মুক্তাঙ্গন-এ উপরোক্ত শিরোনামের নিয়মিত এই সিরিজটিতে থাকছে দেশী বিদেশী পত্রপত্রিকা, ব্লগ ও গবেষণাপত্র থেকে পাঠক সুপারিশকৃত ওয়েবলিন্কের তালিকা। কী ধরণের বিষয়বস্তুর উপর লিন্ক সুপারিশ করা যাবে তার কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম, মানদণ্ড বা সময়কাল নেই। পুরো ইন্টারনেট থেকে যা কিছু গুরত্বপূর্ণ, জরুরি, মজার বা আগ্রহোদ্দীপক মনে করবেন পাঠকরা, তা-ই তাঁরা মন্তব্য আকারে উল্লেখ করতে পারেন এখানে।
ধন্যবাদ।
আজকের লিন্ক
এখানে থাকছে দেশী বিদেশী পত্রপত্রিকা, ব্লগ ও গবেষণাপত্র থেকে পাঠক সুপারিশকৃত ওয়েবলিন্কের তালিকা। পুরো ইন্টারনেট থেকে যা কিছু গুরত্বপূর্ণ, জরুরি, মজার বা আগ্রহোদ্দীপক মনে করবেন পাঠকরা, তা-ই সুপারিশ করুন এখানে। ধন্যবাদ।
৪ comments
মাসুদ করিম - ১২ জুলাই ২০২২ (৫:১১ পূর্বাহ্ণ)
সুরকার আলম খানের চিরবিদায়
https://bangla.bdnews24.com/glitz/article2087685.bdnews
‘ওরে নীল দরিয়া’, ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস’, ‘আমি রজনীগন্ধা ফুলের মতো গন্ধ বিলিয়ে যাই’ এর মত জনপ্রিয় গানের সুরকার, সংগীত পরিচালক আলম খান আর নেই।
ঢাকার শ্যামলীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শুক্রবার সকালে তার মত্যু হয় বলে তার বড় ছেলে, সংগীতশিল্পী আরমান খান জানান।
৭৭ বছর বয়সী আলম খান কয়েক বছর ধরে ক্যান্সারে ভুগছিলেন। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা চলছিল তার।
সিরাজগঞ্জের বানিয়াগাতি গ্রামে ১৯৪৪ সালের ২২ অক্টোবর জন্ম নেন এই গুণী সুরকার। তিনি পপসম্রাটখ্যাত আজম খানের বড় ভাই।
বাবার সরকারি চাকরির সুবাদে আলম খানের শৈশব কেটেছে কলকাতায়। ১৯৪৭ এ দেশভাগের পর ঢাকায় ফিরে থিতু হন তারা। ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী স্কুল থেকে ম্যাট্রিক (এসএসসি) পাস করেন।
স্কুলে পড়ার সময় থেকেই সুর আর গানের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটে আলম খানের। প্রথম দিকে বাবার আপত্তি থাকলেও মায়ের উৎসাহে চলে গানের চর্চা।
পরে ছেলের গানের প্রতি তীব্র ঝোঁক দেখে বাবাই তাকে সংগীতে তালিমের জন্য নিয়ে যান ওস্তাদ ননী চট্টোপাধ্যায়ের কাছে।
ষাটের দশকের শুরুর দিকে সুরকার ও সংগীত পরিচালক রবিন ঘোষের সহকারী হিসেবে ‘তালাশ’ সিনেমার মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্র জগতে পা রাখেন আলম খান। তবে সংগীত পরিচালক হিসেবে তার আত্মপ্রকাশে সময় লেগে যায় আরও এক দশক।
১৯৭০ সালে ‘কাচ কাটা হীরে’ সিনেমায় সংগীত পরিচালক হিসেবে যাত্রা শুরু করেন আলম খান; তবে শুরুতে সাফল্য ধরা দেয়নি এই সুরকারের জীবনে।
এরও আটবছর পর নাট্যকার, নির্দেশক আবদুল্লাহ আল মামুনের ‘সারেং বৌ’ সিনেমায় ‘ও রে নীল দরিয়া’ গানের সুরে বাজিমাত করেন আলম খান, বনে যান কীংবদন্তী। তার সুরে আব্দুল জব্বারের গাওয়া গানটি এখনও জনপ্রিয়।
১৯৮২ সালে ‘রজনীগন্ধা’ সিনেমায় আলম খানের সুরে সাবিনা ইয়াসমীনের কণ্ঠে ‘আমি রজনীগন্ধা ফুলের মত’ এবং এন্ড্রু কিশোরের গাওয়া ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস’, ‘জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প’ এবং রক ধাঁচের ‘তুমি যেখানে, আমি সেখানে’ আজও মনে রেখেছে শ্রোতারা।
