শরণার্থী নামটি যেভাবে পেয়েছে ফিলিস্তিন

মাহমুদ দারবিশকে নিয়ে কিছু একটা লেখার দায়িত্ব পড়েছিল আমার উপর। অথচ গত কিছুদিন পূর্বেও তার সম্পর্কে আমার কোন আগ্রহ ছিল না। মাত্র গত ৯ আগস্ট থেকে তার সঙ্গে আমার পরিচয়। টেক্সাসের একটি হাসপাতালে এদিন তার মৃত্যু হয়েছিল। মৃত্যু সংবাদটি পত্রিকার দু’কলাম জুড়ে ছাপা হবে পরদিন। ইন্টারনেট ঘেঁটে তাৎক্ষণিক প্রতিবেদনটি তৈরি করতে গিয়ে পড়ে ফেল্লাম তার কয়েকটি কবিতা। এরপর নতুন করে আবার তাকাতে হলো সংবাদপত্রের দিকে। গত কয়েকবছরে যে খবরগুলো আমি ইচ্ছে করেই এড়িয়ে যাই সে খবরগুলো খুঁটিয়ে পড়তে লাগলাম আবার।

মাহমুদ দারবিশকে নিয়ে কিছু একটা লেখার দায়িত্ব পড়েছিল আমার উপর। অথচ গত কিছুদিন আগেও তার সম্পর্কে আমার কোন আগ্রহ ছিল না। মাত্র গত ৯ আগস্ট থেকে তার সঙ্গে আমার পরিচয়। টেক্সাসের একটি হাসপাতালে এদিন তার মৃত্যু হয়েছিল। মৃত্যু সংবাদটি পত্রিকার দু’কলাম জুড়ে ছাপা হবে পরদিন।  . . .

‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌========================

তার মুখমন্ডল শেকলে বেঁধেছিল ওরা
দু’হাতে বাঁধা ছিল মৃত্যুর পাথর।
তুমি খুনি, এই বলে ওরা কেড়ে নিল
তার রুটি, জামা আর ব্যানার।
মৃত্যুর কুপের ভেতর ছুঁড়ে দেয়া হল তাকে।
ওরা বলল, তুমি আসলে চোর,
আর তাকে নিক্ষিপ্ত করা হল।
সমস্ত বন্দরের বাইরে।
তরুণী প্রেমিকাকেও নিয়ে গেল ওরা।
অবশেষে ওরা বলল
তুমি একজন শরণার্থী।

মাহমুদ দারবিশ

মাহমুদ দারবিশকে নিয়ে কিছু একটা লেখার দায়িত্ব পড়েছিল আমার উপর। অথচ গত কিছুদিন আগেও তার সম্পর্কে আমার কোন আগ্রহ ছিল না। মাত্র গত ৯ আগস্ট থেকে তার সঙ্গে আমার পরিচয়। টেক্সাসের একটি হাসপাতালে এদিন তার মৃত্যু হয়েছিল। মৃত্যু সংবাদটি পত্রিকার দু’কলাম জুড়ে ছাপা হবে পরদিন। ইন্টারনেট ঘেঁটে তাৎক্ষণিক প্রতিবেদনটি তৈরি করতে গিয়ে পড়ে ফেললাম তার কয়েকটি কবিতা। এরপর নতুন করে আবার তাকাতে হলো সংবাদপত্রের দিকে। গত কয়েক বছরে যে খবরগুলো আমি ইচ্ছে করেই এড়িয়ে যাই সে খবরগুলো খুঁটিয়ে পড়তে লাগলাম আবার। সেই ফিলিস্তিন, পশ্চিম তীর, গাজা, শরণার্থী শিবির, ইসরায়েলি হামলা, আত্মঘাতি বোমারু এসব অনুষঙ্গ আবারও ধীরে ধীরে আমার মাথার ভেতরে প্রবেশ করছিল। আমার হৃদয়ের কোথাও ফিলিস্তিন শব্দটি এতদিন এভাবে উচ্চারিত হয়নি। অথচ আজ দারবিশ যেন নতুন এক গান শোনালেন। তার সুর মূর্ছনায় আমি চিনতে শুরু করেছি ফিলিস্তিনের সব শব্দকে। দারবিশের এই লেখায় প্রবেশ করার আগে বলে নেয়া যাক ফাদেল সানার গল্প।

