প্রিয় শহরে সতেরো বছর পরে
ট্রেন এসে থামল কাউলুনের হোংহাম স্টেশনে। প্রাচ্যের এক আধুনিক শহরের প্রাণকেন্দ্রে। ইমিগ্রেশনের ঝামেলা মিটিয়ে বাইরে এসে দেখা পেলাম শ্বেতশুভ্র কেশের মক ভাইয়ের। আমাকে রিসিভ করার জন্য অপেক্ষা করছেন। এই সুযোগে মক ভাইয়ের পরিচয়টা দেয়া যাক। পুরো নাম মক চিউ ইউ, আমার অগ্রজ নাট্যজন মামুনুর রশীদের বিশেষ বন্ধু, বঙ্গপ্রেমিক। সেই ১৯৯১ সাল থেকে বাংলাদেশে আসা যাওয়া, বাংলাদেশের সাথে নাটক বিষয়ক বিস্তর আদান-প্রদান করেছেন। নিজের নাটকের দল আছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকবার বাংলাদেশে ঘুরে এসেছেন। আমাকে ছোট ভাইয়ের মতো দেখেন, আর ম্যান্ডারিন চাইনিজ বলতে পারি বলে তাঁর কাছ থেকে পাই আলাদা একটা কদর। এই মক ভাইয়ের উদ্যোগেই এবার প্রদর্শনীর আয়োজন এবং সুদূর বেইজিং থেকে হংকং অভিমুখে চলে আসা।
মক ভাইয়ের সাথে শেষ দেখা হয়েছিল কয়েক বছর আগে যখন তিনি বাংলাদেশে গিয়েছিলেন মামুন ভাইয়ের সাথে যৌথ উদ্যোগে একটি ছবির চিত্রায়ণ উপলক্ষে। তখন পুরো টিমকে আমার বাসায় দাওয়াত করে খাইয়েছিলাম। মক ভাই এতদিন পরে আমাকে দেখে জড়িয়ে ধরলেন। শুভ্র কেশের মক ভাই সেই আগের মতোই আছেন। সমস্ত চুল সাদা হয়ে গেছে অনেক আগে থেকেই। বয়স ষাটের কোঠায়, তবে চুল সব সাদা হয়ে গেছে। রেশম-সাদা ধবধবে চুল মক ভাইকে আলাদা এক ব্যক্তিত্ব এনে দিয়েছে। মালপত্র নিয়ে তাঁর সাথে ট্যাক্সিতে উঠে যাত্রা করলাম তাঁদের সিসিসিডি অফিস অভিমুখে। সিসিসিডি অফিসটি মূলত একটি জনকল্যাণমূলক সংগঠন, কমিউনিটি সাংস্কৃতিক উন্নয়নে কাজ করেন। মক ভাইদের এই সংগঠনটিই আমার ছাপচিত্র প্রদর্শনীর স্পন্সর।
ট্যাক্সিতে যেতে যেতে দেখছিলাম হংকং শহরটিকে নতুন করে। সেই আগের মতোই আছে, শুধু সময়ের ছায়া পড়েছে। আমার মধ্যে একটি অনুভূতি কাজ করে — যদি আমার পরিচিত কোনো জায়গায় অনেকদিন পরে আবার যাওয়া হয় তবে ছায়াগুলি অনেক বেশি গাঢ় মনে হয়, মনে হয় এখানে সময় জমা হয়ে আছে। রাস্তায় যেতে যেতে দেখছিলাম আর ভাবছিলাম, কী অদ্ভুত সুন্দরভাবে এই শহরটিকে এরা গড়ে তুলেছে! অল্প জায়গা, অথচ কী চমৎকার ভাবে ম্যানেজ করেছে! হংকং শহরটি বোধহয় স্পেস ম্যানেজমেন্টে পৃথিবীতে অদ্বিতীয়। আমার কাছে মাঝে মাঝে একে ম্যাচবক্স সিটি মনে হয়। শহরের ভিতর অজগরের মতো এঁকেবেঁকে কত রাস্তা যে চলে গেছে তার ইয়ত্তা নেই, কত যে উড়াল সেতু আর একতলা দোতলা রাস্তা।