এ সুরস্রষ্টা শ্রোতাদের উপহার দিয়েছেন ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে’, ‘কি জাদু করিলা পিরিতি শিখাইলা’, ‘সবাই তো ভালবাসা চায়’, ‘আমি একদিন তোমায় না দেখিলে’, ‘তেল গেলে ফুরাইয়া’, ‘আমি তোমার বধূ তুমি আমার স্বামী’, ‘মনে বড় আশা ছিল’, ‘সাথীরে যেও না কখনো দূরে’, ‘বেলি ফুলের মালা পরে’, ‘কাল তো ছিলাম ভালো’, ‘চুমকি চলেছে একা পথে’, ‘ভালবাসিয়া গেলাম ফাঁসিয়া’, ‘তুমি কি এখন আমারই কথা ভাবছো’, ‘আকাশেতে লক্ষ তারা চাঁদ কিন্তু একটারে’র মতো তুমুল সব জনপ্রিয় গান।
মোট ছয়বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন আলম খান। এর মধ্যে পাঁচবার শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালক হিসেবে ও একবার শ্রেষ্ঠ সুরকার হিসেবে পুরস্কার পান।
১৯৭৬ সালে গীতিকার হাবিবুননেসা গুলবানুর সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন আলম খান। তাদের দুই ছেলে আরমান খান ও আদনান খান এবং মেয়ে আনিকা খান।
আরমান খান জানান, শুক্রবার আসরের পর এফডিসিতে জানাজা শেষে শনিবার শ্রীমঙ্গলে আলম খানকে সমাহিত করা হবে।
মাসুদ করিম - ১২ জুলাই ২০২২ (৫:১৪ পূর্বাহ্ণ)
শর্মিলী আহমেদ আর নেই
https://bangla.bdnews24.com/glitz/article2087660.bdnews
বাংলা চলচ্চিত্র ও টিভি নাটকের এক সময়ের আলোচিত অভিনেত্রী শর্মিলী আহমেদ মারা গেছেন।
অভিনয়শিল্পী সংঘের সভাপতি আহসান হাবীব নাসিম জানান, ৭৫ বছর বয়সী শর্মিলী আহমেদ দীর্ঘদিন ধরে ক্যান্সারে ভুগছিলেন। বৃহস্পতিবার রাতে হাসপাতাল থেকে উত্তরার বাসায় নেওয়ার পর শুক্রবার সকালে তার মৃত্যু হয়।
শর্মিলী আহমেদের মৃত্যুর খবর জানিয়ে সংসদ সদস্য অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তফা এক ফেইসবুক পোস্টে লিখেছেন, “আমাদের সময়ের অসাধারণ এক অভিনয় শিল্পী, আমার প্রিয় চাচী আজ সকালে নিজ বাসায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার আত্মার শান্তি কামনা করছি। তার প্রয়াণে গোটা নাট্যজগত তাদের প্রিয় ‘আম্মা’কে হারালেন।”
শর্মিলী আহমেদ বাংলা সিনেমা ও টেলিভিশনে অভিনয় করেছেন দীর্ঘদিন। আশি ও নব্বইয়ের দশকে তাকে এত বেশি সিনেমা আর নাটকে মায়ের চরিত্রে অভিনয় করেছেন যে তার ওই ভূমিকাই অনেক দর্শকের মনেই দাগ কেটে আছে।
তার বোন ওয়াহিদা মল্লিক জলি জানান, শর্মিলী আহমেদকে বনানীতে তার স্বামী রকিব উদ্দিন আহমেদের কবরে সমাহিত করা হবে।
শর্মিলী আহমেদের আনুষ্ঠানিক নাম মাজেদা মল্লিক। ১৯৪৭ সালের ৮ মে মুর্শিদাবাদের বেলুর চাকে তার জন্ম হয়। রাজশাহী পিএন গার্লস হাই স্কুল থেকে এসএসসি করে ১৯৬৪ সালে চলচ্চিত্রে তার ক্যারিয়ার শুরু হয়। সে সময় রাজশাহী বেতারেও তিনি কাজ করেছেন।
বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রথম ধারাবাহিক নাটক দম্পত্তিসহ বিভিন্ন নাটকে অভিনয় করে জনপ্রিয়তা পান শর্মিলী আহমেদ। সুভাষ দত্ত পরিচালিত আলিঙ্গন, আয়না ও অবশিষ্ট, আর্বিভাব সিনেমাতও তিনি কাজ করেছেন।
অভিনয় জীবনে মঞ্চ, টিভি ও সিনেমায় নানা চরিত্রে তাকে দেখা গেছে। তার অভিনীত চলচ্চিত্রের সংখ্যা প্রায় দেড়শ, নাটক করেছেন চারশর মত।
শর্মিলী আহমেদের স্বামী রকিব উদ্দিন আহমেদও একজন পরিচালক ছিলেন। তার নির্মিত পলাতক সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন স্ত্রী শর্মিলী।
অভিনয়শিল্পী সংঘের সভাপতি আহসান হাবীব নাসিম জানান, শুক্রবার জুমার পর উত্তরায় জানাজা হবে শর্মিলী আহমেদের। আসরের পর বনানী কবরস্থানে আরেক দফা জানাজা শেষে সেখানেই তাকে সমাহিত করা হবে।
মাসুদ করিম - ১২ জুলাই ২০২২ (৫:১৯ পূর্বাহ্ণ)
