ট্রপিক অভ ক্যান্সার, ট্রপিক অভ ক্যাপ্রিকর্ন, সেক্সাস, প্লেক্সাস, নেক্সাস ইত্যাদি বহুল আলোচিত ও একই সঙ্গে বহুবিতর্কিত গ্রন্থের রচয়িতা হেনরি মিলারের পরিচয় ওয়াকিবহাল পাঠকের কাছে অজ্ঞাত নয়। উপন্যাস, প্রবন্ধ, আত্মজৈবনিক রচনাসহ তাঁর অসংখ্য গ্রন্থের মধ্যে রিফ্লেকশন্স্ বলে একখানি বইও বাজারে চালু আছে তাঁর নামে। যদিও এই বইটি ঠিক তাঁর রচনা নয়। এটি প্রকাশিত হয় তাঁর মৃত্যুর ঠিক এক বছর বাদে ১৯৮১ সালে, ক্যালিফোর্নিয়ার কাপ্রা প্রেস থেকে জনৈকা টুইঙ্কা থিবো কর্তৃক সম্পদিত হয়ে। থিবো লিখিত মুখবন্ধটি থেকে আমরা জানতে পারি যে তিনি মিলারের জীবনের একেবারে অন্তিম পর্বে তাঁর সঙ্গে চার চারটি বছর কাটান একই ছাদের নিচে, তাঁর ভাষায়, মিলারের পাচক ও দেখভালকারী হিসাবে। এই চার বছর মিলারকে খুব কাছে থেকে দেখার সৌভাগ্য হয় তাঁর। তিনি আবিষ্কার করেন মিলার অসাধারণ বাকপটু, সুরসিক ও চৌকস একজন মানুষ, জীবন ও জগৎকে দেখার একেবারে নিজস্ব একটি দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে যার। সেই সঙ্গে রয়েছে তাঁর পর্যবেক্ষণসমূহ প্রকাশের জন্য একটি অননুকরণীয়, বুদ্ধিদীপ্ত ও চিত্তাকর্ষক ভাষাভঙ্গিও।

হেনরি মিলারের সঙ্গে টুইঙ্কা থিবো
প্রতিদিন সন্ধ্যায় মিলারের কাছে আসতেন তার কোন না কোন বন্ধু কিংবা অনুরাগী। এর বাইরে বেশ কজন লেখক শিল্পীও আসতেন নিয়মিত। তাদের সঙ্গে বসে দীর্ঘসময় ধরে পানাহার আর গল্পগুজবে কাটানো সেই বাঙ্ময় সন্ধ্যাগুলোর ঘনিষ্ঠ সাক্ষী থিবো। মিলার তখন তাদের সঙ্গে যে বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলতেন সেগুলো তিনি গভীর মনোযোগ সহকারে শুনতেন এবং পরে তা যথাসম্ভব মিলারীয় ভাষা ও ভঙ্গিতে লিপিবদ্ধ করে রাখতেন। এক পর্যায়ে বেশ কিছু লেখা জমে গেলে তিনি সেগুলো মিলারকে দেখিয়ে চমকে দেন। মিলার সেগুলো পড়ে খুবই খুশি হন এবং থিবোকে বলেন যে এটি তার জন্য অনেক বড় এক প্রাপ্তি। তিনি এমনকি থিবোকে ভাবীকালের কাছে তাঁর শেষ উচ্চারণসমূহ তুলে-ধরা ব্যক্তিগত লিপিকর বলেও আখ্যা দেন। লেখাগুলো তিনি কিছটা ঘষামাজা করে দেন তার স্বভাবসুলভ লিখনশৈলীতে এবং বলেন, `এগুলো সংকলিত হলে একটি ভালো বই হতে পারে’। তো সেই লেখাগুলোকে একত্রিত করেই থিবো তার মৃত্যুর পরের বছর রিফ্লেকশন্স্ নামে প্রকাশ করেন যেখানে তিনি লেখকের নাম হিসাবে