প্রথম পর্ব / দ্বিতীয় পর্ব / তৃতীয় পর্ব
——————–
ঘটনার শুরু বেশ আগেই। ঢাকা শহরে সংখ্যালঘু কিছু মানুষের মাঝে নতুন উন্মাদনার নাম পর্বতারোহন। সম্মকভাবে ব্যাপারটাতে কারও তেমন অভিজ্ঞতা না থাকলেও উৎসাহী মানুষের উপস্থিতি নিছক কম নয়। ২০০৩ সালের একেবারের শেষের দিকে এভারেস্ট নামটাকে কেন্দ্র করে আমাদের অনেক সভা সমিতি হল। সবাইকে জানিয়ে দেয়া হল আমরা মানে বাংলাদেশীরা পাহাড়ে যাওয়া শুরু করেছি।
পাশাপাশি নেপাল কিংবা সমগোত্রীয় অঞ্চলগুলোতে আমাদের পদধূলি পড়তে থাকলো, যার নাম ট্রেকিং। দারুন উপভোগের নতুন অধ্যায়। ট্রেকিং যখন খানিকটা পোক্ত হলো কারও কারও মনে কিংবা মানসিকতায়, অভিযাত্রিক বৈভবকে আরও বাড়িয়ে তোলার জন্যই কিছু সংখ্যক মানুষ যাওয়া শুরু করলেন আরও উঁচুতে। যার নাম পর্বতারোহন। তার প্রেক্ষিতেই ভারতে পর্বতারোহন স্কুলে আমার মত অনেকেই গেছেন সময় সময়ে। এরই প্রভাবে বলিয়ান হয়ে আটকে গেলাম যে নেশায়, কখন কোথায় কোন্ পাহাড়ে যাব? এর সাথে মূখ্য কিংবা গৌন অনেক কিছুই গেল জড়িয়ে। পর্বতারোহন স্কুল এ পাঠ শেষ করে আমার মত অনেকেই আটকে গেলেন হিমালয় পর্বতমালার সর্ববৃহৎ ব্যপ্তি ভারত হিমালয়ের সৌন্দর্যে। মূলত সমগ্র হিমালয়ের বেশির ভাগ ভৌগলিক অবস্থান হলো ভারতে। আর সে কারনেই মনে হয়ে জগৎ বিখ্যাত অনেক পর্বতের অবস্থান এখানে।
২০০৩ এ মৌলিক পর্বতারোহন দীক্ষা শেষ করে যখন সবার মাঝে ব্যাপারটাকে বলা হলো, উৎসাহিত মানুষের অভাব হলো না তাল দেয়ার। কিন্তু কাজের মানুষ কই? মাঝে যাওয়া হলো বেশ, নানা পর্বতের পাদদেশে, কিংবা শৃঙ্গ খোঁজার আশায়। তবে কাংখিত অভিযানের তৃষ্ণা আটকে ছিল অনেক অনেক দিন। জল্পনা কল্পনার শুরু অনেক আগে থেকেই। তবে সময় আর সুযোগের জটিল মিশ্রনটা হলো এবার, ২০০৭ সালে।
আন্তঃ উপমহাদেশীয় দেশগুলোর মধ্যে বিরাজমান শান্তিকে ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে, বাংলাদেশের অভিযাত্রিক সংগঠন কেওক্রাডং বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গ ভারতের নদীয়া জেলার মাউন্টেনার্স এসোসিয়েশান অব কৃষ্ণনগর ” শান্তির জন্য পর্বতারোহন” মূলনীতি নিয়ে রুবাল কাং পর্বতে অভিযানে যৌথ ভাবে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিল। মাস ব্যাপি এই পর্বতারোহন শুরু হয় ১৩ মে ২০০৭ এ পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার জেলা প্রশাসন ভবনে এক অনাড়ম্বর পতাকা বিনিময় অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে।
প্রথা অনুসারে দু’দেশের আরোহী দলের সদস্যদের আনুষ্ঠানিক পরিচিতি এবং দলনেতাদের হাতে পতাকা তুলে দেয়া হয়। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে উক্ত অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন কোলকাতাস্থ বাংলাদেশ হাই কমিশনের মাননীয় ডেপুটি হাই কমিশনার জনাব মোহাম্মদ ইমরান এবং ফার্স্ট সেক্রেটারি। এছাড়াও স্থানীয় প্রশাসনিক কর্মকর্তাগণ অনুষ্টানটিতে উপস্থিত থেকে ১৩ জনের যৌথ দলটিকে সাধুবাদ জানান।