বিশিষ্ট প্রত্নতাত্ত্বিক ড. এনামুল হক আর নেই
https://www.banglatribune.com/others/752881/%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%B6%E0%A6%BF%E0%A6%B7%E0%A7%8D%E0%A6%9F-%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%A8%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%95-%E0%A6%A1.-%E0%A6%8F%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%AE%E0%A7%81%E0%A6%B2-%E0%A6%B9%E0%A6%95-%E0%A6%86%E0%A6%B0-%E0%A6%A8%E0%A7%87%E0%A6%87
একুশে ও স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত বাংলাদেশের কিংবদন্তীতুল্য প্রত্নতাত্ত্বিক অধ্যাপক ড. এনামুল হক মারা গেছেন। রবিবার তিনি রাজধানীতে নিজে বাসভবনে মারা যান বলে জানিয়েছেন ড. এনামুল হকের সহকর্মী (রিসার্চ ফেলো) সাইফুল ইসলাম।
কাজের স্বীকৃতি হিসেবে প্রফেসর ড. এনামুল হক ২০১৭ সালে একুশে পদক ও ২০২০ সালে স্বাধীনতা পদক এবং ভারতের পদ্মশ্রী পদকে ভূষিত হন।
সাইফুল ইসলাম বলেন, স্যার তিনটা ৩৫ মিনিটে ঘুমের মধ্যে মারা গেছেন। সকাল থেকে তিনি কোরবানির যাবতীয় কাজ তত্ত্বাবধান করে দুপুরে খেয়ে ঘুমাতে যান। ঘুমের মধ্যে সাড়া না পেয়ে তাকে ইউনাইটেড হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। এনামুল হক এর মরদেহ বারডেমের হিমঘরে রাখা হবে। তার মেয়ে আগামী মঙ্গলবার প্রবাস থেকে ফিরলে দাফনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
এনামুল হক ১৯৩৭ সালের ১ মার্চ বগুড়া জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বগুড়া থেকে শেষ করে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস বিভাগে স্নাতক ও ইতিহাস-প্রত্নতত্ত্বে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। পরবর্তীতে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দক্ষিণ এশিয়ার শিল্প নিয়ে গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।
কর্মজীবনে ১৯৬২ সালে এনামুল হক তৎকালীন ঢাকা জাদুঘরে যোগদান করে। পরবর্তীতে ১৯৬৫ সালে পদোন্নতি পেয়ে অধ্যক্ষ, ১৯৬৯ সালে পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঢাকা জাদুঘরকে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে রূপান্তর করা হয় এবং এর প্রতিষ্ঠাকালীন মহাপরিচালক হিসেবে এনামুল হক যোগদান করে। জাদুঘরের উন্নতি ও আধুনিকীকরণে তার অবদান অনস্বীকার্য। মহাপরিচালক হিসেবে তিনি ১৯৮৩ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন।
মাসুদ করিম - ১৬ জুলাই ২০২২ (৬:০৯ পূর্বাহ্ণ)
মন্তের মুড়ার ইটের পাঁজায় কোন ইতিহাসের চাবি
https://bangla.bdnews24.com/bangladesh/article2090727.bdnews
মাটি খুঁড়লেই পুরনো ইট মিলত বলে গাঁয়ের নাম ইটাল্লা, সেই গাঁয়ে মুখে মুখে ফেরে এক মন্ত রাজার গল্প।
ইতিহাসে সেই রাজা থাক বা না থাক, তার নামেই এ প্রত্নস্থানের নাম। গোমতী তীরের মন্তের মুড়ায় মাটি খুঁড়ে পাওয়া অবোলকিতেশ্বরের মূর্তি আর পোড়ামাটির প্রত্নবস্তু বলছে, সপ্তম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে সেখানে বৌদ্ধ সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছিল।
প্রত্নতত্ত্ববিদদের ধারণা, এই মন্তের মুড়া সম্ভবত কোনো বৌদ্ধবিহারের ধ্বংসাবশেষ। তবে শালবন বিহারের মতই বৌদ্ধ আর হিন্দু- দুই সংস্কৃতির নিদর্শনই সেখানে মিলেছে। তার মানে হল, বিস্মৃত সেই জনপদ একাধিক শাসনামলে টিকে ছিল। একই স্থানে বৌদ্ধ ও হিন্দু স্থাপত্যের নিদর্শন প্রমাণ করে, সেখানে ছিল সাম্প্রদায়িক সহাবস্থানও।
