সুপারিশকৃত লিন্ক: মার্চ ২০২১

মুক্তাঙ্গন-এ উপরোক্ত শিরোনামের নিয়মিত এই সিরিজটিতে থাকছে দেশী বিদেশী পত্রপত্রিকা, ব্লগ ও গবেষণাপত্র থেকে পাঠক সুপারিশকৃত ওয়েবলিন্কের তালিকা। কী ধরণের বিষয়বস্তুর উপর লিন্ক সুপারিশ করা যাবে তার কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম, মানদণ্ড বা সময়কাল নেই। পুরো ইন্টারনেট থেকে যা কিছু গুরত্বপূর্ণ, জরুরি, মজার বা আগ্রহোদ্দীপক মনে করবেন পাঠকরা, তা-ই তাঁরা মন্তব্য আকারে উল্লেখ করতে পারেন এখানে।
ধন্যবাদ।

আজকের লিন্ক

এখানে থাকছে দেশী বিদেশী পত্রপত্রিকা, ব্লগ ও গবেষণাপত্র থেকে পাঠক সুপারিশকৃত ওয়েবলিন্কের তালিকা। পুরো ইন্টারনেট থেকে যা কিছু গুরত্বপূর্ণ, জরুরি, মজার বা আগ্রহোদ্দীপক মনে করবেন পাঠকরা, তা-ই সুপারিশ করুন এখানে। ধন্যবাদ।

২ comments

  1. মাসুদ করিম - ২ মার্চ ২০২১ (৯:১০ পূর্বাহ্ণ)

    ঢাকার শঙ্খশিল্পের মৃত্যু অবধারিত?

    বেচাবিক্রি চলছে ভালোই, ক্রেতা-বিক্রেতার হাঁকডাকও নেহাত কম নয়। কিন্তু তারপরও যেন ভাঙনের সুর ঢাকার শঙ্খশিল্পে।

    প্রাচীন ঢাকার ইতিহাসের সঙ্গে মসলিনের মতো জড়িয়ে আছে এখানকার শঙ্খশিল্প। আধুনিকতার পরিক্রমায় সেই ঐতিহ্য এখন নেই বললেই চলে। যন্ত্রে তৈরি ভারতীয় শঙ্খপণ্যের দাপটে ধুঁকছে ঢাকার এই শিল্প। জীবিকার তাগিদে পৈত্রিক পেশা বদলে ফেলেছেন অনেক শঙ্খশিল্পী। কম দাম আর গুণে-মানে ভারতের শঙ্খপণ্য এগিয়ে থাকায় ঢাকায় এই শিল্পের প্রাণ আর ফেরানো সম্ভব নয় বলে শিল্পী-কারিগরদের শঙ্কা।

    ঢাকার শঙ্খশিল্প মূলত পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজার কেন্দ্রিক। বংশানুক্রমে এই শিল্পে জড়িয়ে আছে এখানকার অসংখ্য পরিবার। তাদের অনেকেই জানিয়েছেন শিল্পের বর্তমান দুর্দশার কথা।

    তারা বলছেন, বাঁক বদলের শুরু নব্বইয়ের দশক থেকে। পেশা টিকিয়ে রাখতে কেউ কেউ সনাতন পদ্ধতি ছেড়ে যন্ত্রের দিকে ঝুঁকলেও ভাগ্য বদলাতে পারেননি। ফলে পেশা বদলের যে হিড়িক শুরু হয়, তার ধারাবাহিকতায় একেবারেই সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে এই শঙ্খশিল্প। ‘মড়ার ওপর খাড়ার ঘাঁ’ হয়ে এসেছে করোনাভাইরাস মহামারী।

    পেশা বদলের স্রোতে ঢুকে পড়া অনেক শঙ্খশিল্পীর একজন স্বপন নন্দী। পেশা বদলানোর চিন্তা মাথায় ঘুরছিল গত এক দশক ধরেই। শেষ পর্যন্ত করোনাভাইরাস মহামারী তাকে বাধ্য করেছে। সংসারের খরচ সামলাতে দুই মাস হল শাঁখারীবাজারের শঙ্খশিল্প কারিগর সমিতির সামনে বসে তিনি প্রসাধন সামগ্রী বিক্রি করছেন।
    স্বপন নন্দী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, একসময় দিনে সাত-আটশ টাকা রোজগার ছিল তার, কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে ৩০০ টাকাও ঘরে নিতে পারেননি।