বেইজিং-এর মতো শান্ত সুস্থির শহর থেকে এখানে এই ব্যস্ত শহরে এসে ধাতস্থ হতে একটু সময় লেগে যায়। এখানকার প্রধান বাহন দোতলা বাস। অদ্ভুত সুন্দর ডাবলডেকারগুলো পুরো শহর দাপিয়ে বেড়ায়। হংকং-এ যেহেতু জায়গা কম তাই সবকিছুর উপরদিকে ওঠার প্রবণতা; হাইরাইজ দালানগুলো তার প্রমাণ। পাশাপাশি দোতলা বাসগুলো তার সাথে তাল মিলিয়ে চলছে। যোগাযোগ ব্যবস্থায় হংকং অতুলনীয় — রাস্তায় ডাবলডেকার, মাটির তলে সাবওয়ে, আবার দুই যমজ শহর হংকং ও কাউলুনের মধ্যে ফেরি যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে; সমুদ্রের নীচে টানেল করে এপার ওপার বাস ও সাবওয়ে যাতায়াত অবাধ করা হয়েছে। দক্ষ ব্যবস্থাপনা ও প্রযুক্তির উন্নয়ন কাজে লাগিয়ে হংকং-এর যোগাযোগ ব্যবস্থা এমন এক জায়গায় পৌঁছেছে যে মাঝে মাঝে একে মিরাকল বলে মনে হয়। আফিমযুদ্ধে পরাজয়ের মাশুল হিসেবে হংকং আইল্যান্ড ও কাউলুন পেনিনসুলা অঞ্চলটি ব্রিটিশকে ইজারা দিতে হয়েছিল। তখন নাকি চীনের সম্রাট খুব হেসেছিলেন একচোট, এত জায়গা থাকতে ব্রিটিশদের চোখ পড়ল এরকম একটি জলা জায়গার দিকে! তখন হংকং এলাকাটিতে শুধু কিছু মত্স্যজীবীদের বাস ছিল, উন্নয়ন বলতে কিছু্ ছিলই না। তবে দূরদর্শী ব্রিটিশরা ঠিকই অনুধাবন করতে পেরেছিল এই জায়গাটির ভৌগোলিক গুরুত্ব, এটিকে একটি মুক্ত বন্দর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে একেবারে উন্নয়নের চরম শিখরে নিয়ে গেছে। এখন পৃথিবীর একটি বৃহত্তর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র হংকং।
১৯৯৭ সালে হংকং চীনের অধীনে চলে আসে, চীনারা বলে মূল ভূখণ্ডে ফিরে আসা। ট্যাক্সি ধীরে ধীরে গন্তব্যে চলে আসে। শেকিপ মেই জেলার শাথিন নামক জায়গাটিতে আমরা পৌঁছে যাই; এখানেই মক ভাইয়ের সিসিসিডির অফিস। আপাতত কিছুক্ষণ এখানেই কাটাতে হবে; তারপর চলে যাব আমার আবাসস্থলে। সিসিসিডি অফিসে আমাকে অভ্যর্থনা জানাল এলিজা, এরিখ, উইলসন এবং ওয়াং। এরা সবাই সিসিসিডির কর্মী। তবে সবাই হংকংবাসী চীনা, যদিও নামে সবাই ইংরেজ। চীনা নাম খুব খটমটে, বিদেশিদের জন্য মনে রাখা কঠিন; তাই সবার বিদেশি নাম, বাস্তবসম্মত ব্যবস্থা। জকি ক্লাব ক্রিয়েটিভ আর্ট সেন্টার ভবনের একটি সুপরিসর কক্ষে সিসিসিডির অফিস। এখানে জকি ক্লাব ক্রিয়েটিভ আর্ট সেন্টার সম্পর্কে একটু বলার অবকাশ রাখে। এটি চতুষ্কোণ আকৃতির বিশাল এক আটতলা ভবন — আগে ছিল কুটিরশিল্পের একটি বৃহদাকার কেন্দ্র, ভবনের ছোট ছোট রুমগুলোতে নানা প্রকারের পণ্য তৈরি হতো; পরবর্তীকালে, চীনের মূল ভুখণ্ডের সাথে হংকং-এর একীভবনের পরে, এই