মিলারের নামই ব্যবহার করেন এবং নিজেকে এর সম্পাদক হিসাবে উপস্থাপিত করেন। বইটির সুলিখিত ভূমিকায় তিনি মিলারকে তাঁর শিক্ষক, গুরু, পালকপিতা ও বন্ধু বলে সম্বোধন করেন। এই গ্রন্থে সন্নিবেশিত মোট রচনার সংখ্যা প্রায় পঞ্চাশটির মত। এর মধ্যে একদিকে যেমন তাঁর ব্যক্তিজীবনের অকপট উচ্চারণ রয়েছে, তেমনি রয়েছে বিভিন্ন লেখক শিল্পী সম্পর্কে খোলামেলা মূল্যায়ন এবং ভালোবাসা, মৃত্যু, যৌনতা ইত্যাদি বহুবিচিত্র বিষয়ে তাঁর জীবনব্যাপী উপলব্ধিসঞ্জাত সান্দ্র ও সাহসী কথামালা। সেই লেখাগুলোই এখানে মূল বইয়ের ক্রমানুসারে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। এখানে বলে নিতে চাই যে এই গ্রন্থটি অনুবাদের কাজে উদ্বুদ্ধ করার জন্য রেজাউল করিম সুমনের কাছে আমি বিশেষভাবে ঋণী।
. . .
আমার সন্তানদের জন্য
একদিন আমি বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমার মৃত্যুর কথা চিন্তা করছিলাম আর ভাবছিলাম সেই মুহূর্তে আমি কি যথেষ্টরকম চেতন থাকবো যাতে করে আমি আমার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে পারি, জানাতে পারি তাদের জন্য আমি কী রেখে যাচ্ছি, আর বলে যেতে পারি সেই প্রসিদ্ধ শেষ কথাটি।
তাহলে সবার আগে আমি বলবো বিশ্বাসের কথা। জীবনে যা কিছু ঘটে সবকিছু বিশ্বস করো এমনকি সেইসব অভিজ্ঞতাকেও যা তোমাদের বেদনা দেয়, এসবই শেষ বিচারে তোমাদের কল্যাণে আসবে। ট্র্যাজেডির মুখে ভেতরের দৃষ্টি, বৃহত্তর সত্যদের হারিয়ে ফেলা সহজ। যন্ত্রণাভোগের জন্যই যন্ত্রণা বলে কোন কিছু নেই। জীবনের ছন্দ ও যুক্তির ওপর সাধারণ বিশ্বাস অর্পণের পাশাপাশি আমি তোমাদের নিজস্ব স্বজ্ঞার ওপরেও আস্থা রাখার উপদেশ দেব। তোমাদের বুদ্ধিবৃত্তির চেয়ে এটা অনেক বেশি দিকনির্দেশনা দেবে দীর্ঘমেয়াদে।
আমার তালিকায় এর পরেই আসবে, ভালোবাসা কাকে বলে সেটা শেখার কথা। এটা হলো সম্পূর্ণ ও সর্বাত্মক আত্মসমর্পণ। আত্মসমর্পণ, এটা খুব বড় একটা শব্দ। এর অর্থ এটা নয় যে লোকেরা তোমাকে আপাদমস্তক মাড়িয়ে যাবে, তোমার ওপর নানাভাবে সুযোগ নেবে। যখন আমরা নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিই, আমাদের অহংকে বিসর্জন দিই, তখনই জগতের সকল ভালোবাসা তোমার জন্য অপেক্ষায় থাকবে। ভালোবাসা কোন খেলা নয়, এটা অস্তিত্বের একটা বিশেষ অবস্থা।
