শান্তির খোঁজে পর্বতে — শেষ পর্ব

১ম ও ২য় পর্বের পর দুই দলে ভাগ হয়ে গেছি আমরা। পাঁচ-পাঁচ করে। টিম এ আর টিম বি। প্রথম দলে আমি, সাগর ভাই, তন্ময়, বসন্তদা আর বিশ্বদা। টিম বি আমাদের ব্যাকআপ টিম হিসেবে কাজ করবে। তাই আজ আমাদের সাথে তারা আসলেও লোড রেখে আবার ফিরে যাবে বেস-ক্যাম্পে। আমরা থেকে যাব। বেশ পরিষ্কার আবহাওয়ার মধ্যে ক্যাম্প ১-এর তাঁবুগুলো দেখতে পেলাম কিছুটা আগে থেকেই। [...]

১ম২য় পর্বের পর

ক্যাম্প ১ (৪৪৮৫)

দুই দলে ভাগ হয়ে গেছি আমরা। পাঁচ-পাঁচ করে। টিম এ আর টিম বি। প্রথম দলে আমি, সাগর ভাই, তন্ময়, বসন্তদা আর বিশ্বদা। টিম বি আমাদের ব্যাকআপ টিম হিসেবে কাজ করবে। তাই আজ আমাদের সাথে তারা আসলেও লোড রেখে আবার ফিরে যাবে বেস-ক্যাম্পে। আমরা থেকে যাব। বেশ পরিষ্কার আবহাওয়ার মধ্যে ক্যাম্প ১-এর তাঁবুগুলো দেখতে পেলাম কিছুটা আগে থেকেই। শেরপারা আমাদের আগেই রওনা হয়েছিল আমাদের এই বাড়তি সুবিধাটুকু দেয়ার জন্য। কারণ যদি তুষারপাত শুরু হয়ে যেত তবে তার মধ্যে তাঁবু খাটানোটা বেশ কঠিনই হয়ে পড়ত।

মালপত্র গুছিয়ে রাখার পর আর হাতে কোনো কাজ নেই। রান্নার কাজে সাহায্য করার নামে কিচেন শেডের বাড়তি গরমটুকু পাওয়ার জন্য খুব বেশি হলে মাটি থেকে চার ফুট উঁচু শেডের নীচে গাদাগাদি করে বসে থাকা। খাওয়ার পর তাঁবুতে। তুষারপাত শুরু হয়ে গেছে। চাইলেও আর বাইরে থাকার জো নাই। দেখতে দেখতে কালচে হলুদ রঙের পাথরগুলোর উপর শুভ্র বরফের কুচি পুরো পরিবেশটাকে পাল্টে দিল নিমিষেই। দুপুর গড়িয়ে বিকেল। যেন থামতেই চায় না। স্লিপিং ব্যাগে গুটিশুটি মেরে বসে থাকা আর ডায়েরির পাতা ভরানোই যেন জগতের একমাত্র কাজ। সাগর ভাই তার বিখ্যাত লাল রঙের ট্রাউজারটা মেরামতে ব্যস্ত। সুঁইয়ে সুতা পরাতে গিয়েই ঘাম ঝরার উপক্রম।

উচ্চতার সাথে মানিয়ে নেয়ার জন্যই এখানে থাকা । ধীরে ধীরে উচ্চতা অতিক্রম করা পর্বতারোহণে বাধ্যতামূলক। মাত্র তিনটা টেন্ট। তাই প্রথমবারের মতো বেশ ফাঁকা ফাঁকা লাগল। কেননা এখন পর্যন্ত সবাই একসাথেই ছিলাম। এখানেই প্রথম। রাত নামার পর একটু করে বের হলাম সবাই। চাঁদের ঈষৎ নীলাভ আলোয় পরিবেশটা কেমন ভূতুড়ে মনে হলো। দিনের চেনা আলোয় দেখা আর এখনকার পরিবেশ যেন খুব অচেনা। হাড় কামড়ানো ঠাণ্ডা! বেশিক্ষণ বাইরে টিকতে পারলাম না কেউ। খাবার নিয়ে তাঁবুতে ঢুকে গেলাম। গরম জলের বোতলটাকে ভালো করে মুছে স্লিপিং ব্যাগের উষ্ণতা বাড়ানোর জন্য ভিতরে ঢুকিয়ে দিলাম। প্রতিদিনের নিয়ম এটা। অন্তত কিছুক্ষণ তো এর উষ্ণতা উপভোগ করা যাবে। এতে অবশ্য আরেকটা উপকার হয়; সকালে সাধারণ তাপমাত্রার এক বোতল পানি পাওয়া যায়। কারণ তাঁবুর ভিতরের রাখলেও সেই পানি সকালবেলায় পানের উপযোগী থাকে না।