আল জাজিরা টেলিভিশন কিছুদিন আগে ‘শুটিং দ্য মেসেঞ্জার’ শিরোনামে একটা তথ্যচিত্র সম্প্রচার করেছিল। তাতে দেখানো হয়েছে কি করে ফিলিস্তিনের কর্মরত সাংবাদিকরা ইসরায়েলি মিসাইলের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হচ্ছে। নিহত সাংবাদিকদের তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন রয়টার্সের ক্যামেরাম্যান ফাদেল সানা। একধিকবার ইসরায়েলি হামলায় আহত ফাদেল সানাকে কোনোভাবেই সংবাদ সংগ্রহ থেকে বিরত রাখা যায়নি। রয়টার্স থেকে তাকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে না যেতে অনুরোধ করা হলেও তা তিনি শোনেননি। পাঁচবছর আগে গাজায় সারিয়া সাহ ও জেমস্ মিলারের ঘটনা থেকেও শিক্ষা নেননি তিনি।

এ দুই ব্রিটিশ সাংবাদিক ফিলিস্তিনি শিশুদের ওপর তথ্যচিত্র নির্মাণ করতে এসে ইসরায়েলি গুলি বর্ষণের মুখে পড়েছিলেন। তাৎক্ষণিকভাবে নিজেদের বাঁচাতে একটি ফিলিস্তিনি বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন তারা। ইসরায়েলি সৈন্যরা বাড়িটি ঘেরাও করলে, আশ্রয়দাতা পরিবারটির নিরাপত্তার কথা ভেবে রাতে তারা বেরিয়ে আসেন। নিজেদের গায়ের ওপর টর্চ ফেলে প্রেস লেখা জ্যাকেট দেখিয়ে হাতে সাদা পতাকা নিয়ে ‘ব্রিটিশ সাংবাদিক’ বলে চিৎকার করে সামনে এগুচ্ছিলেন তারা। কিন্তু তাতেও কোনো কাজ হল না। অদূরে ওঁত পেতে থাকা ইসরায়েলি সৈন্যরা সাদা পতাকার জবাব দিল গুলি ছুঁড়ে। প্রথম গুলিটি বিদ্ধ হল জেমস মিলারের বাঁ পায়ের হাঁটুতে। তারপর ডান পায়ের হাঁটুতে দ্বিতীয়টি। ঘাড়ে গুলিবিদ্ধ হবার পূর্বে নিজের সাংবাদিক পরিচয় জানিয়ে বাঁচার ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলেন তিনি ।

তবু এসব ঘটনা ফাদেল সানাদের মত ফিলিস্তিনি সাংবাদিকদের ভীত করে নি। মাহমুদ আল আগারামি আর ফাদেল সানার অবিশ্বাস্য সাহসিকতার কথা ততদিনে জেনে গিয়েছিল ফিলিস্তিনবাসী। এ দু’জন সাংবাদিক আক্রান্ত হবার পরদিন আবার একই স্থানে সংবাদ সংগ্রহ করতে গেছেন একাধিকবার। জেবালিয়াহ এলাকায় ইসরায়েলি ট্যাংকের সামনে দাঁড়ানো একটি শিশুর ফুটেজ ধারণ করছিলেন মাহমুদ আগারামি। পূর্ব সতর্ক সংকেত না দিয়েই ট্যাংকটি থেকে হঠাৎ গোলা ছোঁড়ে ইসরায়েলি সৈন্যরা। সামনে দাঁড়ানো শিশুটিকে অতিক্রম করে গোলাটি আঘাত হানে আগারামির খুব কাছেই। মারাত্মক আহত আগারামি ছয় ঘণ্টা অচেতন ছিলেন এবং ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান।

ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল না ফাদেল সানার ক্ষেত্রে। বার বার হামলা থেকে বেঁচে গেলেও এ যাত্রায় মরতে হল তাকে। বড় বড় অক্ষরে প্রেস টিভি লেখা জিপে চড়ে তিনি গিয়েছিলেন পূর্ব গাজার একটি গ্রামে ইসরায়েলি হামলায় আহত গ্রামবাসীর ছবি তুলতে। ফেরার পথে রাস্তায় ইসরায়েলি ট্যাংক দেখে থামেন একটি ভালো ফুটেজের আশায়। অদূরে দাঁড়ানো ট্যাংকটি ততক্ষণে তার প্রেস, টিভি লেখা গাড়িটিকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে। ফাদেল ক্যামেরা ঘোরানোর অবকাশ পেলেন না। ঘাতক গোলা চিরতরে স্তব্ধ করে দিল তাকে। মৃত্যুর আগে আলজাজিরা টেলিভিশনে সাক্ষাৎকারে ফাদেল বলেছিলেন, ‘কেবল দুটো ঘটনা আমাকে সংবাদ সংগ্রহ থেকে বিরত রাখতে পারে, এক আমার পঙ্গুত্ব, দুই আমার মৃত্যু।’

রাস্তাগুলো ঘিরে আছে আমাদের
এই যে আমরা হেঁটে যাই বোমার ভেতর দিয়ে
এতে কী তুমি মৃত্যুতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছো?
জীবনের অভিলাষ এখনো আমার আছে
আর আছে অনিঃশেষ বাসনা
মৃতদের চেন কী তুমি?
আমি তাদের চিনেছি আর
তা কেবল ভালোবাসার মধ্য দিয়ে।

মাহমুদ দারবিশ

মাহমুদ দারবিশের এই কবিতাটি ফিলিস্তিনের পুড়তে থাকা বারুদের ওপর দাঁড়ানো একজন শান্তিবাদি মানুষের স্থিরচিত্রই তৈরি করে আমার মধ্যে। দারবিশ বাস্তবিক অর্থে তাই ছিলেন। যতটা বিপ্লবী তার চেয়ে বেশি প্রেমিক, যতটা ফিলিস্তিনি তার চেয়ে বেশি বিশ্বমানবিক। সাম্প্রতিক পৃথিবীতে যত যুদ্ধের ঘটনা ঘটেছে তার মধ্যে সবচেয়ে মর্মান্তিক দীর্ঘস্থায়ী এবং অসম যুদ্ধ চলছে ফিলিস্তিনে। এখানে ভয়ঙ্কর অস্ত্রে সজ্জিত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে পাথর হাতে লড়ছে শিশুরা। ফাদেল সানার মত সাংবাদিকদের মৃত্যু সেদেশে তাই রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। হতাশা গ্লানি আর অপমান আত্মঘাতি করে তুলেছে ফিলিস্তিনিদের। দারবিশ এই আত্মঘাতি স্বদেশীদের অবাস্তব মৃত্যু প্রত্যক্ষ করতে করতে ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন। বলেছেন, ‘কেবল স্বাধীনতার সামান্য আশাই আত্মহত্যা থেকে ফিরিয়ে আনতে পারে এই জাতিকে।’

১৩ মার্চ ১৯৪১ এ বর্তমান ইসরাইলের পূর্ব একরের বিরওয়া নামের গ্রামে এক মধ্যবিত্ত কৃষক পরিবারে জন্ম দারবিশের। বাবা মা দুজনই মাঠে কাজ করতেন বলে দাদার কাছেই সারাদিন কাটত তার। আনন্দ উচ্ছল এই শৈশব দীর্ঘস্থায়ী হল না। তার যখন মাত্র ৬ বছর বয়স তখন থেকেই শুরু শরণার্থী জীবনের। ইসরায়েলি সৈন্যরা তাদের গ্রামটি আক্রমণ করলে পরিবারের সাথে পালিয়ে যান লেবাননে। একবছর পর অধিকৃত মাতৃভূমিতে ফিরে এসে দেখেন বাপদাতার ভিটেসহ প্রিয় গ্রামখানি উচ্ছেদ করে বসতি গড়েছে ইহুদিরা। তাই তাদের জায়গা হল না সেখানে। গ্যালিলি শহরের দাইর আল আসাদ নামের জায়গায় থাকতে শুরু করলেন তারা। বাড়িতে কোনো বই ছিল না তাদের। রাস্তা দিয়ে যাওয়া কোনো এক ইসরায়েলি সৈনিকের গাওয়া গানই তাকে প্রথম কবিতার অভিজ্ঞতা দিয়েছিল। গ্রামের এক বড় ভাই তার ভাব গতিকে দেখে অনুরোধ করেছিল সে যেন কবিতা লেখে।