হিমাচল প্রদেশের কুলু হিমালয়ের পার্বতী নদী অঞ্চলেই আমাদের কাঙ্খিত পর্বত রুবাল কাং। সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে প্রায় ২০৩০০ ফুট উঁচু এই পর্বত নিজ গুনে পরিচিত। দলনেতা বসন্ত সিংহ রায় প্রথমে পুরোদলটিকে অভিযান সম্পর্কে ধারণা দেন। আমাদের কার্যপ্রণালী নির্ধারণ করা হয়। পূর্ব নির্ধারিত সময়ে আমরা হাওড়া রেল স্টেশন থেকে চন্ডিগড়গামী ট্রেনে রওনা হলাম। অফিসিয়াল বাধ্যবাধকতার কারনেই আমাদের মানে আমরা যারা বাংলাদেশ থেকে এসেছি তারাসহ অভিযানের দলনেতা বসন্ত সিংহ রায়, লিয়াজো অফিসার দেবাশিষ বিশ্বাস সহ সবাইকে প্রথমে যেতে হলো আই এম এফ (ইন্ডিয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ফাউন্ডেশন) এ। প্রথা অনুযায়ী এই আন্তর্জাতিক পর্বতারোহন অভিযানের অংশগ্রহণকারীদের সাথে সৌজন্য স্বাক্ষাতে মিলিত হন আই এম এফ সেক্রেটারি।
আলাপচারিতা চলাকালে দিপক্ষীয় নানা বিষয়াদি উঠে আসে। তার মাঝে অধূনা বাংলাদেশে পর্বতারোহনের যে সূচনা হয়েছে তাকে কিভাবে স্থায়ী করা যায় এবং একই ভাবে দীর্ঘমেয়াদী কোন পরিকল্পনাকে কিভাবে বাস্তবায়ীত করা যায় সে বিষয়ে যথেষ্ট তথ্য প্রদান করেন। এছাড়া আমাদের নির্ধারিত পর্বত রুবল কাং আরোহনের জন্য প্রয়োজনীয় সব কিছু শেষ করে আমাদের এই দলের সাফল্য কামনা করে প্রায় ৭ মাসের প্রানায়ন্তকর অফিস ঝামেলার সাময়িক ইতি টানলেন এই বলে যে অভিযান শেষ হবার পরে যেন আমরা অবশ্যই তার সাথে দেখা করে যাই। যদিও নিয়মানুসারে আমাদের যেতেই হতো, তবুও তিনি বললেন।
রাজধানী দিল্লীর রাজপথ তখন কেবল খানিকটা শীতল হতে শুরু করেছে। টানা জার্নিতে আমাদের শরীরের অবস্থা ত্রাহি ত্রাহি তার উপর দিল্লীর গরম, আর সেই সাথে খরচা বাঁচানার চাপে আমরা কিলবিল মানুষের ভীড়ে ভরে থাকা পাবলিক বাসে করে চলে এলাম কাশমিরা গেট সংলগ্ন বাস স্টেশনে। কুল্লু যাব। বাস ছাড়বে ৭:৩০ এ। আমরা ছয়জন। তবে একসাথে টিকেট পাওয়া গেলনা। বাসে ঢোকার পর সবার শুধু এটাই মনে হবে, এত বড় দেশে বাস গুলোর সীট এতটাই ছোট হয় কি ভাবে ? ঢাকা শহরে চলাচলকারী যে কোন বাসের জন্য আমার দৈর্ঘ্য, প্রস্থ উচ্চতা আদর্শ হলেও এ বাসে যেন খানিকটা বে সাইজ। তারপর জার্নিটাও ছোট না। ভিতরে কলেজ পড়ুয়া ক্যাম্পাররা আছে, ছেলে মেয়ে একসাথে থাকার জন্যই মনে হয় তাদের মনে স্বাধীনতা প্রকাশের জন্য নিজের গলাটাকেই প্রধান মাধ্যম হিসেবে বেছে নিলেন তারা। আমার পাশের সীটে জানলার পাশে পাগড়ী পরা শিখ ভদ্রলোক বাস ছাড়ার খানিক বাদেই রাতের খাবার সেরে ঘুমানোর এনতেজাম নিয়ে ব্যস্ত। ঠিক পেছনে কোন এক জন যিনি অবশ্যই ব্যবসা করেন এবং প্রচুর পান খান, এক নাগারে বলেই যাচ্ছেন অনেক কথা, কার সাথে জানি না। তার সাথের সীটে তন্ময়, বেচারা কানে গুঁজে দিয়েছে ইয়ার ফোন। সাগর ভাই আর রিপনের বসার জায়গাটাকে পাওয়ার জন্য মনের কোণে যে ইর্ষাটুকু কাজ করছিল তাও উবে গেল তাদের পা রাখার কায়দা রেখে। আশীর্বাদ দিলাম নিজেকে। দলনেতা বসন্তদা আর এল ও (লিয়াজো অফিসার) দেবাশিযের অবস্থাও অনুমেয়। ইঞ্জিনের গরমে আর দুই সীটের ফাঁকে মনে হয় আটকে আছেন পুরো দলের সবচেয়ে লম্বা মানুষ বসন্তদা।