শিখর খোঁজার তাড়া: দ্য বটল নেক

শিখর খোঁজার তাড়া: দ্য বটল নেক

ক্যাম্প ১ (৪৪৮৫) ২য় দিন

রাতে ঘুম হয়নি বললেই চলে। আজেবাজে স্বপ্নে আর এপাশ-ওপাশ করেই কেটেছে রাতটা। যখনই সাগর ভাইকে ডাকতাম উনিও উত্তর দিতেন, কখনো সাথে সাথে কখনো-বা খানিক বাদে। উনারও যে ঘুমে সমস্যা হয়েছে তা সকালেই বোঝা গেল। কেউই উঠতে পারলাম না আটটার আগে। আজ আবার লোড ফেরি। ক্যাম্প ২-এ যাব আমরা। মোট আট জন। আমরা পাঁচ আর তিন জন শেরপা। টিম বি আজ ক্যাম্প ১-এ আসবে। সকালে ওয়াকিটকিতে যোগাযোগ করে এটাই জানা গেছে। কিন্তু এমন তুষার পড়েছে যে দলনেতা বসন্তদা বেলা খানিকটা না চড়লে এপথে আসতে নিষেধ করে দিয়েছেন।

দশটার দিকে রওনা হলাম আমরা। রীজের শেষ মাথা থেকে ওয়েস্ট গ্লেসিয়ারের স্নাউটটা দেখা গেল। তার ঠিক সামনেই বিশাল ফাঁকা জায়গা। কয়েক কদম দিতে না দিতেই বরফের খাঁজে পা আটকে গেল। বেশ খানিকটা উচ্চতা উৎরাতে হবে আজ। গতকালের আলোচনায় এটাই ঠিক করা হয় যে, আমরা মুটামোটি ৫০০০ মিটারের কাছাকাছি কোথাও ক্যাম্প করব। সে হিসেবে উঠতে হবে প্রায় ৬০০ মিটারের কাছাকাছি।

পথ সেই আগের মতোই। শুরু ও পথটুকু সমতল এ কারণে যে, ওয়েস্ট গ্লেসিয়ার থেকে যে জলধারাগুলো নেমে আসছে সেগুলো বেশ বড় একটা সমতল এলাকাকে প্লাবিত করেছে। আর গতরাতের ও আজ সকালের বরফে ঢাকা-পড়া পুরো এলাকাটাকে বিশাল একটা মাঠ বলে মনে হচ্ছে। এই পথেই কেটে গেল প্রায় ৩০ মিনিট। সামান্য বামদিকে বাঁক নিয়ে গ্লেসিয়ার ধরে এগোতে থাকলাম। মোরেইন আর বোল্ডারে ভরা পুরো এলাকা। বরফ পড়াতে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ রূপ ধারণ করল। ঠিকভাবে পা না ফেললে দুই পাথরের ফাঁকে পা আটকে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। এক লাইনে সবাই। শেরপা ঠেনদিব সবার আগে। এলোমেলো পথে কখনো উঠে, কখনো নেমে ওয়েস্ট গ্লেসিয়ার এ রীজের প্রায় মাঝামাঝিতে চলে এলাম আমরা। ভাগ্য বেশ খারাপ বলতে হয়; ঝকঝকে সুন্দর সকালটা হঠাৎই বদলে গেল। তুষারপাতের পূর্বাভাসে কালো মেঘ আটকে গেছে প্রায় চারদিকে। খানিক বাদেই পথের মাঝেই ঝড়। তবে লুকানোর কোনো জায়গা পাওয়া গেল না, কিছুক্ষণ বড় পাথরের আড়ালে থাকলেও পথ হারাবার ভয়ে বেরিয়ে এলাম। কেননা নতুন বরফে পায়ের ছাপগুলো হারিয়ে গেলে আর এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না। আট জনের দল হলেও প্রথম আর শেষজনকে কখনোই দেখা যেত না তাদের হাঁটার গতির তারতম্যের জন্য। গুমোট আলোর মধ্যে বেশ দূরে শেরপা আর বসন্তদার অবয়ব চেনা গেল। ফেরি-করা লোডগুলো রাখা হয়েছে একটা পাথরের উপর। বুঝে গেলাম এখানেই শেষ। পৌঁছে মালপত্র রেখে দ্রুততার সাথেই যাওয়া শুরু করলাম। অত্যন্ত ঠাণ্ডা আর আবহাওয়া আরো খারাপ হয়ে যাওয়ার আগেই নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছানোটাই জরুরি হয়ে পড়ল। ক্যাম্প ১-এ ফিরে এলাম যখন তখন বেলা প্রায় ৩টা। বাড়তি একটা তাঁবু দেখে বুঝে গেলাম দেবাশিসদারা এসে পড়েছে।