তোমাদের অবশ্যই ক্ষমা করতে ও অতীতকে ভুলতে শিখতে হবে। তুমি সারা জীবন অসুখী থাকবে যদি তুমি অপ্রীতিকর স্মৃতি আঁকড়ে থাকো। আমি বুঝি আমাকে পিতা হিসাবে পাওয়াটা এবং এমন মা-বাবার সন্তান হওয়াটা কতটা কষ্টকর যারা সারাক্ষণ পরস্পরের গলা চেপে ধরতে উদ্যত। আমি স্বীকার করি যে আমি তোমাদের মায়েদের ডাইনি বানিয়ে ছেড়েছি, যেটা আসলে ছিল আমার দুর্বলতা। তোমরা যদি তাঁদের প্রতি মনে ক্ষোভ পুষে রাখো তাহলে আমিও তার জন্য অংশত দায়ী। তাঁদের সঙ্গে ভাব করে নিয়ো, তোমাদের ভালোবাসা ও দয়ার কাছে তাঁরা নত হবে।
আমার মৃত্যতে তোমরা মুক্ত হবে, এতটাই স্বাধীন যা তোমরা কল্পনা করতে পারছো না। আমার প্রস্থানের পর তোমরা ভালো থাকবে, তোমরা সুখী, স্বাস্থ্যবান ও শক্তিমান হবে। একটা বিশেষ পর্যায়ের পর বাবা-মারা সন্তানের জীবনকে কঠিন করে তোলে। আমি অধিকাংশ পিতামাতার চেয়েই আলাদা হতে চেয়েছি, কিন্তু আমি মনে করি না যে আমি একজন ব্যতিক্রমী পিতা। কখনো কখনো আমি খুবই স্বার্থপরের মত আচরণ করেছি, আমার যা মনে হয়েছে তাইই করেছি, এতে অন্যেরা কষ্ট পেয়ে থাকলেও। কিন্তু আমি কখনোই তোমাদের কষ্ট দিতে চাই নি, যদি দিয়ে থাকি তবে সেটা সত্যি সত্যি আমার ইচ্ছার বাইরে। আমি বিশ্বাস করি তোমরা আমাকে ক্ষমা করে দেবে, এক্ষুনি না হলেও আগামী দিনগুলোতে।
তোমরা যদি কখনো সন্তান নেবার সিদ্ধান্ত নাও একমাত্র তখনই আমাদের সঙ্গে তোমাদের সম্পর্কের সঠিক পরিপ্রেক্ষিতটুকু বুঝতে পারবে তোমরা। সন্তানেরা বড় শিক্ষকও বটে। সন্তান বড় করার দায়িত্বটা শুধুমাত্র দারুণ একটা প্রাপ্তির কাজ নয় এটি একজন ব্যক্তির জীবনে অত্যন্ত কঠিন দায়িত্বও বটে। তুমি সন্তানদের মধ্য দিয়ে আরো বেশি সুন্দর ও প্রাজ্ঞ হয়ে ওঠো কিন্তু একান্ত সদিচ্ছা থাকা স্বত্বেও তুমি স্রেফ তাদের জন্যই তোমার জীবন যাপন করতে পারো না। এটা অবাস্তবই শুধু নয়, অসম্ভবও বটে।
আমার মৃত্যকে তোমরা হাসিমুখে মেনে নিও, ভয় পেয়ো না। এটাকে স্রেফ যবনিকাপাতের মত একটি অংকের অবসান বলে ভেবো। আমি দারুণ একটা জীবন যাপন করেছি, যাকে বলা যায় সম্পূর্ণ জীবন। আমি আমার মৃত্যুকে দুহাত মেলে আহ্বান করি, তোমরাও তাইই করো।
তোমাদের দায়িত্ব এখন তোমাদের জীবন নিয়ে জীবনযাপনের কাজে সামনে এগিয়ে যাওয়া। বাঁচো পরিপূর্ণভাবে, আনন্দের সঙ্গে, মমতার সঙ্গে, ভালোবাসার সঙ্গে।

লেখক, অনুবাদক, সংস্কৃতিকর্মী