কুমিল্লা জেলার পাঁচথুবী ইউনিয়নের ইটাল্লা গ্রাম থেকে ময়নামতী প্রত্নস্থানের দূরত্ব মোটামুটি ১০ কিলোমিটার। তবে সেটা গোমতী নদীর ওপারে, লালমাই পাহাড়ে।
সেখানকার বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য ধর্মীয় স্থাপনগুলো যে একসময় পাহাড়ি এলাকা ছাড়িয়ে সমতলে এবং মেঘনা-গোমতী অববাহিকায় বিস্তৃত ছিল, প্রত্নতত্ত্ববিদদের সেই ধারণাকেই সমর্থন দিচ্ছে পাঁচথুবীর মন্তের মুড়া।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের উদ্যোগে গত অর্থবছরে মন্তের মুড়ায় খনন শুরু হয় সিলেট ও চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কার্যালয়ের আঞ্চলিক পরিচালক এ কে এম সাইফুর রহমানের নেতৃত্বে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “পাঁচথুবী এলাকায় মন্তের মুড়াসহ আরও অনেক পুরাকীর্তির ধ্বংসাবশেষ ছিল, যার বেশিরভাগই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এখনও মাটির নিচে প্রচুর প্রাচীন ইট ও মৃৎপাত্রের ভগ্নাংশ পাওয়া যায়। খুব সম্ভব সপ্তম থেকে একাদশ-দ্বাদশ শতক সময়কালের মধ্যে এখানে বৌদ্ধ ধর্ম ও সংস্কৃতির একটি উল্লেখযোগ্য কেন্দ্রের বিকাশ ঘটেছিল।”
নিজে এ খননকাজে যুক্ত না থাকলেও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্বের অধ্যাপক স্বাধীন সেন পাঁচথুবীর প্রত্নতাত্ত্বিক খননকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন।
তার মতে, মন্তের মুড়ার মত প্রত্নস্থানে ইতিহাসের হারিয়ে যাওয়া সেই সংযোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যেতে পারে, যা হয়ত প্রমাণ করবে, একসময় চীন, তিব্বত আর চট্টগ্রাম হয়ে সাগরপথের মাঝে প্রাচীন এক যোগাযোগ নেটওয়ার্কের কেন্দ্রস্থলে ছিল এই লালমাই-ময়নামতী অঞ্চল।
“আমার যতটুকু জানাশোনা আছে, তার ভিত্তিতে বলতে পারি, গোমতী নদীর তীরবর্তী এ ধরনের প্রত্নস্থানের গুরুত্ব আমাদের ইতিহাসের নতুন বোঝাপড়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”
পাঁচথুবীর পথে
কুমিল্লা শহরের উত্তর-পূর্বদিকে কাপ্তানবাজার থেকে গোমতী নদীর বেড়িবাঁধ ধরে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের বিবিরবাজার সড়কের টিক্কার চর সেতু পার হলেই শুরু হয় পাঁচথুবী ইউনিয়ন।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কার্যালয়ের প্রতিবেদন বলছে, ওই এলাকাটিতে কিছুকাল আগ পর্যন্ত পাঁচটি ঢিবি বা স্তূপের অস্তিত্ব ছিল। কাছাকাছি ঢিবিগুলোতে প্রচুর পুরনো ইট পাওয়া যেত।
প্রখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া আশির দশকেই এ এলাকায় পাঁচটি ঢিবি বা স্তূপের কথা উল্লেখ করেছিলেন তার লেখায়। এই পাঁচটি ঢিবি বা স্তূপের অস্তিত্ব থেকেই এলাকাটির নাম হয় পাঁচথুবী (<পাঁচ স্তূপী <পাঁচস্তূপ <পঞ্চস্তূপ)। সংরক্ষণের অভাবে এখন আর সেগুলোর অস্তিত্ব নেই। এ ইউনিয়নেরই একটি গ্রামের নাম ইটল্লা। গ্রামের এমন নামকরণের গল্প শোনা গেল গাঁয়ের পথে ঢুকতেই চায়ের দোকানের এক আড্ডায়। অশীতিপর বৃদ্ধ তাজুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বললেন, “আগে মাডি কুড়লেই (মাটি খুঁড়লেই) ইট পাইতাম। আল্লায় মিলাইয়া দিসে ইট। এর লাইগ্যা আমরার গেরামের নাম ইটাল্লা।” সেই ইটাল্লা এখন ইটল্লা বা ইটলা