ক্যাম্প ২ (৫০৩০)

সকাল সকালই রওনা হলাম সবাই। গত রাতে তন্ময় ছিল আমাদের সাথে। আজ সবাই মিলে রওনা হলাম। কিছুটা চেনা বলেই মনে হয় পথটাকেও ছোট মনে হলো কালকের চেয়ে। তিন তাঁবুতে আটজন। আজ শেরপারাই রান্নার কাজ করবে। দুপুরে পৌঁছানোর পর দেবাশিসদারা ফিরে গেল ক্যাম্প ১-এ। এখানে কাজের মধ্যে ছিল শরীরটাকে গরম রাখা। ভয়াবহ ঠাণ্ডা এখানে। যেসব জায়গায় আমরা ক্যাম্প করেছি তার মধ্যে এখানেই শীতের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি। রীজের দু-পাশই ঢালু হয়ে নেমে গেছে অনেকখানি। আমাদের তাঁবু ফেলার জায়গাটা বেশি হলে ২০ ফুটের মতো চওড়া হবে। সাদা বরফ ছাড়া সমতল বলে কোনো কিছু নেই। এবড়োখেবড়ো ভাবে মাঝে মাঝে কিছু বোল্ডার দেখা যায়।

দুপুরের খাবার শুধু ভাত আর বাটার! তবে চায়ের ব্যবস্থা করা গেল। তাঁবুতে বসে পরের দিনের কাজগুলো বুঝে নিয়ে চলে এলাম নিজের তাঁবুতে। স্লিপিং ব্যাগে ঢুকে আড্ডা দেয়া আর বাদাম খাওয়া ছাড়া তেমন কোনো কাজ করার ছিল না। কোনো বেলা খাবারের সমস্যা হলে কিংবা না খেতে ইচ্ছা করলে আমরা বেশ মজা করেই চীনা কিংবা কাজু বাদামের পোটলা নিয়ে বসতাম। কখনো খালি, কখনো-বা সরিষার তেল আর মুড়ির সাথে! মাঝে মাঝে দরজাটাকে একটু ফাঁক করে দেখে নেয়া হতো বাইরের কী অবস্থা। বিকেলের শেষ আলোয় বেরিয়ে এলাম বসন্তদার ডাকে — ইমরান, ও ই ই ম রা ন ন, দেখ ভারি সুন্দর একটা ওয়েদার। বের হতে ইচ্ছা না করলেও এই উচ্চতার সাথে মানিয়ে নেয়ার জন্য অবশ্যই বের হতে হবে। যত বেশি তাঁবুর বাইরে থাকা যায় ততই ভালো। এসব এলাকার মজা হলো সূর্য ডুবে যাওয়ার পরও আকাশ যদি পরিষ্কার থাকে তাহলে রাতের অনেকটা সময়ও ঝকঝকে থাকে। দেখতে দেখতে সাদা বরফগুলো একসময় নীলচে হয়ে গেল। দূরের চূড়াগুলো আঁধারে হারিয়ে গেল কিছুক্ষণের জন্য। চাঁদের আলোয় শৃঙ্গগুলোকে মনে হচ্ছিল বাতিঘর।