    “মহামারীতে তো ইনকাম একেবারে বন্ধ ছিল। অনেকদিন ধরে ভাবছিলাম কিছু একটা করি, কিন্তু পেশার মায়ায় হয় নাই, এইবার বাধ্য হইছি। যে মজুরি পাই, তাতে বাড়ি ভাড়া দিয়ে খাব কী? কাজ নাই দেখেই এইসব জিনিস বিক্রি করতেছি। এখন শাখা বানানোর ফাঁকে টুকটাক বিক্রি করেও দিনে ২০০ টাকা লাভ করতে পারি।”

    উপার্জন কমে যাওয়ায় অনেকেই এ পেশা ছেড়েছেন বলে জানান স্বপন।

    “স্বাধীনতার পরে শাঁখারীবাজারে ৪০০ থেকে ৫০০ জন শঙ্খশিল্পী ছিল। এইটা কমতে কমতে নব্বইয়ের দশকে ৮০-৯০ জনে ঠেকে। এখন ১২ জন আছে। অনেকে মারা গেছে, অন্য পেশায় গেছে, ভারতে চলে গেছে।”

    কেন এই দুর্দশা?
    স্বপনের জবাব, “কাজটা না থাকলে মানুষ কী করবে? এই কাজ কইরা যদি খাওয়া না পায়, তাইলে কী করবে? আরেকটা কাজে যাইতে হবে। অনেকদিন কাজ করছি। কিন্তু এই শিল্পে কোনো উন্নতি নাই। আমাদের অনেকে চা বেচছে, রিকশা চালাচ্ছে। আমাদের চেয়ে তাদের বেশি ইনকাম। কিন্তু আমরা তো সেসব কাজে যেতে পারছি না।”

    কাঁচামাল হিসেবে ভারত ও শ্রীলঙ্কা থেকে যে সামুদ্রিক শঙ্খ আসত, তা পণ্যে রূপ দিতে ছয় ধরনের কারিগরের প্রয়োজন হত বলে জানান কারিগর শম্ভুনাথ সুর। এখন কারিগর কমে যাওয়ায় এর পাঁচ ধরনের কাজই ঢাকায় বন্ধ হয়ে গেছে বলে জানান তিনি।

    “এখন আমরা এক ধরনের কারিগর আছি। আমরা শুধু শেষ ধাপের কাজটা করি। কিছু মেশিন পড়ে আছে, সেসবের কারিগর এখানে আর নেই। ফলে শাঁখা প্রস্তুতের আরও পাঁচ ধাপের যে কাজ, সেটা এখন ভারত থেকেই হয়ে আসে।”

    শম্ভুনাথ জানান, শাঁখারীবাজারে হাতের অলঙ্কার ছাড়া অন্য শঙ্খপণ্যের কারিগররা বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

    “আগে শঙ্খ দিয়ে শাঁখা ছাড়াও গলার-কানের সেট, আংটি, লকেট, মাথার ক্লিপ তৈরি করা হত। এখন এগুলো বানানোর লোক নাই। বাদ্যশঙ্খ ও জলশঙ্খের দুইজন কারিগর ছিলেন সর্বশেষ। তারা মোটা অংকের মজুরি পেতেন। কাজ না পেয়ে এখন একজন শঙ্খের দোকানে তিনশ টাকার মজুরিতে কাজ করছেন।”

    সঙ্কট কোথায়?
    শাঁখারীবাজারের শঙ্খশিল্পী ও ব্যবসায়ীদের মতে, ভারতীয় পণ্যের বিস্তৃতিই এদেশে শাঁখা উৎপাদনকে সঙ্কুচিত করে ফেলেছে।

    কীভাবে এই পরিবর্তন ঘটল, তা উঠে এসেছে নিউ লক্ষ্মী ভাণ্ডারের স্বত্ত্বাধিকারী সুদীপ্ত সুরের কথায়। বাবার ব্যবসা চালিয়ে আসা এই ব্যবসায়ী জানান, তাদের সব শাঁখাই এখন ভারত থেকে আমদানি করা হয়।

    “এখন কারিগর কম, উৎপাদনও কম। ভারত থেকে শঙ্খ এনে দেশে (পণ্য) তৈরি করতে খরচটা বেড়ে যায়। তাই আমরা রেডিমেইড শাঁখা, বাদ্যশঙ্খ এগুলো ভারত থেকে কিনে আনি। এতে আমাদের লাভ হয় বেশি।”