নামেও পরিচিতি পেয়েছে বলে তাজুল ইসলামের ভাষ্য। প্রত্নতত্ত্ববিদদের ধারণা, পাঁচথুবীর ঢিবিগুলো ছিল বৌদ্ধস্তূপ। আরও কিছু প্রাচীন ইমারতের ধ্বংসাবশেষ ওই এলাকায় ছিল। এর মধ্যে একটি চকমিলান ইমারতকে মন্তের মুড়া বা মহন্ত রাজার বাড়ি হিসেবে চেনে স্থানীয়রা। তাজুল ইসলাম জানালেন, গ্রামের লোকজন মাটি খুঁড়ে ইট সংগ্রহ করত ঘরের মেঝে পাকা করার জন্য বা গোয়াল ঘর বানাবার জন্য। কেউ কেউ সেই ইট বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করত। এসব তিনি ছোটবেলা থেকেই দেখছেন। এত কিছুর পরেও মন্তের মুড়াটা টিকে আছে। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের উদ্যোগে ২০২১-২২ অর্থবছরে পাঁচথুবী এলাকার ইটল্লা গ্রামের মন্তের মুড়ায় খনন শুরু হয়। তাতে উন্মোচিত হয় বিভিন্ন ধরনের স্থাপত্য কাঠামোর ধ্বংসাবশেষ। খননে উঠে আসে পোড়ামাটির অলংকৃত ইট, তেলের প্রদীপ, ছোট পাত্র, পিরিচ এবং নলাকার পাত্রের অংশবিশেষসহ নানা প্রত্নবস্তু। এ প্রত্নতাত্ত্বিক খনন দলের প্রধান সাইফুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সেখানে বেশ কয়েকটি সময়কালের স্থাপত্য কাঠামোর ধ্বংসাবশেষ চিহ্নিত করেছেন তারা। এর মধ্যে মন্তের মুড়া দুর্গাকারে তৈরি করা বৌদ্ধবিহারের ধ্বংসাবশেষ হতে পারে। লোককথা এবং ইতিহাস গ্রামের মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত আছে, একদা মন্ত রাজা যুদ্ধ করতে গিয়েছিলেন পাশের রাজ্যের সঙ্গে। যুদ্ধে যাবার আগে রানিকে বলে গিয়েছিলেন, হেরে গেলে তিনি বার্তাবাহক কবুতরটি ছেড়ে দেবেন। যুদ্ধ তখনও শেষ হয়নি, কিন্তু বার্তাবাহক কবুতরটি খাঁচা ভেঙে ফিরে আসে মন্ত রাজার প্রাসাদে। আর যুদ্ধ জয় করে ফিরে আসার পর রাজা দেখেন রানিসহ প্রাসাদের সব নারী-শিশু আগুনে আত্মাহুতি দিয়েছে! এই মহন্ত রাজা কে, কখন তিনি রাজত্ব করেছেন- এ বিষয়ে কোনো তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায় না। কারও কারও ধারণা, এ উপাখ্যানে ইতিহাসের অন্য কোনো কালের গল্প মিশে গিয়ে থাকতে পারে। গল্পটি শোনার পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সাঈদ ফেরদৌস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “লোকশ্রুতি ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে। তবে লোকমুখে পরম্পরায় বেঁচে থাকে যে অ্যাখ্যান, তাকে অবশ্যই স্থান, কাল ও পরিপ্রেক্ষিতের সাপেক্ষে মিলিয়ে দেখতে হয়। “আজকে যে স্থানের প্রত্ন নিদর্শনটি নিয়ে আমরা কথা বলছি, সেটি হয়তো একটি স্থানের একটি বিশেষ সময়কালের প্রতিনিধিত্ব করছে। আবার ওই একই স্থান ঘিরে হয়তো একেবারেই ভিন্ন কোনো লোকশ্রুতি চালু রয়েছে, যা ওই একই স্থানের অপর একটি সময়ের সাক্ষ্য বহন করে। ফলে আপাত অর্থে মনে হতে পারে যে আমরা একই স্থানের দুটো পরস্পরবিরোধী সত্য পাচ্ছি। বাস্তবতা হল, আমরা একই স্থানের দুটো ভিন্ন সময়ের ভিন্ন ভিন্ন বাস্তবতার দিকে তাকাচ্ছি।” সামাজিক ইতিহাস নিয়ে গবেষণার জন্য খ্যাতি পাওয়া নৃতত্ত্বের এই শিক্ষক বলেন, “লোকজ বয়ান, কিংবা কিংবদন্তীতে ভ্রান্তি, বিস্মৃতি কিংবা অসঙ্গতি মিশে থাকে অহরহ। একথা মাথায় রেখেই স্থান, কাল ও পরিপ্রেক্ষিতের নিরিখে তাকে ব্যাখ্যা করতে হয়।” প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক স্বাধীন সেন বাংলাদেশের উত্তর ও দক্ষিণে বেশ কিছু প্রত্মতাত্ত্বিক খননের কাজ করেছেন। তিনি বলছেন, “এ ধরনের লোকশ্রুতি বাংলাদেশের