রাতের খাওয়া হলো ডিমে ঝুড়ি আর ভাত। বেশ। বেশ না, আসলে অসাধারণ। এই উচ্চতায় উচ্চতাজনিত কারণে খাওয়ার কোনো রুচিই থাকে না। গতানুগতিক খাওয়া তখন হয়ে যায় অসহ্য। তাই গরম ভাতের সাথে ডিমে ঝুড়ি আর সাথে ঘিয়ের মতো করে সরিষার তেল ছিটিয়ে খাওয়া।

ক্যাম্প ৩ লোড ফেরি (৫৩৭৮)

ক্যাম্প ৩-এর দিকে রওনা হতে হবে আজ। কেমন যেন দুরু দুরু করছে বুক। প্রায় কাছেই চলে এসেছি মকবুলে মকসুদ রুবল কাং শিখরের কাছাকাছি। মাত্র ক’টা দিন বাকি আর। দল বেঁধে লোড ফেরির জন্য বের হলাম। লোড ফেরি আর নতুন কোনো বিষয় নয় আমাদের জন্য। আর ভাগ্যিস উঠতি পথে এটাই শেষ। প্রথম দিকের বেশির ভাগ পথই প্রায় সমতল, মাঝে মাঝে ছোট-বড় কিছু হাম্প থাকলেও তেমন কঠিন কিছু ছিল না। পুবদিকে রুবাল কাং-কে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। উত্তরে পাশাপাশি হোয়াইট (সাদা) পিক আর ব্ল্যাক পিক। ব্ল্যাক পিকটা দেখতে একেবারে মাউন্ট এভারেস্টের নর্থ ফেসের মত। ভীষ রকম লম্বা এই প্রায়-সমতল পথ। একঘেয়েমি পেয়ে বসার আগেই শরীর নিংড়ে নেয়ার মতো চড়াই পেয়ে গেলাম সামনেই। কত হবে, ৫০ মিটার, ১০০ মিটার? নীচ থেকে বলাটা বেশ শক্ত। কেননা ৩০ থেকে ৪০ ডিগ্রি কোণে এগিয়ে যাওয়া ঢালটার শেষ কোথায় তা দেখা যাচ্ছিল না। নরম তুষারে ঊরু অবধি বসে যাচ্ছে। তাই সামনের জনের ফেলে যাওয়া পায়ের ছাপ ধরে এগিয়ে যাওয়াটাই সুবিধাজনক। মাঝে মাঝে অবশ্য সমস্যাও হয়। বার বার পা ফেলার কারণে নরম হয়ে যাওয়া বরফ শরীরের ভর ধরে রাখতে না পেরে নীচের দিকে ধ্বসে যায়। তখন কোমর অবধি বরফের মধ্যে অন্যের সাহায্য ছাড়া বেরিয়ে আসাটা একেবারেই অসম্ভব।

চড়াই ধরে এগিয়ে যাওয়ার সময় সামান্য উত্তরে বাঁক নিয়ে দেখলাম, পথ একটা বড় বোল্ডারে বাঁক নিয়ে আবার দক্ষিণদিকে বেঁকে গেছে। বাম পাশটা খাড়া উঁচু আর নরম পাথরে ভরা। বুঝে গেলাম ল্যান্ড স্লাইড প্রবণ এলাকা এটা। শরীরের শক্তি বলে কোনো কিছু আর অবশিষ্ট নেই। তবে থেমে যাওয়ারও কোনো উপায় নেই। পর্বতারোহণের মজাই এখানে — প্রথম পা ফেলার পর আর পিছিয়ে আসতে চায় না কেউই। বেশ চড়াইটা পার হয়ে এগিয়ে যেতেই চিরচেনা তাঁবুগুলোকে দেখে দারুণ লাগল। তবে বেশিক্ষণ না থেকেই আবার রওনা হলাম ক্যাম্প ২-এর দিকে।

