মুক্তাঙ্গন-এ উপরোক্ত শিরোনামের নিয়মিত এই সিরিজটিতে থাকছে দেশী বিদেশী পত্রপত্রিকা, ব্লগ ও গবেষণাপত্র থেকে পাঠক সুপারিশকৃত ওয়েবলিন্কের তালিকা। কী ধরণের বিষয়বস্তুর উপর লিন্ক সুপারিশ করা যাবে তার কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম, মানদণ্ড বা সময়কাল নেই। পুরো ইন্টারনেট থেকে যা কিছু গুরত্বপূর্ণ, জরুরি, মজার বা আগ্রহোদ্দীপক মনে করবেন পাঠকরা, তা-ই তাঁরা মন্তব্য আকারে উল্লেখ করতে পারেন এখানে।
ধন্যবাদ।
আজকের লিন্ক
এখানে থাকছে দেশী বিদেশী পত্রপত্রিকা, ব্লগ ও গবেষণাপত্র থেকে পাঠক সুপারিশকৃত ওয়েবলিন্কের তালিকা। পুরো ইন্টারনেট থেকে যা কিছু গুরত্বপূর্ণ, জরুরি, মজার বা আগ্রহোদ্দীপক মনে করবেন পাঠকরা, তা-ই সুপারিশ করুন এখানে। ধন্যবাদ।
১২ comments
মাসুদ করিম - ৩ নভেম্বর ২০২১ (১০:০৯ পূর্বাহ্ণ)
COP26: What climate summit means for one woman in Bangladesh
https://thefinancialexpress.com.bd/views/opinions/cop26-what-climate-summit-means-for-one-woman-in-bangladesh-1635856119
The people of Gabura in Bangladesh are having everything that’s most threatening about climate change thrown at them.
Storms keep wrecking their coastal defences, and rising sea levels are pushing salty seawater into their wells and fields.
Bangladesh is one of the countries hit hardest by extreme weather, and this vulnerable community is enduring exactly the kind of future that the COP26 climate conference in Glasgow is trying to avoid.
It’s also experiencing the painful reality of a key issue at the talks- how a promise of financial help for the poorest nations remains unfulfilled after 12 long years.
And the story of one woman, Shorbanu Khatun, represents all that’s proved least effective about international efforts to tackle climate change so far.
I met her in 2009 when Gabura was still reeling from the aftermath of a cyclone that had left the village totally exposed to the waves. She and her four children were living in a makeshift shelter perched on a high narrow ridge, the only safe ground for about 5,000 people.
At every high tide, seawater poured through gaps in a series of earth embankments meant to hold back the sea. Whenever they could, the men of the village formed human chains to pass along handfuls of mud to fill the holes – mud was all they had, and it never really did the job.
‘Hopenhagen’
To highlight the plight of the village – and the needs of all developing countries suffering from climate change – Oxfam offered Shorbanu the chance to make her case on a global stage.
She made the long journey to Denmark in December 2009 to the COP15 climate conference, the equivalent of the meeting underway in Glasgow now.
When I saw her there, I asked what she made of the giant event – it was given the optimistic billing of “Hopenhagen”.
“It’s good to be with all these big people,” she told me, and she seemed upbeat about the chances of them listening.
And as it happens, while Shorbanu was in Copenhagen, the richest nations made a promise to the poorest countries – that by 2020 they would give them $100bn a year to deal with the impacts of climate change.
At the time, this was seen as a breakthrough offer because it signalled to developing nations that their needs and losses were being taken seriously.
But 12 years later, that target has not been met and, as things stand, it won’t be until 2023.
‘Water everywhere’
So what does this mean for Shorbanu and the people of Gabura?
A trickle of aid has reached them, but not remotely on the scale promised in Copenhagen, and much of the assistance that has got through was raised within Bangladesh.
It has paid for sandbags to reinforce some of the mud embankments, though the biggest storms still breakthrough.
A new school has been built and, when cyclones strike, the concrete structure serves as a storm shelter.
But all the time the rise of the sea, millimetre by millimetre, fuelled by the melting of the distant polar ice, contaminates local wells and keeps reducing supplies of drinking water.
“There is water everywhere around us,” Shorbanu says, “but it doesn’t have any use. We have a serious crisis.”
The nearest safe source is more than a mile away, at a solar-powered desalination plant built by the charity Oxfam, but reaching it involves walking in punishing heat and then carrying a heavy container back again, every day.
Many people try to rely on water that’s closer at hand, but find it causes skin diseases because of the high salt content and – for women in particular – washing in dirty water increases the likelihood of infections.
Researchers are also investigating whether an increase in the amount of salt that women are drinking could explain the relatively high number of miscarriages in the region.
Shorbanu, now aged 44, sounds more worried and desperate than ever.
“We have no idea what we can do,” she says. “If people help us, then something can change.
“We don’t have the money to move to other places. I have nothing that I can give to my children.”
One of her sons now has a job on a shrimp farm. It’s a growing industry as fields are turned into ponds, but it creates shortages of locally grown food, exacerbating problems of malnutrition.
What does Shorbanu most want from anyone who might read her story, especially the leaders deciding the outcome of the talks in Glasgow?
She wants a strong embankment, which will not be destroyed so easily, and easy access to drinking water.
But most of all, she says, she wants action: “We have suffered a lot – we do not want our children and grandchildren to suffer more.”
https://twitter.com/febdonline/status/1455715099398733828
মাসুদ করিম - ৬ নভেম্বর ২০২১ (৩:০৭ পূর্বাহ্ণ)
দেশবন্ধু: প্রাসঙ্গিকতা, আক্ষেপ ও করণীয়
https://opinion.bdnews24.com/bangla/archives/67956
লম্বা ও খর্বাকৃতির দু’জন মানুষ একটি প্রাচীরের উপর থেকে খেলা দেখতে চেষ্টা করছে; দু’জনের জন্যই প্রাচীরের উচ্চতা সমান- এটা সমানাধিকার বা ইক্যুয়ালিটি। অন্যদিকে খর্বকায় মানুষটির পায়ের তলায় একটি পাটাতন দিয়ে তাকে লম্বা মানুষটির সমউচ্চতায় তুলে আনা হচ্ছে- এটা সমদর্শিতা- ইক্যুইটি। নাগরিক অধিকার বিষয়ক যেকোনো আলাপে এই সমানাধিকার বনাম সমদর্শিতার পার্থক্য নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয় ইদানিং। এরই প্রেক্ষিতে ঐতিহাসিকভাবে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে আনবার দর্শন নিয়ে আলোচিত হয় ‘ইতিবাচক ক্রিয়া’ বা ‘অ্যাফার্মেটিভ অ্যাকশন’ নামক ধারণাটির। পশ্চিমা সভ্যতায় সর্বপ্রথম নীতিগতভাবে এই অ্যাফার্মেটিভ অ্যাকশন-এর বাস্তবায়ন সম্ভবত হয়েছিল ১৯৬৫ সালের মার্কিন সিভিল রাইটস অ্যাক্ট-এর মাধ্যমে।
বাংলাদেশে সম্প্রতি কোটা বিষয়ক বাস্তব আলাপের একটি সুযোগ সৃষ্টি হলেও তা বেশ নোংরাভাবে সমাপ্ত হয়েছে। নানান সময়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রে চালুকৃত বেশকিছু ‘ইতিবাচক ক্রিয়া/অ্যাফার্মেটিভ অ্যাকশন’ যা প্রচলিত শব্দে ‘কোটা’ হিসেবে পরিচিত ছিল; তা প্রথমে ২০১৩ সালের মাঝামাঝি নাগাদ ‘বাতিল’-এর এবং পরে ২০১৮ সাল নাগাদ ‘সংস্কার’-এর দাবিতে আন্দোলন হয়েছে। উদ্দেশ্যহীন, বিক্ষিপ্ত এবং কক্ষচ্যুত এই আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ততোধিক বিক্ষিপ্ত সিদ্ধান্তে সকল প্রকার কোটার বিলুপ্তি ঘটানো হয়েছে সরকারি কর্মক্ষেত্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে।
ফলশ্রুতিতে, স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রে সাম্প্রতিক অতীতে আমরা যতগুলো সফল আন্দোলন সংগঠিত হতে দেখেছি, তারমধ্যে সবথেকে স্বার্থপর, গোষ্ঠীবদ্ধ, মিথ্যাভিত্তিক ও অসৎ এই আন্দোলনটির সমর্থক-সংগঠকরা দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে! এই আন্দোলনটির ব্যাপারে এতটা নেতিবাচকতা প্রকাশের কিছু কারণ আছে। সবথেকে দুঃখজনক দিকটি হচ্ছে এই আন্দোলনটির সংগঠক ও সমর্থক ছিল/আছে একদল শিক্ষার্থী। জ্ঞানার্জন, সামাজিক সাম্যের দিকে যাত্রা, সমানুভূতির চর্চা আর ন্যায়ের পথ যাদের পাথেয় হবার কথা ছিল সেই ছাত্রদের একটি আন্দোলন কতটা বাস্তবতাবিবর্জিত, অমানবিক, অসাম্যমূখী ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হতে পারে তার প্রমাণ পাওয়া যায় এই আন্দোলনটি থেকে। তথাকথিত ‘মেধার অবমূল্যায়ন’ সূত্রে একদল শিক্ষিত, জ্ঞানার্থী মানুষও এদের খুব একচোট সমর্থন যুগিয়েছেন। কোটাবিরোধী আন্দোলনের কাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতির দিকটি তাই যতটাই হোক, স্বাধীন বাঙালির পরিশীলিত মননে এর নীতিগত ক্ষয়ক্ষতির দিকটি তাই আমার কাছে সবথেকে বেশি দুঃখজনক ও ঘৃণার্হ। এই আন্দোলনের কুশিলবগণ ও উদ্দেশ্য সমর্থনকারীদের তাই ক্ষণিকের ভুলে পা হড়কানো অর্বাচীন বলে মনে করি না।
আন্দোলনোম্মুখ জাতি হিসেবে বাঙালির ইতিহাসে এমন আরেকটি স্বার্থপর আন্দোলন বা আন্দোলন-প্রচেষ্টার উদাহরণ প্রায় নেই বললেই চলে। খুঁজতে গেলে দীর্ঘকাল যাবত কেবল অন্য একটাই ইতিহাস চোখে পড়ে। যা সংগঠিত হয়েছিল আজ থেকে প্রায় এক শতাব্দী পূর্বে। মুলত সেই ইতিহাসে প্রধান বিয়োগান্তক নায়কটিকে নিয়েই এই লেখা। বাঙালির মনে দেশবন্ধু হিসেবে আসন নেয়া রাজনীতিক চিত্তরঞ্জন দাসের কথা বলছি। আজ থেকে ১৫২ বছর আগে (৫ নভেম্বর ১৮৭০) জন্মগ্রহণ করেন এই দুরদৃষ্টিসম্পন্ন আইনজীবি, সুলেখক ও রাজনীতিক। তৎকালীন আধুনিক মানব ইতিহাসের মানবিকতম নীতিমালা তিনি গ্রহণ করেছিলেন বাঙালি সমাজের বিদ্যমান অর্থনৈতিক ও সামাজিক অসাম্য দূরীকরণের উদ্দেশ্যে। পশ্চিমা সভ্যতায় এসব ব্যাপারে তাত্ত্বিক আলাপ শুরুরও বহু বছর আগেই ১৯২৩ সালে ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ নামক এক নীতিমালায় দেশবন্ধু তৎকালীন সময়ে পিছিয়ে পড়া মুসলমান বাঙালিকে কোটাভিত্তিক সুযোগ প্রদানের মাধ্যমে সমাজের মূলধারায় তুলে আনার প্রচেষ্টা নিয়েছিলেন। কোটাভিত্তিক নিয়োগের মাধ্যমে জনসংখ্যার অনুপাতে চাকুরিক্ষেত্রে ৫৫% ও যতদিন পর্যন্ত এই অনুপাত নিশ্চিত না হয় ততদিন পর্যন্ত মুসলমান বাঙালিকে ৮০% নিয়োগদানের ব্যাপারে নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়। আধুনিক সমাজবিজ্ঞানে ‘অ্যাফার্মেটিভ অ্যাকশন/ ইতিবাচক ক্রিয়া’ ধারণা আসার বহু বহু আগেই এই বাঙালি মহামানব সেই ধারণার বাস্তবায়নে ব্রতী হয়েছিলেন। সে হিসেবে বৈশ্বিকভাবে এই বাঙালি রাজনীতিককে অ্যাফার্মেটিভ অ্যাকশন ধারণার প্রবর্তক বলে রায় দেয়া যেতে পারে!
এই ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ বংগীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসে সর্বসম্মতিতে গৃহীত হওয়া সত্ত্বেও একশ্রেণীর হিন্দু রাজনীতিক ‘মেধার অবমূল্যায়ন’ জাতীয় সেই ঠুনকো যুক্তি দিয়ে এর বিরুদ্ধে সংগঠিত হতে থাকে। দেশবন্ধুর মতো দেবতুল্য মানুষকে নিয়ে খিস্তি-খেউরের মেলা বসে তাদের পরিচালিত নানান গণমাধ্যমে। তবে প্রথমে উল্লেখিত ‘কোটাবিরোধী আন্দোলনের’ মতোই ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ বিরোধী এই আন্দোলনপ্রচেষ্টার সবথেকে বাজে দিক শুধু কাঠামোগত নয়, বরং জাতির মননের যে নীতিগত ক্ষতিটি এর মাধ্যমে হয়েছে তার তুলনা হয় না। সবথেকে বাজে দিক আমি মনে করি এই স্বার্থপর ও বৈষম্যমূখী আন্দোলনটিতে নানান কারণে এমন কিছু মানুষকে আমরা সমর্থন দিতে দেখি যারা নিজেদের দৃশ্যমান সাম্যবাদী চরিত্রের জন্য খ্যাতিমান। খুব বেশি নাম নেব না, কয়েকটা নাম বলি- সুরেন ব্যানার্জি, বিপিন পাল আর প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। শেষোক্ত এই লোকটি এমনকি দেশবন্ধুর মৃত্যুর দীর্ঘদিন পরেও নিজের লেখা প্রবন্ধে বেঙ্গল প্যাক্ট করবার জন্য দেশবন্ধুকে নিয়ে টিপ্পনি কেটেছেন ক্রমাগত! এদের সন্মিলিত বিরোধীতার কারণে, সুভাষ বসুদের মতো তরুণদের সমর্থন থাকা সত্ত্বেও, ১৯২৫-এ দেশবন্ধুর হঠাৎ মৃত্যুর সাথে সাথেই রহিত হয় ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’-এর মত প্রগতিশীল ও সময়োত্তীর্ণ ধারণাটি! এরই ফলশ্রুতিতে বাংলা ভূখণ্ডের অখণ্ডতা রক্ষার সর্বশেষ বাস্তব প্রচেষ্টাটি ব্যর্থ হয় যার মূল্য দিতে হয় ১৯৪৬-৪৭-এর দাঙ্গা আর ১৯৭১-এর ৩০ লক্ষ প্রাণ দিয়ে!
অথচ আজকে দেশবন্ধুর এই ১৫২তম জন্মদিনে এসে দাঁড়িয়েও আমাদের পরম বেদনার সাথে দেখতে হয় যে, স্বাধীন বাঙালির মূলধারায় চিত্তরঞ্জন দাস বা তার ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ নিয়ে আলাপ নেই বললেই চলে। দুঃখের সাথে উপলব্ধি করি যে, স্বাধীন বাঙালি দেশবন্ধুকে ভুলে গেছে। যেন তাকে খুব সফলভাবে ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে বাঙালির মানসপট থেকে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অষ্টম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত প্রতিটা শ্রেণিতে দেশবন্ধুকে অপমান করা, সাম্যের গান গাওয়া অথচ চরম মুসলমান-বাঙালি বিদ্বেষী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ারে লেখা কিশোরদের পড়ানো হচ্ছে! অথচ সুলেখক, সুসাহিত্যিক দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের একটি লেখাও স্বাধীন বাংলাদেশের পাঠ্যক্রমে নেই। কোনোদিন ছিলও না! দেশবন্ধুকে করে তোলা হয়েছে একটি বিস্মৃত নাম! দেশবন্ধুর মতো মহান, আধুনিক আর ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি নেতা, লেখককে উপেক্ষা করে সাম্প্রদায়িক ভণ্ডদেরকে পরিচিত করাব আমরা আমাদের কিশোরদের সাথে; আর সেই অর্বাচীনতাকে ছুতো করে ধর্মব্যবসায়ীরা যখন আমার ধর্মনিরপেক্ষ পাঠ্যক্রমে কাঁচি চালানোর দাবি তুলবে তখন বুঝে উঠতে পারব না ভুলটা কোথায় করলাম! হুমায়ূন আজাদের মতো করে বলতে হয়, আমাদের নীতিনির্ধারকেরা আজও শেখেনি কার সাথে পর্দায় যেতে হয়, আর কার সাথে শয্যায়।
১৫২তম জন্মজয়ন্তীতে দেশবন্ধুর প্রতি অসীম শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি। সেই সাথে দাবি জানাচ্ছি স্বাধীন বাঙালির মাধ্যমিকের পাঠ্যসূচিতে দেশবন্ধুর রচিত প্রবন্ধসমূহ অন্তর্ভুক্ত করবার।
https://twitter.com/urumurum/status/1456818853699153928
মাসুদ করিম - ৭ নভেম্বর ২০২১ (৩:২১ পূর্বাহ্ণ)
দুর্গাপূজায় সাম্প্রতিক তাণ্ডব: কারণ, দায় ও করণীয়
https://opinion.bdnews24.com/bangla/archives/67965
‘মা, ওরা বাবাকে মারলো কেন?’ ক্রন্দনরত ছেলেকে কী উত্তর দেবে সাম্প্রতিক সাম্প্রদায়িক হামলায় নিহত কোনো যুবকের তরুণী, বিধবা স্ত্রী? অন্তর্জালে একটি ছবিতে দেখলাম, চার বছরের অবুঝ ছেলেটিকে কোলে নিয়ে নির্বাক বসে আছেন এরকমই একজন। দৃষ্টিতে ভয়, শোক কিংবা কোনও প্রকার অনুভূতিই নেই। একেবারে থ হয়ে গেছে বধূটি দুর্ঘটনায় আকস্মিকতায়। কেউ বলছে, লাঠির আঘাতে, কেউ বলছে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেছে তার স্বামী। লাঠির আঘাত গুজব হতে পারে, কিন্তু হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া যে তার বন্ধ হয়ে গেছে সেটা তো মিথ্যা নয়।
স্বাধীনতার পঞ্চাশতম বার্ষিকীতে এ তরুণী বিধবা এবং তার দুধের বাচ্চাটির দিকে তাকানোর মতো মুখ আমাদের নেই। এমন এক ভূখণ্ডে আমরা জন্ম নিয়েছি, অনেক চেষ্টাতেও যা একটি কার্যকর ‘রাষ্ট্র’ হয়ে উঠতে ব্যর্থ হচ্ছে বার বার। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাতো দূর কী বাত। এবারকার দুর্গাপুজার দুর্গতদের বিচারে, তাণ্ডবের মাপকাঠিতে অন্তত, ইয়াহিয়ার পাকিস্তানের সঙ্গে ‘উন্নয়নশীল’ বাংলাদেশের মৌলিক কোনো তফাৎ নেই।
দুর্গাপূজাকালীন সাম্প্রতিক তাণ্ডবের কমবেশি যে ২০টি কারণ পাঠ্য-দৃশ্য-শ্রাব্য-সামাজিক-বুনিয়াদি গণমাধ্যমে কিংবা লোকজনের সঙ্গে আলাপে জানলাম-শুনলাম-দেখলাম, সেগুলো নিম্নরূপ:
১. প্রশাসনের সহায়তা কিংবা মদদে এ হামলা হয়েছে, কারণ ক্ষমতাসীন দল দেখাতে চায় যে তাদের ভোট দেওয়া ছাড়া সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু নির্বিশেষে বাংলাদেশের জনগণের গতি নেই।
২. এই হামলার পিছনে কলকাঠি নেড়েছে বিরোধী দল, কারণ তারা দেখাতে চায় যে ক্ষমতাসীন দল জনগণের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ।
৩. বাংলাদেশের শিক্ষা, সমাজ, রাজনীতি মানুষকে সাম্প্রদায়িক করে তুলেছে আশির দশক থেকে। বাংলাদেশে বিদ্যমান গত কুড়ি বছরের বিশেষ সমাজ-রাজনৈতিক আবহের কারণে সংখ্যাগুরু গোষ্ঠী সংখ্যালঘুদের ঘৃণা করতে শুরু করেছে।
৪. এই সব হামলার উদ্দেশ্য, স্রেফ হিন্দুর জমি দখল। যত দাঙ্গা হবে, তত বেশি হিন্দু দেশ ত্যাগ করবে। একটি গোষ্ঠী মনেপ্রাণে চায়, বাংলাদেশে হিন্দুর শতকরা সংখ্যা অচিরেই এককের ঘরে চলে আসুক এবং কয়েক দশকের মধ্যে পাকিস্তান-আফগানিস্তানের মতো শূন্যের কোঠায় চলে যাক। হিন্দুদের ফেলে যাওয়া খালি জায়গায় রোহিঙ্গা ভাইয়েরা থাকতে পারবে।
৫. কুমিল্লার হামলার কারণ স্থানীয় রাজনীতি- কোনো নেতা নিজের প্রভাব প্রদর্শন এবং/অথবা অন্যের প্রভাব ক্ষুণ্ণ করার জন্যে পরিকল্পিতভাবে হনুমানকাণ্ড ঘটিয়েছেন।
৬. হাজার হাজার পূজামণ্ডপের মধ্যে ৪/৫টি হামলা হতেই তো পারে, এক বস্তা চালেও কি কয়েকটি কাঁকড় থাকে না?
৭. অতিরিক্ত সংখ্যায় পূজা হচ্ছে, সরকারি চাল খয়রাত পাবার জন্যে হিন্দুরা যেখানে-সেখানে পূজামণ্ডপ তুলেছে। সরকার বেডরুমের নিরাপত্তা দিতে পারবে না বলেছে, পূজামণ্ডপের নিরাপত্তা কীভাবে দেবে?
৮. ভারতেও বর্ণহিন্দুরা হরিজনদের পূজামণ্ডপে হামলা করেছে। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুরা তো এক অর্থে হরিজনই, কারণ হরি তাদেরও দেবতা এবং তাদের সর্বস্ব হরণ করা সংখ্যাগুরুর পক্ষে জায়েজ বটে! সুতরাং উচ্চবর্ণের সংখ্যাগুরু নাগরিকেরা তাদের পূজামণ্ডপে আক্রমণ করতেই পারে!
৯. ‘উৎসব সবার, ধর্ম যার যার!’ এই শ্লোগান দিয়ে মুমিনদের বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। এক ধর্মের উৎসবে অন্য ধর্মের লোক সামিল হতে পারে না, বিশেষ করে মূর্তিপূজা হচ্ছে শিরক এবং দুর্গাপূজা হচ্ছে বাংলাদেশে শিরকের সর্ববৃহৎ আয়োজন।
১০. সংখ্যালঘুর ওপর এ আক্রমণ হয়েছে, যাতে এই অজুহাতে একটি গোষ্ঠী বাংলাদেশের সংবিধান ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে ধর্মনিরপেক্ষ করে তোলার দাবি তুলতে পারে। ধর্মনিরপেক্ষতা মানেই ধর্মহীনতা এবং তৌহিদী জনতা কখনই ধর্মনিরপেক্ষতাকে মেনে নিতে পারে না। সংখ্যালঘুর উপর এই হামলা তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী গোষ্ঠীর একটি চক্রান্ত বৈ নয়।
১১. আওয়ামী লীগ এখন তিনটি পৃথক দলের সমাহার: ক. ধর্মান্ধ আওয়ামী লীগ (যার ভিতরে আছে ক্লিনশেভ করা/হিজাব-খোলা বর্ণচোরা জামাত ও বিএনপি সমর্থক, ক্ষমতাকে যারা ঘিরে ফেলেছে), খ. ধান্দাবাজ আওয়ামী লীগ এবং মাঠে-ঘাটে ত্যাগী আওয়ামি লীগ। ধর্মান্ধ আওয়ামী লীগ সামাজিক গণমাধ্যমে জঙ্গি হুজুরদের সাম্প্রদায়িক প্রচারণা চালাতে দিচ্ছে এবং ধান্দাবাজ আওয়ামী লীগ ফোকটে নিজের স্বার্থ উদ্ধার করছে। ত্যাগী আওয়ামী লীগ ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চার মতো হতাশ তাকিয়ে আছে।
১২. ক্ষমতাসীন দল, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সব জায়গায় সাম্প্রদায়িক মানসিকতার লোকজন ঢুকে বসে আছে। তারা সময়মতো প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছে না, কিংবা নিতে গড়িমসি করছ। তারা আদেশ দিচ্ছে না, কিংবা আদেশ মানছে না, কিংবা আদেশ মানার ভান করছে। সর্বাঙ্গে ব্যথা, ঔষধ দিব কোথা?
১৩. সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা ব্যর্থ হয়েছে, যেমনটা তারা ব্যর্থ হয়েছিল কর্তৃপক্ষকে পিলখানা বিদ্রোহ, মোদির আগমন উপলক্ষে ঘটানো তাণ্ডবের পূর্বাভাস দিতে।
১৪. দেশে বহুদিন যাবৎ কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন হচ্ছে না। সত্যিকার গণতন্ত্রের দীর্ঘ অনুপস্থিতিতে এমনতরো অনাচার ঘটারই কথা!
১৫. সংখ্যালঘুর ওপর হামলার অপরাধীরা যেহেতু সরকারি দলের প্রভাবশালী সদস্য, সেহেতু তাদের শাস্তি দেওয়া যায় না। রামু, নাসিরগর ইত্যাদি ঘটনার না হয়েছে ঠিকমতো তদন্ত, না হয়েছে চিহ্নিত অপরাধীদের শাস্তি! শাস্তির বদলে দলীয় অপরাদীদের দেয়া হয় পুরস্কার, যেমন সম্প্রতি নাসিরনগরের চিহ্নিত দুই সন্ত্রাসী নির্বাচনে মনোনয়নও পেয়েছিল ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে। বিচার ও শাস্তির অনুপস্থিতিতে দলীয় কুচক্রীদের সাহস দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে।
১৬. বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম এবং বাংলাদেশ ৯০% ভাগ মুসলমানের দেশ। দুর্গাপূজা হচ্ছে শিরক এবং মুসলমানকে শিরকের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতেই হবে। কাবাশরীফের মূর্তিগুলো ভাঙা হয়েছিল, লাত, উজ্জা ইত্যাদি দেবীর মূর্তি ধ্বংস করতে রসুল (স.) নিজে আদেশ দিয়ে পাঠিয়েছিলেন খালেদ বিন ওয়ালিদকে।
১৭. সংখ্যালঘুদের মধ্যেও সাম্প্রদায়িক মানসিকতা আছে। তারও ধোয়া তুলসীপাতা নয়, কারণ কখনই তারা স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি কিংবা বিএনপি-জামাতকে ভোট দেয় না। সুতরাং হামলার জন্য তারাও কিছুটা দায়ীতো বটেই।
১৮. বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা সৃষ্টি করা হয়েছে, যাতে ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গসহ সারা ভারতে বিজেপি ও মোদির গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পায়। এ কারণেই মোদি সরকার এই হামলার ব্যাপারে চুপচাপ। এর প্রমাণ, ইতিমধ্যে ত্রিপুরায় মুসলিম সংখ্যালঘুদের বাসস্থান ও ধর্মস্থানে হামলা হয়েছে। ভুক্তভোগীদের কেউ কেউ বলছে, গত ত্রিশ বছরে বাম ও কংগ্রেস শাসনে তারা এমন হামলা দেখেনি। বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই হামলা শুরু হয়েছে।
১৯. হিন্দুদের উপর হামলার কারণ, ৭২ এর সংবিধান, যাতে ধর্মনিরপেক্ষতা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা যদি না থাকতো, সংবিধান যদি পাকিস্তানের মতো ইসলামী প্রজাতন্ত্র হতো, তাহলে হিন্দুরা নিরাপদে থাকতো পাকিস্তানে এবং বাংলাদেশে।
২০. হিন্দুরা পাকিস্তান আমল থেকে একের পর এক ভুল করে আসছে। পাকিস্তানের জন্মের পর পরই তারা প্রথমে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছে এবং তারপর যুক্তফ্রন্ট এবং আওয়ামী লীগকে সমর্থন করেছে। পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ করাতে হিন্দু এবং হিন্দু ভারতের ভূমিকাই প্রধান। পাকিস্তানের মূল চেতনার বিরোধী হওয়াতেই হিন্দুদের ওপর যত হামলা, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ আমলে।
উপরোক্ত কারণগুলোর মধ্যে কোনটি বা কোনগুলো সত্য তা আমরা কখনই জানতে পারবো না, কারণ এসব নিয়ে কোনো গুণগত বা সংখ্যাগত গবেষণা আগেও হয়নি, এবারও হবে না। ১৯৪৭ সাল থেকে পূর্ববঙ্গে শত শত সাম্প্রদায়িক হামলা হয়েছে বটে, কিন্তু সরকার কখনও জানতে দেয়নি, দাঙ্গার জন্যে কে দায়ী। পাকিস্তান আমলে একটি গোষ্ঠীর চেষ্টা ছিল, সব হিন্দু ভারতে চলে যাক। বঙ্গবন্ধু বহু চেষ্টা করেছেন পূর্ববঙ্গের দাঙ্গা থামাতে, সোহরাওয়ার্দী তাঁর রাজনৈতিক ক্যারিয়ার জলাঞ্জলি দিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের রক্ষা করার দুশ্চিন্তায়।
এখন একটি গোষ্ঠী চেষ্টা করছে, বাঙালি মুসলমান যেন ১৯৪৭ এর ঘোর থেকে বের হতে না পারে, সে যেন ভুলে যায়, ১৯৭১ সালে একটি মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। এদের সাম্প্রতিক দর্শনটা হচ্ছে এরকম:
“১৯৭১ এর যুদ্ধ আসলে স্বাধীনতা যুদ্ধ ছিল না, এটি ছিল মূলত লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়নের চেষ্টা। লাহোর প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, ভারতের দুই প্রান্তে দুটি মুসলিমপ্রধান রাষ্ট্র থাকবে। দুর্ভাগ্যক্রমে পূর্বপ্রান্তের রাষ্ট্রটির নাম ‘বাংলাদেশ’, নামটি ইষৎ ‘না-পাক’, কিন্তু তাতে কী, লাহোর প্রস্তাবে তো দেশ দুটির কোনো নাম ছিল না!”
