[হেনরি মিলারের ‘ভাবনাগুচ্ছ’ : ১, হেনরি মিলারের ‘ভাবনাগুচ্ছ’ : ২, হেনরি মিলারের ‘ভাবনাগুচ্ছ’ : ৩]
কাউবয় দিনগুলো
আমি পশ্চিমের পথে বেরিয়ে পড়েছিলাম, কেননা আমার ঝোঁক ছিল কাউবয় তথা একজন বহিরঙ্গনের মানুষ হওয়ার দিকে। আরেকটা ব্যাপার, আমার দৃষ্টিশক্তি খারাপ ছিল, আমি ভেবেছিলাম খোলা আকাশের নীচে কাজ করার ফলে সেটারও উন্নতি ঘটবে।
আমি সান দিয়েগোর ঠিক লাগোয়া একটা খামারে কাজ পাই। আমার কাজ ছিল লেবু গাছ থেকে ছেঁটে ফেলা ডালপালার বিশাল স্তূপকে আগুনে পোড়ানো। আমি গাধায়-টানা একটা গাড়ি চালাতাম আর একটা বিশাল হাতা দিয়ে কাঠকয়লা উল্টেপাল্টে সারাদিন আগুন জ্বালিয়ে রাখতাম। আমার ভুরু জ্বলে গিয়েছিল, আমার ঠোঁট ফেটে গিয়েছিল আর হাতদুটো কঠিন হয়ে এমন জোড়া লেগে গিয়েছিল যে প্রত্যেকদিন সকালে সেগুলোকে টেনে খুলতে হতো।
সেখানকার অন্যান্য মানুষগুলোর তুলনায় আমি নেহাতই একজন মেয়েলি স্বভাবের শহুরে বালক ছিলাম। কিন্তু তারা সবাই আমার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতো। তারা হয়ত একদল সঙ্কীর্ণমনা মানুষই ছিল, কিন্তু আমাকে পছন্দ করতো। আমি তাদেরকে ঘন্টার পর ঘন্টা ন্যুয়র্কের গল্প করে আমোদিত করে রাখতাম। ন্যুয়র্কের পাতালরেল, গগনচুম্বী অট্টালিকা আর নারীদের বিষয়ে আমার অতিরঞ্জনগুলো তাদেরকে বিস্ময়বোধে ভরে তুলতো। তারা আমার ডাকনাম দেয় ইয়র্কি আর আমার সঙ্গে খুবই ভালো আচরণ করতো। সেখানে থাকাকালীনই প্রথম নীৎশের সঙ্গে পরিচয় ঘটে আমার। আর তার জন্য দায়ী ছিলেন এমা গোল্ডম্যান।
এক কাউবয়, বিল পার নাম, কোন এক শনিবার রাতে আমার কাছে এসে বলে, “ইয়র্কি, আমি দারুণ এক বেশ্যালয়ের খবর পেয়েছি। চলো আমরা সান দিয়েগো যাই।” কথামতো আমরা ট্রলি করে রওনা দিলাম। সেখানে পৌঁছানোর পর একটা বড় পোস্টার চোখে পড়লো যাতে লেখা: আজ রাতে এমা গোল্ডম্যান নীৎশে, স্ট্রিন্ডবার্গ, ইবসেন ও শ-এর ওপর বক্তৃতা করবেন। এটা দেখামাত্র আমি তাকে বললাম যে আমি তার সঙ্গে যেতে পারবো না। আমাকে এমা গোল্ডম্যানএর বক্তৃতা শুনতে হবে।
