[হেনরি মিলারের ‘ভাবনাগুচ্ছ’ : ১, হেনরি মিলারের ‘ভাবনাগুচ্ছ’ : ২, হেনরি মিলারের ‘ভাবনাগুচ্ছ’ : ৩, হেনরি মিলারের ‘ভাবনাগুচ্ছ’ : ৪]
বন্ধুত্ব
বন্ধুদের প্রতি আমার মনোভাবের যে দিকটার ওপর আমার জোর দেয়া উচিৎ সেটা হচ্ছে দ্বৈততা। ভালো বন্ধু হবার জন্য আমার প্রশংসা জুটলেও, ক্ষেত্রবিশেষে আমি প্রচণ্ড অবিশ্বস্তও হতে পারি। আমি তাদের পেছনে কথা বলি, তাদের সমালোচনা করি এবং তাদের দোষ ও দুর্বলতা নিয়ে ঠাট্টা মশকরা করি। বস্তুত যে জিনিসটা আমি সবার আগে খেয়াল করি সেটা তাদের খুঁতসমূহ। অদ্ভুত শোনালেও সত্য যে, তাদের খুঁতগুলিই আমাকে তাদের প্রতি আকৃষ্ট করে। আমি দুর্বিনীত ও বদমাশ স্বভাবের লোকদের বেশি পছন্দ করি কেননা আমার স্বভাবচরিত্রও যে তাদেরই মত!
আমি সেই মানুষগুলোকে সহ্য করতে পারি না যারা আমার ব্যাপারে বেশি উদ্বিগ্ন, যারা সরাক্ষণই আমার শরীর-স্বাস্থ্যের খবর নিতে থাকে। অথবা যারা আমাকে এজাতীয় প্রশ্নে বিরক্ত করে যে, "হেনরি তুমি আমার সঙ্গে দেখা করো না আজকাল, তুমি কি আমাকে আর পছন্দ করো না, আমি কি তোমাকে কষ্ট দিয়েছি কোনভাবে ?" আমাকে তাদের কাছ থেকে চিরতরে দূরে সরিয়ে দেওয়ার জন্য এটাই যথেষ্ট। একজন প্রকৃত বন্ধুর এজাতীয় প্রশ্ন করার দরকার পড়ে না। তোমার প্রয়োজনের মুহূর্তে সে ঠিকই তোমার পাশে থাকে আবার একইসঙ্গে নিজেকে কীভাবে সম্মানজনক দূরত্বে রাখতে হয় তা-ও তার অজানা নয়। একজন খাঁটি বন্ধু ঠিক সেই মুহূর্তটি থেকে শুরু করতে পারে যখন তোমার সঙ্গে তার শেষ দেখা হয়েছিল, তা সেটা এক সপ্তাহ, এক মাস কী কুড়ি বছরই হোক না কেন!