সংখ্যালঘুরা যত বেশি সংখ্যায় বাংলাদেশ ছেড়ে যাবে, ততই পূর্বপ্রান্তের দেশটি অধিকতর মুসলিম প্রধান হয়ে উঠবে, ঠিক যেভাবে পাকিস্তানে সংখ্যালঘুর সংখ্যা কয়েক লক্ষ, কিংবা আফগানিস্তানে কয়েক হাজারে নেমে গেছে। উপমহাদেশের দুই প্রান্তে সংখ্যালঘুর সংখ্যার পারদ ক্রমহ্রাসমান। বাংলাদেশে হিন্দুদের সংখ্যা এককের সর্বনিম্ন ঘরে নিয়ে আসার পর যে কয়েক লক্ষ তখনও ভাগশেষ থাকবে, ‘এক হাতমে তলোয়ার, আরেক হাতমে গ্রন্থ’ নিয়ে তাদের সামনে দাঁড়ালেই আফগানিস্তানের কাফির জনগোষ্ঠীর মতো তারা সদলবলে ধর্মান্তরিত হবে। কাফিরিস্তানের ধর্মান্তরিত নাম আজ ‘নূরিস্তান’।
কোনো সাম্প্রদায়িক হামলাই স্বতঃস্ফূর্ত নয়, ১০০ শতাংশ আরোপিত। সব হামলাই আসলে হোলি আর্টিজান, পার্থক্য শুধু তীব্রতা ও গুরুত্বের। প্রতিটি হামলার একটি গ্রাহকগোষ্ঠী থাকে এবং তারা হামলার বরাৎ দেয়। প্রতিটি এলাকায় একাধিক হামলা সরবরাহকারী গোষ্ঠীও থাকে, কারণ অর্থনীতির নিয়মে চাহিদা থাকলে সরবরাহ থাকবেই। গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা/নিলামের ভিত্তিতে হামলার বরাৎ দেওয়া হয়, অনেকটা পদ্মা বা যমুনা সেতুর মতো। হলি আর্টিজানের হামলা, শ্রীলঙ্কায় বোমা হামলার জন্য আন্তর্জাতিক নিলাম হওয়ার কথা এবং কুমিল্লা বা রংপুরের হামলার জন্যে হয়তো আন্তর্জাতিক/আঞ্চলিক/আভ্যন্তরীণ নিলাম হয়েছে। কোথায় হামলা হবে, কখন হবে, কীভাবে হবে, সব পূর্বনির্ধারিত। একাধিক রেস্টুরেন্ট বেছে নিব্রাসরা অবশেষে হলি আর্টিজানে ঢুকেছিল।
হামলার বরাৎ যারা দেয়, তাদের কত রকম স্বার্থ থাকতে পারে। এই যেমন ধরুন, বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক শান্তি বিঘ্নিত হলে ত্রিপুরার নির্বাচনে বিজেপি ভাল ফল করার কথা। বাংলাদেশে বিরোধীদল দীর্ঘ এক যুগ ক্ষমতায় নেই। অপেক্ষার, সহ্যেরও তো একটা সীমা আছে, নাকি! ওরা হয়তো বলবে, ক্ষমতাসীনেরাই এর বরাৎ দিয়েছে, প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বাবর যেমন বলেছিল, ‘শেখ হাসিনাই পল্টনে নিজের ওপর গ্রেনেড হামলা করিয়েছে!’ ষড়যন্ত্রতত্ত্ব মতে সবই সম্ভব। এ সবই অবশ্য আমার কল্পনা, তবে রবীন্দ্রনাথ যেমন লিখেছেন: ‘কবি তব মনোভূমি রামের জনমস্থান অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো!’
পুরাণে দুই অসুরের গল্প আছে: বাতাপি ও ইল্বল। কোনো ঋষিকে দেখামাত্র ইল্বল মহা সমাদরে তাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যেতো। ইতিমধ্যে বাতাপি ছাগলের রূপ ধারণ করতো এবং ইল্বল ভাইকে কেটে রান্না করে খাওয়াতো ঋষিবরকে। খেয়েদেয়ে ঋষি যখন তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছেন, তখন ইল্বল ‘বাতাপি বাতাপি’ বলে ডাক দিতো। বাতাপি তখন স্বরূপ ধারণ করে ঋষির পেট ফুঁড়ে বেরিয়ে আসতো, যার ফলে বেঘোরে মৃত্যু হতো সেই ঋষির। ঋষিহত্যা থামাতে অগ্যস্ত মুনি আসলেন একদিন ইল্বলের অতিথি হয়ে। ইল্বল তাকে পাদ্য-অর্ঘ্য দিয়ে স্বগৃহে নিয়ে গিয়ে যথারীতি ছাগলরূপী বাতাপিকে কেটে খাওয়ালো। সবটুকু মাংসই খেলেন তিনি, একেবোরে ঝোলের তলানিটুকুও চেছেপুছে। তারপর ‘বাতাপি ভস্ম’ মন্ত্র পড়ে পেটে কয়েক বার হাত বুলিয়ে বাতাপিকে হজমই করে ফেললেন। হতবাক ইল্বলকেও ঋষি ভস্ম করলেন ব্রহ্মতেজে।
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা থামাতে আসা গান্ধীর ছাগলকে নাকি কেটে খেয়ে ফেলেছিল নোয়াখালির দাঙ্গাবাজেরা। দুই বার দেশভাগ এবং লক্ষ লক্ষ সংখ্যালঘুকে হত্যা ও দেশছাড়া করার পরও নোয়াখালির ইল্বল ও বাতাপিদের গায়ের ঝাল যে মেটেনি, তার অতি সাম্প্রতিক প্রমাণ পূজায় তাণ্ডব। জানি না, শুভবুদ্ধিরূপী অগস্ত্য মুনি কবে এদেশে আগমন করবেন, নাকি বাংলাদেশের বেহাল ভাবসাব দেখে ‘অগস্ত্য যাত্রা’ই করেছেন তিনি, এ জীবনে আর ফিরবেন না বলে!
সংখ্যালঘু সর্বত্রই দেশ ত্যাগ করে, প্রায় কখনই যে রুখে দাঁড়ায় না, দাঁড়াতে পারে না, তার প্রমাণ প্যালেস্টাইনি, রোহিঙ্গা, সিরিয়ান মুসলমান আজ স্বদেশ ত্যাগ করে পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ডে এখনই বেশ কিছু বাংলাদেশি গারো-চাকমা-বড়ুয়া-হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা পাবেন। গত কুড়ি বছরে গড়ে উঠেছে এসব এলাকা ধীরে ধীরে।
ইউরেনিয়াম আইসোটোপ তেজষ্ক্রিয়তা হারিয়ে সীসায় পরিণত হয় শুনেছি। সব সংখ্যালঘু, সব ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বিতাড়িত হলে বাংলাদেশও পাকিস্তান-আফগানিস্তানের মতো সীসা-দেশে পরিণত হবে। তখন সেখানে প্রথমে আক্রান্ত হবে, আহমদিয়া, শিয়া মুসলমান এবং তারপর জেলাভিত্তিক মুসলমানরা ‘যুদ্ধং দেহি’ বলে পরস্পরের মুখোমুখি হবে, অসম্ভব কী! এমন একটি সীসামার্কা দেশ যদি আমাদের কাম্য হয়, তবে আগামী কয়েক বছর কয়েকটি দুর্গাপূজায় তাণ্ডব চালানোই যথেষ্ট। খুব একটা খরচও নেই, একটি হনুমানের মূর্তি বানাতে আর কী এমন খরচ। আসল একটি হনুমানকেই বসিয়ে দিলেই বা সমস্যা কী!
যেকোনও হামলার পর ফেইসবুকে সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর কোনও কোনও সদস্য পোস্ট দেয়:
দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে, এবার রুখে দাঁড়াতে হবে। অনেকে এও বলে, হিন্দু যুবক-যুবতীদের জুডো-ক্যারাটে শিখাতে হবে, যাতে তারা আত্মরক্ষা করতে পারে। ভাগ্য ভালো যে এখনও কেউ সংখ্যালঘুদের সশস্ত্র হবার বুদ্ধি দিচ্ছে না। সংখ্যাগুরু সদস্যদের মধ্যে কেউ কেউ অভিযোগ করে, হিন্দুরা ভয় পেয়ে খামাখা কেন ভারতে পালিয়ে যায়? কেন ভারতীয় মুসলমানদের মতো মাটি কামড়ে মাতৃভূমিতে পড়ে থাকে না তারা? হিন্দুরা আসলে দুদেল বান্দা, কলমাচোর। তারা বাংলাদেশেরও খায়, ভারতেরও কুড়ায়। বাংলাদেশের সম্পদ তারা বিদেশে পাচার করছে। সরকারের উঁচু পর্যায় থেকেও বলা হয়, সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু ও কিছু না। নিজেদের আপনারা সংখ্যালঘু মনে করবেন না, আপনারা সবাই এদেশেরই নাগরিক, আমাদেরই মতো।
সত্য বটে, সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু মূলত একটি কুসংস্কার, জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আগে যার অস্তিত্বই ছিল না। এই কুসংস্কার জাতিরাষ্ট্রে সংখ্যালঘু নিপীড়নে আকছার ব্যবহৃত হচ্ছে। জাতিরাষ্ট্রের প্রশাসন সাধারণত সংখ্যাগুরুর পক্ষে যায়। প্রশাসনের প্রত্যক্ষ সহায়তা ছাড়া সংখ্যাগুরু কখনই সংখ্যালঘুকে দেশছাড়া করতে পারার কথা নয়। বিশ্বাস না হলে রোহিঙ্গাদের জিগ্যেস করে দেখুন।
শরীরচর্চা করে কিংবা সশস্ত্র হয়ে কোনো জাতিরাষ্ট্রে সংখ্যালঘু নিজেকে রক্ষা করতে পারবে না। ১৯৪৭ এর দেশ ভাগের সময় পুরান ঢাকার ওয়ারী ছিল একটি হিন্দুপ্রধান এলাকা। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই এই জনচিত্র পালটে গিয়েছিল। পুরান ঢাকার মুকুল সিনেমার মালিক মুকুল বাবুর স্বাস্থ্য খুব ভালো ছিল, এলাকার নেতাও ছিলেন তিনি। একদিন সকালে তার গলাকাটা লাশ সিনেমা হলের সামনে দেখার পর তার নিকটাত্মীয়েরা সেই যে ভারতে চলে গেলেন, অদ্যাবধি বাংলাদেশের নামও শুনতে পারেন না। ঢাকায় সব স্বদেশী করা স্বাস্থ্যবান যুবকেরা ছিলেন। কী করতে পেরেছেন তারা? কেন কিছু করতে পারেননি? এমনটা হওয়ার অন্যতম নয়, একমাত্র কারণ, পাকিস্তানের প্রশাসন ছিল সংখ্যাগুরু মুসলমানের পক্ষে।
পক্ষান্তরে পশ্চিমবঙ্গে, কলকাতায় দাঙ্গা হয়েছে, কিন্তু কোনো মুসলিমপ্রধান অঞ্চল, কলকাতার মুসলিম প্রধান এলাকা, যেমন মেটিয়াবুরুজ কিংবা নিউ মার্কেট- কখনই হিন্দুপ্রধান হয়ে ওঠেনি। এর কারণ কী? পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানেরা কি বাংলাদেশের হিন্দুদের তুলনায় বেশি সাহসী, স্বাস্থ্যবান ছিল? না, এর পেছনে অন্যতম কারণ, পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসন বেশিরভাগ সময় দাঙ্গাবাজ হিন্দুদের সহায়তা করেনি। অথচ ভারতেই যেখানে মুসলমানেরা আক্রান্ত হয়েছে, হচ্ছে, সেখানেই প্রশাসন আক্রমণকারীদের পক্ষে ছিল কিংবা আছে। ১৯৮৫ সালে প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদদেই দিল্লিতে হাজার হাজার শিখ খুন হয়েছিল। নোয়াখালিসহ সারাদেশে যেভাবে হিন্দুদের ওপর আক্রমণ হলো, প্রশাসন কিংবা রাজনৈতিক দল সক্রিয় থাকলে কখনই সেটা সম্ভব হতো না।
পুরো সংখ্যালঘু গোষ্ঠী একজোট হলেও নিজেদের রক্ষা করতে পারবেন না কোনো জাতিরাষ্ট্রে, যদি তাদের পিছনে প্রশাসনের কার্যকর সমর্থন না থাকে। বেশি দূরে যাবার দরকার কী, সরকার বদল হলে, লেজুর ছাত্রসংগঠনের নেতারা যে রাতের অন্ধকারে পালিয়ে যায়, কিংবা নারায়ণগঞ্জের প্রবল শক্তিধর নেতাকেও যে দ্বিতীয় বিএনপি আমলে কানাডায় পালিয়ে প্রাণ বাঁচাতে হয়েছিল, সে তো প্রশাসনের সমর্থনহীনতার কারণেই।
প্রশাসনের ভেতরের কারও মদদ ছাড়া সংখ্যালঘুর ওপর হামলা হয় না। বড়দের মুখে শুনেছি, আমাদের কুমিরা গ্রামে ১৯৫০ সালের রায়টের রাতে পুলিশ আসেনি, এসেছিল পরদিন সকালে। আগের রাতে যারা নির্বিচারে হিন্দু প্রতিবেশিদের খুন করেছিল, তারা তখন ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি দিয়ে ঢাকা ট্রাঙ্ক রোডেই খোলা তলোয়ার হাতে মিছিল করছিল। তাদের দুই-একজনকে ধরে, পুলিশসুলভ দুই একটি খিস্তি করে, দুই একটা চড়-থাপ্পড় দিয়েই কর্তব্য শেষ করেছিল সীতাকুণ্ড থানার কনস্টেবলেরা।
এই খুনিদের একজন কুমিরা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা (স্কুলের জমিটা তার দান) নিবারণ চন্দ্র দাশকে খুন করে মৃতদেহকে টুকরা টুকরা করেছিলেন। তিনি নিবারণ দাশের প্রিয় ছাত্রও ছিলেন, নিবারণ দাশের অর্থানুকূল্যেই তার জীবন চলতো। মরণোন্মুখ নিবারণ দাশ নাকি বলেছিলেন: ‘রফিক (নাম বদলানো হয়েছে, বদলাতে হলো, কারণ তাঁর উত্তরপুরুষেরা আমার এলাকার ছোট ভাই, আমি তাদের প্রিয় দাদা!), তোকে যে এতদিন ধরে মানুষ করলাম, তুই তার এই প্রতিদান দিলি!’ এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন দানবীর শিক্ষাব্রতী নিবারণ দাশের পরিবারের মেয়েরা, যারা তখন পাশের ঘরে লুকিয়ে মৃত্যুভয়ে থরহরি কম্পমান।
রফিকের সঙ্গে আমার দাদুর দুটি সংলাপ এলাকায় বিখ্যাত ছিল। এক. ১৯৫০ সালে রায়টে আগের রাতে পুড়ে যাওয়া মাটির ঘর সাফ করছিলেন আমার দাদু। রফিক এসে বললো: ‘আহা ঠাকুরদা, আপনার মতো লোকের ঘরেও কেউ আগুন দেয়!’ দাদুর সপ্রতিভ উত্তর ছিল: ‘রাতে আগুন যখন দিয়েছিলে, কথাটা তখন মনে ছিল না!’ দুই. এই একই রফিক সাহেব আইউব খানের মৌলিক গণতন্ত্রের নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন বিডি (বেসিক ডেমোক্রেসি) মেম্বর পদে। দাদুর কাছে ভোট চাইতে এলে নিবারণ দাশকে নৃশংসভাবে হত্যা করার কথা রফিককে তিনি স্মরণ করিয়ে দেন। রফিক কাঁচুমাচু হয়ে উত্তর দিয়েছিলেন: ‘তখন বয়স কম ছিল, রক্তও গরম ছিল, ভুল হয়ে গেছে, মাফ করে দেওয়া যায় না?’ মাফ না করে সংখ্যালঘুর আর উপায়ইবা কী! রফিক পরে ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হয়েছিলেন, স্কুল কমিটির সভাপতিও ছিলেন।
আমরা লক্ষ্য করতে পারি, পুরো পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলজুড়ে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলাকারীদের কারোরই কোনো শাস্তি হয়নি। তারা প্রত্যেকে সুখে-শান্তিতে দীর্ঘ জীবন যাপন করে স্বশয্যায়, সসম্মানে মৃত্যুবরণ করেছেন। ইহজগতে কোনো শাস্তিই তারা পায়নি, পরলোক যদি থাকে, সেখানে হয়তো তাদের বিচার হলেও হতে পারে। বিশ্ববেহায়ার মতো ব্যক্তি আজীবন নিজের ও পরের ভার্যাদের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে অতি বৃদ্ধ বয়সে সসম্মানে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। পরকালের ভরসায় থেকে পৃথিবীতে শাস্তি না হলে অপরাধী একই অপরাধ বার বার করবে প্রয়োজনে বা সুযোগ বুঝে এবং সম্ভাব্য অপরাধীরাও একই অপরাধ করতে উৎসাহিত হবে। বিচারহীনতার ফলে বাংলাদেশের গ্রামগুলো হিন্দুশূন্য হচ্ছে গত সত্তর বছর ধরে।
বাংলাদেশে দুর্গাপূজায় সাম্প্রতিক তাণ্ডবের বেশ কিছু সমাধান উদারবাদীরা দিয়েছেন: ১. মানুষের মনে শুভবুদ্ধি জাগ্রত করতে হবে। এই লক্ষ্যে ফেইসবুকে পোস্ট দিতে হবে, প্রতিবাদ মিছিল-সভা-সমাবেশ করে বক্তব্য দিতে হবে; ২. সংবিধানকে ধর্মনিরপেক্ষ করতে হবে। ৩. দোষী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে অতি সত্বর শাস্তিবিধান করতে হবে; ৪. দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে হবে। ৫. প্রশাসনে যাদের বিরুদ্ধে আদেশ পালন না করা বা আদেশ পালনে দীর্ঘসূত্রিতার অভিযোগ পাওয়া যাবে, তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ৬. অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠনের লক্ষ্যে শিক্ষাকে অসাম্প্রদায়িক করে তুলতে হবে, অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি যেমন কবিগান, বাউলগান, যাত্রাপালা, পালাগান ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হবার মতো পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। এগুলো উদারবাদীদের প্রদত্ত সমাধান এবং সরকারের কাছে উত্থাপিত দাবি।
রাজনীতিবিদেরা একে অপরের দোষ দিচ্ছেন। বলা হচ্ছে, কিছু সাম্প্রদায়িক দল এই অপকর্ম করছে। কিন্তু পাগলেও বিশ্বাস করবে না, মার্কামারা সাম্প্রদায়িক দলগুলো এই অপকর্ম করতে সক্ষম, যখন কিনা সরকারি প্রশাসন এবং সরকারি দলের অনিচ্ছায় গাছের পাতাটিও নড়ে না। কিছু সম্ভাব্য অপরাধীকে চিহ্নিত করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। পুলিশ কর্মকর্তারা ইতিমধ্যে বদলি হয়েছেন, যা ইঙ্গিত করে যে ‘ডালমে কুছ না কুছ কালা’ ছিল। ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেবার আদেশ হয়েছে। বুদ্ধিজীবীরা প্রথমে (সম্ভবত হতবুদ্ধি হয়ে) বাতাস কোনদিকে যায়, বোঝার চেষ্টা করেছে, সামান্য প্রতিবাদটুকুও করেনি। কয়েক দিন পর বাতাস বুঝে তারা সভা-সমাবেশ-মিছিল-পথনাটক শুরু করেছেন। অসাম্প্রদায়িক সংবিধানের দাবিও উঠতে শুরু করেছে। নিন্দুকেরা বলছে, বুদ্ধিজীবী-সংস্কৃতিকর্মীরা সরকারের কোনো অপকর্মের প্রতিবাদ কখনও করে না, এখন সংখ্যালঘু নির্যাতনের প্রতিবাদ করলেই লোকে তাদের কথা গুরুত্ব দিয়ে শুনবে কেন?
মৌলবাদীরা বলেছেন, ধর্মীয় ব্যাপারে বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদদের নাক গলানো বন্ধ করতে হবে, কারণ এই বিষয়ে বলার মতো জ্ঞান ও অধিকার আছে কেবল ধর্মগুরুদের, বিশেষ করে ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’- এর মতো অন্তঃসারশূন্য কথাবার্তা বলা বন্ধ করতে হবে। ইসলাম ধর্মীয় বক্তাদের মধ্যে কেউ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উপর জোর দিয়েছেন মদিনায় এবং অন্যত্র হজরত মুহম্মদের (স.) সংখ্যালঘুদের প্রতি আচরণের রেফারেন্স দিয়ে। কেউ বা আবার বলেছেন, কোরানের অবমাননা বরদাস্ত করা হবে না। হিন্দু ধর্মীয় নেতারা নিন্দা ও হতাশা জানিয়ে সংখ্যালঘুদের দেশত্যাগের অনিবার্যতার দিকে ইঙ্গিত করেছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ৭২ এর সংবিধানে ফিরে যাবার দাবিও জানিয়েছেন।
উপরের সমাধানগুলো প্রত্যেকটিই হয়তো কমবেশি কাজের। সচেতন নাগরিক একজোট হয়ে মিটিং-মিছিল-সমাবেশ-পথনাটক করতেই পারে, কিন্তু এসব কখনই সংখ্যলঘু নিপীড়নের কার্যকর ও স্থায়ী সমাধান হবে না। মূল কাজটা যে করতে হবে রাষ্ট্র তথা প্রশাসনকে’ এ ব্যাপারে সবাই কমবেশি একমত। সব দেশে, সব কালে সংখ্যালঘু নিপীড়নের জন্যে প্রশাসন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দায়ী থাকে। সুতরাং এক বাক্যে প্রশাসনকে দোষ দিচ্ছে সকলেই, দেওয়ারই কথা, কারণ দায়িত্ব প্রশাসনের। দায়িত্ব পালন করতে না পারলে প্রশাসন অন্তত স্বীকার করুক, ব্যর্থতার জন্যে ক্ষমা চাক।
বিচার, শাসন, আইন প্রণয়ন, শিক্ষা ইত্যাদি মিলিয়ে রাষ্ট্রের চতুরঙ্গকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, বাংলাদেশ রাষ্ট্র আসলে কী চায়। সংখ্যালঘু বিতাড়ণে যদি রাষ্ট্রের মঙ্গল হয়, তবে সেই পথেই হাঁটা উচিত। ঢাক ঢাক গুড় গুড় করে লাভ নেই। ঝেড়ে-কাশাটাই সবার জন্যে মঙ্গল। যদি সংখ্যালঘুদের পরিষ্কার বলে দেওয়া হয়, মায়ানমারের বর্মী বৌদ্ধরা যেমনটা বলেছে রোহিঙ্গাদের: ‘বাপু তোমাদের আর এ দেশে থেকে কাজ নেই, তোমার নিজের নিজের পথ দেখো!’, তবে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরাও তাদের আশু করণীয় ঠিকই করে নিতে জানবে।
এতে সংখ্যালঘুরা হয়তো সাময়িক কষ্ট পাবে, কিন্তু দুই-এক প্রজন্ম পরেই সবাই সব কিছু ভুলে যাবে। ভাসানচর কি ইতিমধ্যেই অনেক রোহিঙ্গার নতুন আবাসভূমি হয়ে উঠেনি? আমারই কতো নিকটাত্মীয় নিজের প্রাণ আর পরিবারের মা-মেয়ের ইজ্জতটুকু বাঁচাতে পাকিস্তানের পৈত্রিক ভদ্রাসন ছেড়ে গিয়ে উড়িষ্যার দণ্ডকারণ্যের গহীন জঙ্গলে জীবনপাত করেছেন। যারা যাননি তারা যে কম বেশি যতন সাহার মতো মৃত্যুঝুঁকিতে আছেন- তাতে কি সন্দেহের কোনো অবকাশ আছে?
ইতিহাস বলে, পাকিস্তান-আফগানিস্তানের বর্তমান দুরবস্থা ও ব্যর্থতা থেকেও অনুমান করা যায়, সংখ্যাগুরুর এই সিদ্ধান্ত তার নিজের জন্যই বুমেরাং হবে, নিজের কবর নিজেই খুঁড়বে সে। কেন? উপনিষদে বলা হয়েছে: ‘স বৈ নৈব রেমে, স দ্বিতীয়ম অইচ্ছত’ অর্থাৎ ‘সে একা আনন্দ পেলো না, সে দ্বিতীয়কে ইচ্ছা করলো!’ কোরানের ৪৯নং সুরা আল হুজুরাতের ১৩নং আয়াতে বলা হয়েছে: ‘হে মানবকূল, তোমাদের আমি একাধিক কওমে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পরকে জানতে পারো’। এর অর্থ বৈচিত্র্যই জীবনের ধর্ম, সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু মিলেমিশে থাকাটাই রাষ্ট্রের জন্য মঙ্গল।
জনবৈচিত্র্য যে একটি দেশের প্রকৃত সম্পদ, কোনোমতেই আপদ নয়- এই স্বতঃসিদ্ধ এখন প্রতিষ্ঠিত সত্য। আমরা যদি জোর করে বিদ্যমান বৈচিত্র্য ধ্বংস করি, তবে অচিরেই নতুন বৈচিত্র্য সৃষ্টি হবে। আফগানিস্তানে হিন্দু নেই, কিন্তু আন্তমুসলিম/আন্তর্জাতিক সাম্প্রদায়িকতা সেখানে প্রায় প্রতিদিন রক্ত ঝরিয়ে যাচ্ছে। পাকিস্তান কিংবা আফগানিস্তানে ধর্ম কি মানুষকে একসূত্রে গাঁথতে সক্ষম হয়েছে?