এমার চমৎকার বক্তৃতার পর বিল রাইটম্যান নামে তার একজন সহযোগী মিলনায়তনের বাইরে বই বিক্রি আরম্ভ করে। আমি তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করি নীৎশের অ্যান্টিক্রাইস্ট বইখানা আছে কিনা। একথা শোনামাত্র সে আমাকে জেরা করা শুরু করলো।
“তোমার বয়স কত? এর আগে নীৎশের কোন বই পড়েছো?” এই জাতীয় প্রশ্ন। আমি তাকে যথাযথ উত্তর দেওয়ার পর সে আমাকে বইটি কিনতে দিল।
আপনারা জানেন, তাদের ওপর কর্তৃপক্ষের সুনজর ছিল না, তাই তাদেরকে সতর্ক থাকতে হত যেন তারা তাদের বইপত্র ভুল লোকের হাতে না তুলে দেয়।
তার কিছুদিন পরই একদল প্রতিক্রিয়াশীল মাস্তান তাকে তুলে নিয়ে গায়ে আলকাতরা মেখে, বেদম পিটিয়ে মরুভূমিতে ফেলে আসে।
আমাকে বলতেই হবে যে সে রাতটা ছিল আমার জীবনের একটা মোড়ফেরানো মুহূর্ত। যে মুহূর্তে এমা গোল্ডম্যান বলতে শুরু করেন আমি বুঝতে পারি আমি একজন বুদ্ধিজীবী, কাউবয় নই, আর সেইসঙ্গে যে কথাটা আমার মাথায় আসে সেটা হচ্ছে আমি এখান থেকে কী করে বেরুবো? আমি তাদেরকে কী বলবো?”
আমি সবসময়ই ছিলাম গল্পবাজ, অতিরঞ্জনস্বভাবী, সোজা কথায় বানিয়ে বলায় ওস্তাদ। আমাকে একটা বিশ্বাসযোগ্য গল্প বানিয়ে বলতে হবে যেন তারা মনে না করে যে আমি এখানকার কাজের চাপ সহ্য করতে না পেরে পালিয়ে যাচ্ছি।
আমি ন্যুয়র্কস্থ আমার এক বান্ধবীকে চিঠি লিখে বলি আমাকে টেলিগ্রাম করে একটা জরুরি বার্তা পাঠাতে। “তোমার যেটা খুশি বানিয়ে লিখে দাও। আমাকে এখান থেকে বেরুতেই হবে।”
কদিন বাদে টেলিগ্রাম আসে: “মা খুব অসুস্থ। পত্রপাঠ বাড়ি আসো।” কালবিলম্ব না করে আমি বাক্সপ্যাঁটরা গুছিয়ে কাউবয় জীবনকে বিদায় জানিয়ে বাড়ির পথ ধরি।
আমি যখন ট্রেনে উঠি আমি তখন একজন পরিবর্তিত মানুষ। জীবনে প্রথমবারের মত আমি বুঝতে পারি আমি ঠিক কী। আর এমা গোল্ডম্যান-এর কল্যাণে যা হতে পারতো পিঠ-বেঁকে-যাওয়া, পুরস্কারবিহীন এক জীবন তার হাত থেকে মুক্তি পাই। আমি একজন কাউবয়? সেটা হতো বিশাল এক প্রতিভার অপচয়, একথা আমি নিজেই নিজেকে বলি।
এমা গোল্ডম্যান
তাঁর জন্য শুধু প্রশংসাই ছিল আমার। আহ্, শ্রমজীবী মানুষদের পক্ষ থেকে দেয়া তাঁর সেইসব বক্তৃতা! তিনি আপনার গায়ে আগুন ধরিয়ে দিতে পারতেন, আপনাকে উত্তেজিত করে দাঙ্গা বাঁধাতে, বাড়িঘর পুড়িয়ে দিতে এমন কী দরকার হলে মানুষ খুন করাতেও পারতেন!