ভাবনা চিন্তা আর বিশ্রামের চেষ্টা করতে করতে ক্লান্ত শরীর থেমে যায় কখন জানি না। মনে মনে সবাই যেন থেমে গেছে। সকাল হবো হবো করছে, হিমাচলের মেঘে ঢাকা রাস্তাগুলোতে লাটিমের মত পাক খেয়ে উঠে আসছে আমাদের বাস। প্রকৃতির মনলোভা সৌন্দর্যে আটকে আছে আমার মত সবাই। খেয়াল করলাম অনেকেই তাকিয়ে আছে বাইরে – বিশাল আকাশ আর প্রকৃতির মাঝে। বেশির ভাগই স্থানীয় দেখেই বোঝা যায়, তাতে কি, অপার সৌন্দর্যের হাতছানি কখনও পুরোনো হবার নয়, এটা বোধ করি তারই প্রমাণ। বাসের কাঁচ ভেদ করে র্তীযক কিরণ এল চোখে, বুঝে গেলাম, গুড মর্নিং এভরি ওয়ান।
প্রাতরাশের সময় আমরা কুল্লু পুলিশ স্টেশানের সামনে। দেখা করতে হবে এবং আই এম এফ থেকে যে কাগজ দিয়েছে তা দিতে হবে পুলিশ সুপারকে। ভদ্রলোক তখনও অফিসে আসেন নি। এই ফাঁকে খেতে গেলাম। আলু পরোটা আর সাথে কিছু একটার ঝোল হবে। গতকাল সন্ধার পর এই প্রথম ঠিকমত খাওয়া, মূলতঃ সময়ের অভাবই এর কারণ।
নিয়ম মাফিক আইটিবিপি (ইন্ডিয়া টিবেত বর্ডার পুলিশ) স্থানীয় অফিসে গেলাম। আসলে পর্বতারোহন কালে আমাদের যদি কখনও কোন সমস্যা হয় তো তাদের ছাড়া এই তল্লাটে আর কাউকে পাওয়া যাবে না, এটাই হলো মোদ্দা কথা। সে হিসেবে আমাদের জন্য যথেষ্টই জরুরী ছিল ব্যাপার। এডজুটেন্ট সাহেব যথেষ্ট অবাক হলেন বিশেষত আমাকে দেখে। বাংলাদেশ, সারা জীবন হয়তো সীমান্ত সংক্রান্ত গোলযোগের কথাই শুনে এসেছেন তিনি, কিন্তু আজ সম্পূর্ন ভিন্ন বিষয়ে সেই আমাদেরই নিরাপত্তার জাল বিছানোর জন্য তার কি আপ্রাণ আগ্রহ। ভাল লাগল। আসলে অসম্ভব ভাল লাগল। অজানা অচেনা মানুষগুলোকে দারুণ আপন মনে হলো। বাড়ি থেকে হাজার মাইল দূরে এই হিমালয় কোলে সত্যিকার অর্থে সাহায্যের প্রয়োজন হলে তা পাওয়া যে কতখানি দূরুহ তা বোঝানো যথেষ্টই কঠিন। যথাসাধ্য চেষ্টাতো তিনি করবেনই এবং উপদেশ দেয়ার জন্য গতবারের আইটিবিপি’র মাউন্ট এভারেস্ট অভিযানের এক সফল আরোহনকারীর সাথে দেখা করিয়ে দিলেন। ভারতের পর্বতারোহনে আইটিবিপির আছে বিশাল অবদান। সরকারী এই প্রতিষ্ঠানের সদস্যরা নানা সময় ভারত সহ নানা দেশের অনেক বিখ্যাত পর্বতারোহন করেছেন।
দুপুরনাগাদ ফিরে এলাম আবার পুলিশ স্টেশনে। পুলিশ সুপার সাহেব সবার মতো দারুন আগ্রহে বাতলে দিলেন তার কাছ থেকে কিভাবে পূর্ণ সহায়তা পেতে পারি। নিজের ব্যক্তিগত ফোন নম্বর দিয়ে দিলেন এবং অভয় দিলেন যে কোন সমস্যায় যেন তাকে ফোন করি। একটা কথাই শুধু মনে হলো, জাতিগত কিংবা রাষ্ট্রীয় বিভেদ গুলো সৃষ্টি হয় শুধুমাত্র কিছু মানুষের জন্য। আর তাদের বেঁধে দেয়া নিয়মে আটকে পড়ি আমরা, না হলে সামান্য সুযোগ থাকলে অপরাপরের প্রতি শ্রদ্ধা কারও কম নয়। ”শান্তির জন্য পর্বতারোহন” আমাদের এই প্রচেষ্টা যেন মাঠ পর্যায়ের বাস্তবতার সত্যিকার প্রতিফলন। নিজের বিশ্বাসটা আরও পোক্ত হয়ে গেল তাদের অকৃপণ ভালবাসায়। পারতেই হবে, আমার কিংবা আমাদের জন্য নয়, বিশ্ব মানচিত্রে ক্ষুদ্রতম দেশের একটি আমাদের এই বাংলাদেশ। সমতল ভু-খন্ডে উচ্চতার ঘাটতি থাকলেও স্বাধীন দেশের লাল সবুজ পতাকাটিকে আরও উঁচুতে নিয়ে যাওয়ার তাড়নায় নিবেদিত হলাম আমরা। দেশের জন্য সম্মান বয়ে আনার দুর্দান্ত এক অভিসন্ধিতে আটকে গেলাম।