বেশিরভাগ প্রত্নস্থানের চারপাশের মানুষের স্মৃতিতে ও শ্রুতিতে বিরাজ করছে। “উত্তরবঙ্গে বা দক্ষিণবঙ্গেও এমন লোককথা বিভিন্ন সাইটের সঙ্গে থাকা বসতিতে শুনতে পাওয়া যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১৭ শ থেকে ১৮ শ শতকের কোনো কাহিনী, কোনো কোনো ক্ষেত্রে পৌরাণিক কাহিনির চরিত্র বা কুশীলব, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক চরিত্রেরই উপরে অলৌকিক দেবত্ব আরোপসহ নানাভাবে লোকস্মৃতিতে এসব কাহিনি সঞ্চালিত ও পরিবর্তিত হতে থেকেছে।” পাঁচথুবীর ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে বলে মনে করেন স্বাধীন সেন। তার মতে, মহন্ত বা মন্ত রাজার ওই গল্পের ঐতিহাসিকতা থাকার সম্ভাবনা ক্ষীণ, কিন্তু গোমতী নদীর তীরে এ ধরনের প্রত্নস্থান এই এলাকার ইতিহাসকে নতুনভাবে বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ইতিহাসের নতুন বোঝাপড়া গোমতীর অন্য পাড়ে মন্তের মুড়ার মত প্রত্ন নিদর্শনের গুরুত্ব কোথায়, তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অধ্যাপক স্বাধীন সেন বললেন হিন্টারল্যান্ড বা পশ্চাদভূমির ধারণার কথা। “সমতলভূমির চাষাবাদ ও কারিগরি উৎপাদনসহ মানববসতি এখানে পশ্চাদভূমি বা হিন্টারল্যান্ড হিসেবে কাজ করেছে। এই হিন্টারল্যান্ড বোঝার মাধ্যমে নদী-সমুদ্রের-স্থলপথের নিবিড় সম্পর্ক বোঝা যেতে পারে। কোনো বড় ধর্মীয় বা রাজনৈতিক বা বাণিজ্যিক কেন্দ্রই হিন্টারল্যান্ডের অস্তিত্ব ছাড়া বিকশিত হয়ে টিকে থাকতে পারে না। নালন্দা মহাবিহার, সোমপুর মহাবিহার বা বিক্রমশীলা মহাবিহার এর বড় প্রমাণ। “আর লালমাই-ময়নামতীর ক্ষেত্রে পার্বত্যভূমি-সমতলভূমি-নদী-সমুদ্রের এক সম্মিলন ঘটেছে, যা বাংলাদেশ ও বাংলা অঞ্চলে বিরল। এই সম্মিলনের কারণে এই স্থানের প্রভাব এখানকার অতীত মানব বসতির ওপরে প্রবল ছিল। সেই সম্মিলনের প্রভাবের প্রক্রিয়াকে বোঝার যাত্রা শুরু হতে পারে এই ধরনের প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ও গবেষণার মাধ্যমে।” স্বাধীন সেন বলেন, “লালমাই-ময়নামতী বলতে আমরা এখন পর্যন্ত কেবল লালমাই পাহাড়ের প্রত্মস্থানগুলোকে বুঝি। সেগুলোর ভিত্তিতে আদি-মধ্যযুগীয় জনপদ সমতট-হরিকেলের ইতিহাসকে বুঝতে চেষ্টা করি। লিপিতাত্ত্বিক বিভিন্ন আলামত প্রমাণ করে যে কেবল লালমাই-ময়নামতীর প্রত্মস্থানগুলোই নয়, চারপাশের মেঘনা-গোমতীর সমতলভূমির এই প্রত্মস্থান এখানকার বসতি বোঝার জন্য ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। “পাশাপাশি রয়েছে লিখিত এবং মূদ্রাতাত্ত্বিকসহ নানান প্রমাণ। এগুলো স্পষ্টভাবেই নির্দেশ করে যে, কেবল বৌদ্ধধর্মীয় কয়েকটি বিহার ও মন্দির এবং ব্রাহ্মণ্য একটি মন্দিরের ভিত্তিতে এই বসতিকে পুরোপুরি বোঝা সম্ভব নয়।” প্রত্মতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালক সাইফুর রহমান জানিয়েছেন, পাঁচথুবীর প্রত্নতাত্ত্বিক খননে অবোলকিতেশ্বরের মূর্তি পাওয়া গেছে। তাতে ধারণা হচ্ছে, ওই এলাকা বৌদ্ধ ধর্ম ও সংস্কৃতির একটি উল্লেখযোগ্য কেন্দ্র ছিল। বৌদ্ধ বিশ্বাস অনুযায়ী, গৌতম বুদ্ধ ৫৫০ বার জন্মগ্রহণ করে জগতের সকল জীবের মুক্তি কামনা করেন এবং সাধনা করে বুদ্ধত্ব লাভ করেন। তার পূর্বজন্মগুলোকে বলা হয় বোধিসত্ত্ব । মহাযানী দর্শনে বোধিসত্ত্বের আদর্শকে সর্বোচ্চে স্থান দেওয়া হয়। জন্মের ক্রম অনুসারে বোধিসত্ত্বের বিভিন্ন রূপ কল্পনা করা হয়। প্রথম রূপ হচ্ছে