একদিন গোল্ডম্যান ও আলেক্সান্ডার বার্কম্যান (তিনি সম্ভবত তাঁর প্রেমিক ছিলেন) বিশাল ইস্পাত কারখানার মালিক, ধনকুবের শিল্পপতি ফ্রিককে খুন করার সিদ্ধান্ত নেন। তাঁরা খুনাখুনির কাজটা এর আগে কখনো করেন নি, তাই ভাবছিলেন কী দিয়ে তাকে খুন করবেন, পিস্তল, ছুরি, বোমা নাকি অন্যকিছু দিয়ে! তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন পিস্তলই হবে একাজের জন্য দ্রুততম ও নিশ্চিততম মাধ্যম, কিন্তু সমস্যা হলো পিস্তল কেনার মত পয়সাই ছিল না তাঁদের।
গোল্ডম্যান তখন ঠিক করলেন শরীর বেচেই তিনি এর জন্য টাকা যোগাড় করবেন। মহৎ কাজের জন্য সবকিছুই জায়েজ, তাই না! তিনি বিতিকিচ্ছিরিভাবে নিজেকে সাজিয়ে তোলেন। চড়া প্রসাধনীতে তাঁকে কিম্ভূতকিমাকার দেখায়। এইসব বিষয়ে তাঁর কোন জ্ঞানগম্যিই ছিল না কিনা! তিনি রাস্তায় দাঁড়িয়ে খদ্দেরের অপেক্ষা করেন যদিও তাঁর ধারণা ছিল না তাঁকে কী বিচ্ছিরি আর ভয়ঙ্করই না দেখাচ্ছিল তখন!
প্রথম যে পুরুষটি তাঁর কাছে আসে সে ছিল সুবেশধারী এবং তাকে শিক্ষিত বলেই মনে হচ্ছিল। সে তাকে কাছের একটি রেস্তোঁরায় খেতে আমন্ত্রণ জানায় এবং নানারকম প্রশ্ন করতে থাকে।
“তোমাকে দেখে তো পেশাদারদের মত মনে হচ্ছে না! তুমি এমন বাজেভাবে পোশাক পরে এখানে কী করতে এসেছ? তোমাকে খুবই জঘন্য দেখাচ্ছে!” গোল্ডম্যান তাকে সবকিছু খুলে বলে, তাঁর কাজ, তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাস এমনকি খুনের পরিকল্পনার কথাও।
লোকটি তাঁর কথাবার্তা শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়, তাঁর সঙ্গে শোয়ার বাসনা তার উবে যায়। সে তাঁকে শুধু ভালো একটা ভোজনেই আপ্যায়ন করে না, বিদায় নেবার সময় তাঁর হাতে মোটা অংকের টাকাও তুলে দিয়ে যায়। তাঁরা পরস্পরকে আর কোনদিনই দেখে নি।
পরে সেই টাকা দিয়ে তাঁর দোসর বার্কম্যান পিস্তল যোগাড় করে ফ্রিককে লক্ষ্য করে গুলিও ছোড়ে কিন্তু তাতে ফ্রিক মারা যায় না, কেবল সামান্য আহত হয়। আর দেহপসারিণীরূপে গোল্ডম্যানের স্বল্পস্থায়ী পেশার কল্যাণে বার্কম্যান এর কুড়ি বছর কারাবাস হয়ে যায়।
বলাই বাহুল্য, তাঁর সান্নিধ্যে যাঁরাই এসেছেন তিনি তাঁদের সবার মনেই প্রবল রেখাপাত করেছেন। তিনি একজন ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব ছিলেন, চমৎকার এক নারী যিনি আমার জীবনেও বিশাল ভূমিকা রেখেছেন।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
৬ comments
মুয়িন পার্ভেজ - ২৯ এপ্রিল ২০১০ (৪:৩৬ অপরাহ্ণ)