এবার বারসেনি-তে যেতে হবে। মনিকরন হয়ে যেতে হবে। বারসেনি থেকেই নেতে হবে গাইড আর মালবাহক। আর এখানে বলে রাখা ভাল মনিকরন বিখ্যাত শিখ ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান হিসেবে। তাই এখানে বিশাল এক জনপদের সৃষ্টি হয়েছে। স্থানীয় এবং প্রচুর বিদেশীদের সমাগম। সামান্যই যাত্রাবিরতি এখানে। নদী তীরের উপাসনালয়গুলো দারুন। ঈশ্বরের ঐশ্বর্য সবখানে, নদীতে, আকাশে, কালচে পাহাড়ের আটকে থাকা বরফের চূড়ায়, সবখানে।
দুপুরের দিকে পৌঁছলাম বারসেনিতে। আগের টিম অপেক্ষায়, জমায়েত হলাম সবাই গাইড চমন সিংয়ের আদি বাড়িতে। বাড়ি বলতে পাথরের দেয়াল আর কাঠের পাটাতনের দ্বিতল নিবাস। পুরোদলের মালামালের হিসেব জানলাম তখন। মেপে দেখা গেল ৭৬০ কেজি। তাই পোর্টারের সংখ্যা গেল বেড়ে। আর এই পরিমান লোড বেস ক্যাম্প পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার গুরু দ্বায়িত্ব এই চমন সিং এর। এই অঞ্চলে তার বিচরণ অনেক আগে থেকেই। অনেক দলের সাথে ছোট বেলায় তার বাবুর্চি হিসেবে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে তার কর্মজীবনের শুরু, এখন তিনি সবচেয়ে অভিজ্ঞ গাইডদের একজন। মিষ্টভাষী সদালপি লজিক্যাল মানুষটার সাথে কথা বলে দারুন লাগল।
বিকালে দোতলার ঝুল বারান্দায় বসে আমাদের সবার সাথে পরিচয় হলে বসে গেলাম পরদিনের পরিকল্পনায়। আমাদের দরকার প্রায় জনা ত্রিশ মালবাহকের কিন্তু ভাগ্যের ফেরে এত জনের হদিস মেলাতে পারলেন না চমনসিং। অগত্যা সেখানে একদিনের বাড়তি থাকা। নিচতলার একটা খুপরি ঘর আর ঝুল বারান্দায় ডালা বিছানা করা হলো। তবে বিকাল থেকে শুরু হওয়া বৃষ্টিটা সবার মাথায়। থামবে তো? সন্ধ্যার খানিক বাদে থেমে গেল। খিচুড়ি খেয়ে প্রথম রাতের থাকার আয়োজনে আমরা ব্যস্ত হয়ে গেলাম। তবে বেশিক্ষন হবে না, তার আগেই বারান্দায় নড়াচড়ার শব্দ পেয়ে বুঝতে বাকি থাকলনা বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। সকালে দেখা গেল বড় এক পলিথিনে মুড়ে শুয়ে আছে প্রায় দশ জন।
সকালটা দারুন। আশপাশ দেখে আমার ডেরায় এসে দেখলাম চমনসিং পরিপাটি হয়ে বসে আছে। বসন্তদার সাথে আমাদের এলও (লিয়াজো অফিসার) দেবাশিষদা। আলোচনা থেকে এটা বের হলো আমাদের মাল বহনের জন্য ঘোড়া নেয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই। প্রতি ঘোড়া নিতে পারে প্রায় ৬০ কেজির মত। পরদিন সকালেই শুরু হবে হাটা। সে অপেক্ষাতেই রাতটা কেটে গেল।