আমার এমন একজন বন্ধুও ছিল না আমি যার কাছ থেকে ভিক্ষা কিংবা ধার নিই নি, আমি এমনকি চুরিও করেছি তাদের কাছ থেকে। একবার আমি আমার ভালো বন্ধু আলফ্রেড পের্লে সম্পর্কে একটা প্যাম্ফলেট লিখি যার নাম দিই 'আলফ্রেড সম্পর্কে তুমি কী করতে যাচ্ছো?' আমি তাকে ইবজা পাঠানোর জন্য তহবিল সংগ্রহ করছিলাম, যেখানে গিয়ে তার ধারণা সে সস্তায় জীবনযাপন করতে পারবে এবং যে বইটা লিখছিল সেটা সহজে শেষ করতে পারবে। এই প্যাম্ফলেটখানি অসংখ্য লেখক ও শিল্পীর কাছে পাঠানো হয়েছিল যাদের অনেককেই আমরা চোখেও দেখি নি কোন দিন। যাঁরা টাকাসহযোগে আমাদের চিঠির উত্তর দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন আঁদ্রে জিদ ও আল্ডাস হাক্সলি, আপনারা কল্পনা করতে পারেন আমি সেই টাকা আমার নিজের কাজে খরচ করে ফেলেছিলাম। আল্ফ যখন জানতে চাইল তার জন্য কোন টাকাপয়সা যোগাড় হয়েছে কিনা তখন আমি খোলাখোলি স্বীকার করি যে তার টাকা আমি ঘরভাড়া, খাদ্য ইত্যাদির পেছনে খরচ করে ফেলেছি। সে মোটেও রাগ করে নি। সে জানতো যে সে-ও আমার অবস্থায় থাকলে ঠিক একই কাজ করতো। আমি এটাকেই বলি বন্ধুত্ব।
আমি বন্ধৃদের কাছ থেকে সবসময় শুধু নিই নি। যদি কেউ, এমনকি কোন অচেনা ব্যক্তি, যদি তাকে আমার ভালো লাগে, কোন সাহায্য চাইতো তাহলে আমার কাছে টাকা না থাকলেও আমি ধার করে হলেও তাকে সাহায্য করতাম। ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নে কাজ করাকালীন আমি পকেট শূন্য করে মানুষকে সাহায্য করতাম তা সেটা আমার সাধ্যের মধ্যে থাকুক আর নাই থাকুক। আমার এই বেহিসেবি বদান্যতার জন্য আমার স্ত্রী ও সন্তানেরা বেশ কষ্ট পেয়েছে।
আমি সবকিছুর জন্য বন্ধুদের কাছে ঋণী। যে মুহূর্তে আমি ভূত ছেড়ে দিতে উদ্যত হতাম অর্থাৎ আমার মরণাপন্ন মুহূর্তে কেউ না কেউ এসে আমার হাত ধরতো, আমি যাদের বলি অভিভাবক দেবদূত। আমি বিশ্বাস করি তাদের সাহায্য ও সহযোগিতা না পেলে আমি মারাই যেতাম।
যে জিনিসটা আমাকে বেশি পীড়িত করে সেটা হচ্ছে আমার ছেলেবেলার বন্ধুদের কাছ থেকে আমি একটা বাক্যও শুনি নি, কোন স্বীকৃতিও পাই নি। আমি নিশ্চিতভাবে ভেবেছিলাম আমি বিখ্যাত হবার পর আমি তাদের কারো কারো কাছ থেকে চিঠি কিংবা ফোন পাবো। যেন তারা বিশ্বাসই করতে পারে নি যে আমি লেখক হব বা এরকম কিছু একটা আমার মধ্যে ছিল। আমি জানি না কেন এটা আমাকে পীড়িত করে, কিন্তু করে যে সেটা সত্য।
বুঝদার হবার পর আমি উপলব্ধি করি যে আমার খুব বেশি বন্ধুর প্রয়োজন নেই, আমি একা থাকতে পছন্দ করি, আমি আমার একাকিত্বকে উপভোগ করি। আমি দীর্ঘ পথ একা একা হাঁটতে পারতাম, দিনের পর দিন নিজের মধ্যে ডুবে থাকতে পারতাম, তখন বরং কেউ একজন এসে হাজির হলে আমার আনন্দটাই মাটি হত।
বন্ধুত্ব নিজেই একটি পৃথিবী। বন্ধুতা ছাড়া জীবনের কোন মানেই থাকতো না, তা হত অর্থহীন, মৃত। তবে বন্ধুত্ব নিজেকে অভিশাপ ও আশীর্বাদ, দুভাবেই প্রতিষ্ঠা করেছে।
. . .