    বিধান শঙ্খ ভাণ্ডারের মালিক ভবতোষ নন্দী জানান, দেশে তৈরি শঙ্খ মজবুত হলেও ডিজাইনে ভারতীয় শঙ্খ এগিয়ে রয়েছে।

    “ভারতে শঙ্খের চাহিদা অনেক বেশি। শঙ্খটা পাওয়া যায় ভারতেই। তাই ওখানে উৎপাদন বেশি হয়, দামটাও কিছুটা কম হয়। আমাদের দেশে তো শঙ্খ পাওয়া যায় না, ভারত থেকেই আনতে হয়।”

    তার মতে, দেশের শঙ্খ উৎপাদন কমে যাওয়ার মূল কারণ এটাই।

    বংশগতভাবে এ ব্যবসায় জড়িত ভবতোষ বলেন, “৩০০ থেকে আড়াই হাজার টাকায় শাঁখা পাওয়া যায়। আমাদের এখানে কারিগররা যেটা বানায়, সেটা মজবুতও হয়। তবে দামটা ভারতেরটার তুলনায় ২০০ থেকে ৩০০ টাকা বেশি পড়ে। একটু কম দাম আর ভালো ফিনিশিং পাওয়ায় কাস্টমাররা ভারতের শাঁখাটাই নেয়।

    “আমাদের কারিগররা ২০ টাকা মজুরিতে সাধারণ একটা শাঁখা তৈরি করে দেবে না। কিন্তু এই মজুরিতে ইন্ডিয়া থেকে ওরা ঠিকই করে দিতে পারবে। ওদের প্রযুক্তিও অনেক উন্নত, সেজন্য ডিজাইনও আকর্ষণীয় হয়। কাস্টমার অনেক বেশি। কাজও অনেক বেশি। আমাদের বিক্রি কিন্তু কমে নাই। উৎপাদন কমে গেছে।”

    গত ১৫ বছর ধরে ঢাকায় উৎপাদন একেবারে কমে এসেছে জানিয়ে তিনি বলেন, “আর কিছুদিন গেলে এটা একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। শাঁখারিবাজারে আর কেউ শাখা কিনতে আসবে না। এখানে কারিগররা আছে বলেই অনেকে এখনও আসে।”
    কারিগর সঙ্কটের কারণে ভারতের পণ্য আনতে হচ্ছে বলে জানান নিউ অঞ্জলী শঙ্খ ভাণ্ডারের কর্ণধার সন্তোষ নন্দী।

    “আমরা আগে তো দেশেই বানাতাম। এখনও আমার কয়েকজন কারিগর আছেন। কিন্তু তারা তো চাহিদা পূরণ করতে পারছেন না। অনেক কারিগর ভারতে চলে গেছেন। অনেকে কম মজুরির কারণে অন্য পেশায় চলে গেছেন। কিন্তু ভালো কারিগর না হলে তো বেশি টাকা দিতে পারব না। সবাই তো লাভ করতে চায়।”

    শাঁখারীবাজারে সবচেয়ে বেশি কারিগর কাজ করেন মা মনসা শঙ্খ শিল্পালয়ে। এই দোকানের স্বত্ত্বাধিকারী অমোঘ নাগ মনে করেন, পরিস্থিতি যেখানে ঠেকেছে, সেখান থেকে ঢাকার শঙ্খশিল্পকে বাঁচানোর আর কোনো পথ নেই।

    “আমাদের ৫-৬ জন নিজস্ব কারিগর আছে। আমরা নিজেরা তৈরি করি। আমাদের ভারত থেকে আনার প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু কাস্টমাররা যেমন সস্তা দামে জিনিস চায়, সেটা আসলে এখানে তৈরি করে দেওয়া সম্ভব না।

    “ভারতের অনেক বড় বাজার। নতুন নতুন যন্ত্রপাতি এসেছে। নিত্যনতুন ডিজাইন। সেটা কম দামে দেশের বাজারে আসছে। দেশে উৎপাদন করতে খরচ পড়ে এর চেয়ে বেশি। যে পরিমাণ চাহিদা আছে, সে পরিমাণ উৎপাদনের কারিগরও এখানে নেই। ফলে বাজার চলে গেছে ভারতের দিকে।”