অপ্রয়োজনীয় জিনিস গুলো রেখে বাক্স পেটরা বেঁধে রওনা হলাম ঘোড়ায় মালগুলো চাপানার জন্য। ভোরের আমেজ মাখা সকাল তখনও। মালগুলোকে ভাল করে মেপে নীল রং এর ড্রাম ( প্লাস্টিকের এই ড্রাম গুলো আমাদের খুবই পরিচিত) গুলোতে বেশির ভাগ মালপত্র ভরে ফেলা হলো, আর তার ভর যাতে বেশি না হয় তার দিকে লক্ষ্য রাখা হলো। ড্রামের গায়ে সেটে দেয়া হলো ইন্দো বাংলা মাউন্ট রুবলকাং এক্সপিডিশন ২০০৭। ভরে ওঠা বুকে সব সময়ের স্মৃতিটা আরও উজ্জ্বল হলো। নেপাল কিংবা ভারতে অভিযান কিংবা ট্রেকিংএর সময় বড় অভিযানের দলগুলোর বাক্স পেটরার গায়ে নিজ দেশের নাম দেখে সেই কবে থেকে ঈর্ষা আমার মনে আগলে রেখেছি, তা বলে বোঝানো যাবে না। নিজের দেশের নামটাকে দেখার তীব্র আগ্রহ অনেক দিনের। মোট ১৭টি ঘোড়ায় আমাদের সব কিছু উঠে গেল। অবশ্য নিজ নিজ ব্যাকপ্যাক ভরে মালামাল নিজের কাঁধে।
মূল সড়ক যেখানে শেষ, পার্বতী নদীতে চলছে হাইড্রো ইলেক্ট্রিক প্রজেক্ট। ওয়াই জংশনের মতো নদীর মাথা আটকে দেয়া হচ্ছে। বেশ কয়েক বছর আগে শুরু হয়ে কাজ চলছেই। একারণে স্থানীয় যারা গাইড কিংবা পোর্টারের কাজ করত তারা অনেকেই এখন এই প্রজেক্টের সাথে জড়িয়ে গেছে। আলু পরোটা আর চা সকালের খাবার। মিনিট কুড়ি বাদে কাঠের ব্রীজ দিয়ে নদীটা পার হয়ে পাথুরে রাস্তা শুরু হয়ে গেল। প্রথম দিনের গন্তব্য খিরগঙ্গা। যেতে ৪ থেকে ৫ ঘন্টা লাগবে। ট্রেইলটা যথেষ্ট সুন্দর, হিমালয়ের গতানুগতিক চিত্র বল্লে ভুল হবে না। ডান পাশটা খাড়া নেমে গেছে নিচের দিকে আর বাম পাশ উপরে, মাঝখানে খুব বেশি হলে দু’ফুটের মত চওড়া পায়ে চলা পথ। কংকরময় রাস্তাটা সাপের মত এঁকে বেঁকে এগিয়ে গেছে। বেশ খানিকটা সময় পর হৈচৈ দেখে দাঁড়িয়ে গেলাম। আমাদের একটা ঘোড়া পড়ে গেছে খাদে। আর দার্জিলিং থেকে নিয়ে আসা শেরপা পেমা তারই খোজে প্রায় ২০০ ফুট নিচে। যখন ফিরে এল ঘোড়া ওয়ালার দিকে তাকিয়ে আমাদের কারও বুঝতে বাকি থাকলোনা ঘোড়ার পরিনতি। এতে করে পুরো অভিযানের প্রয়োজনীয় খাবার ডালের বস্তাটা হারিয়ে গেল। এছাড়া বাকি পেটরাগুলোকে পাওয়া গেল।
তের জনের অভিযাত্রিক দল তার সাথে দু’জন কুক, তিন জন শেরপা, এক জন গাইড আর ১৭টা ঘোড়ার সাথে তার মালিক এবং তার সাথে আরও জনা তিনেক মানুষ, এই হলো আমাদের পুরো দল। বেস ক্যাম্প অবধি এ অবস্থাই থাকবে। পাইন আর ফার গাছের সারিগুলো উঁচুতে উঠতে উঠতে আকাশের গায়ে কাছাকাছি প্রায়। উপর থেকে বয়ে চলা টিম টিমে ঝর্না নিচে নেমে সেকি বিশাল জলপ্রপাতের মত ছুটে চলেছে। হিমালয়ের ফুল, লতা, গুল্ম সবই আছে নিজের ঐশ্বর্য নিয়ে। পথিকের পায়ে চলা পথের দু’ধারে অবারিত অনাবিল প্রকৃতি অকৃপণ মনলোভা তার সৌন্দর্যে।
খিরগঙ্গা
সবার হাঁটার গতি এক না হওয়ায় দলের শুরু এবং শেষটা আর দেখা গেলনা। রিপনের জন্য আমাদের খানিকটা দেরি হলো, পুরো অভিযানের ভিডিও ডকুমেন্টারির দায়িত্ব তার উপর। আর তার প্রয়োজনে যখন যাকে সে যে ভাবে যা করতে বলে, মুখ বুঁজে আমরা সবাই তা মেনে নিই। আর এতে বিরক্তির সাথে মাঝে মাঝে যা হয় তা হলো প্রয়োজনীয় সময় হয় নষ্ট। একে তো কিঞ্চিত স্থুলাকৃতির মানুষ তার উপর ক্যামেরার কারসাজিতে আমাদের অবস্থা ত্রাহি ত্রাহি। এক পর্যায়ে এমন অবস্থা হলো যে সে এক পা হাটে তো দু’মিনিট জিরোয়। পাহাড়ে দিন বলতে সূর্য