অবলোকিতেশ্বর। আবার আরএস রেকর্ড অনুযায়ী মন্তের মুড়া প্রত্নস্থানটি নরসিংহ বিগ্রহ মন্দিরের দেবোত্তর সম্পত্তি। নরসিংহ হলেন বিষ্ণুর চতুর্থ অবতার। পুরাণ ও অন্যান্য প্রাচীন হিন্দুগ্রন্থে তার উল্লেখ রয়েছে। সে কারণে এই প্রত্মস্থানটি হিন্দুধর্ম ও সংস্কৃতির কেন্দ্র হিসেবেও বিকশিত হয়ে থাকতে পারে কোনো একটি সময়। এ কে এম সাইফুর রহমান বলেন, “আমাদের বর্তমান অর্থ-বছরের জরিপে আমরা লালমাই-ময়নামতী এলাকার চারপাশের সমতলভূমিতে সপ্তম হতে দ্বাদশ শতকের অনেক প্রত্নস্থান শনাক্ত করেছি। অর্থাৎ লালমাই-ময়নামতির পাহাড়ি এলাকা ছাড়াও পাঁচথুবীসহ চারপাশের নদীবিধৌত সমতলভূমিতে একটা বড় সময়কাল ধরে প্রাচীন বসতির আলামত পাওয়া যাচ্ছে, যা এই অঞ্চলের প্রাচীন ইতিহাসের বোঝাপড়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।” একই স্থানে বৌদ্ধ ও হিন্দু সংস্কৃতির বিকাশের বিষয়টি ব্যাখ্যা করে পুরাকীর্তি গবেষক মোহা. মোশাররফ হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঐতিহাসিক ওই কালকে বুঝতে হলে আমাদের এই এলাকার হাজার বছরের অসাম্প্রদায়িক ইতিহাসকে বুঝতে হবে। সপ্তম শতকের দ্বিতীয়ার্ধে মগধ ও গৌড়ে পরবর্তী গুপ্তবংশীয় রাজারা প্রভুত্ব স্থাপন করলে খড়গ বংশের রাজারা দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় একটি স্বাধীন রাজ্যের সৃষ্টি করেন। তাদের রাজধানী কর্মান্ত বাসক হাল-আমলের কুমিল্লা জেলার বড় কামতায়। খড়গ বৌদ্ধ হলেও তাদের এক রানি প্রভাবতী ছিলেন শৈব। তিনি যে শিবের স্ত্রী সর্বাণীর পূজা করতেন এটা নিশ্চিত। ভবানী, দুর্গা, সর্ব অর্থাৎ শিবের স্ত্রীর একটি মূর্তিও কুমিল্লায় পাওয়া গিয়েছে। খড়গদের শাসনামল সপ্তম শতকের শেষ থেকে অষ্টম শতকের শুরু পর্যন্ত। “খড়গদের সমসাময়িক রাত বংশ নামে আরো একটি রাজবংশের কথা জানা যায়। রাতরা খড়গদের অধীন ছিল বলে ধারণা এবং প্রথমে হিন্দু ধর্মাবলম্বী হলেও পরে পণ্ডিত শীলভদ্রের প্রভাবে বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হয়। এরপরই আসে দেববংশ। দেববংশ ছিল অষ্টম থেকে নবম শতকের শেষ পর্যন্ত। এরপর মাঝে চন্দ্রবংশ ক্ষমতায় আসে। চন্দ্ররা একই সঙ্গে বৌদ্ধ এবং শৈব ধর্মে সমান অনুরাগী ছিলেন। পরে ১২০৫ সালের লিপিতাত্ত্বিক নিদর্শনে আরও একটি দেব বংশের দেখা মেলে।” বৌদ্ধধর্মীয় স্থানের ব্রাহ্মণ্যধর্মীয় স্থানে রূপান্তরিত হওয়ার উদাহরণ যেমন রয়েছে, ঠিক তেমনি বৌদ্ধধর্মীয় স্থাপনায় ব্রাহ্মণ্যধর্মীয় বিভিন্ন নিদর্শন ও প্রতিমা পাওয়ার উদাহরণও অনেক। সে কথা তুলে ধরে স্বাধীন সেন বলেন, “ধর্মীয় ঐতিহ্যগুলো নানাভাবেই পরিবর্তন, রূপান্তর ও বিনিময়ের মধ্য দিয়ে গেছে। আর সে সময়ের যোগাযোগ নেটওয়ার্কের কেন্দ্রে থাকা এই বসতিগুলোতে যোগাযোগের ও বিনিময়ের আরো বেশি প্রমাণ পাওয়া যাবে, সেটা বলাই বাহুল্য।” লিপিতে যা লেখা প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ রণবীর চক্রবর্তী লিপিতাত্ত্বিক প্রমাণের ভিত্তিতে দেখিয়েছেন, খ্রিস্টীয় দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতকে হিন্দু শাসনের সময় দেব রাজবংশের রাজধানী দেবপর্বত হিসেবে লালমাই-ময়নামতীকে চিহ্নিত করা যায়। এখানে একটি সক্রিয় নৌবন্দর থাকার কথাও এসেছে। আরবীয় বণিকদের লেখায় সমুন্দর নামে যে বন্দরের উল্লেখ রয়েছে সেই বন্দর আজকের চট্টগ্রামে ছিল বলে অধ্যাপক রণবীর চক্রবর্তীসহ ইতিহাসবিদদের অনেকে অনুমান