‘ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব’ এমা গোল্ডম্যান সম্পর্কে আরও জানার কৌতূহল বেড়ে গেল, বিশেষত হেনরি মিলারের জীবনে এমার ‘বিশাল ভূমিকা’র কথা। উইকিপিডিয়া-র পাতায় বেশ কিছু তথ্য পাওয়া যায়, তবে এখানে আলেক্সান্ডার বার্কম্যানের সাজার মেয়াদ বলা হয়েছে ‘বাইশ বছর’ — ‘কুড়ি বছর’ নয়। সাবলীল অনুবাদের জন্য আলম খোরশেদকে আবারও ধন্যবাদ।
Alam Khorshed - ৩ মে ২০১০ (৫:৫১ অপরাহ্ণ)
মুয়িন পার্ভেজকে অসংখ্য ধন্যবাদ আমার এই যৎসামান্য অনুবাদকর্মটির প্রতি আগ্রহ দেখানর জন্য। সেই সঙ্গে আরেকপ্রস্থ ধন্যবাদ তার প্রাপ্য, সম্পূরক তথ্য ও সংযোগিকাগুলোর বাবদে। ’কুড়ি-বাইশ’ বিসম্বাদ প্রসঙ্গে এই লেখাটি যে পুরোপুরিই স্মৃতি ও শ্রুতিনির্ভর, এটুকু বলাই নিশ্চয় যথেষ্ট।
kamruzzaman Jahangir - ২৯ এপ্রিল ২০১০ (৬:৩২ অপরাহ্ণ)
সকালেই এর সম্পর্কে অনুভূতি জানাতে চেয়েছিলাম, তখন অবশ্য এমা গোল্ডম্যান ছবিসহ ছিলেন না। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেই হয়। আলম খোরশেদ বোধ করি এ ব্যাপারে হেল্প করবেন না। অন্য কেউ যদি এ কাজটি করেন, তবে অবশ্যই কৃতজ্ঞ থাকব। মুয়িন পার্ভেজকেও শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।
Alam Khorshed - ৩ মে ২০১০ (৬:২২ অপরাহ্ণ)
কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর, আপনি আমার প্রতিটি লেখা পড়েন ও মন্তব্য করেন এটি আমার বিরল সৌভাগ্য। তবে এমা গোল্ডম্যান-কে শ্রদ্ধা জানানর ব্যাপারে আমি আপনাকে কীভাবে হেল্প করতে পারি সেটা ঠিক বোধগম্য হলোনা। সে যাক, আপনাকে অজস্র ধন্যবাদ।
kamruzzaman Jahangir - ৪ মে ২০১০ (১০:৫৪ অপরাহ্ণ)
আসলে আমি এমা গোল্ডম্যান সম্পর্কে বিস্তৃতভাবে জানতে চাই, ওই ব্যাপারেই পাঠকের হেল্প চেয়েছিলাম। এ ব্যাপারে অগ্রিম-নিরাশ হওয়ার কারণ হচ্ছে, আমি বরাবরই খেয়াল করছি, আপনি প্রত্যুত্তরের ব্যাপারটাকে যেন অত গুরুত্ব দিচ্ছেন না।
নিরাভরণ - ১০ মে ২০১০ (৯:৪৭ অপরাহ্ণ)
হেনরি মিলারের জীবনে যেমন এমা গোল্ডম্যান তেমনি অনেকের জীবনেই হয়ত জীবনের বাঁক ঘুরিয়ে দেয়া কোন ব্যক্তি বা ঘটনা থাকে। হেনরির পরিবর্তনটা অবশ্য বেশ আকস্মিক মনে হল। গোল্ডম্যানের আত্মজীবনি এই পেজে পাওয়া যাবে। তার সম্পর্কে সামান্য ঘেটে কেবল জানতে পারলাম তিনি একজন এনার্কিস্ট (নৈরাজ্যবাদি?) ছিলেন। অর্থাৎ রাষ্ট্রের প্রয়োজন নেই এমনটা বিশ্বাস করতেন। স্বভাবতই তার প্রতি সরকারের ক্ষোভের ব্যপারটা বোধগম্য হবার কথা। তাকে একসময় আমেরিকা থেকে বের করেও দেয়া হয়েছিল। তার জীবনি খুবই ঘটনাবহুল বলেই মনে হয়। ‘ভাবনা গুচ্ছ’ ভাল লাগছে।