ওঠার পর থেকে দুপুর, ভাগ্য খূব ভাল থাকলে বেলা ২টা। তার পর আবহাওয়া কেমন হবে তা কেউ বলতে পারবে না। সে কারনেই সময়ের ব্যপারটাই মাথায় ছিল বেশি। ১১টার পর থেকে আকাশে মেঘের ঘনঘটা। নদীর ডান পাড় ধরে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা বনের ভিতর দিয়ে। বেশ শীতল একটা ভাব। খুব দ্রুত পা চালাতে পারছিনা রিপন পিছিয়ে পড়বে সে কারণে। প্রমত্তা নদীর চলার আওয়াজ, বাতাসের তোড়ে গাছের পাতায় পাতায় ঘষা খাওয়ার খসখসে আওয়াজ, মাঝে মাঝে পাখির অস্তিত্বের প্রমান দিয়ে কিচিরমিচির – এসবের মধ্যে আমাদের ট্রেক। পানি ফুরিয়ে গেলেও চিন্তা নেই। খানিক বাদে পাওয়া যায় ঝর্না। একপা – দু’পা করতে করতে আমরা যখন খিরগঙ্গার কাছাকাছি পৌঁছুলাম, তখন বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। চারপাশ কালো অন্ধকার হয়ে গেল হঠাৎ করেই। তড়িৎ ভাবটা দেখা গেল সবার মধ্যেই। শেষটা ভালই চড়াই। তাই খুব যে বেশি একটা দ্রুত যাওয়া সম্ভব হলো তা নয়। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির কারণে ছাতা বের করতে হলো। খানিকবাদে চড়াইটা পার হতেই আমাদের তাঁবুগুলো দেখতে পেলাম। শেরপারা আগেই চলে এসেছে। রান্নার জোগাড়ে ব্যস্ত বাবুর্চিরা। আমরা চার জন (আমি, রিপন, সাগর ভাই, তন্ময়) এক টেন্ট এ। আমাদের পাশেই রান্নার ভাঙ্গাচোরা ঘর। বয়ে যাওয়া একটা পানির নালাতে পাইপ বসিয়ে ব্যবহারের জন্য পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে। অবিরাম বৃষ্টি চলে যাচ্ছে। দুপুরের খাওয়া ভাত আর সবজি।
খিরগঙ্গা বিখ্যাত হলো উষ্ণ প্রস্রবনের জন্য। তাই দেশি বিদেশি পর্যটকের ভিড়ে একাকার এলাকাটা। এলাকা বললে ভুল হবে, কেননা বড়জোর ৭০০ থেকে ১০০০ মিটার হবে পুরো সমতল ভূমিটা আর তাতেই গড়ে ওঠা নেপালি কায়দার একচালা হোটেল ও খাওয়ার ব্যবস্থা। তাতে শুধুই বিদেশীদেরই দেখতে পাওয়া যায়। এখানে যারা আসে মূলতঃ হিমাচলের উন্নত মানের চরস আর গাজা সেবনের জন্যই আসে। পার্বতী নদীতীরের এই ভূখন্ডটি এ দুটো জিনিসের জন্য খুবই বিখ্যাত! বিকালে ক্যাম্প এরিয়া থেকে খানিকটা উপরে উঠে এগিয়ে গেলাম উষ্ণ প্রস্রবনের দিকে। সকাল পাঁচটা থেকে সন্ধ্যা ৭ টা পর্যন্ত সময়ের মধ্যে এখানে গোসল করা যায়। মহিলাদের জন্য দেয়াল দিয়ে আলাদা করে দেয়া হয়েছে। নামার আগে পরিস্কার হয়ে নেয়াই নিয়ম। তাই করে আমরা একে একে পানিতে নেমে গেলাম। পড়ন্ত বিকালে হালকা বাতাসে অনাবৃত অংশগুলোতে শীতের চিনচিনে পরশ লাগলেও পানিতে নামার পর বেশ আরাম। ঢাকার রাজপথে শীতের সময় যে ঠেলা কিংবা টং কিংবা আস্তাকুড়ের মত দেখতে দোকানগুলোতে ভাপা পিঠা বিক্রি হয় এবং দূর থেকে দেখলে ভাপা পিঠার উপর যে ভাপ দেখা যায়, খানিকটা দূর থেকে আমাদের গা থেকেও সেরকম ভাপ উঠতে দেখা গেল। গত ক’দিনের ক্লান্তিকর যাত্রা আর প্রথম দিনের ট্রেক, সব মিলিয়ে শরীরের জন্য দারুণ উপকার হলো। হঠাৎ করে উচ্চতাজনিত কারণে খানিকটা মাথা ব্যাথার লক্ষণ দেখা দিলেও এইবার একে বারেই ফিট। কোনও সমস্যা আর নেই!