কারখানাগুলো চীনদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চলে যায় সস্তা শ্রমের সহজলভ্যতার কারণে। ধীরে ধীরে এই জায়গাটি পরিত্যক্ত হয়ে যায়। অতঃপর সরকারি ব্যবস্থাপনায় এবং হংকং জকি ক্লাবের আর্থিক সহায়তায় একটি শিল্পপল্লী (আর্টিস্ট ভিলেজ) হিসেবে গড়ে ওঠে — নানা মাধ্যমের শিল্পীরা এখানে স্টুডিও ভাড়া নিতে পারে সস্তায়। আর এখানকার একমাত্র গ্যালারি ‘নিউবার্গ আর্ট স্পেস’-এ অক্টোবরের তিরিশ তারিখ (২০০৯) আমার ছাপচিত্র প্রদর্শনী শুরু হবে। গ্যালারির মালিক মিশালে সজ্জন মহিলা, এর আগে বেইজিং গিয়ে আমার কাজ দেখে এসেছে।
মক ভাইয়ের অফিসে বসে কিছুক্ষণ আড্ডা দেয়া গেল। তাঁর সহকর্মীরা কোনো-না-কোনো সময়ে বাংলাদেশ ঘুরে এসেছে, তাই আড্ডার বিষয়বস্তু খুঁজে পেতে অসুবিধা হলো না। বাংলাদেশ, চীন এবং হংকং বিষয়ে বেশ কিছুক্ষণ আলাপচারিতা হলো; মূল বিষয় ছিল হংকং-এর পরিবর্তন। চীনের সঙ্গে একীভূত হওয়ায় তাদের অনেক সুবিধা হয়েছে, বহু হংকঙ্গিজ চীনের মূল ভূখণ্ডে তাদের কর্মক্ষেত্র খুজে পেয়েছে। অন্যদিকে, আগে হংকং ছিল চীনের জন্য পশ্চিমা দুনিয়ার গেটওয়ে, এখন আর সেটি নেই; পশ্চিমা দুনিয়া এখন সরাসরি চীনেই ঢুকে পড়েছে। তাতে তাদের ব্যাবসা কিছুটা কমে গেছে; তবে চীনাদের হাতে টাকা এসেছে। সেটিও হংকং-এর জন্য বয়ে এনেছে শুভ বার্তা। এই শহরের বড় বড় শপিং মল্-গুলো মূল ভূখণ্ডের চীনা ক্রেতারাই বাঁচিয়ে রেখেছে, বিশেষ করে মহামন্দার সময়ে, যখন পশ্চিমা দুনিয়াতে হাহাকার শুরু হয়েছিল। হংকং-এর আয়ের সিংহ ভাগের উত্স ট্যুরিজম ব্যবসা। চীনা ভূখণ্ডের বড়লোকরা প্রায়ই এখানে আসে বেড়ানো আর শপিং-এর উদ্যেশ্যে। আসলে চীনের উন্নতি সব হিসেবনিকেশ পালটে দিয়েছে। মূল ভূখণ্ডের চীনাদের এরা আগে ম্লেচ্ছ ভাবত, এখন তারাই এদের ভাগ্যনিয়ন্তা।
বিকেলের দিকে আমরা যাত্রা শুরু করলাম আমার থাকার জায়গা যেখানে ঠিক হয়েছে তার উদ্দেশ্যে। যেতে হবে অনেক পথ, কাউলুন থেকে হংকং-এর শেষ প্রান্তে। যথারীতি মক ভাই আমার সঙ্গী, আমাকে পৌঁছে দেবেন আমার সাময়িক আবাসস্থলে। আমার সমস্ত জিনিসপত্র নিয়ে উঠে পড়লাম দোতলা বাসে—বিলাসবহুল ঝকঝকে বাস। মানুষ নেই বললেই চলে; এসি-র বাতাস তাই একটু বেশিই লাগছিল। প্রায় দেড় ঘণ্টার পথ; বাস চলছিল একেবারে শহরের মাঝখান দিয়ে। সুসজ্জিত দোকানপাট শপিং মল্ সেই আগের মতোই ঝকঝক করছে। নাথান রোড আর মংকক হচ্ছে হংকং-এর প্রধানতম শপিং এলাকা, তার মাঝখানে সরু রাস্তা—সে-রাস্তা ধরেই গাড়ি যাচ্ছে। বড্ড স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ছিলাম। বার বার ফিরে যাচ্ছিলাম সেই সময়গুলোতে।