প্রায় বিকেল, সূর্যের তেজ কমে গেছে বেশ খানিকক্ষণ আগে। কুক রামলালকে দেখলাম তাঁবুটাকে ফাক করে উনুনের উপর কিছু একটাকে নাড়াচাড়া করতে। পেটে ক্ষুধা, পরনে সারা দিনের ঘামে ভেজা কাপড়, অস্বস্তিকর এক অবস্থা। শরীর বিশ্রাম চায়; তাই খাওয়া শেষ করেই ঘুমিয়ে পড়লাম। কাল হবে আসল পরীক্ষা।

সামিট ক্যাম্প

সকালে রওনা হওয়ার পর তেমন একটা বেগ পেতে হয়নি আজ; কেননা গতকাল রাতে নতুন বরফ পড়াতে পথ বেশ শক্ত। মচমচ শব্দ করে এগিয়ে গেলাম। তাঁবুটাকে আরেকবার ঠিক করে নিলাম। কাপড় পালটে খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। কুকরা সবাই নীচে, শেরপারা থাকলেও রোপ ফিক্সিং করার কাজেই সবাই ব্যস্ত। এই হাড়-কাঁপানো ঠাণ্ডায় খাওয়ার রুচি না থাকলেও খেতে হবে। আজ রাতেই আমাদের সামিট পুশ! কত দিনের স্বপ্ন আমাদের, কত কষ্ট — সব কিছুর অবসান আর ঘণ্টা কয়েক পর।

ওটমিল, দুধ, চকোলেট আর বাদাম — এই ছিল খাবার। শেষে বসন্তদা এলেন আমাদেও তাঁবুতে। অনেক কথা হলো, কীভাবে কখন রওনা হব, কারা কারা যাব, কীভাবে যাব। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে, একটু পরই শুরু হবে রাত; অথচ ঘড়িতে সময় বেশি হয়নি। প্রথম দলে আমি, সাগর, তন্ময়, বসন্তদা, বিশ্ব আর দুজন শেরপা — ঠেন্ডিব আর পেমা। রাত ৩ টায় উঠতে হবে — এই বলে বসন্তদা চলে গেলেন নিজের তাঁবুতে।

ঘুমাতে পেরেছি কিনা জানি না। ধড়ফড় করে যা যা নেয়ার কথা, গায়ে জড়ানোর কথা, সবই করলাম। খাবার এল গরম দুধে কর্নফ্লেক্স। কোনো অনুভূতির সঞ্চার হলো না — না শরীরে, না মনে। কেমন যন্ত্রের মতো মনে হচ্ছে সব। খুঁটে খুঁটে দেখা নিয়ে রওনা হলাম এক সারিতে। চারদিক অন্ধকার, তবে বরফের উপর নিজের ছায়া দেখে বেশ অস্বস্তি হচ্ছিল। প্রায় সমতল পথে এগিয়ে যাওয়া। গতকাল এ পথে শেরপারা এসেছিল, বেশ বোঝা গেল। খানিক পর সমতল মিশে গেল প্রায় ৩৫ ডিগ্রির সাথে। ওঠা শুরু করে দিলাম। ধীরে, খুব ধীরে। প্রথমটায় ধাতস্থ হতে সময় লাগছিল, তবে খানিক বাদে বেশ ফিট লাগল নিজেকে। ততক্ষণে পুবাকাশে ফুটে উঠতে শুরু করেছে আলোর আভাস।

ক্রাম্পন লাগাতে বললেন বসন্তদা। তবে গতরাতে হয়ে যাওয়া এভেলাঞ্চে বেশ কিছুটা জায়গার বরফ ধ্বসে যাওয়ায় পথ খানিটা বদলাতে হলো। সামিট ক্যাম্প দেখা তিনটি বড় বড় রক ফেসের পাশ দিয়েই আমাদের পথ। এপর্যায়ে প্রথমটায় আমরা। রোপে টান পড়ল; পিছনে তাকিয়ে দেখলাম, কিছু হয়নি। আবার ওঠা শুরু করলাম, আবার টান পড়ল। ফিরে তাকিয়ে দেখলাম তন্ময় আর সাগর বেশ নীচে একসাথে কথা বলছে। চিৎকার করে জানতে পারলাম, সাগর স্নো গগল্স নিয়ে আসেনি। ভাগ্যিস আমাদের কাছে বাড়তি একটা স্নো গগল্স ছিল!