    ত্রিশ বছর ধরে এ পেশায় জড়িত এ ব্যবসায়ী বলেন, “মজুরি কম হওয়ায় এই কাজে কেউ থাকতে চাচ্ছে না। ঢাকা শহরের জীবন ব্যয়বহুল। ফলে ঢাকার একজন কারিগরকে যে মজুরি দেওয়া দরকার, সেটা আমরা দিতে পারি না। আর কোনো সরকারই এই শিল্প নিয়ে চিন্তা করে নাই।”
    ভারতীয় পণ্যের রমরমা বাজারের কারণে ব্যবসায়ীরাও কারিগরদের মজুরি কমিয়ে দিচ্ছেন বলে জানান স্বপন নন্দী।

    “আগের চেয়ে কাজ কমে গেছে। আবার মালিকরা রেটও কমিয়ে দিচ্ছেন। তারা বলেন- ‘কাজ করলে করো, না করলে নাই’। এ কারণে আরও বেশি চাপে পড়ে গেছি আমরা। ১০ ঘণ্টা কাজ করে ৩০০ টাকা পাই, এতে তো সংসার চলে না।”

    এসব কারণে ঢাকায় শঙ্খশিল্প আর টিকিয়ে রাখা যাবে বলেই মনে করছেন কারিগর শম্ভুনাথ সুর।

    “আমাদের পূর্বপুরুষ বাপ-দাদারা এ পেশায় ছিল। তাদের কাছ থেকে শিখছি। মায়া থেকে এইটা ছাড়তে পারি না। ঐতিহ্যটা ধরে রাখতে চাই, আমরা চলে গেলে এটা আর এখানে বাঁচবে না।”

  2. মাসুদ করিম - ৬ মার্চ ২০২১ (৫:১৫ পূর্বাহ্ণ)

    বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

    প্রথমটি ছিল- সকলের জন্য সমান লিবার্টি বা স্বাধীনতার প্রস্তাব। দ্বিতীয়টি ছিল- সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য কত দূর পর্যন্ত স্বীকার্য তা নিয়ে তার উপলব্ধি। ‘সবচেয়ে গরিবকে সবচেয়ে বেশি সুবিধা’ দিতে হবে সবার আগে, সবার জন্য ‘মৌলিক চাহিদা’ পূরণের ক্ষেত্রে- এটি তার ন্যায়বাদী সমাজের একটি প্রধান পূর্বশর্ত ছিল। কিন্তু মনে রাখা প্রয়োজন, তার নির্দেশিত মুক্ত ও সামাজিক ন্যায়ের সমাজেও মৌলিক অধিকারের ক্ষেত্রে ‘যুক্তিসংগত বাধানিষেধ’ আরোপিত হয়েছিল। যেমন, বহুত্ববাদিতা তিনি চেয়েছেন, কিন্তু সেই বহুত্ববাদিতাকে হতে হবে যুক্তিযুক্ত- এজন্যই তার নাম দিয়েছেন ‘Reasonable Pluralism’ বলে। কিন্তু কোনটা (এবং কতদূর পর্যন্ত) হবে যুক্তিসংগত বহুত্ববাদ, তার সীমানা নির্ধারণ কেবল মাত্র জনগণের মধ্যে মুক্ত আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই নিষ্পন্ন করা সম্ভব। অমর্ত্য সেন যাকে (জন স্টুয়ার্ট মিলের অনুসরণে) বলেছেন, গণতন্ত্র হচ্ছে এমন একটি সরকার-ব্যবস্থা যেখানে সবকিছু পরিচালনা করা হয় ‘আলাপ আলোচনার মাধ্যমে’ (‘রুলিং বাই ডিসকাশন’)। সংসদ সেরূপ মুক্ত পর্যালোচনার জন্য একটি প্রধানতম প্ল্যাটফর্ম। এটি বাহাত্তরের সংবিধানের প্রণেতাদের একটি মৌল পূর্বানুমান (Premise)।