দেশের উন্নতি কিংবা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বার্থে যদি সংখ্যালঘুর সংরক্ষণ অপরিহার্য হয়, সংখ্যার লঘু-গুরু যদি আসলেই একটি কুসংস্কার হয়, তবে সংখ্যালঘুকে সর্বতোভাবে রক্ষার চেষ্টা করতে হবে সংখ্যাগুরুকে এবং রাষ্ট্রের প্রশাসনকে। সংখ্যালঘু প্রকৃতিগতভাবে দুর্বল বলে তাকে রক্ষায় সম্ভাব্য সব রকম যত্নেরও প্রয়োজন হবে। সংখ্যালঘুর মনে স্বস্তি ও রাষ্ট্রের প্রতি বিশ্বাস ফিরিয়ে আনা সহজ কাজ নয়। পৃথিবীর বড় বড় জাতিরাষ্ট্রগুলোও অনেক ক্ষেত্রে এ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। মনে রাখতে হবে, সংখ্যার লঘুগুরু একটি আপেক্ষিক ব্যাপার। বাঙালি মুসলমান তার ডানে-বাঁয়ে শ পাঁচেক মাইল অতিক্রম করেই ভারত বা মায়ানমারে গিয়ে সংখ্যালঘু হবার স্বাদ নিয়ে আসতে পারে।
দুর্গাপূজায় তাণ্ডবের সমস্যাটা আগাপাশতলা রাজনৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবেই এর সমাধান করতে হবে। রাজনৈতিক সমাধানের প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে, সব রাজনীতির যা ভিত্তি, রাষ্ট্রের সেই সংবিধানটিকে ধর্মনিরপেক্ষ হতে হবে। ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার এবং সে কারণেই রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম থাকতেই পারে না। সংবিধানে সংখ্যাগুরুর ধর্ম রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে রাখা হলে রাষ্ট্রই চরিত্রহীন হয়ে যায়, কারণ আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের সূত্রপাত যে ফরাসি বিপ্লবে, সেই ফরাসি বিপ্লবের দৃষ্টিকোণ থেকে ধর্মের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক একটি নিষিদ্ধ রাজনৈতিক আচরণ। সংখ্যালঘুর মনে নাগরিকত্বের বোধ পুনস্থাপনের জন্যও ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান অপরিহার্য।
কাজীর গরু কাগজে থাকলেও যে গোয়ালে থাকবে না সেটা জানি, কিন্তু গোয়াল নয়, প্রথমে কাগজটাই ঠিক করতে হবে। বিচার করা নয়, সভ্যতার প্রথম সোপানই হচ্ছে আইন প্রণয়ন করা এবং তার পর সেই আইনের ভিত্তিতে বিচার হবে, আইন কেউ না মানলে শাস্তিবিধান হবে। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বজায় রেখে ধর্মনিরপেক্ষ কিংবা ধর্মীয় সন্ত্রাসমুক্ত বাংলাদেশ গঠনের স্বপ্ন সোনার পাথরবাটি।
কাগজ ঠিক করার পর গোয়ালের দিকে নজর দিতে হবে কাজীকে। শিক্ষা, বিচারব্যবস্থা, প্রশাসনসহ রাষ্ট্রের চতুরঙ্গকে অসাম্প্রদায়িক করে তুলতে হবে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই এটা করা সম্ভব। একই সঙ্গে চেষ্টা করতে হবে, রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ মিডিয়া যাতে এতটাই স্বাধীন ও দায়িত্বপরায়ন ওঠে যে বাকি তিনটি স্তম্ভের কর্তব্যে যে কোনো প্রকার বিচ্যুতি তারা জনসমক্ষে নিয়ে আসতে পারে। সরকারকে বুদ্ধিজীবীদের কথা আমলে নিতে হবে এবং বুদ্ধিজীবীদেরও লোভের মুখে লাগাম দিয়ে সরকারের লেজুরবৃত্তি বন্ধ করতে হবে।
অসাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে কোনো ছাড় দেওয়া যাবে না। ‘দুদেল বান্দা কলমা চোর, না পায় শ্মশান না পায় গোর’। রাষ্ট্র ও জনগণকে প্রথমে লক্ষ্য বা নিয়ত ঠিক করতে হবে এবং ঠিক রাখতে হবে। হিন্দু লেখকের রচনা সিলেবাসে বেশি রাখা যাবে না, নজরুলের রচনায় ‘মহাশ্মশান’ লেখা থাকলে সেটাকে কেটে ‘গোরস্থান’ করে দিতে হবে, মুসলমানের বাংলা নাম রাখা যাবে না, কারণ বাংলা হচ্ছে হিন্দুয়ানি ভাষা, বাসে-ট্রেনে ওঠামাত্র সাঈদীর ওয়াজের রেকর্ড শুরু হবে যাতে সংখ্যালঘুদের হেয় এবং ধর্মান্তরিত করার খবর সগৌরবে বয়ান করা হচ্ছে … এইসব ‘ছোট বালুকার কণা বিন্দু বিন্দু জল’ যুক্ত হয়ে ১৯৪৭ সাল থেকে অদ্যাবধি সাম্প্রদায়িকতার এক অতল সাগর সৃষ্টি হয়েছে যাতে ডুবে মরতে যাচ্ছে পুরো জাতি। পশ্চিমবঙ্গেও অনুরূপ প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে বটে, কিন্তু সেটা বাংলাদেশের সমস্যা নয়। আমরা চাই, বাংলাদেশ ভারতের জন্য অনুকরণীয় উদাহরণ হয়ে উঠুক, কিন্তু আমরা চাই না, ভারতের অপকর্মকে অজুহাত হিসেবে গ্রহণ করুক বাংলাদেশের কোনও দুষ্কৃতি।
মানুষ কমবেশি অপরাধপ্রবণ। কোনো কোনো চোরা অবশ্যই ধর্মের কাহিনী শুনতে চাইবে না। রোগের নিরাময় অপেক্ষা নিবারণ উত্তম। উপযুক্ত গোয়েন্দা ব্যবস্থা সুযোগসন্ধানীদের অপকর্ম নিবারণে অন্যতম একটি অস্ত্র। রাজাকে তিন সেট গুপ্তচর রাখার নিদান দিয়েছিলেন চাণক্য। প্রথম ও দ্বিতীয় সেট পরস্পরের অপরিচিত থাকবে। প্রথম ও দ্বিতীয় সেট ঠিকঠাকমতো কাজ করছে কিনা দেখবে তৃতীয় সেট। তিন সেটের গোয়েন্দাপ্রধানের সঙ্গে আলাদাভাবে কথা না বলে রাজা রাতে শুতে যাবেন না। প্রাক্তন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত বীনা সিক্রি বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থার ব্যর্থতার কথা সরাসরি বলেছেন। পিলখানা বিদ্রোহ, নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশ সফর এবং এ বারের দুর্গাপূজায় সংঘঠিত পরিকল্পিত অপকর্ম আগে থেকে আঁচ করতে না পারা প্রশাসনের ব্যর্থতার টুপিতে তিনটি কালো পালক বটে।
https://twitter.com/urumurum/status/1457185598540697607
মাসুদ করিম - ১০ নভেম্বর ২০২১ (৩:১৪ অপরাহ্ণ)
মুবিনুল হায়দার চৌধুরী: জাসদ ভাঙার কারিগর
https://opinion.bdnews24.com/bangla/archives/68000
এ বছর ৭ জুলাই অনেকটা নিভৃতে চিরবিদায় নিলেন বাম রাজনীতির একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী। বাংলাদেশে এক ভিন্নধারার বাম রাজনীতির সূচনা করেন তিনি।
মুবিনুল হায়দারের মৃত্যুর খবর গণমাধ্যমে গুরুত্ব দিয়ে আসেনি। এমনকি বাম রাজনৈতিক দলগুলোও তার মৃত্যুতে অতোটা গুরুত্ব দিয়ে শোক প্রকাশ করেনি। সারা জীবন নিভৃতে থেকে রাজনীতি করেছেন মুবিনুল হায়দার। নিজের প্রচার এবং প্রতিষ্ঠার পেছনে ছোটেননি আর দশজন রাজনীতিবিদের মত। তিনি যে মতাদর্শে বিশ্বাস করেছেন, সারা জীবন সব সিদ্ধান্ত তিনি নিয়েছেন সে মতাদর্শের প্রতি তার আনুগত্যের জায়গা থেকে—ব্যক্তিগত লাভ বা সুবিধা প্রাপ্তির জায়গা থেকে নয়।
মুবিনুল হায়দারের রাজনীতির ধরন কিছুটা সিরাজুল আলম খানের মত। সিরাজুল আলম খানের মত তিনিও লাইমলাইটে আসতে চাইতেন না। জাসদ যেমন সিরাজুল আলম খানের ‘ব্রেইন চাইল্ড’, তেমনি বাসদও হল মুবিনুল হায়দার চৌধুরীর ‘ব্রেইন চাইল্ড’। সিরাজুল আলম খানের জাসদকে ভাঙার মূল কারিগরও তিনি। তবে পার্থক্যের একটি জায়গা হচ্ছে- সিরাজুল আলম খান আনুষ্ঠানিকভাবে জাসদের কোনও কমিটিতে ছিলেন না। কিন্তু মুবিনুল হায়দার বাসদের নেতৃস্থানীয় পদে ছিলেন।
ভারতীয় নাগরিক মুবিনুল হায়দার দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে আসেন ভিন্ন ধাঁচের বাম রাজনীতি গড়ে তোলার জন্য। ১৯৩৫ সালে চট্টগ্রাম জেলার বাড়বকুণ্ডে জন্ম নেন তিনি। কিন্তু ব্রিটিশ ভারত ভাগের সময় তিনি তার ভাইয়ের কাছে কলকাতায় থেকে যান।
স্বশিক্ষিত মুবিনুল হায়দারের প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। দরিদ্রতার কারণে এর বেশি আর পড়াশোনা এগোয়নি। ১৯৫০ সালে তিনি যোগ দেন সদ্য প্রতিষ্ঠিত সোশ্যালিস্ট ইউনিটি সেন্টার অব ইন্ডিয়াতে (এসইউসিআই)। এটা তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।
সন্দ্বীপের কমরেড মুজফ্ফর আহমেদের নেতৃত্বে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির যাত্রা শুরু হয় ১৯২১ সালে। এ ধারার বাইরে গিয়ে ভারতের রাজনীতি অর্থনীতিকে ভিন্ন আঙ্গিকে ব্যাখ্যা করে ১৯৪৮ সালে এসইউসিআই প্রতিষ্ঠা করেন শিবদাস ঘোষ, নীহার মুখার্জীসহ আরও কয়েকজন। ২০০৯ সালে নয়া দিল্লীর রামলীলা ময়দানে পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসের পর দলটির নামের পাশে কমিউনিস্ট শব্দটি ‘ব্রাকেট বন্দি’ করা হয়, দলটি যে ‘বিশুদ্ধ’ ধারার বামপন্থি দল, এটি বোঝার জন্য।
এসইউসিআই প্রতিষ্ঠিত শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারার ওপর ভিত্তি করে। ১৯৩৫ সালে ঢাকাতে জন্ম নেন শিবদাস। মুবিনুল হায়দারের মত তিনিও প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা খুব বেশি করেননি। দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করা শিবদাস ১৩ বছর বয়সে অনুশীলন সমিতিতে যোগ দেওয়ার মাধ্যমে উপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অংশ নেন। প্রথমদিকে তিনি মানবেন্দ্রনাথ রায়ের চিন্তাধারার প্রতি আকৃষ্ট হন।
উল্লেখ্য, ভারতীয় বাঙালি মানবেন্দ্রনাথ রায় একাধারে মেক্সিকো এবং ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির (তাসখন্দ কেন্দ্র) প্রতিষ্ঠাতা। অবশ্য পরবর্তীতে তিনি আর কমিউনিস্ট থাকেননি। স্তালিনের সাথে মতাদর্শগত বিরোধের জের ধরে তিনি লিবারেলিজম এবং কমিউনিজম- এ দুটো ধারাকে সংশ্লেষ করে ‘র্যাডিকাল হিউম্যানিজম’ নামে এক ভিন্ন চিন্তাধারার জন্ম দেন।
১৯৪২ সালে শিবদাস ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনে যোগ দেন এবং গ্রেপ্তার হন। জেলে তিনি মার্কসবাদ-লেনিনবাদের মৌলিক সাহিত্যের সাথে পরিচিত হন। তিন বছরের জেল জীবনে শিবদাস বিভিন্ন মার্কসবাদী সাহিত্যের ওপর ব্যাপক পড়াশোনা করেন।
ব্রিটিশ ভারতে জেলের লাইব্ররিগুলোতে ব্রিটিশ শাসকরা মার্কস-লেনিন-স্তালিনের গ্রন্থের বড় সংগ্রহ গড়ে তুলেছিল। নিজেরা সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী উপনিবেশিক অর্থনীতির পক্ষে থাকলেও জেলখানাগুলোতে তাদের চিন্তাধারা বিরোধী মার্কসবাদী সাহিত্যের বড় সংগ্রহ কেন তারা গড়ে তুলেছিলেন এটি পরিষ্কার নয়। অনেক রাজবন্দি জেলখানাতে এসে এ মার্কসবাদী সাহিত্যের সাথে পরিচিত হয়ে পরবর্তীতে কমিউনিস্ট রাজনীতিতে যুক্ত হন।
মার্কসবাদী-লেনিনবাদী সাহিত্যের সাথে ব্যাপক পরিচয় ঘটলেও শিবদাস সোভিয়েত ইউনিয়ন বা পরবর্তীতে মাও সে তুং এর গণচীন এর কোনওটা দ্বারাই প্রভাবিত হননি। তিনি এ দুই ধারার বাইরে গিয়ে স্বতন্ত্র অবস্থান থেকে ভারতে ভিন্ন আঙ্গিকে কমিউনিস্ট রাজনীতি গড়ে তোলেন।
সোভিয়েত প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ভারত এবং বাংলাদেশের ‘মস্কোপন্থি’ দলগুলো ‘জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের’ তত্ত্ব হাজির করে। এর বিপরীতে সব ঘরানার ‘পিকিংপন্থি’ দল ‘জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের’ কথা বলে। শিবদাস মস্কো, পিকিং ধারার বাইরে গিয়ে ঘোষণা করেন (যেটিকে তারা থিসিস বলেন) ভারত পুঁজিবাদী রাষ্ট্র। সুতরাং শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে ভারতের বিপ্লবের স্তর হচ্ছে সমাজতান্ত্রিক।
১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর আওয়ামী লীগ এবং তার ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ থেকে সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে কিছু নেতাকর্মী বের হয়ে গিয়ে মেজর (অব.) আবদুল জলিলকে সভাপতি এবং আ স ম আবদুর রবকে যুগ্ম আহ্বায়ক করে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) গঠন করেন।
সময়টা তখন বিশ্ব রাজনীতিতে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের জোয়ারের যুগ। তাই যারা পাকিস্তান আমলে পুঁজিবাদী অর্থনীতির রাজনীতি করেছেন, সে-ই তারাই রাতারাতি ভোল পাল্টে রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়ার জন্য জাসদের ব্যানারে কমিউনিস্টদের মত কার্ল মার্কসের ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের’ স্লোগান দেওয়া শুরু করেন।
উল্লেখ্য, মার্কস তার পূর্বে যারা সমাজতন্ত্র নিয়ে চিন্তাভাবনা করেছেন, তাদের চিন্তাধারাকে নাকচ করার জন্য, তাদের ভাবনাকে ‘ইউটোপিয়’ বা ‘কাল্পনিক সমাজতন্ত্র’ বলে আখ্যায়িত করে নিজের চিন্তাধারাকে ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ বলে অভিহিত করেছেন।
মার্কসবাদী চিরায়ত সাহিত্য সম্পর্কে অজ্ঞ কিন্তু বিপ্লবী রোমান্টিকতায় আক্রান্ত জাসদের তরুণ নেতৃত্ব বাংলাদেশের মস্কো এবং পিকিংপন্থি ধারার বাইরে একটা স্বতন্ত্র অবস্থান নিতে চাইলেন। ইতিহাস, রাজনীতি ইত্যাদি সম্পর্কে তাদের ধারণা যে খুব বেশি ছিলনা, সেটা স্পষ্ট হয়ে উঠে তাদের দলের নামকরণ থেকে। জার্মানির নাৎসি পার্টি অর্থাৎ, ‘ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টির’ নাম অনুকরণ করে তারা দলের নাম ‘জাসদ’ রাখেন। তারা যে বিষয়টা সচেতনভাবে করেছেন এমন নয়। মুবিনুল হায়দারসহ অন্যরা ধরিয়ে দেওয়ার পরেও তারা নাম পরিবর্তন করার কোন উদ্যোগ নেননি।
মার্কসবাদী বা অন্য ধারায় মৌলিক চিন্তা করবার মত ধীশক্তি বাংলাদেশের অন্যান্য বামপন্থিদের মত জাসদ নেতৃত্বের মাঝে আরো প্রবলভাবে অনুপস্থিত ছিল। তাই নিজেদের স্বাতন্ত্র্য প্রমাণ করার প্রয়াস হিসেবে তারা শিবদাসের চিন্তাধারা হুবহু অনুকরণ করে বাংলাদেশেও বিপ্লবের স্তর সমাজতান্ত্রিক বলে ঘোষণা করেন।
জাসদের সাথে সংশ্লিষ্ট অর্থনীতিবিদ আখলাকুর রহমান শিবদাসের ভারত পুঁজিবাদী রাষ্ট্র—এ তত্ত্ব অনুসরণ করে বাংলাদেশের কৃষি অর্থনীতি সামন্ত কাঠামো থেকে বের হয়ে ধনতন্ত্রে উত্তরণ ঘটেছে বলে উল্লেখ করেন।
শিবদাস চাচ্ছিলেন, তার চিন্তাধারার আলোকে বাংলাদেশে একটি রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে। জাসদের রাজনৈতিক অবস্থানের মধ্যে তার চিন্তার প্রতিফলন দেখে তিনি মুবিনুল হায়দারকে বাংলাদেশে পাঠান জাসদের সাথে যোগাযোগ গড়ে তোলার জন্য। বাংলাদেশে এসে তিনি নানা স্তরের জাসদ নেতাকর্মীদের সাথে যোগাযোগ করেন। সিরাজুল আলম খানের সাথে শিবদাস ঘোষের কয়েকবার বৈঠকের ব্যবস্থাও করে দেন তিনি।
জাসদের কার্যক্রম মুবিনুল হায়দারকে হতাশ করে। তিনি বুঝতে পারেন যে, জাসদ নেতৃত্ব এসইউসিআই এর কিছু শ্লোগান এবং প্রত্যয় শুধু অনুকরণ করছে রাজনীতিতে নিজেদের স্বতন্ত্র অবস্থান প্রমাণ করার কৌশল হিসেবে।
এসইউসিআই এর মত করে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের চর্চা করা,কর্মীদেরকে চিরায়ত মার্কসবাদী সাহিত্য সম্পর্কে ধারণা দেওয়া এবং সেভাবে জীবন যাপন করা- এ ধরনের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, যোগ্যতা- এর সবকিছুই জাসদ নেতৃত্বের মাঝে অনুপস্থিত। মার্কস-লেনিনকে না জেনে তাদের নাম ব্যবহার করে দল গঠন করা যে একটা রাজনৈতিক ভাওতাবাজি, এটা মুবিনুল হায়দারের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়।
সদ্য স্বাধীন দেশ মধ্য এবং নিম্ন মধ্যবিত্তের মাঝে উচ্চাকাঙ্ক্ষার জন্ম দেয়। শ্রেণিচরিত্রের জন্য দ্রুত অনেক কিছু পাবার আকাঙ্ক্ষা তাদের পেয়ে বসে। ক্ষমতাসীন দলের তাদের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে না পারাকে পুঁজি করে জাসদ খুব দ্রুত এ শ্রেণির মাঝে নিজেদের শক্তিশালী সংগঠন গড়ে তোলে। এদেরকে কাজে লাগিয়ে সশস্ত্র পন্থায় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারকে উৎখাতের কৌশল নিয়ে জাসদ এগোতে থাকে। এ লক্ষ্যে দলের সশস্ত্র শাখা হিসেবে গড়ে তোলা হয় ‘বিপ্লবী গণবাহিনী’।
একই সাথে সেনাবাহিনীর মাধ্যমে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে সরকার পতনের লক্ষ্যে কর্নেল (অব.) তাহেরের নেতৃত্বে সেনা সদস্যদের মধ্যে গোপনে ‘বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার’ বিস্তার ঘটান হয়। উল্লেখ্য যে, তাহের ‘বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার’ সাথে শুরু থেকে যুক্ত ছিলেন না। সৈনিকদের মাঝে সংগঠন গড়ে তোলার কাজ প্রথম শুরু করেন মেজর জলিল।
১৯৭১ সালে গণহত্যায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করার জন্য দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ধর্ম-নির্ভর ডান এবং দক্ষিণপন্থি দলগুলোকে নিষিদ্ধ করা হয়। ওই সময় এ দলগুলোর একটিই লক্ষ্য হয়ে ওঠে- যেকোনও মূল্যে, যে কারো দ্বারা বঙ্গবন্ধু সরকারের পতন ঘটান।
সশস্ত্র পন্থায় সরকার পতন ঘটানোর প্রক্রিয়ায় সেসময় জাসদ ছাড়াও সক্রিয় ছিল সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টি এবং কমরেড আবদুল হক, তোয়াহা প্রমুখ ‘পিকিংপন্থি’ কমিউনিস্টরা। এদের মধ্যে জাসদের ভূমিকা সবচেয়ে সক্রিয় এবং অগ্রসর থাকায় ধর্মভিত্তিক দলগুলো জাসদের প্ল্যাটফর্মকে আরও শক্তিশালী করার কৌশল নেয়। ফলে, তৎকালীন সরকারবিরোধী সশস্ত্র সন্ত্রাসের ভরকেন্দ্র হয়ে ওঠে জাসদ।
বঙ্গবন্ধু সরকারকে অস্থিতিশীল করে তোলার জন্য সেসময় যা যা করা দরকার জাসদ তার সবই করে। একদিকে তারা গণবাহিনী দ্বারা থানা আক্রমণ, ভঙ্গুর অর্থনীতির দেশে ব্যাংক লুট, পুলিশ এবং আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা, খুন ইত্যাদি কার্যক্রম পরিচালনা করে। অপরদিকে, ‘গণকণ্ঠ’সহ অন্য প্রচার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক নেতিবাচক প্রচারণা চালায়।
এসবের প্রতিক্রিয়ায় পুলিশ এবং রক্ষীবাহিনীর পাল্টা ভূমিকায় তৃণমূল পর্যায়ে জাসদের অনেক তরুণ কর্মী প্রাণ হারান। বস্তুত এসবের মধ্যে দিয়ে বঙ্গবন্ধু সরকার উৎখাতের ক্ষেত্র তৈরিতে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করে জাসদ।
জাসদ নেতৃত্ব যখন মনে করছিল সরকার উৎখাতের প্রক্রিয়াকে তারা মোটামুটি গুছিয়ে এনেছে, ঠিক তখনই সেনাবাহিনীর কিছু দক্ষিণপন্থি জুনিয়র অফিসার ১৫ অগাস্টের বিয়োগান্তক ঘটনার জন্ম দেয়। এতে পুরো জাতির সাথে জাসদ নেতৃত্বও স্তম্ভিত হয়ে যান। তাদের দাঁড় করানো ক্ষেত্র ব্যবহার করে রাষ্ট্রক্ষমতা দক্ষিণপন্থি জুনিয়র অফিসাররা নিয়ে নেবেন, এটা তারা মেনে নিতে পারছিলেন না। তাই তারা আরেকটি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানোর সুযোগ খুঁজছিলেন, যার মাধ্যমে তারা রাষ্ট্র ক্ষমতার দখল নিতে পারবেন।
এ সময়টিতেই কর্নেল তাহের ‘বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার’ মাধ্যমে সেনাবাহিনীতে ব্যাপকভাবে সক্রিয় হন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করবার পরিকল্পনা নিয়ে। বঙ্গবন্ধু এবং আওয়ামী লীগ রাজনীতির বিরোধী তাহের পাকিস্তান আমল থেকেই দেশের জন্য কিছু একটা করতে হবে- এরকম ভাবছিলেন। তিনিও অন্য অনেকের মত সেসময়কার প্রভাবশালী চিন্তাধারা, সমাজতন্ত্র-কমিউনিজমের প্রতি আকৃষ্ট হন। কিন্তু সমাজ, রাষ্ট্র, অর্থনীতি, দর্শন এসব নিয়ে ব্যাপক পড়াশোনা, জানাবোঝার চেয়ে বাংলাদেশের আর দশজন বামপন্থির মতই বামপন্থার ‘রোমান্টিকতার’ প্রতিই তিনি আকৃষ্ট হন।
দেশ, রাজনীতি, অর্থনীতি ইত্যাদি বিষয়ে বাংলাদেশের অন্য বামপন্থিদের মত তাহেরও মৌলিক চিন্তা করতে পারেননি। তিনি নিজেকে মার্কসবাদী মনে করলেও মার্কস—লেনিন সম্পর্কে জানা-বোঝার ঘাটতি তার মাঝে ছিল প্রবল।
কমিউনিস্ট আন্দোলন যে কোন জাতীয়তাবাদী আন্দোলন নয়—এটা যে আন্তর্জাতিকতাবাদী আন্দোলন—এ বিষয় সম্পর্কে তাহের হয় আগ্রহী ছিলেন না। ফলে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের সাথে তাহের বা জাসদের কোন যোগাযোগ ছিল না। তাহেরকে বড় জোর বলা যায় আওয়ামী লীগ বিরোধী হঠকারী জাতীয়তাবাদী।
জানাবোঝার অভাব থেকে জনগণকে সংগঠিত করে লড়াই, সংগ্রাম, আন্দোলন গড়ে তোলার পরিবর্তে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সামরিক ক্যু সংগঠিত করাকেই তাহের বিপ্লব মনে করলেন। এ লক্ষ্যে তিনি যখন প্রায় গুছিয়ে আনছিলেন ঠিক তখনই ঘটে যায় আরেক বিপত্তি।
৩ নভেম্বর মধ্যপন্থি জাতীয়াতাবাদী ধারার ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ আরেকটি অভ্যুত্থান ঘটিয়ে বসেন। এ বিষয়টিও তাহের এবং জাসদ নেতৃত্বকে একই সাথে বিস্মিত এবং বিচলিত করে। অভ্যুত্থান সংগঠিত করার পূর্বেই একের পর এক অভ্যুত্থানের ঘটনা তাদেরকে দিশেহারা করে তোলে। ফলে যেকোনও মূল্যে তারা বিশেষত তাহের ক্ষমতা দখলের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন।
তাহেরের অভ্যুত্থান পরিকল্পনার সমর্থনে জাসদ খালেদ মোশাররফকে ‘discredit’ করার জন্য ভারতবিরোধী ‘ট্রাম্প কার্ড’ ব্যবহার করে। উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধেও তারা ধর্মভিত্তিক রাজনীতিবিদদের ব্যবহৃত সেই একই ভারতবিরোধী কার্ড ব্যবহার করে। অর্থাৎ কোন মৌলিক ভিন্নতার নিজস্ব জায়গা থেকে নয়, ’ইসলামপন্থি’দের ধার করা বিষয় নিয়ে জাসদ তার ভারত বিরোধিতার রাজনীতি করে।
এ রাজনীতির অংশ হিসেবে জাসদ খালেদ মোশাররফকে ভারতের চর/দালাল ইত্যাদি হিসেবে অভিহিত করে এবং একে ভারতের পরিকল্পনার ক্যু হিসেবে প্রচার চালায়। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো এ প্রচারে ব্যাপক ঘি ঢেলে তাহেরের অভ্যুত্থানের ক্ষেত্র তৈরি করে দেয়।
৭ নভেম্বর অভ্যুথান সফল করেই তাহের বুঝতে পারেন যে অভ্যুথানের নিয়ন্ত্রণ আর তার হাতে নেই। নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে ডানপন্থি সামরিক অফিসারদের হাতে। ফলে জিয়ার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর ছাড়া তার সামনে আর কোন বিকল্প ছিল না।
জিয়া ক্ষমতা পাবার পর সামরিক আদালতে গোপন বিচারে দ্রুত তাহেরকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলান। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত জাসদের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে কারারুদ্ধ করে নিজের ক্ষমতা সুসংহত করতে সচেষ্ট হন।
জাসদের মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা জিয়া সরকারের নিষ্পেষণে দিশেহারা বোধ করেন। ঘটে যাওয়া ঘটনাবালী এবং সে প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন এগিয়ে নেওয়া, এসব বিষয়ে জাসদ নেতারা তাদের কর্মীদের সামনে গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা হাজির করতে ব্যর্থ হন।
অনেকটা শুরু থেকেই জাসদকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে মুবিনুল হায়দার যে বিষয়টা বুঝতে পারেন সেটা হল জাসদের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা আন্তরিকভাবেই বাংলাদেশের সেক্যুলার, সমাজতান্ত্রিক রূপান্তর দেখতে চান। তিনি তাদের একটা বড় অংশকে এ বিষয়টা বোঝাতে সক্ষম হন যে, তাদের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের জন্য জাসদ একটি ভুল প্ল্যাটফর্ম।
মুবিনুল হায়দার এদেরকে নিয়ে তিনি যে মিশনে বাংলাদেশে এসেছিলেন অর্থাৎ শিবদাসের চিন্তার আলোকে এসইউসিআই এর ‘বন্ধুপ্রতীম’ দল গঠন, তা গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন। এরই ফলে ১৯৮০ সালে ‘প্ল্যাটফর্ম অব অ্যাকশন’ হিসেবে জাসদ ভেঙ্গে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) গঠন করেন।
জাসদের ভাঙন জিয়ার জন্য স্বস্তি বয়ে আনে। যে দলের সামরিক শাখার অভ্যুত্থানের ফলে তিনি ক্ষমতায় এসেছিলেন, সে দলটির রাজনৈতিক অঙ্গনে শক্তিশালী অবস্থান জিয়ার জন্য মানসিক শঙ্কার কারণ ছিল। মুবিনুল হায়দারের বাসদ গঠন জিয়াকে সে শঙ্কা থেকে মুক্তি দেয়।
বাসদ গঠনের শুরুতেই ধাক্কা খায়। ১৯৮৩ সালে একজন নারী কমরেডের সাথে দুই শীর্ষ নেতার ‘ত্রিভুজ প্রেম’ এর বিষয়কে কেন্দ্র করে দল ভেঙে যায়। আফম মাহবুবুল হকের নেতৃত্বে পৃথক বাসদ (মাহবুব) গঠিত হয়। এটিও পরে ভেঙ্গে বাসদ (রেজা) নামে ব্রাকেট বন্দি হয়।
একজন সৎ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব মাহবুবুল হক তার দলকে নিয়ে খুব বেশিদূর এগোতে পারেননি। শিবদাসের পথে নয়, তিনি মূলত জাসদের রাজনীতি-ই ‘বাসদ’ নামে করেছেন। শেষ জীবনে তিনি স্মৃতিশক্তি হারান এবং কানাডাতে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর আজ বিলুপ্ত প্রায় বাসদ (মাহবুব) কয়েক জন ব্যক্তি ধরে রাখবার চেষ্টা করছেন।
মাহবুবুল হক বের হয়ে যাবার পর খালেকুজ্জামান ভূঁইয়া, আব্দুল্লাহ সরকার প্রমুখকে নিয়ে মুবিনুল হায়দার শিবদাসের চিন্তা বাস্তবায়নের পথ ধরেন। তার দিক নির্দেশনায় বাসদ এমন কিছু চর্চা করে, যেটি এর পূর্বে বা পরে বাংলাদেশে আর কোন রাজনৈতিক দল করেনি।
মার্কসবাদ রাজনৈতিক দর্শন হিসেবে আপাদমস্তক একটি বস্তুবাদী দর্শন হলেও শিবদাসের চিন্তার আলোকে মুবিনুল হায়দারসহ বাসদ নেতৃত্ব কমিউনিস্ট নীতি নৈতিকতা চর্চাকে ব্যাখ্যা করেন উপমহাদেশের ভাববাদী সন্ন্যাস দর্শনের আলোকে। তাদের মতে বিপ্লব করতে হলে আগে পার্টি সদস্যদের কমিউনিস্ট নৈতিকতা অর্জন করতে হবে। এটি অর্জনের অন্যতম পূর্বশর্ত হল পার্টি সদস্যদের প্রেম, বিয়ে, যৌন-জীবন সম্পূর্ণরূপে পরিহার করা। শুধু তাই নয়, দলের সভ্যদের পার্টি অফিসে অন্যদের সাথে এক সাথে জীবন-যাপনে অভ্যস্ত হতে হবে—যেটিকে তারা ‘কমিউন জীবন’ বলে থাকে। এমনকি তাদের জন্য পড়াশোনা শেষে চাকরি বা ব্যবসা করাও কমিউনিস্ট নৈতিকতার পরিপন্থি বলে গণ্য করা হয়। ব্যক্তি জীবনে সমস্ত রকম প্রতিষ্ঠা, সুনাম, সম্মানের জন্য কাজ করাকে অনুৎসাহিত করা হয়।
বাসদের এ ধরনের কঠোর রেজিমেন্টেড জীবন কিছু তরুণকে আকর্ষণ করে। শিক্ষার্থী থাকার সময় তারা এর মাঝে বিপ্লবী রোমান্টিকতা খুঁজে পায়। বাসদ তার ছাত্র সংগঠন সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টকে সারা দেশের অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়।
সোভিয়েত পতন পরবর্তী সময়ে সিপিবির ভাঙ্গন, ছাত্র ইউনিয়নের দুর্বলতা ফ্রন্টের বিকাশে সাহায্য করে। তবে ফ্রন্ট কোথাও মূল ধারার সংগঠন হিসেবে দাঁড়াতে পারেনি। বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানেই এর অস্তিত্ব ছিল সাংগঠনিক শক্তির হিসেবে চতুর্থ, পঞ্চম বা আরো নিচে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাইরে আর কোথাও উল্লেখ করার মত কোন সংগঠন বাসদ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়। ফলে, এটি মূলত ছাত্র নির্ভর রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়।
ছাত্র রাজনীতি শেষ করে এ তরুণরা যখন মূল সংগঠনে আসে, তখন দলের চাকরি, ব্যবসা, বিয়ে না করার শর্ত তাদেরকে হতাশ করে। ফলে ব্যাপক সংখ্যায় তরুণ বাসদ রাজনীতি থেকে নানা সময়ে সরে পড়েন। এছাড়া এ তরুণদের মাঝে তাদের কোন কোন নেতার কথা ও কাজের বৈপরীত্যও স্পষ্ট হয়ে উঠে।
দলীয় মুখপাত্র ‘ভ্যানগার্ডে’ কারো লেখা লেখকের নামবিহীন অবস্থায় ছাপাবার নিয়ম ছিল। সবাই তাই পালন করতেন। কিন্তু দলের আহ্বায়ক খালেকুজ্জমান সে নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে নিজের নামে লেখা প্রকাশ করতে থাকেন। দল প্রতিষ্ঠা হবার পর থেকে তিনি দলের আহ্বায়ক পদও ধরে রাখেন।