ক্রমে পুবের আকাশে সূর্যের আভা ফুটে উঠল। নীচে ক্যাম্পটাকে দেখাচ্ছে অনেক ছোট। ওই যে পিঁপড়ার মতো নড়াচড়া করছে কে যেন! আমাদের শেরপা? উপর থেকেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে কারমাজিকে। পথে আমরা আটকে পড়ে আছি; পেমা এগিয়ে যাচ্ছে রোপ ফিক্স করতে। পথটা বেশ খাড়া, ঠিকমতো দাঁড়িয়ে থাকতেও সমস্যা হচ্ছে। দু’পা আগে-পিছে করে ভারসাম্য রক্ষা করেই কথা চালিয়ে যাওয়া — এরপর আর পথ কতটুকু, আমাদের প্রয়োজনীয় রোপ আছে কিনা, আরও কতটা সময় লাগবে। এটা-সেটা আরো কত প্রশ্ন! অর্বাচীনের মতো আরো কত কথা আমার পেটে ঘুরপাক খাচ্ছিল। সময়ই বলে দিল এখানে নিরাপত্তার কথা জিজ্ঞেস করাটা খুবই বেমানান। পর্বতারোহণ হলো সেই খেলা যেখানে পর্বতারোহী নিজেই নিজের বিচারক। তার গৌরব বা পরজয়ের অংশীদার সে নিজেই। আর নিরাপত্তার প্রশ্নটা আরও ভয়ঙ্কর, তাই বলা হয়ে থাকে পর্বতারোহণের সময় তুমি কখনোই মারা যাবে না, কেননা তুমি যে মৃত সেই চিন্তা মাথায় রেখেই তুমি পর্বতারোহণে এসেছ। উল্টাপাল্টা চিন্তা করতে করতে আমরা এগিয়ে যেতে থাকলাম। কর্নেসের উপর দিয়ে স্টেপ কেটে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো রাস্তা নেই। কর্নেস হলো ঝুলে থাকা বরফের দেয়াল। আমাদের বাড়িঘরের জানালায় যে কর্নেস থাকে ব্যাপারটা আসলে সেরকমই।

যতটা দ্রুত উঠতে পারব বলে আশা করা গিয়েছিল রোপ লাগানোর ফলে তার চেয়ে বেশি সময় লাগছিল। সাতজন একসাথে একটা রোপে এগিয়ে যাওয়া। সামিট দেখা যাচ্ছে সামনে। কিন্তু মাঝখানে একটা বড় রীজ। বেশ সরু এবং তারপর বটল নেকের রক ব্যান্ড। সেখান থেকে আরো ৫০ ফুট দূরত্বে — সামিট। রক ব্যান্ডের সামনে যাওয়ার পর আরোহণের কোনো রাস্তাই পাওয়া যাচ্ছিল না। প্রায় ঘণ্টা খানেকের প্রাণান্তকর পরিশ্রমের পর ঐ পথটুকু পেরুলাম আমরা। সামিটে আগেই পৌঁছে গেছে শেরপা ঠেন্ডিব। আমরাও একে একে উঠে এলাম। বাঁধনহার কান্নায় আত্মহারা আমরা সবাই। কে বাংলাদেশী, কে ভারতীয়, কে তিব্বতী — এই শীতের মধ্যেও যে সবাই চোখের জলের লোনা স্বাদ পেলাম তাতে কোনো সন্দেহ নেই। দেশের পতাকা হাতে নেয়ার সময় গর্বে ভয় উবে গেল। এত উঁচুতে আমরা — এত উঁচুতে, যে-উচ্চতায় কেউ জাতীয় পতাকাকে নিয়ে আসেনি। গর্ব তো হবেই! আর এ গর্বের কথা ভাবতে কিংবা বলতে আরো গর্ববোধ হয়! দলগত ছবি ওঠানোর পর আর বেশিক্ষণ থাকার সময় পেলাম না। হঠাৎ করেই চারদিক ঘিরে ফেলল তুষারের সাদা আবরণ। ঘড়ির দিকে তাকালাম; বেলা অনেক হয়েছে। গত কয়েক সপ্তাহের নিয়মানুযায়ী বেলা ১২টার পর থেকেই দমকা হাওয়া বইতে শুরু করে। তুষারপাতের সময় এখন। পড়িমড়ি করে নামতে শুরু করলাম। নামার পথটাও আর শেষই হতে চায় না।

