হেনরি মিলারের ‘ভাবনাগুচ্ছ’ : ৩

আমি খুব ছোটবেলাতেই, বয়স হয়ত তখন কয়েক বছর মাত্র, জেনেছি পৃথিবীটা খুবই জঘন্য জায়গা। [...]

[হেনরি মিলারের ‘ভাবনাগুচ্ছ’ : ১, হেনরি মিলারের ‘ভাবনাগুচ্ছ’ : ২]

আমার মা

আমি খুব ছোটবেলাতেই, বয়স হয়ত তখন কয়েক বছর মাত্র, জেনেছি পৃথিবীটা খুবই জঘন্য জায়গা। আমার বাবা-মার ধরনধারনকে আমার খুবই নির্বোধের মত মনে হত। তাঁদের তাস খেলা, তাঁদের ডিনার পার্টিসমূহ, হাবভাব- যা কিছু তাঁরা করতেন, যা কিছু তাঁরা বিশ্বাস করতেন সবই আমার কাছে ছিল নিদারুণ ঘৃণার বিষয়। তাঁরা ছিলেন নীরস, অনাকর্ষণীয় মানুষ। একথাগুলো বলতে গিয়ে আমি দুঃখ পাচ্ছি কিন্তু এগুলো সত্য। শিশু হিসাবে আমি ছিলাম খুবই কৌতূহলী স্বভাবের, সবসময়ই প্রশ্নরত, সবসময়ই জানার জন্য উদগ্রীব, কিন্তু সে ব্যাপারে তাঁদের কোন আগ্রহই ছিল না। নিজের জ্ঞানতৃষ্ণার নমুনা হিসাবে আমার এই ছবিটাই কেবল মনে আসে যে মায়ের জরায়ু থেকে লাফ দিয়ে নেমেই সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আমি দরজা পেরিয়ে এক দৌড়ে গিয়ে হাজির হয়েছি লাইব্রেরিতে!

আমার মা ছিলেন একটি প্রথম শ্রেণীর কুক্কুরী, যিনি আমার বোনকে পিটিয়ে অজ্ঞান করে দিয়েছিলেন তাঁকে বিব্রত করার অপরাধে, আমার গোবেচারা প্রতিবন্ধী বোনটি! একেবারে শিশুকাল থেকেই আমি বুঝেছিলাম আমাকে একজন দানব ও নির্বোধ মা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। আপনারা এমন একজন ব্যক্তির কথা কল্পনা করতে পারেন যে তার প্রতিবন্ধী মেয়েকে পিটিয়ে তার মাথায় কিছু বুদ্ধি ঢোকাতে চাইতে পারে? এটা পুরোপুরি হাস্যকর। আমার মাকে সারাজীবন ঘেন্না করার পেছনে এটা অন্যতম একটা কারণ ছিল।

কয়েক বছর আগে দেখা একটি স্বপ্ন নিয়ে আমি ছোট্ট একটা লেখা লিখেছিলাম। স্বপ্নে দেখি আমি মারা গেছি এবং ডেভাচান গিয়েছি। হঠাৎ আমার মা হাজির হন এবং তিনি আমার স্মৃতিতে তাঁর যে রূপ ছিল তা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তাঁকে খুবই চমৎকার, উজ্জ্বল, সংবেদনশীল এমনকি বুদ্ধিমতী দেখাচ্ছিল। সেই লেখাটি লেখার পর তাঁর সম্পর্কে আমার মনোভাব কিছুটা নরম হয়। আমি আমার পছন্দমত একটা আদল গড়ে নিই তাঁর, যাঁকে আমি বুঝতে পারি, এমনকি যাঁকে ভালোবাসতে পারি। আমার মনে হয় আমার মা যদি সেই স্বপ্নে দেখা মায়ের মতই হতেন তাহলে হয়ত আমি কোনদিন লেখক হতে পারতাম না। আমি হয়ত আমার বাবার মত দর্জি হতাম। আমি হয়ত তিনি যেমনটা চাইতেন ঠিক সেরকম সমাজের একটি উন্নত স্তম্ভ হয়ে উঠতাম।

কিন্তু তিনি আমাকে উৎসাহ দেবার পরিবর্তে সবসময় তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতেন। আমি যত চেষ্টাই করি না কেন সেটা তাঁর কাছে যথেষ্ট ছিল না। তিনি আমাকে ভৎর্সনা করে, লজ্জা দিয়ে শ্রদ্ধেয় করে তুলতে চাইতেন। তিনি তাঁর ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে হয়ত ভেবেছিলেন যে ঠিক কাজটিই করছেন। কিন্তু যেটা তিনি বুঝতে পারেন নি সেটা হচ্ছে তিনি একজন অস্থির ও অত্যন্ত রাগী মানুষকে তৈরি করে তুলছিলেন।

অবশেষে যখন এতকাল মনে পুষে রাখা কথাগুলো লেখার সাহস হলো আমার, তখন সেগুলো একটা দীর্ঘ, অবিরাম কটূক্তিধারার মত বেরিয়ে এলো। আমার মায়ের একেবারে প্রথম স্মৃতি থেকে শুরু করে আমি এতটা ঘৃণা, এতটা ক্রোধ জমা করে রেখেছিলাম যে তা দিয়ে একশ’টি বই লেখা যেতে পারে।

আলম খোরশেদ

লেখক, অনুবাদক, সংস্কৃতিকর্মী

২ comments

  1. kamruzzaman Jahangir - ২১ এপ্রিল ২০১০ (৬:১৫ পূর্বাহ্ণ)

    ওরে বাবা, মায়ের উপর এত রাগ/অভিমান কারও থাকে!

  2. kheyalimon - ২১ এপ্রিল ২০১০ (৯:৫১ পূর্বাহ্ণ)

    মায়ের উপর রাগের বা অভীমানের মাত্রা দেখে কেন যেন মনে হয় উনি আপনার আপন মা ছিলেন না । আচ্ছা মায়ের কি প্রকারভেদ হয় ?

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.