এ পদ ধরে রাখার স্বার্থে বাসদের কোন সম্মেলন আহ্বান করা হয়নি। এর পেছনে অদ্ভুত যুক্তি দেখিয়ে বলা হয় যে, বাসদ এখনো দল হয়ে উঠেনি। বিশ্বে আর কোনও বাম বা সমাজতান্ত্রিক দল দেখা যায় না যারা প্রতিষ্ঠা হবার পর সম্মেলন বা কংগ্রেস করেনি । এমনকি শীতল যুদ্ধের সময় নিষিদ্ধ ঘোষিত বাম দলগুলোও গোপনে কংগ্রেস আহ্বান করত। পূর্ব পাকিস্তান এবং বাংলাদেশেই এর নজির রয়েছে।
সম্মেলন না করা বাসদ- মুবিনুল হায়দার, খালেকুজ্জমান, আব্দুল্লাহ সরকার, শুভ্রাংশু চক্রবর্তী- এ চার ব্যক্তি নিয়ন্ত্রিত দলে পরিণত হয়। এর মাঝে আব্দুল্লাহ সরকার ছাড়া বাকি সবাই ছিলেন ‘চির কুমার’। দলের নিয়ম অনুসারে তারা সবাই দলীয় অফিসে একই কক্ষে ‘কমিউন জীবন’ অনুসরণ করে থাকতেন। কিন্তু এ তিন জনের মাঝ থেকে একজনের এক নারী কমরেডের সাথে প্রণয় সম্পর্ক মুবিনুল হায়দারসহ বাকিদের ব্যথিত করে। এটাকে তারা দলীয় নৈতিকতার লঙ্ঘন হিসেবে দেখেন।
এর সাথে উক্ত নেতার দলীয় ফান্ড, শেয়ার বাজার ইত্যাদি নিয়ে আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগ দলে অস্থিরতার জন্ম দেয়। এমতাবস্থায় আব্দুল্লাহ সরকার দলীয় রাজনীতি থেকে বিদায় নেন। পরবর্তীতে ২০১৩ সালে মুবিনুল হায়দার মার্কস, লেনিন, মাওয়ের সাথে শিবদাসকে সমমানের চিন্তক হিসেবে স্বীকৃতি দেবার দাবি তুললে খালেকুজ্জমান এর বিরোধিতা করেন। ফলে শুভ্রাংশু চক্রবর্তীকে সাথে নিয়ে বাসদ থেকে বের হয়ে গিয়ে মুবিনুল হায়দার বাসদ (মার্কসবাদী) নামে আরেকটি দল গঠন করেন।
তারা দুজনেও শেষ পর্যন্ত এক সাথে থাকতে পারেননি। নেতৃত্বের উত্তরাধিকারের বিরোধকে কেন্দ্র করে শুভ্রাংশু চক্রবর্তী আবার দল থেকে বের হয়ে গিয়ে গঠন করেন ‘বাংলাদেশের সাম্যবাদী আন্দোলন’।
ভাববাদীদের মত শিবদাস ছিলেন মুবিনুল হায়দারের কাছে গুরুর মত। ‘গুরু’ যা বলেছেন মুবিনুল তার সবই সঠিক মনে করেছেন। শিবদাসের চিন্তাধারার সমস্যগুলো চিহ্নিত করার মত মেধা, প্রজ্ঞা, ইচ্ছা কোনটাই তার ছিল না। বরং একজন নীতিনিষ্ঠ শিষ্যের মত সারা জীবন তার দেখানো পথে চলতে চেষ্টা করেছেন। এ অর্থে বাংলাদেশের আরো অনেক বামপন্থি দাবীদারদের মত তিনি আসলে গুরুবাদ বা ভক্তিবাদেরই চর্চা করেছেন, বস্তুবাদী হয়ে উঠতে পারেননি।
ব্যক্তি মুবিনুল হায়দারের সততা, নিষ্ঠা এবং তার বিশ্বাসের প্রতি আন্তরিকতা প্রশ্নাতীত। কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হল রাজনীতিতে সফল হবার জন্য এসব গুণাবলীই শেষ কথা নয়। রাজনীতিবিদ হিসেবে তো বটেই, এমনকি বাম রাজনীতিবিদ হিসেবেও মুবিনুল হায়দার সফল হতে পারেননি।
ইতিহাসের ট্র্যাজেডি হলো ইতিহাস ব্যর্থ মানুষদের মনে রাখে না। ইতিহাস মুবিনুল হায়দার চৌধুরীকেও মনে রাখবে না।
মাসুদ করিম - ১৩ নভেম্বর ২০২১ (৭:২৬ পূর্বাহ্ণ)
Crony capital: Should we be worried?
https://today.thefinancialexpress.com.bd/28th-anniversary-issue-1/crony-capital-should-we-be-worried-1636452154
Amongst Bangladesh’s many achievements one that stands out quite prominently is the meteoric rise of the private sector, and in particular, the emergence of a brand-new capitalist class. No one has attempted to delve into the fascinating story of how this class came to be. The popular notion is that the ‘brief-case’ businessmen of the 70s-80s, the opening of the RMG export sector in the 1980s, money made by ‘manpower’ exporters, and a deliberate policy of cheap loans that did not really have to be paid back were instrumental in primitive accumulation. In addition, working capital requirements descended from thin air through another scam-the well-known method of over-invoicing/under-invoicing. This, of course, is an oversimplification, although there is more than a grain of truth in the narrative. What we can say with hindsight is that Bangladesh’s capitalist class has emerged with well over 100 family-firms identifying themselves as “Groups” that enjoy billion-dollar turnovers (if key business sources are to be believed). How this has come to be is certainly worth exploring but for this particular piece written for the FE, my objective is much more limited. I would simply like to observe that along with expansion, maturity, and evolution of our business class, we now also have a strong crony capital segment alongside it. My impression is that it is the crony segment that is in the ascendant. The question I pose is: does it matter?
What is Crony Capital:
“Crony capitalism is a term describing an economy in which success in business depends on close relationships between business people and government officials. It may be exhibited by favouritism in the distribution of legal permits, government grants, special tax breaks, or other forms of state interventionism,” as it is stated in Wikipedia.
Various types of crony benefits have been discussed in the literature, including: 1. Direct money transfers in the form of reduced taxes, subsidies, or ‘special treatment’; 2. Entry barriers to preventing competitors coming into the market through tariff or non-tariff barriers; 3. Direct price intervention or control. Here, cronyism is seen as being almost similar to legislation intended to benefit a particular ‘special interest’ group. In other words, it is just another way to refer to what economists call rent-seeking, and everybody else calls it corruption.
The crony phenomenon is not new and certainly not restricted to developing countries or even advanced countries. Numerous examples can easily be traced by just doing a simple Google search. Economic historians have even blamed crony capital for the decline of European nations in medieval times when the main form of industrial organisation was the Guild-a retrograde form that presided over monopolies, restricted entry, and kept wages and innovation at a low level.
In an effort to better understand the concept of cronyism, one researcher conducted a Google Scholar search but found this unhelpful. He writes, “I have examined the first 100 articles in Google Scholar with “Crony Capitalism” in the title. The literature is not very robust. Google Scholar indicates that there are in total about 26,000 results. The most cited article in the list is cited fewer than 500 times, and most are cited fewer than 50 times. In comparison, there are over 120,000 references to “rent-seeking.” The most cited article is cited over 5,000 times, and many are cited over 1,000 times.” Clearly the concept is not doing very well.
A range of stakeholders have begun to worry about cronyism across the world, including investors, entrepreneurs, and public officials concerned with adverse effects that this is having upon host economies. In a context where powerful private-sector interests shape the laws and regulations to their own advantage, the outcome can easily be guessed. A few powerful firms are able to influence legal, political, and regulatory bodies to safeguard and indeed expand their access to privileges. In other words, a few companies or sectors/sub-sectors benefit at the expense of everyone else. Thus, it is crucial to be able to understand the extent to which “state capture” is problematic as part of a general assessment of the governance regime.
A closer look would then involve the use of special exemptions given out by the tax system or selective enforcement of rules. Frequently, financing is obtained in the shape of cheap, publicly guaranteed credit while government contracts are awarded on the basis of ‘political connections’. The other side of the coin consists of those left out – smaller entities or those without connections whose numbers are much larger. They face the costs and risks that the influential firms are able to avoid. Desai (2105) shows a table that relates various costs to firm influence where the power of influence to reduce costs is brought out starkly. A political economy that rewards influence may well be punishing the most dynamic firms and sectors thus constraining expansion, growth and innovation.
Is There a Crony Sector in Bangladesh: There are cronies everywhere, even in the Land of the Free. This does not mean every big or powerful company is a ‘crony’. Henderson (1999), for example, identifies General Motors as a crony but also notes that Ford Motors is not. Similarly, in Bangladesh we could probably point to some large Groups of Companies who are cronies but at the same time point to others who are not. So, it is safe to assume that the crony problem exists, and even it is thriving, but at the same time we should acknowledge there is a large, independent sector that may currently be smarting. The tell-tale signs are everywhere. Policy making today is explicitly about how to encourage the private sector which is certainly a good objective to have, but there is a concern also: what it really means is that policy concessions are essentially driven by the few in the name of the many. The state of the banking sector is a stark reminder of this. One need not go much beyond the high NPLs (non-performing loans) to understand the power of crony capital. Similarly, banking rules and regulations have also been influenced and crafted in a manner that seems to address crony interests. For example, the interest rate policy imposed on the economy goes against all market norms. The reversal to an earlier era of administered interest rates – and that too without much technical discussion-is difficult to comprehend without invoking the crony phenomenon. Certainly, the impact of the new interest rate paradigm on investment has been imperceptible while we are still watching whether the interest collapse imposed on us will in fact lead to a better performing stock market. Even if that were to happen, what implication does that have for promoting a thriving, independent private sector? In the meantime, desolate depositors, including pensioners and widows, can look forward to an era of negative real returns on their money at perhaps the most difficult time of their/our lives as we continue to struggle against Covid-led blues.
One must also point to what can only be considered a policy obsession when it comes to RMG (ready-made garment). The sector has power and influence, and an ability to lobby hard – but it is hard to understand why most policy targets focus singularly on this sector at the expense of all others, including those which may well emerge as powerful sectors given support. At least for RMG, support that is given is sector-wide and so may not be intrinsically crony in character, although the continuous demand for ‘support’ is not easy to sympathise with.
Every sector in the economy can be divided into crony and non-crony segments. While the crony segment is doing much better in terms of access to credit, an ability to ‘enjoy’ an even higher rate of NPL (non-performing loans) and enter into lucrative deals with public sector entities, the non-crony sector is tied down and can only compete with difficulty and at high costs. However, history tells us that crony capital eventually becomes soft and lazy, and reaches a point when without continued support it falls flat on its face. Innovation evaporates, appetite for risk taking dwindles and entrepreneurship takes a hard hit. It is actually the non-crony sector that can lead us to the next phase of development whether in agriculture, industry, exports or services – and it is therefore crucial to re-centre and re-balance the playing-field and not punish the good and prop up the bad. This will be difficult, given extensive crony infiltration into policy making processes, but that is exactly what is required. This is the lesson of history if anyone cares to take a look. Let me give an example here from close to home: there is a small ‘old capital’ segment in Bangladesh that dates back to the pre-1971 era. This old capital was used to licenses and handouts, but being old capital, they felt it was their birthright to keep benefiting from concessions indefinitely. However, after 1971, all equations had to be reset, and we find that old capital while still around (forgive me for not calling names out) has been forgotten and superseded as a new, vibrant capital came and replaced it. Old Capital was unfit to compete with the new even when it came to rent-seeking. We now have a class of new ‘old capital’. This class also thinks it will continue to benefit from their networks forever. History tells us a slightly different story.
The vicissitudes of history are not entirely lost upon cronies. It is precisely from such concerns that we have a huge problem of capital flight and money laundering as cronies struggle to stash away the fruits of their concessions in safer locations.
The ‘What’ Question: Bangladesh has entered a phase in its development trajectory that requires massive public investments. At the same time, the private sector is poised to extend its grasp well beyond RMG in a number of new directions, including light engineering, start-ups, chemicals, automobiles, and the hitherto sluggish leather sector. New opportunities in the energy sector are also beckoning. We see that crony capital is aggressively trying to appropriate these opportunities and it is a cause of concern. First, crony sustainability will require an open-ended commitment from the government for concessions, rebates and bailouts without which they will find it hard to compete globally. Secondly, the flow of raw energy of independent capital derived from the fresh and continued entry of younger, dynamic, and aggressive entrepreneurs will become stalled. While the short-term effects may not be immediately discernable, ambitious, longer-term goals of the government will be seriously compromised and even defeated.
One may well ask how it is that East Asia is doing so well despite a long history of crony capital. This is a good question but one that has to await an answer. Let us, however, note that a number of East Asian countries suffer from the Middle Income Trap (e.g. Thailand, Indonesia, the Philippines) and that a major problem in these countries is the power of unbridled crony capital.
Unfortunately, I see no fundamental departure from business-as-usual anytime soon. One thing that is certain is-one set of crony network will eventually give way to a new set over longer time ‘political-economy’ cycles. This will only mean that one set of cronies will be replaced by another – hardly an exciting prospect. What we must collectively ponder over is how to encourage a governance regime that will decisively move towards a new political economy and line up solidly behind independent capital.
Post script: While going through the literature, I came across country studies on crony capital and its effects in a number of contexts: India, Egypt, Latin America and so on. Perhaps our researchers might want to explore this area of work – of course, in a calm, objective manner devoid of value judgements.
https://twitter.com/urumurum/status/1459420508827512836
মাসুদ করিম - ১৫ নভেম্বর ২০২১ (৩:৪০ পূর্বাহ্ণ)
বাংলাদেশের বুনো খরগোশ
https://samakal.com/todays-print-edition/tp-last-page/article/2111130902/%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%82%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B6%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%AC%E0%A7%81%E0%A6%A8%E0%A7%8B-%E0%A6%96%E0%A6%B0%E0%A6%97%E0%A7%8B%E0%A6%B6
ভাদ্রের মাঠঘাট জলে থইথই, বাড়ির পুকুর-দিঘি জলে টইটম্বুর। ভাদ্রের বাতাসে মাঠগুলো মনে হচ্ছে ঢেউখেলানো নদী- ছোট ছোট ঢেউ খেলছে টলটলে জলে। বাড়ির পুকুরঘাট থেকে তিনখানা তালের ডোঙায় চড়ে বসে মোট পাঁচজন ছেলেমেয়ে। পুকুর থেকে বেরিয়ে তারা ঘুরে বেড়াবে জলভরা মাঠে- করবে হইচই, দুষ্টুমি করে ডুবিয়ে দেবে দু-একটি ডোঙা, আবারও ডোঙা তুলে জল সেঁচে ভাসাবে ডোঙা। দারুণ মজার খেলা। ভাদ্রের মাথাপোড়া রোদে ঘেমে গেলে পানকৌড়ি বা ডুবুরি পাখির মতো টুপটাপ গোটাকয় ডুব দিয়ে ঠান্ডা করে নেবে শরীর- সে শরীর শুকিয়ে যাবে আবার চড়া-কড়া রোদে। মাঝমাঠে গিয়ে শুরু করবে ‘ডোঙাবাইচ’- প্রবল বেগে ডোঙা চালাতে গিয়ে ডোঙায় ডোঙায় ঠোকাঠুকি হয়ে দু-একখানা ডোঙা ডুবেও যেতে পারে। ডুবুক! আবারও জাগাও ডোঙা- চালাও টার্গেটের দিকে। জায়গায় জায়গায় (মাঠের ওই জায়গাগুলো উঁচু) মাথা তুলে আছে হোগলা-কাশ-ছিটকা ঝোপ, কলমি শাক ভেসে আছে এখানে-সেখানে। আছে সাদা শাপলা ও নীল শাপলা। মাথার ওপরে নির্মেঘ আকাশ- বলা যায় ইস্পাতনীল আকাশ, বালিহাঁসদের ওড়াউড়ি-ডাকাডাকি। দূরের রোপা আমন ক্ষেতের ভেতর থেকে ভেসে আসছে কোড়াপাখির জোরালো গলার ডাক। একঝাঁক শকুন আকাশে বৃত্তাকারে ঘুরপাক খেতে খেতে ক্রমে আরও ওপরে উঠে যাচ্ছে- দূরে কোথাও যদি নজরে পড়ে গরু-মোষের ‘মড়ি’।
কাশবন, কাশফুলে এখন আর আগ্রহ নেই এই পাঁচজনের। ডোঙাবাইচের শেষ সীমানায় এসে পৌঁছাল তারা দ্রুতবেগে। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় হলো তিনখানা ডোঙা। জলভরা মাঠের এ-প্রান্তের শেষেই ঝোপঝাড়পূর্ণ বেশ বড় একটা উঁচু মাঠ। জায়গায় জায়গায় মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো তাল-খেজুরের গাছ। ঘাসবন। নাটাকাঁটা ঝোপ। ছোট ছোট তাল-খেজুরের চারা। একটু বিশ্রামের জন্য ওরা এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল একটা উড়ে আমের ছায়ায়। জলের কিনারের উঁচু তালগাছ থেকে প্রচণ্ড শব্দে একটি পাকা তাল পড়ল আধা জল-আধা মাটিতে। সেকেন্ডের ভেতর গাছটার গোড়ার দুর্গম-দুর্ভেদ্য ঝোপ থেকে লাফিয়ে বেরিয়ে একজোড়া বুনো খরগোশ বা ‘লাফা’ অথবা ‘লাফারু’ চোখের পলকে বেরিয়ে গিয়ে ঢুকে পড়ল দূরের গ্রামীণ বাগানটায়। উল্লসিত পাঁচজন আনন্দে চিৎকার দিয়ে ছুটল তালগাছটির দিকে। ছানা পাওয়া যাবে নিশ্চয়ই! পোষা যাবে তাহলে। দারুণ মজা হবে।
না, তালপড়া গাছটার গোড়ায় লাঠিসোটা দিয়ে খোঁচাখুঁচি করে ও বৈচির কাঁটায় মাথা-ঘাড় রক্তাক্ত করে আর তন্নতন্ন করেও পাওয়া গেল না কোনো ছানা। তবে ১০/১৫ হাত দূরের আরেকটা তালগাছের গোড়ার ঝোপ থেকে এ সময়ে তীক্ষষ্ট কণ্ঠের কান্নার মতো শব্দ ভেসে এলো, শোনা গেল ঝোপঝাড়ের শব্দ বা আলোড়ন। দৌড়ে এখানটায় পৌঁছানোর আগেই একটি খরগোশ ছানা মুখে ধরে বেশ হাসি হাসি মুখে ও গদাইলস্করি চালে খোলায় বেরিয়ে এলো মস্তবড় একটা গুইসাপ। ছেলেমেয়েরা করল তাড়া, গুইসাপটি কিছুটা দৌড়ে গিয়ে চড়ে বসল একটা আমগাছে। দুষ্টু ছেলেমেয়েগুলো লাঠিসোটা জোগাড় করে চড়ল গাছে- ব্যাটা গুইসাপ! খরগোশের বাচ্চা
খাবি! না, এটির নামও গুইসাপ! মাটি-বৃক্ষ ও জলে সমান সচল, সাবলীল। মুখের মজাদার খাবার কি আর ফেলে! অনেক উঁচু থেকে লাফিয়ে পড়ল মাঠের জলে। তার পরে ডুব। একেবারে অদৃশ্য। ছেলেমেয়েগুলো জানে- জলের তলায় ডুব দিয়ে এরা আধাঘণ্টারও বেশি সময় থাকতে পারে।
অল্পক্ষণ খুঁজতেই দুষ্টু-মিষ্টি চেহারার ফুটফুটে চারটি তিন/চার দিন বয়সী খরগোশ ছানা ওরা পেয়ে গেল- ছাগলছানা বা বিড়ালছানার মতো আদর করে কোলে নিল, ছটফট সামান্য করছে বটে, ভয়ে কাঁপছে থিরথির করে। ওরা যদি ছানাগুলো না-ও আনত, বাঁচতে পারত না বোধ হয়। ওই গুইসাপটি আবারও আসত। খরগোশেরা ছানা স্থানান্তর করতে পারে বটে, গুইসাপ হলো তল্লাশিতে সেরা, সার্চ করে করে ঠিকই খোঁজ পেয়ে যেত।
চারটি ছানা নিয়ে পাঁচজনে ডোঙায় চড়ে বাড়ির হিজল তলার ঘাটে যখন পৌঁছল, তখন যে কী আনন্দ বাড়ির সবার! তবে এই আনন্দটা দু-একদিনের ভেতর বিষণ্ণতায় পরিণত হয়। ড্রপার বা ফিডারে ছাগল-গরুর দুধ পান করিয়েও বাঁচানো যায় না খরগোশ ছানাদের। আমার নিজের ও গ্রামের আরও অনেকের অভিজ্ঞতার আলোকে এ কথা বলছি।
হায় বুনো-খরগোশ! বাগেরহাট-খুলনায় পরিচিত ছিল ‘লাফা’ নামে। লাফাতে পারে ছন্দোময়-শিল্পিত গতিতে। লাফানোর সময় দর্শনীয় লম্বা কান দুটি সেঁটে থাকে ঘাড়ের দু’পাশে। ওই দুটি কান খাড়া করে যেমন বিপজ্জনক শব্দ শোনার চেষ্টা করে, তখন দেখতেও লাগে খুব সুন্দর- তার চেয়েও সুন্দর হলো বড় দুটি কানের ‘কানতালি’। কানতালি বাজায় ওরা আনন্দে, শত্রুকে ভয় দিতে ও ছানাদের সঙ্গে দৌড়াদৌড়ি খেলার সময়। ১৯৬০ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত বাগেরহাট-ফকিরহাটে বুনো খরগোশ টিকে ছিল- ৬০ থেকে ৮০ পর্যন্ত সন্তোষজনক সংখ্যায় ছিল। কৈশোরে চাঁদনি রাতে বন্দুক হাতে বাবা যখন যেতেন গ্রামের মাঠগুলোতে, তখন প্রায়ই সঙ্গে যেতাম আমি ও আমরা। বাবা প্রায় প্রতি রাতেই (শরৎকাল থেকে গ্রীষ্মমকাল পর্যন্ত) দু/তিনটি খরগোশ শিকার করতেন। তা থেকে একটিকে বহন করার সুযোগ আমি পেতাম। লম্বা একটি কান মুঠিতে পুরে মাটিতে হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে বাড়িতে আনতাম বীরপুরুষের মতো। আরেকটু বড় হয়ে আমরা চাঁদনি রাতে মটরশুঁটি-ছোলা-মুগডাল-মসুর ও অন্যান্য স্থানে জোটবদ্ধ হয়ে খরগোশ তাড়াতাম। ওটা ছিল আমাদের কাছে খরগোশদের সঙ্গে ‘গোল্লাছুট’ খেলা। ধরতে তো আর পারতাম না, চাঁদের আলোয় আমরা যেন হারিয়ে যেতাম অপার্থিব বা রূপকথার জগতে। তবে কখনও কখনও বাচ্চা ধরে ফেলতাম, পিচ্চি হলে ছেড়ে দিতাম- ওগুলো খাওয়ার যোগ্য ছিল না, দুধ পান করার বয়সই ওদের শেষ হয়নি। খরগোশের মাংস বৃহত্তর খুলনা জেলায় খাওয়া হতো। জানা যায়, সারাদেশেই খাওয়া হতো, ধরতে পারলে আজও খাওয়া হয়। এদের পা অনেকটাই বিড়ালের থাবার মতো, তবে নখর বিড়ালের চেয়ে অনেক ছোট- অনেকটা ‘বরই কাঁটার’ মতো। মাংস সুস্বাদু। আমার বিচারে খরগোশদের সবচেয়ে প্রিয় খাদ্য হলো মুগডাল। তার পরে মসুর ডাল-মটরশুঁটি-নাগালে থাকলে কচি শিম-গাজর-শিকড়-পছন্দের কচিপাতা। গোল আলু খায় বলে শুনেছি, মিষ্টিআলুর কথাও শুনেছি। ‘দুধধানের’ সাদা তরল পান করে। মাটিতে পড়া পাকা তালপাকা খেজুর-গোলাপজাম-জাম-খুঁদিজামসহ মিষ্টি বরই, হামঝুমও খায়। বিশেষভাবে আমরা খেয়াল করেছি- শরতের মধ্যভাগ থেকে মাঘের শেষভাগ পর্যন্ত দূর্বাঘাসে জমা শিশির পান করে তৃপ্তিসহকারে। খুব পছন্দের আরেকটি খাবার হলো ‘বীজতলার’ কচি ধানের পাতা। খেজুর-তালের রস মাটিতে পড়লে চেটেপুটে খায়। এদের মূল আশ্রয়স্থল হলো (এরা মূলত নিশাচর, দিনেও বেরোয় কস্ফচিৎ) খড়বন-বেতঝোপ-পানের বরজ-আখক্ষেতসহ যে কোনো ধরনের ঝোপাল জায়গা। রাতে নানার সঙ্গে জালের ফাঁদ পাততে গিয়ে যেমন চাঁদনি বা আঁধার রাতে টর্চের আলোয় ওদের জ্বলন্ত চোখ দেখেছি, তেমনি রাতে বন্দুক শিকারি বাবার সঙ্গে গিয়েও তা দেখেছি। খরগোশ ধরা জাল সাধারণত মোটা সুতা দিয়ে বানানো হতো- পরে আসে নাইলনের সুতা, যা অনেকটাই লম্বা-চওড়ায় ব্যাডমিন্টন খেলার নেটের মতো। জালে ধরা পড়লে বা গুলি খাওয়ার পরে আহত খরগোশের টলটলে চোখে শিশিরবিন্দুর মতো জল জমতে আমি দেখেছি- নিজে গুলি করেও তা দেখেছি। কাঁদত কি! আমাদের উপজেলা ফকিরহাটের কিছু শৌখিন মানুষ জাল পেতে খরগোশ শিকার করত। শরতের শেষ থেকে পুরো শীতকাল ও বর্ষাকালের শিশিরভেজা মাটি ও বৃষ্টিভেজা মাটির ওপরের পায়ের ছাপ দেখে ওদের আশ্রয়স্থলের সন্ধান পাওয়া যেত। ওদের মলের (লেদি) চিহ্ন অনুসরণ করেও সন্ধান মিলত। পুরুষ খরগোশের লেদি বা মল অনেকটাই ছাগলের লেদির মতো, গোল গোল বড়ি যেন। আকারে খরগোশের লেদি ছোট। তবে মর্দাটার বা পুরুষের লেদি ডিম্বাকার, মেয়েটার লেদি গোলাকার। দিনে বা খুব ভোরে অথবা শেষ বিকেলে এরা মাঠের পাখি বুনো কোয়েল বা নাগরবাটইয়ের সঙ্গে মিলেমিশে চরে। হয়তো বা এর পেছনের কারণ হলো- বিপদ এলেই যেন কেউ না কেউ টের পায়, বিপদসংকেত দেয় দেহ ভাষায় তথা চোখের ভাষায়। নিরীহ প্রাণী খরগোশ। অথচ দিনের বেলায় এদেরকে দেখলেই ফিঙে-ছাতারে-বুলবুলি-শালিক ইত্যাদি পাখি ওদের ঘিরে বা যে ঝোপে লুকিয়েছে- সেই ঝোপের ওপরে উড়ে ঘুরে স্লোগান দেয়। এর কারণ আজও আমার কাছে অজানা। এই পাখিদের সঙ্গে শত্রুতার নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে! খরগোশেরা কি সুযোগ পেলে উল্লিখিত পাখিদের ডিম-ছানা খায়! কিন্তু সেটা সম্ভব কীভাবে!