করেন। তাদের ধারণা, লালমাই-ময়নামতী থেকে সমুন্দর হয়ে একদিকে জলপথে ও সমুদ্রপথে, আর অন্যদিকে উত্তরের মেঘালয়-মণিপুর হয়ে মায়ানমার থেকে চীন পর্যন্ত পূর্বদিকে আর হিমালয়ের পাদদেশীয় অঞ্চল হয়ে তিব্বতের সঙ্গে যোগাযোগের যে নেটওয়ার্ক, তাতে কেন্দ্রীয় ভূমিকা ছিল লালমাই-ময়নামতীতে ছড়িয়ে থাকা প্রত্নস্থানগুলোর। এ বিষয়ে অধ্যাপক সুচন্দ্রা ঘোষ, কেনেথ হল, রীলা মুখার্জী, রণবীর চক্রবর্তী, তানসেন সেন, বেন ইয়াংসহ বঙ্গোপসাগরীয় ও ভারত মহাসাগরীয় বাণিজ্যের ইতিহাস বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের লেখার কথা তুলে ধরে অধ্যাপক স্বাধীন সেন বলেন, তারা দেখিয়েছেন, লালমাই-ময়নামতীসহ সংলগ্ন অঞ্চল আদি-মধ্যযুগীয় গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা বদ্বীপের অন্যতম প্রধান একটি বসতি-কেন্দ্র ছিল। “বজ্রযানী-তন্ত্রযানী বৌদ্ধ ধর্ম বিকাশ ও প্রসারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নানা অঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্মের প্রসারে এই কেন্দ্রটি এমন সময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল যখন উত্তরভারত, পশ্চিমভারত ও দক্ষিণভারতে বৌদ্ধধর্মের সংকোচন ঘটছিল। বৌদ্ধ ধর্মের এই প্রসারের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত ছিল বাণিজ্য ও তৎকালীন কূটনৈতিক তৎপরতা।” তানসেন সেন, রীলা মুখার্জীর মত বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া হয়ে চীন অবধি বাণিজ্য ও কূটনীতির প্রসার ছিল সে সময়। সে কথা তুলে ধরে স্বাধীন সেন বলেন, “ওই বিশেষজ্ঞদের পাঠ করে আমার অনুধাবন হয়েছে, বঙ্গোপসাগর-চীনসাগরসহ ওই অঞ্চলের সঙ্গে বাণিজ্যিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে ভূমধ্যসাগরীয় ও ইউরোপের অন্যান্য অঞ্চল, মধ্যপ্রাচ্য এবং ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের বাণিজ্যিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে এই লালমাই-ময়নামতীসহ প্লাবনভূমির বসতিগুলো অন্তবর্তী কেন্দ্রের ভূমিকা পালন করত। “ধাতুবিদ্যা, ব্রোঞ্জের নির্মাণ প্রযুক্তি ও শিল্পশৈলীসহ নানা শৈল্পিক মোটিফের প্রভাবও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় গেছে এই পথ ধরে। যে ক্রুশাকৃতি মন্দির আমরা সোমপুর মহাবিহার, বিক্রমশীলা মহাবিহার, শালবন মহাবিহারে পাই, সেই স্থাপত্য-রীতি এবং নকশা প্রভাবিত করেছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মন্দিরের স্থাপত্যরীতিকে। লালমাই-ময়নামতীর বসতি থেকে সমুন্দর হয়ে একদিকে পূর্বে আরেক দিকে পশ্চিমে যোগাযোগের বিস্তৃত নেটওয়ার্কের কথাই বলেন সামুদ্রিকবাণিজ্যের ইতিহাসবিদ এবং সামুদ্রিক প্রত্নতত্ত্ববিদরা।” স্বাধীন সেন বলেন, “পাঁচথুবীর মন্তের মুড়ার প্রত্মতাত্ত্বিক নিদর্শন প্রমাণ করে, কেবল পাঁচথুবী নয়, কুমিল্লা ও চট্টগ্রামের সমতলভূমি এবং পাহাড়ি এলাকায় ওই সময়ের অনেক প্রত্নস্থান টিকে থাকার সম্ভাবনা এখনও প্রবল। প্রণালিবদ্ধ জরিপ পরিচালনা করলে এইসব প্রত্নস্থান এখনও শনাক্ত ও নথিভুক্ত করা সম্ভব। প্লাবন সমভূমিতে গোমতী নদী সংলগ্ন এ ধরনের প্রত্নস্থানের সন্ধানের জন্য যত তাড়াতাড়ি নিবিড় গবেষণার ব্যবস্থা করা যাবে, ততই এখনও টিকে থাকা আরও মানববসতির চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যাবে।” https://twitter.com/urumurum/status/1548171573261058050