বেইজিং-এ ছাত্র থাকাকালীন বেশ কয়েকবারই আসা হয়েছিল হংকং-এ; তবে ১৯৮৯ সালের স্মৃতিটা যেন অন্যরকম। জুনের ৪ তারিখে থিয়ানানমেন স্কোয়ারে চীনের গণতন্ত্রপন্থী ছাত্র আন্দোলনের এক রক্তাক্ত পরিসমাপ্তি ঘটে। সেই সময়ে বেইজিং-এ আমরা পুরোদস্তুর ছাত্র। বেইজিং তখন থমথমে এক ভূতুড়ে শহর, যদিও সরকারি নিয়ন্ত্রণে খুব দ্রুতই সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে আসে। সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয় অনির্দিষ্ট কালের জন্য। আমাদের কেন যেন বেইজিং আর ভালো লাগছিল না। আমি আর হেলাল (বর্তমানে খ্যাতিমান এনিমেটর, তখন বেইজিং-এ ছাত্র) সিদ্ধান্ত নিলাম কিছুদিনের জন্য হংকং চলে যাব। তখন ব্রিটিশ হংকং, বাংলাদেশীদের জন্য পোর্টভিসার ব্যবস্থা খুব সহজ ছিল। হংকং-এ ঢোকার সময়ে তিনমাসের ভিসা দিয়ে দিত। দুটি উদ্দেশ্য নিয়ে হংকং অভিমুখে পাড়ি জমিয়েছিলাম—প্রথমত বেইজিং-এর ডিপ্রেস্ড্ অবস্থা থেকে মুক্তি লাভ আর দ্বিতীয়ত খণ্ডকালীন চাকুরি করে কিছু অর্থ উপার্জন। হংকং-এ পৌঁছেই দেখতে পেলাম পরিস্থিতি বেশ উত্তাল, বেইজিং-এর ঘটনার প্রতিবাদে সরব সবাই—চারিদিকে মিছিল মিটিং আর আন্দোলন। বেইজিং শান্ত হয়ে গেছে, কিন্তু হংকং তখনও উত্তাল। সর্বত্র হায় হায় রব, কারণ আর কয়েক বছর পরেই হংকং চীনের অধীনে চলে যাবে, তখন কী হবে তাদের! অনেকেই অন্য দেশের ইমিগ্রেশন নিয়ে চলে যাচ্ছে। ব্রিটিশ কর্তারা প্রচুর সংখ্যক লোককে ইমিগ্র্যান্ট করে নিচ্ছে। মানবাধিকারের দোহাই দিয়ে ব্রিটিশ মিত্র কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকা বেশ কিছু লোকের ইমিগ্রেশনের ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। ঠিক এইরকম একটি সময়ে আমরা হংকং গিয়ে পৌঁছলাম।
আমাদের বাস চলছে শহরের মাঝখান দিয়ে, মক ভাই আমার পাশে বসা। ভদ্রলোক চুপচাপ, বেশি কথা বলা তাঁর ধাতে নেই। এই সুযোগে আমি ভাবনার জগতে ডুবে যাই। সে-বার আমাদের পরিচয় হয়েছিল ডাইমন্ড ইউন নামে এক ভদ্রলোকের সাথে। পঞ্চাশোর্ধ বয়সের ডাইমন্ডের সাথে আমাদের পরিচয় হয়েছিল হারবারের পারে; আমরা বেইজিং থেকে এসেছি জেনে আরো আগ্রহী হয়েছিল আলাপ জমানোর ব্যাপারে। বেইজিং-এর বিস্তারিত খবরাখবর জেনে নিয়েছিল আমাদের কাছ থেকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ডাইমন্ডের সাথে ভাব জমে গিয়েছিল, ধীরে ধীরে আমাদের মূল লক্ষ্যের কথা তাঁকে জানাই, অর্থাৎ একটি চাকুরি। এ ব্যাপারে ডাইমন্ড আমাদের যথেষ্ট আশ্বাস দিলেন যে যেভাবেই হোক আমাদের একটি চাকুরি জোগাড় করে দেবেন। এরপর শুরু হলো ডাইমন্ড সহযোগে আমাদের চাকুরি খোঁজার অভিযান।