    Lost in Translation দিয়ে এই অধ্যায়টি শুরু করেছিলাম। এবারে অনুবাদের একটি সমস্যা দিয়ে নতুন প্রসঙ্গে যেতে চাই। এটি কৌতূহলোদ্দীপক যে, ‘সমাজতন্ত্র’ ধারণাটির অনুবাদ সংবিধানের বাংলা ও ইংরেজি ভাষ্যে সমার্থক ব্যঞ্জনা পায়নি। বাংলা পাঠে সমাজতন্ত্র ধারণাটি অনেক বেশি ‘র‌্যাডিকেল’ ইংরেজি পাঠের তুলনায়। র‌্যাডিকেল এই অর্থে যে, বাংলা ভাষ্যটি অনেক বেশি যুগান্তকারী, বিপ্লবাত্মক ও ‘সুদূরের পিয়াসী’। ইংরেজি পাঠ সে তুলনায় অনেক বেশি ধীরে-চলা নীতির, সংস্কারবাদী ও আশু কর্মসূচির। এটি কিছুটা ব্যাখ্যার দাবি রাখে।

    ১০ নং আর্টিকেল-এর ইংরেজি পাঠে লেখা হয়েছিল তিনটি গুরুত্বপূর্ণ শব্দবন্ধ : ‘Socialist economic system’, ‘attainment of a just and egalitarian society’ Ges ‘free from the exploitation of man by man’। এই প্রতিটি বাক্যাংশই অনেক অর্থের ভারে নুয়ে আছে। ‘সোশ্যালিস্ট ইকোনমিক সিস্টেম establish করার’ যথার্থ অর্থ কী তা ধ্রুপদি মার্কসবাদে নির্দিষ্ট করা ছিল না। মার্কসবাদ ছাড়া অন্যান্য ধারার সমাজতন্ত্রেও অর্থটি নির্দিষ্ট হয়ে নেই। যেমন, জন স্টুয়ার্ট মিল নিজেকে সমাজতন্ত্রী ভাবতেন, সমাজতন্ত্র নিয়ে তার ট্রিটিজ রয়েছে। কিন্তু সেই সমাজতন্ত্রের সঙ্গে ‘ফেবিয়ান সোশ্যালিজম’-এর ফারাক আছে। আধুনিক অর্থনীতির জনক আলফ্রেড মার্শাল অর্থশাস্ত্রে নব্য-ধ্রুপদি ধারাকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, কিন্তু সমাজ-চিন্তায় তিনি নিজেকে ‘সমাজতন্ত্রী’ হিসেবেই দেখেছেন। ‘টু মার্শালস’ বইতে মার্শালের দ্বৈত-চরিত্র তুলে ধরা হয়েছে। ব্লুমসবিউরি গ্রুপের বিদগ্ধ সদস্য ও দিকপাল অর্থনীতিবিদ জন মেইনার্ড কেইনস প্রথাগত সমাজতন্ত্রের কট্টর সমালোচক ছিলেন, কিন্তু নিজেকে তিনি ‘বামধারার’ অর্থনীতিবিদ হিসেবেই ভাবতেন, বিশেষত অর্থনীতিতে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের প্রশ্নে জোরালো অবস্থান নিয়ে। ‘সোশ্যালিস্ট ইকোনমিক সিস্টেমের’ অন্য একটি প্রচলিত অর্থ হচ্ছে সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন ও অন্যান্য পূর্ব ইউরোপীয় ‘সমাজতান্ত্রিক দেশ’-এর মডেল অনুসরণ করা। কিন্তু সেটি বঙ্গবন্ধু ও তার নিকটতম সহকর্মীরা সংবিধানের আলোচনায় আগেভাগেই স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, সে ধরনের মডেল এদেশে হবার নয়। বাংলাদেশের মতো কৃষিপ্রধান অনগ্রসর পটভূমিতে সে ধরনের উন্নয়নের ছকে ‘কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার অর্থনীতি’র মডেলকে আশ্রয় করে এগোবার সম্ভাবনা সুদূরপরাহত। ১৯৭৩ সালে গৃহীত দেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা দলিলেও সেই বাস্তববোধের স্বীকৃতি ছিল। এখানে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার জন্য অন্য রাস্তা দেখতে হবে, যাতে করে ন্যায়ানুগ, সমতাবাদী ও শোষণমুক্ত সমাজ কালক্রমে প্রতিষ্ঠা করা যায়।