আমার ভাগ্যতারা
এক রাতে প্যারিসে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরুনোর সময় আমি আকাশের দিকে চেয়ে একটা উজ্জ্বল বহুবর্ণ তারা দেখতে পাই। কেউ একজন বলেছিল ওটা বৃহস্পতি, আমি জানতাম সেটা সত্য কেন না আমার জ্যোতিষ বন্ধু মরিকান্ড আমাকে এটা দেখার কথা মনে করিয়ে দিয়েছিল।
বাড়ি ফেরার পর আমি মই বেয়ে ছাদে উঠে আকাশের দিকে অনেকক্ষণ ধরে চেয়ে থাকি। আমার মনে হয় দুয়েক ফোঁটা চোখের জলও ফেলে থাকতে পারি আমার ভাগ্যতারা, সেই রত্নসদৃশ গ্রহটির সঙ্গে সহবাস করার আনন্দে। কী সুখী আর উল্লসিত আর উচ্ছ্বসিত আর আচ্ছন্নের মতই না লাগছিল।
মই বেয়ে নামার সময় আমি পা পিছলে একটা খোলা কাচের দরজার ওপর আছড়ে পড়ি। কাচের টুকরা চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। আমি কাপড় খুলে স্নানঘরে ঢুকি, জল সরার নালার দিকে তাকিয়ে দেখি রক্তে পানি লাল হয়ে আছে। আমার শরীর থেকে তখনও রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। আমার সারা শরীরে, এমনকি পাছার মধ্যেও কাচের টুকরো গেঁথে ছিল।
আমি বিছানায় যাই কাল সকালে হাসপাতালে যাবার কথা ভাবতে ভাবতে। ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে আমি জেগে উঠি এবং বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে থাকি। আমি বাতি জ্বালিয়ে দেখতে পাই বিছানার চাদর রক্তে ভিজে সপসপে হয়ে আছে। আমি আমার প্রতিবেশীকে ডেকে তুলি যে আমাকে নিউইর আমেরিকান হাসপাতালে নিয়ে গেলে তারা আমাকে ব্যান্ডেজে মুড়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়।
ট্যাক্সি করে বাড়ি ফেরার পথে আমার প্রতিবেশী বলে “আমার খুব খিদে পেয়েছে, চলো কোন ক্যাফেতে নেমে কিছু একটা খেয়ে নিই।”
আমরা তখন ঠিক সাঁজেলিজের ওপরেই ছিলাম, আমি ভাবি, কেন নয়, যেহেতু আমরা ক্যাফেপাড়াতেই আছি। আমি ট্যাক্সি থেকে নামি, আমার পরনে তখন স্নানের পোশাক, পায়ে চপ্পল, সেভাবেই আমরা ক্যাফেতে ঢুকি কফি ও ক্রয়সাঁ খাওয়ার জন্য। একমাত্র প্যারিসেই আপনারা এমন কিছু একটা করে পার পেয়ে যেতে পারেন।
বাড়ি ফিরে আমি সম্ভবত টানা আটচল্লিশ ঘন্টা ঘুমিয়েছিলাম। তারপর মরিকান্ড এসে তার গ্রহনক্ষত্রের মানচিত্র দেখিয়ে আমাকে বোঝাল আমি মৃত্যুর কত কাছ থেকে ফিরে এসেছি।
বৃহস্পতি ছাড়া মানচিত্রের প্রতিটি গ্রহকেই খুব বাজেভাবে দেখানো হয়েছে। বৃহস্পতি, আমার ভাগ্যতারা, তুমি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছো।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
২ comments
kamruzzaman Jahangir - ১২ মে ২০১০ (১১:০১ অপরাহ্ণ)
বন্ধুত্ব বিষয়ে তার সহজাত স্মৃতিচারণা বেশ ভালো লাগল। জীবনকে গোছানোর জন্যও এইসব কথন অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে। আলম খোরশেদকে ধন্যবাদ।
স্বরূপ সুপান্থ - ১৩ মে ২০১০ (১২:৫৪ পূর্বাহ্ণ)
ভাল লাগল।
এত ভাল লাগছে যে মাঝে মাঝে মনে হ্য় অনুবাদগুলা এত ছোট ছোট খন্ডে কেন প্রকাশিত হচ্ছে———–
আলম ভাইকে ধন্যবাদ,আগ্রহী চোখ সবসময় জারি থাকবে।