বেলা তখন তিনটা। বিকেলের সোনালি আলোয় টেন্টগুলোকে দারুণ লাগছে দূর থেকে। ওহ! অবশেষে ফিরে এলাম। যদিও এখনও আরো অনেকটা পথ পাড়ি দেয়া বাকি। আজই ফিরতে হবে ক্যাম্প ২-এ। ভারী কাপড় ছেড়ে সামান্য কিছু মুখে দিলাম। টিম বি চলে এসেছে; আজ তারা আরোহণের চেষ্টা চালাবে। আমরা তিনজন আর বিশ্বদেব রওনা হলাম প্রায় সাড়ে চারটার দিকে। ক্যাম্প ১ থেকে রেখে যাওয়া মালগুলো একত্র করে নীচে নেমে আসার সময় বিশ্রীরকমের ঝড়ের মধ্যে পড়লাম। বেশ খানিকটা দেরি হলেও বেস-ক্যাম্পে পৌঁছানোর পর আনন্দে অভিভূত রিপন আর অশোকদাকে জড়িয়ে কান্না চেপে রাখতে পারলাম না। অবশেষে ফিরে এলাম বেস-ক্যাম্পে। দেশে ফেরার তাগাদা অনুভব করলাম। ভরপেট খেয়ে শুয়ে পড়লাম, তলিয়ে গেলাম ঘুমে, স্বপ্ন জুড়ে রইল আমার প্রিয় মাতৃভমি — বাংলাদেশ।

প্রথম পর্ব / দ্বিতীয় পর্ব / তৃতীয় পর্ব
——————–

মুনতাসির

আমি পাহাড়ে চড়ি, সাগরে ডুবি, পৃথিবী আমার প্রেম।

২ comments

  1. ইমতিয়ার - ২৮ জানুয়ারি ২০০৯ (৯:১১ অপরাহ্ণ)

    ভাত আর বাটার, খাবার হিসাবে মন্দ না, অন্তত যাত্রাপথে (আমি অবশ্য কখনও খাইনি। খেতে পারব কি না পরখ করে দেখতে হবে)! এরকম পথে আপনাদের সঙ্গে মুড়ি আর সর্ষের তেলও থাকবে, চিন্তা করিনি। আরও লিখেছেন :

    কে বাংলাদেশী, কে ভারতীয়, কে তিব্বতী — এই শীতের মধ্যেও যে সবাই চোখের জলের লোনা স্বাদ পেলাম তাতে কোনো সন্দেহ নেই। দেশের পতাকা হাতে নেয়ার সময় গর্বে ভয় উবে গেল। এত উঁচুতে আমরা — এত উঁচুতে, যে-উচ্চতায় কেউ জাতীয় পতাকাকে নিয়ে আসেনি।

    মুড়ি আর সর্ষের তেল পর্যন্ত সঙ্গে গেছে দেখেই মনে হচ্ছিল এরকম একটা কিছু ঘটবে। ধন্যবাদ মুনতাসীর। ভালো ঘুম হোক আপনার।

  2. সৈকত আচার্য - ১ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ (১২:৪৭ অপরাহ্ণ)

    “হে দুরন্ত প্রাণ
    লও মোর প্রণতি
    হাজার সালাম।।”

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.