ভদ্রলোক প্রতিদিন সকাল সকাল হাজির হন আমাদের সাময়িক আবাসস্থল চুংকিং ম্যানশনে। তারপর বেরিয়ে পড়ি জনারণ্যে চাকুরির সন্ধানে। ডাইমন্ডের হাতে থাকত একটি পত্রিকা আর তাতে আমাদের জন্য সুইটেবল জব্গুলো লাল কালিতে দাগানো থাকত। অনেক জায়গাতেই চাকুরি খোঁজা হলো—কখনো টেলিফোনে, কখনো সশরীরে হাজির হয়ে। কিন্তু সব চেষ্টাই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হচ্ছে। আমাদের চাকুরি না হওয়ার পেছনে দুটি কারণ ছিল—প্রথমত হংকং-এর আইডি কার্ড না-থাকা, দ্বিতীয়ত ক্যান্টনিজ ভাষা না-জানা। তবে ডাইমন্ড নাছোড়বান্দা, যেভাবেই হোক আমাদের চাকুরি যোগাড় করে দেবেনই। এরপর প্রতিদিন ডাইমন্ড তাঁর কাজকর্ম বাদ দিয়ে আমাদের সাথে নিয়ে চাকুরি খোঁজা অভিযানে বেরিয়ে পড়লেন। আমি আর হেলাল ভাবি, ডাইমন্ডের কী স্বার্থ আছে যে আমাদের এই দুই বঙ্গসন্তানের জন্য প্রাণাতিপাত করছে? পৃথিবীতে এমন মানুষও আছে! ভেবে ভেবে কূলকিনারা পাই না। যাই হোক, ডাইমন্ড একদিন সকাল সকাল হাজির হলেন এবং বেশ প্রসন্ন চিত্তে ঘোষণা করলেন যে আমাদের চাকুরি হয়ে গেছে, আর সেই সাথে থাকার ব্যবস্থাও। আমাদের আর চুংকিং ম্যানশনে কড়ি গুনতে হবে না! তবে কাজের ধরন শুনে কিছুটা চুপসে গেলাম। একটি বহুতল অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের প্রতিটি দরজার সামনে পলিথিন ব্যাগে রেখে দেয়া ময়লা সংগ্রহ করে তা বড় গার্বেজে ফেলে দিতে হবে! ডাইমন্ড আমাদের খুব উত্সাহ দিল, আপাতত এটাই শুরু করে দাও, পরে আরো ভালো কাজ জোগাড় করে দেয়া যাবে। আমরা সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে আমাদের বাক্সপেটরা নিয়ে ডাইমন্ডের সাথে বেরিয়ে পড়লাম। জায়গাটি নিউ টেরিটোরির একটি হাউজিং। নতুন আবাসস্থলে আমাদের জিনিসপত্র রেখে আমাদের নতুন কাজের ট্রায়াল দিতে রওয়ানা হলাম। দরোজার সামনের পলিথিন ব্যাগগুলো একে একে তুলে একটি এক-চাকার ট্রলিতে ঠেলতে ঠেলতে নীচে মূল গার্বেজে ফেলে দিতে হবে। দু-এয়েকটি পলি-ব্যাগ তুলতেই নাকে ভেসে এল উটকো দুর্গন্ধ। আর এগোতে পারলাম না। আমরা জানি বিদেশে এসে সবাই অড্ জব্ করে, কিন্তু এই কাজটি আমদের জন্য একটু বেশিই অড্ হয়ে গিয়েছিল। আমাদের আর চাকুরি করা হলো না। ডাইমন্ড অবশ্য কিছু মনে করল না। চাকুরি করলেও আমাদের থাকার জায়গাটি রয়ে গেল। বাকি যে-কয়দিন আমরা হংকং-এ থাকব এখানেই থাকা যাবে, এটিও আমাদের জন্য মহার্ঘ।