১৯৪৮ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত সামরিক আইনের অধীনে বসবাস করেছে ইসরায়েলি আরবরা। প্রতিটি পদক্ষেপেই ছিল কঠোর নিয়ন্ত্রণ। ছিল না রাজনীতি করার অধিকার। শৈশব থেকে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন তার পরিবার এবং স্বদেশের আর সব ফিলিস্তিনি দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত হয়েছে।

দারবিশের লেখাপড়া শুরু হয়েছিল একটি ইসরায়েলি স্কুলে। হিব্রু ভাষায় পাঠদান হত সেখানে। শিক্ষকরাও ছিলেন ইহুদি। ইসরায়েলের জাতীয় দিবস উপলক্ষে কবিতাও লিখেছিলেন তিনি। কবিতাটি শৈশবেই হারিয়ে ফেলেছিলেন তবে পরবর্তীকালে তার স্মৃতিকথা থেকে এর বিষয়বস্তু সম্পর্কে জানা যায়। এক আরব বালক অন্য এক ইহুদি বালকের কাছে আর্তি জানাচ্ছে কবিতাটিতে। আরব বালকটি বলছে, ‘তুমি যেমন ইচ্ছে খেলতে পার রোদের মধ্যে, তোমার আছে উৎসব আনন্দ, আমার তা নেই। আমরা কী পারি না এক সাথে খেলতে?’ এ রকম বিষয়বস্তু নিয়ে কবিতা লেখার অপরাধে সামরিক সরকারের কর্তাব্যক্তিদের কাছ থেকে হুমকিও এসেছিল। এমন কবিতা ফের লিখলে তাকে স্কুল থেকে চলে যেতে হবে আর তার বাবাকেও চাকরিচ্যুত করা হবে বলে শাসিয়ে দিল সামরিক কর্তৃপক্ষ। অবশ্য বেশ কিছু ইহুদির সাথে তার ব্যক্তিগত সম্পর্কও গড়ে উঠেছিল।

স্কুলের শিক্ষকদের মধ্যে অন্তত একজনকে তিনি খুব পছন্দ করতেন। রক্ষণশীল আরব পরিবারের মেয়েদের চাইতে ইহুদি মেয়েদের সাথে অনেক সহজভাবে মিশতে পারতেন। জীবনের প্রথম প্রেমও ছিল একটি ইহুদি মেয়ের সঙ্গে। স্কুলে, হিব্রু অনুবাদে পড়েছিলেন ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা ও পাবলো নেরুদার কবিতা। এছাড়া হিব্রু সাহিত্যের প্রতি অনুরাগও তার বাড়তে থাকে এ সময়। ক্লাসিক্যাল হিব্রু কবি তোরা থেকে শুরু করে আধুনিক কবি ইহুদি আমাচি সহ অনেকেই তাকে ভীষণ রকম আলোড়িত করে। আরব কবিদের মধ্যে ইরাকি কবি আবদাল ওহাব আল বায়াতি এবং বদর সাকির আল সায়াব তাকে প্রভাবিত করে। বৈরুতের আল শির সাহিত্য পত্রিকাকে কেন্দ্র করে তরুণ কবিদের যে সাহিত্য আন্দোলন শুরু হয়েছিল তাও স্পর্শ করেছিল তাকে। এছাড়া সিরিয়ার কবি এডোনিস (আলি আহমদ সাইদ আসবার) এবং নাজির কাব্বানিও তার ভালো লেগেছিল।

দারবিশের প্রথম কবিতার বিষয়বস্তু ছিল ইসরায়েলি দুঃশাসনের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধ। প্রথম কাব্যগ্রন্থ জলপাই গাছের পাতা প্রকাশিত হয় ১৯৬৪ সালে। এরপর ফিলিস্তিনি প্রেমিক ১৯৬৬ তে এবং রাতের শেষ প্রকাশিত হয় ১৯৬৭ সালে ইসরায়েল থেকে। সে সময় দারবিশ ইসরায়েলি কমিউনিস্ট পার্টি রাকাহ এর সঙ্গে যুক্ত হন এবং পার্টির পত্রিকার আরব সংস্করণ সম্পাদনার দায়িত্ব পান। আল ইত্তিহাদ নামের পত্রিকাটির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর ঘন ঘন গ্রেফতার ও গৃহবন্দী হতে থাকেন তিনি। দারবিশের প্রথম দিককার কবিতাগুলো ছিল ক্লাসিক্যাল ঘরানার। কিন্তু ৬০ দশকের মাঝামাঝি বদলে যেতে থাকেন তিনি। আরো সরাসরি হয়ে ওঠে তার কবিতা। সহজ, দৃঢ় আর বারুদের মত বিস্ফোরক কবিতাগুলো এ সময় ফিলিস্তিনিদের কান্নারই অনুবাদ। তবে ছোট কবিতাগুলো বহু স্তরের অর্থ ধারণ করে। রাগ, ক্ষোভ, অবিচার ও বঞ্চনার অনুভূতি এক সাথে জড়িয়ে থাকতে দেখা যায় তার কবিতায়। আইডেন্টিটি কার্ড বা পরিচয়পত্র কবিতাটিতে একজন আরব লোক নিজের পরিচয় দিচ্ছে এভাবে ‌-

