপর থেকে আমার মন উঠে গেছে। আমি দেখতে পাচ্ছি যে আমরা এই গ্রহে বাস করেও একে কী করে আমাদের অস্ত্র, বোমা আর কম্প্যুটারসমূহ দিয়ে আরো সুচারুরূপে ধ্বংস করা যায় সেটা ছাড়া আর কিছুই শিখি নি।
আমি সুযোগ পাওয়ামাত্রই উড়ন্ত সসারে চেপে বসবো লাফ দিয়ে। আমি নিশ্চিত তাদের অস্তিত্ব রয়েছে, এর সপক্ষে এত বেশি সাক্ষ্যপ্রমাণ রয়েছে যে আমার পক্ষে অবিশ্বাসী হওয়া কঠিন। আমি এই বিষয়ে যা কিছু পেয়েছি পড়েছি। এগুলো খুবই চমকপ্রদ । নিঃসন্দেহে যদি মহাবিশ্বে অপর প্রাণীর অস্তিত্ব থেকে থাকে তাহলে তারাও আমাদের ব্যাপারে ততটাই কৌতূহলী যতটা আমরা তাদের বিষয়ে। এটা অপরিহার্য যে একদিন আমরা একে অপরের গায়ে ধাক্কা খাবো। আশা করি মানুষেরা তার জন্য প্রস্তুত আছে। দুই পৃথিবীর ভেতর জ্ঞানের বিনিময়ের ব্যাপারটা খুবই চমৎকার হতে পারে।
আমরা সবাই জন্মেছি স্বর্গের সন্ধান করার জন্য। আমরা এই স্বর্গকে নানাভাবে সংজ্ঞায়িত করতে পারি: বর্হিপৃথিবী, জ্ঞানালোক, মানবিক উৎকর্ষ ইত্যাদি। ঊর্ধজাগতিকতা, বর্হিপৃথিবী বলা হয়ে থাকে যাকে, তার সন্ধান মানবের সবচেয়ে শক্তিশালী ও তাৎপর্যপূর্ণ তাড়না সন্দেহ নেই।
গুর্ডজিয়েফ
গুর্ডজিয়েফ বিংশ শতাব্দীর অন্যতম রহস্যময় চরিত্র ছিলেন। তিনি এতটাই দুর্জ্ঞেয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন যে যদিও তাঁর অসংখ্য অনুসারী তাঁকে একজন মহান চিন্তক, দার্শনিক ও রাহসিক হিসাবে বিবেচনা করতেন কিন্তু কেউই বুঝতে পারেন নি তিনি ঠিক কোন আদর্শ বা দর্শনে বিশ্বাস করতেন।
তাঁর লেখা আমার কাছে রীতিমত দুর্বোধ্য ছিল, তারপরেও দারুণ একটি বই, ফ্রিট্জ পিটার্স এর লেখা বয়হুড উইথ গুর্ডজিয়েফ, এর কারণে আমার মনে হয় আমি তাঁকে খুব ঘনিষ্ঠভাবে চিনি। এটা একটা চমৎকার গ্রন্থ যা প্রতি পাঠের সঙ্গে আরো ভালো ঠেকে। আমি নিজেই এটি অন্তত চার কিংবা পাঁচবার পড়েছি।
ছোটবেলায় পিটার্স ফ্রান্স এর ফুন্তানব্লু শহরে অবস্থিত গুর্ডজিয়েফ ইন্সটিট্যুট ফর দ্য হারমোনিয়াস ডেভেলপমেন্ট অফ ম্যান এ বেশ কয়েক বছর কাটিয়েছিল। ধারণা করা যায় যে গুরু তাকে তাঁর পাখার তলায় নিয়ে কিছুদিনের জন্য তাকে ব্যক্তিগত দীক্ষা দিয়েছিলেন।
একদিন এমনি শিক্ষাদান পর্বে গুর্ডজিয়েফ তাকে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে সে কী দেখতে পাচ্ছে জানতে চান।
“একটা ওক গাছ” সে বলে।
” হ্যাঁ, একটা ওক গাছ। তা ওক গাছের ওপর কী দেখতে পাচ্ছো তুমি?” শিক্ষক জিজ্ঞাসা করেন।
“গোটা”, পিটার্স বলে।
“কয়টা গোটা?” গুর্ডজিয়েফ জানতে চান।
ছেলেটা অনেকক্ষণ ধরে আন্দাজ করে দ্বিধাভরে বলে “কয়েক হাজার?”
গুরু জানতে চান “এই গোটাগুলো থেকে কয়টা গাছ হবে বলে তুমি মনে করো?”
ফ্রিট্জ পিটার্স উত্তর হাতড়ে বেড়ায়, তারপর বলে “হয়ত পাঁচ-ছয়টা।”
“না” গুর্ডজিয়েফ ধমকে বলেন “মাত্র একটা গাছ হলেও হতে পারে, হয়তবা একটাও নয়।”
তারপর তিনি ব্যাখ্যা দিতে শুরু করেন যা খুবই চমৎকার। তিনি ছেলেটিকে বলেন “প্রকৃতি হাজার হাজার বীজগোটা তৈরি করে কিন্তু সেগুলো থেকে একটা আস্ত গাছ হবার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। মানুষের বেলাতেও এটা সত্য। মানুষেরা জন্মায় ঠিকই কিন্তু খুব অল্প সংখ্যকই বড় হয়, বাকিরা স্রেফ সার! প্রকৃতি এই সারের ওপর নির্ভর করে মানুষ ও গাছ তৈরির জন্য। হাজার হাজার বীজগোটার মত মানুষও মাটিতে মিশে যায়, অপর মানুষ ও গাছেদের বেড়ে ওঠার সম্ভাবনা সৃষ্টির জন্য। প্রকৃতি সবসময়ই খুব দয়ালু” তিনি ব্যাখ্যা করেন “কিন্তু তা শুধু সম্ভাবনার জন্ম দেয়। প্রকৃত গাছ কিংবা মানুষ হবার জন্য কঠোর পরিশ্রম ও প্রবল প্রচেষ্টার প্রয়োজন পড়ে।”
এরকম আরো অসংখ্য মজাদার গল্প রয়েছে বইটায়, কিন্তু আমি সেসব বলে দিয়ে বইয়ের মজাটা নষ্ট করে দিতে চাই না, আপনাদের এটা অবশ্যই পড়তে হবে। আমি এই ছোট্ট রত্নটিকে আমার আমার পছন্দের সেরা দশটি বইয়ের মধ্যে রাখবো।

লেখক, অনুবাদক, সংস্কৃতিকর্মী
