গেল মাসে ক্রিস্টোফার কলম্বাসের (১৪৫১-১৫০৬) আমেরিকায় পদার্পণ দিবস পালিত হয়েছে। এ-দিবসটি উপলক্ষে সরকারি ছুটি ঘোষিত হয়েছে। কিন্তু সে-ছুটি যুক্তরাষ্ট্রের বহু মানুষ পালন করেননি। কলম্বাস অনেকের কাছে আজ আর আমেরিকার আবিষ্কারক নন বরং ঐতিহাসিক মিথ্যুক ও প্রতারক হিসেবে আজ মানুষ তাকে জানছে। কলম্বাস কলম্বিয়ান এক্সচেঞ্জ নামের এক ধরনের বিনিময়প্রথা চালু করেছিলেন স্থানীয় আদিবাসীদের সাথে। এই বিনিময়প্রথার মাধ্যমে সহজ-সরল আদিবাসীদের ঠকিয়ে তাদের সম্পদ, জমিজিরাত মায় তুচ্ছ জীবনটুকুও হস্তগত করতেন কলম্বাস। আজকের মার্কিন শাসকদের সাথে কী ভীষণ মিল কলম্বাসের! ভাবতে অবাক লাগে। এই বিষয়টা নিয়ে পত্রিকা অফিসে (যেখানে আমি কাজ করি) আলাপ করছিলাম। নিউজ সেকশানের একজন বয়োজ্যেষ্ঠ সহকর্মী বিষয়টা ভালোভাবে নিলেন না। তিনি বললেন, ‘তোমরা মার্কিনিদের বিজয়ে হতাশ। ওরা যে প্রায় সব নোবেলই বাগিয়ে নিল, সেটাই তোমাদের সহ্য হচ্ছে না। তোমরা আমেরিকার শুভ্র দেয়ালে কালি ছিটিয়ে দিতে চাও।’ আমি বললাম, ‘আমি নই, মার্কিন শিশুরাই সেদেশের দেয়ালে কালি ছিটিয়ে দিয়েছে।’ বিশ্বাস না হলে পাঠক নীচের লেখাটি পড়ুন :
আমেরিকা আবিষ্কার করেছেন কে? — এই প্রশ্নের জবাবে যারা এতদিন কলম্বাসের নাম বলেছেন, তাদের সচেতন হবার সময় এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের স্কুলগুলোতে শিশুরা প্রশ্ন তুলেছে : যদি কলম্বাস আসার আগেই আমেরিকায় মানুষের বসবাস থেকে থাকে, তবে কী করে কলম্বাসকে আমেরিকা-আবিষ্কারের কৃতিত্ব দেয়া যায়? যুক্তরাষ্ট্রে কলম্বাসের পদার্পণ দিবস উপলক্ষে নির্ধারিত সরকারি ছুটি পালন করেনি যুক্তরাষ্ট্রের বহু স্কুল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বেশিরভাগ স্কুলের শিক্ষার্থী এখন আর কলম্বাসকে ইতিহাসের মহানায়ক ভাবতে রাজি নয়। যদিও আমেরিকার পপ সংস্কৃতিতে কলম্বাস জায়গা করে নিয়েছেন, তবু এ-প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা প্রকৃত সত্য জানতেই আগ্রহী। স্কুলশিক্ষক জেফরি কলোউইথ বলেন, ‘শিশুদের সাথে আমি কলম্বাস বিষয়ে আলাপ করেছি। বইতে যা লেখা আছে তা পড়েই শিশুরা ধিক্কার দিয়েছে। তারা বলেছে, সে এত নীচ আর কর্তৃত্বপরায়ণ ছিল যে ভাবতেই অবাক লাগে।’ কলম্বাসের মহিমা যুক্তরাষ্ট্রের শ্রেণীকক্ষগুলোতে দিনদিনই খাটো হয়ে যাচ্ছে। বহু জেলা ও রাজ্য তার নামে ঘোষিত রাষ্ট্রীয় ছুটি বাতিল করেছে জনগণের চাপে। শিশুরা বইতে যা আছে তা-ই পড়ছে। আর তারা জানছে, কলম্বাসের আমেরিকা-আবিষ্কারের পর স্থানীয় আদিবাসীদের জীবনে কী দুর্দশা নেমে এসেছিল। টেক্সাস এ অ্যান্ড এম কলেজের শিক্ষা ও মানবিকতা বিভাগের অধ্যাপক জেমস কারাচ বলেন, ‘এ-যুগে আবিষ্কার শব্দটি তার আগের মাহাত্ম্য হারিয়েছে। আগের মতো কলম্বাসকে তাই আমেরিকা-আবিষ্কারের কৃতিত্ব দেয়া হয় না। আদৌ লোকটি তা যে করেনি মানুষ এখন তা বুঝতে পারছে।’ কেবল কারাচ নন, স্কুলের শিশুরাও এই প্রশ্ন তুলেছে। তাদের কাছে কলম্বাস একজন নিষ্ঠুর, ধাপ্পাবাজ, লুণ্ঠনকারী এবং হাস্যকর বোবা লোক হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। টেক্সাসের এক স্কুলের শিশুদের মতে, লোকটি এতটাই নির্বোধ ছিল যে সে কোথায় এসেছে তাও জানত না ! টেক্সাসের স্কুলগুলোতে পঞ্চম শ্রেণীর বইতে কলম্বাসের ‘কলম্বিয়ান একচেঞ্জ’ নামের একটি অধ্যায় আছে। এই বিনিময়প্রথার মাধ্যমে সহজ-সরল আদিবাসীদের ঠকিয়ে কলম্বাস জাহাজ ভর্তি করে সোনা আর শস্য নিয়ে গেছেন। বিনিময়ে দিয়েছেন নানা সংক্রামক ব্যাধি, যার ফলে নির্বিচারে মারা পড়েছে আদিবাসীরা। টেক্সাসের স্কুলশিক্ষক লুরি ক্রফোর্ড বলেন, ‘শিশুদের ভাষায়, সে একটা অতি খারাপ লোক।’ মায়ামি, ডালাস, লস এঞ্জেলেস এবং সিয়াটলের স্কুলগুলো সোমবার খোলা ছিল। এই রাজ্যের মানুষজন কলম্বাসের স্মরণে সরকারি ছুটি পালন করেনি। এই অঞ্চলে বসবাসকারী আদিবাসী আমেরিকানদের কাছে দিনটি একটি কালো দিন। আলাস্কার শিক্ষা ও শিক্ষণ সহায়তা বিভাগের উপ-পরিচালক পল প্রাশিং বলেন, ‘আলাস্কার অধিবাসীদের একটি বড় অংশ আদিবাসী আমেরিকানদের কাছে কলম্বাস যুক্তরাষ্ট্রের জনক নয়। যখন এ-কথা বলা হয় তখন আমাদের খুব অদ্ভুত অনুভূতি হয়। পিটসবার্গের ৩০ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত ফোর্ট চেরি এলিমেন্টারি স্কুলের শিশুরা এক ছদ্ম বিচারের আয়োজন করেছে। এই বিচারের আসামি কলম্বাস এবং বিচারক শিশুরা। শিশু বিচারকরা কলম্বাসকে মিথ্যা বলা ও চুরির অপরাধে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে। টেক্সাস এ এম অ্যান্ড কলেজের অধ্যাপক জেমস কারাচ শিশুদের এই অনুভূতির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেন, সেই যুগ গত হয়েছে যখন কলম্বাস একজন বীর ছিলেন। তিনি শৈশবে পাঠ্য বইতে কলম্বাসের যে-ছবিটি দেখেছিলেন তার কথা উল্লেখ করেন, ‘ছবিটিতে দেখানো হয়েছে কলম্বাস এক হাতে ক্রুশ অন্য হাতে পতাকা নিয়ে আমেরিকার ভূমিতে অবতীর্ণ হচ্ছেন। এই বীরত্বের ছবি আজ বিলীন হতে চলেছে।’ তিনি বলেন, ‘আমার কাছে অবাক লাগে লোকটি আমাদের জন্য কী নিয়ে এসেছে? কেবল গুটি বসন্ত ছাড়া আমেরিকাবাসীকে সে কী দিয়েছে!’ তবে ১৪৯২ : যে-বছর জন্ম হয়েছিল পৃথিবীর — এই নামের একটি বইয়ের লেখক ফিলিপ ফারনান্দেজ-আর্মেস্তো বলেন, ‘প্রত্যেক নায়কই অন্য কারও কাছে খলনায়ক। আসলে বীরত্ব আর খল চরিত্র একই মুদ্রার এপিঠ ও ওপিঠ।’
সূত্র : এপি
চট্টগ্রামে বসবাসরত। পেশা : লেখালেখি। জীবিকা : সাংবাদিকতা।