    ‘জাস্ট অ্যান্ড ইগালিটারিয়ান সোসাইটি’ বাক্যাংশ নিয়েও বাংলা ও ইংরেজি পাঠে বড় রকমের ধন্দের সৃষ্টি হলো। ড. আনিসুজ্জামান কমিটি ‘জাস্ট’-এর বঙ্গানুবাদ ঠিকই করলেন ‘ন্যায়ানুগ’, কিন্তু গোল বাধল ‘ইগালিটারিয়ান’ শব্দটির বাংলা নিয়ে। ড. কামাল লিখলেন ‘egalitarian society’; ড. আনিসুজ্জামান লিখলেন ‘সাম্যবাদী সমাজ’। আপাতঃদৃষ্টিতে দুটোকেই সমার্থক শব্দ মনে হলেও এরা আদৌ সমার্থক নয় বর্ণে-গন্ধে, ঐতিহ্যে, পরম্পরায়। egalitarianism নানা ধারার মতবাদেই, নানা ধরনের সংবিধানেই আছে। যে কোনো ‘লিবারেল বুর্জোয়া’ ধারার টেক্সটেই ‘egalitarian society’ শব্দবন্ধটি খুঁজে পাওয়া বিচিত্র নয়, অস্বাভাবিকও নয়। এর একটা কারণ- অর্থনীতিতে না হোক, রাজনীতিতে egalitarianism অর্থাৎ Political equality, এবং মৌলিক অধিকারের equality প্রতিশ্রুত হয়ে থাকে। এর শুরু ইউরোপীয় এনলাইটেনমেন্টের দর্শনে সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতাব্দীতে। এটি রাজনৈতিকভাবে ধারণ করেছিল ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লব, যার স্লোগান ছিল- ‘লিবার্টি, ইকুয়ালিটি, ফ্রেটারনিটি’। ইকুয়ালিটি ফরাসি উচ্চারণে হয় ‘ইগালিতে’- সেখান থেকে ইংরেজিতে তার পুনর্জন্ম egalitarian ব্যাঞ্জনায়। আমি বলতে চাইছি, কী ঐতিহাসিকভাবে এবং ব্যুৎপত্তিগতভাবে ড. কামাল যখন just and egalitarian society ব্যবহার করে ছিলেন তিনি কমিউনিস্ট অর্থে, সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠা করার অর্থে খুব সম্ভবত ব্যবহার করেননি। তিনি ব্যবহার করেছিলেন লিবারেল পলিটিক্যাল ফিলোসফির পলিটিক্যাল ইকুয়ালিটির বহুল প্রচলিত অর্থে। ফরাসি বিপ্লবের Spirit-এ। কিন্তু ড. আনিসুজ্জামানের হাতে পড়ে সেটা হয়ে গেল- ‘সাম্যবাদী সমাজ’। তিনি এর পরিবর্তে ‘সমতাবাদী সমাজ’, ‘সুষম বণ্টনের সমাজ’ নানা ধরনের বিকল্প ভাবতে পারতেন বা নতুন শব্দ উদ্ভাবন করতে পারতেন। কিন্তু তা না করে তিনি হাত বাড়ালেন এমন একটি শব্দের প্রতি যার অর্থ বহুকাল ধরে একটি সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক দর্শনের মধ্যে সংজ্ঞায়িত হয়ে আছে। মার্কসবাদী প্রগতিবাদী দর্শনের যে কোনো টেক্সটে যখন ‘সাম্যবাদী সমাজ’ শব্দটি লেখা হয়, তখন তার একটিই (বা প্রধানতম) মানে হচ্ছে- মার্কস-এঙ্গেলসের নির্দেশিত পথের ‘সাম্যবাদী সমাজ’। যে সাম্যবাদী সমাজের দুই ধাপ- প্রথমটি সমাজতান্ত্রিক সমাজ (বিকাশের অপেক্ষাকৃত নিচু পর্যায়ে)। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে সাম্যবাদী সমাজ (বিকাশের অপেক্ষাকৃত উঁচু পর্যায়ে)। এটি হতেই পারে না যে ড. আনিসুজ্জামান বা তার সহ-অনুবাদকগণ ‘সাম্যবাদী সমাজ’ লেখার ‘ছায়া-অর্থ’ বা Connotation জানতেন না। অন্তত ড. আনিসুজ্জামান- যিনি এক সময়ে (পঞ্চাশের দশকে) কিছুকালের জন্য কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হিসেবে সক্রিয় ছিলেন (এবং পরবর্তীকালেও এ ধারার সংলগ্ন আফ্রো-এশীয় সংহতি পরিষদের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন)- সাম্যবাদী সমাজ লেখার গভীরতর তাৎপর্য ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন বা বুঝতে পারার কথা।