দিনের আশ্রয়ের জন্য পাটের চারার ক্ষেত (যে গাছগুলো এক-দেড় ফুট বড় হয়েছে) খুবই আদর্শ স্থান এদের। কিন্তু আগে উল্লিখিত পাখিদের নজরে যদি পড়ে যায়, তাহলে কখনও কখনও বিপদ ঘটে। পাখিদের ওড়াউড়ি ফলো করে খেপজালে আটকাতে পারে কোনো মানুষ। গুলিও করা চলে। যে কোনো স্পটে গুলি লাগার সঙ্গে সঙ্গে খরগোশ ঝট করে খাড়া লাফ দেবেই। সঙ্গে হয়তো আছে তিন/চারটি অপ্রাপ্তবয়স্ক ছানা। আনাড়ি ছানাগুলো কিছুই বোঝে না। বোঝে না মৃত্যু। চুপচাপ বসে থাকে। এই বয়সী ছানারা বেশ স্বাস্থ্যবান হয়ে থাকে। গোলগাল ছানাগুলো দেখলে আদর করতে ইচ্ছা করবে। বয়সী খরগোশরা একনজরে লালচে-বাদামি। ছানারা হয় কালচে-বাদামি। স্বাস্থ্যবান ও নাদুসনুদুস।
দ্রুতগতির এই প্রাণীরা আমার মতে বোকার হদ্দ। মানুষ বা কুকুরের ধাওয়া খেলে কিছুটা দৌড়ে গিয়ে ঝোপঝাড় বা কলাগাছের ভেতর মাথা গুঁজে দেবে। ওদের ধারণা- কেউ দেখছে না ওদের। দারুণ ভীতু আর অসম্ভব টেনশনে ভোগা খরগোশরা লাফ দেওয়ার সময়ে যদি একটি ছোট ঢিলের চোটও খায় মাথা বা শরীরের যে কোনো জায়গায়, পড়ে যাবে- বেহুঁশ হবে- এমনকি মৃত্যুও হতে পারে।
অনেক সময় সাহসী হতেও দেখা যায়। যেমন- বনবিড়াল-গুইসাপ-শিয়ালকে ভয় দেখায়; রুখে দাঁড়ায় (যদি কিনা ছানা থাকে)। ১৯৬৯ সালের চৈত্র মাসে ঝোপ থেকে প্রথমে ছিটকে বেরোতে দেখি একটি খ্যাঁকশিয়ালকে, তাকে তাড়া করে একজোড়া খরগোশ- চৈত্রের রোদে পোড়া বিশাল মাঠটি পাড়ি দিল দু’জাতের প্রাণীই- গ্রামীণ বন-মাঠের যারা চ্যাম্পিয়ন দৌড়বিদ। কিন্তু সেদিন যে দৌড় প্রতিযোগিতাটা আমরা অনেকেই দেখেছিলাম- তাতে খ্যাঁকশিয়ালই চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। খরগোশের ছানা আমরা উল্লিখিত ঝোপটিতে খুঁজে পেয়েছিলাম।
বাংলাদেশের আবাসিক এই বুনো খরগোশটি ১৯৭০ সাল পর্যন্ত সারাদেশেই দেখা যেত। টিলা-পাহাড়-বনে ছিল। দেশের উত্তর প্রান্তের গারোপাহাড় শ্রেণিতে ছিল- ছিল দেশের শালবন অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে। বাগেরহাটে সর্বশেষ দেখা গিয়েছিল একজোড়াকে- ২০১৪ সালে। শেষ বিকেলে ওরা একটা ধানের বীজতলায় এসেছিল। আমি নিজে আমার এলাকায় সর্বশেষ দেখেছি ১৯৯১ সালে। এখন আর নেই।
বুনো খরগোশের ইংরেজি নাম Indian Hare/Rufous-tailed Hare। ফাইট্টা, লাফা, শশক ইত্যাদি নামেও পরিচিত। বৈজ্ঞানিক নাম Lepus nigricollis। দৈর্ঘ্য ৪০-৭০ সেন্টিমিটার। লেজ ১০ সেন্টিমিটার। ওজন ১.৩৫ থেকে ৭.০ কেজি। ১৯৭৮ সালে আমি ফকিরহাট বাজার থেকে (হাটবার) মুরগির ও ছাগলের হাটখোলা থেকে ১৪০ টাকায় একজোড়া খরগোশ কিনেছিলাম খাওয়ার জন্য। তখন নিয়মিত খাঁচাবন্দি বুনো খরগোশ বিক্রি হতো বাগেরহাটের বিভিন্ন হাটবাজারে। ওগুলো স্থানীয় জাল শিকারিরা যশোর-কুষ্টিয়া এলাকা থেকে ধরে আনতেন। বন্যপ্রাণী আইন তখন বোধ হয় কার্যকর ছিল না!
ডাগর চোখের নিরীহ এই স্তন্যপায়ীদের মূল প্রজননকাল (যদিও সারাবছরই ছানাসহ দেখা যায় এদের) অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি।
মেয়ে খরগোশ ৪১-৪৭ দিন গর্ভধারণের পর একসঙ্গে এক থেকে চারটি ছানা প্রসব করে। জন্মের সময় ছানাদের শরীরে কালচে ছোট ছোট লোম থাকে- ডাগর দুটি চোখ থাকে খোলা। এই বয়সী ছানাদের প্রথম লম্ম্ফঝম্প মনোমুগ্ধকর- যেন-বা প্রকৃতি-শোকেসের জীবন্ত শোপিস। ছানা দেওয়ার আগে এরা খড়বন-ঝোপঝাড়-কলাঝাড়ের গোড়া বা অন্য জুতসই স্থানে বাসা বানায়। শুকনো পাতা-ঘাস-লতা-কলাপাতা ইত্যাদি দিয়ে বাসামতোন বানায়। মাটিতে সামান্য গর্ত খুঁড়েও বাসা বানাতে পারে। একটি নির্দিষ্ট এরিয়ায় (৩০ ফুট ৩০ ফুট) চার/পাঁচটি আঁতুড়ঘর তথা বাসা করে। যাতে প্রয়োজন হলে ছানাদের অন্য বাসায় স্থানান্তর করা যায়। আখমহালও এদের খুবই পছন্দের জায়গা।
https://twitter.com/urumurum/status/1460086343741034507
মাসুদ করিম - ১৬ নভেম্বর ২০২১ (৩:৪৫ পূর্বাহ্ণ)
অনন্তে বাংলা ভাষার ‘আগুনপাখি’
https://samakal.com/todays-print-edition/tp-first-page/article/2111131048/%E0%A6%86%E0%A6%97%E0%A7%81%E0%A6%A8%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%96%E0%A6%BF%E0%A6%B0-%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A6%97%E0%A6%B0%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%89%E0%A7%9C%E0%A6%BE%E0%A6%B2-%E0%A6%A5%E0%A7%87%E0%A6%AE%E0%A7%87-%E0%A6%97%E0%A7%87%E0%A6%B2
হাসান আজিজুল হকের উপন্যাস ‘আগুনপাখি’ বর্ধমানের কথ্যভাষায় সাজানো বাঙালির প্রাত্যহিক জীবনের অসামান্য প্রতিধ্বনি। সাহিত্যে তিনি মানুষের অন্তহীন সংগ্রামের কথা বারবার বলেছেন; জানিয়েছেন সীমাহীন সম্ভাবনার কথা। সেই ‘আগুনপাখি’র কারিগরের উড়াল থেমে গেল। বাংলা ভাষার জীবন ও বাস্তবতার অবিনশ্বর রূপকার, কথাশিল্পী হাসান আজিজুল হক আর নেই। তিনি গতকাল সোমবার রাত সাড়ে ৯টায় রাজশাহী নগরের চৌদ্দপায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আবাসিক এলাকা বিহাসে নিজ বাড়িতে মারা যান। তিনি বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগে ভুগছিলেন। তার বয়স হয়েছিল ৮২ বছর। হাসান আজিজুল হক গত
আগস্টে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। উন্নত চিকিৎসার জন্য ২১ আগস্ট তাকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে ঢাকায় নেওয়া হয়। প্রথমে তাকে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়; পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলে চিকিৎসকের পরামর্শে ৯ সেপ্টেম্বর তাকে বাড়িতে নেওয়া হয়। বার্ধক্যজনিত সমস্যা ছাড়াও আগে থেকেই তার হার্টে সমস্যা, ডায়াবেটিস ছিল। শরীরে লবণের ঘাটতিও ছিল। তিনি এক পুত্র, তিন কন্যা রেখে গেছেন।
ষাটের দশকে কথাসাহিত্যে আবির্ভূত হয়ে পরবর্তী ৬০ বছরেরও বেশি সময় হাসান আজিজুল হক তার অতুলনীয় গদ্য মহিমা, মর্মস্পর্শী বর্ণনাভঙ্গি, মনস্তত্বের অতল গভীরতার জন্য সুবিখ্যাত। জীবন সংগ্রামে লিপ্ত মানুষের কথকতা তার গল্প-উপন্যাসের প্রধান অনুষঙ্গ। রাঢ় বঙ্গ তার অনেক গল্পের পটভূমি। বাঙালি জাতিসত্তার কথাশিল্পী হাসান আজিজুল হক নিজ সমাজ-সংস্কৃৃতি-রাজনীতি ও অর্থনীতিকে সাহিত্যের বিষয় করে তাকে চিরকালীন করে তোলার অসামান্য ক্ষমতার কুশলী এক কারিগর।
বাংলা সাহিত্যের বিস্তৃত পটভূমিতে হাসান আজিজুল হক নিজ ভাষা ও চিন্তার মৌলিকত্বে বিশেষ অবস্থানের অধিকারী। ছোটগল্পে তার অসামান্য কুশলতায় তিনি জীবিত অবস্থাতেই কালজয়ী হয়ে ওঠেন। বাঙালির দ্রোহ, বঞ্চনা, প্রান্তিক মানুষের অনির্বাণ সংগ্রাম তার সাহিত্যে বারবার বিষয় হয়ে আসে। তার উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্মের মধ্যে রয়েছে- সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য, আত্মজা ও একটি করবী গাছ, নামহীন গোত্রহীন, রাঢ়বঙ্গের গল্প, মা মেয়ের সংসার, বিধবাদের কথা ও অন্যান্য গল্প, চালচিত্রের খুঁটিনাটি, একাত্তর :করতলে ছিন্নমাথা, সাবিত্রী উপাখ্যান, শামুক, শিউলি, চন্দর কোথায় (জর্জ শেহাদের নাটকের ভাষান্তর), ফিরে যাই, ফিরে আসি, উঁকি দিয়ে দিগন্ত, এই জীবনের আখরগুলি, জন্ম যদি তব বঙ্গে, বং বাংলা বাংলাদেশ। ‘আগুনপাখি’ (২০০৬) তার রচিত সাড়া জাগানো উপন্যাস।
সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি দেশ-বিদেশে বহু গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ১৯৬৭ সালে তিনি আদমজী সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৭০ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৯৯ সালে একুশে পদক এবং ২০১৯ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার পান। ২০১২ সালে আসাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এবং ২০১৮ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডি-লিট ডিগ্রি পান। তার উল্লেখযোগ্য আরও কয়েকটি পুরস্কার হলো- বাংলাদেশ লেখক শিবির পুরস্কার, আলাওল সাহিত্য পুরস্কার, দিবারাত্রির কাব্য সাহিত্য পুরস্কার (পশ্চিমবঙ্গ), অমিয়ভূষণ সম্মাননা (জলপাইগুড়ি), গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন সম্মাননা, হুমায়ূন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কার, সেলিম আল দীন লোকনাট্য পদক, শওকত ওসমান সাহিত্য পুরস্কার প্রভৃতি। সার্বজৈবনিক সাহিত্যচর্চার স্বীকৃতিস্ব্বরূপ ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে তাকে ‘সাহিত্যরত্ন’ উপাধি দেয় দেশের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। ২০১৯ সালে তিনি স্বাধীনতা পুরস্কার পান। ২০১১ সালে আত্মজীবনীমূলক ‘উঁকি দিয়ে দিগন্ত’ গ্রন্থের জন্য তিনি ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হন।
মঙ্গলবার বাদ জোহর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে জানাজা শেষে রাবি কবরস্থানে তাকে দাফন করা হতে পারে বলে জানা গেছে। এর আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারের মুক্ত মঞ্চে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য তার মরদেহ রাখা হবে।
প্রখ্যাত এ কথাশিল্পীর মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শোক প্রকাশ করেছেন। গতকাল রাতে শোকবার্তায় রাষ্ট্রপতি বলেন, হাসান আজিজুল হকের মৃত্যু দেশের সাহিত্য অঙ্গনের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। দেশের সাহিত্য-সাংস্কৃৃতিক উন্নয়নে তার অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
প্রধানমন্ত্রী তার শোকবার্তায় বলেন, হাসান আজিজুল হক তার সাহিত্যকর্ম ও সৃজনশীলতার জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
হাসান আজিজুল হক ১৯৩৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার যবগ্রামে সল্ফ্ভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম মোহাম্মদ দোয়া বখশ্? এবং মায়ের নাম জোহরা খাতুন। হাসান আজিজুল হক ১৯৫৪ সালে যবগ্রাম মহারানী কাশীশ্বরী উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ১৯৫৬ সালে খুলনার দৌলতপুরের ব্রজলাল কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৫৮ সালে রাজশাহী সরকারি কলেজ (রাজশাহী কলেজ) থেকে দর্শনে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬০ সালে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি রাজশাহী সিটি কলেজ, সিরাজগঞ্জ কলেজ, খুলনা সরকারি মহিলা কলেজ এবং সরকারি ব্রজলাল কলেজে অধ্যাপনা করেন। ১৯৭৩ সালে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) দর্শন বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। টানা ৩১ বছর অধ্যাপনা শেষে ২০০৪ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি ২০০৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার পদে দায়িত্ব পালন করেন।
https://twitter.com/urumurum/status/1460278729456816129
https://twitter.com/urumurum/status/1460448286892912640
https://twitter.com/urumurum/status/1460452900065329153
আমার যা কিছু অতৃপ্তি সবই লেখালেখিকে ঘিরে: হাসান আজিজুল হক
সমকালীন বাংলা ভাষার প্রধান কথাশিল্পী হাসান আজিজুল হক সোমবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে রাজশাহী নগরীর চৌদ্দপাইয়ের বিহাসের নিজ বাসভবনে মারা গেছেন। তার আশিতম জন্মদিন উপলক্ষে সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন মুহিত হাসান- যা সমকালের কালের খেয়ায় ২০১৮ সালের ২ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত হয়। সাক্ষাৎকারটি সমকাল অনলাইনের পাঠকদের জন্য আবার প্রকাশ করা হলো:
প্রশ্ন: ২ ফেব্রুয়ারি আপনি বয়স ৭৯ বছর পূর্ণ করে ৮০’তে পা দেবেন। নিজের এই দীর্ঘ জীবনের দিকে পেছন ফিরে তাকালে আপনার কেমন উপলব্ধি হয়? আসা-যাওয়ার পথের ধারে হাতে কী রইল?
উত্তর: সাধারণত, আমি নিজের বয়স নিয়ে তেমন একটা খেয়াল রাখি না। প্রতিনিয়ত খেয়াল করার তো প্রশ্নই ওঠে না। আমার বয়স এক বছর বাড়ল, কি আরেক দিন বাড়ল- এ নিয়ে মোটেও ভাবতে চাই না। জন্মদিন পালন করা বা হিসাব রাখার রীতি তো আমাদের সমাজে সেভাবে ছিল না। এটা পরে এসেছে। এমনকি জন্মদিন লিপিবদ্ধ করাটাও ছিল প্রায় দুর্লভ কাণ্ড। তবে ভবিষ্যতের ও ইতিহাসের জন্য এটা যে গুরুত্বপূর্ণ, তা পরে সবাই বুঝতে পেরেছে। সে যাক, আমি নিজের বয়স সম্পর্কে ইচ্ছা করেই সচেতন থাকি না। যদি সচেতন থাকতাম, তাহলে মনে হয়, প্রতি মুহূর্তেই অত্যন্ত বিপর্যস্ত অবস্থা হতো। আয়ু কমে যাচ্ছে প্রতিক্ষণ- এই ভয়েই কাতর থাকতাম। তবে এসব তো একেবারে এড়িয়ে যাওয়া যায় না। কেজো কারণে যখন নিজের জন্ম তারিখ কোথাও লিখতে হয়, কাউকে জানাতে হয়, তখন তো খেয়াল করতেই হয়। আর ভাবি, আহ! অনেকটাই তো বয়স হয়ে গেল। ওই রকম সময় আমার বাবার কথা মনে পড়ে। তিনি আমার মতো বয়সে কী কী করতেন, সেসব স্মরণে আসে। আমার এক চাচা আমার মতো বয়সেই নির্দি্বধায় গৃহত্যাগ করেছিলেন; তার কথাও মনে পড়ে। মনটা স্বভাবতই তখন বিষণ্ণ হয়। আবার তা কেটেও যায় অবশ্য। বা কাটানোর জন্য বয়স বাড়া নিয়ে ঠাট্টাও তো কম করি না। সুকুমার রায়ের ‘হযবরল’র ওই ঠাট্টাটা আমার খুব প্রিয় :’চল্লিশ বছর হলেই আমরা বয়েস ঘুরিয়ে দিই। তখন আর একচল্লিশ বেয়াল্লিশ হয় না- ঊনচল্লিশ, আটত্রিশ, সাঁইত্রিশ করে বয়েস নামতে থাকে।’ আর প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাব সেভাবে করতে চাই না। জাগতিক কি বৈষয়িক- সাংসারিক জীবন নিয়ে তেমন কোনো অতৃপ্তি নেই। আমার যা কিছু অতৃপ্তি, সবই লেখালেখিকে ঘিরে।
প্রশ্ন: তাহলে জীবনের এই পর্যায়ে এসে নিজের লেখালেখির জগৎকে কি নতুন করে সাজানোর কথা ভাবছেন? খুব লিখতে ইচ্ছা করে, কিন্তু লেখা হয়নি- এমন কোনো কাজে হাত দিতে চান?
উত্তর: ওই যে বললাম- তৃপ্তি পাই না। প্রতিনিয়ত কিন্তু এটাই মাথার মধ্যে ঘোরে যে সবচেয়ে ভালোভাবে যা লিখতে পারতাম, একটি ‘ফাইনেস্ট’ গল্প কিংবা একটি উপন্যাস- তার কোনোটিই লিখতে পেরেছি বলে এখন অব্দি মনে হয় না। আজ অথবা এই মুহূর্ত পর্যন্ত যা কিছু লিখেছি, তাকে আমার এখনও অকিঞ্চিৎকর বলেই মনে হয়। বারবার মনে হয়, আরও ক’টা ভালো গল্প তো লিখতে পারতাম। আরও লিখতে পারতাম একটি বৃহদাকৃতির, সর্বার্থে ‘এপিক’ কোনো উপন্যাসও। ত্রিকাল জড়িয়ে লিখতে চেয়েছিলাম, শৈশবেই তো জীবন ব্যাপক বিচিত্র অভিজ্ঞতা উপহার দিয়েছে আমায়। এসব মিলিয়ে মিশিয়ে প্রেক্ষিতটা নেহাত কম বড় করতে পারতাম না। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি। তবে আকাঙ্ক্ষাটা এখনও মনের মধ্যে তুষের আগুনের মতো যে অল্প-বিস্তর জ্বলছে না, তা-ও তো নয়। দেখাই যাক!
প্রশ্ন: উপন্যাসের কথাই যখন উঠল, আরেকটু বিস্তারে যেতে চাই। আপনার এখন অব্দি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত দুটি উপন্যাসই এক হিসাবে নারীকেন্দ্রিক, এবং দুটিরই প্রেক্ষাপটে রয়েছে রাঢ়বঙ্গ। কিন্তু আপনার জীবন যে বিরাট বৈচিত্র্যের মধ্যেই কাটল- জন্ম হলো গ্রামে, কৈশোরেই স্বভূমিহারা হলেন, তারুণ্য কাটল রাজনীতির মাঠে, আর বাকি জীবন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে- মাঝে আরও কত কী ঘটল! উপন্যাসের বিষয় হিসেবে বামপন্থি রাজনীতি বা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসরের প্রসঙ্গ তো আপনি বেছে নিতেই পারতেন। তা নেননি কেন?
উত্তর: না, ভাবিনি। এসব নিয়ে উপন্যাস লেখার মতো কোনো উপকরণ আমার হাতে আছে বলে মনে হয় না। কারণ, আমি তো আর সব ঘটনা কল্পনা করে নিয়ে লিখি না। একেবারে চোখের সামনে যা ঘটে, তাই নিয়ে আমার আখ্যানের মূল জমিটুকু তৈরি করি। তুমি যে দুটি প্রসঙ্গের কথা বললে, সেসবের অন্তর্জগৎ আমি আগাপাশতলা গভীরভাবে চিনি বলে দাবি করতে পারি না। বরং আমি অন্য কয়েকটা বিষয় নিয়ে উপন্যাস লিখতে চেয়েছিলাম, এখনও চাই। গ্রামজীবনের যে অন্তর্গত সংঘাত; বাইরে থেকে তা সেভাবে বোঝা যায় না; তার মধ্যকার বিবমিষা, ক্ষুধা, হারজিৎ, লড়াই- সব মিলিয়ে একটা গ্রামের রূপকে গোটা বাংলাদেশেরই গল্প বলার ভাবনা ছিল। আবার নদীর যে ভাঙাগড়া, তাকে ঘিরে মানুষের জীবনযাপন- এটা আমার কাছে খুব আশ্চর্য একটা বিষয়। বারবার তাই নদীকে ঘিরে একটা উপন্যাস লিখতেও ইচ্ছা করে। বিভূতিভূষণের ‘ইছামতী’ বা মানিকের ‘পদ্মানদীর মাঝি’ এখনও আমাকে দারুণভাবে তাড়িয়ে বেড়ায়। নদী কীভাবে এ জনপদের ভাগ্য গড়ে দিয়েছে, তা লেখার চেষ্টা হয়তো করব। আমি শৈশবে নদী চিনতামই না। এই অপরিচয় আমার জন্য প্রাথমিকভাবে বিড়ম্বনার হলেও, পরে তা আবার নতুন আবিস্কারের সুযোগও এনে দিয়েছে। শৈশব থেকেই নদীকে দেখার সুযোগ হলে হয়তো এর মধ্যকার বাঁক ও ঘাত-প্রতিঘাত আমি সেভাবে বুঝতে পারতাম না। অতিপরিচয়ের আবরণ তা ঢেকে রাখত। দেশভাগের পর খুলনায় এসে আমি প্রথমবারের মতো নদীকে চিনতে শুরু করি, এবং আমার ধারণা, সেই চেনা অন্য অনেকের থেকেই আলাদা রকম।
প্রশ্ন: অনেক দিন তো পূর্ণদৈর্ঘ্য গল্প লিখছেন না। সেই কবে ‘বিধবাদের কথা’ বেরুলো; তারপর যা বেরিয়েছে তার সবই তো নকশা জাতীয় আখ্যান…
উত্তর: বড় আকারের গল্প এখন একটা লিখছি। ওটা নিয়েই কাজ করে যাচ্ছি। এ বাদেও আমার তূণীরে আরও তীর আছে হে। বৃহদাকৃতির আরও গল্প লেখার পরিকল্পনা করছি। আর নকশা জাতীয় আখ্যানগুলো একত্র করে একটা বই বানিয়েছি। নাম দিয়েছি ‘রাই কুড়িয়ে বেল’। এবারের বইমেলায় বেরুবে। এই জাতীয় রচনার ওখানেই ইতি।
প্রশ্ন: দেশভাগের পর খুলনায় এসে কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে ভর্তি হওয়ার প্রসঙ্গেই আপনার আত্মজীবনীর সমাপ্তি। একটু বেশি আগেই ইতি টেনেছেন বলে মনে হয়। আত্মকথাকে কি আরেকটু বিস্তারিত করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন?