এখানে সন্ধ্যা নামার সময় শিশির পড়ে না, দমকা হাওয়া বয়। শরীরের প্রতিটি আনাচে কানাচে শীতের চিরুনি আঁচড় কাটার জন্য আঁকুপাঁকু করে। তবে রক্ষা হলো বর্মের মতো কয়েক আস্তর শীতের কাপড়। খাওয়ার পর যে যার মতো তাঁবুতে স্লীপিং ব্যাগে। প্রথমে কিছুটা সময় একটু কষ্ট হয় তবে স্লীপিং ব্যাগ গরম হয়ে গেলে বেশ আরাম। বেশ সকাল সকাল উঠতে হবে তাই দেরি না করে ঘুমানোর চেষ্টায় মত্ত সবাই আমার মতো।
টুন্ডাভুজ
আজকের গন্তব্য টুন্ডাভুজে। খুব ভোরে উঠে গেলাম সবাই, ঘুম ভাঙ্গল কুক জগিন্দরের ডাকে। ঘোড়া গুলোকে একসাথে করার জন্য ছুটোছুটি দেখলাম ঘোড়া ওয়ালার। প্রথমটায় শীষ দেয়, বেয়ারা ঘোড়াগুলো ছাড়া সবাই চলে আসে আর যারা আসে না তাদের পিছনে ছোটা ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই। শুরু করতে করতে প্রায় ৯টা বেজে গেল। কেননা সাতটা তাঁবু গুটানো, মালামালগুলোকে আবার নিয়মমাফিক ঘোড়ার পিঠে বাঁধা, যার যার ব্যাগ প্যাক করে রেডি হতে হতে সময় লেগে গেল।
এবারের ট্রেকটা বেশ ছোট বেশি হলে ঘন্টা দুয়েক লাগার কথা। তাই সবার মাঝেই একটু আলসেমী দেখা গেল। এ ফাঁকে যে যার মত হাঁটার সঙ্গী হয়ে গেছে বুঝে ওঠার আগেই। আমার সাথে ব্রহ্মদা। চল্লিশ ছোঁয়া ভদ্রলোক ফটো উঠানোর কারণেই এই গতিতে চলছে আমার সাথে। বসন্তদা চলে গেছে প্রায় সবার আগে কেননা কোন জায়গায় তাঁবু ফেলতে হবে তা তারই নির্ধারন করতে হবে। তাই ব্রহ্মদার কাছ থেকে জানতে পারলাম – ভুজ নামে একধরনের গাছ আছে এ অঞ্চলে আর তার বাকলগুলো হয় বেশ পাতলা। কোন এক সময় এই গাছের পাতা লেখার কাগজ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। খানিকবাদে পায়ের নিচে কাগজের মত পড়ে থাকা বস্তুটা হাতে তুলে নিয়ে চিনিয়ে দিলেন আর এর খানিক বাদেই দেখিয়ে দিলেন গাছগুলো। খুব বেশি একটা অপরিচিত লাগেনা আকার দেখে, গতানুগতিক গাছের মতই। তবে এ পথে ফুলের বেশ ছড়াছড়ি। আমাদের কারওই নাম জানা নেই। জানা নেই গোত্র পরিচয়। পথ খুবই সুন্দর। উঠানামা থাকলেও পরিবেশের কারণে অসহনীয় হয়ে উঠছে না। যে নদীটাকে আমরা বাম পাশে রেখে এগিয়ে আসছিলাম, তা এখনও বয়ে যাচ্ছ। এখানে নদীর বেদ বেড় বড়। গর্জনের শুনে বোঝা যায় কতদূর তার ক্ষমতা। নদীর একটা পাশের নালা জমে বরফ হয়ে গেছে। সেই দিন প্রথম বরফের উপরে হাঁটার অভিজ্ঞতা হলো আমাদের দলের অনেকের। ৫০ থেকে ৭০ ফিট হবে বেশি হলে।