    প্রশ্ন উঠবে, অনুবাদটি যে যথাযথ হলো না আক্ষরিক ও রাজনৈতিক উভয় অর্থে, সেটি আনিসুজ্জামানের হাত থেকে নিষ্ফ্ক্রান্ত হলেও সংবিধান-কমিটির অন্য সদস্যদের তো এই অনুবাদের দার্শনিক-রাজনৈতিক তাৎপর্য চোখে পড়ার কথা। তাহলে সেটি নিয়ে সেদিনের গণপরিষদে তর্ক ওঠেনি কেন? সংবিধান-কমিটিতেও এ নিয়ে বাদানুবাদ হতে পারত অল্পবিস্তর। সেটা হয়েছিল কিনা আজ সেটা জানবার প্রায় উপায় নেই। আমরা শুধু এটুকু জানি যে বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম বা ড. কামাল হোসেন কেউই egalitarian society-র প্রতিশব্দ হিসেবে ‘সাম্যবাদী সমাজ’ প্রতিষ্ঠার রূপকল্পে আপত্তি জানাননি। হতে পারে তারাও রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রাপ্ত দেশটিকে ওইরকম একটি আদর্শ বা আদর্শায়িত সমাজের দিকেই কালক্রমে- অনেক ঝড়-ঝঞ্ঝা ও চড়াই-উৎরাইয়ের ক্লেশ-যন্ত্রণা স্বীকার করেই নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। অবশ্যই এই যাত্রা হতো গণতান্ত্রিক রীতি-নীতি অনুসরণ করে- অগণতান্ত্রিক পরমত অসহিষ্ণু পথে নয়- সন্দেহ নেই। সমতামুখী সমাজের দিকেই এগোতে চেয়েছিলেন তারা। অন্তত সেরকম স্বপ্ন তাদের ছিল। সে জন্যেই আনিসুজ্জামানের অনুবাদে তারা আপত্তি জানাননি সেদিন কেউই।

    ১০. ‘সুযোগের সমতা’ ও ‘শ্রম-অনুযায়ী বণ্টন’

    আগেই বলেছি, সমাজতন্ত্র মানে রাষ্ট্রায়ত্ত মালিকানাভিত্তিক সমাজ নয়। সমাজতন্ত্রকে এমনকি শুধু সম্পত্তির ওপরে মালিকানা নিরিখে বিচার করা চলে না। মালিকানার বিচার সমাজতন্ত্রের একটি মূল দিক। তবে একমাত্র দিক নয়, প্রধানতম দিকও নয়। এর কারণ সমাজতন্ত্র প্রতিশ্রুতি দেয় প্রত্যেক নাগরিককে ‘সুযোগের সমতা’র অধিকার। সুযোগের সমতা বা equality of opportunity সমাজতন্ত্রের মৌলিক শর্তের একটি অবশ্য পূরণীয় শর্ত। সমাজতন্ত্রের চরিত্রে রয়েছে ‘সামাজিক মালিকানা’ (যার মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রীয় মালিকানা, সমবায়ী মালিকানা ও ব্যক্তি মালিকানার নানা দেশ-কাল ভেদে বিভিন্ন মিশ্রণ)। কিন্তু সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে একটা বিশেষ লক্ষ্যে, আর সেটা হচ্ছে সকল নাগরিকের মধ্যে ‘সুযোগের সমান অধিকারের’ প্রতিষ্ঠা করা। মালিকানা- তা সে রাষ্ট্রীয় হোক বা ব্যক্তি মালিকানাই হোক- কেবল উদ্দেশ্য সিদ্ধির ‘উপায়’ মাত্র। উপায় ও উদ্দেশ্যের মধ্যে গুলিয়ে ফেললে সমাজতন্ত্রের চরিত্রে বিকৃতি দেখা দিতে বাধ্য। নানা দেশে সমাজতন্ত্র গড়ার অভিজ্ঞতায় এটা দেখা গেছে- কখনও ‘স্তালিনীয় সমাজতন্ত্রে’র মডেলে পণ্য-অর্থ সম্পর্ককে হালকা করে দেখার মাধ্যমে। কখনও কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার ওপরে মাত্রাতিরিক্ত জোর দিয়ে, কখনও না-পরিকল্পনা না-বাজার এমন একটা জগাখিচুড়িপূর্ণ ‘অর্থনৈতিক সংস্কার’ কর্মসূচি হাতে নিয়ে (যেমনটা হয়েছিল গর্বাচেভের সংস্কার-প্রচেষ্টার আমলে)। সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীনসহ প্রায় প্রতিটি ‘সমাজতান্ত্রিক দেশেই’ মালিকানা সম্পর্কের বিশুদ্ধতা রক্ষায় বেশি তৎপর হতে গিয়ে আসল উদ্দেশ্য জনকল্যাণ থেকে দৃষ্টি সরে গেছে সময় সময়। সে জন্যেই সমাজতন্ত্র কী তা বোঝার জন্য consequentialist দৃষ্টিভঙ্গিকে আশ্রয় করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সমাজতন্ত্রকে টিকতে হলে তাকে মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের ভাষায় কথা বলতে হবে, ‘অধিকারের ভাষায়’ কথা বলতে শিখতে হবে। যার ইঙ্গিত রেখেছিলেন মার্কস ‘ক্রিটিক অব দ্য গথা প্রোগ্রামে’ যেখানে সমাজতন্ত্রকে ক্রমশ মানবচাহিদামুখীন (Need based society) সমাজ হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন মার্কস। বাহাত্তরের সংবিধানের আদি প্রণেতারা ও বঙ্গবন্ধু ‘অধিকারের ভাষাতেই’ সমাজতন্ত্রকে দেখতে চেয়েছেন- শুধু মালিকানা-সম্পর্কের নিরিখে দেখতে চাননি। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ সংবিধানের ১৯ এবং ২০ নম্বর অনুচ্ছেদ। এ নিয়েই আমরা এখানে আলোচনা সীমিত রাখব। বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র ব্যাখ্যার জন্য এ দুই অনুচ্ছেদের পদ্ধতিগত গুরুত্ব অপরিসীম।