বেশ কিছুদিন এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরি করে যখন ট্যাঁকে টান পড়ল তখন আবার হংকং থেকে বেইজিং-এ ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে মনঃস্থির করলাম। যাওয়ার একদিন আগে ডাইমন্ড এসে হাজির; আমাদের জন্য তেমন কিছু করতে পারল না বলে খুব আফসোস করল। তবে এতদিনে ডাইমন্ডের আসল উদ্দেশ্য পরিষ্কার হলো, এবং তা যে খারাপ কিছু তাও নয়। তাঁর এই বয়সে বিরহ আর ভালো লাগছে না, স্ত্রীর সাথে ডিভোর্স হয়ে গেছে অনেকদিন, একা একা আর কতদিন থাকা যায়! তিনি আবার বিয়ে করতে চান। তাই আমাদেরকে চীনদেশ থেকে একজন পাত্রী জোগাড় করে দিতে হবে। অতঃপর আমাদের হাতে তাঁর সুদৃশ্য ছবিসহ একটি বায়োডাটা ধরিয়ে দিলেন। তখন চীনদেশ থেকে পাত্রী জোগাড় করা বেশ একটা রেওয়াজে পরিণত হয়েছিল; আর চীনা রমণীরাও বাইরে বেরোনো্র জন্য তখন ছিল উন্মুখ। আমরা বেইজিং-এ ফিরে গিয়ে ডাইমন্ডের জন্য পাত্রী সংগ্রহের কিছুটা চেষ্টাও করেছিলাম, তবে আমাদের সেই কচি বয়সের ঘটকালিতে তেমন সফল হতে পারিনি।
সেই দেড় যুগ আগের ঘটনাগুলো যেন মন্তাজচিত্রের মতো মনের আয়নায় ভিড় করছে। এরকম নানা সাতপাঁচ ভাবছিলাম, আর এর মধ্যেই আমরা হারবারের টানেলের মুখে এসে পড়লাম। এখানে বাস চেঞ্জ করতে হবে। আবার জিনিসপত্র সমেত নেমে পড়লাম। এখানে সব গাড়ি ওপারে যায় না। তবে যে-বাসে আমরা টানেলের ভিতর দিয়ে হারবার পাড়ি দেব তার ভাড়া একটু বেশিই। আবার একটি দোতলা বাসে ওঠা গেল। বাসটি টানেল পেরিয়ে আমাদের মূল লক্ষ্য আপ-লেই-ছাউ-এর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিল। হংকং-এর এ এলাকাটি একটু নিরিবিলি—বাস ধীরে ধীরে পাহাড়ের দিকে উঠে যাচ্ছে, দু-পাশে বাড়িঘর আর পাহাড়ের উপর থেকে সমুদ্র দেখা যাচ্ছে। মক ভাই আমাকে দূরে একটি বিশালাকৃতির জাহাজ দেখালেন, যা আসলে খুবই নামকরা একটি ভাসমান রেস্তোরাঁ। প্রায় এক ঘণ্টা ভ্রমণের পর বাস আপ-লেই-ছাউ স্টেশনে এসে পৌঁছল। এটি একটি আবাসিক এলাকা, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জন্য সরকারি উদ্যোগের হাউজিং। অনেকগুলো হাইরাইজ দালান। এখানেই একটি অ্যাপার্টমেন্টে আমার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। এটি মকচাই নামে আরেক বন্ধুর খালি অ্যাপার্টমেন্ট। এখানেই মকচাই অপেক্ষা করছে আমাকে