বারোটার দিকে পৌঁছে গেলাম। বড় একটা নালার উপর কাঠের সাঁকো দিয়ে পার হয়ে তাঁবুতে চলে এলাম। সমতল যে নদীর এমন গর্জন, ক্যাম্প বসে তার খুব একটা শোনা যায় না। এতে উচ্চতার ধারণা করা সম্ভব। তাঁবু এলাকার সামান্য কিছুটা দূরেই এই ভূ-খন্ডের শেষ। প্রায় ৪০০–৫০০ ফিট নিচ দিয়ে বয়ে চলা নদীটাকে নিজেরই অচেনা লাগছে। রোদের তাপে শরীরটা ঝলসে নেয়ার জন্য রোদে বসে মুড়ি খাওয়া হলো। আর দুপুরে ভাত-সবজি।
বিকালে গেলাম হাইট গেইন করতে। সাগর ভাই সবার আগে, তার সাথে আমাদের দলেও (!) কুল্লু থেকে আসা কুকুরটা। সামান্য ঢাল ধরে ধীরে ধীরে উঠে আসছি। এটাকে ঠিক হাইট গেইন বলা যায় না। আমরা বেশি দূর চলে আসলেও বেশি উপরে উঠতে পারিনি। তাই সামন্য সময়ের জন্য বসে কালো হয়ে আসা আকাশ থেকে বৃষ্টি ঝরার আগেই তাঁবুর দিকে দৌড়।
(চলবে)
প্রথম পর্ব / দ্বিতীয় পর্ব / তৃতীয় পর্ব
——————–
Have your say
You must be logged in to post a comment.
৬ comments
নীড় সন্ধানী - ১ ডিসেম্বর ২০০৮ (৬:২৯ পূর্বাহ্ণ)
অসাধারন ভ্রমন কাহিনী। পড়তে পড়তে একেবারে ভেতরে ঢুকে গিয়েছিলাম। পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায়।
hasan_mahmud - ৫ ডিসেম্বর ২০০৮ (২:৫১ পূর্বাহ্ণ)
Mamun,
Carry on – all the bst.
Hasan Mahmud
ইমতিয়ার - ১০ ডিসেম্বর ২০০৮ (২:৩৫ অপরাহ্ণ)
হিংসা করা জায়েজ,- আপনার এই দুর্দান্ত পাহাড়যাপন দেখতে দেখতে এই ফতোয়া দেয়ার ইচ্ছা হচ্ছে।
রায়হান রশিদ - ১০ ডিসেম্বর ২০০৮ (৩:০৭ অপরাহ্ণ)
মুনতাসির এর ফ্যান্টাসী নয়, একেবারে সত্যি সত্যি সদলবলে পাহাড়বিহার! তাও আবার ওঁচা কোন পাহাড় নয়, খোদ হিমালয়।
ফতোয়াটা দিয়েই ফেলুন ইমতিয়ার ভাই, আমিও আছি। এক দৌড়ে গিয়ে অজু করে এসেই সামিল হবো। টুপিটা খুঁজে পেতে একটু সময় লাগতে পারে। কোথায় যে রেখেছিলাম শেষবার ?
-ইতি-
(হিংসায়) সবুজ
মুনতাসির - ১১ ডিসেম্বর ২০০৮ (১২:৪৬ অপরাহ্ণ)
ধন্যবাদ ভাইয়া
হিংসা আছে বলেই এখনও কোথাও আটকে থাকতে পারলাম না। হিংসা হয় যারা ভাল কাজ করে। 🙂 যদিও সেটা রপ্ত করতে পারিনি। চলে আসেন আমাদের দেশের পাহাড় পৃথিবীর কোন পাহাড়েরর কম না। আমার পাহাড় দেখা কম হয়নি।এই কথাটায় আমি নিজের বড়াই নিজেই করলাম।
আসেন না এক বার যাওয়া যাবে। ভাবতে পারেন আপনি সেই সময়টুকুতে সবার উপরে থাকবেন?
রায়হান ভাই, বেশি বললেন 🙂
Pingback: শান্তির খোঁজে পর্বতে : দ্বিতীয় পর্ব | মুক্তাঙ্গন