[হেনরি মিলারের ‘ভাবনাগুচ্ছ’ : ১]
আমার বাবা
ন্যুয়কের্র ফিফ্থ্ অ্যাভিন্যুর গা ঘেঁষে একটি বেশ উঁচুমানের দর্জির দোকানের মালিক ছিলেন আমার বাবা। আমার মায়ের ইচ্ছেতে বাবার ওপর গোয়েন্দাগিরি করাই আমার সেই দোকানে কাজ করতে যাবার অন্যতম কারণ ছিল। আমার বাবা ছিলেন ভয়ংকর মদ্যপায়ী, যাকে বলে একেবারে অ্যালকহলিক। আমার বাবা যখন মদের আসরে যেতেন তখন আমাকেও তঁর সঙ্গে যেতে হত কেননা তিনি এতটা মাতাল হয়ে যেতেন যে বাড়ি ফেরার পথ চিনতে পারতেন না। দর্জির দোকানটা ছিল একটা ক্লাবঘরের মত যেখানে ব্যবসার কাজে কাপড়বিক্রেতারা আসতেন এবং কাজশেষে আমার বাবাকে মদ খাওয়াতে নিয়ে যেতেন।
একদিন আমি ও বাবা যখন ব্রডওয়ের একটা ভদ্রস্থ পানশালায় যাই তখন এক খচ্চর গোছের ফরাসি বেয়ারা আমার বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলে “তুই একটি আস্ত মাতাল বদমাশ ছাড়া আর কিছু না।” সে এমন ভঙ্গিতে কথাটা বলে যে আমার ঘাড়ের লোম খাড়া হয়ে যায়। আমি তাকে ধাক্কা দিয়ে মেঝেতে ফেলে দিয়ে তার গলা চেপে ধরি। আমি চাইছিলাম সে যা বলেছে সেটা যেন ফিরিয়ে নেয়। পানশালার লোকজন আমাকে টেনে সরিয়ে দেয় কেননা ততক্ষণে তার চোখ বেরিয়ে আসছিল প্রায়। আমি খুবই অপমানিত বোধ করছিলাম কেননা সে যা বলেছে সেটা আদতে সত্য। কিন্তু আমি এটা মানতে প্রস্তুত ছিলাম না যে আমার বাবা একজন মদ্যপ।
এর পাশাপাশি, বইয়ের প্রতি, বিদ্যার প্রতি তাঁর অনাগ্রহও আমাকে খুব পীড়িত করতো। তিনি খবরের কাগজ ছাড়া আর কিছুই পড়েন নি কোনদিন। বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের কোন আকর্ষণ ছিলনা তার কাছে। হয়তবা আমার বাবামার অনাগ্রহের কারণেই আমি সেই জগতের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলাম। এটি আমাকে তাঁদের থেকে আলাদা ও দূরবর্তী করে তুলেছিল। আমি তাঁদের মত হতে চাই নি কেননা একেবারে ছোটবেলা থেকেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে তাঁরা আসলে মূর্খ।
কিন্তু আমার বাবা সবসময়ই আমার সঙ্গে সুন্দর ব্যবহার করেছেন। আমার মায়ের বিপরীতে তিনি ছিলেন দয়ালু ও সহিষ্ণু। তিনি মনের দিক থেকে একজন ভালো মানুষ ছিলেন। আমি কেন জানি সবসময় তাঁর জন্য দুঃখ অনুভব করেছি। আমার মায়ের সঙ্গে বাস করা এত কঠিন ছিল যে আমি জানি না কীভাবে তিনি তাঁর সঙ্গে থাকতে পেরেছিলেন কিংবা কেন তিনি তাকে ছেড়েছুড়ে একেবারে চলে যান নি। আমার মা এমন একজন মানুষ ছিলেন যিনি পৃথিবীর সুস্থতম মানুষটিকেও মদ খাওয়ার দিকে ঠেলে দিতে পারতেন।
এমনকি যখন তিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুশয্যায় তখনও তিনি অভিযোগ করতেন, তাঁকে গালমন্দ করতেন, যেন তিনি ইচ্ছে করেই অসুস্থ হয়ে তাঁর জন্য কাজ বাড়িয়েছেন। এটা ছিল খুব করুণ একটা অবস্থা। হয়ত এর ফলেই আমি ও আমার বাবা কাছাকাছি আসতে পেরেছিলাম। আমি যখন তাঁর পাশে গিয়ে বসতাম তখন তিনি আমাকে দারুণ কিছু গল্প বলেছিলেন। তিনি আমার কাছে তাঁকে মেলে ধরেছিলেন। এবং আমাকে স্বীকার করতেই হবে যে তিনি মারা যাবার পর আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলাম। আমার মায়ের সঙ্গে এক জন্ম কাটানোর পর এটুকু শান্তি ও নীরবতা তিনি অর্জন করেছিলেন অবশ্যই।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
৯ comments
kamruzzaman Jahangir - ১২ এপ্রিল ২০১০ (৯:৪৭ অপরাহ্ণ)
বেশ ভালোই লাগল। এ ভালোলাগা ক্রমাগত হোক।
স্বরূপ সুপান্থ - ১৩ এপ্রিল ২০১০ (১১:৫৯ অপরাহ্ণ)
পড়তে পড়তে হঠাৎ যেন শেষ হয়ে গেল।
ভাল লেগেছে।
ধন্যবাদ আলম ভাই
Alamgeer Haque - ১৭ এপ্রিল ২০১০ (১২:৫৭ পূর্বাহ্ণ)
Khoob bhalo laglo Alam Khorshed anibad kormo Deshey Henry Miller r boi portam tokhon second boi’yer dokan theke
বিনয়ভূষণ ধর - ১৭ এপ্রিল ২০১০ (১২:৩২ অপরাহ্ণ)
যদিও আমার মূল বইটি পড়া হয়নি তারপরও আপনার অসাধারন অনুবাদকর্মের কারণে লেখাটি খুব ভালো লাগছে আলম ভাই। বইটির মূল লেখিকা টুইঙ্কা থিবো’র একখানা ছবি কি আপনার সামনের লেখায় দেয়া যায়?
Alam Khorshed - ৩ মে ২০১০ (৬:৩১ অপরাহ্ণ)
প্রিয় বিনয়, আপনার অনুরোধে বইটির মূল লেখিকা টুইঙ্কা থিবো’র একখানা ছবি বিলম্বে হলেও লেখাটির প্রথম কিস্তির সঙ্গে সংযুক্ত হলো। ধন্যবাদান্তে, প্রীতিমুগ্ধ আলম খোরশেদ
বিনয়ভূষণ ধর - ৯ মে ২০১০ (৮:২৭ অপরাহ্ণ)
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ জানাচ্ছি আলম ভাই বইটির মূল লেখিকা টুইঙ্কা থিবো’র একখানা ছবি আপনার লেখায় সংযোজনের করার জন্যে…
নওশের - ১৭ এপ্রিল ২০১০ (১০:১১ অপরাহ্ণ)
খোরশেদ
অনেকদিন পর তোমার লেখা পড়লাম । বেশ ভালো লাগলো ।তোমাকে নূতন বছরের শুভেচ্ছা ।
Pingback: মুক্তাঙ্গন | হেনরি মিলারের ’ভাবনাগুচ্ছ’ : ৩ | আলম খোরশেদ
Pingback: মুক্তাঙ্গন | হেনরি মিলারের ‘ভাবনাগুচ্ছ’ : ৪ | আলম খোরশেদ