চাবি বুঝিয়ে দেয়ার জন্য। অনেকদিন পর মকচাইয়ের সাথে দেখা হলো। মকচাইয়ের সদ্য স্বামী বিয়োগ ঘটেছে। তার স্বামী ফু লৌপিং ছিল আমাদের খুব কাছের মানুষ। মকচাই এবং ফু অনেকবার বাংলাদেশে গিয়েছে। ফু ছিল তুখোড় অভিনেতা, অতিরিক্ত ধূমপান আর মদ্যপানের ফলে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে অকালে ঝরে যেতে হলো তাকে—অন্তত স্ত্রী মকচাই তা-ই মনে করে। মামুন ভাইয়ের অত্যন্ত প্রিয় মানুষ। মৃত্যুশয্যায় ফু-কে দেখতে মামুন ভাই সুদূর বাংলাদেশ থেকে ছুটে এসেছিলেন।
ফু মারা যাওয়ায় মকচাইকে বড্ড নিঃসঙ্গ মনে হচ্ছে। ফু আর মকচাই বাংলাদেশে গিয়ে আমার স্টুডিওতে গিয়েছিল, আমার আঁকা দুটি ছবি ওদের উপহার দিয়েছিলাম। ছবি দুটি এখনো পরম যত্নে ওদের দেয়ালে ঝুলিয়ে রেখেছে। কিছুক্ষণ আলাপচারিতার পরে মক ভাই আমাকে মকচাইয়ের হাতে সঁপে দিয়ে বিদায় হলেন। মকচাই আমাকে তার ঘরের সবকিছু ঘুরিয়ে দেখিয়ে আমার জন্য নির্ধারিত ঘরের চাবি বুঝিয়ে দিল, আমাকে ডিনারে আমন্ত্রণ জানাল। আমরা হাউজিং এলাকার ভিতরেই একটি রেস্তোরাঁয় গিয়ে বসলাম। খেতে খেতে ফু-র কথাই ঘুরে ফিরে আসল। হংকং-এ এসেছি অথচ ফু নেই—ভাবতেই বুকের ভিতরটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠল। আহা কী দরাজদিল মানুষ ছিল ফু। ‘ক্লাব সিক্সটিফোর’ নামের একটি বারের বারটেন্ডার ছিল। হংকং-এ এলে প্রায়ই যাওয়া হতো সেখানে। যাওয়ার সাথে সাথে এক জাম্বো সাইজের মগে করে বিয়ার এনে দিত আমার সামনে, খেতেই হতো। আর নানা কিছু বলার চেষ্টা করত। সে ভালো ম্যান্ডারিন বলতে পারত না, আকার-ইঙ্গিতে আমাকে বুঝে নিতে হতো। মামুন ভাই নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে হংকং পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশনের আমন্ত্রণে দুটি পথনাটকের নির্দেশনা দিতে হংকং এসেছিলেন। সফদর হাশমির লেখা নাটক দুটিতে ফু-র অভিনয় ছিল দুর্দান্ত। একটি নাটকে পুলিশ চরিত্রে ফু অনবদ্য অভিনয় করেছিল; আমার চোখের সামনে লাঠি হাতে শ্রমিক ঠ্যাঙানো সেই পুলিশের চরিত্রটি এখনো ভাসে।
মকচাইয়ের সাথে ডিনার সেরে আমি চলে এলাম আমার নতুন ডেরায়, আর মকচাই চলে গেল তার আস্তানায়। সেই বেইজিং থেকে আসার ধকল এবং হংকং-এ ও-প্রান্ত থেকে এ-প্রান্তে ছুটে আসা। বেশ ক্লান্তই হয়ে পড়েছিলাম। গরম স্নান সেরে দ্রুতই বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম।
(পাঁচ পর্বে সমাপ্য)
Have your say
You must be logged in to post a comment.