প্রথম পৃষ্ঠার শুরুতে লিখ
আমি মানুষকে ঘৃণা করি না।
কখনো কারো কাছ থেকে কিছু চুরি করিনি।
তবু
যদি আমি ক্ষুধার্ত হই তবে
খেতে শুরু করবো হানাদারের মাংস
সাবধান, সাবধান আমার ক্ষুধা থেকে
আর আমার রাগ থেকে।

অগ্নিগর্ভ এই কবিতাটিতে বিদ্রোহ থাকলেও কোথাও একটা বিশ্বমানবিক সুরও ধ্বনিত হয়। ফিলিস্তিন নামের প্রিজমের মধ্য দিয়ে তিনি দেখতে পেয়েছিলেন বাইরের দুনিয়ার আবেগ অনুভূতির রঙগুলো। সত্যিকারের ফিলিস্তিনি হতে হলে আন্তর্জাতিক হতে হবে নিজেকে, এই সত্যটা অনুধাবন করেছিলেন তিনি। হাজার বছরের ফিলিস্তিন সভ্যতার ভেতরে বহুদিন ধরে সঞ্চিত হয়েছে নানান জাতির গায়ের ঘাম। এদের কণ্ঠস্বর আধুনিক ফিলিস্তিন জাতির সাথে এক হয়ে মিলেমিশে গেছে। হাজার বছর ধরে হিব্রু, গ্রিক, রোমান, তুর্কি ও ব্রিটিশরা নিজেদের চিহ্ন রেখে গেছে এই ভূখন্ডে। এইসব কিছু নিয়েই ফিলিস্তিন। তাকে অস্বীকার করে নয়। আর এসব কিছু থেকেই চেনা যায় একজন ফিলিস্তিনিকে। দারবিশ এই বৈচিত্র্যকেই ধরতে চেয়েছিলেন তার কবিতায়।

ইসরায়েলি সৈন্যদের নিজের মতই পরিস্থিতির শিকার ভাবতেন দারবিশ, দমনমূলক সামরিক শাসন তার কাছে ছিল অবাস্তব। এই অবাস্তব জগৎকে ছেড়ে ১৯৭১ সালে মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার জন্য পাড়ি জমান তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নে। এরপর কিছু দিন কায়রোতে কাটিয়ে বৈরুতে থিতু হন। জড়িত হন প্যালেস্টাইন রিসার্চ সেন্টারের সঙ্গে। লেবাননের গৃহযুদ্ধের শুরুর দিকে বৈরুতে কাটিয়েছিলেন তিনি। ১৯৮২ সালে ইয়াসির আরাফাতের সঙ্গে বৈরুত ত্যাগ করে তিউনিস যান এবং তিউনিস থেকে শেষে প্যারিসে। এ সময়কালকে তার রাজনৈতিক জীবনের উত্থানের সময় বললেও ভুল হবে না। প্যারিসে থাকাকালে প্রভাবশালী আরবি সাহিত্য পত্রিকা আল কারমেল এর সম্পাদক হন তিনি। ১৯৮২ সালে বৈরুতে ইসরায়েলি বোমা বর্ষণের স্মৃতি নিয়ে রচনা করেন ‘বিস্মরণের স্মৃতি’ । একটি দীর্ঘ গদ্য কবিতা ছিল এটি। যাতে ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ আর উপহাসের ছলে সহিংসতা, উন্মাদনা আর দুঃখময় নির্বাসিত জীবনের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। রাজনৈতিক জীবনে তিনি কখনো আপস করেন নি। জীবনের শেষ বছরগুলো তিনি রামাল্লা আর জর্ডানের রাজধানী আম্মানে কাটিয়েছিলেন।