উত্তর: এটা নিয়ে দোটানায় আছি। নিজের এক সময় মনে হয়েছিল, আর লিখে কী হবে! সবার তারুণ্য কি যৌবন তো এমন ব্যতিক্রমধর্মী কিছু নয়, কিন্তু শৈশবটা প্রত্যেকেরই আলাদা। শৈশবে দু’জন মানুষের অবিকল এক অভিজ্ঞতা হয় না। সে জন্য শুধু শৈশব নিয়েই সবিস্তার লিখে সন্তুষ্ট ছিলাম। যদিও পরে অনেকেই বলছেন, আপনি এটা লিখে চলুন; থামবেন না। কিন্তু আমি এখনও কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি।
প্রশ্ন: বাস্তবতা থেকে আখ্যানের মূল জমি তৈরির ব্যাপারে বলছিলেন। অনেক সময় আপনার গল্প-উপন্যাসের সাথে আপনার চার খণ্ডের আত্মকথার কোনো কোনো ঘটনার ব্যাপক মিল দেখতে পাই। যেমন, আপনার শৈশবস্মৃতির নিপীড়ক মর্দানা বুবুর সঙ্গে খুব মিলে যায় ‘একটি আত্মসমর্পণের কাহিনী’ গল্পের শিক্ষিকা চরিত্রটি…
উত্তর: ঠিক তেমন সচেতনভাবে এটা করি না। গল্পটির ওপর ওই স্মৃতির ছায়াটা পড়েছে মাত্র। লেখার সময় যে এটা মাথায় রেখেই লেখা শুরু করেছি, তেমনটা নয়। ঘটনাটা গল্পের জমিটুকু সরবরাহ করেছে এটা যেমন সত্যি, আর তার ওপর আমি কল্পনার বিস্তার ঘটিয়েছি. তাও তেমনি সত্যি। কথাসাহিত্যে কল্পনা বাদ দিলে বাস্তব পোক্ত হয় না; বাস্তব বাদ দিলে কল্পনা ডানা মেলে না। দুটোই সমান দরকারি। ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ লেখার নেপথ্য কাহিনীটা এখানে বলি। গল্পটা কোথায় ছিল? খুলনার ফুলতলার এক গ্রামে একটা বিলের কাছে লাগোয়া একটা কুঁড়েঘরে, দেশভাগের পর যখন সেখানে চলে এসেছি, একটা পরিবারকে দেখতে পাই। পরিবার বলতে এক বৃদ্ধ- তিনি শারীরিকভাবে খুবই দুর্বল, আর এক কিশোরী। তারা সম্পর্কে মামা-ভাগ্নি। তাদেরকে ঘিরে তখন এলাকায় নানা কানাঘুষা শোনা যেত। দেশভাগের পর ওপার থেকে প্রায় খালি হাতে এসেছে, খুব দরিদ্র অবস্থায় তারা দিন কাটায়। মামা ও নিজের পেটের ক্ষিদে নিবারণের জন্য মেয়েটিকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও শরীর বিক্রি করতে হয়। এলাকার কিছু বখাটে ছেলেপুলে লালসা মেটাতে ওই ঘরে নাকি নিয়মিত যায়। ওই মামার চরিত্রটি আমার গল্পে হয়ে গেছে বৃদ্ধ বাবার চরিত্র। মেয়েটিকে কারা ওই পথে এনেছিল, কেউ তাকে জোর করে ওই কাজে প্রথম বাধ্য করেছিল কি-না, আমি কিছু জানি না। ঘটনাটা জানার পর দুই কি আড়াই বছর পর, ওই ঘটনার কঙ্কালের সাথে কল্পনা ও প্রেক্ষিতের রক্ত-মাংস মিশিয়ে গল্পটি চূড়ান্তভাবে লিখে ফেলি। এর আগে দু-তিনবার চেষ্টা করলেও পারিনি। সময়ের দূরত্বটাই হয়তো লেখাটা সার্থকভাবে গড়ে দিতে সাহায্য করেছে।
চলে গেলেন কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক
প্রশ্ন: বরাবরই দেখেছি, আপনি খুব সামাজিক মানুষ। কিন্তু নিজের কাছে আবার খুবই একলা। এই যে সবাই ডাকলেই সভা-সমিতিতে যান, এমনকি একটা কথা চালু আছে- পাড়ার মোড়ের চায়ের দোকানে সাহিত্যসভা বসিয়ে সেখানে আপনাকে ডাকলেও যেতে দ্বিধা করবেন না। কখনও এসব সভাতে যেতে বিরক্তি বোধ করেন না? আমার তো মনে হয়, এ কারণে আপনার লেখার সময়েরও অপচয় হতে পারে।
উত্তর: সভা-সমিতি আমার লেখাকে কোনোদিনই বাধাগ্রস্ত করেনি। একটা দিন বাইরে যাব, সেটা থেকেও তো শিখব। লেখা তো নানান অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়। তুমি মনে করছ একটা বিষয় তুমি জানো, আসলে তো তা জানো না। অনেক কিছুই জানো না। এই জানা-বোঝা কি অবগত হওয়াটা ঘটে তখনই, যখন তুমি বাইরের মানুষের সঙ্গে মেশো; বহু রকম মানুষের সঙ্গে মেশো। এসি রুমে বসে লেখক হওয়া যায় না। কাজেই সভা-সমিতিকে আমি গুরুত্ব দিই। তবে আজকাল সভায়-অনুষ্ঠানে যেতে তেমন ইচ্ছা করে না দুটো কারণে। প্রথমত, শরীর আগের তুলনায় কিঞ্চিৎ দুর্বল। দ্বিতীয়ত, খুব বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতা পাওয়ার সুযোগ আর ঘটছে না।
প্রশ্ন: আপনার জীবনকে ভাগ করে দেখলে মনে হয়, তিনটি ভূখণ্ড আপনার গড়ে ওঠায় বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। প্রথমটি আপনার জন্ম-ভূখণ্ড রাঢ় অঞ্চল, দ্বিতীয়টি দেশভাগের পর যেখানে আবাস খুঁজে নিলেন, সেই খুলনা এলাকা; আর তৃতীয়টি রাজশাহী। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদানের পরই যেন আপনার জীবনের বহিরঙ্গে একটা স্থিরতা এলো…একটা আর্কষণীয় বন্ধুবৃত্ত খুঁজে পেলেন, যারা প্রত্যেকেই একেকজন গুণী লেখক-কর্মী-চিন্তক…
উত্তর: রাজশাহীর এই বন্ধুবৃত্ত না থাকলে আমি সম্পূর্ণ হতাম না। বলতে পার, আমি বন্ধুকৃত্য করতে পারলে রীতিমতো বর্তে যাই। খুব পছন্দ করি তাদের, খুব ভালোবাসি। এরা যখন আসেন, গল্প করেন, কথা বলেন’ দারুণভাবে উজ্জীবিত হই। কষ্টের বিষয়, এই বৃত্তের কয়েকজন আর নেই। প্রয়াত আলী আনোয়ার, রমেন্দ্রনাথ ঘোষ, নাজিম মাহমুদের কথা খুব মনে পড়ে। কয়েকজনকে আবার কাছে পাই না। গোলাম মুরশিদ লন্ডনে, শহিদুল ইসলাম ঢাকায়। হাতের কাছে আছেন একমাত্র সনৎকুমার সাহা। কাছে মানে নিকট প্রতিবেশীই আদতে। ‘রণে বনে জলে জঙ্গলে’ সর্বত্র তিনি আমার পাশে আছেন। আমার সব লেখার প্রথম পাঠক তিনি, আবার তার লেখারও প্রথম পাঠক আমি। আমাদের এই বন্ধুবৃত্ত বিষয়ে একটা কথা বলা যায়- ডব্থৎব ড়হব নঁঃ ব্থিৎব হড়ঃ :যব ংধসব. মানবিকতার শর্তে, শ্রেয়বোধের দিক থেকে আমরা সবাই এক, কিন্তু আমাদের প্রত্যেকের চিন্তার প্রক্রিয়া, লেখালেখি বা জীবনযাপনেও ভিন্নতা রয়েছে। এই বৈচিত্র্যের হারমোনিটাই আমাদের মধ্যে ঐক্যের বন্ধন গড়েছে। বন্ধুত্বকে এত নিবিড়, এত দৃঢ় করেছে। স্থানিক দূরত্ব যতই থাক, পরস্পরকে আমরা কখনোই মনের আড়াল হতে দিই না।
প্রশ্ন: আপনার পরিবারের প্রসঙ্গ নিয়ে একটু কথা বলি। একদম সাদামাটা প্রশ্নই হবে হয়তো। তারা কীভাবে আপনার বেড়ে ওঠা, লেখালেখিতে প্রভাব রেখেছেন?
উত্তর: আমার ছেলেবেলার যৌথ পরিবারের কথা প্রথমে বলি। আমার জীবনে তার অবদানও কম নয়। সেখানে আমি গায়ে মাটি মাখতে শিখেছি, সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশতে শিখেছি, গ্রামজীবনকে ভালোবাসতে শিখেছি। আমার বাবা-মা ও অন্য গুরুজনরা কখনও সামনে কোনো দেয়াল তুলে দেননি। বরং উল্টোটাই করেছেন, তারা আমার চারপাশের সব দেয়াল ভেঙে দিয়েছিলেন। আমি রাখালদের সাথে দিনের পর দিন মাঠে কাটিয়েছি, বাবা বা মা কিছুই বলেননি। একটু ভ্রূকুঞ্চনও নয়। যখন বিয়ে করলাম, তখন ত্রাতা হয়ে এলেন আমার প্রয়াতা স্ত্রী। যেটা অনেকেই জানে না, তিনি খুব নির্ভুল বাংলা লিখতে পারতেন। লিখতে বসে কোথাও খেই হারিয়ে ফেললে তিনিই ধরিয়ে দিতেন। আর আমার ভেতরের একাকিত্ব, শিল্প সৃষ্টির সময় আমার ভেতরের যে দহন- সেটা তিনি ছাড়া আর কেউ বুঝতেন না। আমার ওপর রাগ করতেন শুধু একটা সময়েই, যখন আমি কোনো লেখালেখির কাজ না করে অলস সময় পার করতাম। বাড়িতে আড্ডা দিলে কিছু বলতেন না, উল্টো ক্ষণে ক্ষণে চা-শিঙ্গাড়া ইত্যাদি খাদ্যের জোগান দিয়ে সহায়তা করতেন। কখনও নিজেও আড্ডাতে যোগ দিতেন। কিন্তু যখনই আমি কিছু করছি না; রেডিওতে বিবিসির খবর শুনছি কি একটু টিভি দেখছি; অমনি তিনি খুব বিরক্ত হতেন। রাগ করে বলতেন, ‘এসব করে সময় নষ্ট করছ কেন? লিখতে বসবে না?’
প্রশ্ন: লেখালেখির ক্ষেত্রে কখনও কোনো রুটিন মেনে চলেছেন বা মেনে চলার কথা ভেবেছেন?
উত্তর: হ্যাঁ, মানি তো! সকাল ১০টায় লেখার ঘরে ঢুকি। বেলা দুটো কি আড়াইটা পর্যন্ত লেখাপড়ার কাজ করে স্নান-আহার শেষ হওয়ার পর সন্ধ্যা ছটা পর্যন্ত গান শুনি। তার পর একটু হাঁটাহাঁটি করে ৮টার পর আবার এসে লেখার টেবিলে বসলাম। এভাবে চলল ১০টা পর্যন্ত। তারপর খাওয়া আর ঘুম।
প্রশ্ন: হায়াৎ মামুদ একবার আপনাকে ‘নিষ্ঠুর তান্ত্রিক’ বলে বসেছিলেন। কিন্তু এ ধরনের মূল্যায়ন কি বেশি একপেশে বলে মনে হয় না?
উত্তর: এ নিয়ে আমি আর কী বা মন্তব্য করতে পারি! সদ্য প্রয়াত কথাসাহিত্যিক রবিশংকর বল আমাকে একদিন টেলিফোনে একদম এর উল্টো কথা বলেছিলেন। তার কথা ছিল এমন :’আপনার লেখায় তো আমি কেবল রাগই পাই না, পাই স্নিগ্ধতাও। শুধু বিচ্ছিন্নতা বা নির্লিপ্ত আখ্যানই নয়; পাই মানুষে মানুষে সংযোগের কথাও।’ তবে কী, আমি তো খুব আবেগপ্রবণ মানুষ; তাই নিজের কলমে একটা নির্লিপ্ততার আবরণ বসিয়ে রেখেছি। বলতে পার, আমার লেখায় এই নির্লিপ্ত ভাবটা আমি ইচ্ছা করেই বেশি এনেছি। লেখার কোথাও, কোনো লাইনে এই ব্যক্তি ‘আমি’কে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে পড়তে দিইনি। অথচ আড়ালে আড়ালে গভীরভাবে লেখার সাথে না জড়িয়ে থাকলে ওই নির্লিপ্ততার আবরণটুকু অর্জন করা যায় না।
ব্যাপারটা হয়ে দাঁড়িয়েছে নারকেলের খোলের মতো। মুশকিল যে, সবাই স্রেফ খোলটাই দেখে। খোলের ভেতরের শাঁসটুকু আবিস্কারে বড়ই অনীহা। নির্লিপ্ততা মানে তো আর আবেগহীনতা নয়। কিন্তু আবেগকে সংযম ও দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করতে হবে। যেন তা আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে না যায়। ভাষার ব্যাপারেও একই রকম সংযম আমার প্রার্থিত। আমি তো সর্বনিম্ন পরিমাণে শব্দ ব্যবহার করে একটি বাক্য লিখতে চাই। কিছুতেই কোনো বিশেষণ বসাতে চাই না। এ ব্যাপারে আমি একটুখানি আর্নেস্ট হেমিংওয়ের শিষ্য, বলতে পার। তিনি ওইভাবে লিখতেন। কিছুতেই ওভার-স্টেটমেন্টে যেতেন না, আন্ডার-স্টেটমেন্ট করতেন। অথচ লেখার মধ্যে ভায়োলেন্স ও মৃত্যু থই থই করছে।
প্রশ্ন: ‘সাবিত্রী উপাখ্যান’ উপন্যাসেও তো ভায়োলেন্স প্রচণ্ড পরিমাণে রয়েছে।
উত্তর: সেটা হেমিংওয়ের থেকে একদম আলাদা ধরনের ভায়োলেন্স। ওই বইটা লিখতে গিয়ে আমাকে অসহনীয় মানসিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল। গোটা আখ্যানকে সামলানো আমার জন্য খুব কঠিন কাজ ছিল।
প্রশ্ন: কোনো বিশেষ লেখা শেষ করতে না পারার বা লিখতে না পারার খেদ আপনার আছে কি?
উত্তর: ‘তরলাবালা’ উপন্যাসটি এখনও শেষ করতে পারলাম না- এই খেদ আছে। ভেবেছিলাম, এটা শ’পাঁচেক পৃষ্ঠার একটি উপন্যাস হবে; একশ’ পাতা লিখে থেমে আছি। ভারত ভাগ বা বাংলা ভাগ নিয়ে একটি বড় উপন্যাস লিখতে চেয়েছিলাম। কীভাবে ইতিহাসকে চিরতরে এ ঘটনাটি ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে, তা নিয়ে লেখার কথা এখনও মাঝে মাঝে ভাবি। লিখতে পারলে তার মধ্যে একটা মহাকাব্যিক স্বভাব বিস্তারের চেষ্টা করতাম। কিন্তু জানি আর হবে না, কোনোদিন লিখতে পারব না সেই স্বপ্নের উপন্যাসটি। একদিকে অন্য অনেক লেখার কাজ পড়ে আছে- আর এর বিষয়কে আমি কতটুকু নির্লিপ্ততার সঙ্গে ধারণ করতে পারব, তা নিয়েও রয়েছে সংশয়। তাও এর ভাবনা আজও আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। ওই যে বলে না- ধন্য আশা কুহকিনী! আশার কুহক এখনও আমার পিছু ছাড়েনি।
মাসুদ করিম - ১৭ নভেম্বর ২০২১ (৩:২৮ পূর্বাহ্ণ)
একি মন্তব্য করলেন বিচারক কামরুন্নাহার!
https://opinion.bdnews24.com/bangla/archives/68036
একজন বিচারকের অদক্ষতা সমাজ জীবনে যে চরম অমানিশা নামিয়ে আনতে পারে, তার প্রমাণ পাওয়া গেল নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালতের বিচারক কামরুন্নাহারের রাজধানী বনানির রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণের মামলায় এখতিয়ারবহির্ভূত পর্যবেক্ষণ এবং রায় দিয়ে । বহু আলোচিত ওই ধর্ষণ মামলার রায় দিতে গিয়ে তিনি যেসব মন্তব্য করেছেন তা একদিকে যেমন আইনের সাথে সাংঘর্ষিক ও অবিশ্বাস্য, অন্যদিকে ভয়ংকরও বটে।
তিনি লিখেছেন, ‘ধর্ষণের অভিযোগের ৭২ ঘণ্টা পরে পুলিশ যেন ধর্ষণের অভিযোগে এজাহার গ্রহণ না করে।’ এই উদ্ভট মন্তব্যের পেছনে যে কারণটি তিনি বোঝাতে চেয়েছেন তা হলো- এতো সময় পরে ধর্ষিতার দেহে আর আসামির বীর্য উপস্থিত থাকে না। এ কথা বলে তিনি প্রমাণ করেছেন যে তার মেডিকেল জুরিসপ্রুডেন্সে জানাশোনার সীমাবদ্ধতা রয়েছে। অথচ ফৌজদারি মামলার সাথে জড়িত, বিশেষ করে খুন ধর্ষণের মামলার সাথে জড়িত সকল আইনজ্ঞ এবং বিচারকদের মেডিকেল জুরিসপ্রুডেন্সে জ্ঞান এতোই অপরিহার্য যে এ ছাড়া খুন ধর্ষণের মামলা করা অসম্ভব। বিচারক কামরুন্নাহারের যদি মেডিকেল জুরিসপ্রডেন্সে ন্যূনতম জ্ঞানও থাকতো তাহলে তিনি জানতেন যে বীর্য বিশ্লেষণই ধর্ষণ প্রমাণের একমাত্র সাক্ষ্য নয়। এটি প্রয়োজন হয় ডিএনএ- এর উপস্থিতি পরীক্ষার জন্য। কিন্তু ডিএনএ ছাড়াও ধর্ষণ প্রমাণের বহু পন্থা রয়েছে।
মেডিকেল জুরিসপ্রুডেন্স- এর অতি পরিচিত লেখক অধ্যাপক জয়সিং মুদি লিখেছেন, ধর্ষণের চিহ্ন ধর্ষিতার সারা দেহেই থাকতে পারে। যেমন- ধর্ষিতার বাহুতে, হাতের কব্জিতে, মুখে, বক্ষদেশে, বিশেষ করে স্তনে, তলপেটের নিম্নাংশে, উরুতে এবং পিঠে। এসব এলাকায় নখের আঘাতের দাগ, ক্ষতচিহ্ন, ফুলে যাওয়া বা জোর প্রয়োগের চিহ্ন থেকে ধর্ষণের প্রমাণ পাওয়া যায়। এছাড়া বক্ষদেশে স্তনবৃন্তে, গালে, ঠোঁটে কামড়ের দাগও ধর্ষণ প্রমাণের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। তবে ধর্ষিতার যৌনাঙ্গের ক্ষতকেই অধ্যাপক মুদি বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ধর্ষণের বহু পরেও যৌনাঙ্গ থেকে মৃদু রক্তপাত হতে পারে। তদুপরি যৌনাঙ্গের অভ্যন্তরে এবং আশেপাশে দাগ, রক্তাক্ত লাল অবস্থা, ছেঁড়া ও ফোলা অবস্থা, ক্ষতও বড় প্রমাণ। মুদির ভাষ্য, ধর্ষণের ৮/১০ দিন পরে এসব চিহ্নগুলো ধীরে ধীরে কমতে থাকলেও বহুদিন পর্যন্ত তা নির্ণয় করা যায়। তিনি লিখেছেন, যৌনাঙ্গের অভ্যন্তরের পোস্টারিয়ার এবং বাইরে ভালবা এলাকায় ছিঁড়ে যাওয়ার চিহ্ন থাকা খুব স্বাভাবিক, যা কয়েকমাসেও সেরে যায় না। ভালবা অঞ্চলেও ছোট/বড় ক্ষত পাওয়া যায়। এসব এলাকায় ধস্তাধস্তির প্রমাণও বহুদিন থাকে। যৌনাঙ্গের নালিতেও ধর্ষণের চিহ্ন থাকে। মুদি এবং আলেকজান্ডার উভয়েই লিখেছেন- ধর্ষণ এবং স্বাভাবিক যৌন সম্পর্কের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য হলো এই যে, ধর্ষণে বলপ্রয়োগের কিছু না কিছু চিহ্ন থেকেই যায়, যা বহুকাল পরেও নির্ণয় করা যায়।
বহু আলোচিত ইয়াসমিন ধর্ষণ-হত্যা মামলা হাইকোর্টে পরিচালনার ভার পড়েছিল আমার ওপর। আমি তখন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল। ইয়াসমিন মামলা দায়েরেও বেশ বিলম্ব হয়েছিল। তার মৃতদেহে বীর্যের কোনও চিহ্নই ছিল না। সে সময়ে ডিএনএ পদ্ধতিও আবিষ্কৃত হয়নি। তারপরও যৌনাঙ্গের এবং দেহের অন্যান্য স্থানের ক্ষত, আঘাতের চিহ্ন, ফোলা অবস্থা, দাগ, নখের প্রয়োগের চিহ্ন এবং বলপ্রয়োগের বিভিন্ন প্রমাণ থেকেই হাইকোর্ট নিশ্চিত হয়েছিল যে ইয়াসমিনকে ধর্ষণ করে পরে পুলিশের গাড়ি থেকে ফেলে দেওয়ায় তার মৃত্যু হয়েছিল। সেই মামলায় তিনজন পুলিশ সদস্যের ফাঁসি হয়েছিল। তাছাড়া বহু আলোচিত বরিশালের স্মৃতি কণা ধর্ষণ মামলায় হাইকোর্ট পরিষ্কারভাবে বলেছিল, ‘আদালত যদি ধর্ষিতার একক সাক্ষ্যকে বিশ্বাসযোগ্য মনে করে, তাহলে ধর্ষিতার একক সাক্ষ্যের ভিত্তিতেই আসামির সাজা হতে পারে।’ ওই মামলায় স্মৃতি কণার একক সাক্ষীর ভিত্তিতেই হাইকোর্ট আসামিকে সাজা দিয়েছিল। আপিল বিভাগও সেই রায় অনুমোদন করেছিল বিধায় এটি এখন দেশের আইন। বিচারক কামরুন্নাহার নিশ্চয়ই সেই রায়টি পড়ে দেখেননি। অথচ এই যুগান্তকারী রায়টি ধর্ষণ মামলার সাথে সম্পৃক্ত সকলের জানা উচিত।
বিচারক কামরুন্নাহার আর একটি অমার্জনীয় অন্যায় করেছেন এই বলে যে, ‘ধর্ষণের অভিযোগ আনা দুই নারী আগে থেকেই যৌন কার্যকলাপে অভ্যস্ত’। ধর্ষণের মামলায় এ ধরনের তথ্য বিবেচনায় নেওয়া শুধু আইনবিরোধী নয়, মারাত্মক ধরনের বিকৃতিও বটে। পৃথিবীর অনেক দেশের সাক্ষ্য আইনেই ধর্ষিতদের যৌনজীবনের ওপর কোনও প্রশ্ন করতে দেওয়া হয় না, যা সম্ভবত আমাদের দেশেও হতে যাচ্ছে। আইন অনুযায়ী এমনকি একজন যৌনকর্মীও উপযুুক্ত ক্ষেত্রে ধর্ষণের মামলা করতে পারেন।
বিচারক কামরুন্নাহার বিচার জগতে নবাগত নন। তিনি জেলা জজ মর্যাদার বিচারক, অর্থাৎ বেশ জ্যেষ্ঠ। অথচ তার মন্তব্যগুলো থেকে ধরে নেওয়া যায় আইনের ব্যাপারে তার শিক্ষা বা জ্ঞান একজন সাধারণ মানুষের মতো। তার মন্তব্য নতুন করে প্রমাণ করছে নিম্নআদালতের বিচারকদের ব্যাপক প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন।
মাননীয় প্রধান বিচারপতি কামরুন্নাহারের বিচারিক ক্ষমতা রুদ্ধ করে খুবই প্রশংসনীয় কাজ করেছেন। কেননা তার মতো শিক্ষা এবং জ্ঞান বিবর্জিত বিচারকের রায় সর্বদাই ভ্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকবে। আমি হাইকোর্টের বিচারপতি থাকাকালে একজন অতি জৈষ্ঠ জেলা ও দায়রা জজের বিচারিক ক্ষমতা রুদ্ধ করে দিয়েছিলাম, কারণ সেই জেলা জজ একটি খুনের মামলায় আপস মেনে নিয়ে রায় দিয়েছিলেন।
বিচারক কামরুন্নাহারের ধ্বংসাত্মক মন্তব্যগুলোকে মুছে না ফেললে তার মারাত্মক ফলাফল রয়ে যাবে। এর ফলে পুলিশ ধর্ষণ মামলা গ্রহণ করতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলবে। তাই এগুলো অবশ্যই মুছে ফেলার উদ্যোগ নেওয়ার জন্য রায়টি হাইকোর্টে নিয়ে যেতে হবে।
বহু দেশে ধর্ষণের কয়েক বছর পরও মামলা শুধু নেওয়া হয়নি, বিচারে সাজাও দেওয়া হয়েছে। বিচারক কামরুন্নাহারের তো এগুলো জানার কথা। এটাও মনে রাখা প্রয়োজন যে, ডিএনএ শুধু বীর্য, রক্ত বা লালা থেকেই পাওয়া যায় না, নখ, চুল, খসে যাওয়া চামড়া, দাঁত প্রভৃতি থেকেও পাওয়া যায়। পরিধেয় বস্ত্রেও বীর্য, রক্ত, চুল মাসের পর মাস থেকে যেতে পারে। যেগুলো থেকেও ডিএনএ নেওয়া যায়। প্রতিটি বিচারককেই এগুলো শেখানো প্রয়োজন। এছাড়া স্মৃতি কণা মামলার রায়সহ ভারত, যুক্তরাজ্য প্রভৃতি দেশের সেই সমস্ত রায়সমূহ পড়াতে হবে যেগুলোয় বলা হয়েছে, আদালত বিশ্বাসযোগ্য মনে করলে ধর্ষিতা বা নির্যাতিতার একক সাক্ষ্যেই আসামির সাজা হতে পারে।
https://twitter.com/urumurum/status/1460810893801910272
মাসুদ করিম - ১৭ নভেম্বর ২০২১ (৬:৪৯ পূর্বাহ্ণ)
ধর্ষণ মামলার রায়ে রহস্যাবৃত বিচারিক পর্যবেক্ষণ
https://www.banglatribune.com/713109/%E0%A6%A7%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%B7%E0%A6%A3-%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%AE%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A7%9F%E0%A7%87-%E0%A6%B0%E0%A6%B9%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A6%AC%E0%A7%83%E0%A6%A4-%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%9A%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A6%95-%E0%A6%AA%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%AC%E0%A7%87%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%B7%E0%A6%A3
১৯১৯ সালে রবার্ট রিপলি (Robert Ripley) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত একটি মার্কিন ফ্র্যানচাইজি রিপলি’স বিলিভ ইট অর নট। এটি উদ্ভট, অস্বাভাবিক, অবিশ্বাস্য, কৌতূহলোদ্দীপক সত্য ঘটনাবলি জনসমক্ষে তুলে ধরে। যেমন, ১৮৫৩ সালে জন কফি নামের এক ব্যক্তি আয়ারল্যান্ডের ডানডকে কারাগার নির্মাণ করেন। শেষমেশ তিনিই ওই কারাগারের প্রথম বন্দি হিসেবে ঢোকেন ঋণ পরিশোধ করতে না পারায়! যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউজে প্রথম টেলিফোন বসানো হয় ১৮৭৭ সালে এবং ফোন নম্বরটি ছিল এক সংখ্যার – ‘১’!
রিপলি’স বিলিভ ইট অর নট-এ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে বাংলাদেশি শিশু ওয়াসিক ফারহান রূপকথা। ৬ বছর বয়সী অসাধারণ মেধার অধিকারী এই রূপকথাকে বিশ্বের সবচেয়ে কম বয়সী কম্পিউটার প্রোগ্রামার হিসেবে অভিহিত করে ‘বিস্ময়কর বালক’ স্বীকৃতি দিয়ে একটি বিশেষ ছবি প্রকাশ করেছে রিপলি’স বিলিভ ইট অর নট। আমাদের বিচার বিভাগ শত সীমাবদ্ধতার মাঝেও যেভাবে কাজ করে যাচ্ছেন তাতে এটি রিপলি’স বিলিভ ইট অর নট-এ ঠাঁই করে নিলে অবাক হবো না। যুক্তরাষ্ট্রে ৩২ কোটি জনসংখ্যার বিপরীতে যেখানে ৮৬ হাজার বিচারক রয়েছেন, সেখানে ১৬ কোটি মানুষের বাংলাদেশে অনুমোদিত বিচারকের পদই আছে মাত্র এক হাজার ৬৫৫টি। এই পদের মধ্যে কয়েক’শ আবার শূন্য। কর্মরত বিচারকদের মধ্যে আবার শতাধিক বিচারক বিচারকাজের বাইরে প্রেষণে রয়েছেন।
সময়ের পরিক্রমায় রাষ্ট্র ও সমাজের চাহিদা অনুযায়ী আইন প্রণয়ন করে নতুন নতুন বিষয়কে বিচারিক কার্যক্রমের আওতাভুক্ত করা হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ জন্য পর্যাপ্ত আদালত তৈরি করা হয়নি। বিদ্যমান আদালতের ওপর তা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, সাইবার ক্রাইম, মানবপাচার, পরিবেশ, ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালের কার্যাবলির বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারে। এ ছাড়া সময়ে সময়ে একটি উপজেলা ভেঙে একাধিক উপজেলা ঘোষণা করে উপজেলা নির্বাহী অফিসার, ওসি, এএসপি ও অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তার পদ সৃষ্টি করা হলেও এসব নবসৃষ্ট উপজেলার জন্য বিচারকের পদ সৃষ্টি করা হয়নি। ফলে এক উপজেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত বিচারককে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে একাধিক উপজেলার বিচারকের দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। ধর্ষণ-নির্যাতনের এক লাখ ৭০ হাজার মামলার বিপরীতে ১০১টি ট্রাইব্যুনাল আছে। তার মানে প্রতি বিচারককে এক হাজার ৬৮৪টি মামলার দ্রুত বিচার করতে হবে। এ মামলার বিচার চলাকালে যুক্ত হবে আরও নতুন মামলা।
অন্যদিকে ট্রাইব্যুনালের বিচারককে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের অধীনে মামলার বিচার ছাড়াও শিশু আইনের অধীনেও বিচারিক দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে। আর এ প্রক্রিয়ায় মামলাজট ফুলেফেঁপে উঠছে দিন, মাস, বছর গড়িয়ে। এ অবস্থায় বিচারকের সংখ্যা বাড়ানোর বিকল্প নেই। কিন্তু সমস্যা হলো অধিক সংখ্যক বিচারক নিয়োগ হলে এজলাস কোথায় পাওয়া যাবে?