৯ comments
রায়হান রশিদ - ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১০ (১২:২৬ পূর্বাহ্ণ)
অসাধারণ অবজারভেশন।
সৈকত আচার্য - ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১০ (৩:৫৫ অপরাহ্ণ)
পঞ্চাশোর্ধ ডাইমন্ডের আসল উদ্দেশ্যটা পড়ে বেশ মজা পেলাম। তাও মন্দ কি! সে তার উদ্দেশ্য পূরনের এতটুকু আশায় আপনাদের জন্য একটা চাকুরী জোটানোর চেষ্টায় প্রাণাতিপাত করে করেছে। চাকুরি জুটিয়ে তবেই কিনা ক্ষান্ত দিয়েছে। হোক না, সেটা ময়লা ফেলার কাজ। বিদেশের মাটিতে একটা সময় পর্যন্ত এগুলোই তো নগদ নারায়নের দেখা মিলবার একমাত্র সুযোগ।
কিন্ত বেচারা ডাইমন্ডের জন্য আপনাদের “কিছুটা চেষ্টা” ঘটকালির ব্যর্থতার অনিবার্য কারন। ডাইমন্ডের মতো হণ্যে হয়ে খুঁজলে, নিশ্চয় মিলে যেতো একজন চায়নীজ পাত্রী! আপনাদের এই ব্যর্থতা তাকে কোন পীড়া দিয়েছিল কিনা জানি না, তবে এই ডাইমন্ড চরিত্র জায়গা করে নিয়েছে আমাদের মনে এবং আপনাদের এই ব্যর্থতা আমাদের পীড়া দিয়েছে।।
বাকী পর্বগুলো পড়ার অপেক্ষায় থাকলাম। দারুন এই স্মৃতিকথন শুরু করার জন্য আপনাকে অভিনন্দন।
রশীদ আমিন - ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১০ (৬:৩৯ পূর্বাহ্ণ)
ধন্যবাদ সৈকতদা, আপনার রসঘন ইন্টারেস্টিং মন্তব্যের জন্য। আপনি ঠিকই বলেছেন, ডাইমন্ডের ঋণ শোধের জন্য আমাদের আপ্রাণ চেষ্টা করা উচিত ছিল। তখন আমাদের বৃত্ত ছিল খুবই সীমিত। আমরা পারিনি, তবে ডাইমন্ডকে স্মরণ করি সবসময়। সত্যি তার কাছে চিরঋণী হয়ে আছি।
আলম খোরশেদ - ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১০ (১১:৫২ পূর্বাহ্ণ)
রশীদ আমিন, তোমার এই চিত্ররূপময় অনবদ্য ভ্রমণাখ্যানটি পড়ে বিমলানন্দ অনুভব করছি। তোমাকে অভিনন্দন।
আলম খোরশেদ, বিশদ বাঙলা, চট্টগ্রাম
রশীদ আমিন - ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১০ (৬:২৬ পূর্বাহ্ণ)
ধন্যবাদ আলম খোরশেদ ভাই, আপনার সুন্দর মন্তব্যে আমি অনুপ্রাণিত বোধ করছি।
নীড় সন্ধানী - ৭ অক্টোবর ২০১০ (৫:৪৬ অপরাহ্ণ)
হংকং এর ভাষা কি ক্যান্টনিজ নাকি? এখানে মান্দারিন চলে না? চাইনিজ ভাষা শিখতে চাই আগামী দুনিয়া নাকি চাইনীজরা শাসন করবে। আপনার এই পর্বটা দারুণ লাগলো।
রশীদ আমিন - ৮ অক্টোবর ২০১০ (৭:৫৭ পূর্বাহ্ণ)
হ্যাঁ, হংকং-এ ক্যান্টনিজ প্রচলিত। তবে হংকং চীনা মূল ভূখণ্ডে ফিরে আসার পর এখানে মান্দারিন শেখার একটা প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। আপনি রেডিও চায়না-তে চীনা ভাষা শেখার অনুষ্ঠান নিয়মিত শুনতে পারেন। চীনারাও এখন সমস্ত পৃথিবীকে চীনা ভাষা শেখানোর জন্য উঠে পড়ে লেগেছে।
Pingback: মুক্তাঙ্গন | বেইজিং থেকে হংকং : পর্ব ৪ | রশীদ আমিন
Pingback: মুক্তাঙ্গন | বেইজিং থেকে হংকং : পর্ব ৫ | রশীদ আমিন