দারবিশ লিখতেন আরবিতে, অনর্গল বলতেন আরবি, ইংরেজি, ফরাসি আর হিব্রু ভাষা। হিব্রু ভাষায় আধুনিক কবিতার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল তার। হিব্রুতে পড়েছেন আর্তুর র্যাঁবো এবং এলেন গিনসবার্গের কবিতা। মাতৃভূমি ফিলিস্তিন এবং তার স্বাধীনতাকামী জনগণ দারবিশের কবিতার প্রধান অনুষঙ্গ হলেও ইহুদি বিদ্বেষী তিনি কখনোই ছিলেন না। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি আমার শত্রুদের মানবিক করার চেষ্টা চালিয়ে যাব। যে আমাকে প্রথম হিব্রু পাঠদান করেছিল, ইহুদি ছিলেন তিনি। আমার প্রথম প্রেম ছিল একটি ইহুদি মেয়ের সাথে। যে বিচারক আমাকে প্রথম জেলে পাঠিয়েছিলেন তিনি ছিলেন একজন ইহুদি নারী। তাই আমি ইহুদিদের ফেরেশতা অথবা শয়তান কোনোটাই মনে করতাম না। তাদের কেবল মানুষ হিসেবেই বিবেচনা করতাম আমি।’

২০০০ সালের মার্চ মাসে ইসরায়েলি শিক্ষামন্ত্রী ইউসি সারিদ দারবিশের কিছু কবিতা ইসরায়েলের স্কুলগুলোর পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এহুদ বারাক এর তীব্র বিরোধীতা করেন। তার যুক্তি ছিল ইসরায়েল এখনো প্রস্তুত নয়। এহুদ বারাকের কথাই হয়ত ঠিক, ইসরায়েল এখনো প্রস্তুত নয়। প্রস্তুত নয় আত্মহত্যার দিকে এগিয়ে যাওয়া ফিলিস্তিনিদের হাহাকার শুনতে। দারবিশ বলেছিলেন, কেবল স্বাধীন হবার সামান্যতম আশাও এই জাতিকে ফিরিয়ে আনতে পারে। সেই আশাবাদের কথা শোনাতে রাজি নয় ইসরায়েল। কারণ তার পেছনে আছে কর্তৃত্বপরায়ণ এক আগ্রাসী জাত্যাভিমান। ইসরায়েলে শান্তিবাদী মানুষের অভাব নেই। গত বছর হাইফাতে অনুষ্ঠিত দারবিশের কবিতা পাঠের অনুষ্ঠানে এমন দু’হাজার শান্তিবাদী মানুষ সমবেত হয়েছিলেন যারা মনে করেন শান্তির সুবাতাস সেখানে বইবেই। হয়ত পৃথিবী অপেক্ষা করেছিল দারবিশের জন্য। যার কথা, গান আর শব্দ প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরছে ফিলিস্তিনের রাস্তায় রাস্তায়।

… আমি হাঁটছিলাম, যেন আমি অন্য কেউ
আমার ক্ষতস্থানে ফুটেছিল একটা সাদা গোলাপ
আর আমার দুই বাহু বুকের মধ্যে পৃথিবীটাকে চেপে উড়ছিল
আমি হাঁটছিলাম না, উড়ছিলাম
অন্য কেউতে পরিণত হয়েছিলাম আমি
রূপান্তরিত
না ছিল সময় না স্থান
কিন্তু আমি ভাবলাম
একা তারপর
একজন সৈনিক চিৎকার ছুড়ে দিল
আবারো তুমি? তোমাকে কী আমি হত্যা করিনি?
আমি বললাম, তুমি আমাকে হত্যা করেছে …
কিন্তু আমি ভুলে গেছি
তোমারই মত
ভুলে গেছি এই কথা
যে একদিন আমারও মৃত্যু হবে।

মাহমুদ দারবিশ : জেরুজালেম

প্রাসঙ্গিক অন্যত্র: এখানে দেখুন।

Site Default

চট্টগ্রামে বসবাসরত। পেশা : লেখালেখি। জীবিকা : সাংবাদিকতা।

১৩ comments

  1. সৈয়দ তাজরুল হোসেন - ২৯ সেপ্টেম্বর ২০০৮ (৩:২৪ অপরাহ্ণ)

    মাহমুদ দারবীশকে নিয়ে চমৎকার এই লেখাটির জন্য ধন্যবাদ আহমেদ মুনিরকে । অনেক দিন থেকে মনে মনে আপনাকে খুঁজছিলাম নির্মাণে । এখন থেকে আপনাকে আরেকটু নিয়মিত পাওয়ার আশা কি আমরা করতে পারি?