বিচার বিভাগ তো ভয়ংকর ভৌত অবকাঠামো সমস্যায় জর্জরিত। দেড়শ’ বছরের পুরাতন বাঁশের বেড়া, কাঠের খুঁটি ও টিনের ছাউনিযুক্ত পটিয়া আদালত ঘর। আদালত ভবন বললে এর বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ প্রকাশ পায় না, এটি প্রায় কুঁড়েঘর। বহুকাল আগে থেকে জং ধরা টিনের চালা মাটির মতো ঝুরঝুরে হয়ে কোনও এক অজানা রহস্যে ভর করে এখনও বসে আছে, মেরামত করতে ওপরে ওঠা যায় না, পায়ের সামান্য চাপেই ফেটে ও ভেঙে যায়। বৃষ্টি এলে আদালতের কাজ বন্ধ করে জজ সাহেবদের দৌড়াতে দেখেছি বিচারের নথিপত্র ও জনগণের ধন-সম্পত্তির অতি মূল্যবান দলিলপত্র বাঁচানোর জন্য। যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজসহ সাতটি আদালত রয়েছে পটিয়ায়। কিন্তু বিচারকদের জন্য নেই কোনও বাসস্থান।
ব্রিটিশরা বিচারকদের জন্য তিনটি ‘মুন্সেফ কোয়ার্টার’ তৈরি করলেও সময়ের পরিক্রমায় বিচারকদের বাসস্থান ‘মুন্সেফ কোয়ার্টার’-এর কোনও চিহ্ন নেই। ঘন ঝোপঝাড়ে পোকামাকড় আর সাপের ঘর-বসতি ওইসব ‘মুন্সেফ কোয়ার্টার’। বিচারকগণ থাকেন ভাড়া বাসায়। বিচারক পেশার মানুষদের অপেক্ষাকৃত বেশি ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও পটিয়ার বিচারকগণ পায়ে হেঁটে বা রিকশায় আসেন আদালতে। অনেক জেলায়ই বর্তমান বিচারকদের একই এজলাস ভাগাভাগি করে বিচারকাজ চালাতে হচ্ছে। দিনের এক অংশে একজন বিচারক এজলাসে বসছেন আর দিনের অপর অংশে আরেকজন বিচারক সেই এজলাসে বসে বিচারিক কাজ করছেন। ফলে বিচারক তাঁর দায়িত্বের পুরোটা পালন করতে পারছেন না কেবল এজলাসের অভাবে। এভাবে বিচারকের অব্যবহৃত সময় ও সম্ভাবনা মামলাজটে ভূমিকা রাখছে।
যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ১০ হাজার নাগরিকের বিপরীতে একজন ও ভারতে ৬৭ হাজার নাগরিকের বিপরীতে একজন করে বিচারক কর্মরত। আর বাংলাদেশে প্রায় দেড় লাখ নাগরিকের বিপরীতে কর্মরত বিচারকের সংখ্যা মাত্র একজন। এক গবেষণায় প্রকাশ, যে হারে মামলা নিষ্পত্তি ও নতুন মামলা দায়ের হচ্ছে এ অবস্থার পরিবর্তন না হলে আগামী কয়েক’শ বছরেও মামলাজট নিরসন সম্ভব নয়। বিচারব্যবস্থার পদ্ধতিগত ভয়ানক ত্রুটির সংস্কার না করে বিচারকের সংখ্যা বাড়ালেই মামলাজট নিরসন ও বিচারের দীর্ঘসূত্রতা থেকে রেহাই মিলবে জোর দিয়ে বলার উপায় নেই।
উদাহরণস্বরূপ, একটি দেওয়ানি মামলা দায়েরের পর বিবাদীর ওপর সমন জারি ও বিবাদীর লিখিত জবাব দাখিল হতে বছরের পর বছর চলে যায়। এখানে সমন জারির সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের কারসাজি বন্ধে ও বিবাদীর জবাব দাখিলের ক্ষেত্রে আইনের সংস্কার করা না হলে বিচারকের সংখ্যা বাড়িয়ে কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।
সব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও অধিকাংশ বিচারক তাঁদের সবটুকু মেধা, শ্রম, নিষ্ঠা ও সততা দিয়ে চেষ্টা করছেন দায়িত্ব পালন করতে, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে। তবে কিছু বিচারকের দায়িত্বহীনতা ও কর্মকাণ্ড দেখলে আপনি নিশ্চিতভাবেই বিস্মিত হবেন, ক্ষুব্ধ হবেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছু বিচারক ডিজিটাল সুরক্ষা আইন লঙ্ঘন করে অপরের সম্মানহানি করছে, ভয়ংকর মিথ্যাচার করছে। আবার কারও বিচারের রায় আইন ও সংবিধানের সীমাকে লঙ্ঘন করছে।
সম্প্রতি বহুল আলোচিত রেইন্ট্রি হোটেল ধর্ষণ মামলার রায়ে পাঁচ আসামিকেই খালাস দিয়েছেন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোছাম্মাত কামরুন্নাহার। রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেছেন, (পত্রপত্রিকার বিবরণ অনুযায়ী), ‘মামলার দুই ভিকটিম বিশ্বাসযোগ্য নয়। ভিকটিম দুজনই আগে থেকেই সেক্সুয়াল কাজে অভ্যস্ত, হাসপাতাল রিপোর্ট তাই বলে। অহেতুক তদন্ত কর্মকর্তা প্রভাবিত হয়ে আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছেন। এতে আদালতের ৯৪ কার্যদিবস নষ্ট হয়েছে। এরপর থেকে পুলিশকে এ বিষয় সতর্ক থাকার পরামর্শ দিচ্ছি। এছাড়া এখন থেকে ধর্ষণের ৭২ ঘণ্টা পর যদি কেউ মামলা করতে যায়, তা না নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘দুই ভিকটিম স্বেচ্ছায় রেইনট্রি হোটেলে যান। সেখানে উভয়ের সম্মতিতে তারা সাফাত আহমেদ ও নাঈম আশরাফের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করেন। তাদের ভয়ভীতি বা মারধর করে ধর্ষণ করা হয়নি। ঘটনার ৩৮ দিন পর আসামি সাফাত আহমেদের তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রী ফারিয়া মাহবুব পিয়াসার প্ররোচনায় মামলা করা হয়। ধর্ষণের উপাদান না পাওয়ার পরও পুলিশ মামলাটি তদন্ত করে অহেতুক ট্রায়ালে পাঠায়।’
বিচারকের পর্যবেক্ষণ বেশ কিছু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে –
এক. নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোছাম্মাত কামরুন্নাহার জেলা ও দায়রা জজের পদমর্যাদাসম্পন্ন। এই অবস্থায় আসতে তিনি কম-বেশি ২০ বছর বিচারিক কাজ করেছেন। তিনি কি জানেন না নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করার কোনও সময় বেঁধে দেওয়া নেই? আর সংবিধান ভিকটিমকে বিচার চাওয়ার অধিকার দিয়েছে?
দুই. বিচারক বলেছেন, মেডিক্যাল রিপোর্ট ও ডিএনএ টেস্টে ধর্ষণের প্রমাণ মেলেনি। তিনি এর আগেও ধর্ষণ মামলার বিচার করেছেন। সহকর্মীদের অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ হয়েছেন। শুধু মেডিক্যাল রিপোর্টই ধর্ষণ মামলার বিচারের একমাত্র সাক্ষ্য প্রমাণ নয়।
২০১০ সালে Utpal Das and another vs. State of West Bengal মামলায় ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বলেন, ‘ধর্ষিতার মেডিক্যাল পরীক্ষায় তার গোপনাঙ্গে কিংবা শরীরে ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায়নি – আসামিপক্ষের আইনজীবীর এ যুক্তির কারণে ধর্ষিতার মামলাকে অবিশ্বাস করার কারণ নেই।’
অপরাধ শনাক্ত করতে ফোনকল, এসএমএস, সিসিটিভি ও ভিডিও ফুটেজ, গতিবিধি নজর রাখা ও পারিপার্শ্বিক তথ্য-প্রমাণসহ অনেক পদ্ধতি রয়েছে, যার দ্বারা অপরাধ প্রমাণ করা যায়। আমাদের উচ্চ আদালত ও ভারতের উচ্চ আদালতের স্পষ্ট নির্দেশনা আছে, শুধু ভিকটিমের সাক্ষ্যের ভিত্তিতেও বিচার করা যাবে। পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য এবং আলামতের ভিত্তিতেও বিচার করা যাবে। ২০১৫ সালে মুম্বাই হাইকোর্ট এক মামলায় শুধু ধর্ষিতা স্কুলছাত্রীর বক্তব্যের ভিত্তিতে আসামিকে সাজা দিয়ে বলেন, ‘If the statement of a rape victim is trustworthy and reliable, further corroboration is not needed.’
ধর্ষিতার বক্তব্য যাচাই করার জন্য যদি সাক্ষ্যের প্রয়োজন হয়, তবে পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যকে (Evidence of Circumstance) বিবেচনায় নেওয়া উচিত। ২০১২ সালে কাটোয়া-আমোদপুর লাইনের ট্রেন থেকে একজন নারীকে নামিয়ে নিয়ে ধর্ষণের মামলায় বলা হয়েছে, একজন মহিলাকে যখন একাধিক পুরুষ জবরদস্তি ট্রেন থেকে নামিয়ে নিয়ে যায় তখন তাদের উদ্দেশ্যকেই তদন্তে ও বিচারে ‘পাখির চোখ’ করা উচিত। স্কুলছাত্রীকে তার যাওয়া-আসার পথে মিথ্যা বলে ধর্ষকের নিজের বাড়ি বা কোথাও নিয়ে যাওয়াকেই পারিপার্শ্বিক প্রমাণ হিসেবে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
তিন. রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেন, ‘মামলার দুই ভিকটিম বিশ্বাসযোগ্য নয়। ভিকটিম দুজনই আগে থেকেই সেক্সুয়াল কাজে অভ্যস্ত, হাসপাতাল রিপোর্ট তাই বলে। একজন সেক্সুয়াল কাজে অভ্যস্ত হলেই তিনি মিথ্যুক এটা নিশ্চিত করে বলা যাবে? আর সেক্সুয়াল কাজে অভ্যস্ত এটি ডাক্তারি রিপোর্টের ভিত্তিতে চূড়ান্তভাবে নিশ্চিত হওয়া যায়?
আমাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষায় কত ভুল রিপোর্ট আসে। পত্রিকায় দেখেছি পুরুষের মূত্র পরীক্ষায় প্রেগন্যান্সি টেস্ট পজিটিভ এসেছে। একই ব্যক্তির রক্তের গ্রুপ তিন ল্যাবে তিন রকম এসেছে। ক্যানসার, হৃদরোগ নির্ণয় হওয়ার পর বিদেশে গিয়ে দেখা গিয়েছে এসব কিছুই হয়নি রোগীর। আসামিরা নিজেরাই স্বীকার করেছেন তারা সেক্সুয়াল কাজে অভ্যস্ত। আসামি নাঈম আশরাফ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেন, তিনি বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। সেই সূত্রে তাঁর সঙ্গে বেশ কিছু মডেলের পরিচয় ছিল। তারা সুযোগ পেলে ইচ্ছেমতো এই নারীদের ব্যবহার করতেন। জন্মদিনের অনুষ্ঠানেও বিকেল থেকে দু’জন মডেল ছিলেন। পরে তাদের অনুরোধে আরও একজন বাড্ডা থেকে যোগ দেন। আসামিদের সেক্সুয়াল কাজে অভ্যস্ততার বিষয়ে কোনও পর্যবেক্ষণ নেই কেন?
চার. দুই ভিকটিম স্বেচ্ছায় রেইনট্রি হোটেলে যান। সেখানে উভয়ের সম্মতিতে তারা সাফাত আহমেদ ও নাঈম আশরাফের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করেন। একজন মানুষ মুক্তভাবে এবং উৎসাহের সঙ্গে সম্মতি দিয়েছেন কিনা সেটা নিশ্চিত করতে হবে।
যদি মুক্তভাবে এবং উৎসাহের সঙ্গে সম্মতি দিয়ে থাকেন তাহলে তারা কেন মামলা করলেন সেই ব্যাখ্যা কী?
পাঁচ. আসামিরা ধর্ষণের স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। কিন্তু আদালত প্রশ্ন তুলেছেন এটি ধর্ষণ কিনা? আমাদের হাইকোর্ট স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন, ‘কেউ যদি আদালতে দেওয়া জবানবন্দি পরে প্রত্যাহার করার আবেদনও করেন, তাতে জবানবন্দি অগ্রহণযোগ্য হয় না।’ পাঁচ জন আসামির চার জনই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিলেও তাদের মারপিট করে জবানবন্দি নেওয়ার কথা বলেছেন বিচারক। বিচারক কী করে নিশ্চিত হলেন মারপিট করে জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে?
আসামিরা যে পরিমাণ প্রভাবশালী তাতে তাদের মারপিট করা হবে এটি কি বিশ্বাসযোগ্য?
ছয়. আদালত বলেছেন, ‘ধর্ষণের শিকার হলে ভিকটিমদের কাজ ছিল থানায় যাওয়া। তারা তা না করে আগেই তাদের বন্ধু শাহরিয়ার আহমেদ এবং স্নেহার সঙ্গে দেখা করেন।’ থানায় না গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করার কারণে মামলা বিশ্বাসযোগ্যতা হারায় কি?
সাত. তদন্ত কর্মকর্তা প্রভাবিত হয়ে আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছেন। এতে আদালতের ৯৪ কার্যদিবস নষ্ট হয়েছে। এজন্য তদন্ত কর্মকর্তাকে ভর্ৎসনাও করেন বিচারক৷ একটি গবেষণায় প্রকাশ, সারাদেশে বিচারের জন্য ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের দেড় লক্ষাধিক মামলা ঝুলে আছে। এসব মামলার বিচার চলছে ঢিমেতালে৷ বছরে নিষ্পত্তি হচ্ছে মাত্র ৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ মামলা। আর সাজা পাচ্ছে হাজারে মাত্র সাড়ে ৪ জন। সাজার হার ০.৪৫ শতাংশ। আরেক গবেষণায় দেখা যায়, সাইবার অপরাধের ক্ষেত্রে মাত্র ৩ শতাংশ অপরাধী শাস্তি পেয়েছে।
আমি যে প্রশ্নগুলো উত্থাপন করেছি তার উত্তর আমার চেয়ে ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোছাম্মাত কামরুন্নাহার ভালো করে জানেন। তাহলে কেন তিন এমন পর্যবেক্ষণ দিলেন?
করোনার এই দুঃসময়ে তাঁর কি শারীরিক বা মানসিক কোনও সীমাবদ্ধতা ছিল, নাকি অন্য কোনও বিষয় ছিল এর পেছনে? অথবা বিচার বিষয়ে তাঁর কি কোনও বিশেষ দর্শন ছিল? যেমন, তিন বন্ধু বনে গিয়ে দেখলেন একটি বাঘ শিকার ধরার জন্য একটি হরিণকে তাড়া করেছে। হরিণটি কোনোমতে বেঁচে গেলেও বাঘের থাবায় মারাত্মকভাবে জখম হলো। বাঘও শিকার হারিয়ে ব্যর্থ মনোরথে গুহায় ফিরে এলো। একই ঘটনায় তিন বন্ধুর মূল্যায়ন ভিন্ন – একজন বললেন, ‘জঙ্গলে চরম খাদ্য সংকট! বিপন্ন বাঘ।’ দ্বিতীয়জন বললো, ‘জঙ্গলে বাঘের উপদ্রব! বিপন্ন হরিণ।’
তৃতীয়জনের মূল্যায়নে ঘটনাটি হলো, ‘বাঘে-হরিণে তুমুল লড়াই!’ একজন অতি অভিজ্ঞ বিচারক কেন এমন নজির সৃষ্টি করলেন যাতে সমাজ বিক্ষুব্ধ হলো সেই রহস্য উন্মোচিত হোক, একজন আইনের ছাত্র হিসেবে এটি আমার একান্ত প্রত্যাশা। বিচারিক ক্ষমতা প্রত্যাহার কিংবা কর্মস্থল পরিবর্তন সমস্যার সমাধান নয়।
https://twitter.com/urumurum/status/1460861952507351040
মাসুদ করিম - ২০ নভেম্বর ২০২১ (১২:৪৪ অপরাহ্ণ)
এক গাছে পাঁচবার ধান!
https://samakal.com/todays-print-edition/tp-first-page/article/2111131741/%E0%A6%8F%E0%A6%95-%E0%A6%97%E0%A6%BE%E0%A6%9B%E0%A7%87-%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%81%E0%A6%9A%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%A7%E0%A6%BE%E0%A6%A8
মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার হাজীপুর ইউনিয়নের কানিহাটি গ্রাম। কৃষিনির্ভর এ গ্রামের দিগন্তজোড়া মাঠে এখন ধানক্ষেত। শিশির ভেজা বাতাসে দুলছে সোনালি ফসল। এই গ্রামেরই দুই বিঘা জমি ঘিরে টান টান উত্তেজনা। কারণ এই জমির ধান সাধারণ নয়, এই ধান ভিন্ন প্রকৃতির। বিস্ময়জাগানো পাকা এ ফসল কাটা হবে আর কয়েকদিন পর। তখন নিভৃত কানিহাটি গ্রাম থেকে সৃষ্টি হবে নতুন এক ইতিহাস। একবার রোপণে এ ধানের গাছে বছরজুড়ে পাঁচবার ফলন এসেছে।
ধানের এ নতুন জাত উদ্ভাবন করেছেন অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী ধান গবেষক ও জিনবিজ্ঞানী আবেদ চৌধুরী। তিনি সমকালকে জানান, বোরো হিসেবে বছরের প্রথমে লাগানো এ ধান ১১০ দিন পর পেকেছে। ওই গাছেই পর্যায়ক্রমে ৪৫ দিন পরপর একবার বোরো, দু’বার আউশ এবং দু’বার আমন ধান পেকেছে।
এক গাছে পাঁচ ফলনের এমন ঘটনা পৃথিবীতে বিরল বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। তবে আবেদ চৌধুরী আছেন তার উদ্ভাবন আরও এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টায়। তিনি ওই গাছেই ছয়বার ফসল তোলার গবেষণা চালিয়ে যাবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। পাশাপাশি নতুন জাতের ধানটি সারাদেশেই চাষাবাদ সম্ভব কিনা তা যাচাই করবেন। এজন্য বিভিন্ন জেলায় এ ধানের পরীক্ষামূলক চাষ করবেন।
আবেদ চৌধুরীর ভাষ্য, কম সময়ে পাকা এই ধানের উৎপাদন বেশি, খরচও কম। তবে প্রথম ফলনের চেয়ে পরের ফলনগুলোতে উৎপাদন কিছুটা কম। কিন্তু পাঁচবারের ফলন মিলিয়ে উৎপাদন প্রায় পাঁচ গুণ বেশি।
কুলাউড়ার কানিহাটি গ্রামের সন্তান আবেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে কৃষি বিষয়ে উচ্চশিক্ষা শেষে চাকরি নিয়ে চলে যান অস্ট্রেলিয়ায়। সেখানকার জাতীয় গবেষণা সংস্থার প্রধান ধানবিজ্ঞানী হিসেবে ধানের জিন নিয়ে গবেষণা করে কাটিয়ে দিয়েছেন ২০ বছর। এ পর্যন্ত তিনি প্রায় ৩০০ রকমের নতুন ধান উদ্ভাবন করেছেন। পেশাগত কারণে বিদেশের মাটিতে গবেষণা করলেও দেশে তার গ্রাম কানিহাটিতে গড়ে তুলেছেন খামার।
আবেদ চৌধুরী বলেন, ‘আম-কাঁঠালের মতো বছরের পর বছর টিকে থাকার সৌভাগ্য ধান গাছের হয় না- এটা কোনোভাবেই মানতে পারছিলাম না। তাই নেমে পড়ি গবেষণায়।’
ধান গাছের দ্বিতীয় জন্ম নিয়ে ১৪ বছর ধরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান আবেদ চৌধুরী। ২০১০ সালের ডিসেম্বর মাসে কানিহাটি গ্রামে ২৫ বর্গমিটারের একটি ক্ষেতে ২০টি ধানের জাত নিয়ে গবেষণা শুরু করেন তিনি। এর মধ্যে চীন, ফিলিপাইনসহ বিভিন্ন দেশের ও স্থানীয় ধানের জাত ছিল। যে জাতগুলোর ধান পাকার পর কেটে নিয়ে গেলে আবার ধানের শীষ বের হয়, সেগুলো তিনি আলাদা করেন। এভাবে ১২টি জাত বের করেন। তিন বছর ধরে জাতগুলো চাষ করে দেখলেন, নিয়মিতভাবে এগুলো দ্বিতীয়বার ফলন দিচ্ছে। তারপর তিনি শুরু করেন একই গাছে তৃতীয়বার ফলনের গবেষণা। তাতেও সফল হলেন। কিন্তু এর মধ্যে চারটি জাত ছাড়া বাকিগুলো চতুর্থবার ফলন দিয়ে ধ্বংস হয়ে যায়।
আবেদ চৌধুরী জানান, চারটি জাত একই গাছ থেকে পাঁচবার ফলন দিচ্ছে। এই চারটি জাতের ওপর ১০ বছর ধরে চলছে গবেষণা। চলতি বছরের জানুয়ারিতে বোরো ধানের এই চারটি জাত দুই বিঘা জমিতে রোপণ করা হয়। পরিমাণমতো ইউরিয়া সার প্রয়োগ করা হয়। সঠিকভাবে সেচ ও পরিচর্যা করার পর ১১০ দিনের মধ্যে ৮৫ সেন্টিমিটার থেকে এক মিটার উচ্চতার গাছে ফসল আসে। পরে মাটি থেকে ৩৫ সেন্টিমিটার উচ্চতায় পরিকল্পিতভাবে ওই ধান কেটে ফেলা হয়।
মে মাসে প্রথম দিকে প্রথমবার কাটা ধানে হেক্টরপ্রতি উৎপাদন হয়েছে চার টন। তারপর থেকে ৪৫ দিন অন্তর প্রতিটি মৌসুমে হেক্টরপ্রতি কখনও দুই টন, কখনও তিন টন ফলন এসেছে। সবগুলো জাত হেক্টরপ্রতি প্রায় ১৬ টন ফলন দিয়েছে।
বিজ্ঞানী আবেদ চৌধুরী বলেন, দুটি পদ্ধতির মাধ্যমে জাতগুলো করা হয়েছে। স্থানীয় জাতের সঙ্গে বিভিন্ন উচ্চ ফলনশীল জাত এবং স্থানীয় জাতের সঙ্গে স্থানীয় হাইব্রিড জাতের সংকরায়ন ঘটানো হয়েছে। ১০-১২ বছর আগে এগুলো থেকে দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয়বার ফলন দেওয়ার জন্য উপযোগী করে চিহ্নিত করা হয়।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, দেশে হেক্টরপ্রতি ধান উৎপাদন হয়ে থাকে তিন থেকে চার টন। গতকাল শুক্রবার টেলিফোনে আবেদ চৌধুরী সমকালকে বলেন, ‘এটি একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, সারা পৃথিবীর জন্য ঐতিহাসিক। আমার নিজ গ্রাম কানিহাটির কৃষকদের সমন্বয়ে আমি এটি করতে পেরেছি। সারা বছর যেহেতু ধান দিচ্ছে, সেহেতু বর্ষজীবী বলা যেতে পারে। কারণ একটি ঋতুর পরই সাধারণত ধানের জীবনের অবসান ঘটে। কিন্তু আমার উদ্ভাবিত ধান বোরা, আউশ ও আমন তিন মৌসুম বা পুরো বছর ধরে ফসল দিয়েছে।’
তিনি বলেন, সাধারণত ধান একবার লাগানো হয় এবং ১২০ দিন পর কাটা হয়। এভাবে আমাদের বোরো, আউশ ও আমন ধান আছে। আমার উদ্ভাবিত ধানগুলো লাগানো হয়েছে বছরের প্রথমে বোরো হিসেবে। তারপর একটি বোরো, দুটি আউশ এবং দুটি আমন দিয়েছে। যতবার ফসল কেটে ঘরে নেওয়া হয়েছে, ততবারই গাছটি আরও বেশি বড় হয়ে উঠেছে। এটি একটি যুগান্তকারী ফলাফল। এবার আর কয়েকদিন পর পঞ্চমবারের মতো ধান কেটে গাছগুলো রেখে দেওয়া হবে। এই গাছ থেকে আরও ফলন আনতে গবেষণা চলবে।
নতুন ধানের নামকরণ বিষয়ে আবেদ চৌধুরী বলেন, একই গাছের শরীর থেকে পাঁচবার ধান বেরিয়ে আসে। ফলে এই ধানের তিনি নাম দিতে চান ‘পঞ্চব্রীহি’। নামকরণের ব্যাখ্যা তুলে ধরে তিনি বলেন, ধানকে ব্রীহি বলা হয়। এটা যেহেতু পাঁচবার ফলন দিয়েছে, সেহেতু ‘পঞ্চব্রীহি’ নাম দিতে চাই। পরবর্তী ষষ্ঠবার ফল দিলে ষষ্ঠব্রীহি নামে নামকরণ করা যেতে পারে। তবে এই ধানের নাম এখনও তিনি চূড়ান্ত করেননি।
তিনি বলেন, বছরের যে কোনো সময়ে এ ধান রোপণ করা যায়। এখন পরের ধাপগুলোতে কিছুটা কম উৎপাদন হচ্ছে। আমার চেষ্টা থাকবে, আরও বেশি ফলন বের করার।
পঞ্চমবার ফলন দেওয়া ধান উদ্ভাবন সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরে আবেদ চৌধুরী বলেন, এর আগে আমি অন্য ধানের জাত উদ্ভাবন করেছি। দু’বার ফসল হয়, এমন ধানও উদ্ভাবন করেছিলাম; যাকে আন্তর্জাতিক মিডিয়া ‘রাইস টুআইস’ বলেছে। আবার অনেকে ‘জীবন বর্ধিত ধান’ বলেছে। এই প্রথম সারা বছর ধরে আমার অন্য আরেকটি ধানের জাত মাঠে থাকল। এ ধানের চারা ৫ সেন্টিমিটার দূরত্বে রোপণ করতে হয়। ফলে গাছটি মাটি থেকে ভালোভাবে শক্তি নিয়ে বেড়ে উঠতে পারে এবং একটি ধান গাছ থেকে আরও বেশ কয়েকটি ধান গাছ গজাতে থাকে।
এই ধান পরিবেশবান্ধব উল্লেখ তিনি বলেন, কোনো একটি জমি যতবার চাষ দেওয়া হবে, ততবার মিথেন গ্যাস ও কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গত হবে। একবার চাষ দিয়ে দু’বার ফসল উৎপাদন করলে উৎপাদন খরচ কমে যাওয়ার পাশাপাশি তা কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ কমিয়ে এনে জলবায়ু পরিবর্তনে ভূমিকা রাখবে।
ধানের এই জাতগুলোকে দেশের কৃষকদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার বিষয়ে আবেদ চৌধুরী জানান, এ ধানের বীজ সংগ্রহ সহজ। কৃষকরা নিজেরাই তা করতে পারবেন। অন্য ধানের মতো বীজতলায় রোপণের পর চারা তুলে চাষ করতে হয়।
তিনি বলেন, ‘আপাতত আমি নিজের খরচে কানিহাটিতে পরীক্ষামূলক চাষ করব। তারপর সারাদেশে চাষ করে দেখব। সারাদেশের ফলাফল বিশ্নেষণ করে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক ও আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ধানের বীজ কৃষকদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার বিষয়ে ভাবব।’
আবেদ চৌধুরী অস্ট্রেলিয়ায় থাকলেও সবকিছু দেখার জন্য রাসেল মিয়া নামে একজনকে দায়িত্ব দিয়ে যান। রাসেল মিয়া বলেন, এ ধানে চিটা নেই। খরচ কম এবং ফলন বেশি। জমিতে রেড়ি করে বোরো রোপণের পর আর জমি রেড়ি করতে হয় না। নির্দিষ্ট একটা মাপে ধান কেটে নেওয়ার পর মোড়া অংশে লতাপাতা ও ঘাস বাছাই করে সার দিই। এটুকু করলেই আবার ধানের গাছ বাড়তে থাকে।
রাসেল জানান, যদি পোকামাকড়ে ধরে তাহলে সামান্য কীটনাশক ব্যবহার করতে হয়। এই ধান মেঘবৃষ্টি নষ্ট করতে পারে না। খুব শক্ত ধানের গাছ। এলাকার কৃষকরা এ ধানের ফলন দেখে চাষাবাদ করতে আগ্রহী হয়েছেন।
কুলাউড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আব্দুল মোমিন বলেন, এক গাছে পাঁচবার ধান উৎপাদন নতুন দেখেছি। এটি দেশের জন্য সুখবর। এই উদ্ভাবনের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাওয়া উচিত।
বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিনা) নবনিযুক্ত মহাপরিচালক, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিজ্ঞানী ও বিশিষ্ট কৃষিবিদ ড. মির্জা মোফাজ্জল ইসলাম বলেন, পুনর্জন্ম পদ্ধতিতে একটি ধান গাছে চারবার ফলন আসা সম্ভব। তবে পাঁচবার ফলন বের করা একটু কঠিন।
ড. মির্জা মোফাজ্জল ইসলামের ভাষ্য, প্রথমবার ফলন আসার পর পরের বার ফলন কমতে থাকে। এ জন্য এটি এতটা লাভজনক নয়। ততদিনে এই ধান কেটে আরেকটি ফসল লাগালে লাভজনক হবে। এক গাছে সর্বোচ্চ দু’বার ফলন হলে ভালো। এ পদ্ধতিতে এখন ফল বাড়াতে আরও গবেষণা করা যেতে পারে।
তিনি বলেন, এটি জীনবিজ্ঞানীর কাজ নয়। ফলন বাড়ানোর বিষয়ে কৃষিতত্ত্ববিদ ও মৃত্তিকা বিজ্ঞানীরা গবেষণা করতে পারেন। মাটি, গাছ, প্রজনন, বায়োকেমেস্ট্রি ও জিনসহ সব ব্যবস্থাপনা দেখতে হবে। আবেদ চৌধুরী শুধু জিনের অবস্থা দেখছেন। লাভক্ষতি হিসাব করতে হবে। শুধু উদ্ভাবন করলে হবে না, ফলন আশাব্যঞ্জক না হলে কৃষক তা নেবেন না।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) মহাপরিচালক কৃষিবিজ্ঞানী ড. মো. শাহজাহান কবীর বলেন, একটি ধানের গাছ থেকে একাধিকবার ফসল সম্ভব, কিন্তু ফলন কম হবে। এটি টেকসই কোনো উদ্ভাবন নয়। যেখানে আমরা জমিতে আরও বেশি উৎপাদনের চেষ্টা করছি, সেখানে তিনি খরচ বাঁচানোর জন্য উৎপাদন কমনোর প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে তো লাভ নেই। এসব বিষয় নিয়ে আবেদ চৌধুরীর সঙ্গে আমরা একাধিকবার কথা বলেছি। তাকে আমরা দাওয়াত দিয়েছি, কিন্তু তিনি আসেন না। আমরা তো বিজ্ঞান নিয়েই ৫০ বছর ধরে চর্চা করছি। ধানের ফলন বাড়ানোসহ নানা বিষয় নিয়ে কাজ করছি।
ড. আবেদ চৌধুরী বংশগতিবিষয়ক গবেষক। একদল অস্ট্রেলীয় বিজ্ঞানীর সঙ্গে তিনি ফিস (ইন্ডিপেনডেন্ট সিড) জিন আবিস্কার করেন। তিনি লাল রঙের চাল ও রঙিন ভুট্টাও উদ্ভাবন করেছেন। তার ডায়াবেটিস ও ক্যান্সার প্রতিরোধক রঙিন ভুট্টা বিশ্বব্যাপী আলোচিত। বর্তমানে তিনি অস্ট্রেলিয়ায় উচ্চ ফলনশীল ধান উৎপাদন ও ভবিষ্যতের খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ে গবেষণা করছেন।
https://twitter.com/urumurum/status/1462000715258155009