    ১৯নং অনুচ্ছেদে ১নং ধারায় বলা হয়েছে ‘সুযোগের সমতার কথা’, আর ২নং ধারায় বলা হয়েছে ‘সুষম বণ্টনের’ কথা। ১নং ধারায় অতি সংক্ষেপে বলা হয়েছে : ‘সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করিতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হইবেন।’ অতি সংক্ষেপেই চুম্বক-বাক্য হিসেবে ‘ইকুয়ালিটি অব অপরচুনিটির’ কথা লেখা হয়েছে বিশদ ব্যাখ্যা না করেই। কোন কোন সুযোগের ক্ষেত্রে সমতা বিধান করা হবে বা বেশি জোর দেওয়া হবে, কতটুকু সমতা বিধান করা হবে (কতটা গভীর গিয়ে বৈষম্যের প্রশ্নটি সমাধা করা হবে); কোন কোন ক্ষেত্রে সমতা-বিধানের প্রশ্নটি সবার আগে সমাধান করা জরুরি, এবং কী ধরনের সুযোগের ক্ষেত্রে সমতার প্রশ্নটি ক্রমান্বয়ে অর্জিত হবে এসব প্রশ্নই প্রচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ভেতরে। এই প্রশ্নগুলো নিয়ে প্রচুর আলোচনা, গণ-আলোচনা, তর্ক-বিতর্কের সুযোগ রয়েছে। তার কিছু কিছু দিকের কথা এখানে তুলে ধরা হলো।

    সুযোগের সমতা নিশ্চিত করতে গেলে প্রথমেই এসে পড়ে সুযোগের ক্ষেত্রে ‘আদি-বৈষম্য’ (initial inequality) দূর করার সমস্যাটি। এ ক্ষেত্রে বার্নার্ড উইলিয়ামস একটি উপদেশ দিয়েছেন। ধরা যাক কোনো একটি দেশে নীতি-নির্ধারকেরা ঠিক করলেন যে কেবলমাত্র ক্ষত্রিয় বা বিশেষ কোনো যোদ্ধা-শ্রেণি বা গোত্র (ইংরেজিতে যাকে বলে- warrior class) থেকেই সামরিক বাহিনীতে নিয়োগ দেওয়া হবে ব্যাপারটা এমন নয়। এবার থেকে সমাজের সকল স্তরের মানুষেরাই সামরিক বাহিনীতে যোগ দেওয়ার ‘সমান সুযোগ’ পাবেন। অর্থাৎ, এ ক্ষেত্রে ‘সুযোগের সমতা’ পূর্ব-ঘোষিত হলো।

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.