  2. সৈকত আচার্য - ২ অক্টোবর ২০০৮ (১০:০৬ অপরাহ্ণ)

    মাহমুদ দারবিশের স্মরনে এই লিখাটি সুলিখিত। আমার মনে হয়, তিনি শুধু প্যালেষ্টানীদের কবি নন, তিনি সারা বিশ্বের স্বাধীনতাকামী মানুষের একজন প্রতিনিধি, একজন যোদ্ধা, বিশেষ করে দুনিয়ার দেশে দেশে যাঁরা আত্ননিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্টার জন্য লড়াই করে চলেছেন।

    আমাদের দেশ স্বাধীন হয়েছে ৩৭ বছর। একটা ভুখন্ড পেয়েছিলাম। নিজেদেরকে আমরা নিজেরা শাসন করবো, গনতন্ত্র চালু থাকবে ও প্রেকটিস হবে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে এই আশা করতে পারি না এখন। কোথাও একটা খটকা লাগে ইদানীং। এই খটকা আরো বেশী লাগে যখন দেখি তিন মাস চলে যাওয়ার পরও কোন এক ফকরুদ্দিন নিজেকে চীফ এডভাইজার দাবী করেন। বছরের পর বছর। আমিতো দেশের শাসনতন্ত্রের কোথাও এরকম বিধান পাইনি খুঁজে। তাহলে কারা এখন রাষ্ট্র ক্ষমতায়? এরা কি অনুপ্রবেশকারি না দুস্কৃতিকারী । এই প্রশ্ন আমাকে নিয়ে যায় মাহমুদ দারবিশের কাছে। আমরা যাদের ম্যান্ডেট দিই নাই তারা আমাদের রাষ্ট্র চালাচ্ছে? কি ভাবে? কোন অধিকারে? তাহলে গনতন্ত্র কি ডাকাতি হয়ে গেল?

    মাহমুদ দারবিশ গনতন্ত্রের জন্য লড়েছিলেন। শিখিয়ে গিয়েছিলেন, কি ভাবে বর্বর মিলিটারী জান্তা’র বিরুদ্ধে লড়ে যেতে হয়। আমরা গনতন্ত্র প্রেমিরা তাঁর যোগ্য উত্তরসূরী হতে চাই। সেই শক্তিতে বলীয়ান হতে চাই। এই দেশে এখন তার বড়ই প্রয়োজন।

  3. রায়হান রশিদ - ৭ অক্টোবর ২০০৮ (৩:৫৪ অপরাহ্ণ)

    মাহমুদ দারবিশকে নিয়ে বাংলায় আমার পড়া শ্রেষ্ঠ লেখা। কবিতার অনুবাদগুলো যদি লেখকের হয়ে থাকে (উল্লেখ করা হয়নি, তাই বুঝতে পারছিনা), সেগুলোও আমার পড়া শ্রেষ্ঠ। রেজাউল করিম সুমন প্রস্তাবিত অনুবাদ সংকলনটির জন্য আমরা দারবিশের আরো কিছু কবিতা পেয়ে গেলাম, ভাবতেই ভাল লাগছে।
    ধন্যবাদ মুনির। এমন লেখা আরো চাই।

    • আহমেদ মুনির - ৮ অক্টোবর ২০০৮ (১১:১৫ পূর্বাহ্ণ)

      ধন্যবাদ রায়হান,কবিতাগুলো আমারই অনুবাদ। তবে নেটে দারবিশের খুব বেশি কবিতা পেলাম না। যাও পেলাম তার সবগুলো যে পূর্ণাঙ্গ তা মনে হলো না। বাড়াবাড়ি প্রশংসা চিরকালই করেছিস । আমার কোন লেখাটা তোর অসাধারণ মনে হয়নি?