এ উদ্ভাবন গরিবদের জন্য বিলিয়ে দেব
https://samakal.com/todays-print-edition/tp-first-page/article/2111131740/%E0%A6%8F-%E0%A6%89%E0%A6%A6%E0%A7%8D%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%AC%E0%A6%A8-%E0%A6%97%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A6%AC%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%9C%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%AF-%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%B2%E0%A6%BF%E0%A7%9F%E0%A7%87-%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%AC
মৌলভীবাজারের যে গ্রামে ১৪ বছর ধরে এই ধান চাষ করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছি, সেই গ্রামেই আমি বড় হয়েছি। শৈশবে আমি গ্রামের স্কুলে লেখাপড়া করেছি। ওই কমিউনিটিতে
আমি থেকেছি। একটা সংগ্রামময় জীবন ছিল আমার। ষাটের দশকে কৃষিকে ঘিরে আমাদের একটা জীবন ছিল। আমি যখন ছোট ছিলাম তখন বাবাকে হারিয়েছি। পরে মাকে কেন্দ্র করে আমার একটা জীবন ছিল। গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার সময় কৃষকের জীবন খুব কাছ থেকে দেখেছি। তখন থেকেই ধান নিয়ে কিছু একটা করব- এরকম একটা ভাবনা আমার ছিল।
আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিজ্ঞান বিষয়ে পড়ে আমেরিকায় গেলাম। তখন চেষ্টা করেছি বায়োলজির দিকে ফিরে আসতে। ধানের বিজ্ঞানের দিকে ফিরে আসার চেষ্টা করেছি। আমার একটা স্বপ্ন ছিল, ধান ফলিয়ে মানুষের আয় বাড়ানোর। কারণ, আমি দেখেছি কৃষিকাজ যারা করছেন, তারা একেবারেই দরিদ্র অবস্থায় রয়ে গেছেন। ধান ফলিয়ে টাকা রোজগার করা যায় না- এটাই হচ্ছে বাস্তবতা। এই সংগ্রামের অঙ্গ হিসেবে আমি যখন বিদেশে গেলাম, তখন জেনেটিক্স আয়ত্ত করার চেষ্টা করেছি। দেশে দেশে গেছি বিজ্ঞান শেখার জন্য।
১৪ বছর ধরে আমি আমার গ্রাম কানিহাটির মাঠে এই ধানগুলো লাগিয়েছি। একটি ধানের সঙ্গে আরেকটি ধান ক্রস করেছি। আমেরিকাসহ সারা পৃথিবীতে থাকা আমার শিক্ষকদের সাহায্য নিয়েছি। আমি চেষ্টা করেছি ধান কত বেশি উৎপাদনশীল করা যায়। এভাবে আমি আমার কাজটি এগিয়ে নিয়েছি।
আমার শৈশবের স্মৃতি, দারিদ্র্য দেখা এবং কৃষিকে কেন্দ্র করে মানুষের বেঁচে ওঠার সংগ্রাম আমাকে শক্তি জুগিয়েছে। আমার মনে হচ্ছে, এই ধানগুলো আমার জীবনেরই একটা প্রতিচ্ছবি। ধানের উৎপাদন বাড়ানোর মাধ্যমে আমি জাগ্রত হয়ে উঠেছি। একটা কবিতা আমাকে সব সময় অনুপ্রেরণ দেয়, ‘হঠাৎ নিরীহ মাটিতে কখন জন্ম নিয়েছ সচেতনতার ধান, গত আকালের মৃত্যুকে মুছে আবার এসেছে বাংলাদেশের প্রাণ।’
আমার জীবনের অভিজ্ঞতা, সংগ্রামের অভিজ্ঞতা, দারিদ্র্য এবং কৃষিকে কেন্দ্র করে সংগ্রামের মাধ্যমেও যারা দরিদ্র রয়ে গেছেন, তাদের এই সংগ্রামের অভিজ্ঞতা আমাকে প্রেরণা জুগিয়েছে।
আমার উদ্ভাবিত ধান পাঁচবার ফলন দিচ্ছে, যা বর্তমান জলবায়ু পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে অত্যন্ত জরুরি। এটি জলবায়ুবান্ধব ধান। এই ধানটি হাইব্রিড নয়, কিন্তু এই ধানের উৎপাদন হাইব্রিডের সমান। সাধারণত আমাদের দেশে আউশ, আমন ও বোরো ধান রোপণ করা হয়। দীর্ঘসময় মাঠ খালিও থাকে। অনেক সময় তিনটি ধান একসঙ্গে করাও যায় না। কিন্তু আমার উদ্ভাবিত ধান সারাবছরই উৎপাদনের কারণে লাগানো যায়।
একটি বিশাল দিক হচ্ছে, কৃষক নিজের কাছে এ ধানের বীজ সংরক্ষণ করতে পারেন। এটি এমন একটি আবিস্কার, যার মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিরাট একটা পরিবর্তন আসতে পারে। গত বছর যখন দেখেছি এ ধানটি পাঁচবার মাঠে থাকতে পারে এবং ফসল দিতে পারে- এটা আমাকে বিরাট উজ্জীবনী শক্তি দিয়েছে। যেন সংগ্রামমুখর জীবন পেরিয়ে দীর্ঘ রজনীর পর উষার দ্বারপ্রাপ্তে এসে উপনীত হয়েছি। বিজ্ঞানী হিসেবে আমি অনেক কাজ করেছি। কিন্তু আমার সব কাজ ছাপিয়ে এখন মনে হচ্ছে, শেষ পর্যন্ত কিছু একটা অর্জন করতে পেরেছি।
এই যে দীর্ঘ সংগ্রামের একটা জীবনের মধ্যে কৃষি ও ধানের বিজ্ঞানকে নিয়ে জাগ্রত হয়ে ওঠা, ২০-৩০ বছর ধরে একই সঙ্গে কাজ করা এবং ফাইনালি একটা কিছু করতে পারা- এটা মনে হচ্ছে একটা পরিণতির দিকে আমাকে নিয়ে এসেছে। আমি আজ অত্যন্ত তৃপ্ত, অত্যন্ত খুশি।
বাংলাদেশের অনেক সুধীজন, বন্ধু, পরিচিতজন আমাকে সব সময় সহাযোগিতা করেছেন। আমি বিশেষ করে স্মরণ করছি আমার মাকে, যিনি আমাকে বড় করেছেন। এ অর্জন তারই জীবনের সার্থকতার প্রতিচ্ছবি। আজ তিনি বেঁচে নেই। তার কথা আমি বিশেষ করে মনে করি এবং এসব কাজকে আমি তার স্মৃতির প্রতি নিবেদন করলাম। এ ছাড়া কানিহাটি গ্রামে আমার এ ধান চাষের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে সহায়তা করেছেন রাসেল মিয়া। তার প্রতিও কৃতজ্ঞতা। আমার এই উদ্ভাবন কোনো ব্যবসায়িক কাজে নয়, গরিব মানুষের জন্য বিলিয়ে দেব।
https://twitter.com/urumurum/status/1462003842015318019
মাসুদ করিম - ২২ নভেম্বর ২০২১ (৩:১২ পূর্বাহ্ণ)
Woo FDI in three sectors, Foreign investors suggest at research report launch
https://today.thefinancialexpress.com.bd/first-page/woo-fdi-in-three-sectors-1637519291
Foreign investors in Bangladesh find agribusiness, digital economy and green business as three potential sectors which they think would propel the country onto the next trajectory of development.
While appreciating the country’s remarkable socioeconomic progress achieved over the last 50 years, they suggested ensuring pro-business policies to attract FDI (foreign direct investment) in these growth-driving sectors.
They also recommended prioritising high-potential sectors and marketing those globally through proper branding of the country’s manufacturing skills.
The businesspeople came up with the suggestions at an event of the Foreign Investors’ Chamber of Commerce and Industry (FICCI) in Dhaka on Sunday.
A research report on the three future growth drivers of Bangladesh in accelerating investment opportunities was also released at the event.
The report stresses the importance of policy interventions to benefit more from the sectors where the future of global economy lies.
Policy Exchange Bangladesh (PEB) prepared the report for the FICCI, marking the 50th year of independence of Bangladesh and the birth centenary of Father of the Nation Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman.
Sharing the research findings, PEB founder and chairman Dr. M. Masrur Reaz said the research will help undertake strategic approach by coming out of traditional and general approach that had worked well in past few decades.
“But it will be difficult if we continue the business-as-usual approach in a more competitive and fast-changing world,” he told the meet.
About the three growth drivers, he said that around 68 per cent of the global population is expected to live in cities by 2050 when agricultural production needs to be enhanced by 70 per cent due to increase in population.
“We can take the opportunity applying global best practices. Community farming with amalgamation of land could be an option for us as it is successful in Vietnam,” he said.
About digital economy, he said technology will dominate the workplace with artificial intelligence and smart assistants being common, while the use of augmented and virtual reality continues to increase by 2050.
While the global green-bond market could be worth over US$ 2.3 trillion by 2023, the climate investment opportunities between now and 2030 would stand at US$ 23 trillion.
Around 24 million new jobs can be created globally by 2030 through shifting to a greener economy, he quoted the International Labour Organization (ILO) as saying.
“So, opportunities are huge in these areas.”
Managing Director of Apex Footwear Limited Syed Nasim Manzur said Bangladesh has many fantastic products but these are not sold properly.
Talking about soft power, he said the country needed to learn proper use of the soft power like K-pop of South Korea for branding the country globally.
He also put emphasis on utilising the country’s “B power” that he meant for “Baul, Build and Biriyani.”
“I think Bangladesh is the factory of the world. We are manufacturing world-class garments, ships, shoes, pharmaceuticals and biriyani. So, this is our time,” he said.
Citing an article, he said Bangladesh does not follow traditional path of progress. “We listen to all but follow our own course and we have to find a model that works for Bangladesh. We need to find out something what is best for B-Bangladesh,” he added.
MCCI President Barrister Nihad Kabir said the country needed to fix policies about whether it wants FDI or not, whether it wants protection or not.
“The policy needs to be fixed. Once our policies are fixed, we need to act accordingly,” she said.
She also highlighted the importance of training the civil servants in the context of private-sector demands in taking the economy further ahead.
Executive Chairman of Bangladesh Investment Development Authority (BIDA) Md. Sirajul Islam said the World Bank has dropped releasing the Ease of Doing Business Index, but it will not hamper their moves to bring reforms to create a feel-good businesses ambiance.
“We will not drop it at all. We will continue improving business climate here through bringing reforms in the regulations on a regular basis,” he added.
State Minister for Foreign Affairs Md. Shahriar Alam said they have been discussing with the partners, especially from the European Union, so that the economy is not affected even after graduation from the LDC status.
“We’re well aware of the risk factors in the post-graduation regime and we’re working on it tirelessly,” he added.
Japanese ambassador in Dhaka Ito Naoki laid emphasis on sustainability and predictability of the policies and regulations to woo overseas investors.
South Korean ambassador Lee Jang-keun suggested using success stories of RMG and Nuclear Power Plant for branding the country.
“I believe this roadmap presentation and the three growth drivers will be a good reference in the development planning and will bring in FDI to aid our economy flourish in all sectors,” said planning minister M.A Mannan.
He said that these driving sectors will be the key agents of success. “We listen to all and learn from them, but we would like to do things in our way that is our branding.”
Prime Minister’s private-sector industry and investment affairs adviser Salman F Rahman said each of these sectors has a high potential for meeting the country’s economic goals.
The goals are: creating employment for a large number of young and skilled people, increasing export earnings, making significant impact on small and medium enterprises, unlocking potential for long-term sustained growth, and exploring new investment opportunities.
FICCI President Rupali Haque Chowdhury said Bangladesh’s GDP growth was negative 5.48 per cent, per-capita income only US$ 134, FDI US$ 90,000 and life expectancy 46.64 years just after the independence.
But the figures now improved to 8.15 per cent, US$ 2,554, US$ 3.61 billion and 72.6 years respectively. “It shows how remarkably we’re performing,” she added.
https://twitter.com/DhakaTribune/status/1462383490071072778
মাসুদ করিম - ২২ নভেম্বর ২০২১ (১:৫০ অপরাহ্ণ)
‘বাং-পাকিস্তানিদের’ মনন ও পাকিস্তানি ক্রিকেটারদের আগ্রাসী আচরণ
https://www.banglatribune.com/714136/%E2%80%98%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%82-%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%95%E0%A6%BF%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B0%E2%80%99-%E0%A6%AE%E0%A6%A8%E0%A6%A8-%E0%A6%93-%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%95%E0%A6%BF%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A6%BF-%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A6%95%E0%A7%87%E0%A6%9F%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B0
‘বাং-পাকিস্তানি’ বলতে আমি বুঝাতে চাচ্ছি যাদের জন্ম এই দেশে কিন্তু ওরা এই দেশি কেবল কাগজে-কলমে, অন্তরে-আনুগত্যে নয়। এরা এই দেশে জন্মেছে। এই দেশে থাকে, খায়, পড়াশোনা করে, আয়-রোজগার করে। এ দেশের আলো-বাতাসে, স্নেহ-মমতায় বড় হয়। কিন্তু কোনোদিন এরা দেশটাকে আপন ভাবে নাই। বাবর আজম ভালো খেলে বলে সমর্থন করে না। ভালো খেলার জন্য সমর্থন করলে খেলা শেষে ‘পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ কেন আলাদা হয়ে গেলো’ এই পরিতাপ করতো না। কিংবা ‘পাকিস্তান বাংলাদেশ দুটো একই দেশ দু’টোই ভাই ভাই, যে হারুক-জিতুক আমাদের কোনও সমস্যা নাই’ এই কথা বলতো না।
পাকিস্তানের জার্সি পরে পাকিস্তানের পতাকা হাতে ‘পাকিস্তান পাকিস্তান’ বলে চিৎকার করতো না, ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ স্লোগান দিতো না। এরা মানতে চায় না যে বাংলার জমিনে তারা চলাফেরা করে, তাদের আহার জোগায় যে বাংলার মাটি তা অতি চড়া মূল্যে পাওয়া। ৩০ লাখ শহীদ আর ৪-৫ লাখ কন্যা-জায়া-জননীর চরম উৎসর্গের বিনিময়ে অর্জিত এই রাষ্ট্রটি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মানবতার নৃশংস এক বিয়োগগাথা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। মনুষ্যত্বের অমোচনীয় এক কলঙ্ক সৃষ্টি করেছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এই দেশীয় দোসররা। এত অল্প সময়ে এত বেশি সংখ্যক মানুষকে আর কোথাও প্রাণ দিতে হয়নি, এত বেশি নারীকে আর কোথাও নির্যাতিত হতে হয়নি। পাকিস্তান ও তার এ দেশীয় দোসরদের ষড়যন্ত্র ও নৃশংসতা কুখ্যাত হিটলারকেও হার মানায়। জবাই করে, চামড়া তুলে, গুলি করে, পুড়িয়ে, ফাঁসিতে ঝুলিয়ে, বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে নানা নৃশংস কায়দায় হত্যা করা হয় ৩০ লাখ বাঙালিকে। বাঙালি জাতিসত্তাকে পাল্টে দিতে বাঙালির ধমনীতে পাকিস্তান আর তাদের দোসর ধর্ষকদের নাপাকি রক্ত মিশিয়ে দিতে পরিকল্পিতভাবে ৪-৫ লাখ বাঙালি রমণীকে ধর্ষণ করা হয়। এ বিষয়ে পাকি মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা তাঁর ‘A Stranger In My Country: East Pakistan,1969-1971’ গ্রন্থে লিখেছেন, Gen. Niazi told his officers to let loose their soldiers on the women of East Pakistan till the ethnicity of the Bengalis was changed. মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ ঘুরে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাংবাদিক ডান কলিন পাকিস্তানি বাহিনীর নারী ধর্ষণ ও নির্যাতনের ভয়াবহতা তুলে ধরে একটি রিপোর্ট করেন, তা ২৫ অক্টোবর সাপ্তাহিক টাইম ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়। সেখানে তিনি লেখেন, একটি বীভৎস ঘটনা হলো, ঢাকার একটি সামরিক ক্যান্টনমেন্টে আটকে রাখা হয়েছে ৫৬৩ জন বাঙালি যুবতীকে। এরা সবাই এখন গর্ভবতী। তাদের গর্ভপাত ঘটানো সম্ভব নয়। প্রতিবেদনটি তখন বিশ্বব্যাপী আলোচিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী বাঙালি নারীদের যে ব্যাপক সংখ্যায় ও নির্বিচারে ধর্ষণ করেছে তা বিশ্বের যুদ্ধের ইতিহাসে বীভৎসতম ঘটনাগুলোর একটি। শিশু থেকে বৃদ্ধা, অন্তঃসত্ত্বা, প্রসূতি যাকে ধরতে পেরেছে কাউকেই তারা রেহাই দেয়নি।
একাত্তরের ২০ মে ভারত থেকে প্রকাশিত যুগান্তর পত্রিকায় ‘পাকিস্তানে নারীত্বের চরম লাঞ্ছনা’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, কুষ্টিয়া জেলার জীবননগর থানার স্যানহুদা গ্রামে ১৮ বছর বয়স্কা বিবাহিতা দুই নারীকে রাইফেল দেখিয়ে জোর করে সম্পূর্ণ উলঙ্গ করে ফেলে। সৈন্যরা উলঙ্গ অবস্থায় তাদের সমগ্র গ্রাম ঘুরিয়ে এনে ধর্ষণ করে এবং অচেতন অবস্থায় গ্রামের এক পাশে তাদের ফেলে আসে। ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘জীবননগর থানার উতলী গ্রামে সৈন্যরা ছয় জন তরুণীকে ধরে নিয়ে যায় এবং তাদের ওপর জুলুম করে। এদের বয়স ১৫ থেকে ২৫ বছর। ওই থানার নূরনগর গ্রামে ১৪ বছর বয়স্কা জনৈকা মুসলমান কিশোরীকে সৈন্যরা পাশবিক অত্যাচার শেষে তার দেহ দাঁত দিয়ে কামড়িয়ে ক্ষতবিক্ষত করে দেয়। কয়েক দিন মেয়েটির জ্ঞান ফেরেনি। ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে অস্ট্রেলিয়ান চিকিৎসক ডা. জিওফ্রে ডেভিস বাংলাদেশে এসেছিলেন। তিনি তখন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত নারীদের চিকিৎসা সেবা দেন। ওই বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি দৈনিক বাংলায় এই চিকিৎসকের কাজ নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে ডা. জিওফ্রে ডেভিসের বরাত দিয়ে বলা হয়, সরকার উদ্যোগ নেওয়ার আগেই এক লাখ ৫০ হাজার থেকে এক লাখ ৭০ হাজার নারীর ভ্রূণ স্থানীয় দাই, ক্লিনিকসহ যার পরিবার যেভাবে পেরেছে সেভাবে ‘নষ্ট’ করেছে। তিনি বলেন, পৌনঃপুনিক লালসা চরিতার্থ করার জন্য হানাদার বাহিনী অনেক তরুণীকে ধরে তাদের শিবিরে নিয়ে যায়। এই তরুণীদের মধ্যে অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার লক্ষণ কিংবা রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে হয় তাদের পরিত্যাগ করা হয়েছে, নয়তো হত্যা করা হয়েছে। কোনও কোনও এলাকায় ১২ ও ১৩ বছরের বালিকাদের শাড়ি খুলে নগ্ন অবস্থায় রেখে ধর্ষণ করা হয়েছে, যাতে তারা পালিয়ে যেতে অথবা আত্মহত্যা করতে না পারে। জিওফ্রে ডেভিসের মতে, মুক্তিযুদ্ধের সময় নির্যাতনের ফলে গর্ভধারণ করেছেন এমন নারীর সংখ্যা প্রায় দুই লাখ এবং প্রায় চার লাখ ৩০ হাজার নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি মাঠ পর্যায়ে জরিপ চালানোর পর এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় নির্যাতিত নারীর সংখ্যা কমপক্ষে চার লাখ ৬৮ হাজার। এরমধ্যে নিজ গৃহে কিংবা আক্রমণের স্থানে তাৎক্ষণিক ধর্ষণের শিকার নারীর সংখ্যা প্রায় তিন লাখ ২৭ হাজার ৬০০ জন, যাদের প্রায় ৩০ ভাগ অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন। ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে বাংলাদেশে প্রতিদিন তাৎক্ষণিক ধর্ষণে গড়ে তিন হাজার পাকিস্তানি সৈন্য অংশগ্রহণ করেছিল। তাদের সহযোগী ছিল প্রায় ছয় হাজার বিহারি ও দালাল। নির্যাতিত নারীদের তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে কমিটি আরও জানায়, পাকিস্তানি বাহিনী, বিহারি, রাজাকার ও দালালরা অধিকৃত বাংলাদেশের শহর-গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে বা এলাকায় আক্রমণ করে খুন-লুটপাটের পাশাপাশি উপস্থিত নারীদের সেখানেই ধর্ষণ করতো। আবার বিভিন্ন স্থান থেকে নারীদের এনে ধর্ষণ করা হতো। তাদের কাউকে ছেড়ে দেওয়া হতো, কখনও বা হত্যা করো হতো। এ ছাড়া দীর্ঘদিন ক্যাম্পে আটক রেখে নির্যাতন করা হতো। একাত্তরে মোট নির্যাতিত নারীর শতকরা ৭০ ভাগই তাৎক্ষণিক ধর্ষণের শিকার। আর যাদের ক্যাম্পে আটকে রাখা হতো তাদের কোনও পোশাক পরতে দেওয়া হতো না, যাতে ওরা পালিয়ে যেতে বা আত্মহত্যা না করতে পারে।
কমিটি মাঠ পর্যায়ে অনুসন্ধান করে কমপক্ষে সাড়ে ৭০০ নারীর সন্ধান পেয়েছিল, যাদের অপহরণ করে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বাহাত্তর সাল থেকে পরবর্তী ১০ বছরে পাকিস্তানি বাহিনীর ধর্ষণের ঘটনায় জন্ম নেওয়া আড়াই হাজার ‘যুদ্ধশিশু’কে কানাডা, যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাঠানো হয়েছে দত্তক হিসেবে। শিশুদের অনেকেই জানে না তাদের জন্মপরিচয়। আবার জেনে মায়ের সন্ধানে এ দেশে এসেছেন এমন যুদ্ধশিশুও পাওয়া গেছে।
গ্যালারিতে পাকিস্তানের পতাকা হাতে উল্লাসের পাশাপাশি আরও একটি বিষয় লক্ষণীয়। তা হলো, পাকিস্তানি ক্রিকেটারদের আগ্রাসী আচরণ ও ঔদ্ধত্য। বাংলাদেশি ক্রিকেটারের রান নেওয়ার সময় লাথি মারতে উদ্ধত হওয়া, ক্রিজে থাকা বাংলাদেশি ক্রিকেটারকে বিনা প্রয়োজনে টার্গেট করে বল ছুড়ে মেরে আহত করা, বাংলাদেশি ব্যাটার আউট হলে অবমাননাকর আচরণ-ইঙ্গিত করা কোনোভাবেই খেলার অংশ নয়। তাদের এই আচরণের জন্য তারা বিশ্ব ক্রিকেটের আইন অনুযায়ী শাস্তিপ্রাপ্তও হয়েছে।
পাকিস্তানি একই ক্রিকেটাররা সদ্য সমাপ্ত টি-২০ বিশ্বকাপে খেলে এসেছে। সেখানে তারা এমন আগ্রাসী ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করেনি। প্রশ্ন হলো, ভদ্রলোকের খেলা খ্যাত ক্রিকেটে পাকিস্তানি ক্রিকেটারদের বাংলাদেশে কেন এমন আগ্রাসী আচরণ? এর সবই হয়েছে জাতিগত আক্রোশ থেকে, মুক্তিযুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশোধমূলক মানসিকতা থেকে। যারা অস্বীকার করতে চান তাদের বিনয়ের সঙ্গে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, বার্সা আর রিয়ালের রাইভালরি শুরুই হয়েছিল কাতালান আর স্প্যানিশ জাতিগত পরিচয়ের সংঘাত থেকে।
দেশপ্রেম জোর করে আদায় করা যায় না। বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে পাকিস্তানের জার্সি গায়ে পতাকা নিয়ে খেলা দেখতে আসা, পাকিস্তানকে সমর্থন করা, পাকিস্তানের সাফল্য-জয়ে উল্লাস করা রীতিমতো গ্লানির, দৈন্যের। পৃথিবীর ঘৃণ্যতম দৃশ্য নিজের দেশের খেলার দিন রাষ্ট্রের জন্মযুদ্ধের প্রধান শত্রুর পতাকা হাতে উল্লাস! পাকিস্তানের মহব্বতে মাতোয়ারা বাংলাদেশের কেউ হতে পারে না।
আক্ষেপ হলো, যারা বিশ্বাস করে এবং বলে ‘দুর্ভাগ্য আমাদের দেশটা পাকিস্তান থেকে ভাগ হয়ে গেলো এটাই আমাদের কষ্ট’, কিংবা ‘দুই পাকিস্তানকে আলাদা করা ভুল ছিল, এটা ভারত তার স্বার্থে করিয়েছে’ এই অসুস্থ মানসিকতার বিশ্বাসঘাতকদের সঙ্গেই আমাদের থাকতে হচ্ছে। লাখো শহীদের জীবন ও কন্যা-জায়া-জননীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত এই রাষ্ট্র ও তার সব সুযোগ-সুবিধা বিশ্বাসঘাতকদের সঙ্গে ভাগ করতে হচ্ছে। অনেকেই বলছে, খেলার মাঠের এগুলো ট্রেইলার মাত্র, সামনে আরও ভয়ংকর দিন অপেক্ষা করছে। সাধু সাবধান!