      • জিফরান খালেদ - ৮ অক্টোবর ২০০৮ (৩:২০ অপরাহ্ণ)

        আমি আপনার যা যা লিখা পড়েছি, আমারো কিন্তু সবকটাকেই অসাধারণ মনে হয়েছে। মনে হয়না, রায়হান ভাই ভুল কিছু বলেছেন।

        চিটাগং থাকতে আপনার সাথে দেখা হয়নি মনে হয়। পরে, এইখানে এসে ধ্রুব হাসানের কাছে অনেক গল্প শুনি এবং উনি বোধহয় যোগাযোগের চেষ্টা চালান। হয়ে ওঠেনি আর।

        হাফিজ রশীদ খানের পত্রিকাটিতে আপনার একটা গদ্য ফর্ম্যাটে লিখা কবিতা ছিল। সেও বছর তিন চারেক হবে। আমার মাথায় ঐ কবিতা এখনো ঘোরে।

        ভাল থাকুন কবি। ভাল থাকুন অসাধারণ গল্পকার।

        আবারো বলি, রায়হান ভাই ভুল কিছু বলেননি।

  4. জিফরান খালেদ - ৮ অক্টোবর ২০০৮ (৩:৩১ অপরাহ্ণ)

    দারবিশের বেশ কিছু কবিতা আমার কাছে আছে। দরকার লাগলে পাঠানো সমস্যা হবে না।

    বেশ লাগলো লিখাটা। কবিতার অনুবাদো খুব ভাল লাগলো।

  5. রণদীপম বসু - ১১ অক্টোবর ২০০৮ (৮:২৬ পূর্বাহ্ণ)

    মাহমুদ দারবিশ’কে নিয়ে অসম্ভব সুন্দর লেখা ! আর এতো ঝরঝরে আবেগমাখা অনুবাদ খুবই ভালো লেগেছে।
    ধন্যবাদ আহমেদ মুনির। এরকম লেখা আরো চাই।

  6. আহমেদ মুনির - ১২ অক্টোবর ২০০৮ (১২:০০ অপরাহ্ণ)

    ধন্যবাদ জিফরান এবং রণদীপম বসুকে। জিফরান দারবিশের কিছু কবিতা পাঠাতে পারেন। আপনাদের উৎসাহে আগামিতে হয়ত আরো কিছু লিখবো।

  7. রেজাউল করিম সুমন - ১৬ অক্টোবর ২০০৮ (৫:৫১ অপরাহ্ণ)

    খুবই ভালো লাগল তোমার লেখাটা।
    মাহমুদ দারবিশের কিছু কবিতা আমার কাছেও আছে। তুমি অনুবাদ করলে ভালো হয়।

    ভালো কথা, আজ বেশ অনেকটা সময় কাটল কবি শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে!

  8. স্নিগ্ধা - ৬ জানুয়ারি ২০০৯ (৪:৪৪ পূর্বাহ্ণ)

    চমৎকার লেখাটা আগে কিভাবে যেন চোখ এড়িয়ে গেছিলো! আজকে, খবরে গাযার লালরঙ্গা আকাশ দেখতে দেখতে এটা পড়লাম আর মাহমুদ দারবিশের ফিলিস্তিনের জন্য আবারও কষ্টে মূক হয়ে গেলাম!

    • আহমেদ মুনির - ৬ জানুয়ারি ২০০৯ (১০:২১ পূর্বাহ্ণ)

      ধন্যবাদ স্নিগ্ধা ।

  9. তারেক রহিম - ৪ এপ্রিল ২০০৯ (১:২১ পূর্বাহ্ণ)

    খুব ভালো লাগলো লেখাটা।
    ভালো লাগলো আপনাকে এখানে দেখেও।

  10. ফারুক ওয়াসিফ - ২৯ ডিসেম্বর ২০০৯ (১২:২৮ পূর্বাহ্ণ)

    বিলম্বে পড়া অপরাধ না আত্মপ্রবঞ্চনা সেটা ভাবছি। এ লেখার অভাব ছিল, অনেকটা মিটলো। মনে হচ্ছে সুমনের প্রস্তাব সত্যি হচ্ছে।

    লেখার ভেতরে কবিতার অনুবাদ, দারুণ। সময় নিয়ে হলেও আরো কিছু করুন না।

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.